শনিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৬

ক্রিকেটে ভবিষ্যতের উদ্‌যাপন

ইংলিশ অধিনায়ক বাটলারের উইকেট পতনের পর মাশরাফিদের উদ্‌যাপন পছন্দ হয়নি আইসিসির। এমন চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতের উদ্‌যাপন কেমন হবে দেখা যাক।  

এক মিনিট নীরবতা
.ম্যাচে তীব্র প্রতিযোগিতা। শেষ দুই বলে লাগবে ছয় রান। ব্যাটসম্যান উড়িয়ে মারলেন। চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাতের ভাষায় ‘বল চলে যাচ্ছে সীমানার বাইরে’। ঠিক এ সময় এক ফিল্ডার ছুটে এসে অনবদ্য ডাইভে বলটা তালুবন্দী করলেন। আউট আউট আউট!
কিন্তু মাঠে নেমে এল পিনপতন নীরবতা। কেউ দৌড়াল না। কেউ কাউকে জড়িয়ে ধরল না। ফিল্ডার বলটাকে নিয়ে আস্তে আস্তে বোলারের কাছে গেলেন। ক্যাপ্টেনও এলেন ধীরে ধীরে। ওদিকে মুখ শুকিয়ে উইকেটকিপার দাঁড়িয়ে থাকলেন। জায়ান্ট স্ক্রিনে লেখা উঠল, ‘ব্যাটসম্যান আউট! এক মিনিট নীরবতা!’
ব্যাটসম্যান হাসতে হাসতে চলে গেলেন প্যাভিলিয়নের দিকে। আর পিচের ওপর দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে এক মিনিট নীরবতা উদ্‌যাপন করতে থাকলেন বোলার ও ফিল্ডাররা।
পত্রপাঠ বিদায়
.ব্যাটসম্যান সমানে পিটিয়ে যাচ্ছেন। বোলাররা কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না। এ সময় এক পার্টটাইম বোলার এসেই বোল্ড করে ফেললেন ব্যাটসম্যানকে। মুহূর্তেই শোকের ছায়া নেমে এল ফিল্ডারদের চোখে-মুখে। কাভারে দাঁড়ানো ফিল্ডারটি তো কেঁদেই ফেললেন। পকেট থেকে রুমাল ও একটি কাগজ বের করে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে পড়তে শুরু করলেন—হে বিদায়ী ব্যাটসম্যান, বিশ্ব ক্রিকেটে আপনি এক অনন্য প্রতিভা। আপনি এতক্ষণ যে চার-ছয়ের ফুলঝুরি ছুটিয়েছেন, তা ছিল দৃষ্টিনন্দন। আপনার এই বিদায়বেলায় আমাদের বুকে যেন রচিত হয়েছে বেদনার মহাকাব্য।
আপনি ফিরে যাচ্ছেন, কিন্তু আমাদের জন্য রেখে যাচ্ছেন দুর্লভ স্মৃতি। আবার কোনো ম্যাচে, আবার কোনো মাঠে আপনার সঙ্গে আমাদের আবার হয়তো দেখা হবে। আবারও আপনি আমাদের ছয়-চার মেরে স্তব্ধ করে দেবেন, সেই আশাই করি।
পুষ্পমাল্য দান
.প্রচণ্ড উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচ চলছে। রান রেট উঠে গেছে আটের ওপর। টু ডাউনে নেমেই স্পিন বোলার পেয়ে ব্যাটসম্যান চলে এলেন ডাউন দ্য উইকেটে। উড়িয়ে মারতে চাইলেন। কিন্তু বল ব্যাটের কোনায় লেগে আলতোভাবে শূন্যে ভেসে চলে গেল বোলারের হাতে। কট অ্যান্ড বোল্ড। বোলার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলেন ব্যাটসম্যানের দিকে। একি করছেন বোলার? তিনি কি উইকেট পাওয়ার পর উদ্‌যাপন করতে ভুলে গেলেন? তিনি কি এখন হাত-পা ছুড়ে উল্লাস প্রকাশ করবেন? মাঠের ফিল্ডাররা হতবাক, দর্শকদের মধ্যে উৎকণ্ঠা। কিন্তু না, বোলার ভুল করেও কোনো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন না। বরং পকেট থেকে বের করলেন একটা বেলি ফুলের মালা। ব্যাটসম্যানের গলায় তা পরিয়ে দিলেন। ব্যাটসম্যান সেই মালা পরে আস্তে আস্তে মাঠের বাইরে চলে গেলেন। ফিল্ডার ও দর্শকের মধ্যে নেমে এল স্বস্তি। হাজার হোক, ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা!
চায়ের দাওয়াত দেওয়া
.অনেকক্ষণ থেকে খেলছেন ব্যাটসম্যান, এগিয়ে চলেছেন সেঞ্চুরির দিকে। কিন্তু তখনই ভুল করে একটা নিখুঁত বল করে ফেললেন বোলার। ব্যাটসম্যানের ব্যাটে চুমু খেয়ে বলটা চলে গেল উইকেটকিপারের হাতে। ব্যাটসম্যান গ্লাভস খুলতে খুলতে যে-ই না ক্রিজ ছাড়বেন, অমনি সব ফিল্ডার ঘিরে ধরবেন ব্যাটসম্যানকে। সমবেতভাবে আবৃত্তি করবেন ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতাটি। ক্যাপ্টেন এগিয়ে ব্যাটসম্যানের সঙ্গে হাত মেলাবেন, তারপর কোলাকুলি করবেন। তারপর ম্যাচ শেষে অফিশিয়াল চায়ের আড্ডায় দাওয়াত জানাবেন। ব্যাটসম্যান যদি চায়ের দাওয়াত গ্রহণ না করেন, তবে ক্যাপ্টেন তাঁকে আবার ব্যাটিং করতে অনুরোধ জানাবেন।
উদ্‌যাপনের জন্য বাড়তি দিন
.এসব উদ্‌যাপনের পর আরও উদ্‌যাপনের যদি কিছু থেকে থাকে, যদি খেলোয়াড়দের মন না ভরে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে প্রতিটি সিরিজে হয়তো একটা বাড়তি দিন রাখা হবে। এই দিনে প্রথম ভাগে এক দল মাঠে নামবে। জায়ান্ট স্ক্রিনে তাদের উইকেট নেওয়া দেখানো হবে। তখন তাঁরা নাচানাচি, পরস্পরকে জড়াজড়ি করে পিঠ চাপড়াচাপড়ি করবেন। কেউ যদি ডিগবাজি খেতে চান, তবে তা-ও খেতে পারবেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে, প্রতিপক্ষ দলের চোখে যেন এসব না পড়ে। এরপর প্রতিপক্ষ দল এসে একইভাবে উদ্‌যাপন করতে পারবে মাঠে। এটা হবে ভদ্রলোকি উদ্‌যাপনের চূড়ান্ত প্রকাশ।

শনিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৬

ইলিশের দাম ও গোপাল ভাঁড়

আঁকা: রাজীবঅনেক অনেক অনেক অনেক দিন আগে গোপাল ভাঁড় একবার বাজি ধরে ইলিশ কিনতে গিয়েছিল। বাজির শর্ত অনুযায়ী ইলিশের দাম যেন কেউ জিজ্ঞেস না করে, সে জন্য গোপাল ভাঁড় পরনের ধুতি খুলে মাথায় বেঁধেছিল পর্যন্ত। সেই অবস্থায় দেখে গোপাল ভাঁড়কে কেউ আর ইলিশের দাম জিজ্ঞেস করেনি আর গোপাল ভাঁড়ও বাজি জিতেছিল বেশ বড় অঙ্কের।
কিন্তু দিন বদলে গেছে। এখন আর গোপালের সঙ্গে তেমন কেউ বাজিও লাগে না, আর গোপালের আয়–রোজগারও গেছে কমে। আয়–রোজগার কমে গেলে কী হবে, ইলিশের প্রতি টানটা তার ঠিক টনটনে আছে। এবার হঠাৎই নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে জাটকার বদলে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। দামও কমে গেছে হু হু করে। গোপালের মনে হলো, এই সুযোগ। এবারই এক জোড়া ইলিশ কিনে গিন্নিকে চমকে দেবে।
গোপাল ছুটল মাছবাজারে। কিন্তু পথিমধ্যেই দেখা হয়ে গেল সেই লোকের সঙ্গে, যে অনেক অনেক অনেক অনেক দিন আগে গোপালের সঙ্গে ইলিশ নিয়ে বাজি ধরেছিল। সে বলল, ‘কী হে গোপাল, যাও কোথায়?’
: এই তো বাজারে।
: বাজারে? তা মাছবাজারেই নাকি?
: হ্যাঁ, ওই ভাবলাম দুইটা ইলিশ কিনে আনি। দামও সস্তা!
: হ্যাঁ, খুব সস্তা। এত সস্তা যে এক জোড়া কেন, এক হালি ইলিশ কিনে ঝোলাতে ঝোলাতে নিয়ে গেলেও কেউ দাম জানতে চাইবে না!
: না না, তা নিশ্চয়ই চাইবে!
: উঁহু, চাইবে না। বাজি?
: ঠিক আছে, আমার কাছে দাম জানতে চাইলে কী দেবেন?
: ৫০০ ইলিশের দাম। আর যদি না জিজ্ঞেস করে, তাহলে কিন্তু তোমাকে মুখে চুনকালি মাখতে হবে।
: ঠিক আছে।
গোপাল ৫০০ টাকায় এক জোড়া বেশ বড়সড় ইলিশ কিনে বাজার থেকে বেরিয়ে এল। হাতে ঝুলিয়ে পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য দোলাতে থাকল বেশ কায়দা করে। কিন্তু গত কদিনে ইলিশ কেনা এতই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে যে পথচারীদের কেউ ফিরেও তাকাল না। গোপাল আরও জোরে মাছ দোলাতে লাগল, কিন্তু তার দিকে দু-একজন তাকালেও ইলিশের দিকে একজনও নয়। গোপাল খুবই বিস্মিত। ইলিশ কেনা হয়েছে, অথচ কেউ তাকাচ্ছে না! এই কি তবে বঙ্গদেশ? বাজিতে কি তাহলে হেরে যাবে সে? একটা-দুইটা না, ৫০০ ইলিশের দাম! উফ্! অবশ্য গোপাল দমে যাওয়ার পাত্র নয়। চলতি পথেই এক পরিচিতজনকে পেয়ে সে দাঁড় করাল।
: হে হে হে। কোথায় যাচ্ছেন?
: এই তো বাজারের দিকে।
: আচ্ছা আচ্ছা। আমিও বাজার থেকে এলাম। এই যে এক জোড়া ইলিশ কিনলাম।
: ও ইলিশ? ইলিশ আর কত খাব? দেখি, সবজি পাই কি না!
: খুব সস্তায় পেলাম তো। খুব সস্তা!
: দাম তো সস্তাই ইলিশের। এ আর নতুন কী?
পরিচিতজন চলে গেল। গোপাল ভাঁড় মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। বাজি বোধ হয় হেরেই যাচ্ছে সে। ইলিশের দাম নিয়ে দেখা যাচ্ছে কারও কোনো আগ্রহই নেই।
আরেকটু এগোতেই এক প্রতিবেশীর দেখা পেল গোপাল। দূর থেকে দেখেই ওই প্রতিবেশী বলল, ‘কী গোপাল, ইলিশ কিনলে নাকি?’
খুব খুশি হলো গোপাল ভাঁড়। যাক, একজন পাওয়া গেল যে ইলিশ নিয়ে আগ্রহী। দামও নিশ্চয়ই জানতে চাইবে। গোপাল পড়িমরি করে ছুটে গেল তার সামনে।
: হ্যাঁ, এই যে ইলিশ। এক জোড়া! কিনে ফেললাম সস্তা পেয়ে।
: তোমাদের এই এক সমস্যা। সস্তা কিছু পেলে আর মাথা ঠিক থাকে না। জানো না, সস্তার তিন অবস্থা? সস্তা পেয়ে গাপুসগুপুস ইলিশ খাবে আর দু-পাঁচ বছরের ইলিশ না-খাওয়া পেটটা খারাপ করে ছাড়বে। ওই পেট ঠিক করতে কত টাকার ওষুধ খেতে হবে, জানো? শোনো, সবার পেটে ইলিশ সয় না!
: হ্যাঁ, তা তো ঠিকই, তা তো ঠিকই। তবে দামে এত সস্তা যে লোভ সামলাতে পারলাম না...
: লোভে পাপ আর পাপে ইলিশ, গোপাল! ইলিশও ওই রকম লোভ করে মিঠা পানিতে এসে ধরা খায়। তুমিও ধরা খেয়েছ! আর খবরদার, আমার ফ্রিজে ওই ইলিশ কিন্তু রাখতে আসবে না, বুঝেছ?
প্রতিবেশী গজগজ করতে করতে চলে গেল। গোপাল বুঝল, জীবনে এই প্রথম সে বাজি হারতে বসেছে। মুখে চুনকালি মাখার জন্য সে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল। তবে তার আগে শেষ চিকিৎসা হিসেবে সে দাঁড়িয়ে পড়ল মাঝ রাস্তায়। তারপরেই হাতের ইলিশ দুটো একটার সঙ্গে আরেকটার গায়ে ঘষতে শুরু করল। গোপাল ভাঁড়ের কাণ্ড দেখে লোক জমে গেল একেবারে।
: আরে, কী করেন ভাই?
গোপাল নিরুত্তর। সে ইলিশ ঘষেই যাচ্ছে। লোক আরও জড়ো হলো। সবার মুখেই এক প্রশ্ন, ‘লোকটা করছেটা কী?’ একজন তো বলেই বসল, ‘ইলিশ কিনে বোধ হয় পাগলই হয়ে গেছে গোপাল।’
গোপাল বলল, ‘নারে ভাই, পাগল হই নাই। কিন্তু ইলিশ বিক্রেতার কথামতো কেন যে কাজ হচ্ছে না, সেটা বোঝার চেষ্টা করছি!’
: কী বলেছিল সে?
: বলেছিল, এই মাছ দুইটা নাকি ভবিষ্যৎ বলতে পারে। দুইটা ইলিশকে একসঙ্গে ঘষা দিলেই নাকি কথা বলে ওঠে। আর বলে দেয়, কার কী ভবিষ্যৎ!
: দূর! তা হয় নাকি? তুমিও খুব বোকা তো!
: কী জানি ভাই, কিছুই বুঝতে পারছি না। এদিকে দামও তো নিল ম্যালা!
: কত দাম?
গোপাল কিছু না বলেই হাঁটতে শুরু করল। লোকগুলোও হাঁটতে লাগল তার পিছু পিছু।
: আরে আরে, বলছ না কেন কত দাম নিল? কত দামে তোমাকে ঠকাল, শুনি?
গোপাল ভাঁড় কিছুই না বলে জোর কদমে হাঁটতে থাকল। তাদের একমাত্র আগ্রহ, গোপাল ভাঁড় কত টাকা ঠকেছে তা জানা!
গোপাল ভাঁড় ততক্ষণে বাজি ধরা লোকটার কাছে পৌঁছে গেছে। তার পেছনের লোকগুলোকে ইলিশের দাম জিজ্ঞেস করতে দেখে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলতি বাজারদরে ৫০০ ইলিশের দাম কত, তা হিসাব করতে শুরু করল।


প্রথম প্রকাশ- রস আলো

শনিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

অদভূত আর বদভূত


অলংকরণ: তুলি




ছিল এক অদভূত, আর এক বদভূত। ভূতের বাচ্চা। থাকত বেলের গাছে। ঘুমাত সারা দিন, রাতে বের হতো মানুষকে ভয় দেখাতে। দাঁড়িয়ে থাকত ফাঁকা কোনো রাস্তায়। কেউ এলে নাকি স্বরে বলত, হাঁউ মাঁউ খাঁউ!
কিন্তু অনেক দিন এ রাস্তায় কেউ আর আসে না। একদিন তাই বদভূত বলল, ‘চল, মানুষের বাড়ি গিয়ে ভয় দেখিয়ে আসি!’
অদভূত তো একটু ভিতু। তাই বলল, ‘না না, মা বলেছে মানুষের বাড়ি যেতে নেই। তাদের বাড়িতে কুকুর থাকে, বেড়াল থাকে...ছাগল-গরু-ষাঁড়ও থাকে! যদি তাড়ে? কামড়ে যদি দেয়?’
: ধুর! যেসব বাড়িতে এসব নেই, তেমন একটা বাড়ি খুঁজেই যাব। চল!
বলেই ছুটল বদভূত। অগত্যা তার পিছু পিছু অদভূত!
অনেক রাত।
ঢুকল তারা একটা বাড়ির ঘরে। ঘরের ভেতর ঘুমিয়ে আছে রাফি।
রাফিকে দেখেই বদভূত ভীষণ খুশি। ভয় দেখাবে একেই। মুখের কাছে মুখটা নিয়ে আঁতকা একটা চিৎকার দিলেই...ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠবে সে! কেমন মজা হবে!
যেমন ভাবা তেমন কাজ!
দুজন মিলে একলাফে উঠল বিছানায়। শুয়ে পড়ল রাফির পাশে। ঢুকে গেল কাঁথার তলায়। এবার তারা যেই না ভয় দেখাতে যাবে অমনি ঘরে এলেন মা।
ঢিকঢিক! ঢিকঢিক! কাঁপছে অদভূত আর বদভূতের বুক। এই বুঝি ধরা পড়ে গেল! এই বুঝি দেখল তাদের মা!
কিন্তু না, মা খেয়ালই করলেন না। রাফির মাথায় হাত বুলিয়ে, পাশে রাখা মশারিটা টাঙিয়ে, চারপাশটা ভালো করে গুঁজে চলে গেলেন তিনি।
তখন ধীরে ধীরে কাঁথার ভেতর থেকে মুখ বের করল অদভূত আর বদভূত। যাক, বাঁচা গেছে! এবার ভয়টা দেখাতে হবে! কিন্তু তখনই অদভূত খেয়াল করল জিনিসটা। একটা পাতলা জাল দিয়ে যেন তাদের ঘিরে রাখা হয়েছে। এমন জিনিস তো তারা আগে কখনো দেখেনি, কারও কাছে শোনেওনি। কী এটা?
বদভূত বলল, ‘তাই তো? কী এটা?’
: বোধ হয় মাছ ধরার জাল। দেখছিস না কেমন ফুটো ফুটো!
: কিন্তু মাছ ধরার জাল এমন কেন? চারটা কোনা কেন এমনভাবে বাঁধা?
: কে জানে! কেন মা জাল ফেললেন? আমাদের ধরার জন্য নাকি?
বলেই ভীষণ ভয় পেয়ে গেল তারা। যে করেই হোক জাল থেকে বেরোতে হবে। কোথায় দরজা? কোথায় জানালা?
অনেকক্ষণ হুটোপুটি করল তারা। কিন্তু বেরোতে পারল না। চারদিকে ফুটো আর ফুটো কিন্তু বেরোনোর কোনো ফুটো নাই এই জিনিসটায়। এই জিনিসটা কী?
তখনই কথা বলে উঠল রাফি। ভূতের বাচ্চা দুটোর কাণ্ডে অনেক আগেই ঘুম ভেঙেছে তার। এতক্ষণ শুধু মজা দেখছিল। বলল, ‘এটা মশারি।’
: মশারি? এটা থেকে তোমরা বের হও কীভাবে?
: বলব না!
: বলো, প্লিজ। আর কোনো দিন তোমাকে ভয় দেখাতে আসব না! প্লিজ, বলো।
: বলব না, বলব না!
: এখান থেকে বেরোতে না পারলে সবাই জেনে যাবে আমরা মানুষের কাছে আটকা পড়েছি। তাতে ভূত সমাজে আমাদের প্রেস্টিজ থাকবে না! বলো...তুমি যা বলবে তা-ই করব!
: যা বলব, তা-ই করবে?
: হ্যাঁ।
: আমার বন্ধু হবে?
: বন্ধু? হ্যাঁ হব।
: বন্ধু হওয়ার কিন্তু অনেক কাজ!
: কী কাজ?
: একসঙ্গে খেলতে হয়!
: হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরা একসঙ্গে খেলব।
: একসঙ্গে ঘুরতে হয়!
: হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরা একসঙ্গে ঘুরব।
: একসঙ্গে পড়তে হয়।
: পড়তেও হয় নাকি?
: হ্যাঁ। একসঙ্গে স্কুলেও যেতে হয়।
: কী বলো, এসব?
: হ্যাঁ। তোমরা কি আমার সঙ্গে স্কুল যাবে? একসঙ্গে ক্লাস করবে?
বদভূত বলল, ‘কক্ষনো না। মাথা খারাপ?’
কিন্তু তারপরেই অনেকক্ষণ অদভূত আর বদভূত চিন্তা করল। মানুষের জালে ধরা পড়ার চেয়ে মানুষের বন্ধু হয়ে স্কুলে যাওয়াই বোধ হয় ভালো! তারা হাত মেলাল রাফির সঙ্গে। রাফি তখন তোশকের নিচ থেকে মশারি বের করল। মশারির ফাঁক গলে এবার অদভূত আর বদভূত বেরিয়ে এল। ভীষণ অবাক তারা। এমন আজব জাল শুধু মানুষই বানাতে পারে! চলে যাচ্ছিল তারা। রাফি বলল, ‘শোনো, বন্ধুরা কিন্তু কথা দিয়ে কথাও রাখে!’
অদভূত আর বদভূত বিড়বিড় করে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি!

এখন রহনপুর শিক্ষানিকেতনের ফাইভের ক্লাসে গেলে দেখা যায় রাফির দুই পাশে অদভূত আর বদভূত বসে আছে। অদভূতের বাংলা ছড়া খুব ভালো লাগে, এর মধ্যেই সে কয়েকটা মুখস্থ করে ফেলেছে। বদভূত অবশ্য অঙ্কে খুব ভালো। বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে, এমনই তার ইচ্ছা।

বুধবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৬

স্বামীর ডায়েরি থেকে...

রস+আলোর গত সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘বউয়ের ডায়েরি থেকে’। কিন্তু শুধু যে বউই ডায়েরি লেখেন তা তো নয়, ডায়েরি লেখেন তাঁর স্বামীও। কী আছে সেই ডায়েরিতে? পড়ুন এবার...
.হোয়াট ইজ স্বামী?আমি অনেক দিন ধরেই ভাবছি, স্বামী আসলে কী? কী মানে সে যে মানুষ নয়, সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। এ ছাড়া সে আসলে কী? কোনো পদার্থ (বউ অবশ্য অপদার্থই বলে), নাকি বহিরাগত কোনো জীব (বউ অবশ্য আজিব বলে থাকে)! স্বামীকে মৃত, অর্ধমৃত হিসেবে ঘোষণা আগেই করা হয়েছে, কিন্তু আসলে স্বামী কী? স্বামী আসলে বীর। সেই বীর যে পরাজিত জেনেও সংসার নামের এক মহাযুদ্ধে দিনের পর দিন ঢাল-তলোয়ার বাগিয়ে লড়াই করে যায়। আমরা যারা স্বামীর জাত, তাদের এখন একসঙ্গে কণ্ঠে আওয়াজ তোলা উচিত, ‘আমরা স্বামী আমরা বীর...আমরা শক্তি পৃথিবীর’!

স্বামীই কেন আসামি?একটা ব্যাপার আমার মাথায় কোনোভাবেই ঢোকে না যে সব সময় কীভাবে আমিই আসামি হয়ে যাই? কী করে সমস্ত দায় আমার ওপরেই এসে পড়ে? সেদিন রাতে বাইরে খেতে যাওয়ার কথা ছিল। আমার স্ত্রী রুনা দীর্ঘক্ষণ ধরে সাজার পর অবশেষে দয়া করে মুখ তুলে চাইল। মিষ্টি হেসে (আমি আমার বউয়ের মিষ্টি হাসি দারুণ ভয় পাই। কেন যেন মনে হয় এই হাসি শেষেই একটা অ্যাটম বোমা ছুটে আসবে আমার দিকে) বউ বলল, ‘লিপস্টিকটা কেমন হয়েছে?’ আমি ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলাম, ‘ভালোই তো!’
: শুধু ভালোই তো? এটা খালাতো বোন নূপুর পাঠিয়েছে ম্যারিকা থেকে! রংটা দারুণ না?
: হ্যাঁ।
: তুমি আর রঙের কী বুঝবে? তুমি তো মিষ্টি রং আর ম্যাজেন্টার মধ্যে পার্থক্য বোঝো না!
: না না, সুন্দর আছে রংটা!
: তা তো থাকবেই। কিন্তু তোমাকে তো কোনো দিন দেখলাম না এ রকম সুন্দর রঙের লিপস্টিক কিনতে!
: আমি তো লিপস্টিক কিনি না...!
: তা কিনবে কেন? বউয়ের জন্য কোনো কিছু কিনতে তো তোমার হাত কাঁপে...বুক ধড়াস ধড়াস করে। ভাবো যে এত টাকা খরচ করে ফেলব! অথচ সেদিন তোমার কলিগের বউয়ের বার্থডেতে কত কত গিফট নিয়ে গেলে তোমরা!
: আরে, ওটা তো সবাই মিলে কিনেছিলাম।
: হুহ্‌, সবাই মিলে কিনেছিলে না? আমি বুঝি না। এইগুলাতে তোমার তো খুব চালাকি! সবার নাম দিয়ে আসলে এগুলা তুমি নিজেই কেন! বলো, সত্যি কি না, বলো?
: আরে, কী বলো তুমি এসব?
: কী বলি মানে? আমি মিথ্যা বলি? তুমি তো একটা গবেট। গাধার গাধা। নিজের পকেট থেকে কেনো আর নাম হয় সবার! এ রকম গাধা আমি দুনিয়ায় দেখিনি!
আমি অত্যন্ত কনফিউজড হয়ে পড়ি এ সময়। একটা মানুষ একই সঙ্গে চালাক ও গবেট কীভাবে হতে পারে? পাশাপাশি এ ব্যাপারেও কনফিউজড হই যে লিপস্টিক না কেনায় আমার দোষ কোথায়? কারণ দোকানে গেলে তো আমার বউ আমাকে পাত্তাই দেয় না। এই কনফিউশনের মধ্যেই আমার বউ উঠে দাঁড়ায় আর বলে, ‘থাক থাক, আর জ্ঞানীদের মতো বসে বসে ভাবতে হবে না! চলো...বনানী ভাড়া করবা রিকশা। তিরিশ টাকার বেশি না কিন্তু, বুঝছ?’
আমি কিছু বলে ওঠার আগেই ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নামে। রুনা গজগজ করে ওঠে। আর আমাকে বলে, ‘সব তোমার দোষ! সব তোমার দোষ!’
: আরে, বৃষ্টি প্রাকৃতিক ব্যাপার। এর মধ্যে আমার দোষ কোথায়?
: তোমার দোষ না? তোমার জন্যই তো এতক্ষণ ধরে কথা বলতে হলো... না হলে কবেই রেস্টুরেন্টে পৌঁছে যেতাম। এখন খাবে কী? ঘরে তো কোনো খাবার নেই! এই তোমার জন্য এখন না খেয়ে রাত পার করতে হবে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না। মনে মনে বলেছিলাম, স্বামীই আসামি। স্বামীই একমাত্র আসামি।
সংসার সুখের হয় শুধুই স্বামীর গুণে
কত যে ভুলভাল প্রবাদ প্রচার হয়ে আসছে অতীত থেকে। এই ভুলভাল প্রবাদগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভুল প্রবাদ হলো, সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে! অসম্ভব! সংসার আসলে সুখের হয় আমাদের গুণে অর্থাৎ স্বামীদের গুণে। বউ সকাল থেকে আমাদের পেছনে লেগে থাকে। বলে, ‘আরে, এভাবে দাঁত ব্রাশ করছ কেন? তুমি কি ছোট বাচ্চা! ভালোমতো ব্রাশ করো...ভেতরটাও করো...।’
আমরা স্বামীরা কিছু বলি না। চুপচাপ সহ্য করে যাই।
অফিসে কাজের মধ্যে থাকা অবস্থায় বউ ফোন করে। হয়তো বসের সামনে আছি তখন বউ ফোন দিয়ে পাশের বাড়ির লালচে বেড়ালটা যে তিনটা সাদা বাচ্চা দিয়েছে তা নিয়ে গল্প শোনায়।
আমরা স্বামীরা কিছু বলি না। চুপচাপ সহ্য করে যাই।
সন্ধ্যায় বাসায় ঢুকে হয়তো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে পরবর্তী দিনে অফিস আড্ডায় কী বলা যায়, তার খোরাক জোগাতে একটু টিভিটা দেখব, একটু টক শো, একটু খবর দেখব কিন্তু তার কোনো উপায় থাকে না। বউ এসে রিমোট নিয়ে সুলতান সুলেমান দেখতে শুরু করে।
আমরা স্বামীরা কিছু বলি না। চুপচাপ সহ্য করে যাই। ভর রাতেবারান্দায় দাঁড়িয়ে হয়তো একটা সিগারেট খেতে যাই, তখনই বউ আঁতকা চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘তোমাকে না কতবার বলেছি আর সিগারেট খাবে না? আবার ধরাচ্ছ তুমি?’ সঙ্গে সঙ্গে সিগারেট ফেলে দিয়ে সুড়সুড় করে মশারির ভেতর ঢুকে যাই এবং হ্যাঁ, আমরা স্বামীরা কিছু বলি না। চুপচাপ সহ্য করে যাই।
আর এই যে বলি না কিছু, এই যে চুপচাপ সহ্য করে যাই বলেই তো সংসারে অশান্তি হয় না, বিবাদ হয় না, ঝগড়া হয় না। যদি বলতাম, যদি সহ্য না করতাম, তাহলে প্রতিদিন রেসলিং হবে সংসারে। ঝগড়াঝাঁটির ডোজ হবে রোজ রোজ! আমরা স্বামীরা শান্তিকামী। আমরা জন্মেইছি পকেটে সাদা রুমাল নিয়ে। বউ যতই শাসন আর শোষণ করুক আমাদের, পকেট থেকে সাদা রুমাল সব সময় উঁকি দেয় বাইরে...আর তাই সংসারটা সুখের হয়। তাই সংসার সুখের হয় স্বামী, শুধুই স্বামীর গুণে—এটিই আসল প্রবাদ, এটাই সত্য প্রবাদ।
কিন্তু সন্ন্যাসী হতে পারি না
গৌতম বুদ্ধও তো চলে গিয়েছিলেন! হায়! কতবার ভাবি আমিও চলে যাব। আর তো সহ্য হয় না! কিন্তু পারি না। পারি না কারণ, আমার বউ আমাকে যতটা আগলে রাখে, যতটা ভালোবাসে...অন্যের বউ কি ততটাই আগলে রাখবে, ভালোবাসবে?

বউয়ের ডায়েরি থেকে...

আঁকা: আসিফ



মানুষ কত কিছু আবিষ্কার করে! আমি আমার বউয়ের ডায়েরি আবিষ্কার করেছি। তাতে বিতং করে লেখা আছে আমারই কথা। অন্যের ডায়েরি পড়া অন্যায় ভেবে এড়িয়ে যেতে পারিনি। কারণ, লেখা তো আমাকে নিয়েই। লেখার শিরোনাম, ‘যে কারণে আমি আমার স্বামীকে ডিভোর্স দিই না’! এই শিরোনাম পড়ার পর বাকি লেখা না পড়ে আর অন্য উপায় আমার ছিল না।
যে কারণে আমি আমার স্বামীকে ডিভোর্স দিই না!
১. আমার স্বামীটা একটা গবেট। বোকার বোকা। আমার ধারণা, বিয়ের পর তার বোকামি আরও বেড়েছে। কাঁচাবাজারে গেলে প্রতিটা সবজি বিক্রেতা তাকে ঠকায়। গত বছরের টমেটো তাকে গতকালকে মাঠ থেকে তুলে আনা টমেটো বলে চালিয়ে দেয়। মাছ বিক্রেতারা ফরমালিন মেশানো মাছ ধরিয়ে তাকে বলে তাজা মাছ, কোনো ক্যামিকেল নাই। আর সে তা-ই মেনে নিয়ে ঢ্যাং ঢ্যাং করে বাসায় ফেরে। অদ্ভুত একটা! রিকশাওয়ালারা পর্যন্ত তাকে ঠকায়। ৩০ টাকার ভাড়া তার কাছ থেকে ৫০ টাকা আদায় করে। আমি আমার এক জীবনে এত গবেট মানুষ দেখিনি! এ রকম মানুষের সাথে সংসার করার কোনো মানে নেই!
২. আমার স্বামীটা একটা অলস। যেনতেন অলস না, আমার ধারণা আলসেমির কোনো অস্কার থাকলে সে পরপর সাত-আটবার অস্কার পেয়ে গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লেখাত। তার সবচেয়ে বেশি আলসেমি মশারি টানানোয়। সে পারলে মশারি গায়ে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এমনকি সে ঘুমের মধ্যেও আলসেমি করে বলে আমার ধারণা। কারণ, এক কাতে ঘুমানোর পর সারা রাত সে অন্য কাতে যায় না। ওভাবেই সকালে ঘুম থেকে ওঠে। তারপর মুখে ব্রাশ নিয়ে ঢুলতে থাকে। দাঁত ব্রাশ করার মতো সহজ একটা কাজেও তার রাজ্যের আলসেমি। তিন দিন আগে সে এক গ্লাস পানি খেতে চেয়েছিল। আমি রান্নায় ব্যস্ত ছিলাম বলে তাকে সেটা না দিয়ে বলেছিলাম, ‘নিজে নিয়ে নাও!’ আমার ধারণা, তারপর সে আর পানি খায়নি। এমনও হতে পারে, সে হয়তো এই তিন দিনেও পানি খায়নি! তাকে দিয়ে কিচ্ছু বিশ্বাস নেই।
৩. আমার স্বামীটা খুবই আড্ডাবাজ। আড্ডাবাজ, কিন্তু সে শুধুই তার বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজি করবে। আমরা যখন কাজিন-টাজিন মিলে গল্প করি, তখন সে চুপচাপ ভ্রু কুঁচকে বসে থাকে। বোঝাই যায়, সে আমাদের কথাবার্তায় বিরক্ত। অথচ সেই মানুষটাই যখন তার বন্ধুবান্ধবের সাথে বসে তখন হা হা হি হি করে অস্থির হয়ে যায়। কথায় কথায় মজা করার চেষ্টা করে। তার হিউমারে অন্যরা হেসে হেসে গলে গলে পড়ে (জঘন্য একেকটা!), অথচ আমার কোনো হাসি পায় না। কারণ, এই কৌতুকগুলো সে আমাকে আমাদের বাসররাতেই শুনিয়েছিল, আর সেগুলো খুবই খুবই খুবই পুরোনো। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে শুরু করলে এই লোকের কোনো সময়জ্ঞান থাকে না। আমি যে ওর সাথে আছি, সম্ভবত সেই বোধটাও থাকে না। আমি যতবার বলি, ‘এবার চলো...!’ সে বলে, ‘আরেকটু আরেকটু...!’ অথচ এই লোক শপিংয়ে যাওয়ামাত্রই বাসায় ফিরতে চায়। আমার সাথে কিছুক্ষণ ঘুরলেই তার মুখে রাজ্যের ক্লান্তি। শুধু বন্ধুদের সাথে আড্ডায় তার কোনো ক্লান্তি নেই। এ রকম একটা লোকের সাথে বাকিটা জীবন পার করার চেয়ে বনবাসে যাওয়া ভালো!
৪. বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা শুরু হলে আমার স্বামী কেমন পাগলের মতো হয়ে যায়। সেদিন হয় সে অফিস যায় না, না হলে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দ্রুত ফিরে আসে। তারপর টিভির সামনে রিমোট হাতে গ্যাট হয়ে বসে থাকে। এ সময় তার কাছে রিমোট চাইতে গেলে তার চোখ ধকধক করে জ্বলে। মনে হয় যেকোনো সময় সে চিৎকার করে উঠবে। যদি বলি, ‘এখন আমার সিরিয়াল দেখার সময়। চ্যানেল চেঞ্জ করো।’ তখন সে বড় বড় করে শ্বাস ফেলতে থাকে। আমি দুই দিন জোর করে রিমোট নিয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করে দেখেছি, লোকটা কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বেরিয়ে মহল্লার টং দোকানে বসে খেলা দেখছে। আমার ধারণা, বাংলাদেশের ম্যাচ চলাকালে সে আধপাগলা হয়ে যায়। এ রকম আধপাগলা লোকের সাথে কীভাবে আমি দিনের পর দিন কাটাচ্ছি, ভাবতেই আমার শরীরে কাঁটা দিচ্ছে!
৫. আমার স্বামীর সাথে আমার কোনো কিছুতেই মেলে না। আমার পছন্দের রং ম্যাজেন্টা, তার পছন্দ খ্যাত একটা সবুজ। আমি রোমান্টিক সিনেমা পছন্দ করি, আর সে পছন্দ করে তামিল টাইপ মারদাঙ্গা সিনেমা। আমি টিভিতে নাটক দেখি, আর সে দেখতে চায় টক শো (কিন্তু চাইলে কী হবে? আমি দেখতে দিলে তো!)! আমার পছন্দ ফ্রায়েড চিকেন আর তার পছন্দ কিনা ছোলামুড়ি! সে মাঝে মাঝে এতই অন্যমনস্ক থাকে যে আমার মনে হয় কোনো একদিন সে ভুলে কোনো বাসে চড়ে ভুল কোনো জায়গায় গিয়ে নেমে পড়বে! এই আতঙ্ক নিয়ে জীবন যাপন করা দুরূহ!
কিন্তু এত কিছুর পরও আমি আমার স্বামীকে ডিভোর্স দিই না! কারণ, ও যা কিছুই করতে চাক না কেন, আমি তাকে যখন বলি, ‘শোনো, আমার কথা শোনো...’, তখন সে আমার কথা শোনে। কোনো রকম ভেজাল করে না। এ রকম নির্ভেজাল মানুষ আজকাল শুধু স্বামী হিসেবেই পাওয়া যায় বোধ হয়!
(আগামী সংখ্যায় আসছে ‘স্বামীর ডায়েরি থেকে’!)

শনিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৬

আঙুর ফল টক


লেখা হতো যদি অন্য স্টাইলে
ইশপের ‘আঙুর ফল টক’ গল্পটি ছিল এমন—একদিন বনের রাস্তা দিয়ে এক শিয়াল যাচ্ছিল। সে দেখল, বেশ উঁচুতে এক থোকা আঙুর। সে অনেকক্ষণ ধরে সেই আঙুর পেড়ে আনার চেষ্টা করল। অনেক পরিশ্রমের পরও সেই আঙুর নিজের নাগালের ভেতরে না আসায় সে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘আঙুর ফল টক!’ এখন এই গল্প যদি লেখা হতো অন্য স্টাইলে, তাহলে কেমন হতো?
মাসুদ রানা সিরিজ স্টাইল
সিরিজের নাম: আঙুরসংকুল (খণ্ড-১)
..গভীর রাত। শ্বাপদসংকুল জঙ্গল। সুন্দরবন কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের দুর্ধর্ষ স্পাই খেক্স শিয়াল বেরিয়েছে শিকারে। চোখে নাইট গগলস, ঠোঁটে ভুবন ভোলানো হাসি। তিন কিলোমিটার দূরের ঝিঁঝিপোকাটিকেও সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সাঁৎ করে একটা অশুভ ছায়া যেন সরে যায় পাশ থেকে। কোমরের বেল্টে গুঁজে রাখা ওয়ালথার পিপিকেটা হাত দিয়ে একবার ছুঁয়ে নেয় খেক্স। নাক আকাশের দিকে তুলে বাতাসের গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করে সে। একটু এদিক-ওদিক হলেই শিকারি থেকে নিজেই শিকারে পরিণত হবে, খেক্স তা জানে। কাঁচা-পাকা ভ্রুর সেই মানুষের মুখটা এক ঝলকে খেক্সের সামনে ভেসে ওঠে। সাবধানবাণী তাঁর মুখে, ‘সাবধান! বন মুরগি শিকার পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজের একটা!
সাবধান, খেক্স! সাবধান!’
সাবধানি খেক্স এগিয়ে চলে। কিন্তু বাতাসে মাতাল করা এক ঘ্রাণ। শরীর মুহূর্তেই চনমনে হয়ে ওঠে। অন্ধকারের ভেতর একটা ঝোপের মধ্যে বাতাসে ডাইভ কাটতেই একটা ঝিলিক। মুহুর্মুহু মেঘের ডাক। আর সেই বৈদ্যুতিক ঝিলিকেই খেক্স প্রথম দেখে আঙুরের থোকাটা। অনিন্দ্যসুন্দর। প্রমাণ সাইজের গোল গোল আঙুরগুলো যেন তাকিয়ে আছে তারই দিকে। রবীন্দ্রনাথ মনে পড়ে যায় খেক্সের—আমি পাইলাম, ইহাকে পাইলাম!
মুহূর্তেই খেক্সের হাতে বেরিয়ে আসে ওয়ালথার পিপিকে। নিখুঁত নিশানায় ছুড়ে দেয় গুলি। মিস! এই প্রথম খেক্সের নিশানা এমন হলো। মনে মনে রেগে উঠলেও নিজেকে শান্ত রাখল সে। এ রকম পরিস্থিতিতে নিজেকে কীভাবে শান্ত রাখতে হয়, তার ট্রেনিং সে সেই শিক্ষানবিশকালেই নিয়েছে। দ্বিতীয় গুলিটা ছুড়ল সে। টার্গেট মিস। কোথাও একটা বনমোরগ ডেকে উঠল। যেন তাকে নিয়েই তামাশা করছে। তৃতীয় গুলি...মিস! চতুর্থ...মিস! একে একে ম্যাগাজিন খালি করে দিল খেক্স। কী হয়েছে আজ তার? সামান্য এক আঙুরের থোকাই সে গুলি করে ফেলতে পারছে না? বয়স হয়ে যাচ্ছে? এরপর কি তার জন্য শুধু অপেক্ষা করছে ডেস্কের চাকরি? মনে মনে প্রমাদ গুনল খেক্স। রাতের অখণ্ড নীরবতা খণ্ডন করে, নরক গুলজার করে একটানা দ্বিতীয় ম্যাগাজিনটাও শেষ করল সে। নাহ্! ফুরিয়ে গেছে সে! ঠিক তখনই তার মনে এল বাংলা প্রবাদটা—আঙুর ফল টক। ঠোঁটে ভুবন ভোলানো হাসিটা ফিরে এল খেক্সের। তাই তো, টক আঙুরের জন্য এত কিসের কষ্ট? খেক্স আঙুরের থোকা ছেড়ে একটা ডাইভ দিল সামনে। আশপাশেই সাড়া পাওয়া যাচ্ছে বনমোরগের, যেটাকে শিকার করাই তার মিশন, টক আঙুর নয়!
হিমু সিরিজ স্টাইল
.বইয়ের নাম: একজন হিমু শিয়াল ও এক থোকা আঙুর (চলতি মেলার বেস্টসেলার)রাত বারোটা।
হলুদ পাঞ্জাবি পরে নিজের ডেরা থেকে বেরিয়ে এসেছে হিমু শিয়াল। রূপবতী শিয়ালকন্যা রুপার বাসায় আজ তার দাওয়াত। এই দাওয়াত রুপা দিয়েছিল তিন বছর আগে। বাংলা পঞ্জিকা মিলিয়ে দিন-তারিখ ঠিক করে দাওয়াত। কারণ, আজ কোনো সাধারণ দিন নয়। আজ পূর্ণিমা। এই পূর্ণিমাটাও সাধারণ কোনো পূর্ণিমা নয়; আজকের এই পূর্ণিমাতেই একদিন ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিলেন সিদ্ধার্থ। আজ বেরিয়েছে হিমু শিয়াল।
আকাশ মেঘলা। চাঁদের দেখা নেই। টোটাল ব্ল্যাকআউট বন। মাঝে মাঝে দু-একটা জোনাক পোকা জ্বলতে জ্বলতে নিভে যাচ্ছে। বাবার উপদেশ মনে পড়ে হিমু শিয়ালের। উপদেশ ১৩৭-এ লেখা ছিল, ‘জোনাক পোকার দিকে তাকালে দেখিতে পাইবে সে ক্ষণকাল জ্বলিয়াই নিভিয়া যায়। মানুষ জোনাক পোকার মতোই ক্ষণে ক্ষণে জ্বলিয়া ওঠে ও নিভিয়া যাইতে থাকে। কিন্তু মহাপুরুষ জ্বলা ও নেভার বাইরের এক সত্তা। তুমি কখনো জ্বলিবেও না, কখনো নিভিবেও না!’
জোনাক পোকা দেখতে দেখতে হিমু শিয়াল কখন যে আঙুরগাছের নিচে এসে হাজির হয়েছে, বুঝতেও পারেনি। গাছের ওপর থোকা থোকা আঙুর। হিমু শিয়াল ভাবল, রুপার জন্য আঙুর নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। আগে মানুষ মৃত্যুপথযাত্রীদের দেখতে আঙুর নিত। বাড়িতে আঙুর দেখেই বোঝা যেত, এই বাড়িতে হয় কেউ মারা গেছে, না হয় মারা যাবে। আঙুর নিয়ে রুপার সামনে হাজির হলে সে নিশ্চয় ভ্রু কুঁচকে তাকাবে। তাকাক, হিমুরা পৃথিবীর সব কোঁচকানো ভ্রু উপেক্ষা করতে পারে।
হিমু শিয়াল গাছ ধরে ঝাঁকাল কয়েকবার। তার মনে হচ্ছে, যেকোনো সময়ই আঙুরের থোকাটা পড়ে যাবে। কিন্তু না, অনেকক্ষণ চেষ্টার পরেও আঙুর পড়ল না। ঠিক এ সময় আকাশের মেঘ কেটে গেল। গোল থলথলে চাঁদ আকাশে। হিমু শিয়াল চাঁদের দিকে তাকিয়ে বাবার উপদেশের কথা আবার মনে করল। কোনো কিছুতেই জ্বলা বা নেভা যাবে না। সে আঙুরের থোকার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। আঙুর ফল টক। এর জন্য নিজেকে জ্বালিয়ে বা নিভিয়ে লাভ কী! আর যখন আঙুরই পাওয়া গেল না, তখন রুপার বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়েই বা কী লাভ? রুপা হয়তো ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে...রুপাকে কি সে একবার বলে আসবে যে আঙুর ফল আসলে টক?
হিমু শিয়াল দ্বিধান্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বনের ভেতর। তার হলুদ পাঞ্জাবি আর ধূসর লেজ ভেসে যাচ্ছে গৃহত্যাগী জোছনায়।
বাংলা সিনেমা স্টাইল
.সিনেমার নাম: আঙুর কেন টক! (সম্পূর্ণ রঙিন)বনের সবচেয়ে বড়লোকের শিয়ালকন্যা শিলুকে ভালোবাসে দরিদ্র ফক্স খান। সিনেমার শুরুতেই শিলু আর ফক্স খানের হাত ধরাধরি করে বৃষ্টিতে ভিজে এক গান—চুরি করেছ আমার মনটা...হায় রে হায় শিয়ালকন্যা!
কিন্তু গান শেষ হতে না-হতেই শিলুর প্রতাপশালী পিতার গুন্ডারা এসে ধরে নিয়ে যায় ফক্স খানকে। শিলুর বাবার বিরাট বাড়ি। আর বাড়ির ভেতর প্রকাণ্ড সিঁড়ি। সেই সিঁড়ির নিচে শিলুর বাবা ও ফক্স খানের কথোপকথন—
: তোর এত বড় সাহস, তুই আমার মেয়ের লেজের দিকে তাকাস!
: চৌধুরী সাহেব, শুধু লেজ না, আমি আপনার মেয়ের চোখ-কান-মাথা-নখ—সব ভালোবাসি!
: চোপ! তুই জানিস, আমি কে? আমার মেয়ে সারা দিনে যত গিগার ইউটিউব ইউজ করে, তুই তত গিগা চোখেও দেখিস না!
: একটা কথা জেনে রাখবেন চৌধুরী সাহেব, হতে পারি আমি গরিব, হতে পারে আমি ফ্রি ফেসবুক চালাই, কিন্তু আমারও মান-সম্মান আছে! আপনার মেয়ে হয়তো আমার কাছে গিগাবাইট পাবে না, কিন্তু ভালোবাসা পাবে!
: ভালোবাসা! হুহ্! যদি তুই সত্যি আমার মেয়েকে ভালোবাসিস, তাহলে আজই বনের সবচেয়ে উঁচু জায়গাটা থেকে পাকা আঙুরের থোকাটা পেড়ে এনে দেখা! যদি না পারিস, তাহলে ভুলে যা আমার মেয়েকে!
ভালোবাসা জয় করতে দরিদ্র ফক্স খান ছুটল আঙুর পাড়তে। কিন্তু আঙুরের থোকাটা যে অনেক উঁচুতে। ফক্স খান নায়ক রুবেলের মতো লাফ দিয়ে গাছে ওঠার চেষ্টা করল, কিন্তু ব্যর্থ হলো সে। তারপর বনের রাজা টারজান ড্যানি সিডাকের মতো প্রবল ঘুষি চালাল গাছে, তাতে লতানো গাছটা কিছুটা নড়ল বটে, কিন্তু আঙুর পড়ল না। অবশেষে সে ট্র্যাজিক কিং জসিমের মতো হু হু করে কেঁদে উঠল গাছতলায়। কিন্তু না, এতেও মন গলল না আঙুর থোকার। তখন সে আঙুরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আসলে আঙুর ফল আর বড়লোকের মেয়ে—দুটোই টক!’ বলেই সে চলে গেল সিনেমার সেকেন্ড নায়িকার কাছে!
রাবীন্দ্রিক স্টাইল
.বইয়ের নাম: শেষের আঙুর (সুলভ সংস্করণ)খবর শুনিয়া শৃগাল সবুর করিতে পারিত, কিন্তু তাহার মন আর গৃহে টিকিল না। ইহাও কি সম্ভব? তাহারই বাটির সমুখে, তাহারই চোখের আড়ে, এত বড় এক আঙুরগাছ বাড়িয়া উঠিয়াছে, অথচ তাহার হদিস তাহার জানা নাই?
শৃগাল ঊর্ধ্বমুখে ছুটিল। পাশের গর্তের লাল লেজুরের শৃগাল জানিবার আগেই আঙুর গাছখানা তাহাকে আবিষ্কার করিতে হইবে। ইহা যত না আপনার লোভের জন্য, তাহার চাইতেও বেশি আসলে ইংরাজি ইগোর কারণে। ইংরাজ জাতের আর কিছু গ্রহণ না করিলেও আমাদের শৃগাল তাহাদের ইগোখানা সযত্নেই গ্রহণ করিয়াছিলেন।
খুঁজিয়া-ফিরিয়া শৃগাল কাঙ্ক্ষিত আঙুরগাছখানি আবিষ্কার করিল বটে। এক আশ্চর্য গাছ! ঊর্ধ্বমুখে বিস্তৃত হইয়া গগন ছুঁইবার অভিপ্রায়ে উঠিতেই আছে উপরের দিকে। শৃগাল গাছের একেবারে মাথায় আঙুরের থোকাখানিকে লক্ষ্য করিল। আহা, কী অপরূপ শোভা! যেন বা এক্ষণেই তাহার পাকস্থলীতে যাইবার উপযুক্ত। যেন ইহাই তাহার সম্পদ, ইহাই তাহার সম্পত্তি!
শৃগাল কসরত কম করিল না! প্রথমে মাটির ঢেলা কুড়াইয়া আঙুরের থোকার দিকে মারিতে লাগিল। হা ভগবান, তাহার কোনোটাই গিয়া আঙুরথোকাখানিকে স্পর্শ পর্যন্ত করিল না। ইহার পরে শৃগাল আরো ক্রুদ্ধ হইয়া গাছে উঠিবার প্রত্যয় প্রকাশ করিল। কিন্তু সেই আশারও যে গুড়ে বালি! শৃগাল কতকবার পড়িতে পড়িতে বাঁচিল, কতকবার মরিতে মরিতে বাঁচিল!
কিন্তু শেষরক্ষা আর হইল না! গাছে উঠিতে গিয়া এইবার সে পিছলাইয়া একেবারে মনসা কাঁটায় গিয়া পড়িল। ‘মাগো!’ বলিয়া এক আর্তচিৎকার বাহির হইয়া আসিল তাহার কণ্ঠ হইতে। কাঁটা হইতে নিজেকে উঠাইয়া সে আঙুর থোকার দিকে চাহিয়া বলিল, ‘আঙুর ফল তো টক!’ এই টক আঙুর যদি বা ওই লাল লেজুরের শৃগাল খায় তো খাক, তাহার কী যায়-আসে!
শৃগাল ফিরিয়া চলিল। মাথায় তাহার ঘুরিতেই থাকিল—আঙুর ফল টক! আঙুর ফল টক!

শনিবার, ৪ জুন, ২০১৬

ডেডবডি

লাল ইট আর সাদা ধূলা ভরা রাস্তাটা যেখানে একটা আঁৎকা মোচড় নিয়ে রহনপুরের দিকে বেঁকে গেছে—তার পাশে—নদীর দিকে পেছন করে প্রায় ঝুলে থাকা যে ভাতের হোটেল তাতে আমি তিরিশ বছর ধরে কাজ করি। যদিও হোটেলের মালিক যার নাম আলতামির আর যার একটা বান্দর আছে সে বলে আমি নাকি মাত্র তিন বছর ধরেই আছি এ হোটেলে। এটা আমি তেমনভাবে মেনে নিতে পারি না। আমার মনে হয় মালিক আলতামির আসলে আমার আরো সাতাশটা বছরের কামাই না দেয়ার ধান্ধায় আছে! এমনিতে এমন না যে গত তিন বছরের টাকাও সে দিয়েছে।
চল্লিশ টাকা দিন হিসাবে আমার যে কত টাকা পাওনা হয়েছে তার কাছে গত তিরিশ বছরে তা আমি হিসাব করে কুলাতে পারি না। কিন্তু আমার প্রত্যেক রাতেই মনে হয় পরের দিন গোসলের সময় আমি এর একটা হিসাব করব। গোসলের সকালের সময়টাতে পুনর্ভবা ঠাণ্ডা আর থির থাকে, আর তখন দুয়েকজনই আসে রাতের বাসি কাপড় নিয়ে। যেহেতু ওই ঘাটের পাশে একটা হলুদ আর শ্যাওলা-সবুজ পাথর আছে আর ওখানে বসে বসে রাতের শুকনো লালা ঠোঁটের কোনায় নিয়ে ওরা কাপড় খাচতে থাকে। আমি কোমর পানিতে নেমে ডুব দিতে থাকি হুসহাস...আর ডুব দিতে দিতে আমার মাথায় পানি লাগলে চাঁদিটা হিম হিম হয় তখন তিরিশ বছরের হিসাব করা যে সম্ভব এরকম আমার রাতের অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে মনে হয়। কিন্তু তাও গোসলের সময়গুলোতে আমি খুব বেশি অবসর পাই না। গোসলে নামতে নামতেই আলতামির যার একটা বান্দর আছে আর বান্দরটা সারাক্ষণ আলতামিরের কান্ধে চেপে থাকে না হয় টিভির ওপর বসে থাকে আর চিক চিক করে আওয়াজ তোলে মাঝে মাঝেই আর আমি পানিতে নামলেই বান্দরটা মহা বিরক্ত হয়ে চিল্লায় ওপর থেকে আর আলতামিরও তখনও বান্দরের সাথে চিল্লাতে থাকে। বলে, ওই তাত্তাড়ি আয়। আলু সিদ্ধ হয়া গেছে! সানা কর তাত্তাড়ি! কাস্টমার আইলরে আইল!

আমি ডুবতে ডুবতে তখন হিসাব করতে চাই যে চল্লিশ টাকা দিনে তিরিশ বছরে আমার কত টাকা পাওনা হয় কিন্তু আলতামিরের চিল্লানিতে আমার হিসাব টলে যায়। আমার চোখের সামনে তখন সিদ্ধ সিদ্ধ আলু আর কাচা মরিচ আর ইন্ডিয়ার বোল্ডার পিয়াজ ভেসে ওঠে। সরিষার তেলের ডিব্বাটাও ভেসে উঠতে উঠতে মিলিয়ে যায়। আর মনের ভেতর একটা তাড়া তৈরি হয় যে ওইসব মিলমিশ করে আঙুলের ভেতর আলুর টুটি চেপে চেপে আমাকে সানতে হবে। সানতে সানতেই আমাকে সানা বানাতে হবে। বানানোর পর সেগুলো পাঁচ টাকা হিসাবে ছোট ছোট বল বানিয়ে সাজিয়ে রাখতে হবে আর তখন জমিতে যাওয়া মানুষেরা বা অফিসে যাওয়া কেউ কেউও হোটেলে ঢুকতে থাকবে আর সরু সরু চোখে সানার বলগুলোকে দেখতে থাকবে। দেখতে দেখতে ভাববে সানা আজ ছোট হয়ে গেল কিনা! তারপর অর্ডার দিবে। দশ টাকার ভাত আর পাঁচ টাকার আলুভর্তা। সঙ্গে ডাল থাকে, তবে সবাই তো ডাল খায় না। ডালের দাম আছে!



আলতামির যে আমাকে ঠকাচ্ছে এই ধারণা অবশ্য আমি প্রথম পাই গোসল করতে গিয়েই। পাথরঘাটের হলুদ আর শ্যাওলা-সবুজ পাথরে স্বামীর লুঙ্গি খাচতে খাচতে লুৎফা আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করে, আপনি কত পান?

কসকো সাবান দিয়ে আমার পা ডলা বন্ধ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ লুৎফার দিকে বেবুঝের মতো তাকিয়েই থাকি। তারপর উঠিয়ে রাখা ভিজা লুঙ্গি কিছুটা নামিয়ে আনি, সাবান মাখানোও বন্ধ করে দিই। লুৎফার মুখে তখন অর্থহীন হাসি অ্যান্টেনায় আটকে থাকা ঘুড্ডির মতো ফড়ফড় করে। আমি বলি, কীসে ফের কত পাই?

লুৎফার মুখের হাসির ঘুড্ডিটা এবার বাতাস পায় যেন আরো—লটপট করে। বলে, আপনে যে বোকা আছেন এইটা জানেন আপনে?

আমার সাঁই করে মেজাজ চড়ে যেতে ধরে। কিন্তু লুৎফার হাসিটা দেখতে আমার ভালো লাগে। কারণ হাসতে গিয়ে তার মুখটা নড়ে ওঠে আর তাতে তার নাকে মটরদানার মতো যে ছোট পাথর সেটা ঝিলিক দিয়েই মিলিয়ে যায়। আমি আরেকবার সেই ঝিলিক দেখার জন্য তাকিয়ে থাকি। তাতে লুৎফা একটু সন্ত্রস্ত হয়ে আশে-পাশে তাকিয়ে নেয়। কাউকে দেখতে না পেয়ে সে আরেকবার হাসে। তাতে আরেকবার নাকফুলটা ঝিলিক দিলে আমার তাকিয়ে থাকা সার্থক হয়। লুৎফা তখন বলে, এই রকম পরের বউয়ের দিকে হাবার মতন তাকায়ে থাকবেন না!

কিন্তু আমি তাকিয়েই থাকলে সে লুঙ্গি থুপথুপানোতে মনোযোগ দেয়। কিন্তু বেশিক্ষণ পারে না। থপ করে লুঙ্গিটা পাথরের রেখে উঠে দাঁড়ায়। তার কোলের কাছের শাড়িটা ভিজে গিয়ে সবুজ রঙটা আরো গাঢ় হয়ে থাকে। কিন্তু নাকফুলের দিকে তাকিয়ে থাকতেই আমার ভালো লাগে যদিও। আর লুৎফা বলে, আপনে তো খুবই হাবলা আছেন! বললেন না আপনারে কত টাকা দেয় আলতামির?

আমি বলি, চল্লিশ টাকা দেওয়ার তো কথা!

লুৎফা চোখ কুঁচকে ফেলে—চল্লিশ! মোটে! আমার স্বামী তো একশ বিশ টাকা পায়! ভাতের হোটেলে তো তিনিও কাম করেন! আপনারে তো আলতামির ঠকায়া ঠকায়া রাখে!



কথাটা আমার মাথার ভেতর ঢুকে যায়। আমি তাড়াতাড়ি গোসল শেষ করি আর হোটেলে যাই। আলতামির তখন ঝিলিমিলি রঙিন টিভি অন করে সকালের কাস্টমারের আশায় ছোট ক্যাশবাক্সটা নিয়ে বসা। আমি হোটেলে ঢুকেই আলতামিরের দিকে তাকাই। পরক্ষণেই চোখ যায় তার বান্দরটার দিকে। ক্যাশবাক্সের পাশে বসেই সে তখন কলা খাচ্ছে। অর্ধেক মতো খাওয়া হয়েছে। আমি অনেক দিন কলা খাই না, এই রকম মনে হয় তখন। আর তখনই আলতামির রুম্মনকে চিৎকার করে ডাক দেয়। ডাক দিয়ে আমাকে ভাত দিতে বলে। যেন আমি তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠে 'ম্যাচিয়ারে'র কাজে রেডি হতে পারি। ভেজা লুঙ্গি হোটেলের পেছনে মেলে আমি তখন ভাত খেতে বসি। সানা আর ভাত। সঙ্গে একটা কাচা মরিচ পাওয়া যায়। পেঁয়াজ চাওয়া যায় না। পেঁয়াজ খুব আক্রা। খেতে খেতে আমার লুৎফার কথা আর মনে পড়ে না।



কিন্তু ঘুমাতে গেলে প্রথমেই লুৎফার কথা মনে আসে। তার পা যে এমন ফরসা! এত ফরসা সে কীভাবে হলো কে জানে? তার বাপ-মা হয়তো ফরসা ছিল। কিংবা তার বাপ-মা হয়তো তাকে নদীতে পেয়েছিল। হয়তো কোনো একটা ডালিতে বানের টানে ভেসে ভেসে সে এসেছিল। লুৎফার নাকফুলটার কী ঝিলিক...এত ঝিলিক নাকফুলটা কীভাবে দেয় কে জানে! এরকম নাকফুল সে কোথা থেকে কিনেছে এটা একবার জানতে হবে। লুৎফা নাও বলতে পারে। তখন লুৎফার স্বামীকে জিজ্ঞেস করতে হবে। নাকফুলটা নিশ্চয়ই তার স্বামীই কিনেছে। কিন্তু আমি তার স্বামীকে চিনি না। লুৎফার বাড়িতে একদিন চলে গেলে তার স্বামীর দেখা মিলবে। বা তার স্বামীর ভাতের হোটেলে। কিন্তু সে কোন ভাতের হোটেলে কাজ করে আমার জানা নাই। লুৎফার নাকফুলটা ঝিলিক দিয়ে মনে আসতে আসতে তার কোলের কাছে যে গাঢ় সবুজ সেটাও মনে পড়ে যায়। এই রকম সবুজ খালি পাওয়া যায় আম বাগানের ভিতরেই। কসকসা সবুজ। আমের যে-গাছগুলার মেলা বয়স হয়েছে তাদের মোটা মোটা ডালের ভিতর এরকম ঘন ঘন সবুজ পাতা থাকে। না ভিজলেও পাতাগুলাকে তাই ভিজা ভিজা লাগে। লুৎফার কোলটা অবশ্য এমনিতেই ভিজা ছিল। ওরকম সবুজ ভিজা কোল নিয়ে কি লুৎফা মিথ্যা বলবে? লুৎফা তাইলে ঠিকই বলেছে যে আলতামির আমাকে ঠকায়ে ঠকায়ে রাখে হোটেলে। দিন চল্লিশ টাকা। মেলা ঠকা। আমি নিশ্চয় এরচেয়ে বেশি পাবো। নিশ্চয় পাবো। আর তিরিশ বছর ধরে তো সে আমাকে কোনো টাকাই দিলো না। এ নিয়ে আলতামিরের সাথে আমার হিসাব-নিকাষ হওয়া দরকার। সক্কালেই হওয়া দরকার! তখন আমি আবার হিসাব করতে বসি তিরিশ বচ্ছরে আমি কত টাকা পাই আলতামিরের কাছে। কিন্তু হিসাব মেলে না। তখন আমি লুৎফার কথা ভাবি যে সে নিশ্চয় আমাকে ঠিকঠাক হিসাব করে দিতে পারবে।



ফলে পরদিন, তার পরদিন, তার পরের পরদিন আমি ঘাটে যাই আর বসে থাকি। কিন্তু লুৎফা আসে না। বেলা চড়ে যায়। নদীর ওপর থেকে আলতামির ও তার বান্দর চিল্লায়। আমি গোসল না করেই হোটেলে ঢুকে পড়ি। আর আলতামিরের ওপর হিসাব নিয়ে হামলা করতে যাই আর তখনই আলতামির রুম্মনকে চিৎকার করে ডাকে আর আমাকে একথালা ভাত দিতে বলে। শুধু ভাত। সানা নাই। কারণ সানা এখনো আমি করি নাই। কিন্তু লুকিয়ে একটা সিদ্ধ আলু দেয় রুম্মন। তাতে লবন মাখিয়ে আমি খাই। বান্দরটা হেলেদুলে টিভির ওপর গিয়ে বসে। আর টিভি ছেড়ে দেয় আলতামির। হিন্দি একটা চ্যানেলে তখন গান বাজে। মে তেরা দুশমন...দুশমন তু মেরা...মে নাগিন তু সাপেরা...গান বাজতে বাজতে একটা মেয়ে ঘুরে ঘুরে নাচে। তখন একটা কাস্টমার ভাত খেতে ঢুকে টিভির সামনে বসে যায়। তাকে ভাত দিলে সে ভাত খায় তবে ভাতের দিকে তাকায় না। তাকে গত রাত্রের সুরুয়া দেওয়া হয় কাতল মাছের। সে সুরুয়া দিয়ে মেখে মেখে মে তেরা দুশমন খেতে থাকে...আর আমি ভরপেট খেয়ে সানা সানতে থাকি। আলতামির তখন রোদ ঢাকার জন্য একটা চট ঝুলিয়ে দেয় তার মুখের ওপর। ক্যাশ ছায়াশীতল হয়ে ওঠে। বান্দর টিভির ওপর চুপচাপ বসে থাকে। দোকানে কাস্টমার আসতে থাকে। আমার সানা করা শেষ হয়।



এর মধ্যে মধ্যে আরো সাতটা বছর কেটে যায়। লুৎফার তিন-চারবার পেট হয়। আর প্রতিবারই মরা বাচ্চা পয়দা করলে তাকে তার স্বামী ধুমধুম করে পেটে-পিঠে মারে। তাতে লুৎফা একটু কাহিল হয়ে যায়। সাত বছরের ধাক্কা অনেক বড় ধাক্কা এরকম বললে লুৎফা ঘাটে আমাকে হঠাৎই মেলা দাঁত দেখায় আর বলে, সাত বচ্ছর না? সাত বচ্ছর কয় মাসে হয় আপনে জানেন? আমার সামনে হাবামি করবেন না আপনে! আপনের হাবামি আমি আপনের পিছনে ঢুকায়া দিবো!

আমি বুঝি এ সাত বছরে লুৎফা অনেক বদলিয়ে গেছে। বদলানোই স্বাভাবিক। এই কথা আলতামিরকে বলতে গেলে আলতামির ঝাড়ি মেরে বলে, যা ভাত খা।

আমি বলি, সাত বছর ধইরা তো ভাতই খাই খালি! আজকা রুটি খাবো।

আলতামির খ্যা খ্যা করে হাসে। এটা কী হাসির কথা কিনা আমি বুঝি না। না বুঝে আমি হাসি হাসি মুখ করে থাকি। আলতামির তখন একটা কাস্টমারকে সাক্ষি টানে। সাক্ষি টেনে বলে, এই মাঙের পুত কয় সে নাকি সাত বছর ধইরা ভাত খাইতেছে!

আমি বলি, গ্যালান ক্যান ভাই? আমারে না গ্যালায়া আপনে আমার পাওনা টাকা দ্যান।

আলতামির খেঁকিয়ে ওঠে। বলে, যা ভাত খা গা যা!

কাস্টমারটা তখন মিটিমিটি হাসে। যেন সে জানে ঘটনা কী। কিন্তু সে কিছু বলে না। আমি তখন চুপচাপ ভাত খাই। সানার সঙ্গে কচুর ঘাঁটি। কচুর ঘাঁটির সাথে ভাত মেখে নিলে ভাত লতপত করে। ভাত টানতে তখন হেবি লাগে। কাস্টমারটা বিল দিয়ে উঠে গেলে আমিও তার পিছে পিছে যাই। কাস্টমারটা একটা সিগারেট ধরিয়ে টানে। আমাকে পেছনে আসতে দেখে বলে, সিগ্রেট খাবি?

আমি মাথা নাড়াই। সে সিগারেট বাড়িয়ে দেয়। তখন ইচ্ছা না করলেও সিগারেট খাই। তখন কাস্টমারটা বলে, এই হোটেলে কদ্দিন আছিস?

আমি আঙুলে হিসাব করি। বলি, একত্রিশ বচ্ছর!

কাস্টমারটাও এবার আলতামিরের মতো খ্যাকখ্যাক করে হেসে ওঠে। আমি সিগারেটে টান দিয়ে কাশতে থাকি। কাস্টমারটা হাসি থামাতে থামাতে বলে, তোর বয়স কত বে কুতুব?

আমি আবারও আঙুল গুনতে থাকি। গুনতে গুনতে বলি, একত্রিশ বচ্ছর!

এবার আরো জোরে জোরে কাস্টমারটা হাসে। হাসতে হাসতে এবার তার মুখের লালা বেরিয়ে যায়। তখন মনে হয় এই লালা আমি চিনি। লালার যে একটা গন্ধ সেইটাও চেনা চেনা লাগে। আমি তখন কাস্টমারটার মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলি, আপনি কি লুৎফার স্বামী?

কাস্টমারটা তখন থতমত খেয়ে যায়। বলে, ক্যান? ক্যান কী হইছে তাতে? লুৎফারে তুই চিনিস ক্যামনে?

আমার মনে পড়ে না আমি লুৎফাকে কীভাবে চিনি। আমি বলি, আপনিও কি ভাতের হোটেলে কাম করেন? আপনারে কত জানি দেয়?

কাস্টমারটা আর কথা বলে না। আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে থাকে। তারপর হনহন করে হেঁটে চলে যায়। তখন আলতামিরের বান্দরটা চিক চিক করে ডেকে ওঠে। আর আলতামিরও ডাকে—কইবে শালা...কই গেলি!

আমি তখন তখনই সিগারেট নিয়ে হোটেলে ঢুকি। আলতামির হাতটা বাড়িয়ে দিলে সিগারেটটা তার আঙুলের দুই ফাঁকে ঢুকিয়ে দিয়ে টিভির সামনে বসি। টিভিতে তখন কী একটা খেলা হয়। একটা খেলোয়াড়ের ওপর অন্য সবগুলো খেলোয়াড় ঝাঁপিয়ে পড়ে। খেলাটা দেখতে দেখতে আমার রাগ হয়। তখন আলতামিরের সামনে গিয়ে আমি দাঁড়াই। আলতামির তাকায়। যেন আমি কী বলব সে জানে। বান্দরটা চিক চিক করে ওঠে আবারও। আমি আলতামিরকে জিজ্ঞেস করি, এই হোটেলে কত বচ্ছর হয় আছি আমি?

আলতামির উত্তর দেয়, তিন বচ্ছর।

আমার তখন আরো রাগ হয়। আমার মনে হয় লুৎফা আসলে এতদিন থেকে ঠিকই বলে আসছে। আলতামির আমাকে ঠকায়েই যাচ্ছে। এবার তার ঘাড়ের মাফলার ধরে টান দিয়ে তার ক্যাশ ভাঙবো। কিন্তু ক্যাশে কত টাকা থাকবে এরকম ভাবতে থাকি আমি। আর তখনই একজন দৌড়ে আসে। হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, ঘাটের ওপর একটা বডি পাওয়া গেছে। বডির অর্ধেক পুঁতা আছে মাটিতে। অর্ধেকটা মানুষ দেখা যায় অর্ধেকটা দেখা যায় না।

এই রকম খবরে সবার আগে টিভির ওপর থেকে লাফ দেয় আলতামিরের বান্দরটা। সে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘাটের দিকে নামতে থাকে। দুয়েকজন কাস্টমার ভাতের থালা হাতে নিয়েই ঘাটের নিচে নেমে যায়। তারা ভাত খেতে খেতে লাশ দেখতে থাকে। দুই জন মেলা ধরাধরি করে, এদিক ওদিক টান দিয়ে, আস্তেসুস্থে বডিটা ওঠায়। কিন্তু বডিটাকে চিনার কোনো উপায় তো নাই। এত কাদা মুখেচোখে আর সারাটা শরীরে। আমরা অনেকক্ষণ লাশটাকে চেনার চেষ্টা করি। কিন্তু লাশের কোনো বিশেষত্ব পাই না। তখন কেউ একজন বলে লাশটার মুখ পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে। আমরা তখন ঝটপট হাতে আজলা আজলা পানি নিয়ে লাশের মুখে দিতে থাকি। কিন্তু লাল আঁইটা মাটি আর কিছুতেই সরে না। তখন ওই আগের লোকটাই বলে, তাইলে লাশটারে ধইরা পাথরের উপ্রে রাখো না বাল। পাত্থর থেইকা মুখটা নামায়া দিবা নিচে...স্রোতে তাইলে সব মাটি ধুয়া যাবে!



দুই তিনজন লাশটাকে ধরে পাথরের ওপর রাখতে যায় কিন্তু তার আগেই লাশটা, যেন জ্যান্ত কুমির, গড়িয়ে পানিতে হুশ করে নেমে যায়। আর নেমে যাওয়ামাত্রই স্রোতের টানে তলিয়েও যায়। অনেকে হইহই করে ওঠে। যাদের ভাত খাওয়া হয়ে গিয়েছিল তারা থালা রেখে পানিতে নেমে পড়ে। লাশ পাওয়া যায় না কিন্তু তারা স্রোতের টানে ভেসে যায় অনেকদূর। পুনর্ভবার লাশ আর মানুষেরা ভেসে ভেসে অনেক দূরে চলে যায়। যাদের ভাত খাওয়া তখনো হয় নি তারা আবার ভাতে মনোযোগ দেয়। আলতামিরের বান্দরটা লাশডোবা কাদার ওপর অনেকক্ষণ দাপাদাপি করলে আলতামির তাকে আদর করে ডেকে ডেকে হোটেলে নিয়ে যায়। আর আমি টেবিলে জমা এঁটো ভাত-টাত সাফি দিয়ে মুছে মুছে ভাঙা ডালিতে জড়ো করতে থাকি। তখন ভেসে যাওয়া মানুষগুলো ফেরত আসে কেউ কেউ। তারা জানায় পানিতে মেলা টান...এই টান উজায়া লাশটা আর পাওয়া যাবে না। তবে তাদের একজন নাকি লাশটা ধরতে পেরেছিল একবার। আর তাতে তার মনে হয়েছিল শরীরটা মেয়েমানুষের। তখন অনেকেই খ্যা খ্যা করে ওঠে। জানায় ওই বডিটা যে মেয়ের তার জন্য লাশের শরীর চটকানের দরকার তো নাই। লাল মাটির ভিতরেই একটা শাড়ি ছিল আর একটা ব্লাউজ ছিল নীল। তখন আরেকজন বলে ব্লাউজ নীল ছিল না...ছিল সবুজ। নীল আর সবুজদের মধ্যে তখন একটা ঝগড়ার মতন হয়। এটা ততক্ষণ চলতে থাকে যতক্ষণ না রানি কেন চাকরানি সিনেমাটা শুরু হয়। সিনেমাটা শুরু হলে দেখা যায় একটা রানি অনেকদিন ধরে একটা বাড়িতে রাজার হালে বা রানির হালেই ছিল। তার বড় বড় বুকে অনেক রকমের আশা থরেথরে সাজানো ছিল। স্বামীর সোহাগ ও সোহাগ চলাকালীন ফুলপাতাপ্রজাপতিমাখা গান ছিল তারপর তার পেট ফুলে গেল আর তার খুব কষ্ট হলো বাচ্চা পয়দা করতে। সে আ আ আ করে অনেক অনেক চিল্লায়...তার চিল্লানিতে একজন ভাতের থালায় বমি করে দেয়া সত্বেও রানির একটা মরা বাচ্চা হয়। আর বাচ্চা মরে গেলে রানির জীবনে মেলা দুঃখকষ্ট নেমে আসে। তাকে অনেকগুলো বাসন মাজতে হয় আর ডালি ডালি কাপড় ধুতে হয়। এতে দর্শকের অনেকেই নাক টানে। কেউ কেউ বলে সানা খুবই ঝাল হইছে! বান্দরটাও একবার হাঁচি দেয়। এভাবে রানি ওই বাড়ির চাকরানি হয়ে ওঠে। আর তখন কেউ তাকে বিষ খাইয়ে দিলে তার শরীরটা নিথর হয়ে থাকে। নিথর শরীর স্বামী আর শাশুড়ি মিলে নদীর পানিতে ফেলে দেয় রাতের অন্ধকারে। কিন্তু নদীর পানি তখন চিৎকার করে ওঠে। বলে এই বিষখাওয়া শরীর আমি নিতাম না! নিতাম না! নিতাম না! নদীর ঢেউ তখন শরীরটাকে আছড়িয়ে ডাঙায় ফেলে। ফেললে রানি বিস্তর বমি করে। আর তার মুখের নীল ধীরে ধীরে সাদা হয়ে আসে। তখন রানি মুখ হা করে শ্বাস নেয়। আর সবাই দেখে রানি তার নীল ব্লাউজটা খুলে ফেলছে আর ভেতরে একটা সবুজ ব্রা খলবল করে উঠলে বান্দর ও আমাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এর বেশি কিছু হয় না তখন। খালি রানি বালু হাতে তুলে কসম কাটে যে সে তার এই মৃত্যুর শোধ নিবে। তখন কে জানি বলে এই সিনেমা হিন্দি একটা সিনেমার নকল। এরকম একটা কসম কাটার সিন সে এই কিছুদিন আগেও দেখেছে। কিন্তু নকলের নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই অ্যাডভ্যাটাইজ শুরু হয়ে যায়। তখন অন্যদের উদ্দীপনাও কমে যায়। লম্বা সময় ধরে ঢেউ টিনের অ্যাড চলতে থাকলে সকালটা দুপুরের দিকে গড়াতে থাকে। তখন হঠাৎ একটা খবর আসে কারো মোবাইলে যে মহানন্দায় নাকি একটা মাছকইন্যা ধরা পড়েছে। প্রথমে আমরা এটা বিশ্বাস করি না। গল্পকথায় মাছকইন্যা ইত্যাদি থাকে। তাই বলে মহানন্দার মতো উটকা একটা নদীতে? এটা তো হতেই পারে না। তখন মোবাইলঅলা অন্যদের ফোন করলে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হয়। একজন বলে, মাছকইন্যা বলে তো কিছু নাই। হতে পারে পানির জিনের যে বাদশাহ থাকে তার বেটিরে ধরেছে কাশেম মাঝি। তখন অন্যদের খুব হিংসা হয় কাশেম মাঝির ওপর। তারা ভাবে যে কাশেম মাঝির শক্তপোক্ত গতর দেখেই হয়তো জিনের বেটি তার কাছে ধরা দিয়েছে। একজন বলে, এইবার কাশেম মাঝিকে তাইলে চুইষা খাবে জিনের বেটিটা!

ঘটনা আরো সবিস্তারে জানতে বারবার মোবাইল করা হয় এদিকে ওদিকে। এর মধ্যে মোবাইলের টাকা ফুরিয়ে গেলে আলতামির আমাকে দিয়ে ফ্লেক্সিলোড করায় দুইবার। একবার তিরিশ একবার বিশ। দুইবারই আমার মনে হয় এই টাকা নিয়ে পালিয়ে যাবো কিনা! তিরিশ বিশ টাকায় কতদূর যেতে পারব এরকম ভাবনা আসে। তাছাড়া ত্রিশ বছরেরও বেশি সময়ের পাওনা বাকি আছে আলতামিরের কাছে এরকম ভেবে আর পালানো হয় না। আবার এরকম একটা উৎসাহও থাকে যে কাশেম মাঝি কীভাবে মাঝকইন্যা বা জিনের বেটিরে ধরল তাও জানা দরকার। জিনের বেটি কী করে কাশেম মাঝিকে চুষে খাবে তারও কিছু জানার ইচ্ছা মনে উঁকি দেয়।



কিন্তু ফোনে ফোনে খুব বেশি জানা সম্ভব হয় না। কিন্তু টুকরা টুকরা খবরাখবর জোড় দিলে যা হয় তাতে এরকম দেখা যায় যে প্রতিদিনের মতোই কাশেম মাঝি তার ভাঙা ডিঙিটা নিয়ে মহানন্দার মাঝে গিয়েছিল কারেন্ট বা সুতা জাল নিয়ে। পানির টান থাকায় এই সময় বোয়াল ধরা পড়ে বেশি আর তার কয়েকটা ধরলে কাশিম মাঝির চাল কেনার সাথে সাথে গুল কেনারও পয়সা বেরিয়ে গেলে সন্ধ্যার দিকে আড়তে বসে তার গুলতানিরও হিল্লা হয়। সে আশায় জাল ফেলতেই তার জাল খলবল করে ওঠে। বড় কোনো মাছ ধরা পড়ছে এরকম চিন্তা করে জাল টানতেই দেখে একটা মাছকইন্যা মতান্তরে একটা জিনের বেটি মতান্তরে একটা জলপরি তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। কাশেম মাঝির মাথাটা ঘুরে ওঠে আর তখনই মাছকইন্যা মতান্তরে জিনের বেটি মতান্তরে জলপরিটা তার হাত লম্বা করে কাশেম মাঝির দাড়ি ধরে টান দেয় আর তাতে কাশেম মাঝি নদীতে ছলাৎ করে পড়ে যায় আর স্রোতের সাথে তাকে মাছকইন্যা মতান্তরে জিনের বেটি মতান্তরে জলপরিটা টানতে টানতে নিয়ে যেতে ধরে। কিন্তু কাশেম মাঝির শরীরে দারুণ শক্তি--নিজের গাভিন গরুটা বাঁচাতে সে একবার আলীনগরের ঝাণ্ডুদের ষাঁড়ের সাথে লড়ে গিয়েছিল—ফলে কাশেম মাঝির সাথে মাছকইন্যা মতান্তরে জিনের বেটি মতান্তরে জলপরিটার খুব ধস্তাধস্তি হয় পানির মধ্যে। আর শেষে কাশেম মাঝি মাছকইন্যা মতান্তরে জিনের বেটি মতান্তরে জলপরিটাকে ডাঙায় তুলে নিজেও জ্ঞান হারায়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মাছকইন্যা মতান্তরে জিনের বেটি মতান্তরে জলপরিটা ডাঙায় খলবল করতে করতে পানি খুঁজছে কিন্তু তাকে পানি থেকে দূরে রাখার সবরকম ব্যবস্থা করা হয়েছে।



আমরা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গল্পটা শুনি আর আফসোস করতে থাকি। এই ঘটনাটা পুনর্ভবায় হলে কী আরামেই না দেখা যেত এইরকম ভাবতে ভাবতে আমাদের আফসোস আরো বাড়ে। তখন একজন বলল, পুনর্ভবায় এই রকম মাছকইন্যা থাকার কোনো কারণ তো নাই! যেহেতু এই নদীটা বেশি ডিপ না! পুনর্ভবায় মেলা পানি...মাছকইন্যার ঘরবসতি ওইখানে থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু আরেকজন বলে মহানন্দা নদী হিসাবে আসলে কিন্তু কিছু নাই। এই পুনর্ভবাই রাইসমিলের বাঁক ফিনিশ করে মহানন্দা হয়ে গেছেগা। আরেকজন তখন খেঁকিয়ে ওঠে যে আসল নদী এই পুনর্ভবা না...আসল নদী ওই মহানন্দাই। ওইটাই ইন্ডিয়া থেকে ঘুরতে ঘুরতে এদিকে আসছে।

এটা নিয়ে আরো ঝগড়া শুরু হলে সেটাও বেশিক্ষণ চলে না। কারণ তখন সবার ইচ্ছা কাশেম মাঝির উদ্ধার করা মাছকইন্যা মতান্তরে জিনের বেটি মতান্তরে জলপরিটা দেখার। এরকম সময় এক ভুটভুটিঅলা বলে যে সে যাবে কাশেম মাঝির বাড়ি। তখন আমরাও তার সাথে যাবার কথা বললে আলতামির তার হোটেল বন্ধ করে দেয়। আর তার বান্দরটা ভুটভুটির ওপর সবার আগে উঠে বসে ব্যাপক আগ্রহে। ভুটভুটিঅলা তার নসিমন স্টার্ট করতে করতে সবাইকে জানিয়ে দেয় যে এই নিয়ে যাওয়া বাবদ তাকে মাথাপিছু পাঁচ টাকা করে দিতে হবে। তবে এরকম কথায় কেউ উৎসাহ দেখায় না। একজন বলে, জিনের বেটিরে দেখতে নিতাছ...তুমি তো মিয়া সোয়াব পাবা...টাকা নিবা ক্যান?

তখন আরেকজন বলে, ওইটা জিনের বেটি না। তবে ওইটা মাছকইন্যা হতে পারে!

আরেকজন বলে, জলপরিও হতে পারে। জলপরির নখে কাটা কাটা দাগ থাকে। আর শরীলের বিশেষ জায়গায় থাকে আঁইশ। আঁইশ দেইখা জলপরি চেনা যায়!

লোকটা তখন মনে হয় কল্পনায় জলপরির আঁইশ দেখতে থাকে। ফলে কারো তেমন কোনো জোরালো সিদ্ধান্ত ছাড়াই ভুটভুটি চলতে শুরু করে। কিন্তু কিছুদূর যেতে না যেতেই মটোর সাইকেলে চড়ে একজোড়া পুলিশ আমাদের ভুটভুটি থামিয়ে দেয়। আমরা জানাই যে আমরা আসলে কাশেম মাঝির বাড়ি যাই জিনের বেটি মতান্তরে মাছকইন্যা মতান্তরে জলপরি দেখতে তখন পুলিশ দুইটা খলখল করে হাসি দিয়ে পিচিক পিচিক পানের পিক ফেলতে থাকে আর বলতে থাকে ওইটা একটা কিছু না!



আমরা তখন খুব আশ্চর্য হই। ‘কিছু না’র মানে কী? তখন জিনের বেটির পক্ষের লোক জোরালো হয়। বলে যে তারা তো ঠিকই বলেছিল। কারণ জিনের বেটি চাইলেই কিছু না হয়া যেতে পারে। পুলিশজোড়া তখন আরো হাসে। পান খুব জোরে জোরে চিবাতে চিবাতে বলে ওইটা কিছু না মানে আসলে একটা ডেডবডি—বাড়ির বউয়ের ডেডবডি! জলপরি বালপরি কিছু না! পুলিশেরাও এইসব খবর শুনে হন্তদন্ত হয়ে গিয়েছিল তো ঠিকই কিন্তু গিয়ে দেখে কাশেম মাঝির উঠানের ওপর হাত-পা ছড়ায়ে একটা বউ মরে পড়ে আছে। তারাও খুবই আশাহত, এক পুলিশের তো কান্দনই চলে আসতে চায়! এর মধ্যে এক সাংবাদিক আগে আগে আসে আর তার পেছন পেছন একটা ভ্যান চলে আসতে থাকে। যার ওপর শুইয়ে রাখা আছে ডেডবডিটা। আর ডেডবডিটার পাশেই কারেন্ট জাল দিয়ে দুই হাত বাঁধা কাশেম মাঝি। ভ্যানের সাথে সাথে বিস্তর মানুষ। তারা আগ্রহ নিয়ে কাঁথামোড়া ডেডবডি আর কাশেম মাঝিকে দেখে। পুলিশজোড়া জানায় কারেন্ট জাল দিয়ে ডেডবডি ধরার অপরাধে কাশেম মাঝিকে গ্রেফতার করা হয়েছে কিন্তু এই সাংবাদিক চাঞ্চল্যকর খবর নেওয়ার জন্য কাশেম মাঝির সাথে কথা বলতে চাইছে। যদিও কাশেম মাঝি কোনো কথা বলতে চায় না। সে মুখ আর চোয়াল বোয়াল মাছের মতো শক্ত করে বসে আছে।



সমস্ত শুনে ভুটভুটিঅলা যারপরনাই খুব বিরক্ত হয়। আলতামিরও হতাশ। তবে সবচেয়ে বেশি হতাশ হয় আলতামিরের বান্দরটা। সে হতাশা ঢাকতে না পেরে লাফিয়ে ভ্যানের ওপর ওঠে আর চিক চিক আওয়াজ তুলতে তুলতে বডিটার মুখ থেকে কাঁথা সরিয়ে দেয়। আর তখন কাপড়ের নিচের মুখটা ঝিলিক দিয়ে উঠলে আমি দেখি এইটা লুৎফার মুখ। মুখের নাকফুলটা আরো একবার ঝিলিক দিয়ে নড়তে শুরু করে। পরে বুঝতে পারি যে ভ্যানটাই আসলে চলতে শুরু করেছে। তখন আমরা তাড়াতাড়ি ভ্যানটা দাঁড় করাই। কেউ একজন বলে এইটা তো সকালের পাত্থরঘাটের লাশটা! কেউ কেউ বলে এইটা তো লুৎফা! আমার তখন কেমন চোরের মতো লাগে। মনে হয় এইটা যে লুৎফা তাতে আমার কোনো হাত আছে। আমার মনে হয় এইটা যে লুৎফা এবং সে যে মৃত তাতেও আমার কোনো আঁতাত আছে। আমি নিজের ভেতর কেমন করে যেন সংকুচিত হতে থাকি। তখন পুলিশ বলে এটা যে তোমাদের দেখা সকালের বডি তার প্রমাণ কী?

একজন বলে, লাশটার ব্লাউজ দেখলেই প্রমাণ পাওয়া যাবে...কারণ সকালের লাশটার গতরে ছিল নীলচা ব্লাউজ!

তখন আরেকজন তাড়াতাড়ি বলে, না না গায়ে ছিল সবুজ ব্লাউজ। সে দেখেছে নিজের চোখে। পুলিশ বলে এই বডিটা যদি সকালের বডি হয় তাইলে কাশেম মাঝির খালি জেল হবে কারেন্ট জালের জন্য! নাইলে তো তার ফাঁসি কেউ ঠেকাতে পারবে না। কারণ তার কারেন্ট জালে আটকায়েই এই লুৎফা না কী তার মরণ হয়েছে!



কিন্তু এতসব উত্তেজনাকর কথার মধ্যেও কাশেম মাঝি চুপচাপ বসে থাকে। পুলিশের কথায় তার কিছু হয় না বলেই প্রতিয়মান। অন্যরা বলে লাশ কখনকার এইটা প্রমাণের জন্য তো বেশি কিছুর দরকার নাই। লাশটার ব্লাউজ দেখলেই হয়...

তখন লাশটার শরীর থেকে ওপরের কাঁথাটা আরেকটু সরানো হয়। সবাই উদগ্রীব হয়ে দেখে কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে যে বডিটার শরীরে কোনো ব্লাউজ তো নাই। নীল বা সবুজ কোনো রঙই সে পরে নাই। পুলিশ বেশ কিছুক্ষণ বডিটা ঘাঁটাঘাঁটি করে এই ভেবে যে কোথাও যদি ব্লাউজটা আটকে থাকে। কিন্তু কাশেম মাঝির দুর্ভাগ্যের কথা জানিয়ে কোনো ব্লাউজ পাওয়া যায় না। আর তারা লাশটা নিয়ে থানার দিকে বা মর্গের দিকে চলে যায়। সাথে কাশেম মাঝিকেও নিয়ে যায়। আর আলতামির আবার তার হোটেল খোলে। আবার টিভি চালু হয়। আবার বান্দরটা টিভির ওপর গিয়ে বসে। টিভিতে তখন ছামছাম গান হয়। কিন্তু সে গানে কেউ মনোযোগ দিতে পারে না। তাদের মন পড়ে থাকে মর্গে। মর্গে কীভাবে শরীর কাটা হয় তারা কেউ কেউ বর্ণনা করে। কেউ কেউ বলে লুৎফার বডিটা সুন্দর ছিল তাই ডোম ময়না আরামেই শরীলটা কাটবে। তখন এসব ভাবতে ভাবতে কেউ কেউ মেজাজ হারিয়ে ফেলে। একজন আমাকে বলে, ওই তুই না লুৎফারে চিনতি?

আমার হাত কেঁপে যায়। বলি যে না না আমি তো চিনি না তাকে! সাত কি আট বচ্ছর আগে তার সাথে একবার দেখা হইছিল! তারপর তার খালি প্যাট হইত...

একজন বলে খালি প্যাট হইত মানে কি? তার তো বিয়াই হইল তিন বচ্ছর। একবার একটা মরা বাচ্চা বিয়ালো মাইয়াটা...তাকে বোধহয় কেউ বিষ খাওয়াইয়া মাইরা ফেলছে!

তখন আরেকজন রানি কেন চাকরানি সিনেমাটার কথা বলে। বলে যে তার স্বামী রমজানে বিষ খাওয়াইতে পারে।

তখন আলতামির ফেউ করে উড়িয়ে দেয় কথাটা। বলে, রমজ্যাইন্যা ভাতই খাওয়াইতে পারে না! বিষ খাওয়াইবো ক্যামনে?



তাইলে তার বউরে মারল কে?



প্রশ্নটা ঘুরতে থাকে জনে জনে। আর আমার কেমন সংকোচন হয় নিজের ভিতর। মনে হতে থাকে যেন আমিই লুৎফাকে মেরেছি। আমি কি তার শরীরে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছি? তার মুখ-নাকে গামছা ধরে তাকে কাদার ভিতর ডুবিয়ে দিয়েছি? আর বাইরের যা-কিছু প্রত্যঙ্গ সব ভিতরের দিকে ঢুকতে থাকলে আমার বমির মতন লাগে। ওয়াক ওয়াক করে আমি বমি করেও দিই। আর তখন বান্দরটা চিক চিক করে ডেকে ওঠে।

তখন কেউ একজন বলে, নিজে নিজেই মরছে বোধহয়। হয়তো অন্যের প্যাট ছিল ভিতরে। ওই মিয়া তুমার সাথে চিনপরিচয় না ছিল লুৎফার?



আমি বমি গিলতি থাকি চুকচুক করে। তারপর মুখ শক্ত করে বলি, আমি তারে চিনি না বহু বচ্ছর যাবৎ!



অন্যরা তখন হেসে ওঠে। মনে হয় ওরা আমাকে নিয়ে মজা করে। আমিও ওদের সাথে বোকার মতো হাসি। আসলে বোকার মতো না...হাবার মতো। লুৎফা বলত আমি নাকি হাবা! আমি হাসলে তাই হাবার মতোই হাসব!

কিন্তু আমার হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। অথবা হয় কিন্তু আমি বুঝতে পারি না। সন্ধ্যা নেমে আসে আর ভাতের হোটেল এবার ম্রিয়মান হতে হতে মিলিয়ে যেতে ধরে। আমি দুইটা বেঞ্চ একত্রে করে শোয়ার আয়োজন করি। বান্দরটা লাফ দিয়ে আলতামিরের কান্ধে ওঠে। টিভি বন্ধ হয়ে যায় ভালো একটা গানের অনুষ্ঠান হওয়া সত্বেও। আলতামির রওনা দেওয়ার ভঙ্গি করে। রুম্মনকে কী জানি বলে আমাদের ভিতরে রেখে দোকানের ঝাঁপি নামায় আর তখনই বাঁশির আওয়াজ পাওয়া যায়। লম্বা ফুঁ দিয়ে পুড়ুৎ পুড়ুৎ আওয়াজ। এই রকম আওয়াজ শুনে আমার কান খাড়া হয়ে যায়। বাঁশির শব্দের সাথে ধপ ধপ কিছু শব্দ হয়। ঘেউ করে ওঠে একটা কুকুর। শব্দগুলো আরো কাছে আসতে থাকে। আমরা, হোটেলের ভেতর, কেমন একটু কুঁকড়ে যাই। বাইরে কী হচ্ছে বুঝতে না পারায় আমাদের ভেতর একটা জমাট শীত চেপে বসতে থাকে। আর তখনই সশব্দে ঝাঁপি খুলে যায়। আর তিন চারটা পুলিশ ভেতরে ঢোকে। দ্রুততার সাথে ঢোকে আলতামির। আলতামিরের বান্দর চিক চিক করে শব্দ করতে থাকে। মাথাপুলিশ বান্দরকে ধমক দেয়—চোপ!

কিন্তু বান্দর আবার চিক চিক করে ওঠে। পুলিশেরা জিজ্ঞাস করে, কাশেম মাঝি কই?

তখন আমরা বুঝতে পারি যে কাশেম মাঝি আসলে পালিয়ে গিয়েছে। কীভাবে পালিয়েছে আমরা জানতে চাই। কিন্তু পুলিশদের অনেক তাড়া। তারা বলে না কিছু। কিন্তু অনেক তাড়া সত্বেও তারা কোথাও যায় না। হোটেলের ভেতরেই খুঁজতে থাকে। একটা পুলিশ বলে, পালাবার আগে ভাত খাওয়ার কথা বলতেছিল হারামিটা। এইখানেই আছে কোথাও বোধয়...ভাত খাইতে আসছে!

মাথাপুলিশ বলে, ভালো কইরা খোঁজ কুত্তাটারে। পাইলে বিচিতে গুলি মারবি। ডাইরেক্ট গুলি!

বান্দরটা আবার চিক চিক করে ওঠে। আমরা আমাদের কাঁথার ভেতর ইত্যাদি দেখাই পুলিশদের আর বারবার জানাই কাশেম মাঝি এখানে আসে নাই আসে নাই। আলতামির মাথাপুলিশকে একপাশে টেনে নেয়। বোধহয় টাকাপয়সা সাধে। তখন মাথাপুলিশটা ঠাস করে একটা চড় মারে আলতামিরকে। চড়ের শব্দের সাথে লাফ দিয়ে দূরে উড়ে গিয়ে পড়ে বান্দরটা। আর আলতামির ছিটকে পড়ে মাটির হাঁড়ার ওপর। মাটির হাঁড়া শক্ত আছে যে আলতামির তার ওপর পড়ার পরও ভাঙে না। তখন সেখানে ছুটতে ছুটতে লুৎফার স্বামী রমজান আসে। রমজানকে অনেক উদভ্রান্ত দেখায় না। মনে হয় তার হুশ ও দিশা ঠিকই আছে। সে এসেই পুলিশকে বলে, কাশেম মাঝি আসছিল তার কাছে!

মাথাপুলিশের কান সজাগ হয়ে যায়। রমজান জানায় সে কাশেম মাঝিকে ধরার চেষ্টা করছে বহু। কিন্তু তার শরীরে মেলা জোর।

তখন আলতামির জানায় এটা সত্যি যে কাশেম মাঝির শরীরে মেলা শক্তি। নিজের গাভিন গরুটাকে বাঁচাতে কাশেম মাঝি একবার আলীনগরের ঝাণ্ডুদের ষাঁড়টার সাথে লড়ে গিয়েছিল। তাতে ষাঁড়টার একটা শিং ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু তারচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছিল ষাঁড়টা আর পাল দিতে পারত না। তখন আশি টাকা কেজি দরে তার মাংস বিক্রির আলোচনা উঠলে ষাঁড়টা একদিন বর্ডার ক্রশ করে ইন্ডিয়া চলে যায়। তারপর আলতামির একটু ভাবে। বলে, ইন্ডিয়াতে ষাঁড়টা বোধহয় ভালোই আছে! বোধহয় তাকে আর কেউ মারে নাই!

তখন মাথাপুলিশ বলে, কাশেম মাঝিও যদি ইন্ডিয়া চলে যায় বর্ডার ক্রশ করে? তখন অন্য পুলিশদের মুখেও আতঙ্ক এসে জমে। পুলিশদের মধ্যে খুব ভয় যে কাশেম মাঝি না থাকলে এই খুন রহস্যের কোনো অগ্রগতি হবে না। কেসটা ঝুলে যাবে। আর তখন ওপর থেকে নানা রকম চাপ আসতে থাকবে। নানা রকমের টানাহ্যাঁচড়ার মধ্যে পড়তে হবে সব্বাইকে। এই জন্য একটা আসামী থাকা খুব দরকার, খুবই দরকার। তখন রমজান জানায় যে আসামীর দরকার পড়লে আসামী তো আছেই হাতের কাছে।



মাথাপুলিশ তখন রমজানকে ধরে। এমনভাবে ধরে যেন পুলিশ ধরেছে তাকে। পরে মনে হয় সত্যিই তো পুলিশই ধরেছে তাকে। তখন আমরা নিজেরা ভিতরে ভিতরে একটু হেসে উঠি। পুলিশের ধরার মধ্যে একটা বিষয় আছে যা দেখলে কেমন আরাম আরাম লাগে। কিন্তু রমজানের আরাম লাগে না। রমজান ছটফট করতে করতে জানায় আজকে সকালেও তার কাছে একজন লুৎফা বিবির খোঁজ নিছে। রমজানের ধারণা কাশেম মাঝির সাথে সাথে তারও এই খুনে হাত আছে। তারপরেই রমজান শালা আমাকে দেখিয়ে দেয়। সব কটা পুলিশ আমার দিকে তাকালে আমি একটা দৌড় দিই। দৌড়ে হোটেল থেকে বের হয়ে ঘাটের দিকে নেমে যাই। আমার লুঙ্গি বাতাসে আটকে যায়। আমি পড়তে পড়তে পড়ি না। পেছনে পুলিশের বাঁশি বেজে ওঠে। তারপর একটা গুলির আওয়াজ হয় ঠাস...তখন যোদ্ধা সিনেমার একটা সিন মনে পড়ে যায় আমার আর আমি মাটিতে শুয়ে যাই। আমার মনে হয় একটা গুলি আমার মাথার উপর দিয়ে চলে যায়। আবারও একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডেকে ওঠে। তখন আবার একটা গুলির শব্দ হয়। আমি পুনর্ভবার পাড় দিয়ে আম বাগানের দিকে দৌড়াতে থাকি। কিন্তু বেশিক্ষণ দৌড়াতে পারি না। আমার পা কাদার মধ্যে ঢুকে যায়। আটকে যাই আমি। হাঁচড়পাচড় করি। আর দেখি আমি সেখানে আটকে আছি যেখানে সকালে লুৎফার লাশ পাওয়া গিয়েছিল। তখন টর্চের বড় বড় ফোকাস ফেলতে ফেলতে পুলিশেরা আসে। আলতামিরও আসে। আর আসে বান্দরটা। বান্দরটা কোনো শব্দ করে না। শুধু মুখের কাছে দিয়ে খুব অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। রমজান আসে সবার পরে। তার চোখ ধ্বকধ্বক করে। মাথাপুলিশ হিসহিস করে। বলে, যে-লালে উৎপত্তি সে-লালে বিনাশ! এখানেই তুই কব্বর দিছিলি না লুৎফার? এখানেই তোর মরণ লেখা ছিল!

বলেই মাথাপুলিশ তার পিস্তল আমার দিকে তাক করে। আমি তখন চোখ বন্ধ করে নিই। আর ভাবি যে আমি এখন মরে যাবো কিন্তু আলতামিরের কাছে আমার যা পাওনা একত্রিশ বচ্ছরের তা আর পাওয়া হলো না। তখন একটা গুলির শব্দ হয় ঠাস। আর আমি যখন চোখ খুলি দেখি আমাকে কোথায় যেন নিয়ে আসা হয়েছে আর সেটা যে একটা থানা সেটা প্রধানমন্ত্রীর ছবি ঝুলতে দেখে বুঝতে পারি। আর আমি একটা শক্ত বেঞ্চিতে বসে আছি। বেঞ্চির হাতল আছে আর হেলান দেওয়ারও জায়গা আছে ফলে আমি হেলান দিয়ে তাকিয়ে থাকি সামনের দেয়ালে যেখানে একটা তেলাপোকা উড়ে এসে বসে। মাথাপুলিশ সামনে এসে দাঁড়ায়। তাতে আলো অন্ধকার হয়ে যায়। আর পুলিশটাকে বিকট লাগে। কিন্তু পুলিশের হাতে কী সব কাগজপত্র। মাথাপুলিশ বলে, এইগুলা তো আপনার বাক্সের ভিতর পাইলাম!

আমি তাকায়ে থাকি কাগজগুলোর দিকে। কিসের কাগজ বুঝি না। মাথাপুলিশ বলে, বলে আমি মাস্টার্স পাশ করছেন?

আমি ঠিক বুঝি না কী বলছে মাথাপুলিশটা। পাশের আরেকটা পুলিশ খুব সন্ত্রস্তভাবে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। মাথাপুলিশটা বলে, আপনি মাস্টার্স পাশ করে ভাতের হোটেলে ম্যাচিয়ারের কাজ করেন ক্যান?

আমি বলি, তো কী কবর?

পুলিশ বলে, আপনার তো এর চাইতে মেলা ভালো চাকরি আছে দেশে!

আমি কিছু বলি না। আমার বিশ্বাস হয় না পুলিশদের কথা। কিন্তু সেটা বলতেও পারি না। পুলিশদের মুখের ওপর কথা বলা মুস্কিল!

পাশের পুলিশটা তখন বলে, স্যার। উনি হয়তো অন্য চাকরিতে আছেন!

মাথাপুলিশটাও মনে হয় সেরকম ভাবে। বলে, আমারও তাই ধারণা। আপনি কি আন্ডারগ্রাউন্ড?

আমি বুঝি না কিছুই। কিন্তু আমি মাথা ঝাঁকাই।

মাথাপুলিশ বলে, আপনার আইডিটা দেখান...

পাশের পুলিশটা বলে, আন্ডারকাভারে থাকলে তো স্যার সেইটা দেখাবে না!

মাথাপুলিশ বলে, তাও ঠিক। কিন্তু আপনি এখানে এভাবে...

পুলিশটা বলে, স্যার বর্ডার তো কাছেই!

মাথাপুলিশ বলে, ও তাই তো তাই তো!

তারপরে মাথাপুলিশটা আমাকে স্যালুট করে। পাশের পুলিশটাও করে। বলে, স্যার, আপনার জন্য কী করতে পারি বলেন স্যার?

আমি কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। আমি বলি যে আলতামিরের দোকানে আমার একত্রিশ বছরের টাকা পাওনা দিন চল্লিশ করে সেইটা তুলে দেন।

পুলিশটা হাহা করে হেসে ওঠে। মাথাপুলিশটা তখন খুব বিরক্ত হয়। বলে যে দেখো কীভাবে কাভারে থাকতে হয়! ক্যারেক্টারে থাকতে হয় কীভাবে, দেখ!

তারপর মাথাপুলিশটা বলে, আপনি যান। কাভারে থাকেন। আপনার কোনো সমস্যা হলে আমরা দেখব স্যার!

বলেই মাথাপুলিশ আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। তারপর তার মটর সাইকেলের পিছে বসিয়ে আলতামিরের দোকানে রেখে যায়। আলতামির তখনও হোটেলের ঝাঁপি খুলে বসে আছে। আমাকে আর পুলিশকে দেখে তার বান্দরটা চিক চিক করে চিৎকার করে ওঠে। মাথাপুলিশ আলতামিরকে বলে, তুমি এর পাওনা মিটায়ে দাও না ক্যান?

আলতামির বলে, এর তো মাথায় সমস্যা। এক বছরকে বলে সাত বছর। তিন বছরকে বলে তিরিশ বছর! পাওনা মেটানোর জন্য হিসাব করতে পারি না।

মাথাপুলিশ বলে, সব পাওনা মিটায়ে দিবা!

বলেই পুলিশটা হাসতে শুরু করে। তারপর আমার দিকে চোখ টিপ দিয়ে মটর সাইকেল স্টার্ট করে চলে যায়। আমি ঘুমানোর আয়োজন করতে থাকি। কিন্তু আলতামির আমার দিকে কেমন জানি সন্দেহের চোখে তাকাতে থাকে। শুধু আলতামির না বান্দরটাও আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়। ফলে আমার মনে হয় আমার পিঠের ওপর একজোড়া মানুষের আর একজোড়া বান্দরের চোখ সবসময় বিদ্ধ হয়ে থাকছে। ফজরের আজানের কালেই আমি তাই গোসল করতে ঘাটে নামি। শরীর কচলে কচলে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করার পরও আলতামির আর আমাকে ডাকে না। তার বান্দরটাও চুপচাপ থাকে। আমি নিজ থেকেই আলুর সানা করার জন্য হোটেলে ঢুকি কিন্তু দেখি আলুর সানা আগেই করা হয়ে গেছে। রুম্মন তখন পাঁচ টাকার হিসাবে আলুর বল বানাচ্ছে। আমি অন্য কাজও করতে যাই কিন্তু কেউ কোনো কাজ করতে দেয় না। তারপর আলতামির আমাকে নিয়ে বসে। বলে, আপনে মাস্টার্স পাশ দিছেন?

আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। আলতামির বলে, হাবামি করবেন না, বলেন?

আমি তারপরও কিছু বলতে পারি না। আলতামির বলে, মাস্টার্স পাশের কোনো কর্মচারি আমি রাখব না! আপনের চাকরি আজই ফিনিশ!



আমার খুব কষ্ট হয়। এই চাকরি ছাড়া আমি কীভাবে ভাত খেতে পাবো বুঝতে পারি না। সানাও কি আর জুটবে আমার? চাকরিটা আমার খুব দরকার ছিল, কিন্তু আমি তা আর আলতামিরকে বলতে পারি না। আমার কেমন যেন কান্না কান্না লাগে।



আলতামির বলে, আমার কাছে আপনের পাওনা কী? কত টাকা, হিসাব দেন!



আমি তখন মনে মনে হিসাব করি। একত্রিশ বছরে দিন চল্লিশ টাকা করে...কিন্তু আমি হিসাব করতে পারি না। তখন আমার লুৎফাকে মনে পড়ে। লুৎফা হিসাবে ভালো ছিল বোধহয়। সে যদি আমার হিসাবটা করে দিতো!


আলতামির বলে, হাবামি করবেন না...যা হিসাব হয় কন! আমি পাই পাই চুকায়ে দিবো আর তারপর আপনে এই হোটেল ছাইড়া চলে যাবেন, বুঝলেন?

আমি কিছু বলি না। শুধু হিসাব করার চেষ্টা করি, পারি না। ফলে আমি আমার পাওনা নিতে পারি না। কিন্তু পাওনা না নিতে পারলেও আমার চাকরিটা চলে যায়। ভাতের হোটেলে আর ম্যাচিয়ারি করা হয় না। চাকরি ফিনিশ হলে আমার ওই মাথাপুলিশটার কথা মনে হয়। আর তার কথামতো একটা

শহরে একটা বড় কোম্পানিতে আমি কাজ করতে শুরু করি। কিন্তু ভাতের হোটেলের সাথে এই কোম্পানিরও তেমন কোনো পার্থক্য তো নাই। এখানেও একটা আলতামির আর একটা বান্দর আছে। রুম্মন আছে। আমি প্রতিদিন কোম্পানিতে গিয়ে আলুর সানা বানাই। আলুর সানা পাঁচ টাকার হিসাবে গোল গোল বল বল করি। প্রতিদিন আলতামির খ্যাকখ্যাক করে ওঠে। বান্দর চিক চিক করে শব্দ করতে থাকে। আমি প্রতিদিন সকালে গোসল করে কোম্পানিতে ঢুকে এঁটোকুটা পরিস্কার করতে থাকি। এভাবে সাত বছর বা এক বছর কাটতে কাটতে ফুরায়। তখন কোম্পানির ছাদে একদিন লুৎফার সাথে দেখা হয় আমার। তার হাতে তার স্বামীর শার্ট আর লুঙ্গি। তাদের বাসায় পানি না থাকায় অফিসে নিয়ে এসেছে সেগুলো খাচতে। আমি লুৎফার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলে সে হাসে। আর বলে, আপনি তো আচ্ছা একটা হাবা আছেন?

আমি আরও হাসতে থাকলে তখন সে বলে, কত দিন ধরে আছেন আপনি এ কোম্পানিতে?

আমি আঙুল গুনে হিসাব করি। বলি, চল্লিশ বচ্ছর।

লুৎফা খুবই অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে, আপনার বয়স কত?

আমি আবার আঙুল গুনে গুনে আবারো হিসাব করি। বলি, চল্লিশ বচ্ছর।



প্রথম প্রকাশ- গল্পপাঠ জৈষ্ঠ সংখ্যা। ১৪২৩ বঙ্গাব্দ।
লিংক:
http://www.galpopath.com/2016/05/blog-post_84.html
 

কানাকানি


কিছুদিন ধরে দেশজুড়ে চলছে কান নিয়ে বিস্তর কানাকানি ও টানাটানি। কান ধরানো ও কান ধরার এ সময়ে আমাদের মধ্যে কানকে সবচেয়ে বিখ্যাত করে তোলা এক তারকার সঙ্গে রস+আলোর কথোপকথন মুখ দিয়ে জোরে জোরে পড়ে কান দিয়ে শুনুন।
.
রস+আলো: শুভেচ্ছা, রমজান সাহেব।
রমজান: আপনাকেও শুভেচ্ছা।
র.আ.: আপনি কোন নামে সবচেয়ে খ্যাত?
রমজান: কানকাটা রমজান!
র.আ.: আপনি কোথায় থাকেন?
রমজান: আমি অন্ধকারের মানুষ, অন্ধকারে থাকতেই পছন্দ করি।
র.আ.: কেন অন্ধকারে থাকেন?
রমজান: কারণ, কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,/ যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;/ যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।’
র.আ.: তার মানে আপনার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ?
রমজান: না, আমার প্রিয় কবি কাহ্নপা। এই কবির নামে কান ও পা দুটাই আছে।
র.আ.: আচ্ছা আচ্ছা। তো আপনার প্রিয় স্থপতি কে?
রমজান: লুই কান। তার চোখ-কান ভালো ছিল।
র.আ.: ঠিক ঠিক। প্রিয় খেলা কোনটা আপনার?
রমজান: কানামাছি। এর সঙ্গে অবশ্য কানের কোনো যোগাযোগ নেই। এই খেলায় অন্যের চোখে ধুলা দেওয়া যায় বলেই খেলাটা আমার প্রিয়।
র.আ.: দারুণ! তো আপনার প্রিয় সিনেমা কোনটা?
রমজান: কান ফেস্টিভ্যালে যায়নি এমন যেকোনো সিনেমাই আমার প্রিয়।
র.আ.: সিনেমার কোনো প্রিয় সংলাপ আছে?
রমজান: ওই যে বলে না, ‘একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো, আমি গরিব হতে পারি কিন্তু অমানুষ নই।’
র.আ.: প্রিয় গান কোনটা আপনার?
রমজান: ‘কানে কানে রটে যাবে আমাদের প্রেমকাহিনি...!’
র.আ.: কিন্তু এটা তো বোধ হয় ‘মুখে মুখে রটে যাবে’...
রমজান: শুধু মুখে মুখে রটে যাওয়া কখনোই সম্ভব নয়। কোনো কিছু রটতে গেলে অবশ্যই কানের প্রয়োজন। কানকে এভাবে ইগনোর করা উচিত না! তাই গানটা আমি মডিফাই করে নিয়েছি।
র.আ.: খুব ভালো, খুব ভালো। আপনার প্রিয় মুহূর্ত কোনটা?
রমজান: ম্যাচের কাঠি দিয়ে কান চুলকানোর মুহূর্তটা।
র.আ.: আপনি সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেন কোনটা?
রমজান: কানকথায়।
র.আ: এই মুহূর্তে কোন জায়গাটায় ঘুরতে যেতে চান?
রমজান: ফ্রান্সের কান শহরে।
র.আ.: আপনার প্রিয় ব্যক্তিত্ব কে?
রমজান: হে হে হে! এইটা সবাই জানে!
র.আ.: সবার উদ্দেশে কিছু বলুন।
রমজান: বাঙালি দাঁত থাকতে যেমন দাঁতের মর্যাদা করে না, তেমনি কান থাকতে কানেরও মর্যাদা করে না। কানের যত্ন নিন সবাই। কারণ, যেকোনো সময় আপনাকে কানে ধরতে হতে পারে!
র.আ.: ধন্যবাদ আপনাকে! আপনার এই সাক্ষাৎকার পড়ে মানুষ আকর্ণবিস্তৃত হাসি দেবে!
রমজান: কী বললি? আমি কি গোপাল ভাঁড় যে আমার কথায় মানুষ হাসব! ওই, কান ধর। ধর কান...

প্রথম প্রকাশ- রস+আলো
লিংক:
http://www.prothom-alo.com/roshalo/article/872668/%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BF

রবিবার, ১৫ মে, ২০১৬

আব্বুটা


অাঁকা: তুলিঅাঁকা: তুলিআব্বুটা যে কী!
এমন এমন কাজ করে যে আম্মু না রেগে পারে না। আম্মু বলে আব্বুকে, তোমার মতো এমন ভুলোমনের লোক বোধ হয় আর কোথাও নেই!
সত্যিই আব্বুর খুব ভুলোমন। আম্মু হয়তো বলল, শোনো, অফিস থেকে ফেরার সময় ডিম নিয়ে এসো তো!
দেখা গেল আব্বু নিয়ে এল মুরগি। আস্ত মুরগি কক-কক করে বাসা মাথায় তুলল। আর আম্মু গেল মহা খেপে। আব্বু তখন আম্মুকে শান্ত করার জন্য বলবে, আরে শোনোই না...ডিম আনতে বলেছ, মুরগিই তো এনেছি! ডিমে তা দিলে তো মুরগিই হতো! তা ছাড়া মুরগিটা দেখে মেয়েটা যেমন ফিক ফিক করে হাসছে—ডিম আনলে কি তা করত? আমার মেয়ের হাসি আমি সবচেয়ে ভালোবাসি!
বলেই আব্বু আমাকে কোলে তুলে নিয়ে নানা রকম আদর করতে শুরু করবে আর বলবে, গুটুসগাটুস পুটুসপাটুস...কোথায় যায়রে ফুটুসফাটুস!
তখন আমি বলব, চলল ফুটুস মেঘের ঘরে...বৃষ্টি যেথায় নড়েচড়ে...
আমাদের বাপ-বেটির আহ্লাদ দেখে মা-ও তখন হাসে। ডিমের ওমলেটের বদলে রাতে মুরগির ঝোল রান্না হয়। আব্বু খেতে খেতে আম্মুর রান্নার প্রশংসা করে আমার দিকে তাকিয়ে চোখটিপি দেয়। আমিও আব্বুকে চোখটিপি দিতে যাই—কিন্তু আমার একটা চোখ বন্ধ না হয়ে দুটোই বন্ধ হয়ে যায়!
আমি আব্বুর পেছনে লাগি। আমাকেও এক চোখটিপি দেওয়া শেখাতে হবে। আব্বু আমার এক চোখ হাত দিয়ে ধরে রাখে। তারপর অন্য চোখটা টিপি দিতে বলে। কিন্তু আমার দুই চোখই বন্ধ হয়ে যায়। আমার মন খারাপ হলে আব্বু বলে, পারবি পারবি, তুইও পারবি। ইচ্ছাশক্তি থাকলে সব পারবি!
আমি বলি, ‘ইচ্ছাশক্তিতে পাহাড়ে চড়া যায়?’
: ‘হ্যাঁ।’
: ‘ইচ্ছাশক্তিতে আকাশে ওড়া যায়?’
: ‘হ্যাঁ।’
: ‘ইচ্ছাশক্তিতে পানিতে ভাসা যায়?’
: ‘হ্যাঁ।’
আমি আর আব্বু দুজন মিলে আবার চোখটিপি দেওয়া প্র্যাকটিস করতে থাকি।
এর মধ্যেই একদিন নানু এল। কী মজা! নানুর কাছে কত্ত গল্প। নানু আমাকে টিয়ে-হাতি-বাঘের গল্প শোনায়। আমিও নানুকে শোনাই স্পাইডারম্যান আর মিকি মাউসের গল্প। কিন্তু আমরা রাত করি না। কারণ নানুর হার্টের অসুখ। নানুকে তাই নিয়ম করে সবকিছু করতে হয়।
এর মধ্যে একদিন নানুর হার্টের ওষুধ ফুরিয়ে গেল। আম্মু ফোন করে আব্বুকে আনতে বলল ওষুধটা। বারবার মনেও করিয়ে দিল। শেষে এসএমএসেও লিখে পাঠাল। ফেরার সময় অবশ্যই অবশ্যই যেন আব্বু ওষুধটা নিয়ে ফেরে।
সেদিন ফিরতে ফিরতে আব্বুর অনেক রাত হয়ে গেল। সবাই আব্বুর জন্য অপেক্ষা করছি। নানুরও রাতের খাওয়া শেষ। এবার নানু ওষুধ খেয়ে শুয়ে যাবে। আব্বু ফিরল। আম্মু তাড়াতাড়ি বলল, ওষুধ এনেছ?
আব্বু হেসে পকেট থেকে ওষুধ বের করল। আম্মুও হাসল। বলল, আমি ভাবছিলাম তুমি বোধ হয় আজকেও ভুলে যাবে!
কিন্তু খেতে গিয়ে নানু দেখল তিনি যে ওষুধ খান এটা সেই ওষুধ না!
সবার মাথায় হাত। আশপাশের সব দোকান তো বন্ধ হয়ে গেছে। ওষুধটা না খেলে নানুর শরীর খুব খারাপ করবে। এখন কী করা? আম্মু বলল, তুমি কি একটা জিনিসও ঠিক করে আনতে পারো না?
আব্বুর মলিন মুখটা দেখে আমার খুব খারাপ লাগল। আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। আর আব্বু যেমন বলে ইচ্ছাশক্তির কথা ঠিক সেভাবেই ভাবতে থাকলাম। ভাবলাম আব্বু আসলে নানুর ওষুধটা এনেছে। এনে আব্বু ভুলে গেছে। আব্বু যেন নানুর ঠিক ওষুধটা এনে থাকে...সত্যি যেন এনে থাকে!
আমি চোখ খুললাম। দেখলাম আব্বু তার প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পকেট থেকে বেরোচ্ছে একটা ওষুধের পাতা। আব্বু বলল, আরে, এটা কোত্থেকে এল?
আম্মু তাড়াতাড়ি ওষুধটা নানুকে দেখাল। নানু জানাল এটিই তার ওষুধ। আব্বুর বিস্ময় কাটেনি। আম্মু বলল, কোত্থেকে এসেছে বুঝতে পারছ না? ওষুধটা কিনে নিয়ে তুমি নিজেই ভুলে গিয়েছিল! উফ্! তোমার মতো ভুলোমনা লোক আমি আর একটাও দেখিনি!
নানু ততক্ষণে ওষুধটা খেয়ে নিয়েছেন। আম্মুও নিজের কাজে চলে গেল। আব্বু এল আমার সামনে। আমি বললাম, আব্বু দেখো, তোমার কথাই ঠিক! ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সব করা যায়!
আব্বু হাসল। আমি তখন আব্বুর দিকে তাকিয়ে চোখটিপি দিলাম!
আব্বু খুব অবাক হয়ে খেয়াল করল, আমি এখন সত্যি সত্যি এক চোখ টিপি দিতে পারি!
ইচ্ছাশক্তি, আব্বুই তো বলেছে!
প্রথম প্রকাশ- গোল্লাছুট, প্রথম আলো