শনিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

অদভূত আর বদভূত


অলংকরণ: তুলি




ছিল এক অদভূত, আর এক বদভূত। ভূতের বাচ্চা। থাকত বেলের গাছে। ঘুমাত সারা দিন, রাতে বের হতো মানুষকে ভয় দেখাতে। দাঁড়িয়ে থাকত ফাঁকা কোনো রাস্তায়। কেউ এলে নাকি স্বরে বলত, হাঁউ মাঁউ খাঁউ!
কিন্তু অনেক দিন এ রাস্তায় কেউ আর আসে না। একদিন তাই বদভূত বলল, ‘চল, মানুষের বাড়ি গিয়ে ভয় দেখিয়ে আসি!’
অদভূত তো একটু ভিতু। তাই বলল, ‘না না, মা বলেছে মানুষের বাড়ি যেতে নেই। তাদের বাড়িতে কুকুর থাকে, বেড়াল থাকে...ছাগল-গরু-ষাঁড়ও থাকে! যদি তাড়ে? কামড়ে যদি দেয়?’
: ধুর! যেসব বাড়িতে এসব নেই, তেমন একটা বাড়ি খুঁজেই যাব। চল!
বলেই ছুটল বদভূত। অগত্যা তার পিছু পিছু অদভূত!
অনেক রাত।
ঢুকল তারা একটা বাড়ির ঘরে। ঘরের ভেতর ঘুমিয়ে আছে রাফি।
রাফিকে দেখেই বদভূত ভীষণ খুশি। ভয় দেখাবে একেই। মুখের কাছে মুখটা নিয়ে আঁতকা একটা চিৎকার দিলেই...ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠবে সে! কেমন মজা হবে!
যেমন ভাবা তেমন কাজ!
দুজন মিলে একলাফে উঠল বিছানায়। শুয়ে পড়ল রাফির পাশে। ঢুকে গেল কাঁথার তলায়। এবার তারা যেই না ভয় দেখাতে যাবে অমনি ঘরে এলেন মা।
ঢিকঢিক! ঢিকঢিক! কাঁপছে অদভূত আর বদভূতের বুক। এই বুঝি ধরা পড়ে গেল! এই বুঝি দেখল তাদের মা!
কিন্তু না, মা খেয়ালই করলেন না। রাফির মাথায় হাত বুলিয়ে, পাশে রাখা মশারিটা টাঙিয়ে, চারপাশটা ভালো করে গুঁজে চলে গেলেন তিনি।
তখন ধীরে ধীরে কাঁথার ভেতর থেকে মুখ বের করল অদভূত আর বদভূত। যাক, বাঁচা গেছে! এবার ভয়টা দেখাতে হবে! কিন্তু তখনই অদভূত খেয়াল করল জিনিসটা। একটা পাতলা জাল দিয়ে যেন তাদের ঘিরে রাখা হয়েছে। এমন জিনিস তো তারা আগে কখনো দেখেনি, কারও কাছে শোনেওনি। কী এটা?
বদভূত বলল, ‘তাই তো? কী এটা?’
: বোধ হয় মাছ ধরার জাল। দেখছিস না কেমন ফুটো ফুটো!
: কিন্তু মাছ ধরার জাল এমন কেন? চারটা কোনা কেন এমনভাবে বাঁধা?
: কে জানে! কেন মা জাল ফেললেন? আমাদের ধরার জন্য নাকি?
বলেই ভীষণ ভয় পেয়ে গেল তারা। যে করেই হোক জাল থেকে বেরোতে হবে। কোথায় দরজা? কোথায় জানালা?
অনেকক্ষণ হুটোপুটি করল তারা। কিন্তু বেরোতে পারল না। চারদিকে ফুটো আর ফুটো কিন্তু বেরোনোর কোনো ফুটো নাই এই জিনিসটায়। এই জিনিসটা কী?
তখনই কথা বলে উঠল রাফি। ভূতের বাচ্চা দুটোর কাণ্ডে অনেক আগেই ঘুম ভেঙেছে তার। এতক্ষণ শুধু মজা দেখছিল। বলল, ‘এটা মশারি।’
: মশারি? এটা থেকে তোমরা বের হও কীভাবে?
: বলব না!
: বলো, প্লিজ। আর কোনো দিন তোমাকে ভয় দেখাতে আসব না! প্লিজ, বলো।
: বলব না, বলব না!
: এখান থেকে বেরোতে না পারলে সবাই জেনে যাবে আমরা মানুষের কাছে আটকা পড়েছি। তাতে ভূত সমাজে আমাদের প্রেস্টিজ থাকবে না! বলো...তুমি যা বলবে তা-ই করব!
: যা বলব, তা-ই করবে?
: হ্যাঁ।
: আমার বন্ধু হবে?
: বন্ধু? হ্যাঁ হব।
: বন্ধু হওয়ার কিন্তু অনেক কাজ!
: কী কাজ?
: একসঙ্গে খেলতে হয়!
: হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরা একসঙ্গে খেলব।
: একসঙ্গে ঘুরতে হয়!
: হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরা একসঙ্গে ঘুরব।
: একসঙ্গে পড়তে হয়।
: পড়তেও হয় নাকি?
: হ্যাঁ। একসঙ্গে স্কুলেও যেতে হয়।
: কী বলো, এসব?
: হ্যাঁ। তোমরা কি আমার সঙ্গে স্কুল যাবে? একসঙ্গে ক্লাস করবে?
বদভূত বলল, ‘কক্ষনো না। মাথা খারাপ?’
কিন্তু তারপরেই অনেকক্ষণ অদভূত আর বদভূত চিন্তা করল। মানুষের জালে ধরা পড়ার চেয়ে মানুষের বন্ধু হয়ে স্কুলে যাওয়াই বোধ হয় ভালো! তারা হাত মেলাল রাফির সঙ্গে। রাফি তখন তোশকের নিচ থেকে মশারি বের করল। মশারির ফাঁক গলে এবার অদভূত আর বদভূত বেরিয়ে এল। ভীষণ অবাক তারা। এমন আজব জাল শুধু মানুষই বানাতে পারে! চলে যাচ্ছিল তারা। রাফি বলল, ‘শোনো, বন্ধুরা কিন্তু কথা দিয়ে কথাও রাখে!’
অদভূত আর বদভূত বিড়বিড় করে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি!

এখন রহনপুর শিক্ষানিকেতনের ফাইভের ক্লাসে গেলে দেখা যায় রাফির দুই পাশে অদভূত আর বদভূত বসে আছে। অদভূতের বাংলা ছড়া খুব ভালো লাগে, এর মধ্যেই সে কয়েকটা মুখস্থ করে ফেলেছে। বদভূত অবশ্য অঙ্কে খুব ভালো। বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে, এমনই তার ইচ্ছা।