শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৪

লেখালেখি













লিখি
আর
কেটে ফেলি

লিখি
আর কেটে ফেলি সবুজের গাঢ়
লালের আগুন
ধূসর বেগুনী ঘুম।

লিখি আর কেটে কেটে ফেলি
একটা বারান্দা কাম দুই বেডরুম

একশেল্ফ বই নীল ফুলদানি গ্রে পেইন্টিং
লিখি আর কাটি জুস ব্লেন্ডার ডিমের পুডিং

লিখি নদী
আর কেটে দিই দ্রুত
লিখার আগেই নির্মোহ কেটে ফেলি গ্রাম
লিখতে লিখতে হয় না লেখা কোথাও নিজের নাম।

লিখি আর কাটি
লিখি
আর কেটে ফেলি প্রাক্তন পিপাসা

লিখি আর কাটি
বারবার কাটি
এতবার কাটি তবু
থেকে যায় ভালোবাসা।


১৫.০৪.২০১৪

সোমবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৪

যেভাবে মতি আর মতি থাকে নি

বেতের নামাজে দ্বিতীয়বার সিজদা থেকে উঠতেই মাথায় পানির ফোঁটাটা বুঝতে পারলো মতি।
টপ।
স্বাভাবিকভাবেই সে ওপরের দিকে তাকালো, মসজিদের টিনের চাল পুরনো হয়ে গেছে, টিনের ফুটো গলিয়ে, লম্বা কাঠটাকে ভিজিয়ে ভিজিয়ে পানি জমছে চালায়, সেখান থেকেই ফোটা ফোটা পানি পড়তে শুরু করেছে। ইচ্ছা করলেই মতি সরে যেতে পারে-- আজ মসজিদে তেমন মুসল্লি নেই, শুক্রবার ছাড়া তেমন মুসল্লি হয়ও না তেমন, তার ওপর গত এক সপ্তাহ থেকে লাগাতার বৃষ্টি চলছে, চারিদিকে পানি থইথই, শ্যামপুর গ্রামের একমাত্র যে বাঁধ তা ভাঙতে বসেছে, এই অবস্থায় এশার নামাজে লোকজন আশা করা অন্যায়। গ্রামের লোকজন হয় বাঁধের কাছে না হয় নিজের ঘর মেরামতে।
মতি মুয়াজ্জিন, তাকে মসজিদে আসতেই হবে; ইমাম সাহেবের বাতের ব্যথাটা বেড়েছে, তিনি নামাজ কাজা করেছেন; এছাড়া এসেছে রহমতুল্লাহ। রহমতুল্লাহ একটু পাগলা কিসিমের আছে; কোনো কোনো দিন পাঁচ ওয়াক্তই নামাজ পড়ে আবার হঠাৎ হঠাৎ আর আসে না। মতি রহমতুল্লাহর দিকে তাকালো। রহমতুল্লাহ দীর্ঘক্ষণ সিজদায় আছে-- বোধহয় ঘুমিয়ে গেছে। মতি একটু সরে দাঁড়ালো।

আজ বৃহস্পতিবার। এই বারটা মতির জন্য একটু বিশেষ। এই রাতে মতি ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের বাড়িতে দাওয়াত খায়। মুয়াজ্জিনি করে মতি মাস শেষে আশি টাকা পায়। তাতে তার নুন আনতে পানতা ফুরায়। তার সাথে যোগ হয়েছে বউয়ের অসুস্থতা। পেটের ব্যথায় বউটা দিনের বেশির ভাগ সময়ই শুয়ে থাকে। ডাক্তার কবিরাজ সবাই হাল ছেড়ে বলেছে শহরে নিতে-- কিন্তু শহরে নেয়ার সামর্থ মতি মুয়াজ্জিনের নাই।

নামাজ শেষ করে দোয়ায় বসে মতি। এই দোয়া সে ইমাম এনায়েতুল্লাহ কাছে শিখেছে। আরবী উর্দু আর বাংলা মিশিয়ে এই দোয়ায় বিশ্বব্যাপী কাফেরদের ধ্বংস করতে বলা হয়েছে। মানির মান রাখতে বলা হয়েছে। মতির খুব ইচ্ছা করে আল্লার কাছে তার নিজের গলাটা মধুর করে দিতে বলতে। মতি মুয়াজ্জিন হওয়া সত্বেও তার কণ্ঠ খুবই কর্কশ। চেয়ারম্যান বলে, আমি ইহজনমে তুমার মতো খারাপ গলার মুয়াজ্জিন দেখি নাই। তুমি মাইকে ফু দিলে কাক-পক্ষী পর্যন্ত ট্যার পাইয়া উইড়া যায়।
মতি তখন চুপ থাকে। সামনে বৃহস্পতিবার রাতের খাওয়া, গরুর মাংসের খুশবু, মতির মন আনচান করে, কিন্তু চেয়ারম্যান খেতে না বললে খাওয়া যায় না। আর চেয়ারম্যানও বয়ান বন্ধ করে না।
চেয়ারম্যান বলে, তুমি যষ্টিমধু খাইয়ে দেখতে পারো মিয়া। প্রত্যেক সক্কালে রসটা খাইও... মুখে ঝাল ঝাল ঠেকে... ভালোই লাগে।
মতি প্রত্যেক সকালে যষ্টিমধুর রস খাচ্ছে। ঝাল ঝাল ঠেকে না, ভালোও লাগে না, তবু খেয়ে যাচ্ছে।

মতির দোয়াটা দীর্ঘ করতে চায়। কিন্তু শেখা দোয়ার বাইরে সে কিছুই বলতে পারে না। দুই করতাল মুখের ওপর নিয়ে, হাত দুটোতে প্রবল শব্দে চুমু খেতে খেতে মতি দোয়া শেষ করে।


২.
চেয়ারম্যানের বাড়ির দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মতি একটু কাশে। স্বাধারণত এই কাশির শব্দেই দরজা খুলে যায়। আজ খুলছে না।
মতি আবার কাশে। দরজা খোলে না।
ইমাম সাহেব আসলে ভালো হতো। তিনি এরকম পরিস্থিতিতে হামদনাত গাওয়া শুরু করে দিতে পারেন। মতিও কয়েকটা হামদনাত জানে, কিন্তু গাইতে ভরসা হয় না।

এদিক ওদিক তাকিয়ে মতি কী করবে বুঝতে পারে না। দরজার কড়ার দিকে বেশ কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কড়া দুটোকে তার আলিবাবা চল্লিশ চোরের খাজানার চাবি মনে হয়।

হঠাৎই দরজা খুলে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় মতি একটু ভয়ই পায়। দেখে দরজা ধরে হারিকেন নিয়ে চেয়ারম্যান দাঁড়িয়ে আছে। চেয়ারম্যানের আরেক হাতে বেশ বড় সড় একটা লাঠি।
মতিকে দেখেই চেয়ারম্যানের ভ্রু কুচকে যায়। বলে, ও তুমি!
মতি দীর্ঘ সালাম দেয় চেয়ারম্যানকে। চেয়ারম্যান উত্তর দেয় বলে মনে হয় না। শুধু মনে মনে কী যেন বিড়বিড় করে। মতি আগ্রহী চোখে চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়ে থাকে। চেয়ারম্যান বলে, বালামুসিবতের রাইত। আমরা সব্বাই খাইয়া দাইয়া শুইয়া পড়ছি...

মতির পেটটা মোচড় দিয়ে ওঠে, বোধহয় বুকটাও। অথচ মুখে কেমন একটা ফ্যা ফ্যা হাসি ধরে রাখতে হয় তাকে। বলে, আলহামদুলিল্লা। বালামুসিবত সবই তাঁর হাতে। তিনিই তরাইবেন।
এইগুলো ইমাম সাহেবের কথা, মতি তার সাথে থেকে থেকে এসব শিখেছে। চেয়ারম্যান বলে, আইচ্ছা। আইজ আসর ওয়াক্তে তোমার তো গলা শুনি নাই। আজান দিছিলা?

জ্বি, আজান তো দিছি।

তাইলে? কেমনে আজান দিলা যে শুনলামই না।

মসজিদের ব্যাটারিটা ডাউন হইয়া গেছে, মাইকটাও ভালো নাই।

শুনো, হযরত বেলাল যখন আজান দিতো তখন কি মাইক ছিল?

জি না, ছিলো না।

কিন্তু তাঁর ছিলো গলা। তিনি আজান দিলে আকাশ বাতাস এক হইয়া যাইতো।

একে অন্ধকার রাত, তার ওপর বৃষ্টি আর বাতাস-- সঙ্গে পেটের খিদা সব মিলিয়ে মতির সব অসহ্য লাগছিলো; এরই মধ্যে জেনেছে আজ খাবার পাওয়ার সম্ভাবনা নাই, ফলে মতির আর দাঁড়িয়ে থাকার মতো উদ্যম ছিলো না। মতি বলে, চেয়ারম্যান সাব, তাইলে আমি আসি।

চেয়ারম্যান মাথা নাড়িয়ে দরজা লাগাতে উদ্যত হয়; তখন ভেতর থেকে ভাবীসাব, মানে চেয়ারম্যানের বড় পক্ষের স্ত্রী চেয়ারম্যানকে ডাক দেয়। মতি দেখে চেয়ার ম্যান একটা তিনবাটির টিফিন ক্যারিয়ার হাতে ফিরছে। মতির পেট গুরগুর করে ওঠে, চোখে আলগা ঝিলিক দেখা দেয়।

ফিরে এসে চেয়ারম্যান বলে, তুমার কপালটা মিয়া ভালো। সাদ্দামের মা তুমার আর তুমার বউয়ের কথা মনে কইরা এই খাবার তুইলা রাখছে। নেও।

মতির মাথা কৃতজ্ঞতায় ঝুঁকে যায়। অনেক কথায় যেন বলতে চায়। কিন্তু ফিসফিস করে শুধু 'সুভানাল্লা সুভানাল্লা' বেরোতে থাকে।


৩.
চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে মতির বাড়িটা  দূর আছে। দুর্যোগের রাত। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। এই বৃষ্টি কবে শুরু হয়েছিল গ্রামের মানুষ প্রায় ভুলতে বসেছে। গ্রামের অর্ধেক লোক চলে গেছে বাঁধ পাহারা দিতে। বাঁধটা মতির ঘরের বেশি দূরে না। যদি বাঁধ ভাঙে, আর পানির ঢল গ্রামে ঢোকে, প্রথম যে ঘরটা উড়ে যাবে সেইটা মতির।

কিন্তু মতির এখন সেসব চিন্তা নেই। টিফিন ক্যারিয়ার থেকে পোলাওয়ের জবরদস্ত ঘ্রাণ আসছে, মতির জিভে পানি চলে আসার দশা। একহাতে টিফিন ক্যারিয়ার আর আরেক হাতে টিমটিম করে জ্বলে থাকা হারিকেন নিয়ে মতি মোটামুটি ছুটছে। বাড়িতে পৌঁছেই বউকে নিয়ে সে খেতে বসবে। দুপুরে, বউ আর তার, কারোরই, ভাত জোটে নি। গুড় দিয়ে দুজনেই দুইমুঠ মুড়ি খেয়েছিল।

তালতলার যে পুকুর, সেখানে এসে পেশাব পেলো মতির। খুবই স্বাভাবিক। খিদে ঠেকাতে এতো পানি মতি খায় যে কিছুক্ষণ পর পরই প্রকৃতির এই ডাক আসে তার। আর এর সঙ্গে চলছে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আবহাওয়া। মতি টিফিন ক্যারিয়ারটা একটা ছোট খেজুর গাছের ডালে আটকে হারিকেন নিয়ে এগিয়ে যায়। একটা তালগাছের গোরায় লুঙ্গিটা হাঁটু অবদি গুটিয়ে, পা-টা ছড়িয়ে পেশাব করতে বসে যায়। বসার পরই বুঝতে পারে ভুল হয়ে গেছে। কারণ আশে পাশে কোনো কুলুব নেই। বৃষ্টিতে সব ঢেলা ভেজা। পেশাব করতে করতেই মতি আশে পাশে কুলুবের সন্ধান করতে থাকে।

একটু দূরে, একটু চকচকে একটা পাথরের মতো কিছু একটা দেখতে পায় মতি। পেশাব শেষ করে, বসে বসেই বিশেষ কসরতে, মতি এগিয়ে যায় ওই পাথরটার দিকে। তারপর বাম হাত দিয়ে ওটা উঠিয়ে কুলুব নেয়। ঘষে। এক দুই তিন।

ভস করে আওয়াজ হয়। মতির দুপায়ের মাঝ থেকে গলগল করে ধোঁয়া বেরোতে থাকে। মতি তীব্র আতঙ্কে পাথরটা দূরে ছুঁড়ে পিছিয়ে পড়েই যায়।

পাথরটা থেকে ধোয়া বেরোনো থামে না, এরমধ্যেই কাশির আওয়াজ পাওয়া যায়। চোখ মুখ ভ্রু কুচকে ওই ধোয়ার মধ্য থেকে একটা অতিকায় শরীরের জিন বেরিয়ে আসতে থাকে।

মতি বিস্ফোরিত চোখে জিনটার দিকে তাকিয়ে থাকে। জিনটা অর্ধেকমতো বেরিয়ে মতির মাথা দোলায়। বলে, হুকুম করুন প্রভু।


(ক্রমশ)