বুধবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৬

স্বামীর ডায়েরি থেকে...

রস+আলোর গত সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘বউয়ের ডায়েরি থেকে’। কিন্তু শুধু যে বউই ডায়েরি লেখেন তা তো নয়, ডায়েরি লেখেন তাঁর স্বামীও। কী আছে সেই ডায়েরিতে? পড়ুন এবার...
.হোয়াট ইজ স্বামী?আমি অনেক দিন ধরেই ভাবছি, স্বামী আসলে কী? কী মানে সে যে মানুষ নয়, সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। এ ছাড়া সে আসলে কী? কোনো পদার্থ (বউ অবশ্য অপদার্থই বলে), নাকি বহিরাগত কোনো জীব (বউ অবশ্য আজিব বলে থাকে)! স্বামীকে মৃত, অর্ধমৃত হিসেবে ঘোষণা আগেই করা হয়েছে, কিন্তু আসলে স্বামী কী? স্বামী আসলে বীর। সেই বীর যে পরাজিত জেনেও সংসার নামের এক মহাযুদ্ধে দিনের পর দিন ঢাল-তলোয়ার বাগিয়ে লড়াই করে যায়। আমরা যারা স্বামীর জাত, তাদের এখন একসঙ্গে কণ্ঠে আওয়াজ তোলা উচিত, ‘আমরা স্বামী আমরা বীর...আমরা শক্তি পৃথিবীর’!

স্বামীই কেন আসামি?একটা ব্যাপার আমার মাথায় কোনোভাবেই ঢোকে না যে সব সময় কীভাবে আমিই আসামি হয়ে যাই? কী করে সমস্ত দায় আমার ওপরেই এসে পড়ে? সেদিন রাতে বাইরে খেতে যাওয়ার কথা ছিল। আমার স্ত্রী রুনা দীর্ঘক্ষণ ধরে সাজার পর অবশেষে দয়া করে মুখ তুলে চাইল। মিষ্টি হেসে (আমি আমার বউয়ের মিষ্টি হাসি দারুণ ভয় পাই। কেন যেন মনে হয় এই হাসি শেষেই একটা অ্যাটম বোমা ছুটে আসবে আমার দিকে) বউ বলল, ‘লিপস্টিকটা কেমন হয়েছে?’ আমি ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলাম, ‘ভালোই তো!’
: শুধু ভালোই তো? এটা খালাতো বোন নূপুর পাঠিয়েছে ম্যারিকা থেকে! রংটা দারুণ না?
: হ্যাঁ।
: তুমি আর রঙের কী বুঝবে? তুমি তো মিষ্টি রং আর ম্যাজেন্টার মধ্যে পার্থক্য বোঝো না!
: না না, সুন্দর আছে রংটা!
: তা তো থাকবেই। কিন্তু তোমাকে তো কোনো দিন দেখলাম না এ রকম সুন্দর রঙের লিপস্টিক কিনতে!
: আমি তো লিপস্টিক কিনি না...!
: তা কিনবে কেন? বউয়ের জন্য কোনো কিছু কিনতে তো তোমার হাত কাঁপে...বুক ধড়াস ধড়াস করে। ভাবো যে এত টাকা খরচ করে ফেলব! অথচ সেদিন তোমার কলিগের বউয়ের বার্থডেতে কত কত গিফট নিয়ে গেলে তোমরা!
: আরে, ওটা তো সবাই মিলে কিনেছিলাম।
: হুহ্‌, সবাই মিলে কিনেছিলে না? আমি বুঝি না। এইগুলাতে তোমার তো খুব চালাকি! সবার নাম দিয়ে আসলে এগুলা তুমি নিজেই কেন! বলো, সত্যি কি না, বলো?
: আরে, কী বলো তুমি এসব?
: কী বলি মানে? আমি মিথ্যা বলি? তুমি তো একটা গবেট। গাধার গাধা। নিজের পকেট থেকে কেনো আর নাম হয় সবার! এ রকম গাধা আমি দুনিয়ায় দেখিনি!
আমি অত্যন্ত কনফিউজড হয়ে পড়ি এ সময়। একটা মানুষ একই সঙ্গে চালাক ও গবেট কীভাবে হতে পারে? পাশাপাশি এ ব্যাপারেও কনফিউজড হই যে লিপস্টিক না কেনায় আমার দোষ কোথায়? কারণ দোকানে গেলে তো আমার বউ আমাকে পাত্তাই দেয় না। এই কনফিউশনের মধ্যেই আমার বউ উঠে দাঁড়ায় আর বলে, ‘থাক থাক, আর জ্ঞানীদের মতো বসে বসে ভাবতে হবে না! চলো...বনানী ভাড়া করবা রিকশা। তিরিশ টাকার বেশি না কিন্তু, বুঝছ?’
আমি কিছু বলে ওঠার আগেই ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নামে। রুনা গজগজ করে ওঠে। আর আমাকে বলে, ‘সব তোমার দোষ! সব তোমার দোষ!’
: আরে, বৃষ্টি প্রাকৃতিক ব্যাপার। এর মধ্যে আমার দোষ কোথায়?
: তোমার দোষ না? তোমার জন্যই তো এতক্ষণ ধরে কথা বলতে হলো... না হলে কবেই রেস্টুরেন্টে পৌঁছে যেতাম। এখন খাবে কী? ঘরে তো কোনো খাবার নেই! এই তোমার জন্য এখন না খেয়ে রাত পার করতে হবে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না। মনে মনে বলেছিলাম, স্বামীই আসামি। স্বামীই একমাত্র আসামি।
সংসার সুখের হয় শুধুই স্বামীর গুণে
কত যে ভুলভাল প্রবাদ প্রচার হয়ে আসছে অতীত থেকে। এই ভুলভাল প্রবাদগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভুল প্রবাদ হলো, সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে! অসম্ভব! সংসার আসলে সুখের হয় আমাদের গুণে অর্থাৎ স্বামীদের গুণে। বউ সকাল থেকে আমাদের পেছনে লেগে থাকে। বলে, ‘আরে, এভাবে দাঁত ব্রাশ করছ কেন? তুমি কি ছোট বাচ্চা! ভালোমতো ব্রাশ করো...ভেতরটাও করো...।’
আমরা স্বামীরা কিছু বলি না। চুপচাপ সহ্য করে যাই।
অফিসে কাজের মধ্যে থাকা অবস্থায় বউ ফোন করে। হয়তো বসের সামনে আছি তখন বউ ফোন দিয়ে পাশের বাড়ির লালচে বেড়ালটা যে তিনটা সাদা বাচ্চা দিয়েছে তা নিয়ে গল্প শোনায়।
আমরা স্বামীরা কিছু বলি না। চুপচাপ সহ্য করে যাই।
সন্ধ্যায় বাসায় ঢুকে হয়তো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে পরবর্তী দিনে অফিস আড্ডায় কী বলা যায়, তার খোরাক জোগাতে একটু টিভিটা দেখব, একটু টক শো, একটু খবর দেখব কিন্তু তার কোনো উপায় থাকে না। বউ এসে রিমোট নিয়ে সুলতান সুলেমান দেখতে শুরু করে।
আমরা স্বামীরা কিছু বলি না। চুপচাপ সহ্য করে যাই। ভর রাতেবারান্দায় দাঁড়িয়ে হয়তো একটা সিগারেট খেতে যাই, তখনই বউ আঁতকা চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘তোমাকে না কতবার বলেছি আর সিগারেট খাবে না? আবার ধরাচ্ছ তুমি?’ সঙ্গে সঙ্গে সিগারেট ফেলে দিয়ে সুড়সুড় করে মশারির ভেতর ঢুকে যাই এবং হ্যাঁ, আমরা স্বামীরা কিছু বলি না। চুপচাপ সহ্য করে যাই।
আর এই যে বলি না কিছু, এই যে চুপচাপ সহ্য করে যাই বলেই তো সংসারে অশান্তি হয় না, বিবাদ হয় না, ঝগড়া হয় না। যদি বলতাম, যদি সহ্য না করতাম, তাহলে প্রতিদিন রেসলিং হবে সংসারে। ঝগড়াঝাঁটির ডোজ হবে রোজ রোজ! আমরা স্বামীরা শান্তিকামী। আমরা জন্মেইছি পকেটে সাদা রুমাল নিয়ে। বউ যতই শাসন আর শোষণ করুক আমাদের, পকেট থেকে সাদা রুমাল সব সময় উঁকি দেয় বাইরে...আর তাই সংসারটা সুখের হয়। তাই সংসার সুখের হয় স্বামী, শুধুই স্বামীর গুণে—এটিই আসল প্রবাদ, এটাই সত্য প্রবাদ।
কিন্তু সন্ন্যাসী হতে পারি না
গৌতম বুদ্ধও তো চলে গিয়েছিলেন! হায়! কতবার ভাবি আমিও চলে যাব। আর তো সহ্য হয় না! কিন্তু পারি না। পারি না কারণ, আমার বউ আমাকে যতটা আগলে রাখে, যতটা ভালোবাসে...অন্যের বউ কি ততটাই আগলে রাখবে, ভালোবাসবে?

বউয়ের ডায়েরি থেকে...

আঁকা: আসিফ



মানুষ কত কিছু আবিষ্কার করে! আমি আমার বউয়ের ডায়েরি আবিষ্কার করেছি। তাতে বিতং করে লেখা আছে আমারই কথা। অন্যের ডায়েরি পড়া অন্যায় ভেবে এড়িয়ে যেতে পারিনি। কারণ, লেখা তো আমাকে নিয়েই। লেখার শিরোনাম, ‘যে কারণে আমি আমার স্বামীকে ডিভোর্স দিই না’! এই শিরোনাম পড়ার পর বাকি লেখা না পড়ে আর অন্য উপায় আমার ছিল না।
যে কারণে আমি আমার স্বামীকে ডিভোর্স দিই না!
১. আমার স্বামীটা একটা গবেট। বোকার বোকা। আমার ধারণা, বিয়ের পর তার বোকামি আরও বেড়েছে। কাঁচাবাজারে গেলে প্রতিটা সবজি বিক্রেতা তাকে ঠকায়। গত বছরের টমেটো তাকে গতকালকে মাঠ থেকে তুলে আনা টমেটো বলে চালিয়ে দেয়। মাছ বিক্রেতারা ফরমালিন মেশানো মাছ ধরিয়ে তাকে বলে তাজা মাছ, কোনো ক্যামিকেল নাই। আর সে তা-ই মেনে নিয়ে ঢ্যাং ঢ্যাং করে বাসায় ফেরে। অদ্ভুত একটা! রিকশাওয়ালারা পর্যন্ত তাকে ঠকায়। ৩০ টাকার ভাড়া তার কাছ থেকে ৫০ টাকা আদায় করে। আমি আমার এক জীবনে এত গবেট মানুষ দেখিনি! এ রকম মানুষের সাথে সংসার করার কোনো মানে নেই!
২. আমার স্বামীটা একটা অলস। যেনতেন অলস না, আমার ধারণা আলসেমির কোনো অস্কার থাকলে সে পরপর সাত-আটবার অস্কার পেয়ে গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লেখাত। তার সবচেয়ে বেশি আলসেমি মশারি টানানোয়। সে পারলে মশারি গায়ে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এমনকি সে ঘুমের মধ্যেও আলসেমি করে বলে আমার ধারণা। কারণ, এক কাতে ঘুমানোর পর সারা রাত সে অন্য কাতে যায় না। ওভাবেই সকালে ঘুম থেকে ওঠে। তারপর মুখে ব্রাশ নিয়ে ঢুলতে থাকে। দাঁত ব্রাশ করার মতো সহজ একটা কাজেও তার রাজ্যের আলসেমি। তিন দিন আগে সে এক গ্লাস পানি খেতে চেয়েছিল। আমি রান্নায় ব্যস্ত ছিলাম বলে তাকে সেটা না দিয়ে বলেছিলাম, ‘নিজে নিয়ে নাও!’ আমার ধারণা, তারপর সে আর পানি খায়নি। এমনও হতে পারে, সে হয়তো এই তিন দিনেও পানি খায়নি! তাকে দিয়ে কিচ্ছু বিশ্বাস নেই।
৩. আমার স্বামীটা খুবই আড্ডাবাজ। আড্ডাবাজ, কিন্তু সে শুধুই তার বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজি করবে। আমরা যখন কাজিন-টাজিন মিলে গল্প করি, তখন সে চুপচাপ ভ্রু কুঁচকে বসে থাকে। বোঝাই যায়, সে আমাদের কথাবার্তায় বিরক্ত। অথচ সেই মানুষটাই যখন তার বন্ধুবান্ধবের সাথে বসে তখন হা হা হি হি করে অস্থির হয়ে যায়। কথায় কথায় মজা করার চেষ্টা করে। তার হিউমারে অন্যরা হেসে হেসে গলে গলে পড়ে (জঘন্য একেকটা!), অথচ আমার কোনো হাসি পায় না। কারণ, এই কৌতুকগুলো সে আমাকে আমাদের বাসররাতেই শুনিয়েছিল, আর সেগুলো খুবই খুবই খুবই পুরোনো। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে শুরু করলে এই লোকের কোনো সময়জ্ঞান থাকে না। আমি যে ওর সাথে আছি, সম্ভবত সেই বোধটাও থাকে না। আমি যতবার বলি, ‘এবার চলো...!’ সে বলে, ‘আরেকটু আরেকটু...!’ অথচ এই লোক শপিংয়ে যাওয়ামাত্রই বাসায় ফিরতে চায়। আমার সাথে কিছুক্ষণ ঘুরলেই তার মুখে রাজ্যের ক্লান্তি। শুধু বন্ধুদের সাথে আড্ডায় তার কোনো ক্লান্তি নেই। এ রকম একটা লোকের সাথে বাকিটা জীবন পার করার চেয়ে বনবাসে যাওয়া ভালো!
৪. বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা শুরু হলে আমার স্বামী কেমন পাগলের মতো হয়ে যায়। সেদিন হয় সে অফিস যায় না, না হলে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দ্রুত ফিরে আসে। তারপর টিভির সামনে রিমোট হাতে গ্যাট হয়ে বসে থাকে। এ সময় তার কাছে রিমোট চাইতে গেলে তার চোখ ধকধক করে জ্বলে। মনে হয় যেকোনো সময় সে চিৎকার করে উঠবে। যদি বলি, ‘এখন আমার সিরিয়াল দেখার সময়। চ্যানেল চেঞ্জ করো।’ তখন সে বড় বড় করে শ্বাস ফেলতে থাকে। আমি দুই দিন জোর করে রিমোট নিয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করে দেখেছি, লোকটা কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বেরিয়ে মহল্লার টং দোকানে বসে খেলা দেখছে। আমার ধারণা, বাংলাদেশের ম্যাচ চলাকালে সে আধপাগলা হয়ে যায়। এ রকম আধপাগলা লোকের সাথে কীভাবে আমি দিনের পর দিন কাটাচ্ছি, ভাবতেই আমার শরীরে কাঁটা দিচ্ছে!
৫. আমার স্বামীর সাথে আমার কোনো কিছুতেই মেলে না। আমার পছন্দের রং ম্যাজেন্টা, তার পছন্দ খ্যাত একটা সবুজ। আমি রোমান্টিক সিনেমা পছন্দ করি, আর সে পছন্দ করে তামিল টাইপ মারদাঙ্গা সিনেমা। আমি টিভিতে নাটক দেখি, আর সে দেখতে চায় টক শো (কিন্তু চাইলে কী হবে? আমি দেখতে দিলে তো!)! আমার পছন্দ ফ্রায়েড চিকেন আর তার পছন্দ কিনা ছোলামুড়ি! সে মাঝে মাঝে এতই অন্যমনস্ক থাকে যে আমার মনে হয় কোনো একদিন সে ভুলে কোনো বাসে চড়ে ভুল কোনো জায়গায় গিয়ে নেমে পড়বে! এই আতঙ্ক নিয়ে জীবন যাপন করা দুরূহ!
কিন্তু এত কিছুর পরও আমি আমার স্বামীকে ডিভোর্স দিই না! কারণ, ও যা কিছুই করতে চাক না কেন, আমি তাকে যখন বলি, ‘শোনো, আমার কথা শোনো...’, তখন সে আমার কথা শোনে। কোনো রকম ভেজাল করে না। এ রকম নির্ভেজাল মানুষ আজকাল শুধু স্বামী হিসেবেই পাওয়া যায় বোধ হয়!
(আগামী সংখ্যায় আসছে ‘স্বামীর ডায়েরি থেকে’!)