শনিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৬

ক্রিকেটে ভবিষ্যতের উদ্‌যাপন

ইংলিশ অধিনায়ক বাটলারের উইকেট পতনের পর মাশরাফিদের উদ্‌যাপন পছন্দ হয়নি আইসিসির। এমন চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতের উদ্‌যাপন কেমন হবে দেখা যাক।  

এক মিনিট নীরবতা
.ম্যাচে তীব্র প্রতিযোগিতা। শেষ দুই বলে লাগবে ছয় রান। ব্যাটসম্যান উড়িয়ে মারলেন। চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাতের ভাষায় ‘বল চলে যাচ্ছে সীমানার বাইরে’। ঠিক এ সময় এক ফিল্ডার ছুটে এসে অনবদ্য ডাইভে বলটা তালুবন্দী করলেন। আউট আউট আউট!
কিন্তু মাঠে নেমে এল পিনপতন নীরবতা। কেউ দৌড়াল না। কেউ কাউকে জড়িয়ে ধরল না। ফিল্ডার বলটাকে নিয়ে আস্তে আস্তে বোলারের কাছে গেলেন। ক্যাপ্টেনও এলেন ধীরে ধীরে। ওদিকে মুখ শুকিয়ে উইকেটকিপার দাঁড়িয়ে থাকলেন। জায়ান্ট স্ক্রিনে লেখা উঠল, ‘ব্যাটসম্যান আউট! এক মিনিট নীরবতা!’
ব্যাটসম্যান হাসতে হাসতে চলে গেলেন প্যাভিলিয়নের দিকে। আর পিচের ওপর দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে এক মিনিট নীরবতা উদ্‌যাপন করতে থাকলেন বোলার ও ফিল্ডাররা।
পত্রপাঠ বিদায়
.ব্যাটসম্যান সমানে পিটিয়ে যাচ্ছেন। বোলাররা কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না। এ সময় এক পার্টটাইম বোলার এসেই বোল্ড করে ফেললেন ব্যাটসম্যানকে। মুহূর্তেই শোকের ছায়া নেমে এল ফিল্ডারদের চোখে-মুখে। কাভারে দাঁড়ানো ফিল্ডারটি তো কেঁদেই ফেললেন। পকেট থেকে রুমাল ও একটি কাগজ বের করে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে পড়তে শুরু করলেন—হে বিদায়ী ব্যাটসম্যান, বিশ্ব ক্রিকেটে আপনি এক অনন্য প্রতিভা। আপনি এতক্ষণ যে চার-ছয়ের ফুলঝুরি ছুটিয়েছেন, তা ছিল দৃষ্টিনন্দন। আপনার এই বিদায়বেলায় আমাদের বুকে যেন রচিত হয়েছে বেদনার মহাকাব্য।
আপনি ফিরে যাচ্ছেন, কিন্তু আমাদের জন্য রেখে যাচ্ছেন দুর্লভ স্মৃতি। আবার কোনো ম্যাচে, আবার কোনো মাঠে আপনার সঙ্গে আমাদের আবার হয়তো দেখা হবে। আবারও আপনি আমাদের ছয়-চার মেরে স্তব্ধ করে দেবেন, সেই আশাই করি।
পুষ্পমাল্য দান
.প্রচণ্ড উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচ চলছে। রান রেট উঠে গেছে আটের ওপর। টু ডাউনে নেমেই স্পিন বোলার পেয়ে ব্যাটসম্যান চলে এলেন ডাউন দ্য উইকেটে। উড়িয়ে মারতে চাইলেন। কিন্তু বল ব্যাটের কোনায় লেগে আলতোভাবে শূন্যে ভেসে চলে গেল বোলারের হাতে। কট অ্যান্ড বোল্ড। বোলার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলেন ব্যাটসম্যানের দিকে। একি করছেন বোলার? তিনি কি উইকেট পাওয়ার পর উদ্‌যাপন করতে ভুলে গেলেন? তিনি কি এখন হাত-পা ছুড়ে উল্লাস প্রকাশ করবেন? মাঠের ফিল্ডাররা হতবাক, দর্শকদের মধ্যে উৎকণ্ঠা। কিন্তু না, বোলার ভুল করেও কোনো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন না। বরং পকেট থেকে বের করলেন একটা বেলি ফুলের মালা। ব্যাটসম্যানের গলায় তা পরিয়ে দিলেন। ব্যাটসম্যান সেই মালা পরে আস্তে আস্তে মাঠের বাইরে চলে গেলেন। ফিল্ডার ও দর্শকের মধ্যে নেমে এল স্বস্তি। হাজার হোক, ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা!
চায়ের দাওয়াত দেওয়া
.অনেকক্ষণ থেকে খেলছেন ব্যাটসম্যান, এগিয়ে চলেছেন সেঞ্চুরির দিকে। কিন্তু তখনই ভুল করে একটা নিখুঁত বল করে ফেললেন বোলার। ব্যাটসম্যানের ব্যাটে চুমু খেয়ে বলটা চলে গেল উইকেটকিপারের হাতে। ব্যাটসম্যান গ্লাভস খুলতে খুলতে যে-ই না ক্রিজ ছাড়বেন, অমনি সব ফিল্ডার ঘিরে ধরবেন ব্যাটসম্যানকে। সমবেতভাবে আবৃত্তি করবেন ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতাটি। ক্যাপ্টেন এগিয়ে ব্যাটসম্যানের সঙ্গে হাত মেলাবেন, তারপর কোলাকুলি করবেন। তারপর ম্যাচ শেষে অফিশিয়াল চায়ের আড্ডায় দাওয়াত জানাবেন। ব্যাটসম্যান যদি চায়ের দাওয়াত গ্রহণ না করেন, তবে ক্যাপ্টেন তাঁকে আবার ব্যাটিং করতে অনুরোধ জানাবেন।
উদ্‌যাপনের জন্য বাড়তি দিন
.এসব উদ্‌যাপনের পর আরও উদ্‌যাপনের যদি কিছু থেকে থাকে, যদি খেলোয়াড়দের মন না ভরে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে প্রতিটি সিরিজে হয়তো একটা বাড়তি দিন রাখা হবে। এই দিনে প্রথম ভাগে এক দল মাঠে নামবে। জায়ান্ট স্ক্রিনে তাদের উইকেট নেওয়া দেখানো হবে। তখন তাঁরা নাচানাচি, পরস্পরকে জড়াজড়ি করে পিঠ চাপড়াচাপড়ি করবেন। কেউ যদি ডিগবাজি খেতে চান, তবে তা-ও খেতে পারবেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে, প্রতিপক্ষ দলের চোখে যেন এসব না পড়ে। এরপর প্রতিপক্ষ দল এসে একইভাবে উদ্‌যাপন করতে পারবে মাঠে। এটা হবে ভদ্রলোকি উদ্‌যাপনের চূড়ান্ত প্রকাশ।

শনিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৬

ইলিশের দাম ও গোপাল ভাঁড়

আঁকা: রাজীবঅনেক অনেক অনেক অনেক দিন আগে গোপাল ভাঁড় একবার বাজি ধরে ইলিশ কিনতে গিয়েছিল। বাজির শর্ত অনুযায়ী ইলিশের দাম যেন কেউ জিজ্ঞেস না করে, সে জন্য গোপাল ভাঁড় পরনের ধুতি খুলে মাথায় বেঁধেছিল পর্যন্ত। সেই অবস্থায় দেখে গোপাল ভাঁড়কে কেউ আর ইলিশের দাম জিজ্ঞেস করেনি আর গোপাল ভাঁড়ও বাজি জিতেছিল বেশ বড় অঙ্কের।
কিন্তু দিন বদলে গেছে। এখন আর গোপালের সঙ্গে তেমন কেউ বাজিও লাগে না, আর গোপালের আয়–রোজগারও গেছে কমে। আয়–রোজগার কমে গেলে কী হবে, ইলিশের প্রতি টানটা তার ঠিক টনটনে আছে। এবার হঠাৎই নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে জাটকার বদলে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। দামও কমে গেছে হু হু করে। গোপালের মনে হলো, এই সুযোগ। এবারই এক জোড়া ইলিশ কিনে গিন্নিকে চমকে দেবে।
গোপাল ছুটল মাছবাজারে। কিন্তু পথিমধ্যেই দেখা হয়ে গেল সেই লোকের সঙ্গে, যে অনেক অনেক অনেক অনেক দিন আগে গোপালের সঙ্গে ইলিশ নিয়ে বাজি ধরেছিল। সে বলল, ‘কী হে গোপাল, যাও কোথায়?’
: এই তো বাজারে।
: বাজারে? তা মাছবাজারেই নাকি?
: হ্যাঁ, ওই ভাবলাম দুইটা ইলিশ কিনে আনি। দামও সস্তা!
: হ্যাঁ, খুব সস্তা। এত সস্তা যে এক জোড়া কেন, এক হালি ইলিশ কিনে ঝোলাতে ঝোলাতে নিয়ে গেলেও কেউ দাম জানতে চাইবে না!
: না না, তা নিশ্চয়ই চাইবে!
: উঁহু, চাইবে না। বাজি?
: ঠিক আছে, আমার কাছে দাম জানতে চাইলে কী দেবেন?
: ৫০০ ইলিশের দাম। আর যদি না জিজ্ঞেস করে, তাহলে কিন্তু তোমাকে মুখে চুনকালি মাখতে হবে।
: ঠিক আছে।
গোপাল ৫০০ টাকায় এক জোড়া বেশ বড়সড় ইলিশ কিনে বাজার থেকে বেরিয়ে এল। হাতে ঝুলিয়ে পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য দোলাতে থাকল বেশ কায়দা করে। কিন্তু গত কদিনে ইলিশ কেনা এতই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে যে পথচারীদের কেউ ফিরেও তাকাল না। গোপাল আরও জোরে মাছ দোলাতে লাগল, কিন্তু তার দিকে দু-একজন তাকালেও ইলিশের দিকে একজনও নয়। গোপাল খুবই বিস্মিত। ইলিশ কেনা হয়েছে, অথচ কেউ তাকাচ্ছে না! এই কি তবে বঙ্গদেশ? বাজিতে কি তাহলে হেরে যাবে সে? একটা-দুইটা না, ৫০০ ইলিশের দাম! উফ্! অবশ্য গোপাল দমে যাওয়ার পাত্র নয়। চলতি পথেই এক পরিচিতজনকে পেয়ে সে দাঁড় করাল।
: হে হে হে। কোথায় যাচ্ছেন?
: এই তো বাজারের দিকে।
: আচ্ছা আচ্ছা। আমিও বাজার থেকে এলাম। এই যে এক জোড়া ইলিশ কিনলাম।
: ও ইলিশ? ইলিশ আর কত খাব? দেখি, সবজি পাই কি না!
: খুব সস্তায় পেলাম তো। খুব সস্তা!
: দাম তো সস্তাই ইলিশের। এ আর নতুন কী?
পরিচিতজন চলে গেল। গোপাল ভাঁড় মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। বাজি বোধ হয় হেরেই যাচ্ছে সে। ইলিশের দাম নিয়ে দেখা যাচ্ছে কারও কোনো আগ্রহই নেই।
আরেকটু এগোতেই এক প্রতিবেশীর দেখা পেল গোপাল। দূর থেকে দেখেই ওই প্রতিবেশী বলল, ‘কী গোপাল, ইলিশ কিনলে নাকি?’
খুব খুশি হলো গোপাল ভাঁড়। যাক, একজন পাওয়া গেল যে ইলিশ নিয়ে আগ্রহী। দামও নিশ্চয়ই জানতে চাইবে। গোপাল পড়িমরি করে ছুটে গেল তার সামনে।
: হ্যাঁ, এই যে ইলিশ। এক জোড়া! কিনে ফেললাম সস্তা পেয়ে।
: তোমাদের এই এক সমস্যা। সস্তা কিছু পেলে আর মাথা ঠিক থাকে না। জানো না, সস্তার তিন অবস্থা? সস্তা পেয়ে গাপুসগুপুস ইলিশ খাবে আর দু-পাঁচ বছরের ইলিশ না-খাওয়া পেটটা খারাপ করে ছাড়বে। ওই পেট ঠিক করতে কত টাকার ওষুধ খেতে হবে, জানো? শোনো, সবার পেটে ইলিশ সয় না!
: হ্যাঁ, তা তো ঠিকই, তা তো ঠিকই। তবে দামে এত সস্তা যে লোভ সামলাতে পারলাম না...
: লোভে পাপ আর পাপে ইলিশ, গোপাল! ইলিশও ওই রকম লোভ করে মিঠা পানিতে এসে ধরা খায়। তুমিও ধরা খেয়েছ! আর খবরদার, আমার ফ্রিজে ওই ইলিশ কিন্তু রাখতে আসবে না, বুঝেছ?
প্রতিবেশী গজগজ করতে করতে চলে গেল। গোপাল বুঝল, জীবনে এই প্রথম সে বাজি হারতে বসেছে। মুখে চুনকালি মাখার জন্য সে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল। তবে তার আগে শেষ চিকিৎসা হিসেবে সে দাঁড়িয়ে পড়ল মাঝ রাস্তায়। তারপরেই হাতের ইলিশ দুটো একটার সঙ্গে আরেকটার গায়ে ঘষতে শুরু করল। গোপাল ভাঁড়ের কাণ্ড দেখে লোক জমে গেল একেবারে।
: আরে, কী করেন ভাই?
গোপাল নিরুত্তর। সে ইলিশ ঘষেই যাচ্ছে। লোক আরও জড়ো হলো। সবার মুখেই এক প্রশ্ন, ‘লোকটা করছেটা কী?’ একজন তো বলেই বসল, ‘ইলিশ কিনে বোধ হয় পাগলই হয়ে গেছে গোপাল।’
গোপাল বলল, ‘নারে ভাই, পাগল হই নাই। কিন্তু ইলিশ বিক্রেতার কথামতো কেন যে কাজ হচ্ছে না, সেটা বোঝার চেষ্টা করছি!’
: কী বলেছিল সে?
: বলেছিল, এই মাছ দুইটা নাকি ভবিষ্যৎ বলতে পারে। দুইটা ইলিশকে একসঙ্গে ঘষা দিলেই নাকি কথা বলে ওঠে। আর বলে দেয়, কার কী ভবিষ্যৎ!
: দূর! তা হয় নাকি? তুমিও খুব বোকা তো!
: কী জানি ভাই, কিছুই বুঝতে পারছি না। এদিকে দামও তো নিল ম্যালা!
: কত দাম?
গোপাল কিছু না বলেই হাঁটতে শুরু করল। লোকগুলোও হাঁটতে লাগল তার পিছু পিছু।
: আরে আরে, বলছ না কেন কত দাম নিল? কত দামে তোমাকে ঠকাল, শুনি?
গোপাল ভাঁড় কিছুই না বলে জোর কদমে হাঁটতে থাকল। তাদের একমাত্র আগ্রহ, গোপাল ভাঁড় কত টাকা ঠকেছে তা জানা!
গোপাল ভাঁড় ততক্ষণে বাজি ধরা লোকটার কাছে পৌঁছে গেছে। তার পেছনের লোকগুলোকে ইলিশের দাম জিজ্ঞেস করতে দেখে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলতি বাজারদরে ৫০০ ইলিশের দাম কত, তা হিসাব করতে শুরু করল।


প্রথম প্রকাশ- রস আলো