বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

ইজিজি




‘মেয়েটি ছোট থেকেই যেন কেমন, আর পাঁচটা বাচ্চার মতো না। চুপচাপ থাকে। যেখানে বসিয়ে রাখা হয়, সেখানেই বসে থাকে। একা একা বিড়বিড় করে। স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড বলতে একমাত্র যা, তা হলো পিঁপড়ার সাথে খেলে। পিঁপড়াকে ডাকে ইজিজি। আর মেয়েটা, ধরা যাক তার নাম মেঘলা, আঙুলে পিঁপড়া নিয়ে অনবরত কথা বলতেই থাকে, বলতেই থাকে। শিশুদের অর্থহীন ভাষাতে বললেও পিঁপড়াগুলো মনেহয় সে ভাষা বুঝতে পারে। পিঁপড়া মেঘলার শরীর বেয়ে কাঁধে উঠে যায়। মেঘলা সুড়সুড়ি পাবার আনন্দে হি হি করে হাসে।’

এ পর্যন্ত লিখে থামে রায়হান। ল্যাপটপের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে অক্ষরগুলো। সিগারেট ধরাবে কি ধরাবে না সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
          ‘কফি কফি...’
          কফির কাপ নিয়ে ঘরে ঢোকে বৃষ্টি। অল্প ক’দিন হলো তারা বিয়ে করেছে। কফির কাপের দিকে তাকিয়ে রায়হানের মনে হয় তার আসলে কফির তৃষ্ণাই পেয়েছিল।
           ‘কী করো?’ কফির কাপ দিতে দিতে বৃষ্টি প্রশ্ন করে।
           ‘আর কি...!’ কাপে ছোট্ট চুমুক দেয় রায়হান। ‘লিখি বেগম সাহেবা... ঈদসংখ্যার গল্প! সম্পাদক মাথা খারাপ করে দিলো, বুঝছো!’
           ‘কী লেখো? শোনাও আমাকে...!’
‘আরে পত্রিকায় ছাপলে পড়ে নিও।’
‘আমি লেখক হলে এমন ত্যাড়ামি করতাম না মিস্টার... শোনাও না প্লি-জ...’
শেষের বাক্যে ঢঙ মিশ্রিত আব্দার ঝরে পড়ে।
           ‘হুম, আচ্ছা শোনো, এটা একটা মেয়ের গল্প...’
‘না না এভাবে না। যেমন লিখেছ তেমনি পড়ে শোনাও।’
‘ওকে!’
মেকি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রায়হান। তারপর পড়তে শুরু করে, ‘মেয়েটা ছোট থেকে যেন কেমন... ’
হাতের ওপর থুতনি রেখে গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে বৃষ্টি।


২.
‘জন্মের বছর দুই শেষ হতে না হতেই মেঘলার মা মারা যান।
দুপুরে ভাত খেয়ে একটু ঘুমানোর অভ্যাস ছিল মেঘলার মায়ের। মেঘলাকে বুকে নিয়ে দুধ দিতে দিতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন। সেই ঘুম ভাঙলো একবুক জ্বালা নিয়ে। শ্বাসের জন্য ঘরের সমস্ত বাতাস টেনে নিতে চাইলেন, পারলেন না। ডাক্তার বদ্যি ডাকার সুযোগ না দিয়ে, মুখে ফেনা তুলতে তুলতে, মারা গেলেন বিকেলে। মেঘলা তখনো দুধ খাচ্ছিল।
মাস তিনেক পরই মেঘলার ছোট খালাকে বিয়ে করেন বাবা। দুধের শিশুটিকে খালা প্রাণ দিয়ে আগলে রাখতেন। বাবা তো সারাদিনই বাইরে বাইরে, এই ব্যবসা সেই ব্যবসা নিয়ে হন্তদন্ত; খালাই তাকে মায়ের আদর-যত্ন দিয়ে বড় করেন। ইশকুলে পাঠান। হ্যাঁ, সাড়ে চার বছর বয়সেই মেঘলা ইশকুল যাওয়া শুরু করে। কিন্তু শিশুসুলভ নটখট, ওজর-আব্দার, চিৎকার ছিল না মোটেই। ইশকুলে গিয়ে, এক কোণের এক বেঞ্চে চুপচাপ বসে পড়তো। কারো সাথে ঝগড়া বা মারামারি নয়, কারো সাথে সদ্ভাবও নয়; তবে ক্লাস থ্রিতে একজন আসে— নাম রুমা। কী সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে। বড় বড় চুল। দু’দিকে দুটো বেণী ঝুলিয়ে, মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে, পড়ে। তাকে দেখলেই মেঘলার মন যেন ভালো হয়ে যায়। মেঘলাকে দেখলে রুমাও ছুটে আসে।
ব্যস, তাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ক্লাসে মেঘলা ফার্স্ট আর রুমা সেকেন্ড। আইশা আপা তো তাদের নাম দিয়ে ফেললেন মানিকজোড়! ফাইভে দু’জন বৃত্তি পেয়ে একই গার্লস হাইস্কুলে ভর্তি হলো। সিক্সটা ভালোই কাটলো, কিন্তু সেভেনে ভীষণ জ্বর হয়ে তিন মাস ইশকুলে যেতে পারলো না মেঘলা।
রুমা তাকে রোজ দেখতে আসতো, পাশে বসে বসে নতুন বাংলা বইয়ের ছড়া কবিতা শোনাতো। কিন্তু রুমাকে আর ভালো লাগতো না মেঘলার। সেভেনে রুমা ফার্স্ট হয়েছিল, আর সে সেকেন্ড— সেকেন্ড হওয়াটা সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিল না।
জ্বর ভালো হলেও মন ভালো হলো না মেঘলার। আর একদিন রুমারা বদলি হয়ে অন্য জায়গায় চলে গেল। অনেক পরে মেঘলা জানতে পেরেছিল রুমা নাকি ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছে। কেন কে জানে, মেঘলার মন সেদিন ভালো হয়ে গিয়েছিল।’

কলিংবেলের শব্দ। বৃষ্টি ল্যাপটপ বন্ধ করে দরজা খোলে। রায়হান।
           ‘কি ঘুমিয়ে ছিলে নাকি?’ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে রায়হান জিজ্ঞেস করে।
           ‘হুম।’
           ‘আজ অফিস থেকে আগেই ছাড়া পেয়ে গেলাম বুঝছো... অন্যসময় হলে একটু আড্ডাবাজি করতাম, কিন্তু ঘরে যে নতুন বউ..’
           ‘থাক আর আহ্লাদ দেখাতে হবে না... চা খাবা?’
           ‘কফি হলে জমে যায়।’
           ‘তুমি জামাকাপড় ছাড়ো, এক্ষুণি কফি দিচ্ছি!’
           ‘ল্যাপটপ বিছানায় কেন?’
           ‘বিয়ের ছবিগুলো দেখছিলাম।’
           ‘ও। ছবিগুলো বেশ তুলেছে, কি বলো?’
           ‘হুম।’


৩.
রায়হান নেই। বিছানার মাঝখানে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে বৃষ্টি। ছবির ফোল্ডারটা ওপেন করে কিছুক্ষণ এ-ছবি ও-ছবিতে ক্লিক করে। কিন্তু পরক্ষণেই ফোল্ডারটা মিনিমাইজ করে রায়হানের লেখার ফাইলটা খোলে। গল্পটা কই? কোন পর্যন্ত যেন পড়েছিল সে? এই তো—

‘মেঘলার খ্যাতি এখন মফস্বল জুড়ে। ভাল ছাত্রী সে ছিলই, এবার মৌসুমী প্রতিযোগীতায় ড্রইংয়ে রাজশাহী বিভাগে প্রথম হয়েছে— এখন যাবে একেবারে ঢাকায়। ঢাকা! এর আগে কখনো সে ঢাকা যায় নি। কী যে উত্তেজনা তার! অবশ্য তার সব উত্তেজনা আর ভালোলাগা ছেলেবেলার সেই খেলার সাথী ইজিজিদের সাথে। হরলিক্সের খালি একটা বয়ামে সে তার বন্ধুদের ঢুকিয়ে রেখেছে। সেটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলে, জানিস ইজিজি, আজ রাতে আমি ইয়া বড় একটা বাসে চড়বো। সাত ঘণ্টা চলার পর পৌঁছাবো ঢাকায়। হ্যাঁরে হ্যাঁ ঢাকা। রাজধানী। ঠাকুর স্যার আমাদের নিয়ে যাবেন। হ্যাঁ অবশ্যই... তোরাও যাবি... তোদের না খালি বড় বড় কথা! সামনে ম্যাট্রিক পরীক্ষা তো কী হয়েছে! দেখিস, আমি স্ট্যান্ড করবো! ওমা... মিষ্টি খাওয়াবো না আবার!’

মোবাইল বাজছে। হাতের কাছেই রাখা। কিন্তু ফোনটা ধরতে একদম ইচ্ছা করছে না বৃষ্টির। ডিসপ্লেতে দেখে রায়হানের নাম। অবশ্য নাম দেখার দরকার ছিল না। রায়হান ছাড়া অন্য কেউ তার নাম্বার জানেও না। আর জানবেই বা কে? সাতকূলে তো তার কেউ নেইও। ফোন রিসিভ করে বৃষ্টি।

‘হ্যালো, কী করছিলে?’
           ‘এইটা জানার জন্য ফোন দিয়েছো?’
           ‘আরে নাহ্, ধন্যবাদ দেয়ার জন্য ফোন দিয়েছি।’
           ‘কোন খুশিতে?’
           ‘আজকের লাঞ্চে চিংড়ি মাছের ভর্তাটা ফাটাফাটি ছিল...’
           ‘চিংড়ি মাছ না, জানো তো?’
           ‘হ্যাঁ হ্যাঁ জানি...’
           ‘লেখক হয়ে এমন ভুল করবে?’
           ‘শোনো, তিন মাসের বৈবাহিক অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বিয়ের পর লেখক আর লেখক থাকে না...’
           ‘কী হয়?’
           ‘হয় প্রেমিক না হয় শ্রমিক হয়ে যায়।’
           ‘তা তুমি কী হয়েছো?’
           ‘প্রেমিক ও শ্রমিক- যুগপৎ!’
           ‘ও আচ্ছা... তাহলে বিয়ের পর প্রেমিক হয়েছেন আপনি, আগে না?’
‘আরে না— আগেও তো প্রেমিক ছিলাম... উফ্ তুমি না খালি ভুল ধরো আমার!’
‘তা প্রেমিক সাহেব কখন আসবেন?’
           ‘তাড়াতাড়ি। যত দ্রুত সম্ভব। ঠিক আছে এখন রাখি।’
           ‘ওকে রাখো। বাই।’
‘বাই।’


৪.
‘মেঘলার ছোট খালা, মানে ছোট মা, মারা যান।
মেঘলা যেদিন ঢাকা থেকে ফিরলো, সেই রাতে। মেঘলা ঢাকায় জিততে পারে নি। সে জানে, সে ভালো ছবি এঁকেছিল। তবু সে পারে নি। ফিরতে ফিরতে ঠাকুর স্যার বলেছিলেন, মেঘলা মা, মন খারাপ করিস না। আমার নজরে তুই-ই সেরা। ওরা কারচুপি করছে করুক। জীবনটা তো আর কারচুপি না।
এ কথাটা মেঘলার খুব মনে ধরেছিল। জীবনটা তো আর কারচুপি না। মেঘলা ঘরে এসে, ব্যাগ থেকে বয়াম বের ক’রে, টেবিলে বইয়ের আড়ালে রেখে, শুয়ে গিয়েছিল।
ছোট মা’র গোঙানি পাওয়া গেল একটু পরেই। এত বছর পর, অনেক ডাক্তার কবিরাজের পর, ছোটমা’র পেটে বাচ্চা এসেছিল। সেই ফোলানো ফাঁপানো পেট ধরে গড়াগড়ি যেতে যেতে ছোট মা চিৎকার করে মেঘলাকে ডাকতে লাগলেন। মেঘলা বোধহয় ঘুমিয়েই গিয়েছিল, শুনতে পেল না। মৃত-বাচ্চা প্রসব করতে করতে, রক্তগঙ্গার ভেতর ছোট মা মারা গেলেন। ডাক্তার নিয়ে বাবা উপস্থিত হলে মেঘলার ঘুম ভাঙলো। ততক্ষণে মহল্লা তোলপাড়! দিক দিক থেকে মানুষ আসছে। মেঘলা বয়ামটা নিয়ে চুপচাপ বসেছিল নিজের ঘরের এক কোণে।
পরদিন সকালে ছোট মা’কে যখন তার মায়ের পাশে কবর দেয়ার কথা ঠিকঠাক হল, মেঘলা নিষেধ করলো তার বাবাকে। মেঘলার চোখে বাবা কী দেখলেন কে জানে, তবে দ্রুতই কবরের স্থান পরিবর্তন করলেন।’

এ পর্যন্ত লেখা। বৃষ্টি ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে বসলো। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ড্রেসিং টেবিলের সামনে। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে বের করলো একটা হরলিক্সের বয়াম। তাতে অসংখ্য পিঁপড়া। বয়ামটা উঁচু করে আয়নার সামনে ধরে বললো, রায়হান কী করে জানলো? তোরা বলেছিস? ...আবার নাকে নাকে বলছিস আমরা কিছুই বলি নি! তোরা না বললে কে বলবে? তোরা ছাড়া কে আছে আমার? কি? বলিস নি? মিথ্যা কথা মিথ্যা কথা মিথ্যা কথা!

টুংটাং। টুংটাং। কলিংবেলের শব্দ। বৃষ্টি তাড়াতাড়ি বয়ামটা ড্রয়ারের ভেতরে রাখলো। আয়নায় নিজের চুলটুল ঠিক করে নিলো। দরজাটা খুললো ঝটকায়। দেখলো কাজের বুয়া।
‘ও তুমি..’
‘হ আফা পোড়া কপাইল্যা আমিই। আর কে আইবো কন... কাম করতে করতে হাতে পইড়লো ফোস্কা, তাও কাম শ্যাষই হইলো না। কী, কাপড় ধোয়ান লাগবো, নাকি খালি ঘর মুছবো— কন।’
কথা বলতে বলতে বুয়া ঘরের ভেতরে ঢোকে। পানি নেয়ার জন্য বাথরুমের দরজা খুলেই চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘ও আল্লা গো... ও আফা গো... দেখেন দেখেন, কত পিঁপড়া কত্ত পিঁপড়া... লাক লাক পিঁপড়া... ও মাগো... আফা ঘরে কি কেরোসিন আছে?’
বুয়া মগে পানি নিয়ে পিঁপড়াগুলোর উপর ঢালতে থাকে। বৃষ্টি দৌড়ে এসে এক ধাক্কায় বুয়াকে সরিয়ে দেয়। চিৎকার করে বলে, ওদের মারবি না খবরদার। যা যা এখান থেকে হারামজাদি! যা।
স্পষ্ট গালিগালাজ করতে করতে বুয়া চলে যায়। যাওয়ার আগে বৃষ্টির কাণ্ড দেখে হতবাক হয়ে যায়। পানিতে ভেসে যাওয়া পিঁপড়াগুলোকে বৃষ্টি তখন ছেঁকে ছেঁকে উদ্ধার করে আনছে পরম মমতায়।


৫.
রাতের খাবারের পর ঝুলবারান্দায় গিয়ে রায়হান সাধারণত একটা সিগারেট খায়। আজ পরপর দুটা টানলো। মাথা কাজ করছে না। গল্পের পরের অংশ ভাবতে চেষ্টা করছে, পারছে না। অথচ কালই গল্পটা পাঠাতে হবে। বৃষ্টি এসে দাঁড়িয়েছে। রান্নাঘরের কাজ বোধহয় শেষ। বিদ্যুৎ গেল। রায়হান উঠে গিয়ে চার্জারলাইট অন করে।
বৃষ্টি বলে, কী হয়েছে, মুড অফ?
রায়হান চার্জারলাইট টেবিলের উপর রাখে। ঘর আধো অন্ধকার। হালকা বাতাস হচ্ছে। ঝুলবারান্দা লাগোয়া ঘরের জানালার পর্দাগুলো অল্প অল্প কাঁপছে। রায়হান বলে, পর্দাগুলো বদলাতে হবে। আরেকটু ভারী পর্দা দরকার।
           ‘এই জন্য তোমার মুড অফ?’
           ‘আরে না... মুড অফ ঠিক না... গল্পটার শেষ পাচ্ছি না, বুঝছো?’
           ‘কোন গল্পের?’
           ‘ওই যে তোমাকে শুনিয়েছিলাম... মেঘলার গল্প!’
           ‘আমি বলি গল্পের শেষটা?’
           ‘তুমিও যে গল্প লেখো তা তো জানতাম না... পেটে লাথ-টাথ মারার ইচ্ছা আছে নাকি! হা হা...!! ’
           ‘বলবো নাকি বলো... মেঘলার ছোট মা মারা গেল... তারপর তো?’
           ‘তুমি পড়েছ?’

রায়হানের কথা যেন ঠিক শুনতে পায় না বৃষ্টি। কেমন ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে সে। তার চোখ ধীরে ধীরে যেন দূর অন্য কোনো দিগন্তের সন্ধানে স্থির হয়ে গেছে।
কেমন রিনরিনে কণ্ঠে বলে, ‘ঢাকা থেকে ফিরলো যে রাতে, সে রাতেই মেঘলার ছোট মা মারা গেলেন। কেন? বাচ্চা হতে গিয়ে। কিন্তু মেঘলার কি কোনো দোষ ছিল তাতে? ছিল না।
ম্যাট্রিকে মেঘলা কথা রাখে— স্ট্যান্ড করে। বাবা খুব খুশি হন। শহর থেকে মিষ্টি আসে। প্যাকেট প্যাকেট মিষ্টি বিলি হয় পাড়ায় পাড়ায়। মেঘলার বয়ামের পিঁপড়াগুলো যে কী ভীষণ খুশি হয়! বয়ামটা টেবিলের ওপর রেখে মেঘলা তাদের জিজ্ঞেস করে, কি মিষ্টি কেমন হয়েছে? ভালো তো হবেই! আব্বা নিয়ে এসছে শহর থেকে। আমি আমার কথা রাখলাম, এবার তোরা তোদের কথা রাখ! কী, না না কিসের শক্ত কাজ! আব্বা রোজ মটর সাইকেল নিয়ে বাজারে যায় না, তাহলে? শোন, ঠাকুর স্যারের ওই কথাটা মনে আছে তো? হ্যাঁ হ্যাঁ জীবনটা কারচুপি না। যে কারচুপি করবে, তার ফল তো ভোগ করতেই হবে! সব জেনে না জানার ভাব করিস না। মনে নাই, ছোটখালা আর আব্বা মিলে মাকে বিষ খাইয়েছিল। আছে, মনে আছে... তাইলে? আরো মিষ্টি পাবি... আরে আমি এনে দিবো! আর এখানে আমি থাকবো নাকি? ঢাকা চলে যাবো! ওখানে কত গাড়ি, কত বাড়ি, কত বইয়ের দোকান... ওখানে অনেক পড়ালেখা করা যাবে। বড় বড় কলেজও আছে। হ্যাঁ হ্যাঁ তোরাও যাবি আমার সঙ্গে, তোরা ছাড়া আমার আর কে আছে?’
‘পরেরদিন সকালে বাবা রোজকার মতো বাইরে যান। যাওয়ার আগে মেঘলাকে জিজ্ঞেস করেন কিছু নিয়ে আসতে হবে কিনা! বৃষ্টি মুচকি হেসে বলে, আব্বা তুমি ফিরে এসো তাহলেই হবে!
বাবা হাসতে হাসতে বেরিয়ে যান মটরসাইকেল নিয়ে। বাজারের মোড়টা পেরোতেই একটা ট্রাক হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হয়ে ধাক্কা দিয়ে মটর সাইকেলটাকে চ্যাপ্টা করে চলে যায়। বাবা হেলমেট পরে ছিলেন না, থাকলেও বাঁচতেন না। ট্রাকের একটি চাকা তার বুক ও মাথার উপর দিয়ে গিয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলে মাথাটা নাকি বেলের মতো ফটাশ আওয়াজে ফেটে যায়।’

জোরে বাতাস হচ্ছে। জানালার পাশে ছোট্ট টেবিলের উপর রাখা সিরামিকের ফুলদানিটা মেঝেতে পড়ে ফটাশ শব্দে। ভাঙে না, মেঝেতেই এদিক ওদিক গড়াগড়ি খায়। রায়হান কিছুক্ষণ ফুলদানিটার এদিক ওদিক গড়াগড়ি দেখে। তারপর জানালা বন্ধ করে দেয়। ফুলদানিটা আবার উঠিয়ে রাখে জায়গা মতো। বলে, তাহলে বাবাও মরলো...?
বৃষ্টি আগের মতোই ঘোর লাগা কণ্ঠে বলে, ‘হ্যাঁ আব্বাও মরলো। আর কোনো বাধা ছিল না। নিজের যা কিছু সঞ্চয় সব নিয়ে ঢাকায় চলে আসে মেঘলা। ঠাকুর স্যার এ সময় খুব হেল্প করেন। মহিলা হোস্টেলে ওঠা, কলেজে ভর্তি করা। এমনকি একটা পত্রিকা অফিসে শিক্ষানবিশ হিশেবে ছোট একটা চাকরিও জুটিয়ে দেন তিনি। ঠাকুর স্যারের জন্য কৃতজ্ঞতায় মন ভরে যায়। কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষার পর, ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির সময়, ঠাকুর স্যার খুব ঘন ঘন আসতে লাগলেন। সপ্তাহে দুবার, তিনবারও। একদিন এক আধা অন্ধকার রেস্তরাঁয় ঠাকুর স্যার হাত ধরে ফেললেন মেঘলার। বললেন, মেঘলা, শোনো, তুমি আর আমার ছাত্রী নও। আর ছাত্রী থাকলেই বা কি, তাই না? তোমাকে আমি বিয়ে করবো। তুমি কী বলো?
মেঘলা আর কী বলবে, চুপ করে তারকার পতন দেখে। হাতটি সে সরিয়ে নেয় না। ঠাকুর স্যার তাতে আরেকটু সাহস পান। বলেন, শোনো, তুমি যদি চাও তবে তোমার কাকিমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবো... তুমি এমনটা চাইতেই পারো, তাই না?
মেঘলা হাসে একটু। তারপর বলে, না ডিভোর্স দেয়ার দরকার নাই। কাকিমা আর আমি একসাথেই সংসার করতে পারবো, পারবো না?
           ‘খুব পারবে, খুব পারবে। তুমি আসলেই খুব বুদ্ধিমান মেয়ে। খুউব বুদ্ধিমান!’
ঠাকুর স্যারের সাথে মেঘলার আর কখনো দেখা হয় নি। শুনেছিল মধ্যরাতে বুকে ব্যথা নিয়ে তিনি মারা যান। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। সম্প্রতি ঠাকুর স্যারের মাংসপ্রীতি খুব বেড়েছিল। নিরামিষভোজী ঠাকুর স্যার হঠাৎই কাবাব আর মুরগির গ্রিলের ভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন।

সেরা বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হতে পারে মেঘলা। না পারার তো কোনো কারণ নেই। সেরা ছাত্রী সে। থার্ড ইয়ারের শেষের দিকে পরিচিত হয় এক ছেলের সাথে। কর্পোরেট কবি। হ্যাঁ এ নামেই তাকে ডাকতো সে। কী যে মিষ্টি ছেলেটার হাসি, চুল। এমনকি তার চোখের চশমাটা পর্যন্ত সুন্দর। শাহবাগ, রমনা, টিএসসি করে খুব বেশি দিন না কাটিয়ে বিয়ে করে ফেললো তারা। দুজনারই কেউ নাই, তাই বিয়েতে কোনো হাঙ্গামা হলো না। ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে উঠে এলো তারা। কিন্তু এই বিয়েতে খুব কষ্ট হলো মেঘলার ইজিজিদের। হ্যাঁ, বয়াম-ভরা সেই পিঁপড়াগুলোর। মেঘলা আগে সারা দিনরাত ওদেরকেই সময় দিতো, ভালোবাসতো, কথা বলতো; কিন্তু স্বামী পাবার পর সেই ভালোবাসা কই, সেই সময় কই? ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ারে, অন্ধকারে, তাদের দিন কাটে। তাদের কোনো কিছু ভালো লাগে না। তাই তারা মেঘলার হাজব্যান্ডকে একদিন সব জানিয়ে দিলো। মেঘলার জীবনের সব ঘটনা এক এক করে বলে ফেললো। তারা ছাড়া মেঘলার জীবনের আর সাক্ষী কে?

মেঘলা কি রাগ করলো? কে জানে! ইজিজিদের সাথে তার খুব ক’রে ঝগড়া হলো। একদিন হাজব্যান্ডকে নিয়ে বেড়াতে বের হলো মেঘলা। রিকশায় ঘুরতে তাদের কী যে ভালো লাগছিল! হঠাৎ কোন দিক থেকে একটা বাস এসে ধাক্কা দিল রিকশাটাকে। মেঘলা কিভাবে কিভাবে যেন রিকশাতেই বসে থাকলো, কিন্তু স্বামী বেচারা পড়ে গেল। গড়াতে গড়াতে গিয়ে আটকালো নর্দমার পাশে। আর একটা মাইক্রোবাস কোনোভাবেই ব্রেক কষতে না পেরে উঠে গেল তার ওপর। সেদিন মেঘলা তার বয়ামটা বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে এলো। এরচেয়ে বেশি কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।’

বিদ্যুৎ এসেছে। ঘর আলোয় ঝলমল করে উঠলো। রায়হান চার্জারলাইট বন্ধ করে। বলে, বাহ, তোমার এ গুণের কথা তো জানতাম না! দারুণ বলেছো গল্পটা। এখন হুবহু লিখতে পারলেই হয়! ফাটিয়ে দেয়া একটা গল্প হবে!
বৃষ্টি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে, রায়হান, এটা গল্প না, সত্যি...!
           ‘দেখো এই ভররাত্রে মশকরা ক’রো না। আমি ল্যাপটপটা নিয়ে আসি। তুমি পাশে থেকে দেখো, গল্পটা ঠিক ঠিক যাচ্ছে কিনা!’
হঠাৎই চিৎকার করে উঠলো বৃষ্টি, ‘বললাম না এটা গল্প না, সত্যি ঘটনা!’ বৃষ্টির চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে। তার এমন চেহারা কখনো দেখেনি রায়হান। রায়হান বিস্ময়ের সাথে জানতে চাইলো, কী হয়েছে তোমার?

বৃষ্টি একছুটে পাশের ঘর থেকে পিঁপড়াভর্তি বয়ামটা নিয়ে আসে। রায়হানের সামনে রাখে। ঘাড় বাঁকা ক’রে, চোখে অদ্ভুত শূন্যতা ধরে রেখে বলে, দেখো... ইজিজির বয়ামটা দেখো। আমার নামই মেঘলা। গ্রামে আমাকে সবাই মেঘলা নামেই চিনতো! ঢাকায় এসে পরিচয় গোপনের জন্য মেঘলা থেকে বৃষ্টি হই আমি। তুমি যাদের কথা লিখেছো, আমি যাদের কথা বলেছি, কাউকেই আমি মারিনি। অবশ্যই আমি মারিনি। না, আমার ইজিজিরাও মারেনি। তারা মরেছে নিজেদের পাপে। ইজিজিরা অনেক ভালো, অনেক ভালো। তুমি আসার আগে তারাই আমার জীবনের সব ছিল, সব। কিন্তু তুমি সাবধান, রায়হান, সাবধান। তোমাকে ভালোবাসার পর তারা কেমন বদলাতে শুরু করেছে। আমার কথাও ঠিকমতো শোনে না। রায়হান, তোমাকে যেমন আমি ভালোবাসি, ওদেরও ভালোবাসি। প্লিজ, তুমি রাগ করো না ওদের মতো..’
রায়হানের দৃষ্টি এলোমেলো। সে একবার বৃষ্টিকে দেখছে, একবার বয়ামটা দেখছে। বৃষ্টির চোখ থেকে করুণ প্রার্থনা ঠিকড়ে পড়ছে।


৬.
কাইসারের সাথে পূর্বপরিচয় ছিল রায়হানের। এক সময় একই এলাকায় বসবাস করতো তারা। কাইসার বাইরে থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে প্র্যাকটিস শুরু করেছে। সাইক্রিয়াটিস্ট। মনোরোগবিশেষজ্ঞ। বৃষ্টিকে কাইসারের কাছে নেয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় রায়হানের জানা ছিল না।
কাইসার একটু পরীক্ষা-টরীক্ষা করলো বৃষ্টিকে। তারপর বললো, সব ঠিক আছে।
বৃষ্টিকে পাশের ঘরে বসতে দিয়ে সিগারেট খাবার কথা বলে দু’জনে একটু আলাদা হলো। চেম্বারের পেছনে ছোটমতো একটা বারান্দা আছে, সেখানেই দাঁড়ালো তারা। নিচ দিয়ে গাড়ির সমুদ্র বয়ে যাচ্ছে লাখ লাখ পিঁপড়ার মতো। উপমাটা ভেবে একটু হাসলো রায়হান। তা দেখে কাইসার জিজ্ঞেস করলো, হাসছো কেন?
রায়হান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললো, রাস্তার গাড়িগুলো দেখো, ঠিক যেন পিঁপড়ার সারি!
কাইসার চুইংগামের র‌্যাপার খুলতে খুলতে বললো, ফরেনে গিয়ে এই লাভটাই হয়েছে শুধু, সিগারেটটা ছাড়তে পেরেছি! যাই হোক, বৃষ্টির যে শারীরিক কোনো সমস্যা নাই এটা তুমিও ভালো জানো। সমস্যা মনের। এখন তুমি যা বলেছো আমাকে, তার সোজা অর্থ দাঁড়ায় তোমার গল্পের চরিত্র আর নিজেকে সে একাকার করে ফেলেছে। এটা ডাবলক্যারেক্টার প্লে করা। বাইরে এরকম অনেক কেস ফেস করেছি, স্টাডি করেছি আমরা। ইনফ্যাক্ট, সাইক্রিয়াটিস্টদের কাছে এরকম কেস বলা যায় নর্মালই।
রায়হান সিগারেটের ছাই ফেলতে ফেলতে বলে, নর্মাল? এইটা নর্মাল? মেঘলাকে রীতিমত আত্মস্থ করে ফেলেছে বৃষ্টি!
          ‘একা একা থাকে বাসায়। তোমার গল্প পড়তে পড়তে একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। ছেলেবেলায় যখন ফিল্ম দেখতাম আমরা, একটা ফিল্ম দেখা শেষ করার পর কিছুক্ষণের জন্য হলেও ওই ফিল্মের হিরো মনে হতো না নিজেকে? কত বাচ্চাদের দেখবে তাদের প্রিয় কার্টুন ক্যারেক্টার প্রিটেন্ড-প্লে করছে! শৈশবে তো আমি নিজেকে স্পাইডারম্যান ভাবতাম! শূন্যে হাত ছুঁড়ে দিয়ে জাল বের হচ্ছে কিনা দেখতাম। বৃষ্টি ঠিক তাই করছে। মেঘলার ভিতর হয়তো নিজের কোনো ছায়া পেয়েছে। বৃষ্টির মাও তো শৈশবেই মারা গেছে... সো... বুঝতেই পারছো!
           ‘আর পিঁপড়া ভর্তি ওই বয়ামটা?’
           ‘মধ্যবিত্ত বাঙালির ঘরে-ঘরেই হরলিক্সের বয়াম আছে। খোঁজ করলে তোমার ঘরেও দু’চারটা পাওয়া যাবে। তোমার গল্প পড়ার পর বৃষ্টি নিজে নিজেই ওই বয়ামে পিঁপড়া ভরেছে, সেটাই স্বাভাবিক না? দুশ্চিন্তা ক’রো না। কিছু মেডিসিন তো দিচ্ছিই, তবে সবচে’ প্রয়োজন রেস্ট আর কী বলে বাংলায়... হ্যাঁ, সহমর্মিতা। ওকে সময় দাও। সাথে সাথে থাকো। ঠিক হয়ে যাবে।’

কাইসারের কাছে বিদায় নিয়ে বৃষ্টি ও রায়হান বেরিয়ে আসে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টি দেখেই বৃষ্টির মন ভালো হয়ে যায়। বলে, দেখো দেখো... বৃষ্টি শুরু হয়েছে... ও কর্পোরেট কবি, আমি কিন্তু ভিজবো... ভিজবো ভিজবো ভিজবো!

রায়হান হাসে। একটা রিকশাওয়ালাও জুটে যায়। রিকশায় বসতে বসতেই ঝেপে বৃষ্টি নামে। রাস্তা জুড়ে শহুরে মানুষদের ছোটাছুটি। সবাই আড়াল চায়, ছাদ চায়। কিছুক্ষণের মধ্যে রাস্তা বেশ ফাঁকা হয়ে আসে। রিকশাওয়ালা তার মাথার ক্যাপ খুলে রিকশার হ্যান্ডেলের সাথে আটকে নেয়। বলে, সার, আইজ ধুমায়ে বিরিস্টি হইবো...
রায়হান বলে, একটু সাবধানে চালাও...!
বৃষ্টি তার হাত সামনে বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা ধরার চেষ্টা করছে। গানও গাইছে নাকি গুনগুন করে?

রিকশা বড় রাস্তা ছেড়ে একটা উপরাস্তায় নেমে আসে। বৃষ্টির গতি রিকশার গতির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এরমধ্যেই রাস্তায় পানি জমতে শুরু করেছে। হঠাৎই, পেছন থেকে রিকশাটাকে, কে যেন ধাক্কা মারে। রিকশাওয়ালা হ্যান্ডেল প্যাডেল ফসকে পড়ে যায়। ছিটকে পড়ে রায়হানও। ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে গড়াতে গড়াতে একবারে নালার পাশে ঘাড়ে বেদম একটা ধাক্কা খেয়ে থামে। ঝটপট ওঠার চেষ্টা করে রায়হান। বৃষ্টির কিছু হলো কিনা দেখার চেষ্টা করে। বৃষ্টির প্রবল ধারার মধ্যে ঝাপসাভাবে দূরে বৃষ্টিকে দেখতে পায়। রিকশায় সে ঠাঁয় বসে আছে। আর তখনই, সেই রাত্রে বলা বৃষ্টির গল্পের শেষ অংশ, মনে পড়ে যায় রায়হানের।
বাম হাতের কব্জিতে সে প্রথম পিঁপড়াটা দেখে, তারপর বাহুতে দেখে আরেকটা। মাথার চুলের ভেতর থেকে অসংখ্য পিঁপড়া যেন বেরিয়ে আসছে যাদুমন্ত্রবলে। কী কারণে ঘাড়টা বাঁকায় জানে না রায়হান, কিন্তু বাঁকিয়েই দেখতে পায় রাস্তার বিপরীত দিক থেকে একটা মাতাল মাইক্রোবাস সোজা তার দিকেই ছুটে আসছে। বিহ্বল রায়হান আরেকবার বৃষ্টিকে দেখতে চায়, তার মনে হয় বৃষ্টি কাঁদছে। তবে এ দেখা তার কল্পনা প্রসূত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা এত বৃষ্টির মধ্যে বৃষ্টির কান্না দেখতে পাবার কথা না রায়হানের।




:::প্রকাশ:::
http://www.banglanews24.com/beta/fullnews/bn/253936.html

বৃক্ষ বৃহন্নলা





ঘর হতে দু’পা ফেলতেই শিমুলের গাছ। শুনলে মানুষ আশ্চর্য হয় যে শিমুল গাছটা আমার প্রিয়। পুরনো গাছ তাই গোড়াটা তার গর্ভবতী মহিলার মতো। গোড়ার একটা অংশ এমনভাবে খাঁজ হয়ে আছে যেন কোনো তরুণী নিতম্ব। আমার প্রিয় অবশ্য সে কারণে না, বা সে কারণেও।

আর গায়ে কাঁটা। বয়স্কার স্তনের বোঁটার মতো লম্বা লম্বা কাঁটা, তীক্ষ্ণ, সুঁচালো। আর চারদিকে দুই হাত বাড়িয়ে দাঁড়ানো কাকতাড়ুয়ার মতোন ডাল। ডালে যখন শিমুল ফুল ধরে তখন মনে হয় এলাকাজুড়ে হোলি খেলা হচ্ছে। লাল লাল লাল। চোখের মণির রঙ তখন কিছুদিন লাল হয়ে থাকে। মণির লাল বুকে গিয়ে জমে। একমাস দুইমাস তিনমাস সেই লাল বুকের ভিতর জমে জমে একটা পাখি হয়ে যায়। পাখি তখন কিচির মিচির করে, ডাকাডাকি করে, উড়ে গিয়ে শিমুল গাছে বসতে চায়। শিমুল গাছে তখন কিন্তু সাদা। ফল তখন ফাটছে, ফেটে উড়ে যাচ্ছে। উড়তে উড়তে দূরে যাচ্ছে। যেতে যেতে ঘুরে যাচ্ছে। জোৎস্নায় পাঁক খাওয়া হাওয়ার মধ্যে শিমুল তুলোর ভ্রমণ আমাকে আছড়ে মারে। শ্বাসরোধ হয়ে আসে, মনে হয় আকাশ খুলে যাচ্ছে, পাতাল উঠে যাচ্ছে, মেঘ এসে হৃদয় ফুঁড়ে ঢুকে যাচ্ছে শরীরের ভেতর।

ফলে শিমুল গাছটা আমার আত্মীয়, প্রেমের কাছাকাছি। প্রেম তবে গোপন প্রেম, পরকীয়ার মতোন গোপন।

আমার একটা জাগতিক প্রেম আছে। একটা নারী। পুরুষও হতে পারতো, তবে হয়নি। প্রেমটা এই শিমুল গাছের কাছাকাছি সুন্দর। উনিশ বিশ। উনিশ নারী, বিশ শিমুল গাছ। নারীর কাছে গেলে খালি শিমুল গাছে কথা মনে আসে— অথচ তার গায়ে কাঁটা নেই। তার স্তন তরুণ, গ্রীবা আলোকিত, ঘ্রাণ মোহনীয়, দৃষ্টি প্রসারিত, ওষ্ঠ গোলাপমথিত। তবু তার কাছে গেলে, তার সাথে দাঁড়ালে বা বসলে বা শুলে— শোওয়ার কিছুটা সময় ছাড়া আমার খালি শিমুল গাছটার কথা মনে হয়। এ কথা সে জানে। কিভাবে কিভাবে জানি জানে। আমি বলিনি, শিমুল গাছটাও বলে নাই, তবু জানে।

একদিন তার বুকের ওপর জাগতে জাগতে তুলোর উড়ে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম তখন সে, নারীটা, আমাকে বললো প্রথম। বললো যে জানে। বললো নানা কথা বা একটা কথা। তখন আমার খালি শোনার সময় ছিল বলে বলছিলাম না কিছু। সে বললো, নারীটা বললো, তুমার আর কেউ আছে না? আরেকটা কেউ?

আমি সাধারণ পুরুষের মতোই অস্বীকার করলাম সাথে সাথে। বললাম, যদিও বলতে ইচ্ছা করছিল না আসলে, মনে হচ্ছিল হুদা কথা বলে লাভ নাই, এদের বলে তো লাভ নাই, তাও বললাম— যে কিছু কথা নিজের সাথেও বলে নেয়া যায় বা নারীটাকেই বললাম, নাতো, কেউ নাই তো! ‘না তুমার আর কেউ তো আছেই। নাইলে একবার যে মাংস খায় সে বারবার খাইতে চায়— আর তুমি এ মহল্লা মাড়াও না— তুমাকে ডাইকা ডাইকা আনতে হয়... তুমি কোন পিরফকির! এখন কও ওই বেটি কোই থাকে?’

কার কথা বলছে ব্যস্ততায় বুঝতে পারি না। অথবা বুঝতে আমি ঠিকই পারি, কিন্তু নিজেকে বোঝাই যে আমি বুঝতে পারছি না। নারী নারীর মতোই কাতরাতে থাকে, বলতেই থাকে। মনে হয় যে ঘ্যানঘ্যান করছে, স্পষ্ট খারাপ লাগে বিরক্ত লাগে, কিন্তু এ মুহূর্তেই তাকে ছেড়ে দেয়াও যায় না। শরীর ছাড়তে দেয় না। ফলে দাবি ও দ্বন্দ্বের ভেতর আমার শেষ হয়। শেষটা ভালো হয় না ফলে। শেষটা এক ধরনের খারাপ হয়। শেষটা হুদামার্কা হয়। তখন মনেহয় শুরু না হলেই ভালো হতো। হুদাই শুরু হয়েছিল। তখন আবার শিমুল গাছটার কথা মনে হয়। মনে হয় যে শিমুল গাছটার একটা ভাঁজ তরুণীর খাঁজের মতো। মনে হয় নারীটার চেয়ে শিমুল গাছটাতে বেশি কাম আছে। তখন অঙ্ক পাল্টে যায়। গণিত পাল্টে যায়। এএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ঝুলে যায়। প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। ফাঁস হয়ে গেলে আমার সিগারেট কেঁপে যায়, আগুন কেঁপে যায়। নারীটা তখন পেঁচাতে চায়। শরীরের সাথে পেঁচায়, মনের সাথে পেঁচায়। তখন নারীটাকে সাপ মনে হলো। মনে হলো যে আমি টারজান এক। বনের রাজা। নারীটা তখন বললো, বালের রাজা। খালি ফাইট্টা যায়। আমার প্যাট হবে রাজার জন্যি।

আমি বললাম, মানে হুদাই বললাম, এখন মার্কেটে আর রাজা নাই। এগুলান অন্য। নারী বললো, সব কন্ডোমই রাজা। আমার বাপে রাজাই ইউজ করতো। আমি জইন্মা যা চিনছি তার নাম রাজা! আমি বললাম, তাই তুমার পরেও তিনটা... তুমার বাপের খালি ফাইট্টা যাইতো? নারী বললো, বাজে কথা রাখো। তুমার লাইফে আর কে আসছে কউ? সে লাড়কি কই থাকে? কী করে? আমি বললাম, কেউ নাই। কুনো লাড়কি নাই। নারী বললো, লাড়কি নাই তাইলে কি আওরাত? তুমি এখন আওরাত লাগাও? কয় পোলার আওরাত লাগাও?

আমার অঙ্ক আবারো ভুল হয়ে যায়। শিমুল গাছ নব্বই হয়ে যায়। আমি শিমুল গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াই। বয়স্ক স্তনের বোঁটার মতো কাঁটা। শিমুল গাছের মাথার ওপর দিয়ে মেঘ চলে যায়। সাঁই সাঁই করে চলে যায়। শিমুল গাছের তুলো ওড়ে। স্বপ্নের মতো তুলো ওড়ে। উড়তেই থাকে, উড়তেই থাকে।

শিমুল গাছটার পাশ দিয়ে একটা নদী থাকতে পারতো, থাকলেই ভালো হতো মনে হয়, তবে না থাকলেও তেমন ক্ষতি কিছু তো নাই। নদী নিজেই বানায়ে নেয়া যায়। ছোটতে দলবল নিয়ে বানাতাম, দলবলের সময় শেষ হয়েছে, এখন যা করার করতে হয় একা। প্যান্ট খুললাম, আসলে প্যান্ট খুললাম না; জিপার খুললাম। জিপার একটু কেতাবি হয়ে গেল— আসলে প্যান্টের চেইন খুলে ফেললাম—  আসলে শুধু খুললাম, কিন্তু ফেললাম না। কিন্তু খুলে যে ফেললাম তাও ভাবলাম, বা আসলে ভাবলামও না। বেশি ভাবাভাবির ভেতর না থাকাই ভালো।

আরাম করে নদী বানানো শুরু করলাম। নদী বয়ে যেতে থাকলো ধুলো গড়িয়ে বালি গড়িয়ে। নদী বাঁক নিলো, ফের বাঁক নিলো, তারপর ধীরে ধীরে মুখ থুবড়ে মিলায়ে গেল।

নদী মিলিয়ে যায়, নদীরা মিলায়ে যায়। যেভাবে এক নদী ছিল আমার। ছোটবেলাকার নদী। ছোট নদী বাঁকা নদী। নদীটাতে ঢেউ ছিল না, তবে নাম ছিল— বিভিন্ন নাম ছিল— একেক জায়গায় একেক নাম ছিল। পূর্ণভবা ছিল আবার মহানন্দাও ছিল, আরো কিছু নাম ভিন্ন কিছু নাম থাকতে পারে। ছোট নদীতেও বড় বড় নৌকা আসতো। পালতোলা নৌকা আসতো, খয়েরি আর সাদা পাল। ছেঁড়া পাল, মাঝে মাঝে ভালো পালও আসতো— সংখ্যায় কম। পেটটা ফুলিয়ে আসতো, দুলিয়ে আসতো, ঝুলিয়ে আসতো। তারপর রাতভর ভোরভর মাল নামতো, লবণ নামতো, চিনি নামতো, গুরপাটালি নামতো, মাল নামতো, কাপড় নামতো, মাটির হাড়ি নামতো, মাল নামতো... সকাল সকাল মাঝিরা চুলা জ্বালাতো, চুলা নৌকার ওপরই জ্বলতো। নদীর ওপর নৌকা, নৌকার ওপর দিয়ে সরু ধোয়া উড়ে যেতো আকাশে, আকাশে গিয়ে মেঘ হয়ে যেতো।

তখন নিমের দাতন ঘষতে ঘষতে নদী, ঘুরতে ঘুরতে নদী, হুদাই হাঁটতে হাঁটতে নদী, বেলা কাটাতে নদী, নদী কাটাতে নদী। নদীতে তখন সকাল, ভাপ ওঠা সকাল, ঝুলে থাকা লম্বা সকাল। আর সকালে আসতো মুয়াজ্জিন মতি। সাদা আলখেল্লার মতি। দেখলেই সালাম নিতো। সালাম নেয়ার জন্যে চোখের ওপর তাকিয়ে থাকতো। চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতো। চোখের ভিতর তাকিয়ে থাকতো।

তারপর লুঙ্গি তুলে নদীর ঢালে, শিয়ালকাঁটার ঝোপে বসে যেতো মুততে। তখন মুততেই বলা হতো, নাইলে পেশতাব বলা হতো। হাইস্কুলের হেডসার একদিন বললো, বললো মানে জানালো যে পেশতাব বলা যাবে না মুততে বলা যাবে না। এগুলান বললে মান থাকে না। শুনতে খ্যাত লাগে। শুনতে চাষাভুষা লাগে, কুলি মজুর লাগে। চামার চামার লাগে। আমরা তখন থেকে পেশাব বলতে লাগলাম। কারো পেশাব লাগলে ক্লাসে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বলতো, সার আমার পোশ্তাব লাগছে... পোশ্আব লাগছে... নুনু টাইট সার যাইতে দ্যান!

তো মুয়াজ্জিন মতি আজিবভাবে মুততো। জুব্বা গুটিয়ে, লুঙ্গি উঠিয়ে, কালো কালো দুইটা বিচি ঝুলিয়ে, পায়ের গোরা ভাসিয়ে মুততো। তারপর ঘটাতো আরো আজিব ঘটনা। লুঙ্গির ভিতরে আস্ত একটা ঢিল ঢুকিয়ে নিতো, নিয়ে দারুণভাবে নাড়াতে থাকতো লুঙ্গির ভিতরটা, নাড়াতে বোধহয় তার খুব ভালো লাগতো, নাড়াতে নাড়াতে তার মুখ কেমন জানি হয়ে যেতো, চোখ বন্ধ হয়ে যেতো, চোখ কেমন জানি ঘুলঘুলি হয়ে যেতো। তারপর আ আ করে করতে করতে ঢিলটা বের করতো। ঢিলটা পেশতাবে বা অন্য কিছুতে ভিজে থাকতো। ভিজে আরো কালো হয়ে যেতো। সেই কালো রঙের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মতি ঢিলটা ফেলে দিতো। তারপর সে একবার ফেলে দেয়া ঢিলের দিকে একবার আমার দিকে তাকাতো। তার তাকানোটা কেমন যেন ছিল, ওই বয়সে আমি বুঝতাম না, বা বুঝতাম আসলে কিছুটা, সম্পূর্ণ বুঝতাম না, যতোটা বুঝতাম তাও বলতাম না কাউকে। কিছুটা তো বুঝতাম— এ কারণে মুয়াজ্জিন মতি যেখানে আমি তার থেকে একশ হাত পাঁচশ হাত দূরে, তার হাত থেকে দূরে, তার ঘামের গন্ধ থেকে দূরে, মুখের জর্দার গন্ধ থেকে দূরে...

কিন্তু আসমা দূরে যেতে পারেনি। গোবরকুড়ানি আসমা। নয় দশ বছর বয়সের আসমা। হাতে একটা ডালি নিয়ে, হাটবাজার ঘুরে ঘুরে, সে গোবর কুড়াতো। গোবরের ডালি উপচে গেলে নিমতলায় গিয়ে জমা দিয়ে আসতো। এক ডালি গোবরের দাম ছিল দুই টাকা। আসমা সারা সারা দিন দশ পনের টাকা কামাই করে নিতো, তাই সে ইশকুল যেতো না, সে আমবাগান ঘুরে বেড়াতো, টমাটোর খেতের পাশে তাকে দেখা যেতো— গরু থাক আর না থাক দুয়েকটা টমাটো সে ডালিতে নিয়ে নিতে পারতো। নদী ডোবা ঘুরে বেড়াতো। শাপলা তুলতো খুব। হাটবারের এক সকালে নদী আসছিল আসমা। মুয়াজ্জিন মতি নিয়ম মতোই আসছিল, পেশাব করছিল, তার ভিতরেই আসমা আসছিল, তার ভিতরেই আসমাকে পেয়েছিল মতি, মুততে মুততে আসমাকে পেয়েছিল মতি।

অল্প বেলা বাড়তেই নৌকার মাঝিরা নৌকা রেখে হাট চলে যেত; নৌকাগুলান মাওরা হয়ে দীর্ঘক্ষণ নদীর তীরে ঝিমাতো, ঘুমাতো, ঘুমাতে ঘুমাতে আড়মোরা ভাঙতো। ফলে ওই ঘুমন্ত ঝিমন্ত দুলন্ত এক নৌকায় আসমার চিৎকার শোনা গেল— আসমার আওয়াজ কানে আসে, আসমার ভয় শোনা যায়। আমি কেনো যেন দৌড়াই, ছোট বলে দৌড়াই, এখন হলে নিশ্চয় দৌড়াতাম না, ভাবতাম যা হচ্ছে হোক— আমার আর কী!

আমি দৌড়াই। আমি যাই। ছোট বলে যাই। দৌড়াই আর যাই। দৌড়ে দৌড়ে যাই। তেরছা করে রাখা কাঠের সিঁড়ি ধুমধাম পেরিয়ে নৌকার ভেতর গিয়ে দেখি, মানে আধা অন্ধকারেই দেখি যে আসমার পায়জামাটা ছেঁড়া, ছিঁড়ে বিয়েবাড়ি সাজানোর পতাকার মতো ঝুলে আছে এদিক ওদিক, ফালি ফালি হয়ে আছে, আর আসমাও ফালি ফালি হয়ে আছে, দুমড়ে আছে, মুচড়ে আছে, বাঁকা হয়ে আছে, এখন ঘুমিয়ে বা মরে আছে— আর মুয়াজ্জিন মতি, লুঙ্গি ছাড়া মতি, একটা বাঁশের মতোন লম্বা হয়ে, পাছা উদাম করে পড়ে আছে আসমার ওপর। আর জীবন্ত ছিল অন্ধকার, মনে হয় অন্ধকারই সবচেয়ে জীবন্ত ছিল, অন্ধকার সবচেয়ে বেশি নড়ছিল, ঘুরছিল; খ্যাঁ খ্যাঁ করে এগিয়ে এসে ধমক দিচ্ছিল।

পরে মুয়াজ্জিন মতি আমাকে ধরেছিল, নানান কথাবার্তার ভেতর দিয়ে জানিয়ে ছিল কাউকে কিছু না জানাতে। যদি আমি জানাই, কাউকে কিছু বলি, বললে আমার অসুবিধা আছে, সমস্যা আছে, আমাকেও লাশ করে দিবে— লাশ করে শিমুল গাছের তলায় আসমার মতোন কবর দিয়ে দিবে— শিয়াল কুত্তায় খাবে। আমি ছোট ছিলাম তাই আমার কিছুটা সাহস ছিল, এখন আর সাহস নাই, তখন বেশ কিছুটা ছিল; মানে সাহসটা থাকা কিন্তু ভালো না, তাও ছিল। ছোটতে যা হয় আর কী! ভূত ভবিষ্যতের চিন্তা নাই— খালি ধানাই ফানাই— খালি ফালফালি— মানে চিন্তা থাকে না তো ও সময়। মনে হয় সব ভেঙে চুরে দিবো, যা কিছু খারাপ মন্দ কালো সব জ্বালিয়ে দিবো, নষ্ট করে দিবো, ভালো করে দিবো... এ রকম মনে হয়, তখন খুব জ্বালা ধরে, মাথা শনশন করে... ছোটতে মানুষের সাহস থাকে, আমারও ছিল, অল্প সাহস ছিল, কিন্তু ছিল। সাহস ছিল তাই আমি আমার বাপ-মাকে জানিয়ে দিই। আমার বাপের ক্ষমতা ছিল। মানে তার যেন ক্ষমতা থাকে এ রকম করেছিল এলাকাবাসী। ক’রে খুব মসিবতে পড়ে গিয়েছিল। আমার বাপ খারাপ চেয়ারম্যান হয়ে গিয়েছিল। আর খারাপ হওয়ার পর সে বারবার পাশ করতে লাগলো। তখন আর আমার বাপ ফেল করতো না। ফেল করতো না বলে বাপ আর ভালো হয়নি। বা এমনও হতে পারে ফেল করলে বাপ আরো খারাপ হতো, বারেবারে পাশ করায় আর বেশি খারাপ হতে পারে নাই।

তো আসমার কথা মতির কথা আমি মাকে বলি। বলি যে মতি আসমাকে করছে, মাকে বলি যে করছে তারপর মেরে ফেলেছে, দাফন দিছে, আমাকে মতি বলেছে যে মেরে ফেলেছে...

তখন মা জানায় আসমা মরে নাই। শিমুল গাছের তলায় তার কোনো কবর হয় নাই, আসমা মেডিকেলে আছে, বেঁচে আছে, সালামত আছে... আমি তখন আবার বলি যে মতি আসমাকে করছে, আসমা মরুক আর না মরুক আসমাকে করছে।

মা কিছু বলে না। মা চুপ থাকে। মনে হয় বলার কিছু থাকে না। তখন ছোট ছিলাম তাই সাহস ছিল কিছুটা। সাহস থাকার কারণে বিপদ ছিল। সাহস থাকলে বিপদ থাকা সম্ভব। বিপদ থাকবেই থাকবে। সাহস আর বিপদ জামা-জামা মানে জোড়া— মানে যমজ... সাহস আর বিপদ দুই ভাই। ভাই বা বোন একই কথা। ভাই বোন একই কথা মানে লিঙ্গ তো নাই। ভাইও যা বোনও তা— পার্থক্য নাই। সাহস থাকলে তাই বিপদ থাকবে। তাই বিপদে পড়লাম।

মুয়াজ্জিন মতি সব রাতেই আমাদের বাড়ি খেতে আসতো। গপাগপ খেতো। খেতে খেতে আঙুলের ফাঁক দিয়ে খাবার বেরিয়ে যেতো, মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেতো, ঠোঁটের কোণায় একলা খাবার ঝুলে থাকতো। তখন দেখতে তাকে দৈত্যের মতো লাগতো। কেহারমানের মতো লাগতো। কিন্তু মতি হা হা ক’রে হাসতো না, খালি গপাগপ গিলতো আর ফসফস আওয়াজ করতো, ঢকঢক পানি খেতো। আঙুলের ফাঁক দিয়ে খাবারের দুয়েকটা দানা বেরিয়ে যেতো। বেরিয়ে এদিকে ওদিকে পড়তো— তখন মতি চট করে খাবারগুলো তুলে নিতো। মুখে দিতো। বলতো ধর্মে একটা দানা নষ্ট করা নিষেধ আছে। দানা নষ্ট করা পাপ। সে খুব ধর্ম ধর্ম বলতো আর গিলতো। ধর্মের কথা বলতো, ধর্মের কত কথা বলতো, বলতো আর গিলতো, বলতে বলতে গিলতে গিলতে তার মুখ থেকে থুতু বেরোতে। থুতুগুলো ছিটে পড়তো তরকারির বাটিতে ডালের বাটিতে।

তো বাপ আর মতি মিলে বারান্দায় খাচ্ছিল। খুব শব্দ হওয়া টেবিল ফ্যানটা ঘরঘর করে ঘুরছিল। মনে হচ্ছিল ফ্যানের পাখাগুলো ফাঁক পেলে খুলে উড়েই যাবে। ঘরঘর করে ফ্যান ঘুরছিল— আমি তখন বাপ আর মতির সামনে দাঁড়াই। ষাট ওয়াটের বাল্বের সামনে গিয়ে দাঁড়াই, তখন আমার ছায়া লম্বা হয়। শরীরের থেকে ছায়া বড় হয়। আমি বাপের চেয়ে বড় হয়ে যাই, মতির চেয়ে বড় হয়ে যাই। তখন আমার আরো সাহস হয়। আমি বাপকে বলি, আব্বা আব্বা আপনে এ লোকের সাথে খায়েন না। এই লোকটারে তাড়ায়ে দেন। দূর করে দেন। বাড়ি থেকে বাহির করে দেন। দূর করে দেন। এই লোক বদ লোক। এই লোক মুছলমান না— এই লোক কাফির— জেনা করছে এই লোক— এই লোক আসমারে করছে— জেনা করছে— কইরা আসমারে মাইরা ফেলছে, মাইরা নদীর ধারের শিমুল তলায় পুতছে— হারমিটা নিজেই বলছে, হারামিটাকে বাহির করে দেন!

মা তখন বলে ওঠে না না আসমা মরে নাই মরে নাই, আসমা মেডিকেলে আছে, সালামত আছে, খোশহালে আছে... আসমা মেডিকেলে খোশহালে আছে!

মুয়াজ্জিন মতি তখন নাউজিবিল্লা বলে থালায় হাত ধোয়। হাত ধুয়ে ঘাড়ের গামছায় হাত মোছে। বাপও তখন খাওয়া শেষ করে, চুপচাপ খাওয়া শেষ করে। কলপাড়ে ধীরে ধীরে হাত পরিষ্কার করে। গরুর চর্বি পরিষ্কার হতে সময় লাগে। লাক্স সাবান সম্পূর্ণ চর্বি ওঠাতে পারে না। বাপে তখন কাপড় কাচা বল সাবান দিয়ে কচলে কচলে হাত ধোয়। মতি ততক্ষণে আঙিনায় দাঁড়ায়। মা তখন তাকে মোড়া এনে দেয়। মতি মোড়ায় বসে। বসে হামদ কি নাত গাইতে শুরু করে। গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করে। মতির কণ্ঠ ভালো— শুনতে ভালো লাগে। মতির হামদ কি নাত শুনতে ভালো লাগে, মতির কণ্ঠ সিরার মতো মিষ্টি লাগে।

কলপাড় থেকে এসেই বাপ হঠাৎ চড়াও হয়, চড়াও হয় আমার ওপর। বাপের হাতে গরু পেটানো লাঠি। বাপ পহেলা লাঠিটা আমার পিঠে আর পাছায় ভাঙে। মারতে মারতে বাপ গোঙাতে থাকে। কী কী যেন বলে। যত বড় মুখ না তত বড় কথা এ রকম কথা স্পষ্ট হয়, মানির মান রাখবার পারে না স্পষ্ট হয় তবে আর কিছু স্পষ্ট হয় না। বাপ খালি গোঙায়, বাপ বাংলা খেয়ে তালের রস খেয়ে যেমন গোঙায় তেমন গোঙাতে থাকে। মা কিছুই যেন হচ্ছে না, না কিছুই যেন হচ্ছে না এভাবে, খুব সাধারণভাবে, স্বাভাবিকভাবে, বারান্দায় বাসনকোসন গোছাতে থাকে। আঙিনায় হামদ কি নাত চলতে থাকে।

সে রাতেই বাপ আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। তাড়িয়ে দেয় মানে সোজা চলে যেতে বলে, বাইরের রাস্তা দেখিয়ে দেয়, দরজা দেখিয়ে দেয়। হয়তো ভাবছিল আমি যেতে চাইবো না, হাতে পায়ে ধরবো, কিন্তু তেমন কিছু হয় না। আমার একবার মনেও হয় হাতে-পায়ে ধরি, কিন্তু ধরতে পারি না। মনে জেদ হয়। সাহস থাকলে জেদও হয়। ছোটবেলায় সাহস জেদ বেশি থাকে। আমি চলে যাই। বাপ তখন মনে করে যে আমি কদিন পর ফিরে আসবো, যে পিঠের ব্যথা ভুলে গেলেই ফিরে আসবো। আমি যখন বেরোই তখন আমিও ভাবছিলাম কদিন পরেই ফিরে যাবো, কিন্তু আর যাওয়া হয় না। অনেক দিন হয়ে যায় আর যাওয়া হয় না। অনেক দিন পর যাওয়ার ইচ্ছাটা মরে যায়। মনে হয় কেনো যাবো বা এসব মনেও হয় না, কিছুই মনে হয় না— তবে আর যাওয়া হয় না।

তারপর একদিন এই শিমুল গাছটা পাই। একটা শিমুল গাছ, তাকে পাই। তখন শিমুল গাছের সাথে থাকতে শুরু করি। শিমুল গাছটাকে ভালোবাসতে শুরু করি। শিমুল গাছটাকে তখন মানুষ মনে হয়, নারী মনে হয়। আমার নারীর চেয়ে বেশি নম্বর পায় শিমুল গাছ। কখনো বিশ পায় কখনো নব্বই পায়, কিন্তু বেশি পায়। আমার নারীর চেয়ে নম্বর বেশি পায়, দিন দিন বেশি পায়।

যখন শিমুল তুলো উড়ে যায়, উড়ে উড়ে দূরে যায় তখন মনে হয় ফেরা যায়— রেখে আসা শৈশবে ফের যাই। যখন মেঘ ওড়ে মনে হয় মতির মুখোমুখি দাঁড়াই, বাপের মুখোমুখি দাঁড়াই, মায়ের মুখোমুখি দাঁড়াই।

কিন্তু আর সাহস নাই। কোনো সাহস অবশিষ্ট নাই। ছোটকালের সাহস নাই, জেদ নাই। সব চামচিকা হয়ে গেছে। চামচিকার মতোন ঝুলে গেছে। নারীটার সামনে একটু সাহস দেখাতে চাই। জোরে কথা বলি, গম্ভীর গলা করি, চোখ গরম করার চেষ্টা করি— কিন্তু হয় না। ঠিকঠাক হয় না। নারীটার ঠোঁটে ঝাঁজ বেশি। ঝাঁজে সাহস হারিয়ে যায়। সাহস গুম হয়ে যায়। সাহস সান্ধিয়ে যায়। সাহম চামচিকা হয়ে যায়।

নারীটা একদিন বলে, দিনে নাকি রাতে বলে? মানে একটা সময়ে বলে, বলে মানে ঝাঁজ তোলে, কণ্ঠে প্রশ্ন তোলে, প্রশ্নে সন্দেহ থাকে, জিজ্ঞাসা করে, ওই শিমুলতলায় তুমি কিসের জন্যি যাও? কুন খানকির কাছে যাও?

আমি কিছু বলি না। মানে বলতে গিয়ে ভাবি যে আসলে কিছু তো বলার নাই। একে কিছু তো বলার নাই। একে কিছু বলা বৃথা। পুরাটাই বৃথা। তখন আমি চুপ থাকি।

তখন নারীটা ফের বলে, একই রকম ঝাঁজ দিয়ে বলে বা ঝাঁজ বাড়িয়ে বলে, চুপ থাকলেই এর ঝাঁজ বাড়ে— এটা আরেক ঝামেলা যে চুপ থাকলেও এর ঝাঁজ বাড়ে, কমে না, ঝাঁজ কমাতে পারে না, নারীটা ঝাঁজ বাড়িয়ে নেয়, মুখ খারাপ করে। বলে, আসমা নামের মাগিটার সাথে তুমি ওখানে দেখা করো না? আসমার সাথে তুমার কী? তারে কয়বার করছো?

আমি তখন নারীটাকে একটা থাপ্পড় মারি। একটা থাপ্পড় তার গালে মারি। জোড়ে মারি। নারীটা উফ করে ওঠে। নারীটা বিছানায় বসে যায়। কিন্তু থাপ্পড় মারার পরও নিজেকে সাহসী মনে হয় না। মনে হয় না কোনো বীরের কাজ করলাম। তখন ভয় হয় খুব। কিসের ভয় বুঝতে পারি না। ফলে ভয় বাড়তে থাকে। ঘাম হতে থাকে। তখন তাকে ঠেলে আমি তার ঘর থেকে বেরিয়ে যাই। মনে হয় তার সাথে ভালোবাসা চুকে যায়, কাম চুকে যায়, প্রেম চুকে যায়, মন চুকে যায়, শরীর চুকে যায়। নারীটার সাথে সব চুকে যায়।

নারীটার কাছে আর কখনো যাই না। অনেকবার যাওয়ার ইচ্ছা হয় তারপর, হতেই থাকে। নারীটাও আসে। বিভিন্ন কথা বলে, কিন্তু তার কাছে আর কখনো যাই না। খুব যেতে ইচ্ছা করে, কিন্তু যাই না। শিমুল গাছটা যেতে বাধা দেয়। দু’হাত দিয়ে আটকে রাখে। তখন খালি ভয় হয়। মনে হয় সবকিছু চামচিকা হয়ে গেছে। সব কিছু সান্ধিয়ে গেছে।




:::প্রকাশ:::
http://www.banglanews24.com/beta/fullnews/bn/232869.html

আমি স্বর্গে যেতে চেয়েছিলাম


পেইন্টিং: ম্যাক্সিম শিয়াশোঁ


যাবো উত্তরা।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। তবে এটাই একমাত্র ভয় নয়— ভয়টা আমার ব্যাগে। অফিস থেকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছে— জায়গামতো পৌঁছে দিতে হবে। প্রেসের ছোট চাকরি আমার, নিতান্তই ছাপোষা মানুষ। ফলে কাঁধে ঝোলানো কালো ব্যাগের ভেতর যখন দুই দুইটা মোটা বান্ডেল তখন তিরিশটা গ্রীষ্মদগ্ধ এই বুকে কাঁপন জাগে।

তার-ওপর দাঁড়িয়ে আছি কুখ্যাত ফার্মগেটে। কুখ্যাত, কারণ এখান থেকেই আমি আমার আড়াই হাজার টাকার মোবাইলটা হারিয়েছিলাম। বাসে উঠতে গিয়ে বুঝেছিলাম আমার পকেট থেকে কে যেন গর্ভমুক্ত করলো মোবাইলটা।
কিছুই করতে পারি নি। কিছুই করার ছিল না আসলে। তবে পুরো ঘটনাটা বিশ্বাস করে উঠতে এক সপ্তাহ সময় লেগেছিল। আর ধাক্কাটা কেটেছিল প্রায় একমাস পর।

দাঁড়িয়ে আছি ফুটপাতে। জুতা স্যান্ডেলের পসরা সাজানো আছে। মানুষজন আসছে, দেখছে সে-পসরা, কিন্তু কিনছে না। মাসের প্রথম দিক চলছে... এখনই তো কেনার কথা। একটু দূরে যৌন বটিকা বিক্রি হচ্ছে। তাদের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে এ দুনিয়ার সকলেই যৌনরোগে ভুগছে। সাথে এক ছাগলের পেটে মানুষের বাচ্চা হওয়ার রগরগে উপাখ্যান বর্ণনা চলছে। তবে তাদের ব্যবসাও মন্দা। মাছিও উড়ছে না বলে মনে হয়। আশপাশে দু’একজন ঘুরঘুর করছে— তবে খুব সম্ভবত লোকগুলো ওই ক্যানভাসারের দলেরই।

এরকম সময় ঘাড় ঘোরাতে গিয়ে দেখলাম মেয়েটাকে— কেমন যেন উসকোখুসকো। একটা মোটা বেণি চুলে। আর কোটরে ঢোকা চোখ। খসখসে চামড়া। আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিতে একধরনের ঘোর।
আমি আমার ব্যাগটা একটু চেপে ধরলাম। পিছিয়ে এলাম একধাপ। মেয়েটার হাতেও একটা ব্যাগ। আমার পিছিয়ে যাওয়া ধাপের সাথে সঙ্গতি রেখেই যেন সে এগিয়ে এলো একধাপ।

কী করবো? ফুটপাত থেকে নেমে যাবো নাকি? আরেকধাপ এগিয়ে এলো মেয়েটি। আমি পিছিয়ে গেলাম আরো একধাপ। পোশাক-আশাকেই বোঝা যাচ্ছে বস্তি-টস্তিতে থাকে। শুকনো ঠোঁট। মুখের চামড়ায় ভাঁজ। অথচ তরুণী। মনে মনে ভেবেই বসলাম— পতিতা নাকি?
হতেই পারে। এদের নানান রকম ধান্ধা থাকে। দিনে এক, রাতে আরেক। আমি ব্যাগটা চেপে ধরে কোনোমতে দাঁড়িয়ে থাকলাম। মেয়েটা এগিয়ে এসে খসখসে গলায় বললো, ভাইজান এয়ারপোর্টের গাড়ি কুনটা?

ব্যাস, বুঝে গেলাম। টার্গেটে পড়ে গেছি। কিন্তু আমার ব্যাগে যে পঁচিশ হাজার টাকার দু’দুটো বান্ডেল সে খবর ওরা কী করে জানলো? এই টাকা অফিসের জামিল স্যারকে পৌঁছে দিতে হবে। জামিল স্যারের স্ত্রীর ডেলিভারি হয়েছে— বাচ্চা ভালো আছে, কিন্তু স্ত্রী আশঙ্কামুক্ত নন। উত্তরা হাসপাতালে ভুগছেন। জামিল স্যারের নগদ ক্যাশ দরকার। এক্ষুণি টাকাটা নিয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু নিয়ে যেতে পারবো কি? এরা কি এখন আমায় ঘিরে ধরবে? মেয়েটার এই প্রশ্নে কি কোনো সিগনাল ছিল? এখনি কি বিভিন্ন দিক থেকে তার গ্রুপের লোকজন চলে আসবে? তারপর আমার সাথে ধাক্কাধাক্কি করে ছিনিয়ে নেবে ব্যাগটা?

মেয়েটা আরেকবার কী যেন জিজ্ঞেস করলো, এগিয়েও এলো আরেকটা ধাপ। আমি আর কোনোদিকে না তাকিয়ে একছুটে চলে গেলাম আনন্দ সিনেমা হলের বারান্দায়। এ জায়গায় ভিড়বাট্টা তুলনামূলক কম। প্রায় ফাঁকা বারান্দা... শুধু, শুধু একটা মেয়ে, একটা পিলারের সাথে হেলান দিয়ে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। হাসছে মেয়েটা। আহা কী সুন্দর হাসি। আর কী কোমল! মনে হচ্ছে একতাল মাখন। আর সেই মাখনের ভেতর একটা জ্বলজ্বলে প্রতিমা। দেখে মনে হলো কবি হয়ে যাবো। ফোনটা হাতবদল করলো মেয়েটা, রিনরিন শব্দ উঠলো। চুড়ি, কাঁচের চুড়ি। কতদিন পর ঢাকায় কাঁচের চুড়ি! যেন পাখির গান। কিন্তু মেয়েটির পায়ের কাছে একটা ট্রাভেল ব্যাগ। ট্রাভেল ব্যাগ কেন? কোথায় যাচ্ছে সে? পালিয়ে যাচ্ছে নাকি! আমি একটু এগিয়েই গেলাম। এ আকর্ষণ চুম্বকের দিকে লোহার আকর্ষণের মতোই পুরনো।

কাছে যেতেই মেয়েটি কথা বলে উঠলো। অবশ্য ফোনের অপরপ্রান্তের কাউকে লক্ষ্য করে। আমার মতো ম্যাদাকলার সাথে তার কথা বলতে বয়েই গেছে! সে বললো, বললো মানে যেন গান... ওই যে একটা গান ছিল না— মুখের কথায় হয় যে গান তুমিই যদিও গাও...
আহা মেয়েটা যদি বেদনা দিতো তাহলে তাও কিন্তু মধুর হয়ে যেতো!

মেয়েটা ঠোঁটটা কেমন একরকমের গোল করে বললো, তাহলে?
তারপর থামলো। তাকালো আমার দিকে এবং স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্ব না দিয়ে তাকালো অন্যদিকে। ফোনে একটু জোর দিয়ে বললো, একা চলে আসবো?
ওদিক থেকে কী যেন বললো, দেখলাম মেয়েটার মুখ থেকে রক্ত সরে গেল। সন্ধ্যার ওই আধোন্ধকারের ভেতরেই যেন তার ঘন চুলের মতোই কালো রাত নেমে এলো চেহারায়। হায়, এমন সুন্দরও বেদনাহত হয়?

আগের তাকানোয় গুরুত্ব পাইনি, এবার গুরুত্ব দাবি করে বসলাম— একটা কাশি দিলাম।

যেন একটা শিশু ডলফিন তাকালো, এত মায়া চোখে। কিন্তু কিছু বললো না। নীরবতা যে-ময়ই হোক না কেন আমি তা চাই না। বললাম, ব্যাগটা সাবধানে রাখুন। ধরে রাখুন। এদিকটায় ম্যালা ঝামেলা আছে।

কথা বলতে বলতে একটু আগে যেদিক থেকে এসেছি সেদিকে তাকালাম। উসকোখুসকো ওই মেয়েটাকে দেখতে পেলাম না। হয়তো কোথাও লুকিয়ে আমাকেই ফলো করছে। আর আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে এই সুন্দরও যেন খুঁজছে সেই অসুন্দর, এই মোহ যেন খুঁজছে সেই আশঙ্কা।

বললাম, ফার্মগেট গিজগিজ করছে ছিনতাইকারী আর চোরে... তাই...
কিন্তু মেয়েটার চোখ শীতল। শীতলই তো, নাকি?

একটু অভিমান হলো, বা হতে পারে এরকম একটা ভাব নিলাম। না, যথেষ্ট হলো, আর না! পা বাড়াতে যাবো, একটা সিএনজি দেখে উঠে যাবো, বাসের অপেক্ষা করা বৃথা...

তখন মেয়েটা বললো, খুব ধীরে ধীরেই বললো, টঙ্গী... এখান থেকে টঙ্গি যেতে কতক্ষণ লাগবে?

আমার মনে হলো, কেউ যেন কানের ভেতর দিয়ে আমার হৃদয় তার পাঁচটা কোমল তুলতুলে আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দিলো।

বললাম, কিভাবে যাবেন তার ওপর নির্ভর করছে... আর রাস্তার জ্যামের ওপর...

বললো, আপনি কোথায় যাবেন? আমাকে একটু বাসটাস দেখিয়ে দেবেন? এখানে... আমাকে নিতে... যে আসার কথা সে আসে নি! একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে...

মনে মনে ভাবি কার আসার কথা ছিল?
ভাই?
বন্ধু?
প্রেমিক?
স্বামী?

নাহ, স্বামি ভাবতে ইচ্ছা করলো না— প্রেমিক তবে? প্রেমিকের বদলে আমি এলাম, আমিও কি প্রেমিক নই?

ভেতরে লালসার জিভের লকলকে সাড়া পাই। সড়সড় আওয়াজ হয়। তাকে ভালোবাসার চোয়াল দিয়ে আটকে রাখি। কণ্ঠ যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলি, তাড়াতাড়ি যেতে চাইলে অবশ্য সিএনজিতে যাওয়াই ভালো!

একটা রাত। সিএনজি। যদি দুজনে পাশাপাশি বসি, টঙ্গী হবে স্বর্গযাত্রা। আমি শ্বাসরোধ করে অপেক্ষা করি। কে না চায় একটা স্বর্গের দিকে যাত্রা করতে?

মেয়েটা বললো, আপনি কোনদিকে যাবেন?
আমি বললাম, আমি...? আমি তো... মানে ওই যে... ওই দিকেই... টঙ্গীর কাছাকাছি...

মেয়েটা যেন একটু স্বস্তি পায়। বলে, কিছু মনে করবেন না... আপনি যদি ওইদিকেই যান... তাহলে কি আমার সাথে একটু যাবেন... মানে আপনি আপনার জায়গায় নেমে গেলেন...

একটা সিএনজি। রাত। ছুটে যাচ্ছি। খুচরো চুল। আমলার ঘ্রাণ।
আবার একটা দৃশ্য ভেসে উঠলো মনের ভেতর।

আমি সংক্ষিপ্তভাবে বললাম, হ্যাঁ নিশ্চয়।

তবু গলা কাঁপলো। আর তারপরেই সিএনজি এসে দাঁড়ালো যেন আমাদের সামনে। ভাড়া চাইলো, যেমন চায় সাধারণত— প্রায় ডাবল। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে উঠে পড়লাম। একটা সিএনজি। রাত। আহা...
ফার্মগেট পেরোনোর সময় দেখলাম সেই যে বস্তি-বস্তি মেয়েটা ভিড়ঠেলা একটা বাসে উঠবার চেষ্টা করছে। আসলে যে কারো পকেট মারতেই উঠছে না তাই বা কে জানে? এরা তো এমনই হয়!

২.
বনানী পেরিয়ে যাওয়াটা একসময় মনে হচ্ছিল অসম্ভব। এত জ্যাম।
আমার কিন্তু বসে থাকতে খারাপ লাগছিল না। আমলার গন্ধ না হলেও মেয়েটা একটা সুন্দর পারফিউম ব্যবহার করেছে। বাতাসের ধাক্কায় মাঝে সাঝে সেটা নাকের ভেতর দিয়ে মাথায় উঠে যাচ্ছে। বুক ভরিয়ে দিচ্ছে। এরমধ্যেই কয়েকবার ভেবেছি নামটা জেনে নেবো... কিন্তু কথায় কথায় তা হয়েই উঠছে না। তবে নামটা জানা খুব জরুরি... কারণ নামটা জানা হলেই ফোন নাম্বারে যেতে পারবো...

একটা সিএনজি। রাত। আর একটা রূপকথার রাজকন্যা। বনানী পেরিয়ে গেলাম। ছুটে চলেছি। মনে হচ্ছে আর থামবার কোনো প্রয়োজন নেই।
উত্তম-সুচিত্রা কি আর এমনি এমনি গেয়েছিল... এই পথ যদি শেষ না হয়...
আহারে, সত্যি সত্যি যদি এই পথ শেষ না হতো...! স্বর্গের দিকের যাত্রা কেন শেষ হবে?

৩.
মেয়েটি সম্পর্কে যতই জানতে চাচ্ছি, ততই যেন কিছু জানতে পারছি না। এয়ারপোর্ট রেলস্টেশনের খুব কাছাকাছি চলে আসছি। আমি শুধু মুগ্ধচোখে মেয়েটাকে দেখছি। একটু আগেই সে ব্যাগ থেকে লিপিস্টিক বের করে ঠোঁটে ঘঁষেছিল। লাল আগুন ঠোঁটে আগে থেকেই ছিল... তার গনগনে ভাব আরো বাড়লো।

এরপরেই আরেকটা কী এক কৌটা বের করলো মেয়েটি। এগিয়ে এলো আমার দিকে। আমার যে হাল সেই একই হাল মেয়েটারও নাকি? কখন থেকে আমার মেয়েটাকে একটা চুমু দিতে ইচ্ছা করছে... মেয়েটারও কি তাই? এগিয়ে এলো আরো।
বাইরে বাতাস। ছুটে চলার তীব্রতা। ভেতরে আমার সাথে মেয়ে। যেন নাকে নাক। কী যেন বললো মেয়েটা। আমাকে? নাকি ড্রাইভারকে?

আমার ঠোঁটটা একটু ফাঁক হয়ে গেল। একটু নতুন স্বাদের আশায় যেন বুকটাও অমন করেই ফাঁক হয়ে রইলো। মেয়েটার শ্বাস এসে পড়ছে আমার গালের ওপর। আর তখনই মেয়েটা সেই কৌটা থেকে কী নিয়ে আমার চোখে ঘঁষে দিলো।

হঠাৎ-ই, লহমায়, যেন অন্ধ হয়ে গেলাম আমি।

চিৎকার করে উঠলাম। তাতে তেমন লাভ হলো না। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক করলো সিএনজি। আর তারপর ঝটকায় ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো আমাকে রাস্তায়। তার আগে অবশ্য আমার কাঁধ থেকে ব্যাগটা টেনে নিয়েছে ওই সুন্দরী। আমাকে ধাক্কা দেয়ার আগে মেয়েটার ঠোঁটে কী অদ্ভুত হাসিই না লেগে ছিল!

বলতে বাধ্য হচ্ছি হাসিটা তখনও খুব সুন্দর ছিল।

রাস্তায় পড়েই অসহনীয় ধাক্কাটা লাগলো আমার কাঁধে। মনে হলো কেউ আগুন দিয়ে ঘঁষে দিলো কাঁধের জায়গাটা। তারপরেই অনেকখানি গড়িয়ে গেলাম। আর গিয়ে থামলাম আরেকটা ধাক্কায়। এবারের ধাক্কাটা লাগলো মাথায়। আইল্যান্ডের সাথে। দেখলাম বা শুনলাম সিএনজিটা ছুটে গেল... মেয়েটা কি ওই খাঁচার ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে দেখছিল তখন?

ধা করে একটা গাড়ি পাশ কাটিয়ে গেল আমাকে। আর তখন আমার খুব ঘুমাতে ইচ্ছা করলো।

৪.
নানা মানুষের গুঞ্জনে চোখ মেলে তাকালাম। এবং তাকাতে গিয়ে বুঝলাম আসলে তাকাতে পারছি না। একটা খসখসে হাত আমার চোখ থেকে মলমগুলো সরানোর চেষ্টা করছে। আমাকে নড়তে দেখে একটা রুক্ষ কণ্ঠস্বর বললো, আপনে এইহানে আইলেন ক্যামনে? কী হইছে আপনের?

কণ্ঠস্বরটা কেমন চেনা চেনা লাগলো যেন। চোখটা আবার মেলতে গেলাম, পারলাম না।

ওই খসখসে হাতদুটো ক্রমাগত আমার চোখ পরিস্কার করে চলেছে। আর উদগ্রীবতার সাথে বলছে, শোনেন, আপনে কই যাইবেন কন... আমারে কন... আমি নিয়া যাইতেছি...

আমার মনে পড়লো— আমি স্বর্গে যেতে চেয়েছিলাম।


...........................................................................

প্রকাশ: http://www.banglanews24.com/beta/fullnews/bn/322447.html