শনিবার, ৪ জুন, ২০১৬

ডেডবডি

লাল ইট আর সাদা ধূলা ভরা রাস্তাটা যেখানে একটা আঁৎকা মোচড় নিয়ে রহনপুরের দিকে বেঁকে গেছে—তার পাশে—নদীর দিকে পেছন করে প্রায় ঝুলে থাকা যে ভাতের হোটেল তাতে আমি তিরিশ বছর ধরে কাজ করি। যদিও হোটেলের মালিক যার নাম আলতামির আর যার একটা বান্দর আছে সে বলে আমি নাকি মাত্র তিন বছর ধরেই আছি এ হোটেলে। এটা আমি তেমনভাবে মেনে নিতে পারি না। আমার মনে হয় মালিক আলতামির আসলে আমার আরো সাতাশটা বছরের কামাই না দেয়ার ধান্ধায় আছে! এমনিতে এমন না যে গত তিন বছরের টাকাও সে দিয়েছে।
চল্লিশ টাকা দিন হিসাবে আমার যে কত টাকা পাওনা হয়েছে তার কাছে গত তিরিশ বছরে তা আমি হিসাব করে কুলাতে পারি না। কিন্তু আমার প্রত্যেক রাতেই মনে হয় পরের দিন গোসলের সময় আমি এর একটা হিসাব করব। গোসলের সকালের সময়টাতে পুনর্ভবা ঠাণ্ডা আর থির থাকে, আর তখন দুয়েকজনই আসে রাতের বাসি কাপড় নিয়ে। যেহেতু ওই ঘাটের পাশে একটা হলুদ আর শ্যাওলা-সবুজ পাথর আছে আর ওখানে বসে বসে রাতের শুকনো লালা ঠোঁটের কোনায় নিয়ে ওরা কাপড় খাচতে থাকে। আমি কোমর পানিতে নেমে ডুব দিতে থাকি হুসহাস...আর ডুব দিতে দিতে আমার মাথায় পানি লাগলে চাঁদিটা হিম হিম হয় তখন তিরিশ বছরের হিসাব করা যে সম্ভব এরকম আমার রাতের অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে মনে হয়। কিন্তু তাও গোসলের সময়গুলোতে আমি খুব বেশি অবসর পাই না। গোসলে নামতে নামতেই আলতামির যার একটা বান্দর আছে আর বান্দরটা সারাক্ষণ আলতামিরের কান্ধে চেপে থাকে না হয় টিভির ওপর বসে থাকে আর চিক চিক করে আওয়াজ তোলে মাঝে মাঝেই আর আমি পানিতে নামলেই বান্দরটা মহা বিরক্ত হয়ে চিল্লায় ওপর থেকে আর আলতামিরও তখনও বান্দরের সাথে চিল্লাতে থাকে। বলে, ওই তাত্তাড়ি আয়। আলু সিদ্ধ হয়া গেছে! সানা কর তাত্তাড়ি! কাস্টমার আইলরে আইল!

আমি ডুবতে ডুবতে তখন হিসাব করতে চাই যে চল্লিশ টাকা দিনে তিরিশ বছরে আমার কত টাকা পাওনা হয় কিন্তু আলতামিরের চিল্লানিতে আমার হিসাব টলে যায়। আমার চোখের সামনে তখন সিদ্ধ সিদ্ধ আলু আর কাচা মরিচ আর ইন্ডিয়ার বোল্ডার পিয়াজ ভেসে ওঠে। সরিষার তেলের ডিব্বাটাও ভেসে উঠতে উঠতে মিলিয়ে যায়। আর মনের ভেতর একটা তাড়া তৈরি হয় যে ওইসব মিলমিশ করে আঙুলের ভেতর আলুর টুটি চেপে চেপে আমাকে সানতে হবে। সানতে সানতেই আমাকে সানা বানাতে হবে। বানানোর পর সেগুলো পাঁচ টাকা হিসাবে ছোট ছোট বল বানিয়ে সাজিয়ে রাখতে হবে আর তখন জমিতে যাওয়া মানুষেরা বা অফিসে যাওয়া কেউ কেউও হোটেলে ঢুকতে থাকবে আর সরু সরু চোখে সানার বলগুলোকে দেখতে থাকবে। দেখতে দেখতে ভাববে সানা আজ ছোট হয়ে গেল কিনা! তারপর অর্ডার দিবে। দশ টাকার ভাত আর পাঁচ টাকার আলুভর্তা। সঙ্গে ডাল থাকে, তবে সবাই তো ডাল খায় না। ডালের দাম আছে!



আলতামির যে আমাকে ঠকাচ্ছে এই ধারণা অবশ্য আমি প্রথম পাই গোসল করতে গিয়েই। পাথরঘাটের হলুদ আর শ্যাওলা-সবুজ পাথরে স্বামীর লুঙ্গি খাচতে খাচতে লুৎফা আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করে, আপনি কত পান?

কসকো সাবান দিয়ে আমার পা ডলা বন্ধ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ লুৎফার দিকে বেবুঝের মতো তাকিয়েই থাকি। তারপর উঠিয়ে রাখা ভিজা লুঙ্গি কিছুটা নামিয়ে আনি, সাবান মাখানোও বন্ধ করে দিই। লুৎফার মুখে তখন অর্থহীন হাসি অ্যান্টেনায় আটকে থাকা ঘুড্ডির মতো ফড়ফড় করে। আমি বলি, কীসে ফের কত পাই?

লুৎফার মুখের হাসির ঘুড্ডিটা এবার বাতাস পায় যেন আরো—লটপট করে। বলে, আপনে যে বোকা আছেন এইটা জানেন আপনে?

আমার সাঁই করে মেজাজ চড়ে যেতে ধরে। কিন্তু লুৎফার হাসিটা দেখতে আমার ভালো লাগে। কারণ হাসতে গিয়ে তার মুখটা নড়ে ওঠে আর তাতে তার নাকে মটরদানার মতো যে ছোট পাথর সেটা ঝিলিক দিয়েই মিলিয়ে যায়। আমি আরেকবার সেই ঝিলিক দেখার জন্য তাকিয়ে থাকি। তাতে লুৎফা একটু সন্ত্রস্ত হয়ে আশে-পাশে তাকিয়ে নেয়। কাউকে দেখতে না পেয়ে সে আরেকবার হাসে। তাতে আরেকবার নাকফুলটা ঝিলিক দিলে আমার তাকিয়ে থাকা সার্থক হয়। লুৎফা তখন বলে, এই রকম পরের বউয়ের দিকে হাবার মতন তাকায়ে থাকবেন না!

কিন্তু আমি তাকিয়েই থাকলে সে লুঙ্গি থুপথুপানোতে মনোযোগ দেয়। কিন্তু বেশিক্ষণ পারে না। থপ করে লুঙ্গিটা পাথরের রেখে উঠে দাঁড়ায়। তার কোলের কাছের শাড়িটা ভিজে গিয়ে সবুজ রঙটা আরো গাঢ় হয়ে থাকে। কিন্তু নাকফুলের দিকে তাকিয়ে থাকতেই আমার ভালো লাগে যদিও। আর লুৎফা বলে, আপনে তো খুবই হাবলা আছেন! বললেন না আপনারে কত টাকা দেয় আলতামির?

আমি বলি, চল্লিশ টাকা দেওয়ার তো কথা!

লুৎফা চোখ কুঁচকে ফেলে—চল্লিশ! মোটে! আমার স্বামী তো একশ বিশ টাকা পায়! ভাতের হোটেলে তো তিনিও কাম করেন! আপনারে তো আলতামির ঠকায়া ঠকায়া রাখে!



কথাটা আমার মাথার ভেতর ঢুকে যায়। আমি তাড়াতাড়ি গোসল শেষ করি আর হোটেলে যাই। আলতামির তখন ঝিলিমিলি রঙিন টিভি অন করে সকালের কাস্টমারের আশায় ছোট ক্যাশবাক্সটা নিয়ে বসা। আমি হোটেলে ঢুকেই আলতামিরের দিকে তাকাই। পরক্ষণেই চোখ যায় তার বান্দরটার দিকে। ক্যাশবাক্সের পাশে বসেই সে তখন কলা খাচ্ছে। অর্ধেক মতো খাওয়া হয়েছে। আমি অনেক দিন কলা খাই না, এই রকম মনে হয় তখন। আর তখনই আলতামির রুম্মনকে চিৎকার করে ডাক দেয়। ডাক দিয়ে আমাকে ভাত দিতে বলে। যেন আমি তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠে 'ম্যাচিয়ারে'র কাজে রেডি হতে পারি। ভেজা লুঙ্গি হোটেলের পেছনে মেলে আমি তখন ভাত খেতে বসি। সানা আর ভাত। সঙ্গে একটা কাচা মরিচ পাওয়া যায়। পেঁয়াজ চাওয়া যায় না। পেঁয়াজ খুব আক্রা। খেতে খেতে আমার লুৎফার কথা আর মনে পড়ে না।



কিন্তু ঘুমাতে গেলে প্রথমেই লুৎফার কথা মনে আসে। তার পা যে এমন ফরসা! এত ফরসা সে কীভাবে হলো কে জানে? তার বাপ-মা হয়তো ফরসা ছিল। কিংবা তার বাপ-মা হয়তো তাকে নদীতে পেয়েছিল। হয়তো কোনো একটা ডালিতে বানের টানে ভেসে ভেসে সে এসেছিল। লুৎফার নাকফুলটার কী ঝিলিক...এত ঝিলিক নাকফুলটা কীভাবে দেয় কে জানে! এরকম নাকফুল সে কোথা থেকে কিনেছে এটা একবার জানতে হবে। লুৎফা নাও বলতে পারে। তখন লুৎফার স্বামীকে জিজ্ঞেস করতে হবে। নাকফুলটা নিশ্চয়ই তার স্বামীই কিনেছে। কিন্তু আমি তার স্বামীকে চিনি না। লুৎফার বাড়িতে একদিন চলে গেলে তার স্বামীর দেখা মিলবে। বা তার স্বামীর ভাতের হোটেলে। কিন্তু সে কোন ভাতের হোটেলে কাজ করে আমার জানা নাই। লুৎফার নাকফুলটা ঝিলিক দিয়ে মনে আসতে আসতে তার কোলের কাছে যে গাঢ় সবুজ সেটাও মনে পড়ে যায়। এই রকম সবুজ খালি পাওয়া যায় আম বাগানের ভিতরেই। কসকসা সবুজ। আমের যে-গাছগুলার মেলা বয়স হয়েছে তাদের মোটা মোটা ডালের ভিতর এরকম ঘন ঘন সবুজ পাতা থাকে। না ভিজলেও পাতাগুলাকে তাই ভিজা ভিজা লাগে। লুৎফার কোলটা অবশ্য এমনিতেই ভিজা ছিল। ওরকম সবুজ ভিজা কোল নিয়ে কি লুৎফা মিথ্যা বলবে? লুৎফা তাইলে ঠিকই বলেছে যে আলতামির আমাকে ঠকায়ে ঠকায়ে রাখে হোটেলে। দিন চল্লিশ টাকা। মেলা ঠকা। আমি নিশ্চয় এরচেয়ে বেশি পাবো। নিশ্চয় পাবো। আর তিরিশ বছর ধরে তো সে আমাকে কোনো টাকাই দিলো না। এ নিয়ে আলতামিরের সাথে আমার হিসাব-নিকাষ হওয়া দরকার। সক্কালেই হওয়া দরকার! তখন আমি আবার হিসাব করতে বসি তিরিশ বচ্ছরে আমি কত টাকা পাই আলতামিরের কাছে। কিন্তু হিসাব মেলে না। তখন আমি লুৎফার কথা ভাবি যে সে নিশ্চয় আমাকে ঠিকঠাক হিসাব করে দিতে পারবে।



ফলে পরদিন, তার পরদিন, তার পরের পরদিন আমি ঘাটে যাই আর বসে থাকি। কিন্তু লুৎফা আসে না। বেলা চড়ে যায়। নদীর ওপর থেকে আলতামির ও তার বান্দর চিল্লায়। আমি গোসল না করেই হোটেলে ঢুকে পড়ি। আর আলতামিরের ওপর হিসাব নিয়ে হামলা করতে যাই আর তখনই আলতামির রুম্মনকে চিৎকার করে ডাকে আর আমাকে একথালা ভাত দিতে বলে। শুধু ভাত। সানা নাই। কারণ সানা এখনো আমি করি নাই। কিন্তু লুকিয়ে একটা সিদ্ধ আলু দেয় রুম্মন। তাতে লবন মাখিয়ে আমি খাই। বান্দরটা হেলেদুলে টিভির ওপর গিয়ে বসে। আর টিভি ছেড়ে দেয় আলতামির। হিন্দি একটা চ্যানেলে তখন গান বাজে। মে তেরা দুশমন...দুশমন তু মেরা...মে নাগিন তু সাপেরা...গান বাজতে বাজতে একটা মেয়ে ঘুরে ঘুরে নাচে। তখন একটা কাস্টমার ভাত খেতে ঢুকে টিভির সামনে বসে যায়। তাকে ভাত দিলে সে ভাত খায় তবে ভাতের দিকে তাকায় না। তাকে গত রাত্রের সুরুয়া দেওয়া হয় কাতল মাছের। সে সুরুয়া দিয়ে মেখে মেখে মে তেরা দুশমন খেতে থাকে...আর আমি ভরপেট খেয়ে সানা সানতে থাকি। আলতামির তখন রোদ ঢাকার জন্য একটা চট ঝুলিয়ে দেয় তার মুখের ওপর। ক্যাশ ছায়াশীতল হয়ে ওঠে। বান্দর টিভির ওপর চুপচাপ বসে থাকে। দোকানে কাস্টমার আসতে থাকে। আমার সানা করা শেষ হয়।



এর মধ্যে মধ্যে আরো সাতটা বছর কেটে যায়। লুৎফার তিন-চারবার পেট হয়। আর প্রতিবারই মরা বাচ্চা পয়দা করলে তাকে তার স্বামী ধুমধুম করে পেটে-পিঠে মারে। তাতে লুৎফা একটু কাহিল হয়ে যায়। সাত বছরের ধাক্কা অনেক বড় ধাক্কা এরকম বললে লুৎফা ঘাটে আমাকে হঠাৎই মেলা দাঁত দেখায় আর বলে, সাত বচ্ছর না? সাত বচ্ছর কয় মাসে হয় আপনে জানেন? আমার সামনে হাবামি করবেন না আপনে! আপনের হাবামি আমি আপনের পিছনে ঢুকায়া দিবো!

আমি বুঝি এ সাত বছরে লুৎফা অনেক বদলিয়ে গেছে। বদলানোই স্বাভাবিক। এই কথা আলতামিরকে বলতে গেলে আলতামির ঝাড়ি মেরে বলে, যা ভাত খা।

আমি বলি, সাত বছর ধইরা তো ভাতই খাই খালি! আজকা রুটি খাবো।

আলতামির খ্যা খ্যা করে হাসে। এটা কী হাসির কথা কিনা আমি বুঝি না। না বুঝে আমি হাসি হাসি মুখ করে থাকি। আলতামির তখন একটা কাস্টমারকে সাক্ষি টানে। সাক্ষি টেনে বলে, এই মাঙের পুত কয় সে নাকি সাত বছর ধইরা ভাত খাইতেছে!

আমি বলি, গ্যালান ক্যান ভাই? আমারে না গ্যালায়া আপনে আমার পাওনা টাকা দ্যান।

আলতামির খেঁকিয়ে ওঠে। বলে, যা ভাত খা গা যা!

কাস্টমারটা তখন মিটিমিটি হাসে। যেন সে জানে ঘটনা কী। কিন্তু সে কিছু বলে না। আমি তখন চুপচাপ ভাত খাই। সানার সঙ্গে কচুর ঘাঁটি। কচুর ঘাঁটির সাথে ভাত মেখে নিলে ভাত লতপত করে। ভাত টানতে তখন হেবি লাগে। কাস্টমারটা বিল দিয়ে উঠে গেলে আমিও তার পিছে পিছে যাই। কাস্টমারটা একটা সিগারেট ধরিয়ে টানে। আমাকে পেছনে আসতে দেখে বলে, সিগ্রেট খাবি?

আমি মাথা নাড়াই। সে সিগারেট বাড়িয়ে দেয়। তখন ইচ্ছা না করলেও সিগারেট খাই। তখন কাস্টমারটা বলে, এই হোটেলে কদ্দিন আছিস?

আমি আঙুলে হিসাব করি। বলি, একত্রিশ বচ্ছর!

কাস্টমারটাও এবার আলতামিরের মতো খ্যাকখ্যাক করে হেসে ওঠে। আমি সিগারেটে টান দিয়ে কাশতে থাকি। কাস্টমারটা হাসি থামাতে থামাতে বলে, তোর বয়স কত বে কুতুব?

আমি আবারও আঙুল গুনতে থাকি। গুনতে গুনতে বলি, একত্রিশ বচ্ছর!

এবার আরো জোরে জোরে কাস্টমারটা হাসে। হাসতে হাসতে এবার তার মুখের লালা বেরিয়ে যায়। তখন মনে হয় এই লালা আমি চিনি। লালার যে একটা গন্ধ সেইটাও চেনা চেনা লাগে। আমি তখন কাস্টমারটার মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলি, আপনি কি লুৎফার স্বামী?

কাস্টমারটা তখন থতমত খেয়ে যায়। বলে, ক্যান? ক্যান কী হইছে তাতে? লুৎফারে তুই চিনিস ক্যামনে?

আমার মনে পড়ে না আমি লুৎফাকে কীভাবে চিনি। আমি বলি, আপনিও কি ভাতের হোটেলে কাম করেন? আপনারে কত জানি দেয়?

কাস্টমারটা আর কথা বলে না। আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে থাকে। তারপর হনহন করে হেঁটে চলে যায়। তখন আলতামিরের বান্দরটা চিক চিক করে ডেকে ওঠে। আর আলতামিরও ডাকে—কইবে শালা...কই গেলি!

আমি তখন তখনই সিগারেট নিয়ে হোটেলে ঢুকি। আলতামির হাতটা বাড়িয়ে দিলে সিগারেটটা তার আঙুলের দুই ফাঁকে ঢুকিয়ে দিয়ে টিভির সামনে বসি। টিভিতে তখন কী একটা খেলা হয়। একটা খেলোয়াড়ের ওপর অন্য সবগুলো খেলোয়াড় ঝাঁপিয়ে পড়ে। খেলাটা দেখতে দেখতে আমার রাগ হয়। তখন আলতামিরের সামনে গিয়ে আমি দাঁড়াই। আলতামির তাকায়। যেন আমি কী বলব সে জানে। বান্দরটা চিক চিক করে ওঠে আবারও। আমি আলতামিরকে জিজ্ঞেস করি, এই হোটেলে কত বচ্ছর হয় আছি আমি?

আলতামির উত্তর দেয়, তিন বচ্ছর।

আমার তখন আরো রাগ হয়। আমার মনে হয় লুৎফা আসলে এতদিন থেকে ঠিকই বলে আসছে। আলতামির আমাকে ঠকায়েই যাচ্ছে। এবার তার ঘাড়ের মাফলার ধরে টান দিয়ে তার ক্যাশ ভাঙবো। কিন্তু ক্যাশে কত টাকা থাকবে এরকম ভাবতে থাকি আমি। আর তখনই একজন দৌড়ে আসে। হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, ঘাটের ওপর একটা বডি পাওয়া গেছে। বডির অর্ধেক পুঁতা আছে মাটিতে। অর্ধেকটা মানুষ দেখা যায় অর্ধেকটা দেখা যায় না।

এই রকম খবরে সবার আগে টিভির ওপর থেকে লাফ দেয় আলতামিরের বান্দরটা। সে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘাটের দিকে নামতে থাকে। দুয়েকজন কাস্টমার ভাতের থালা হাতে নিয়েই ঘাটের নিচে নেমে যায়। তারা ভাত খেতে খেতে লাশ দেখতে থাকে। দুই জন মেলা ধরাধরি করে, এদিক ওদিক টান দিয়ে, আস্তেসুস্থে বডিটা ওঠায়। কিন্তু বডিটাকে চিনার কোনো উপায় তো নাই। এত কাদা মুখেচোখে আর সারাটা শরীরে। আমরা অনেকক্ষণ লাশটাকে চেনার চেষ্টা করি। কিন্তু লাশের কোনো বিশেষত্ব পাই না। তখন কেউ একজন বলে লাশটার মুখ পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে। আমরা তখন ঝটপট হাতে আজলা আজলা পানি নিয়ে লাশের মুখে দিতে থাকি। কিন্তু লাল আঁইটা মাটি আর কিছুতেই সরে না। তখন ওই আগের লোকটাই বলে, তাইলে লাশটারে ধইরা পাথরের উপ্রে রাখো না বাল। পাত্থর থেইকা মুখটা নামায়া দিবা নিচে...স্রোতে তাইলে সব মাটি ধুয়া যাবে!



দুই তিনজন লাশটাকে ধরে পাথরের ওপর রাখতে যায় কিন্তু তার আগেই লাশটা, যেন জ্যান্ত কুমির, গড়িয়ে পানিতে হুশ করে নেমে যায়। আর নেমে যাওয়ামাত্রই স্রোতের টানে তলিয়েও যায়। অনেকে হইহই করে ওঠে। যাদের ভাত খাওয়া হয়ে গিয়েছিল তারা থালা রেখে পানিতে নেমে পড়ে। লাশ পাওয়া যায় না কিন্তু তারা স্রোতের টানে ভেসে যায় অনেকদূর। পুনর্ভবার লাশ আর মানুষেরা ভেসে ভেসে অনেক দূরে চলে যায়। যাদের ভাত খাওয়া তখনো হয় নি তারা আবার ভাতে মনোযোগ দেয়। আলতামিরের বান্দরটা লাশডোবা কাদার ওপর অনেকক্ষণ দাপাদাপি করলে আলতামির তাকে আদর করে ডেকে ডেকে হোটেলে নিয়ে যায়। আর আমি টেবিলে জমা এঁটো ভাত-টাত সাফি দিয়ে মুছে মুছে ভাঙা ডালিতে জড়ো করতে থাকি। তখন ভেসে যাওয়া মানুষগুলো ফেরত আসে কেউ কেউ। তারা জানায় পানিতে মেলা টান...এই টান উজায়া লাশটা আর পাওয়া যাবে না। তবে তাদের একজন নাকি লাশটা ধরতে পেরেছিল একবার। আর তাতে তার মনে হয়েছিল শরীরটা মেয়েমানুষের। তখন অনেকেই খ্যা খ্যা করে ওঠে। জানায় ওই বডিটা যে মেয়ের তার জন্য লাশের শরীর চটকানের দরকার তো নাই। লাল মাটির ভিতরেই একটা শাড়ি ছিল আর একটা ব্লাউজ ছিল নীল। তখন আরেকজন বলে ব্লাউজ নীল ছিল না...ছিল সবুজ। নীল আর সবুজদের মধ্যে তখন একটা ঝগড়ার মতন হয়। এটা ততক্ষণ চলতে থাকে যতক্ষণ না রানি কেন চাকরানি সিনেমাটা শুরু হয়। সিনেমাটা শুরু হলে দেখা যায় একটা রানি অনেকদিন ধরে একটা বাড়িতে রাজার হালে বা রানির হালেই ছিল। তার বড় বড় বুকে অনেক রকমের আশা থরেথরে সাজানো ছিল। স্বামীর সোহাগ ও সোহাগ চলাকালীন ফুলপাতাপ্রজাপতিমাখা গান ছিল তারপর তার পেট ফুলে গেল আর তার খুব কষ্ট হলো বাচ্চা পয়দা করতে। সে আ আ আ করে অনেক অনেক চিল্লায়...তার চিল্লানিতে একজন ভাতের থালায় বমি করে দেয়া সত্বেও রানির একটা মরা বাচ্চা হয়। আর বাচ্চা মরে গেলে রানির জীবনে মেলা দুঃখকষ্ট নেমে আসে। তাকে অনেকগুলো বাসন মাজতে হয় আর ডালি ডালি কাপড় ধুতে হয়। এতে দর্শকের অনেকেই নাক টানে। কেউ কেউ বলে সানা খুবই ঝাল হইছে! বান্দরটাও একবার হাঁচি দেয়। এভাবে রানি ওই বাড়ির চাকরানি হয়ে ওঠে। আর তখন কেউ তাকে বিষ খাইয়ে দিলে তার শরীরটা নিথর হয়ে থাকে। নিথর শরীর স্বামী আর শাশুড়ি মিলে নদীর পানিতে ফেলে দেয় রাতের অন্ধকারে। কিন্তু নদীর পানি তখন চিৎকার করে ওঠে। বলে এই বিষখাওয়া শরীর আমি নিতাম না! নিতাম না! নিতাম না! নদীর ঢেউ তখন শরীরটাকে আছড়িয়ে ডাঙায় ফেলে। ফেললে রানি বিস্তর বমি করে। আর তার মুখের নীল ধীরে ধীরে সাদা হয়ে আসে। তখন রানি মুখ হা করে শ্বাস নেয়। আর সবাই দেখে রানি তার নীল ব্লাউজটা খুলে ফেলছে আর ভেতরে একটা সবুজ ব্রা খলবল করে উঠলে বান্দর ও আমাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এর বেশি কিছু হয় না তখন। খালি রানি বালু হাতে তুলে কসম কাটে যে সে তার এই মৃত্যুর শোধ নিবে। তখন কে জানি বলে এই সিনেমা হিন্দি একটা সিনেমার নকল। এরকম একটা কসম কাটার সিন সে এই কিছুদিন আগেও দেখেছে। কিন্তু নকলের নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই অ্যাডভ্যাটাইজ শুরু হয়ে যায়। তখন অন্যদের উদ্দীপনাও কমে যায়। লম্বা সময় ধরে ঢেউ টিনের অ্যাড চলতে থাকলে সকালটা দুপুরের দিকে গড়াতে থাকে। তখন হঠাৎ একটা খবর আসে কারো মোবাইলে যে মহানন্দায় নাকি একটা মাছকইন্যা ধরা পড়েছে। প্রথমে আমরা এটা বিশ্বাস করি না। গল্পকথায় মাছকইন্যা ইত্যাদি থাকে। তাই বলে মহানন্দার মতো উটকা একটা নদীতে? এটা তো হতেই পারে না। তখন মোবাইলঅলা অন্যদের ফোন করলে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হয়। একজন বলে, মাছকইন্যা বলে তো কিছু নাই। হতে পারে পানির জিনের যে বাদশাহ থাকে তার বেটিরে ধরেছে কাশেম মাঝি। তখন অন্যদের খুব হিংসা হয় কাশেম মাঝির ওপর। তারা ভাবে যে কাশেম মাঝির শক্তপোক্ত গতর দেখেই হয়তো জিনের বেটি তার কাছে ধরা দিয়েছে। একজন বলে, এইবার কাশেম মাঝিকে তাইলে চুইষা খাবে জিনের বেটিটা!

ঘটনা আরো সবিস্তারে জানতে বারবার মোবাইল করা হয় এদিকে ওদিকে। এর মধ্যে মোবাইলের টাকা ফুরিয়ে গেলে আলতামির আমাকে দিয়ে ফ্লেক্সিলোড করায় দুইবার। একবার তিরিশ একবার বিশ। দুইবারই আমার মনে হয় এই টাকা নিয়ে পালিয়ে যাবো কিনা! তিরিশ বিশ টাকায় কতদূর যেতে পারব এরকম ভাবনা আসে। তাছাড়া ত্রিশ বছরেরও বেশি সময়ের পাওনা বাকি আছে আলতামিরের কাছে এরকম ভেবে আর পালানো হয় না। আবার এরকম একটা উৎসাহও থাকে যে কাশেম মাঝি কীভাবে মাঝকইন্যা বা জিনের বেটিরে ধরল তাও জানা দরকার। জিনের বেটি কী করে কাশেম মাঝিকে চুষে খাবে তারও কিছু জানার ইচ্ছা মনে উঁকি দেয়।



কিন্তু ফোনে ফোনে খুব বেশি জানা সম্ভব হয় না। কিন্তু টুকরা টুকরা খবরাখবর জোড় দিলে যা হয় তাতে এরকম দেখা যায় যে প্রতিদিনের মতোই কাশেম মাঝি তার ভাঙা ডিঙিটা নিয়ে মহানন্দার মাঝে গিয়েছিল কারেন্ট বা সুতা জাল নিয়ে। পানির টান থাকায় এই সময় বোয়াল ধরা পড়ে বেশি আর তার কয়েকটা ধরলে কাশিম মাঝির চাল কেনার সাথে সাথে গুল কেনারও পয়সা বেরিয়ে গেলে সন্ধ্যার দিকে আড়তে বসে তার গুলতানিরও হিল্লা হয়। সে আশায় জাল ফেলতেই তার জাল খলবল করে ওঠে। বড় কোনো মাছ ধরা পড়ছে এরকম চিন্তা করে জাল টানতেই দেখে একটা মাছকইন্যা মতান্তরে একটা জিনের বেটি মতান্তরে একটা জলপরি তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। কাশেম মাঝির মাথাটা ঘুরে ওঠে আর তখনই মাছকইন্যা মতান্তরে জিনের বেটি মতান্তরে জলপরিটা তার হাত লম্বা করে কাশেম মাঝির দাড়ি ধরে টান দেয় আর তাতে কাশেম মাঝি নদীতে ছলাৎ করে পড়ে যায় আর স্রোতের সাথে তাকে মাছকইন্যা মতান্তরে জিনের বেটি মতান্তরে জলপরিটা টানতে টানতে নিয়ে যেতে ধরে। কিন্তু কাশেম মাঝির শরীরে দারুণ শক্তি--নিজের গাভিন গরুটা বাঁচাতে সে একবার আলীনগরের ঝাণ্ডুদের ষাঁড়ের সাথে লড়ে গিয়েছিল—ফলে কাশেম মাঝির সাথে মাছকইন্যা মতান্তরে জিনের বেটি মতান্তরে জলপরিটার খুব ধস্তাধস্তি হয় পানির মধ্যে। আর শেষে কাশেম মাঝি মাছকইন্যা মতান্তরে জিনের বেটি মতান্তরে জলপরিটাকে ডাঙায় তুলে নিজেও জ্ঞান হারায়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মাছকইন্যা মতান্তরে জিনের বেটি মতান্তরে জলপরিটা ডাঙায় খলবল করতে করতে পানি খুঁজছে কিন্তু তাকে পানি থেকে দূরে রাখার সবরকম ব্যবস্থা করা হয়েছে।



আমরা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গল্পটা শুনি আর আফসোস করতে থাকি। এই ঘটনাটা পুনর্ভবায় হলে কী আরামেই না দেখা যেত এইরকম ভাবতে ভাবতে আমাদের আফসোস আরো বাড়ে। তখন একজন বলল, পুনর্ভবায় এই রকম মাছকইন্যা থাকার কোনো কারণ তো নাই! যেহেতু এই নদীটা বেশি ডিপ না! পুনর্ভবায় মেলা পানি...মাছকইন্যার ঘরবসতি ওইখানে থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু আরেকজন বলে মহানন্দা নদী হিসাবে আসলে কিন্তু কিছু নাই। এই পুনর্ভবাই রাইসমিলের বাঁক ফিনিশ করে মহানন্দা হয়ে গেছেগা। আরেকজন তখন খেঁকিয়ে ওঠে যে আসল নদী এই পুনর্ভবা না...আসল নদী ওই মহানন্দাই। ওইটাই ইন্ডিয়া থেকে ঘুরতে ঘুরতে এদিকে আসছে।

এটা নিয়ে আরো ঝগড়া শুরু হলে সেটাও বেশিক্ষণ চলে না। কারণ তখন সবার ইচ্ছা কাশেম মাঝির উদ্ধার করা মাছকইন্যা মতান্তরে জিনের বেটি মতান্তরে জলপরিটা দেখার। এরকম সময় এক ভুটভুটিঅলা বলে যে সে যাবে কাশেম মাঝির বাড়ি। তখন আমরাও তার সাথে যাবার কথা বললে আলতামির তার হোটেল বন্ধ করে দেয়। আর তার বান্দরটা ভুটভুটির ওপর সবার আগে উঠে বসে ব্যাপক আগ্রহে। ভুটভুটিঅলা তার নসিমন স্টার্ট করতে করতে সবাইকে জানিয়ে দেয় যে এই নিয়ে যাওয়া বাবদ তাকে মাথাপিছু পাঁচ টাকা করে দিতে হবে। তবে এরকম কথায় কেউ উৎসাহ দেখায় না। একজন বলে, জিনের বেটিরে দেখতে নিতাছ...তুমি তো মিয়া সোয়াব পাবা...টাকা নিবা ক্যান?

তখন আরেকজন বলে, ওইটা জিনের বেটি না। তবে ওইটা মাছকইন্যা হতে পারে!

আরেকজন বলে, জলপরিও হতে পারে। জলপরির নখে কাটা কাটা দাগ থাকে। আর শরীলের বিশেষ জায়গায় থাকে আঁইশ। আঁইশ দেইখা জলপরি চেনা যায়!

লোকটা তখন মনে হয় কল্পনায় জলপরির আঁইশ দেখতে থাকে। ফলে কারো তেমন কোনো জোরালো সিদ্ধান্ত ছাড়াই ভুটভুটি চলতে শুরু করে। কিন্তু কিছুদূর যেতে না যেতেই মটোর সাইকেলে চড়ে একজোড়া পুলিশ আমাদের ভুটভুটি থামিয়ে দেয়। আমরা জানাই যে আমরা আসলে কাশেম মাঝির বাড়ি যাই জিনের বেটি মতান্তরে মাছকইন্যা মতান্তরে জলপরি দেখতে তখন পুলিশ দুইটা খলখল করে হাসি দিয়ে পিচিক পিচিক পানের পিক ফেলতে থাকে আর বলতে থাকে ওইটা একটা কিছু না!



আমরা তখন খুব আশ্চর্য হই। ‘কিছু না’র মানে কী? তখন জিনের বেটির পক্ষের লোক জোরালো হয়। বলে যে তারা তো ঠিকই বলেছিল। কারণ জিনের বেটি চাইলেই কিছু না হয়া যেতে পারে। পুলিশজোড়া তখন আরো হাসে। পান খুব জোরে জোরে চিবাতে চিবাতে বলে ওইটা কিছু না মানে আসলে একটা ডেডবডি—বাড়ির বউয়ের ডেডবডি! জলপরি বালপরি কিছু না! পুলিশেরাও এইসব খবর শুনে হন্তদন্ত হয়ে গিয়েছিল তো ঠিকই কিন্তু গিয়ে দেখে কাশেম মাঝির উঠানের ওপর হাত-পা ছড়ায়ে একটা বউ মরে পড়ে আছে। তারাও খুবই আশাহত, এক পুলিশের তো কান্দনই চলে আসতে চায়! এর মধ্যে এক সাংবাদিক আগে আগে আসে আর তার পেছন পেছন একটা ভ্যান চলে আসতে থাকে। যার ওপর শুইয়ে রাখা আছে ডেডবডিটা। আর ডেডবডিটার পাশেই কারেন্ট জাল দিয়ে দুই হাত বাঁধা কাশেম মাঝি। ভ্যানের সাথে সাথে বিস্তর মানুষ। তারা আগ্রহ নিয়ে কাঁথামোড়া ডেডবডি আর কাশেম মাঝিকে দেখে। পুলিশজোড়া জানায় কারেন্ট জাল দিয়ে ডেডবডি ধরার অপরাধে কাশেম মাঝিকে গ্রেফতার করা হয়েছে কিন্তু এই সাংবাদিক চাঞ্চল্যকর খবর নেওয়ার জন্য কাশেম মাঝির সাথে কথা বলতে চাইছে। যদিও কাশেম মাঝি কোনো কথা বলতে চায় না। সে মুখ আর চোয়াল বোয়াল মাছের মতো শক্ত করে বসে আছে।



সমস্ত শুনে ভুটভুটিঅলা যারপরনাই খুব বিরক্ত হয়। আলতামিরও হতাশ। তবে সবচেয়ে বেশি হতাশ হয় আলতামিরের বান্দরটা। সে হতাশা ঢাকতে না পেরে লাফিয়ে ভ্যানের ওপর ওঠে আর চিক চিক আওয়াজ তুলতে তুলতে বডিটার মুখ থেকে কাঁথা সরিয়ে দেয়। আর তখন কাপড়ের নিচের মুখটা ঝিলিক দিয়ে উঠলে আমি দেখি এইটা লুৎফার মুখ। মুখের নাকফুলটা আরো একবার ঝিলিক দিয়ে নড়তে শুরু করে। পরে বুঝতে পারি যে ভ্যানটাই আসলে চলতে শুরু করেছে। তখন আমরা তাড়াতাড়ি ভ্যানটা দাঁড় করাই। কেউ একজন বলে এইটা তো সকালের পাত্থরঘাটের লাশটা! কেউ কেউ বলে এইটা তো লুৎফা! আমার তখন কেমন চোরের মতো লাগে। মনে হয় এইটা যে লুৎফা তাতে আমার কোনো হাত আছে। আমার মনে হয় এইটা যে লুৎফা এবং সে যে মৃত তাতেও আমার কোনো আঁতাত আছে। আমি নিজের ভেতর কেমন করে যেন সংকুচিত হতে থাকি। তখন পুলিশ বলে এটা যে তোমাদের দেখা সকালের বডি তার প্রমাণ কী?

একজন বলে, লাশটার ব্লাউজ দেখলেই প্রমাণ পাওয়া যাবে...কারণ সকালের লাশটার গতরে ছিল নীলচা ব্লাউজ!

তখন আরেকজন তাড়াতাড়ি বলে, না না গায়ে ছিল সবুজ ব্লাউজ। সে দেখেছে নিজের চোখে। পুলিশ বলে এই বডিটা যদি সকালের বডি হয় তাইলে কাশেম মাঝির খালি জেল হবে কারেন্ট জালের জন্য! নাইলে তো তার ফাঁসি কেউ ঠেকাতে পারবে না। কারণ তার কারেন্ট জালে আটকায়েই এই লুৎফা না কী তার মরণ হয়েছে!



কিন্তু এতসব উত্তেজনাকর কথার মধ্যেও কাশেম মাঝি চুপচাপ বসে থাকে। পুলিশের কথায় তার কিছু হয় না বলেই প্রতিয়মান। অন্যরা বলে লাশ কখনকার এইটা প্রমাণের জন্য তো বেশি কিছুর দরকার নাই। লাশটার ব্লাউজ দেখলেই হয়...

তখন লাশটার শরীর থেকে ওপরের কাঁথাটা আরেকটু সরানো হয়। সবাই উদগ্রীব হয়ে দেখে কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে যে বডিটার শরীরে কোনো ব্লাউজ তো নাই। নীল বা সবুজ কোনো রঙই সে পরে নাই। পুলিশ বেশ কিছুক্ষণ বডিটা ঘাঁটাঘাঁটি করে এই ভেবে যে কোথাও যদি ব্লাউজটা আটকে থাকে। কিন্তু কাশেম মাঝির দুর্ভাগ্যের কথা জানিয়ে কোনো ব্লাউজ পাওয়া যায় না। আর তারা লাশটা নিয়ে থানার দিকে বা মর্গের দিকে চলে যায়। সাথে কাশেম মাঝিকেও নিয়ে যায়। আর আলতামির আবার তার হোটেল খোলে। আবার টিভি চালু হয়। আবার বান্দরটা টিভির ওপর গিয়ে বসে। টিভিতে তখন ছামছাম গান হয়। কিন্তু সে গানে কেউ মনোযোগ দিতে পারে না। তাদের মন পড়ে থাকে মর্গে। মর্গে কীভাবে শরীর কাটা হয় তারা কেউ কেউ বর্ণনা করে। কেউ কেউ বলে লুৎফার বডিটা সুন্দর ছিল তাই ডোম ময়না আরামেই শরীলটা কাটবে। তখন এসব ভাবতে ভাবতে কেউ কেউ মেজাজ হারিয়ে ফেলে। একজন আমাকে বলে, ওই তুই না লুৎফারে চিনতি?

আমার হাত কেঁপে যায়। বলি যে না না আমি তো চিনি না তাকে! সাত কি আট বচ্ছর আগে তার সাথে একবার দেখা হইছিল! তারপর তার খালি প্যাট হইত...

একজন বলে খালি প্যাট হইত মানে কি? তার তো বিয়াই হইল তিন বচ্ছর। একবার একটা মরা বাচ্চা বিয়ালো মাইয়াটা...তাকে বোধহয় কেউ বিষ খাওয়াইয়া মাইরা ফেলছে!

তখন আরেকজন রানি কেন চাকরানি সিনেমাটার কথা বলে। বলে যে তার স্বামী রমজানে বিষ খাওয়াইতে পারে।

তখন আলতামির ফেউ করে উড়িয়ে দেয় কথাটা। বলে, রমজ্যাইন্যা ভাতই খাওয়াইতে পারে না! বিষ খাওয়াইবো ক্যামনে?



তাইলে তার বউরে মারল কে?



প্রশ্নটা ঘুরতে থাকে জনে জনে। আর আমার কেমন সংকোচন হয় নিজের ভিতর। মনে হতে থাকে যেন আমিই লুৎফাকে মেরেছি। আমি কি তার শরীরে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছি? তার মুখ-নাকে গামছা ধরে তাকে কাদার ভিতর ডুবিয়ে দিয়েছি? আর বাইরের যা-কিছু প্রত্যঙ্গ সব ভিতরের দিকে ঢুকতে থাকলে আমার বমির মতন লাগে। ওয়াক ওয়াক করে আমি বমি করেও দিই। আর তখন বান্দরটা চিক চিক করে ডেকে ওঠে।

তখন কেউ একজন বলে, নিজে নিজেই মরছে বোধহয়। হয়তো অন্যের প্যাট ছিল ভিতরে। ওই মিয়া তুমার সাথে চিনপরিচয় না ছিল লুৎফার?



আমি বমি গিলতি থাকি চুকচুক করে। তারপর মুখ শক্ত করে বলি, আমি তারে চিনি না বহু বচ্ছর যাবৎ!



অন্যরা তখন হেসে ওঠে। মনে হয় ওরা আমাকে নিয়ে মজা করে। আমিও ওদের সাথে বোকার মতো হাসি। আসলে বোকার মতো না...হাবার মতো। লুৎফা বলত আমি নাকি হাবা! আমি হাসলে তাই হাবার মতোই হাসব!

কিন্তু আমার হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। অথবা হয় কিন্তু আমি বুঝতে পারি না। সন্ধ্যা নেমে আসে আর ভাতের হোটেল এবার ম্রিয়মান হতে হতে মিলিয়ে যেতে ধরে। আমি দুইটা বেঞ্চ একত্রে করে শোয়ার আয়োজন করি। বান্দরটা লাফ দিয়ে আলতামিরের কান্ধে ওঠে। টিভি বন্ধ হয়ে যায় ভালো একটা গানের অনুষ্ঠান হওয়া সত্বেও। আলতামির রওনা দেওয়ার ভঙ্গি করে। রুম্মনকে কী জানি বলে আমাদের ভিতরে রেখে দোকানের ঝাঁপি নামায় আর তখনই বাঁশির আওয়াজ পাওয়া যায়। লম্বা ফুঁ দিয়ে পুড়ুৎ পুড়ুৎ আওয়াজ। এই রকম আওয়াজ শুনে আমার কান খাড়া হয়ে যায়। বাঁশির শব্দের সাথে ধপ ধপ কিছু শব্দ হয়। ঘেউ করে ওঠে একটা কুকুর। শব্দগুলো আরো কাছে আসতে থাকে। আমরা, হোটেলের ভেতর, কেমন একটু কুঁকড়ে যাই। বাইরে কী হচ্ছে বুঝতে না পারায় আমাদের ভেতর একটা জমাট শীত চেপে বসতে থাকে। আর তখনই সশব্দে ঝাঁপি খুলে যায়। আর তিন চারটা পুলিশ ভেতরে ঢোকে। দ্রুততার সাথে ঢোকে আলতামির। আলতামিরের বান্দর চিক চিক করে শব্দ করতে থাকে। মাথাপুলিশ বান্দরকে ধমক দেয়—চোপ!

কিন্তু বান্দর আবার চিক চিক করে ওঠে। পুলিশেরা জিজ্ঞাস করে, কাশেম মাঝি কই?

তখন আমরা বুঝতে পারি যে কাশেম মাঝি আসলে পালিয়ে গিয়েছে। কীভাবে পালিয়েছে আমরা জানতে চাই। কিন্তু পুলিশদের অনেক তাড়া। তারা বলে না কিছু। কিন্তু অনেক তাড়া সত্বেও তারা কোথাও যায় না। হোটেলের ভেতরেই খুঁজতে থাকে। একটা পুলিশ বলে, পালাবার আগে ভাত খাওয়ার কথা বলতেছিল হারামিটা। এইখানেই আছে কোথাও বোধয়...ভাত খাইতে আসছে!

মাথাপুলিশ বলে, ভালো কইরা খোঁজ কুত্তাটারে। পাইলে বিচিতে গুলি মারবি। ডাইরেক্ট গুলি!

বান্দরটা আবার চিক চিক করে ওঠে। আমরা আমাদের কাঁথার ভেতর ইত্যাদি দেখাই পুলিশদের আর বারবার জানাই কাশেম মাঝি এখানে আসে নাই আসে নাই। আলতামির মাথাপুলিশকে একপাশে টেনে নেয়। বোধহয় টাকাপয়সা সাধে। তখন মাথাপুলিশটা ঠাস করে একটা চড় মারে আলতামিরকে। চড়ের শব্দের সাথে লাফ দিয়ে দূরে উড়ে গিয়ে পড়ে বান্দরটা। আর আলতামির ছিটকে পড়ে মাটির হাঁড়ার ওপর। মাটির হাঁড়া শক্ত আছে যে আলতামির তার ওপর পড়ার পরও ভাঙে না। তখন সেখানে ছুটতে ছুটতে লুৎফার স্বামী রমজান আসে। রমজানকে অনেক উদভ্রান্ত দেখায় না। মনে হয় তার হুশ ও দিশা ঠিকই আছে। সে এসেই পুলিশকে বলে, কাশেম মাঝি আসছিল তার কাছে!

মাথাপুলিশের কান সজাগ হয়ে যায়। রমজান জানায় সে কাশেম মাঝিকে ধরার চেষ্টা করছে বহু। কিন্তু তার শরীরে মেলা জোর।

তখন আলতামির জানায় এটা সত্যি যে কাশেম মাঝির শরীরে মেলা শক্তি। নিজের গাভিন গরুটাকে বাঁচাতে কাশেম মাঝি একবার আলীনগরের ঝাণ্ডুদের ষাঁড়টার সাথে লড়ে গিয়েছিল। তাতে ষাঁড়টার একটা শিং ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু তারচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছিল ষাঁড়টা আর পাল দিতে পারত না। তখন আশি টাকা কেজি দরে তার মাংস বিক্রির আলোচনা উঠলে ষাঁড়টা একদিন বর্ডার ক্রশ করে ইন্ডিয়া চলে যায়। তারপর আলতামির একটু ভাবে। বলে, ইন্ডিয়াতে ষাঁড়টা বোধহয় ভালোই আছে! বোধহয় তাকে আর কেউ মারে নাই!

তখন মাথাপুলিশ বলে, কাশেম মাঝিও যদি ইন্ডিয়া চলে যায় বর্ডার ক্রশ করে? তখন অন্য পুলিশদের মুখেও আতঙ্ক এসে জমে। পুলিশদের মধ্যে খুব ভয় যে কাশেম মাঝি না থাকলে এই খুন রহস্যের কোনো অগ্রগতি হবে না। কেসটা ঝুলে যাবে। আর তখন ওপর থেকে নানা রকম চাপ আসতে থাকবে। নানা রকমের টানাহ্যাঁচড়ার মধ্যে পড়তে হবে সব্বাইকে। এই জন্য একটা আসামী থাকা খুব দরকার, খুবই দরকার। তখন রমজান জানায় যে আসামীর দরকার পড়লে আসামী তো আছেই হাতের কাছে।



মাথাপুলিশ তখন রমজানকে ধরে। এমনভাবে ধরে যেন পুলিশ ধরেছে তাকে। পরে মনে হয় সত্যিই তো পুলিশই ধরেছে তাকে। তখন আমরা নিজেরা ভিতরে ভিতরে একটু হেসে উঠি। পুলিশের ধরার মধ্যে একটা বিষয় আছে যা দেখলে কেমন আরাম আরাম লাগে। কিন্তু রমজানের আরাম লাগে না। রমজান ছটফট করতে করতে জানায় আজকে সকালেও তার কাছে একজন লুৎফা বিবির খোঁজ নিছে। রমজানের ধারণা কাশেম মাঝির সাথে সাথে তারও এই খুনে হাত আছে। তারপরেই রমজান শালা আমাকে দেখিয়ে দেয়। সব কটা পুলিশ আমার দিকে তাকালে আমি একটা দৌড় দিই। দৌড়ে হোটেল থেকে বের হয়ে ঘাটের দিকে নেমে যাই। আমার লুঙ্গি বাতাসে আটকে যায়। আমি পড়তে পড়তে পড়ি না। পেছনে পুলিশের বাঁশি বেজে ওঠে। তারপর একটা গুলির আওয়াজ হয় ঠাস...তখন যোদ্ধা সিনেমার একটা সিন মনে পড়ে যায় আমার আর আমি মাটিতে শুয়ে যাই। আমার মনে হয় একটা গুলি আমার মাথার উপর দিয়ে চলে যায়। আবারও একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডেকে ওঠে। তখন আবার একটা গুলির শব্দ হয়। আমি পুনর্ভবার পাড় দিয়ে আম বাগানের দিকে দৌড়াতে থাকি। কিন্তু বেশিক্ষণ দৌড়াতে পারি না। আমার পা কাদার মধ্যে ঢুকে যায়। আটকে যাই আমি। হাঁচড়পাচড় করি। আর দেখি আমি সেখানে আটকে আছি যেখানে সকালে লুৎফার লাশ পাওয়া গিয়েছিল। তখন টর্চের বড় বড় ফোকাস ফেলতে ফেলতে পুলিশেরা আসে। আলতামিরও আসে। আর আসে বান্দরটা। বান্দরটা কোনো শব্দ করে না। শুধু মুখের কাছে দিয়ে খুব অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। রমজান আসে সবার পরে। তার চোখ ধ্বকধ্বক করে। মাথাপুলিশ হিসহিস করে। বলে, যে-লালে উৎপত্তি সে-লালে বিনাশ! এখানেই তুই কব্বর দিছিলি না লুৎফার? এখানেই তোর মরণ লেখা ছিল!

বলেই মাথাপুলিশ তার পিস্তল আমার দিকে তাক করে। আমি তখন চোখ বন্ধ করে নিই। আর ভাবি যে আমি এখন মরে যাবো কিন্তু আলতামিরের কাছে আমার যা পাওনা একত্রিশ বচ্ছরের তা আর পাওয়া হলো না। তখন একটা গুলির শব্দ হয় ঠাস। আর আমি যখন চোখ খুলি দেখি আমাকে কোথায় যেন নিয়ে আসা হয়েছে আর সেটা যে একটা থানা সেটা প্রধানমন্ত্রীর ছবি ঝুলতে দেখে বুঝতে পারি। আর আমি একটা শক্ত বেঞ্চিতে বসে আছি। বেঞ্চির হাতল আছে আর হেলান দেওয়ারও জায়গা আছে ফলে আমি হেলান দিয়ে তাকিয়ে থাকি সামনের দেয়ালে যেখানে একটা তেলাপোকা উড়ে এসে বসে। মাথাপুলিশ সামনে এসে দাঁড়ায়। তাতে আলো অন্ধকার হয়ে যায়। আর পুলিশটাকে বিকট লাগে। কিন্তু পুলিশের হাতে কী সব কাগজপত্র। মাথাপুলিশ বলে, এইগুলা তো আপনার বাক্সের ভিতর পাইলাম!

আমি তাকায়ে থাকি কাগজগুলোর দিকে। কিসের কাগজ বুঝি না। মাথাপুলিশ বলে, বলে আমি মাস্টার্স পাশ করছেন?

আমি ঠিক বুঝি না কী বলছে মাথাপুলিশটা। পাশের আরেকটা পুলিশ খুব সন্ত্রস্তভাবে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। মাথাপুলিশটা বলে, আপনি মাস্টার্স পাশ করে ভাতের হোটেলে ম্যাচিয়ারের কাজ করেন ক্যান?

আমি বলি, তো কী কবর?

পুলিশ বলে, আপনার তো এর চাইতে মেলা ভালো চাকরি আছে দেশে!

আমি কিছু বলি না। আমার বিশ্বাস হয় না পুলিশদের কথা। কিন্তু সেটা বলতেও পারি না। পুলিশদের মুখের ওপর কথা বলা মুস্কিল!

পাশের পুলিশটা তখন বলে, স্যার। উনি হয়তো অন্য চাকরিতে আছেন!

মাথাপুলিশটাও মনে হয় সেরকম ভাবে। বলে, আমারও তাই ধারণা। আপনি কি আন্ডারগ্রাউন্ড?

আমি বুঝি না কিছুই। কিন্তু আমি মাথা ঝাঁকাই।

মাথাপুলিশ বলে, আপনার আইডিটা দেখান...

পাশের পুলিশটা বলে, আন্ডারকাভারে থাকলে তো স্যার সেইটা দেখাবে না!

মাথাপুলিশ বলে, তাও ঠিক। কিন্তু আপনি এখানে এভাবে...

পুলিশটা বলে, স্যার বর্ডার তো কাছেই!

মাথাপুলিশ বলে, ও তাই তো তাই তো!

তারপরে মাথাপুলিশটা আমাকে স্যালুট করে। পাশের পুলিশটাও করে। বলে, স্যার, আপনার জন্য কী করতে পারি বলেন স্যার?

আমি কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। আমি বলি যে আলতামিরের দোকানে আমার একত্রিশ বছরের টাকা পাওনা দিন চল্লিশ করে সেইটা তুলে দেন।

পুলিশটা হাহা করে হেসে ওঠে। মাথাপুলিশটা তখন খুব বিরক্ত হয়। বলে যে দেখো কীভাবে কাভারে থাকতে হয়! ক্যারেক্টারে থাকতে হয় কীভাবে, দেখ!

তারপর মাথাপুলিশটা বলে, আপনি যান। কাভারে থাকেন। আপনার কোনো সমস্যা হলে আমরা দেখব স্যার!

বলেই মাথাপুলিশ আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। তারপর তার মটর সাইকেলের পিছে বসিয়ে আলতামিরের দোকানে রেখে যায়। আলতামির তখনও হোটেলের ঝাঁপি খুলে বসে আছে। আমাকে আর পুলিশকে দেখে তার বান্দরটা চিক চিক করে চিৎকার করে ওঠে। মাথাপুলিশ আলতামিরকে বলে, তুমি এর পাওনা মিটায়ে দাও না ক্যান?

আলতামির বলে, এর তো মাথায় সমস্যা। এক বছরকে বলে সাত বছর। তিন বছরকে বলে তিরিশ বছর! পাওনা মেটানোর জন্য হিসাব করতে পারি না।

মাথাপুলিশ বলে, সব পাওনা মিটায়ে দিবা!

বলেই পুলিশটা হাসতে শুরু করে। তারপর আমার দিকে চোখ টিপ দিয়ে মটর সাইকেল স্টার্ট করে চলে যায়। আমি ঘুমানোর আয়োজন করতে থাকি। কিন্তু আলতামির আমার দিকে কেমন জানি সন্দেহের চোখে তাকাতে থাকে। শুধু আলতামির না বান্দরটাও আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়। ফলে আমার মনে হয় আমার পিঠের ওপর একজোড়া মানুষের আর একজোড়া বান্দরের চোখ সবসময় বিদ্ধ হয়ে থাকছে। ফজরের আজানের কালেই আমি তাই গোসল করতে ঘাটে নামি। শরীর কচলে কচলে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করার পরও আলতামির আর আমাকে ডাকে না। তার বান্দরটাও চুপচাপ থাকে। আমি নিজ থেকেই আলুর সানা করার জন্য হোটেলে ঢুকি কিন্তু দেখি আলুর সানা আগেই করা হয়ে গেছে। রুম্মন তখন পাঁচ টাকার হিসাবে আলুর বল বানাচ্ছে। আমি অন্য কাজও করতে যাই কিন্তু কেউ কোনো কাজ করতে দেয় না। তারপর আলতামির আমাকে নিয়ে বসে। বলে, আপনে মাস্টার্স পাশ দিছেন?

আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। আলতামির বলে, হাবামি করবেন না, বলেন?

আমি তারপরও কিছু বলতে পারি না। আলতামির বলে, মাস্টার্স পাশের কোনো কর্মচারি আমি রাখব না! আপনের চাকরি আজই ফিনিশ!



আমার খুব কষ্ট হয়। এই চাকরি ছাড়া আমি কীভাবে ভাত খেতে পাবো বুঝতে পারি না। সানাও কি আর জুটবে আমার? চাকরিটা আমার খুব দরকার ছিল, কিন্তু আমি তা আর আলতামিরকে বলতে পারি না। আমার কেমন যেন কান্না কান্না লাগে।



আলতামির বলে, আমার কাছে আপনের পাওনা কী? কত টাকা, হিসাব দেন!



আমি তখন মনে মনে হিসাব করি। একত্রিশ বছরে দিন চল্লিশ টাকা করে...কিন্তু আমি হিসাব করতে পারি না। তখন আমার লুৎফাকে মনে পড়ে। লুৎফা হিসাবে ভালো ছিল বোধহয়। সে যদি আমার হিসাবটা করে দিতো!


আলতামির বলে, হাবামি করবেন না...যা হিসাব হয় কন! আমি পাই পাই চুকায়ে দিবো আর তারপর আপনে এই হোটেল ছাইড়া চলে যাবেন, বুঝলেন?

আমি কিছু বলি না। শুধু হিসাব করার চেষ্টা করি, পারি না। ফলে আমি আমার পাওনা নিতে পারি না। কিন্তু পাওনা না নিতে পারলেও আমার চাকরিটা চলে যায়। ভাতের হোটেলে আর ম্যাচিয়ারি করা হয় না। চাকরি ফিনিশ হলে আমার ওই মাথাপুলিশটার কথা মনে হয়। আর তার কথামতো একটা

শহরে একটা বড় কোম্পানিতে আমি কাজ করতে শুরু করি। কিন্তু ভাতের হোটেলের সাথে এই কোম্পানিরও তেমন কোনো পার্থক্য তো নাই। এখানেও একটা আলতামির আর একটা বান্দর আছে। রুম্মন আছে। আমি প্রতিদিন কোম্পানিতে গিয়ে আলুর সানা বানাই। আলুর সানা পাঁচ টাকার হিসাবে গোল গোল বল বল করি। প্রতিদিন আলতামির খ্যাকখ্যাক করে ওঠে। বান্দর চিক চিক করে শব্দ করতে থাকে। আমি প্রতিদিন সকালে গোসল করে কোম্পানিতে ঢুকে এঁটোকুটা পরিস্কার করতে থাকি। এভাবে সাত বছর বা এক বছর কাটতে কাটতে ফুরায়। তখন কোম্পানির ছাদে একদিন লুৎফার সাথে দেখা হয় আমার। তার হাতে তার স্বামীর শার্ট আর লুঙ্গি। তাদের বাসায় পানি না থাকায় অফিসে নিয়ে এসেছে সেগুলো খাচতে। আমি লুৎফার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলে সে হাসে। আর বলে, আপনি তো আচ্ছা একটা হাবা আছেন?

আমি আরও হাসতে থাকলে তখন সে বলে, কত দিন ধরে আছেন আপনি এ কোম্পানিতে?

আমি আঙুল গুনে হিসাব করি। বলি, চল্লিশ বচ্ছর।

লুৎফা খুবই অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে, আপনার বয়স কত?

আমি আবার আঙুল গুনে গুনে আবারো হিসাব করি। বলি, চল্লিশ বচ্ছর।



প্রথম প্রকাশ- গল্পপাঠ জৈষ্ঠ সংখ্যা। ১৪২৩ বঙ্গাব্দ।
লিংক:
http://www.galpopath.com/2016/05/blog-post_84.html
 

কানাকানি


কিছুদিন ধরে দেশজুড়ে চলছে কান নিয়ে বিস্তর কানাকানি ও টানাটানি। কান ধরানো ও কান ধরার এ সময়ে আমাদের মধ্যে কানকে সবচেয়ে বিখ্যাত করে তোলা এক তারকার সঙ্গে রস+আলোর কথোপকথন মুখ দিয়ে জোরে জোরে পড়ে কান দিয়ে শুনুন।
.
রস+আলো: শুভেচ্ছা, রমজান সাহেব।
রমজান: আপনাকেও শুভেচ্ছা।
র.আ.: আপনি কোন নামে সবচেয়ে খ্যাত?
রমজান: কানকাটা রমজান!
র.আ.: আপনি কোথায় থাকেন?
রমজান: আমি অন্ধকারের মানুষ, অন্ধকারে থাকতেই পছন্দ করি।
র.আ.: কেন অন্ধকারে থাকেন?
রমজান: কারণ, কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,/ যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;/ যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।’
র.আ.: তার মানে আপনার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ?
রমজান: না, আমার প্রিয় কবি কাহ্নপা। এই কবির নামে কান ও পা দুটাই আছে।
র.আ.: আচ্ছা আচ্ছা। তো আপনার প্রিয় স্থপতি কে?
রমজান: লুই কান। তার চোখ-কান ভালো ছিল।
র.আ.: ঠিক ঠিক। প্রিয় খেলা কোনটা আপনার?
রমজান: কানামাছি। এর সঙ্গে অবশ্য কানের কোনো যোগাযোগ নেই। এই খেলায় অন্যের চোখে ধুলা দেওয়া যায় বলেই খেলাটা আমার প্রিয়।
র.আ.: দারুণ! তো আপনার প্রিয় সিনেমা কোনটা?
রমজান: কান ফেস্টিভ্যালে যায়নি এমন যেকোনো সিনেমাই আমার প্রিয়।
র.আ.: সিনেমার কোনো প্রিয় সংলাপ আছে?
রমজান: ওই যে বলে না, ‘একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো, আমি গরিব হতে পারি কিন্তু অমানুষ নই।’
র.আ.: প্রিয় গান কোনটা আপনার?
রমজান: ‘কানে কানে রটে যাবে আমাদের প্রেমকাহিনি...!’
র.আ.: কিন্তু এটা তো বোধ হয় ‘মুখে মুখে রটে যাবে’...
রমজান: শুধু মুখে মুখে রটে যাওয়া কখনোই সম্ভব নয়। কোনো কিছু রটতে গেলে অবশ্যই কানের প্রয়োজন। কানকে এভাবে ইগনোর করা উচিত না! তাই গানটা আমি মডিফাই করে নিয়েছি।
র.আ.: খুব ভালো, খুব ভালো। আপনার প্রিয় মুহূর্ত কোনটা?
রমজান: ম্যাচের কাঠি দিয়ে কান চুলকানোর মুহূর্তটা।
র.আ.: আপনি সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেন কোনটা?
রমজান: কানকথায়।
র.আ: এই মুহূর্তে কোন জায়গাটায় ঘুরতে যেতে চান?
রমজান: ফ্রান্সের কান শহরে।
র.আ.: আপনার প্রিয় ব্যক্তিত্ব কে?
রমজান: হে হে হে! এইটা সবাই জানে!
র.আ.: সবার উদ্দেশে কিছু বলুন।
রমজান: বাঙালি দাঁত থাকতে যেমন দাঁতের মর্যাদা করে না, তেমনি কান থাকতে কানেরও মর্যাদা করে না। কানের যত্ন নিন সবাই। কারণ, যেকোনো সময় আপনাকে কানে ধরতে হতে পারে!
র.আ.: ধন্যবাদ আপনাকে! আপনার এই সাক্ষাৎকার পড়ে মানুষ আকর্ণবিস্তৃত হাসি দেবে!
রমজান: কী বললি? আমি কি গোপাল ভাঁড় যে আমার কথায় মানুষ হাসব! ওই, কান ধর। ধর কান...

প্রথম প্রকাশ- রস+আলো
লিংক:
http://www.prothom-alo.com/roshalo/article/872668/%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BF