শুক্রবার, ৬ জুন, ২০১৪

আবু নাসিম বা লখিন্দর কোনোটিই তার নাম ছিল না... (দুই)


দুই.
এই ফাঁকে একবার রঞ্জনার কথাও বলা দরকার। না বললে, আমরা যারা লখিন্দরের ওই বারান্দায়, তার কণ্ঠ শুনতে উৎকর্ণ তাদের কিছুটা অসুবিধা হয়। রঞ্জনাকেও আমরা আবিষ্কার করি ওই এফডিসিতে। লখিন্দরেরও আগে। ডিরেক্টর লতিফ সাঁইয়ের হাত ধরে 'প্রেম-পীরিতি' ছবিতে তাকে প্রথম দেখা যায়। রঞ্জনার বয়স তখন মাত্র সতের। প্রথম ফিল্মটা তার ফ্লপ, দ্বিতীয়টাও ফ্লপ, তৃতীয়টাও ফ্লপ, এবং এভাবে ক্রমাগত আটটি ফ্লপের পর রঞ্জনার নবম সিনেমাটি হিট হয়। সিনেমার নাম 'আকাশ কেন নীল'। সুইট প্রেমের গল্প। আছাড়ি বিছাড়ি প্রেম। আর এই সিনেমার নায়ক সুপার ডুপার হিট মেগাস্টার আমান খান। আমান খান তখন তার খ্যাতির চূড়ায়, রঞ্জনা যেন তাকে পেয়ে সিনেমা সমুদ্রে টাইটানিক পেয়েছিল। এই টাইটানিক ডুবেছিল যে-বরফের টুকরায় তা কি লখিন্দর?
অনেকে তেমন বলে, কিন্তু আমরা ঠিক ঠাওর করতে পারি না। আমরা শুধু জানতে পারি, আকাশ কেন নীল ফিল্ম দিয়ে রঞ্জনার পায়ের নিচে যেমন মাটি হয় তেমনি মাথার ওপর ছাদও হয়। নিকেতনে। আর সেই ছাদের তলায় প্রায়শ পাওয়া যায় আমান খানকে। তখন রঞ্জনার বয়স একুশ। যদিও সে নিজেকে আঠারো বলেই পরিচয় দিতো। আর এর পাক্কা চার বছর পর, একটা ঈদের ফিল্ম, 'মনও না চায় সজনী', করতে গিয়ে লখিন্দরের সাথে পরিচয় রঞ্জনার। এই সময়টুকুর মধ্যে পার্থক্য শুধু এইটুকু হয়েছিল যে রঞ্জনা নিকেতন থেকে উত্তরায় শিফট হয়ে গিয়েছিল। আর আমান খানের লাল একটা গাড়ি সেই ফ্ল্যাটের গ্যারেজে ফিক্সড হয়ে গিয়েছিল। আর তখন, চট্টগ্রামের সমুদ্রে হঠাৎ একটা ঝড় উঠেছিল। একটা ছোট্ট জলোচ্ছ্বাস। যাতে ভেসে যেতে চাইলেও কেবল লখিন্দরের সাঁতারের জোরে বেঁচে ফিরেছিল রঞ্জনা। অথচ লখিন্দর কোনোদিনও আর জানতে চায় নি, রঞ্জনা কেন একা একা ওই দুর্যোগের মধ্যে সমুদ্রের দিকে গিয়েছিল! আর রঞ্জনাও বলে নি যে আসলে একা যায় নি। তার ভেতরে প্রথিত ছিল আরো একটি জীবন। যে জীবনটাকে পরে লখিন্দর নিজের পরিচয়ই দিতে চেয়েছিল।
আমান খানের থেকে লখিন্দরের এইখানেই একটা পার্থক্য ছিল। লখিন্দর তার ক্যারিয়ার নিয়ে কখনো পরোয়া করে নি। অথচ, পরোয়া না করার পরও, লখিন্দরের একচোখা ঈশ্বরের কৃপায় হোক অথবা নিতান্ত ভাগ্যের জোরেই হোক, লখিন্দরের পায়ের নিচে এসে লুটিয়ে পড়েছিল সিনেমার সবটুকু। যেভাবে একদিন লুটিয়ে পড়েছিল রঞ্জনাও। আর এই দুটোর কোনোটাই আমান খান সহ্য করতে পারে নি। আমান খান ভেবেছিল গেঁয়োভূত লখিন্দর একটা চুটকিতেই হারিয়ে যাবে। কিন্তু অনেকের মতো আমান খানও ভাবতে পারে নি আমানের যা কিছু খ্যাতি, যা কিছু অর্জন এমনকি রঞ্জনাও একদিন লখিন্দরের মুঠিতে চলে আসবে!
আমরা এখন যখন আমান খানকে খুঁজি তখন নয়তলার ওই বারান্দায় আধশোয়া লখিন্দরের প্রলম্বিত ছায়াই দেখতে পাই। এখন এমন বিভ্রম হয় যেন ওখানে অনেক দিন আগের আমান খানই শুয়ে আছে।
তবে এসব অলঙ্করণে আমাদের পিপাসা দূর হয় না। আমরা দ্রুত রঞ্জনা, আর বিশেষত লখিন্দরের কাছে ফেরত যেতে চাই। কারণ আমরা জেনেছি লখিন্দরের নয়তলার ওপরে, পানির ট্যাঙ্কের ভেতরে বস্তাবন্দী অবস্থায় রঞ্জনাকে পাওয়া গেছে। এই রঞ্জনা এখানে কীভাবে এল জানতে চাইলে আমাদের বোধহয় আরো একবার লখিন্দরের সূত্র ধরে ফিরে যেতে হবে এফডিসিতে, আর বাংলা সিনেমার এক অভাবনীয় স্বর্ণযুগে। আর সেদিকটাতে তাকালে দেখতে পাই লখিন্দর এফডিসির ক্যান্টিনে বা গাছতলার একটা বেঞ্চে বসে আছে।
'
লখিন্দর' ফিল্ম রিলিজের পর, এমনকি ওরকম মার মার কাট কাট হিটের পরও, নয় মাস লখিন্দরের হাতে কোনো কাজ ছিল না। এটা এখন অবিশ্বাস্যই মনে হয়, যে আমাদের এই সময়ের সবচেয়ে ব্যস্ত নায়কও একসময় এফডিসির ক্যান্টিনে বসে ধারের সিঙারা খেয়েছে। অথচ তার আগে সে একটা হিট ফিল্ম প্রসবও করেছে। তবে, এ সময়ের মধ্যে, লখিন্দর কি একেবারেই কাজহীন ছিল? তা বলা যায় না। বরং বলা ভালো লখিন্দর মনের মতো কাজ পাচ্ছিল না। এরমধ্যেই তার কাছে বেশ কিছু ফিল্মের অফার আসছিল, কিন্তু তার সবই ছিলো সেকেন্ড লিডের। সেকেন্ড লিড মানে সেকেন্ড হিরো। লখিন্দর সেকেন্ড হিরো হতে চায় নি। কারণ ওইসব সিনেমার বেশিরভাগের লিড হিরো ছিলো আমান খান।
আমান খান ওই চল্লিশেও ছিলো সর্বগ্রাসী হিরো। সে কোনো একটা ফিল্মে থাকলে অন্য কোনো হিরো দূরে থাক, হিরোইনকে পর্যন্ত দেখা যেতো না! লখিন্দর আমান খানকে শ্রদ্ধা তো করতোই কিন্তু তারচেয়ে বেশি ভয় পেতো। আমান খানের ক্যারিয়ারটা লখিন্দরের কাছে ছিলো ঈর্ষণীয়। আর আমান খানের ছিলো স্টাইল! হ্যাট আর সানগ্লাশ। অনেকটা ওয়েস্টার্ন নায়কের মতো। চোখ ধাঁধিয়ে যেতো দেখে। লম্বা কলারের শার্ট, মাথায় ক্যারিবীয় হ্যাট আর দামী সানগ্লাশ মিলিয়ে আমান খান যখন তার দামী লাল গাড়িটা থেকে নামতো, নেমে তার ট্রেডমার্ক হাসিটা দিতো, এমনকি এফডিসিতেও হুলুস্থুল পড়ে যেতো। ডিরেক্টর থেকে শুরু করে স্পটবয় পর্যন্ত উত্তেজনায় কাঁপতো। আর উৎসুক জনতা, ভক্তরা তো ছিলোই। আমান খানকে দেখার জন্য, একটু ছোঁয়ার জন্য তাদের ভেতর নিত্য মারপিট হতো। আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা এফডিসির গেটে তারা অপেক্ষা করতো।
একবার এক মধ্যবয়সিনী নাকি রক্ত দিয়ে আমান খানকে চিঠি লিখে হাসপাতালে ভর্তি ছিলো দীর্ঘদিন। এটা ছিলো ঢাকা থেকে অনেক দূরের একটা মফস্বলে; আর কী আশ্চর্য আমান খান ছুটে গিয়েছিল তার কাছে। ওই মধ্যবয়সিনী নাকি চর্মচোখে আমান খানকে দেখেই দ্বিতীয়বারের মতো জ্ঞান হারিয়েছিল। তারপর সাতদিন অনর্গল কথা বলে চলেছিল। হাসপাতালে। এমনকি বাড়িতে এসেও। তার ঘরভর্তি ছিল নাকি শুধু আমান খানের পোস্টার। আর প্রতিটা পোস্টারে ছিল একাধিক লিপিস্টকের দাগ।
প্রোডাকশন বয়ের হাত থেকে নেয়া ফেটে যাওয়া দুধের ঘন চা খেতে খেতে লখিন্দরের এসব গল্প শুনতে হতো। কখনো ভালো লাগতো, কখনো বিমর্ষবোধ করতো। শুনতে শুনতে লখিন্দরও কল্পনায় নিজেকে হ্যাট সানগ্লাশ আর লাল গাড়িতে দেখতো। রঞ্জনাকে দেখতো কিনা তা জানার নাগাল আমরা অবশ্য পাই না। মানুষের ভেতরে, খুব বেশি ভেতরে ঢোকার আমাদের অধিকার থাকে না। কিন্তু রঞ্জনার ব্যাপারে খুব আলগা কোনো ভাবনা কখনোই আমরা লখিন্দরের ভেতরে লক্ষ্য করি না। না অতীতে, না বর্তমানে... এমনকি ভবিষ্যতেও তেমন একটা দেখবো বলে আশা করতে পারি না। অথচ এমনটা হলে দর্শকশ্রোতা হিশেবে আমাদের ভালোই লাগতো। আমাদের মনো হতো একটা জমাটি প্রেমের গল্পের ভেতর আমরা ঢুকে যেতে পারছি। কিন্তু আসলে ফিল্মে যেমন-যতোটা মানুষের প্রেম থাকে তেমন-ততোটা প্রেম তো আর সত্যিকারের জীবনে থাকে না। আর থাকে না বলেই পর্দা রূপালী হয়ে যায়। মনে হয় এই তো দারুণ জীবন। একটা ছুনছুনে মজা আর খনখনে আফসোস বেশ হতে থাকে। আর ওই আফসোসের দৌলতেই আমরা আবার টিকিট কাটি, একই ফিল্ম বারবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখি!
লখিন্দর অবশ্য তখনো এতসব বোঝে না। আর আমাদের মনে হতে পারে লখিন্দর বোধহয় পরেও কখনো এসব বোঝে নি। সে শুধু কল্পনা করতে পারতো একটা লালগাড়িতে হ্যাট আর সানগ্লাশ চাপিয়ে সে ছুটে যাচ্ছে মফস্বলে। কোনো এক সরু নদীর ধারে। ওই সরু নদীর ওপর, একটা একতলা বাড়ি, ওপরে টিন, দেয়ালগুলো দালানের; সেই দালানের ভেতর একটা রূপসী তার কথা ভেবে ভেবে চোখের পানি ফেলছে আর এমনকি ওই মধবয়সিনীর মতো আঙুল কেটে আঙুলকে কলম বানাচ্ছে। সাদা পাতায় বড় বড় করে তার নাম লিখছে... লখিন্দর!

লখিন্দর?
কিন্তু লখিন্দর কি তার নাম?
না।
তার নাম কি তাহলে আবু নাসিম?
ধুর! এমন অফিল্মি নাম কেউ ফিল্মে রাখে?
কিন্তু ওই যে রূপসী সে তাহলে কী নাম লিখবে সাদা কাগজে... রক্ত দিয়ে? তার পিতৃপ্রদত্ত নাম?
লখিন্দর ভাবে কিছুক্ষণ, তারপর আর ভাবতে পারে না। অথবা ভাবতে চায় না। অনেকেই তাকে তখন লখিন্দর নামেই ডাকতে শুরু করেছে। লখিন্দর তাতে আর বাধা দেয় না। কারণ আবু নাসিম নামটা তার কখনোই বলার মতো মনে হয় নি। কিন্তু নাম একটা জবরদস্ত আমান খান। নামের ওপরেই কি হিট ফ্লপ নির্ভর করে?
আমান খান। তার আগের নাম কী ছিল কে জানে? অন্তত লখিন্দর জানে না।
সে শুধু ভাবে আমান খান নামটাকে। আর ভাবে আমান খানের হিট প্রসবের কথা। আমান খানের লাস্ট বারোটা ছবি ছিলো হিট। এরকম একের পর এক হিট, সুপার ডুপার হিট, ব্লকব্লাস্টার হিট, ইন্ড্রাস্ট্রিতে আর কেউ দেয় নি। ভবিষ্যতেও যে কেউ দিতে পারবে না এ ব্যাপারে সকলেই নিশ্চিত। আমার খান তাই ইন্ড্রাস্ট্রির দেবতা হয়ে উঠেছে তখন। একেক ঈদে তার নিজেরই ছবি আসছে দুইটা তিনটা করে। অন্য ছবিগুলো মার খাচ্ছে পটাপট!

আর এরকম সময়ে লখিন্দর নিয়ে এল এক সলো। মানে লখিন্দর নিয়ে এল বলা ভুল, বরং বলা যায় লখিন্দরকে আবার নিয়ে এল পাদপ্রদীপে। ওই আমান খানের যুগে। যা এখন ভাবলে শরীরে কাঁটা দেয়। শিহরণ আসে মনে। মন বলে, আসলে কোনো কিছুই তো স্থায়ী না... এই অ-স্থায়ীর ভেতর মানুষ হারিয়ে ফেলে, মানুষ পেয়ে যায়। আমাদের লখিন্দর পেয়ে গিয়েছিল। আর আমান খান কি হারিয়ে ফেলেছিল? বলা মুস্কিল। বলা কঠিন!

আমান খানের ট্র্যাডিশনাল প্রেমের ছবির বিপরীতে সেবারের ঈদে মুক্তি পেলো লখিন্দরের ছবি। এর কোনো তুলনাই হয় না। আমান খানের ছবি মেগাস্টার হাইবাজেট, ইন্ডিয়ায় তিনটা গানের শুট করা আর সবচেয়ে বড় কথা আমান খান আর রঞ্জনা জুটি যেখানে উপস্থিত, সেখানে লখিন্দরের সিনেমার অবস্থা দুর্দশাময়... এক লখিন্দর আরেক বান্দর ছাড়া ফিল্মে তেমন কিছুই নেই। সিনেমার নাম 'দুধ ভাই'। ফিল্মের গল্পও উদ্ভট। ফিল্মে পাকচক্রে লখিন্দর আর বাঁদর এক মায়ের দুধ খেয়ে বড় হয়। ফলে তারা দুধভাই। এই দুই দুধভাইয়ের মিলন-বিচ্ছেদ-মিলনই সিনেমার উপজীব্য। এমন কাহিনির ফিল্ম লখিন্দর করতোই না কখনো, কিন্তু তার খুব হাত টান যাচ্ছিল, চারদিকে ঋণের বোঝা পাহাড় হয়ে যাচ্ছিল, ফলে ওস্তাদ কেরামতালি যখন তাকে রোলটা অফার করলো সে আর না বলতে পারলো না। ওস্তাদ কেরামতালির কারবারই এই রকমের। এর আগে সে দুইটা সিনেমা বানিয়েছিল, একটা ছিল সাপের আর অন্যটা ছিল ঘোড়ার গল্প। মানুষের তার সিনেমায় তেমন কিছু করার থাকে না। কিন্তু, তবু, সেটে, কেরামতালি লখিন্দরকে একটা সিনের ব্যাপারে বলেছিল এই সিনটা যদি ঠিকঠাক দেওন যায় তাইলে পাবলিক ঘরে বইসা থাকবো না। হামলায়ে এই ফিল্মের টিকেট কাটবো!
লখিন্দর বিশ্বাস করেছিল কেরামতালিকে। না করে তার কীইবা করার ছিল। ফলে নদীর ধারে, যখন তারা সিনটা শুট করছিল, সিনটা ছিল এই রকম দৌড়াতে দৌড়াতে সে ছুটে যাবে ট্রেনিং দেওয়া বাঁদরটার দিকে আর তাকে জড়িয়ে ধরবে, আর ধরার পর বুঝবে বাঁদরের পিঠে আসলে ছয় ছয়টা গুলির আঘাত, তখন তাকে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে হবে... এমন ভাবে, যেন পর্দার ওইপাড়ে যারা থাকবে তারাও ডুকরে উঠতে বাধ্য হয়। আর তারপর অনেক লাউড মিউজিক হবে আর লখিন্দর তার দুধভাইয়ের মৃত শরীরটা ছুঁয়ে প্রতিশোধের কসম খাবে। আর কসমটা এমনভাবে খাবে যেন পর্দার ওইপাশের মানুষগুলোর চোয়ালও শক্ত হয়ে যায়, মুঠি বন্ধ হয়ে আসে!

কঠিন সিন, বলাই বাহুল্য!
তবে, লখিন্দর উতরে যায়। বা আসলে বলা ভালো লখিন্দর ফাটিয়ে দেয়। আমরা তো এটা জানি যে লখিন্দর আসলে ভালো অভিনয়টা পারতো। মেলোড্রামা যেমন পারতো তেমনি তারমধ্যে সংযত অভিনয়ের গুণটাও ছিল। সিনের পর ওস্তাত কেরামতালি ছুটে এসে লখিন্দরকে জড়িয়ে ধরেছিল। পিঠ চাপড়ে দিয়েছিল, একশ টাকা বকশিস দিয়েছিল। আর সবাইকে দেখিয়ে বলেছিল, দেখে নে... এই যে আমাগো নিউ স্টার। মেগাস্টার!

ওস্তাদের কথা ফলে গিয়েছিল। লখিন্দর মেগাস্টারই হয়ে গিয়েছিল। আর মেগাস্টার হওয়ার জন্য যে প্রথম ধাপ সেটা সে রেখেছিল ওই দুধভাই ফিল্মের মাধ্যমেই। ঈদে, আমান খানের বিগবাজেট ফিল্মের বিপরীতে, সিনেমাটা ব্যবসা করলো এমনভাবে যে বাজিমাত। টানা তিনমাস হল থেকে নামলো না দুধভাই। চোখ মুছতে মুছতে মানুষজন হলে ঢোকে আর চোখ মুছতে মুছতে বেরোয়। টানা বারোটা হিট দেওয়ার পর আমান খানের প্রথম একটা সিনেমা ফ্লপ হলো আর হিট সুপার হিট হয়ে গেল লখিন্দরের দুধভাই।

আর ওই প্রথম লখিন্দর একটা ভয়ের স্বপ্ন দেখলো গভীর রাতে। দেখল আমান খান তার পেটের মধ্যে একটা ভোজালি ঢুকিয়ে দিচ্ছে ঠিক ফিল্মি সিনের মতো। তবে, এই ভোজালিটা আসল আর তার পেট থেকে গলগল করে বের হয়ে আসা রক্তটা আসল। আর সে যে মরে যাচ্ছে ওই মরে যাওয়াটা আসল।

ঘুম ভেঙে গেলে লখিন্দরের মনে হতে থাকে সত্যিই তার মৃত্যুটা খুব এগিয়ে এসেছে। মনে হতে থাকে যে কোনো দিন। আর ওই অবস্থায় টেলিফোন বেজে ওঠে। তীব্রস্বরে। তার মনে হতে থাকে এই গভীর রাতে নিশ্চয় মৃত্যুর পরোয়ানাই এসেছে তার কাছে। ফোন ধরলে হয়তো ওইপ্রান্ত থেকে একচোখা ঈশ্বরের কোনো প্রতিনিধি তাকে টেনে নিয়ে যাবে দূরে কোথাও, কোনো গহীন খাদে, অথবা অতল জলের ভেতর। লখিন্দরের ঘাম হতে থাকে। হাতের তালু ভিজে ওঠে। আর ভেজা তালু নিয়ে, তবুও, লখিন্দর ফোনটা তোলে। এবং শুষ্ক কণ্ঠে বলে, হ্যালো...

আমরা পরে জানতে পারি এই ফোনটা আসলে মৃত্যুর পরোয়ানা ছিল না, ফোনটা ছিল রঞ্জনার। কিন্তু আরও পরে যখন আমাদের কাছে অনেক কিছু পরিস্কার হবে তখন আমাদের সন্দেহ হতে থাকবে যে রঞ্জনাই কি মৃত্যুর পরোয়ানা ছিল?
অথচ এই রঞ্জনাকেই যখন আমরা দেখি লখিন্দরের নয়তলার ট্যাঙ্কের ভেতর, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তখন আমাদের প্রশ্নগুলো আবার উল্টে যেতে থাকে। আর আমরা দেখি নির্লিপ্তপ্রায় লখিন্দর তার বারান্দায় আধশোয়া হয়ে মার্টিনি খাচ্ছে। আর বাইরে তখন পুলিশের সাইরেনের আওয়াজ ভাসছে। পুরো বাংলাদেশ যেন ছুটে আসছে লখিন্দরের শহরতলীতে। তবে তার আগে আমাদের মন চলে যায় ওই ফোনালাপে। কী কথা হচ্ছিল তখন সেই ফোনে, তখন... যখন রঞ্জনা প্রতিষ্ঠিত আর এক দুর্ভেদ্য দুর্গের ভেতর যেন বন্দী আর লখিন্দর যখন পেয়ে যাচ্ছে সেই সোনার হরিণ আর একমাত্র স্বাধীন...

কী কথা হচ্ছিল তাদের মধ্যে?

বৃহস্পতিবার, ৫ জুন, ২০১৪

বানানো বাস্তব


‘এ যুগে আর কে চিঠি লেখে!

অথচ বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম আমার নামে একটা চিঠি এসেছে। বালিশের ওপর রাখা। বাসায় আমি আর আম্মা ছাড়া অন্য কেউ তো থাকে না। দরজা খোলার সময়ও আম্মা কিছু বললেন না চিঠির ব্যাপারে। সরকারী হলুদ খাম যে এখনো টিকে আছে তা দেখে আশ্চর্যই হলাম। আগ্রহ নিয়ে চিঠিটা খুললাম। বড় একটা আধ-দোমড়ানো পাতার একেবারে মাঝ বরাবর লেখা-
ভাইজান,
আমি এই দুবছর অপেক্ষার কথাই বলছিলাম।

নিচে কারো নামটাম লেখা নাই। তবে লেখা না থাকলেও বুঝতে বাকি থাকল না এটা কার চিঠি। লিখতে তাকে আমিই শিখিয়েছিলাম। ‘প’ অক্ষরটা আমি নিজে একটু গোল করে লিখি, সেও ‘প’ লিখতে শিখল গোল করে; এখনো যে ভোলেনি তার প্রমাণ এই চিঠি।
আয়েশা।
আমাদের বাড়িতে এসেছিল বছর চারেক আগে। এসেছিল মানে তাকে নিয়ে এসেছিলেন গ্রাম সম্পর্কের এক চাচা। তার আগে অনেক দিন ধরেই আমরা কাজের লোক পাচ্ছিলাম না। আয়েশাকে পেয়ে আমরা নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করেছিলাম। সৌভাগ্য ততোদিন পর্যন্ত ছিল যতোদিন পর্যন্ত সেই রাত না এল। সেই রাত, যে রাতে আয়েশা মারা গেল।

অতএব, মৃত আয়েশার চিঠি আসতে পারে না- এমন আমি ভাবতে পারি, কিন্তু ভাবছি না। না ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে। চিঠি পরের কথা, মৃত আয়েশা যদি নিজেই সামনে চলে আসে তবু অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বরং এ দুবছর মনে মনে অপেক্ষা করেছি আয়েশার।
আম্মা চিঠিটা দেখেছে নাকি?
খেতে বসে জিজ্ঞেস করব কিনা ভাবছি। আম্মা নিজেই বললেন, তোর একটা চিঠি রেখেছি ঘরে। ওপরে শুধু তোর নাম... এ যুগে আবার চিঠি কে দিল?
যাক, আম্মা বুঝতে পারেননি। আব্বার মৃত্যুর পর আম্মার হার্টটা হঠাৎ করেই বেশি দুর্বল হয়ে গেছে। মৃত আয়েশা চিঠি দিয়েছে বিষয়টা তাঁর অজ্ঞাত থাকাই ভালো।
রাতে আবার চিঠিটা নিয়ে বসলাম। ক’শব্দের চিঠি, এবং প্রেমিকারও চিঠি নয়... বারবার পড়ার অর্থ নেই; তারপরেও পড়তে হচ্ছে। চিঠিটা পরিষ্কার, অথচ আয়েশা কী নোংরা ছিল! আম্মা তাকে প্রথম দেখেই বলেছিলেন, এই মেয়ে যাও বাথরুমে গিয়ে গোসল দিয়ে আসো। খবরদার ভিতরের বাথরুমে যাবা না!

আয়েশা তীব্র শীতের মধ্যে ঠান্ডা পানিতে, সাবান ঘসে ঘসে গোসল করেছিল ওই সন্ধ্যায়। এতটুকু বিকার তার মধ্যে ছিল না। শুধু ঠান্ডাতেই না, ক’দিনের মধ্যে বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করি তার যেন কোনোকিছুতেই বিকার নেই।
একদিন দেখি রান্নাঘরে শিঙ্কের ওপর আয়েশা ঘাড় কাত করে মাথাটা পেতে রেখেছে। ট্যাপ থেকে গলগল করে পানি পড়ছে। শিঙ্কের ফুটোটা বন্ধ করা আছে ছিপি দিয়ে, জমতে জমতে শিঙ্ক উপচিয়ে পানি পড়ছে। আয়েশা নির্বিকারভাবে মাথার চুল ভিজিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে পানি খাচ্ছে। এই ভঙ্গির মধ্যে পশুর পানি খাওয়ার মিল আছে। তেমনই চুকচুক আওয়াজ হচ্ছে। এই আওয়াজের মধ্যে কেমন একটা অস্বাভাবিকতা আছে। যা চোখে লাগে, কানে লাগে; খারাপভাবে লাগে।
আমি বললাম, আয়েশা কী করছিস?
আয়েশা আমার দিকে তাকিয়ে তার বড় বড় চোখ কুচকে ফেলে। এ কথা ঠিক যে আয়েশার নোংরামি আর অস্বাভাবিকতা সরিয়ে ফেললে দেখতে সে ভালোই। বড় বড় চোখ। চোখের ভেতর পানি যেন সবসময় টলমল করছে। নাক মোটামুটি খাড়া। তবে চুলের দিকে তাকানো যায় না। জটা-টটা লেগে একেবারেই বাজে অবস্থা!

আয়েশা পানি খাওয়া থামায় না। আগের মতোই মাথাটা পেতে রাখে শিঙ্কের ওপর। তার নাকে মুখে গলগল করে পানি ঢুকছে। আমি আবার বললাম, কী করিস... পানি নষ্ট হচ্ছে না? চলে আয়।
‘তিষ্না পাইছে ভাইজান... আরেট্টু খাই...!’
‘এভাবে পানি খাচ্ছিস কেন? গ্লাসে খা!’
আয়েশা এমনভাবে আমার দিকে তাকায় যেন অসম্ভব কথা শুনছে। তারপর আবার পানি খেতে থাকে।
সহ্য করতে না পেরে কল বন্ধ করে আয়েশার হাত ধরে টেনে নিয়ে আসি বসার ঘরে। আয়েশা বসার ঘরে বসে অত্যন্ত আগ্রহের সাথে টিভি দেখতে শুরু করে। একটু আগে যে পানি-কাহিনি ঘটে গেছে সে বিষয়ে মনে হলো কোনো ধারণা তার নেই।
শীত তখন শেষ হচ্ছে। হালকা হালকা বাতাস বওয়া ছাড়া শীতের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না। আম্মা গেছেন ফুপুর বাড়ি। আমি বিকেলের ঘুম শেষ করে এক কাপ চা খাবো বলে অনেকক্ষণ আয়েশার নাম ধরে ডাকলাম। আয়েশার কোনো পাত্তা নেই। এতদিনে আয়েশার সাথে আমাদের একটু সদ্ভাব হয়েছে। খেয়াল করে দেখেছি আয়েশা যতো নোংরাই থাক, এক বোতল শ্যাম্পু উজার করেও তার মাথার জট না ছাড়–ক, নিজের সাথে যতোই কথা বলুক, তার মধ্যে চট করে শিখে ফেলার অসম্ভব গুণটা আছে। টিভির রিমোট তার নখদর্পনে, ফ্রিজের কোথায় কী, কোন বইটা কোন শেল্ফে, কোন সিগারেট আমার পছন্দের, আম্মার চা কখন কখন লাগে সবই তার আয়ত্তে। কাপড় কাচায় তার অসীম আগ্রহ। প্রতিদিনই আনন্দের সাথে সে কাপড় কাচছে।
আমাদের কাজ একেবারে কমে গেল। আম্মা রান্নাটা শুধু আয়েশাকে করতে দেন না, তাছাড়া পুরো সংসার আয়েশার তালুর ভেতর। পড়ালেখা না জেনেও এই মেয়ের বইয়ের প্রতি আগ্রহ দেখে আমার নিজের খুব ভালো লেগে গেল। তাকে নিয়ম করে পড়াতে শুরু করলাম। দেখি খুব দ্রুতই অক্ষর চিনে ফেলছে। বাংলা বর্ণমালার প্রতি অসমান্য আগ্রহ দেখে আমরা তাকে ‘বাঙাল’ ডাকতে লাগলাম।  
ছবি-গুগল
ডেকে ডেকে আয়েশাকে না পেয়ে প্রথমে বসার ঘরটা দেখি। টিভির প্রতি অন্যান্য কাজের লোকের মতো তারও ব্যাপক আগ্রহ। সমস্যা হলো সে নাটক বা গান-সিনেমা দেখে না। তার সমস্ত আগ্রহ খবর আর টক-শোর প্রতি। বেশিরভাগ টক-শোয়ের সময় তার জানা, খাওয়া-দাওয়ার পর হাতের কাজ শেষ করে টিভির সামনে বসে যায়। আমরা ঘুমিয়ে যাই, মধ্যরাত পর্যন্ত সে টক-শো দেখে।
এখন দেখি যে টিভির সামনে সে নেই। উঁকি দিলাম রান্নাঘরে এবং যা দেখলাম তাতে ঘাড়ের নিচ দিয়ে একখণ্ড বরফ নেমে গেল। একটা বড় রুই মাছ এনেছিলাম গতরাতে। কাটাকাটির ঝামেলা বলে রান্না হয়নি, আগামীকাল হয়তো হবে। আয়েশাকে দেখলাম ফ্রিজ থেকে সে মাছ বের করে নিয়েছে। রান্নাঘরের মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসেছে বটি নিয়ে। মনোযোগ দিয়ে মাছটা কাটছে। বড় বড় টুকরোগুলো রাখছে পাশের বাটিতে। কিন্তু ভয়ঙ্কর কথা হলো মাছের পেটের ভেতরের যতো নাড়িভুড়ি সেগুলো সে গপগপ করে খাচ্ছে। খাচ্ছে আর খিকখিক করে হাসছে। হাসছে আর অদৃশ্য কারো সাথে কথা বলছে। কথাগুলো এরকম-
এখন ফাল পাড়বি না... ওই হারামি... খবরদার বেজায়গায় হাত দিবি না...হি হি হি...ওই সুরসুরি লাগে জারুয়া...
পুরো দৃশ্যটার মধ্যে, আয়েশার কথা বলার মধ্যে, রান্নাঘরের মধ্যে যেন অন্য কিছু আছে, অন্য কোনো ব্যাখ্যা আছে, অন্য কেউ আছে! এই দৃশ্য আমি নিতে পারি না, ছুটে বেরিয়ে যাই রান্নাঘর থেকে। নিজের ঘরে ঢুকি। আয়েশার অনেক অস্বাভাবিকতা হয়তো মেনে নেয়া যায়, কিন্তু মাছের নাড়িভুড়ি খাওয়া, কাচা মাছ খাওয়া? অসম্ভব! ফুপুবাড়ি থেকে ফিরে আম্মা এ দৃশ্য দেখে ফেললে নির্ঘাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যাবেন। অথচ এ ঘটনা তাকে জানানো উচিত। আয়েশাকে কাজ থেকে বাদ দেয়া উচিত।
ধীরে ধীরে মাথা ঠাণ্ডা হয়ে এল। আরেকবার উঁকি দিতে গেলাম রান্নাঘরে। দেখি আয়েশা মগ ভর্তি করে চা নিয়ে আসছে, যেমন আমি খাই। চায়ে চুমুক দেয়া ছাড়া আমার অন্য কোনো উপায় থাকল না। চুমুক দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে আয়েশার মুখের দিকে তাকালাম। তার ঠোঁটের কোণায় এখনো মাছের উচ্ছিষ্ট লেগে আছে। আমার গা গুলিয়ে গেল।
আয়েশার কথা আম্মাকে বলতে পারলাম না; কিন্তু কাউকে না বলে শান্তিও পাচ্ছিলাম না। শেষে বললাম রাখিকে। রাখি আমার বান্ধবী। বছর খানেক পর বিয়েশাদি করব, এসব তাকে বলা যায়। রাখি তো সব শুনে হেসে অস্থির। বলল, ভালো পাগলি আছে তো মেয়েটা...
হাসছে বলে রাখির ওপর একটু বিরক্তই হলাম। ভ্রু কুচকে তাকালাম তার দিকে; তাতে হাসির হেরফের হলো না। বলল, বললে না মেয়েটার বয়স ১৫-১৬... ওই বয়সী মেয়েদের কত কিছু মনে হয়...ওই বয়সে আমি তো গভীর রাতে ব্যালকনিতে দুপা নিচে ঝুলিয়ে বসে থাকতাম। পাশের ফ্ল্যাটের আজমল চাচা এক রাতে দেখে ফেলল আমাকে... দেখা মাত্র আজান দিতে শুরু করলো। পরের সকালে চাচি এসে আম্মাকে যা বলে গেল তার মর্ম হলো আমার ওপর জ্বিনের আছর আছে, ভালো কোবরেজ না দেখালে নিস্তার নাই... হি হি হি... জ্বিনের আছর...!
আমি অবাক হয়ে রাখিকে দেখি, তার অপ্রকৃতস্থের মতো হাসি দেখি।
রাখি হাসি থামিয়ে বলল, বয়োসন্ধিকালে মেয়েরা কত কী যে করে!
আমি নিশ্চিত হবো, না আরো ভীত হবো বুঝতে পারলাম না। তবে মাথায় বয়োসন্ধিকাল ব্যাপারটা গেঁথে গেল। আয়েশার উদ্ভট কাজগুলোকে স্বাভাবিক চোখে দেখার চেষ্টা করতে লাগলাম। রান্নার সময়টুকু ছাড়া আম্মা ঘরের ভেতরই থাকতেন। নামাজ পরতেন, দোয়াদরুদে ব্যস্ত থাকতেন; আয়েশার এসব অদ্ভুত ব্যাপারস্যাপার বুঝতে পারতেন না। আগেই বলেছি, আমি চাইতামও না আম্মা এসব জানুক।
কিছুদিন এভাবেই গেল। নতুন চাকরি নিয়ে আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, আয়েশাও থাকতে লাগল তার মতো। ঘরের কাজ শেষে তাকে দেখতাম হয় টক-শো শুনছে নাহয় বই পড়ছে। সে খুব দ্রুত পড়ালেখা শিখে ফেলেছিল। আমার কখন কী লাগবে সে বিষয়ে ছিল তার বিশেষ খেয়াল। পানি গরম করে বাথরুমে দেয়া থেকে শুরু করে চায়ের আয়োজন- সবই সে এক ছুটে করতো। তার পরিবর্তন হয়েছিল দেখার মতো। আমাদের সাথে থাকতে থাকতে এক বছরেই তার শরীর থেকে প্রায় সমস্ত গ্রাম্যতা চলে যায়; অতীতের সাক্ষী হয়েকেবল ছিল তার মাথার জটাটা। ওই জট দেখে দেখে আমরাও অবশ্য অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম।
এক রাতে তীব্র গরমে ঘুম ভাঙে। পরেরদিন অফিস বন্ধ তাই এমনিতেই দেরি করে ঘুমিয়েছিলাম, এখন মধ্যরাত পেরিয়ে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বিরক্ত লাগছিল। দেখলাম সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। ঘাড়ের পেছনে চুলের গোরায় জবজবে ঘাম। ফ্যান ঘুরছে, তবে খুবই ধীরে। বুঝলাম কারেন্টের ভোল্টেজ নাই। মেজাজটা খিচড়ে গেল। উঠে এক গ্লাস পানি খেলাম। তারপর সিগারেট খাবার ইচ্ছায় ছাদে গেলাম। আমাদের বাড়িটা পুরনো আমলের- তেতলায় আমরা থাকি, এজাজ দেখেছে...
সিঁড়িঘরের দরজা বন্ধ। বন্ধই থাকে সব সময়। তবে আমার কাছে চাবি আছে। তালা খুট করে খুলে ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম। জ্যোৎ¯œার হালকা আভা আছে, নীলাভ রাত- বাতাসও আছে। উল্টো দিকে ঘুরে সিগারেট ধরাতে যাবো এমন সময় দেখলাম ছাদের কোণায় আয়েশা বসে আছে। আয়েশার কথা কিছু বলা যায় না, এ রাত্রেও সে ছাদে থাকতে পারে; এমনকি ছাদের দরজা তালাবন্ধ থাকলেও। কিন্তু তার হাতে ওটা কী?
এগিয়ে গেলাম একটু। আয়েশার সারা শরীরে বেড়ালের লোম। আর সে দু’হাতে বেড়ালের একটা লেজ ধরে আছে। তবে ওই লেজটুকুই শুধু- বেড়াল নেই।
‘কী করছিস এখানে?’ খেকিয়ে ওঠার চেষ্টা করলাম, তবে গলা থেকে তেমন রাগত স্বর বেরোলো না।
‘খিদা লাগছিল ভাইজান। বিলাইটা খাইলাম। ল্যাজ খামু না!’ বলেই লেজটা ছাদ থেকে শূন্যে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর শরীরটা বাঁকিয়ে ছাদের কিনারা থেকে ঝুলিয়ে দিল।
পড়েই গেল বোধহয়! তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলাম ছাদের কিনারে। উঁকি দিয়ে দেখি বাথরুমের পাইপ ধরে অবিকল বাঁদরের মতো নেমে যাচ্ছে সে। ভয়ে আমার হৃদপিণ্ড থেকে রক্ত ছলকে গেল। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। মনে হলো এক্ষুনি বোধহয় জ্ঞান হারাবো।
কিন্তু জ্ঞান হারালে তো চলবে না। অসুস্থ আম্মা তাঁর ঘরে ঘুমিয়ে আছেন। সেই ঘরের দিকে কি এগিয়ে গেছে আয়েশা? আমি ছুটে নিচের দিকে গেলাম। তাড়াতাড়ি বাসায় ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। দিয়েই ভাবলাম ভুল হয়ে গেল, দরজা বন্ধ করে বরং নিজেদেরই বন্দি করে ফেললাম।
ঘুমাতে যাবার পর আমার মোবাইল ফোনটা সবসময় বালিশের নিচেই থাকে। ফোনটা বের করে কাকে রিং দেয়া যায় ভাবতে প্রথমেই মনে এল ছোট মামার কথা। ছোট মামার নাম্বার খুঁজে ডায়াল করতে যাবো ঠিক তখন পাশ থেকে আয়েশার কন্ঠ- এত রাতে মামাকে কষ্ট দেয়া কি ঠিক হইব ভাইজান?
চমকে উঠলাম, হাত থেকে মোবাইল পড়ে গেল। দেখলাম মোবাইলটা তুলে নিল আয়েশা। আমি এক ছুটে বসার ঘরে গেলাম। পুলিশকে ফোন করা উচিত। ল্যান্ডফোনের রিসিভার হাতে তুলতেই মনে হলো বাতাস থেকে আয়েশার শরীর বেরিয়ে এল।
‘ভাইজান পুলিশকে ফোন কইরা কী করবেন? খালাম্মা ঘুমায়া আছে, এই রাইত্তে হাঙ্গামা করেন ক্যান? ফোনের লাইন নষ্ট, তার কাটা!’
‘কী চাও তুমি? কী করেছি আমরা?’ ঘাম ছুটে যাচ্ছে আমার। কথা বলতে গিয়ে দেখলাম শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
‘কিচ্ছু চাই না ভাইজান... আমারে শুধু থাকতে দিয়েন...’
‘এতদিন দিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু আজকের পর দেয়া যায় না। তোমার এ চেহারা আম্মা দেখলে নির্ঘাৎ মরে যাবে।’
‘আমি আপনের পায়ে ধরি ভাইজান, আমারে দুইটা বছর থাকতে দিয়েন শুধু...’
‘আমি তোর পায়ে ধরছি আয়েশা, এই হাত জোর করছি, তুই যা... এখানে আর কোনোদিন আসিস না...’
‘আমারে থাকতে দেন ভাইজান!’
‘না, এক মুহূর্ত না। আমি যে-বিদ্যা তোরে শিখায়েছি সেই বিদ্যার কসম, তুই যা...!’
কসমে মনে হলো কাজ হয়েছে, আয়েশার মুখ হঠাৎ অন্ধকার হয়ে যেতে দেখলাম। আমিও আর দাঁড়ালাম না। নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। পরেরদিন সকালে ঘুম ভাঙে হৈচৈ-এ-’

এ পর্যন্ত বলে থামলো আতিক, আমার কলিগ এজাজের বন্ধু। ক’দিন আগে আয়েশার অল্প একটু গল্প শুনেছিলাম এজাজের মুখে। প্রথমবার শুনেই মনে হয়েছিল এটা একটা গল্প হতে পারে। বিস্তারিত শোনানোর অনুরোধ করতেই এজাজ সানন্দে নিজের বাসায় চায়ের আসরটা বসালো। আতিককেও ডেকে নিল।
একটানা বলার জন্যই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক আতিক হাঁপাচ্ছে। এজাজ উঠে গিয়ে এক গ্লাস পানি এনে দিল। ঢক ঢক করে পানি খেল আতিক, আমার দিকে তাকালো একটু। তারপর আবার শুরু করল, ‘সকালে উঠে যা জানতে পারলাম তা ভয়ঙ্কর।’
‘জানলেন যে ছাদ থেকে পড়ে আয়েশা মারা গেছে?’ আমি প্রশ্ন করলাম।
‘হ্যাঁ। বাসার সামনের খোলা জায়গাটা রক্তে ভেসে গেছে!’
‘তারপর?’
‘অপঘাতে মৃত্যু বলে আমরা একটু তাড়াতাড়ি করি। তাছাড়া আয়েশা যে কোন গ্রামের তাও আমরা জানি না- জানেনই তো মেয়েটাকে নিয়ে এসেছিল গ্রাম সম্পর্কের চাচা। সেই চাচাকে খবর দেয়ার আগেই আয়েশাকে দাফন করা হলো। হ্যাঁ, পুলিশকে কিছু ঘুষ দিতে হয়েছিল...
...কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আমার খারাপ লাগতে শুরু করল। মনে হলো আয়েশার বাবা-মাকে মেয়ের মৃত্যু সংবাদটা অন্তত দেয়া উচিত। চাচাকে খবর দিয়ে পাঠালাম। আয়েশাদের গ্রামের ঠিকানা নিয়ে এক শুক্রবারে রওনা হলাম। ভোরবেলা বেরিয়ে সন্ধ্যার মুখে পৌঁছালাম সে গ্রামে। খুঁজে খুঁজে অবশেষে পেলাম আয়েশাদের বাড়ি। তার বাবা বাড়ির সামনে বসে বিড়ি ফুঁকাচ্ছিল। আমাকে দেখে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে থাকলো। কীভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না। শেষে, হড়বড় করে সব বলে ফেললাম।
আয়েশার বাবা আমার কথা শুনে কোনো রকম বিকার দেখালো না। বরং বিড়িতে কষে আরো দুটো দম মেরে বলল, ভাই, নিশাপানি করন বাদ দেন। কী উলটপালট কথা কন? আমার আইশা মরবে কুন দুক্খে? সে ঘরেই আছে, আইজ তার গায়ে হলুদ, কাইল বিয়া। এখন কুনো গ্যাঞ্জাম কইরেন না! আপনেরা যেদিন তাড়ায়ে দিছেন- মাইয়া আমার সেদিনই কানতে কানতে এক কাপুড়ে বাড়ি আসছে! যান ভাগেন!
আয়েশাকে নিয়ে যে কোনো ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হলে আমি আর অবাক হই না। কিন্তু তার বাবার কথা শুনে আশ্চর্য না হয়ে আর উপায় কী! আমি আয়েশার সাথে দেখা করতে চাইলাম। খেকিয়ে উঠল আয়েশার বাবা। জানতে চাইলাম কোথায় বিয়ে হচ্ছে আয়েশার?
রক্তচক্ষু একটু শান্ত হলো তার। হাসি মুখে বলল, বিয়া তো আগেত্থেই ঠিক করা। জামাই ইন্যুয়ন চেয়ারমেন। ম্যালা বড় লোক। হারামিরা কইতেছে চেয়ারমেনের নাকি বয়স বেশি, আইশার নাকি কপাল পুড়ব... হ্যাহ্, পুরুষলোকের বয়স কি কন? টেকা থাইকলে সব থাইকলো!
আমি দেখলাম চালের ঘরের দরজায় কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে। আধা অন্ধকারে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। তবে শাড়ি পরা অবয়বটা আয়েশার মতোই।
আমি ডাকলাম, আয়েশা?
আয়েশার বাবা খেঁকিয়ে উঠল, যা ভিত্তরে যা... কত্ত বড় সাহুস, হলুদের রাইত্তে বাইর হইছে!
আয়েশা বা না-আয়েশা ভেতরে চলে যায়। আয়েশার বাবা ঘাড় বাঁকা করে তীব্র চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি সেখান থেকে ফিরে আসি। আয়েশার কথা ভুললেও ভোলা যায় না। তারপরেও ভুলেই তো গিয়েছিলাম... কিন্তু গত সপ্তাহে চিঠি পেলাম তার...এক লাইনের চিঠি...’
‘আর কোনো খোঁজ নেননি?’ আমি জিজ্ঞেস করি। দ্বিতীয়বারের মতো চা নিয়ে আসে এজাজ।
‘খোঁজ মানে চিঠি পাওয়ার পর নিয়েছি... ওই গ্রাম্য চাচা জানালো আয়েশাদের গ্রামের চেয়ারম্যান, মানে আয়েশার স্বামী মারা গেছে গত সপ্তাহে!’
‘মানে যে সপ্তাহে আপনি চিঠিটা পান?’
‘হ্যাঁ।’
এজাজ সোফায় বসল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কী, বলেছিলাম না ফাটাফাটি গল্প! বই লিখে ফেলতে পারবেন...
আতিক মাথা নিচু করে কী যেন গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে। চায়ে চুমুক দিচ্ছে না। বললাম, আপনার আম্মা সব জানেন?
‘না আম্মা বলতে গেলে কিছুই জানে না!’ মাথা উঠিয়ে ধীরে ধীরে বলল আতিক।
এজাজ বলল, গল্পটা পছন্দ হয়েছে? লিখবেন তো?
‘কি জানি, এখনো বুঝতে পারছি না, বোধহয় লিখব।’
‘কোত্থেকে লিখবেন? আমার নাম কিন্তু থাকতে হবে!’ এজাজের আগ্রহ সীমাহীন।
আমি হাসলাম। ‘থাকবে, আপনার নাম থাকবে!’
হঠাৎ আতিক একটু জোরের সাথে বলে উঠল, ‘না, গল্পটা লিখিয়েন না...!’
‘কেন?’ এজাজ প্রশ্ন করে।
আমি কাপটা টেবিলে রাখতে রাখতে বললাম, ‘কারণ আতিক ভয় পাচ্ছে লিখতে গেলে না আবার সত্যটা বেরিয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে আতিক, আপনার গল্পটা বলাই উচিত হয়নি।’
‘গল্প বলতে আমিই ওকে চাপাচাপি করেছি...’ এজাজ একবার আমাকে একবার আতিককে দেখে, ‘কিন্তু সত্য... কী সত্য?’
আমি বললাম, গল্পের সত্য কিংবা বাস্তবের সত্য। গল্পের সত্য আর বাস্তবের সত্য খুব কাছাকাছি... কখনো কখনো আলাদা করা যায় না।
আতিকের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। দেখার চেষ্টা করলাম তার চেহারা কিছু বলছে কিনা! আতিকের চেহারা কিন্তু সাদা কাগজের মতো ভাষাহীন।
এজাজ আমার দিকে ঝুঁকে বলল, সব সময় খেয়ালি কথা-বার্তা বইলেন না ভাই। কী বলতে চাচ্ছেন, আমার দোস্ত মিথ্যা কথা বলতেছে, গল্প বানায়ে বানায়ে বলতেছে?
‘বলছে...’ আমি বললাম। ‘কিছুটা বানাচ্ছে এবং বানাচ্ছে যে তাও ঠিক বুঝতে পারছে না। একটা ঘোরের মধ্যে আছে। এ-ঘোর তার শুরু হয়েছে আয়েশার মৃত্যুর পর পর।’
‘এমনভাবে বলতেছেন যেন আপনি... কি বলে... মনোচিকিৎসক... সাইক্রিয়াটিস্ট!’
‘লেখক মাত্রই সাইক্রিয়াটিস্ট এজাজ। তবে আতিকের গল্প মেলানোর জন্য সাইক্রিটিস্ট বা হোমস হতে হবে না। সহজ হিসাব।’
‘সহজ হিসাব?’
‘সহজ হিসাব এজাজ। আপনার বন্ধু এখন একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ। তার আগে অবশ্য একজন খুনী।’
‘খুনী?’ এজাজ চিৎকার করে উঠল। তবে আতিকের ভেতর কোনো ভাবান্তর হলো না। তার ঘাড় ঝুঁকে আছে চায়ের কাপের দিকে।
‘খুনী। তবে তারো আগে রেপিস্ট। ধর্ষণকারী। ধারাবাহিক ধর্ষণকারী।’
‘কী বলছেন আপনি? আপনাকে বড় ভাই বলি বলে যা খুশি বলবেন তা তো হবে না! আতিক তুই আমাকে মাফ করে দিস দোস্ত!’
‘মাফ হয়তো উল্টো আতিকই চাইবে। আয়েশার কাছে মাফ চাওয়ার জন্যে সে এখন ব্যাকুল। কিন্তু যে-আয়েশাকে নিজ হাতে খুন করেছে তাকে সে এ দুনিয়ার কোথায় পাবে? আতিকের সাবকনশাস জগত তাই আরেকটা আয়েশাকে তৈরি করে নিয়েছে। হ্যাঁ, মাফ চাওয়ার জন্যই।’
আতিক নিশ্চুপ।
আমি বললাম, আয়েশা যখন প্রথম আসে আতিকদের বাসায়, আয়েশার উঠতি শরীর তখনই আতিকের ভেতরে আলোড়ন তৈরি করে। যতো দিন যায় আয়েশার প্রতি তার চাহিদা ততোই বাড়তে থাকে, বাড়তেই থাকে- এবং প্রথম রেপটা সে করে রান্নাঘরে, যতো দূর মনে হয়।’
এজাজ আতিকের দিকে তাকালো প্রতিবাদের আশায়। আতিককে চুপ থাকতে দেখে আমাকে বলল, ‘এত নিশ্চিত করে কীভাবে বলছেন?’
‘আতিকের গল্পে খেয়াল করলে দেখবেন আয়েশাকে সে বেশিরভাগ সময় রান্নাঘরেই দেখাচ্ছে। আর গভীর রাত্রে কখনো কখনো বসার ঘরে। বসার ঘরে আয়েশা কী করছে? টক-শো শুনছে। টক-শো আসলে আয়েশা শুনতো না, শুনতো আতিক। আয়েশাকে সে সঙ্গে রাখতো। কেনো, আশা করি বুঝতে পারছেন! সম্ভবত প্রথম রেপের পর আতিককে আর জোর করতে হয়নি। তাকে বিয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে ব্যাপারটা ক্রমাগত চালিয়ে গেছে সে। গল্পে খেয়াল করবেন আতিক বলেছে তার সব কিছুর দিকেই আয়েশা নজর রাখতো। গরম পানি থেকে চা থেকে সিগারেট, সবই। এতোটা সাধারণত খুব কাছের মানুষই করে থাকে- স্ত্রী কিংবা হবু স্ত্রী। তারপর বছর খানেক হতে না হতে আতিক জানতে পারলো আয়েশার পেটে বাচ্চা। আয়েশাও বিয়ের জন্য জোরাজোরি করে- যেমনটা হয় আর কি! মেয়েটাকে গ্রামে ফেরত পাঠানোতেও ঝক্কি ছিল। গ্রাম থেকে সে এক রকম পালিয়েই এসেছিল চেয়ারম্যানের ভয়ে। আতিকের তাই অন্য কোনো উপায় ছিল না। মধ্যরাতে, ছাদের ওপর নিয়ে, আয়েশাকে তাই ধাক্কা মারতেই হয়।’
‘এতই সহজ?’ এজাজের কণ্ঠ ও চোয়াল দুটোই শক্ত।
‘সহজ না। কোনোভাবেই সহজ না। ধাক্কা মারার পরপরই আতিকের ভেতর আতঙ্ক লাফ দিয়ে ওঠে। নিচে নেমেই সে মোবাইলফোন খোঁজে; খুঁজে ছোট মামাকে ফোন করতে উদ্যত হয়। আতঙ্ক আর ভয়ের মধ্যে খুবই অল্প একটা পার্থক্য আছে। আতঙ্কিত আতিক ফোন করতে চাইলেও ভীত আতিক তা করতে পারে না। খোঁজ নিলে জানবেন ছোট মামার সাথে আতিকের খুব ভালো বোঝাপড়া। খুনের পর আত্মরক্ষার তাগিদে তাই প্রথমেই মামার কথা মনে আসে তার।  
তারপরেই সে সারেন্ডার করতে চায়- ফোন করতে যায় পুলিশে। পারে না। বাইরে আয়েশার মৃতদেহ রেখে আতিক ঘুমাতে যায়। ঘুম তার নিশ্চয় হয় না। কিন্তু সকালে সে ওঠেও না। আতিকের গল্পে খেয়াল করেছেন কি সকালে সে সবার হৈচৈ-এ ওঠে? আসলে সে ঘুমায়নি সারারাত। কিন্ত সকালে, সবার আগে, যেতেও পারেনি লাশের কাছে। যেমনটা হয় আর কি, অংকের মতো!’
‘ কিন্তু জীবনটা অংকের মতো নয়।’ এজাজ বলল। তাকে বিব্রত দেখাচ্ছে। ভাবছে ধরেবেঁধে গল্প শোনাতে চেয়ে কোন বিপদে পড়লো! তারপর মারণাস্ত্র পেয়েছে এমন ভঙ্গিতে বলল, ‘আর চিঠিটার কথা কী বলবেন? চিঠিটা আমি নিজ চোখে দেখেছি!’
‘ওটা আতিকই লিখেছে। ওর সাবকনশাস ওকে দিয়ে লেখিয়েছে। তারপর নিজের নামে পোস্ট করেছে। খামটা ভালো করে দেখলে দেখবেন খামের প্রাপক প্রেরক একই শহরের।’
‘আপনি তো সব জেনে বসে আছেন!’ এজাজের মুখের ভেতরটা যেন তেতো কিছুতে ভরে গেছে।
আমি বললাম, আয়েশার বাবার সাথে আতিকের কখনো দেখা হয়নি। কিন্তু আতিকের অপরসত্তা...সাবকনশাস... কনফেস করতে চাচ্ছে। ফলে সে এই চরিত্রগুলো দাঁড় করিয়ে নিচ্ছে- চরিত্রগুলোর সাথে কথা বলছে। আয়েশার বিয়ে হয়েছে এমন ভেবে শান্তি পাচ্ছে, আবার পাচ্ছে না। একবার বিয়ে দিচ্ছে চেয়ারম্যানের সাথে, আবার চেয়ারম্যানকে মেরে ফেলছে। আয়েশাদের গ্রামে খোঁজ নিয়ে দেখেন গত সপ্তাহে কোনো চেয়ারম্যান টেয়ারম্যান মরেনি।
এজাজকে দেখে মনে হলো সে ধৈর্যের চূড়ান্ত পরীক্ষা দিচ্ছে। যদিও আতিক আগের মতোই ভাবলেশহীন। সে চুপচাপ আমার কথা শুনে যাচ্ছে। তার দিকে চোখ রেখে উঠে দাঁড়ালাম। তাতে এজাজ খুশিই হলো। চটপট দরজার কাছে চলে এল। মানে বলছে, এবার বিদায় হও।
আমি বেরিয়েই যাচ্ছিলাম। এ সময় আতিক বলল, আপনিই সব সত্য জানেন? আসলে আপনি কিছুই জানেন না।
আমি ঘুরে দাঁড়ালাম, পূর্ণচোখে তাকালাম আতিকের দিকে। আতিকের চোখের মণি ধকধক করছে। ধীরে ধীরে বললাম, না। আমি সব সত্য জানি না, আতিক। তবে আমার গল্পের সত্যটুকু আমি জানালাম।
‘মানে?’ এজাজের প্রশ্ন।
‘আমি যদি লিখি, তাহলে এমনই লিখব’ বললাম আমি। ‘জানেন তো এজাজ, আমি ভূতের গল্প লিখি না।’
‘মানে এতক্ষণ আপনি গল্প বানাচ্ছিলেন?’ এজাজের মুখে হাসি।
আমি অবশ্য হাসতে পারলাম না। মৃদুস্বরে শুধু বললাম, গল্প... কিংবা বাস্তব... বানাচ্ছিলাম।  

২.
দেরি করে বাসায় ফিরলে বউয়ের মেজাজ ভালো থাকে না। আজ দশটা পার করে দেয়ার পরও বউয়ের মন মেজাজ ভালো। কিছুক্ষণের মধ্যেই জানতে পারলাম বউয়ের আনন্দের কারণ। গ্রাম সম্পর্কীয় এক চাচা কিছুক্ষণ আগে একটা কাজের লোক দিয়ে গেছে। ১৫-১৬ বছর বয়সী মেয়ে। সবই ঠিক আছে, কেবল বড্ড নোংরা নাকি। মাথায় এই এতো জটা। বউ তাকে বাইরের বাথরুমে ঢুকিয়ে এক ঘন্টা গোসল করার নির্দেশ দিয়েছে। মেয়ে এখন সে নির্দেশ পালন করছে।
উৎসাহে বউ এক কাপ চা নিয়ে এসে আমার হাতে দিতে দিতে বলল, জানো মেয়েটার নাম কি?
আমি বললাম, জানি।
‘কী?’
‘আয়েশা।’

গল্প আবার শুরু হলো।


(নতুন ধারা-৫৫ সংখ্যায় প্রকাশিত)