সোমবার, ৮ জানুয়ারী, ২০১৮

জীবনানন্দ দাশের গরু কেনা

জীবনানন্দ দাশের গরু কেনা

৪৮৪৬২২:২১, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৬
AddThis Sharing Buttons
এমন সঙ্কটে জীবন বাবু কখনো পড়েন নি। এই একটু আগে বন্ধু মহসীন এসে তাঁকে ধরেছেন। এবার আর ছাগ নয়, এই ঈদে তারা আস্ত একটা গরুই কুরবানি দেবে। জীবনানন্দ যেন তাকে সাহায্য করে গরু কেনায়। সম্ভব হলে জীবনানন্দ দাশ আকাশ থেকে পড়তেন। সম্ভব হলো না। তিনি বসেছিলেন ভাঙা হাতলের বুড়োমার্কা চেয়ারে। সেখান থেকে শুধু পিছলে গেলেন। ডাগর চোখে মহসিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি গরু কিনব কীভাবে? আমি তো জীবনেও গরু কিনিনি মহসিন! মহসিন বলল, তুই কখনো হাজার বছর বেঁচেছিস?
ftu

জীবন বাবু পিটপিট চোখে এবার তাকালেন। মহসিন বলল, বাঁচিস নি তো? কিন্তু লিখেছিস তো হাজার বছর আমি পথ হাঁটিতেছি...তাহলে? জীবনে যা করিস নি তা যদি লিখতে পারিস তাহলে একটা গরু কিনতে পারবি না! 

জীবন বাবু বললেন, কিন্তু গরু কিনতে আমিই কেন? 
মহসিন বলল, শোন সকলেই যেমন কবি নয়, তেমনি সকলই কিন্তু গরু নয়। তুই যদি কবিকে চিনতে পারিস তাহলে গরুকেও চিনতে পারবি। গরু আর কবিদের মধ্যে পার্থক্য বিশেষ নাই! 
: কী বলিস এসব? 
: ঠিকই তো বলি। গরু যেমন খাওয়ার সময় খেয়ে নেয় হাপুস-হুপুস তারপর সারাদিন বসে ঝিমায় আর জাবর কাটে...কবিরাও তেমনি সারাদিন এটা-ওটা দেখে আর সারা রাত বসে বসে সেগুলো নিয়ে জাবর কাটতে থাকে...আর কাগজ-কলম বা ল্যাপটপ নিয়ে কবিতা লিখে যায়। কবিতা লেখা আর জাবর কাটার মধ্যে পার্থক্যটা কী বল? না না তুইই বল, পার্থক্যটা কী? শোন, গরু উপকারী...কবিও মোটামোটি উপকারী...বিশেষত এদের কবিতার লাইন প্রেম করতে গিয়ে মাঝে মাঝে ভালোই কাজে লাগে। এবার আর কথা না, চল আমার সাথে। আজকে একটা ভালো গরু কিনতেই হবে।

পরের দৃশ্য গরুর হাটে। ধানসিঁড়ি হাট। আর হাটের ভেতর হাজার হাজার মানুষ, নাকি লাখ লাখ? জীবনানন্দ দাশের তব্দা খাওয়ার অবস্থা। এত মানুষ? তিনি একটু নির্জনতা পছন্দ করেন। কিন্তু শুধু তো মানুষ না। মানুষের মধ্যেই সারি সারি গরু। নানান ধরনের গরু। যেন মানুষ আর গরুর এক মহামিলনমেলা। আহা! কিন্তু জীবনানন্দের বড় অস্বস্তি হচ্ছে। এত মানুষের ভিতর বা এত গরুর ভিতর তিনি কী করবেন?

মহসিন তাকে টানতে টানতে প্রথমেই নিয়ে গেল একটা মাটিরঙা গরুর সামনে। গরুটা তাকিয়ে আছে ছলোছলো চোখে। অন্তত জীবনানন্দের তাই মনে হলো। মহসিন কিছু দর-দাম করে ওঠার আগেই চোখের সামনেই গরুটা বিক্রি হয়ে গেল। তাতে গরুটা খুশিই হলো কিনা বলা মুস্কিল। হতেও পারে। এখানে তীব্র রোদ। খাদ্যের অভাব। সব মিলিয়ে গরুটা হয়তো ভাবছে নতুন ঠিকানাই তার জন্য শুভ। টুংটাং করে নিজের গলার ঘণ্টি বাজিয়ে সে যেতে লাগল ক্রেতার সাথে। আহারে, গরুটা জানে না কী পরিণতি তার সামনে। জীবনানন্দ বলে উঠলেন--

গরুঞ্জনা, ওই দিকে যেও নাকো তুমি 
দিও নাকো দড়ি ওই বুড়োটার হাতে; 
ফিরে এসো গরুঞ্জনা 
লোক-জঞ্জাল ভরা এই ধানসিঁড়ি মাঠে...

গরুটি হাম্বা করে দুইবার ডেকে জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলে গেল। মহসিনের মুখে আফসোস। বলল, ভালো গরু ছিল। মিস হয়ে গেল! চল, চল ওই গরুটাকে দেখি...দেখেছিস তার লেজ কী সুন্দর... 

কিন্তু সৌন্দর্যের চেয়ে বরং জীবনানন্দ দাশ তাকে দেখল দুখী হিসেবে। কেমন মায়া মায়া চেহারা। মাথা এক দিকে করে জাবর কেটে চলেছে বিষাদগ্রস্থ চোখে। আহা! জীবনানন্দের বুকটা ডুকরে উঠল। 

হয়তো তার গাভিটি শুয়ে ছিল পাশে-- বাছুরটিও ছিলো
ঘাস ছিলো, হাম্বা ছিলো--জঙ্গলে--তবু সে দেখিল 
কোন কসাই? জাবর কাটা হলো না তার 
অথবা জাবর কাটে নাই বহুকাল-- ধানসিঁড়ি হাটে শুয়ে জাবর কাটিছে এবার।

মহসিন গরুর দাম জিজ্ঞেস করতেই কয়েক লক্ষের অঙ্ক জীবনানন্দের কানের পাশ দিয়ে সাঁই করে বেরিয়ে গেল। একটা গরুর দাম ২৫ লাখ? বাপরে বাপ! এতো মানুষের চেয়ে ঢের বেশি দামী। ভুল লিখেছেন ভুল লিখেছেন তিনি। নিজেকে দুষতে শুরু করলেন। তাঁকে লিখতে হতো-- 

আমি যদি হতেম বুনোগরু 
বুনোগাভী হতে যদি তুমি 
লক্ষ টাকা দাম হয়ে চড়িতাম ধানসিঁড়ি তৃণভূমি!

দাম শুনে মহসিনেরও অবস্থা খারাপ। ভিড়ের মধ্যে জীবনানন্দকে টেনে প্রায় পালিয়ে আরেক পাশে চলে আসে সে। এখানে কিছু গরু আছে। আকৃতিতে ছোট ছোট। প্রকৃতিতে নরম। তবে একটা গরুর দশা ভিন্ন। সে তার খুঁটি ধরে একা একা ঘুরে চলেছে। আর কিছুক্ষণ পরপর হাম্বা হাম্বা ডেকে চলেছে। জীবনানন্দ দাশ বলে উঠলেন-- 

হায় গরু, সোনালী কানের গরু, এই খটখটে খড়ের দুপুরে 
তুমি আর কেঁদো নাকো বাঁকাত্যাড়া খুটিটিকে ঘুরে ঘুরে।

গরু জীবনানন্দ দাশের কথা আমলে নিলো। ঘোরা বন্ধ করে দুইবার কান ঝেড়ে গোবর ঢালা শুরু করল। তাতে বাতাস কিছুটা ভারী হয়ে আসল বটে। আর তখনই আওয়াজ উঠল হাটজুড়ে, পালাও পালাও! কাহিনি বুঝতে মহসিন ছুটন্ত একজনকে ধরে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? কী হয়েছে ভাই? লোকটি বিস্ফোরিত চোখে বলল, হাটের সবচেয়ে ষণ্ডা ষাঁড়টা খুঁটি উপড়ে ছুটে গেছে। এখন যাকে পারছে তাকেই শিং দিয়ে গুঁতিয়ে পেছনের হাড়হাড্ডি ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলছে...জানে বাঁচতে চাইলে পালাও...

সঙ্গে সঙ্গে গগনবিদারী হাম্বা রব এলো। আরও একদল লোক স্যান্ডেল ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে লুঙ্গি ফেলে দৌড় দিল। অনেক ধুলো আর বাতাসের ভেতর একটা ষাঁড়ের নিঃশ্বাসের প্রায় গরম বাতাস অনুভব করলেন জীবনানন্দ দাশ। দৌড় দিলেন তিনি। দৌড়াতেই থাকলেন। আর যতবার পেছন ফিরে তাকালেন দেখলেন একটা ষাঁড় তার পেছনে তেড়ে আসছে। জীবনানন্দ দাশের পরনের লাল ফতুয়া ষাঁড়টার হয়তো মনে ধরেছে।

সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। আর কবিরা যখন হাঁটে তখনো কবি। যখন ঘুমায় তখনো কবি। আর যখন প্রাণভয়ে দৌড়ায় তখনও তো কবি। তাই দৌড়াতে দৌড়াতে জীবনানন্দ দাশ বলে উঠলেন--

হাজার বছর ধরে দৌড়াইতেছি আমি ধানসিঁড়ি মাঠে 
খড়-বিচালি, কচি ঘাস থেকে থকথকে গোবর সাগরে 
অনেক ছুটেছি আমি; ধুলো ওড়া বালিময় ধূসর তল্লাটে 
এখন রয়েছি আমি; আরো দূর না গেলে যাবো বুঝি মরে

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিক হৈ-হল্লায় যেন নরক গুলজার
আমারে তাড়া করিয়াছে কোথাকার কোন এক ষণ্ডামার্কা ষাঁড়॥

আজিকে হিমুর বিবাহ : রবীন্দ্রনাথ যদি হিমু সিরিজ লিখতেন

কন্যার বাপ সবুর করিতে পারিত, কিন্তু কন্যা সবুর করিতে চাহিল না। এমন হলুদমার্কা কিউটের ডিব্বা পাত্র সহজে পাওয়া যাইবে না। অতএব আজিকাই বিবাহ।
যদিও কী করিয়া গুণিতে হয় জানা নাই, তবুও বাদল প্রমাদ গুণিল। হিমুর দিকে ড্যাবড্যাব করিয়া তাকাইয়া বলিল, হিমু ভাই, তোমার কি উত্তেজনা হইতেছে? তোমার বিবাহের ক্ষণ যে সম্পন্ন হইয়া যাইতেছে!
himu
হিমু বলিল, মানুষ মাত্রেই উত্তেজনাকর জীব। এরা বাদামের মতো ক্ষুদ্র যে খাদ্য তাহা খাইতে গিয়াও উত্তেজনা অনুভব করে। খুব অল্প টিপি দিয়া বাদামের খোসা ভাঙিয়া তাহার ভেতর হইতে বাদাম বাইর করিতে গিয়াই বুকের ভিতর আলোড়ন অনুভব করে...বিবাহ তো সারা জীবনের টিপি খাওয়া! ইহাতেও উত্তেজনার অন্ত নাই! কিন্তু বাবার ডায়েরিতে লেখা আছে--হিমু, উত্তেজনা হইল নিতান্ত বোকা মানুষদের আবেগ। জানোই তো সাময়িক উত্তেজনা কত বড় বড় অপরাধের জন্ম দিয়াছে এই পৃথিবীতে। তোমাকে ভাইব্রেশনহীন মোবাইলের মতো হইতে হইবে। কল আসিবে ঠিকই, কিন্তু তুমি কাঁপিবে না!
বাদল বলিল, কিন্তু আমি তো কাঁপিতেছি! ডিআইজির কন্যা... একি সহজে ছাড়িবে? অদ্যই শেষ রজনী করিয়া ছাড়িয়া দিবে! ডিআইজির সাথে হুদাই ফাঁপড় লইতে যাওয়া একদমই ঠিক হয় নাই! বিগ মিসটেক!
ডিআইজির কন্যা ততক্ষণে আরেকবার ড্রইংরুমে আসিয়া দাঁড়াইছে। হিমু নির্লিপ্ত থাকিলেও বাদলের প্যান্ট ভিজিবার উপক্রম। সূর্যের চাইতে বালি যে বেশি গরম হয় এ কথা বাদল হুমায়ূনের বইয়ে পড়িয়াছে...কিন্তু এখন দেখিতেছে সূর্যের চাইতে স্যান্ডেলও গরম! ডিআইজির চাইতে ডিআইজির মা-কন্যা সকলেই গরম! মিসটেক, বিগ মিসটেক!
২.
ঘটনা তাহা হইলে গোরা হইতেই শুরু করা যাক।
ঘন শালবনে গভীর রাত্রে একাকী জ্যোৎস্না দেখিতে যাইয়া গতবার বাদলের খুবই প্রবলেম হইয়াছিল। যেখানে মানুষ পৌঁছে না সেইখানে বাতাসে বাতাসে মানুষের বিষ্ঠার গন্ধ যে পৌঁছায়া যাইতে পারে তাহা সম্পর্কে বাদলের কোনো ধারণা ছিল না। শালবনের ভেতর নিজেকে মাটিতে আটকায়া নিয়া সারা রাত্রী সেই গন্ধের ভেতর বাদলকে কাটাইতে হইয়াছে। সঙ্গে মশার বাহুবলিরা ছিল। তাহারা কাটিয়া-কামড়াইয়া বাদলের নাক-মুখ রক্তাক্ত করিয়া ফেলিয়াছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বাদল এইবার জ্যোৎস্না দেখার প্ল্যানে কিছু জিনিস অ্যাড করিয়াছিল। সেই উদ্দেশেই কালো ব্যাগ আর হলুদ হিমুকে লইয়া সে মার্কেটে মার্কেটে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল অ্যারোসল আর পারফিউম কিনিবার নিমিত্তে। হিমুরও আগ্রহের সীমা ছিল না। সে বলিল, অ্যারোসল দিয়া মশা মারায় কোনো আরাম নাই...মশা মারা উচিত কামান দিয়া। হিমুর কথায় বাদল বিহ্বল হইয়া পড়িল। ঢাকার কোথায় কোথায় কামান এখনো জীবিত আছে সেই একটা হিসাব করিয়া হিমুকে নিয়া তারা প্রথমেই জাদুঘর গেটে পৌঁছাইল।
জাদুঘরের আগের দিন নাই। একটা সময় এইখানে আন্দোলন-টান্দোলন হইত। এখন কিছু চিমস্যা মারা পোলাপাইন বইসা থাকে। এদের চোখে না আছে বিগত আন্দোলনের সুরভী, না আছে আগামী প্রাপ্তির ভবিষ্যত! বাদল বলিল, মামা, ওই যে কামান! চলো নিয়া আসিগে!
হিমু বলিল, তুই আমারে মামা বলিতেছিস ক্যান? আমি তো তোর খালাতো ভাই!
বাদল বলিল, উত্তেজনায় গোপাল ভাঁড় হইয়া যাইতেছি হিমু খালু! তাড়াতাড়ি চলো, এক্ষুনি কামান লইয়া শালবন পালাই!
হিমু বলিল, যে কোনো উত্তম কাজ করিবার আগে এক কাপ চা খাওয়া উচিত! এই পিচ্চি চা দে...
দোকানে পিচ্চি ছিল না, বরং পিচ্চির বাপ বয়সী একজন চা বানাইতেছিল। সে অত্যন্ত রুষ্ট হয়ে বলিল, আমারে আপনার পিচ্চি লাগিল?
হিমু বলিল, কামান চুরি করিব। এই উত্তেজনায় গোপাল ভাঁড় হইয়া গিয়াছি! চা দাও পাঁঠা!
পাঁঠা বা পিচ্চি কিছুক্ষণ থম মেরে হিমুদের দিকে তাকাইয়া থাকিল, পরে খালি কাপে গরম পানি ঢালিয়া কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করিতে করিতেই কাকে যেন মোবাইল ফোনে কল করিল।
৩.
বাংলাদেশ পুলিশ আর আগের মতো নাই। এখন তাহারা যথেষ্ট করিৎকর্মা। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা সাইরেন বাজিয়ে জাদুঘরের সামনে হাজির হইল। এবং কামান চুরির দায়ে হিমু আর বাদলকে গ্রেফতার করিল।
ডিআইজি বলিল, চল..চল তোরা!
হিমু বলিল, চায়ের অর্ডার দিয়াছি! চা খাইয়া যাইতেছি!
ডিআইজি বলিল, চা, না? চা তোর আমি ‌ড্যাস দিয়া ঢুকায়া দিবো!
হিমু বলিল, এমনি ঢুকাবেন নাকি ফানেল ব্যবহার করিবেন। পুরান ঢাকায় মনতাজ আলী নামের একজন খুব ভালো ফানেল বানায়!
ডিআইজি বলিল, চোপ! চোপ একদম! তোদের আমি কী করিতে পারি জানিস? শালা, হলুদ পাঞ্জাবি পরিস? কোন গ্রুপের তোরা? কী নাম তোদের? দেখি...দেখি কালো ব্যাগ...
himu-1
ব্যাগের মধ্যে অ্যারোসলের ছয়টা বোতল পাওয়া গেল। সঙ্গে দামী দামী পারফিউমের বোতল। ডিআইজি বলিল, বোমা বানানোর সরঞ্জাম নিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছোস তোরা? আবার কামান চুরি করতে চাইস! কামান চুরি করিয়া কী করিবি, অ্যা?
বাদল মিনমিন করিয়া বলিল, মশা মারিব!
ডিআইজ বলিল, চোপ! চোপ একদম! মশা আমি তোর ড্যাস দিয়া ঢুকায়া দিবো!
হিমু বলিল, কিন্তু এইসব করিবার আগে তো আপনার একবার বাড়িতে যাওয়া উচিত! আপনার স্ত্রী তো রক্তপাতের ভিতর আছে!
ডিআইজি আরও খেপিলেন। খেপিয়া বলিলেন, হিমুগিরি? আমার সাথে হিমুগিরি! কী মনে করছোস আমি হিমু পড়ি নাই... এইগুলা খালি ওই হুমায়ূনের অপন্যাসেই হয়, বুঝলি!
এ সময় ডিআইজির ফোন বাজিয়া উঠিল। ফোন কানে নিতেই সে ঝটকায় হিমুর দিকে তাকাইল। তারপর তাড়াতাড়ি বলিল, আসিতেছি, আমি কুইক আসিতেছি!
ফোন রাখিয়া হিমুকে ডিআইজি বলিল, আমার স্ত্রী বাথরুমে মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া গিয়াছে...মাথা কাটিয়াছে বিস্তর...ভাই একটু আসেন আমার সাথে!
ডিআইজি পরম আস্থায় হিমুর হাত ধরিল। মাথার সাথে সাথে যেমন ধর যাইয়া থাকে, ডিআইজির সাথে সাথে হিমু ও বাদল তেমনি ডিআইজির বাড়ি উপস্থিত হইল। আর হইয়াই বুঝিল বিরাট ভুল হইয়া গিয়াছে। বিগ মিসটেক!
৪.
ডিআইজির স্ত্রী সারিয়া উঠিতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লইল না। কপালে দুখানা সেলাই পড়িল মাত্র। কিন্তু হিমুকে দেখিয়া ডিআইজির কন্যার যে অসুখ বাধিল তা ঘণ্টায় ঘণ্টায়, মিনিটে মিনিটে, কি সেকেন্ডে সেকেন্ডে বাড়িয়া চলিল। ডিআইজি বলিল, শোনেন হিমু, আপনি যদি সত্যি হিমু হইয়া থাকেন তা হইলে এইটুকু জানিয়া রাখেন আমি আমার মেয়েকে অত্যন্ত ভালোবাসি! আর আমার মেয়ে আপনারে অত্যন্ত ভালোবাসিয়া ফেলিয়াছে! সে আর কোনো অপেক্ষায় করিতে চাহে না! আমি আজি রাত্রেই আপনাদের বিবাহ দিতে ইচ্ছুক। আপনার মত কী?
হিমু বলিল, আসসালামুআইলাইকুম!
ডিআইজি বিস্মিত হইয়া বলিলে, সালাম কেন দিতেছেন?
হিমু বলিল, নতুন সম্পর্ক হইতে যাইতেছে আমাদের মধ্যে এই জন্য সালাম!
ঘরে ডিআইজির কন্যা উপস্থিত ছিল, সে হাসিয়া ফেলিল। কন্যার হাসি সুন্দর। কারো কারো হাসি সুন্দর হইয়াও বুকে লাগে না, এই কন্যার হাসি লাগে। শীতরাতের জ্যোৎস্না যেমন একই সাথে সুন্দর ও ভয়াবহ...এই কন্যার হাসিও তেমন! বাড়িতে বিবাহের প্রস্তুতি আরম্ভ হইয়া গেল!

আপনার নাম হিমু?

ওসি সাহেব দেখতে দশাসই। চোখ দুটো ছোট ছোট হওয়ায় চেহারায় হাতি-ভাব আছে। পান-মসলা খাওয়ার অভ্যাস আছে বোধ হয়, কিছুক্ষণ পরপরই মুখ নাড়াচ্ছেন। বুকের ওপর নাম লেখা—মোজাফ্‌ফর! প্রথম ‘ফ’য়ের নিচে হসন্ত আছে। বাংলায় এই হসন্ত দোর্দণ্ড প্রতাপে টিকে আছে, এমনটা বলা যায় না। হসন্তের অবস্থা অনেকটা ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের মতো, আছে কিন্তু কেউ ব্যবহার করে না।
: কী হলো, কথা বলছেন না কেন? আপনার নাম হিমু?
আমি কী জবাব দেব বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ আগে রাস্তা থেকে আমাকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। বসে আছি থানায়। ওসি সাহেব হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছেন। মনে হচ্ছে উত্তেজিত। সন্দেহ হচ্ছে উত্তেজনা আমাকে নিয়েই। পুলিশ যখন উত্তেজিত হয়, তখন পা ফেলতে হয় সাবধানে। আমি সাবধানে শুধু পা নয়, পুরো শরীরটাই ফেললাম। কুঁইকুঁই করে জানতে চাইলাম, ‘কেন বলুন তো?’
: যা প্রশ্ন করেছি, তার উত্তর দেন! প্রশ্নের জবাবে প্রশ্ন করবেন না। আমরা তাস খেলতে বসিনি যে আমি একটা তাস ফেলব তার বদলে আপনি একটা তাস ফেলবেন! প্রশ্ন করছি, জবাব দেন! আপনি হিমু?
: হিমু না, হীরু বলতে পারেন।
আমি এখনো জিনিসটাকে মাঝামাঝি রাখার চেষ্টা করছি। পানি কোন দিকে গড়াচ্ছে, বুঝতে পারছি না। পানি যেদিকে গড়াবে সেদিকে ছাতা ধরার নিয়ম। আমার কাছে কোনো ছাতা নেই। ওসি সাহেবের বিরক্তি সম্ভবত চরমে পৌঁছেছে। বললেন, ‘হীরু! এটা কেমন নাম?’
: অত্যন্ত খারাপ নাম, স্যার। আমার দূরসম্পর্কের এক আত্মীয় আমাকে এই নামে ডাকত। আমার খুবই রাগ হতো। রাগ থেকে আমি একবার তাদের বাড়িতে ডাস্টবিনের ময়লা ছুড়ে মেরেছিলাম!
: সর্বনাশ! তারপর?
: তারপরের ঘটনা স্যার অনেক লম্বা! ওই ময়লার মধ্যে একটা মানিব্যাগ ছিল। মানিব্যাগভর্তি ছিল টাকা! টোটাল টাকা ছিল ৫৭ হাজার ৩২৭! ’৯২ সালের ঘটনা স্যার, তখন ৫৭ হাজার অনেক টাকা। আমি ছুড়লাম ময়লা, তারা পেল গুপ্তধন! এই তো কপাল স্যার!
: মানিব্যাগে কেউ ৫৭ হাজার টাকা রাখে! ফাজলামি করছেন আমার সাথে?
: জি স্যার। মানে স্যার, ফাজলামি না ঠিক, কথায় কথায় কথা বাড়িয়ে স্যার বোঝার চেষ্টা করছি ঠিক কী কারণে আমাকে থানায় ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। আর কী কারণেই বা আমার নাম হিমু কি না জানতে চাওয়া হচ্ছে। এটা ইনফরমেশন নেওয়ার একধরনের পদ্ধতি। পদ্ধতিটার জনক হলেন সম্ভব জার্মানির মিস্টার...
: থাক থাক। আর প্যাঁচাল বাড়াবেন না। সোজা কথায় বলেন, আপনি হিমু কি হিমু না।
: স্যার, আমার গায়ে কি পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবি আছে?
: না।
: স্যার, আমার কি দাড়ি আছে?
: না।
: আরেকটা ইনফরমেশন স্যার, আপনাদের সুবিধার্থে দিচ্ছি, রূপা নামের আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নাই। একচুয়ালি আমার কোনো গার্লফ্রেন্ডই নাই! এ নিয়ে আমার মনে কিঞ্চিৎ দুঃখবোধ আছে।
: মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনি হিমু না?
: জি স্যার। আমি হিমু না। আমার নাম আহমেদ খান হীরক। হীরক থেকে হীরু স্যার। ওই যে আমার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের কথা বলছিলাম স্যার, যার বাড়িতে আমি ময়লা ছুড়ে ফেলেছিলাম। যে ময়লার ভেতর মানিব্যাগ ছিল। যে মানিব্যাগে স্যার ৫৭ হাজার...
: থাক থাক, আর বলতে হবে না। আপনি যদি হিমু না হন তাহলে হিমু নিয়ে লেখেন কেন?
: জি স্যার?
: আমাদের কাছে ইনফো আছে, আপনি হিমুকে নিয়ে লেখেন।
: স্যার, আমি খুবই ছোট এক লেখক, স্যার। পেটের দায়ে লেখি। সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য মাঝেমধ্যে হিমু চরিত্র নিয়ে দু-একটা লেখা লিখেছি। লাভের লাভ কিছুই হয়নি। না লেখাগুলো প্রিয় হয়েছে, না আমি জনপ্রিয় হয়েছি! তার মধ্যে স্যার হিমুর ফ্যানরা আমাকে বকাঝকা করেছে। মিষ্টি মিষ্টি গালমন্দও করেছে!
: অত্যন্ত ঠিক কাজ করেছে।
: জি স্যার, উচিত কাজই করেছে। হিমুকে নিয়ে স্যার আমার লিখতে যাওয়া ঠিক হয়নি। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। হিমু নিয়ে লেখা আমি তাই ছেড়ে দিয়েছি।
: কিন্তু ছেড়ে দিলে তো হবে না মিস্টার হীরক না হীরু, আপনাকে লিখতে হবে!
: মানে স্যার?
: মানে আমার স্ত্রী, তিনি বিরাট হিমুভক্ত। আগামীকাল তাঁর জন্মদিন! রাত বারোটায় আমি তাঁকে একটা চিঠি দিতে চাই। যে চিঠিটা আসলে হিমু লিখবে তার জন্য। কী, পারবেন না?
আমার মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরোল না। ওসি সাহেব বললেন, ‘যতক্ষণ চিঠি লিখে দেবেন না ততক্ষণ আপনি আমার হেফাজতে থাকবেন।’ আমার কণ্ঠ আরও নিচু হয়ে গেল। কোনোমতে বললাম, ‘চা...চা হবে এক কাপ?’
২.
চব্বিশ কাপ চা শেষ হয়েছে, একটা লাইনও বের হয়নি। শূন্য পাতার দিকে তাকিয়ে আছি। হিমু হিসেবে ওসি সাহেবের স্ত্রীর জন্য কী লিখব বুঝতে পারছি না। সময় বয়ে যাচ্ছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বারোটা বাজবে। আর বারোটা বাজলেই আমারও বারোটা বাজবে! কারণ, ওসি সাহেব তখন চিঠিটা তাঁর বাসায় পাঠিয়ে দেবেন। পাঠিয়ে ফোন দিয়ে সুরেলা কণ্ঠে বলবেন, ‘হ্যাপি বার্থ ডে, হ্যাপি বার্থ ডে ডিয়ার, হ্যাপি!’ ও হ্যাঁ, ওসি সাহেবের স্ত্রীর নাম হ্যাপি। ওসি সাহেব মাঝেমধ্যেই এসে তাড়া দিয়ে যাচ্ছেন, ‘কী হলো? কদ্দুর হলো?’ আমি চুপ করে থাকি। চোখের দৃষ্টি দিয়ে ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করি। যেন বলছি, ‘হচ্ছে হচ্ছে...এই তো আর কিছুক্ষণ!’
বারোটা বাজতে যখন আর মাত্র ১০ মিনিট বাকি তখন কিছু একটা লিখে ধরিয়ে দিলাম ওসি সাহেবের হাতে। ওসি সাহেব মহাখুশি হয়ে তাড়ার মধ্যে কী লিখেছি না পড়েই স্ত্রীর উদ্দেশে একজন সহকারীকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। আমি বললাম, ‘আমি তাহলে আসি?’ ওসি সাহেব মধুর কণ্ঠে বললেন, ‘না না, তা কী করে হয়! স্ত্রীর রিঅ্যাকশন না জেনেই চলে যাবেন?’
ওসি সাহেব ঘড়ি দেখছেন, আমি নিজের অন্ধকার ভবিষ্যৎ দেখছি। আমার পেট গুড়গুড় করছে। যেকোনো মুহূর্তে কেলেঙ্কারি হয়ে যেতে পারে।
বারোটা বাজল। ওসি সাহেব ফোন তুললেন কানে। বললেন, ‘হ্যাপি বার্থ ডে...’। কথা শেষ করতে পারলেন না। কেমন যেন চমকে উঠলেন। আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল। পরপর দুবার হার্টের রিদম মিস করে গেল। ওসি সাহেব বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি না...এটা তো অন্যজন লিখেছে! হ্যাঁ হ্যাঁ, উনি তো আমার সাথেই আছেন। কথা বলবে? দাঁড়াও, দিচ্ছি!’
ওসি সাহেব আমার দিকে তাঁর ফোনটা বাড়িয়ে দিলেন। আমি ফোনের বদলে যেন আস্ত একটা বোমা ধরলাম। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম, ‘হ্যালো...।’ ও-প্রান্ত থেকে অত্যন্ত মিষ্টি কণ্ঠ রিনরিন করে উঠল। বলল, ‘এটা আপনি লিখেছেন?’
: জি, মানে হ্যাঁ।
: এটা তো খুবই ভালো হয়েছে!
: জি, মানে সত্যি? শুকরিয়া!
: এত ভালো হয়েছে যে সেটা দিয়ে চুলা জ্বালিয়েছি। চুলা জ্বালিয়ে তাতে চা চাপিয়েছি। আমার গবেট হাজব্যান্ডটাকে নিয়ে আসেন এক্ষুনি। চা খেয়ে তারপর যাবেন!
: কী বলেন এইসব?
: যা বলছি তা শোনেন। এক্ষুনি আসেন। আজকে আমি আপনার আর আমার স্বামীর হিমুগিরি ছোটাব! আসেন এক্ষুনি! আসেন!
ফোনের ভেতর থেকে মিষ্টি কণ্ঠ এক নিমেষে দানবীয় হয়ে উঠল। আমি করুণ চোখে ওসির দিকে তাকালাম। ওসির মুখ ঝুলে গেছে। হিতে এতটা বিপরীত হতে পারে তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। আমি খনখনে কণ্ঠে বললাম, ‘আমাদের দুজনকে ডাকছেন উনি...’
ওসি সাহেব বললেন, ‘ডাবলু, গাড়ি বের করো...’
৩.
শালবনে বসে আছি। আমি আর ওসি সাহেব। ওসি সাহেবের মুখ অত্যন্ত ব্যাজার। কিছুক্ষণ পরপর চাটি মেরে মশা মারার চেষ্টা করছেন। মশা মারা যাচ্ছে না। তবে তারা তাদের গানের আওয়াজ বাড়িয়ে তুলেছে। বনের মধ্যে এ সময় ফুলের গন্ধ ভেসে আসার কথা। গল্প-উপন্যাসে তা-ই হয়। আমরা পাচ্ছি বিজাতীয় আঁশটে দুর্গন্ধ। আকাশে ফুলমুন অবশ্য উঠেছে। চাঁদটাকে দেখে তেমন কোনো আহ্লাদ হচ্ছে না। বরং শীতরাতে এভাবে বসে থাকার জন্য আমরা পরস্পরকে দোষ দিয়ে যাচ্ছি। আমি বলছি, ‘ওসি সাহেব, স্ত্রীর ভয়ে শালবনে বসে আছেন; এটা কি কোনো কাজের কথা?’ ওসি সাহেব বলছেন, ‘লেখকদের ওপর কোনো বিশ্বাস নেই, কোনো বিশ্বাস নেই!’
তবে এ কথাগুলো আমরা মনে মনে বলছি। কারণ, মুখে কিছু বলার মতো মুখ না আমার আছে, না ওসি সাহেবের!
বিপিএলে পাঁচটার মধ্যে চারটার শিরোপাই জিতেছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। তা-ও আবার কোনো এক দল থেকে নয়। যখন যেমন দলই তিনি পান না কেন, কাপ পাইয়ে ছেড়েছেন! মাশরাফি জাদু জানেন। আর এই জাদু জানার কথা ধীরে ধীরে জেনে যাচ্ছে বিশ্ববাসীও। এমন জাদুকর দুটো নেই। তাই অদূর ভবিষ্যতে জাদুকর মাশরাফিকে নিয়ে নানান গল্পকথা, উপকথার চল হবে। দেখে নেওয়া যাক সেসব গল্পকথা আসলে কেমন হবে। লিখেছেন আহমেদ খান
আলিবাবা চল্লিশ চোর
আলিবাবা দাঁড়িয়ে আছে গুহার দরজায়। গুহার ভেতরে আছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। আলিবাবা জানে, কী বললে গুহার মুখটা খুলে যাবে। সে বলল, ‘চিচিংফাঁক!’ বলেই হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকল। কিন্তু দরজা খুলল না। আলিবাবা আবার বলল, ‘চিচিংফাঁক!’ আলিবাবা হাতের বস্তাটস্তা গুছিয়ে নিল, দরজা খুললেই ভেতরের হীরা-জহরত বস্তায় ভরে নেবে। কিন্তু না, এবারও দরজা খুলল না। মুশকিল! আলিবাবার জানামতে এটাই তো ছিল পাসওয়ার্ড! আলিবাবা বিচলিত হয়ে নানান শব্দ করল—আলুফাঁক, পটোলফাঁক, মাল্টাফাঁক! কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না। আলিবাবা বুঝল, পাসওয়ার্ড হ্যাক হয়েছে। এখন উপায় কী? যা থাকে কপালে বলে আলিবাবা বলল, ‘মাশরাফি! মাশরাফি!’ আর সঙ্গে সঙ্গে গুহার ভারী দরজাটা খুলে গেল। ভেতরে জ্বলজ্বল করছে হীরা-জহরত। আলিবাবা হাসল মনে মনে। হ্যাককারীও তার মতোই মাশরাফির ভক্ত!
সুখী মানুষের জামা
লোকটার হলো হাড় মড়মড় রোগ। বিছানায় কোনোভাবেই শুতে পারে না। এ-কাত হলে পাঁজরের হাড় মড়মড় করে ওঠে, ও-কাত হলে পিঠের হাড় ভেঙে যাওয়ার জোগাড়। ঘোড়ার মতো দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে ঘুমায়। ডাক্তার-কবিরাজ বহুত হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত এক চিকিৎসক জানাল, এ রোগ সারবে তখনই যখন লোকটি এক সুখী মানুষের জামা পরবে! লোকটা বেরিয়ে পড়ল সুখী মানুষের খোঁজে। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না সুখী মানুষকে। অনেক ঘুরে ঘুরে যা-ও একজনকে পাওয়া গেল, দেখা গেল তার কোনো জামা-ই নেই। লোকটা বুঝতে পারল, তার রোগ সারানোর আর কোনো উপায় নেই। বিফল মনোরথে ফিরছে যখন লোকটা, তখনই তার মনে পড়ল মাশরাফির কথা। মাশরাফির চেয়ে সুখী আর কে আছে পৃথিবীতে! লোকটা মাশরাফির একটা জার্সি জোগাড় করে গায়ে পরে ফেলল। সেদিন থেকে লোকটার হাড় মড়মড় রোগ সেরে গেল। মাশরাফির জার্সি সে এখন শরীর থেকে খোলেই না।
আঙুর ফল টক নয়
এক শিয়াল মিরপুর থেকে ফিরছিল খেলা দেখে। মাশরাফির অনবদ্য পারফরম্যান্স দেখে শিয়ালের এতই ভালো লেগেছিল যে সে তার শেষ পয়সাটা দিয়ে গ্যালারির সবাইকে আইসক্রিম খাইয়েছে। এখন নিজেরই খিদে পেয়েছে। খিদেখিদে পেট নিয়ে বাসার দিকে যেতে না যেতেই শিয়াল দেখল রাস্তার পাশে ভ্যানের ওপর থোকায় থোকায় আঙুর সাজিয়ে রাখা। দেখতে খুবই লোভনীয়। খেতে নিশ্চয়ই আরও ভালো হবে। শিয়ালের জিবে পানি চলে এল। কিন্তু এলে কী হবে, তার কাছে তো কোনো পয়সা নেই! শিয়াল ভাবল দোকানি যেহেতু আশপাশে নেই, তাহলে এই সুযোগ! এক থোকা আঙুর চুরি করে খেয়ে ফেললেই হয়। কিন্তু যেই চুরি করতে যাবে, অমনি তার মনে হলো সে তো মাশরাফির ভক্ত! মাশরাফির মতো একজনের ভক্ত হওয়ার পরও যদি সে চুরি করতে যায়, তাহলে সবচেয়ে বেশি অসম্মান হবে মাশরাফির! শিয়ালটা কিছুক্ষণ ভেবেটেবে বাসায় যাওয়ার পথ ধরল। যেতে যেতে বলল, ‘আঙুর ফল আসলে টক না, কিন্তু টক না হলেই সেগুলো চুরি করার কোনো কারণ নেই!’
আলাদিনের আশ্চর্য মাশরাফি
আলাদিন ছোটবেলাতেই রূপকথার বইয়ে পড়েছিল যে দুনিয়ায় এমন একটা আশ্চর্য প্রদীপ আছে, যার ভেতর থাকে এক দৈত্য। এই দৈত্য মহাশক্তিধর। তার কাছে যা চাওয়া যায় তা-ই পাওয়া যায়। সেই থেকে আলাদিন অন্য সব কাজ বাদ দিয়ে সেই আশ্চর্য প্রদীপের খোঁজে উঠেপড়ে লেগেছে। প্রদীপের সন্ধানে নাওয়া-খাওয়াও ছেড়েছে প্রায়। অন্য কিছু না করার কারণে পড়েছেও ভীষণ বিপদে। ঘরে চুলা জ্বলে না প্রায়ই। মা-বাবাকে নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটছে তার। তবু কোনো কাজের প্রতি তার খেয়াল নেই। তার একটাই কথা, আমার লাগবে আশ্চর্য প্রদীপ! এ রকম একটা সময়ে আলাদিনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল মাশরাফির। আলাদিনের সব কথা শুনে মাশরাফি বলল, ‘আসলে কি জানো আলাদিন, প্রত্যেক মানুষের ভেতরেই আছে একটা আশ্চর্য প্রদীপ! সেই প্রদীপের নাম স্বপ্ন! আর সেই প্রদীপ ঘষা দিলেই বের হবে ইচ্ছা নামের এক মহাশক্তিধর দৈত্য! তাই তুমি সেই ইচ্ছাশক্তি দিয়ে তোমার স্বপ্ন পূরণ করো। বাইরের কোনো আশ্চর্য প্রদীপের তোমার কোনো দরকারই হবে না!’ সেই থেকে আলাদিন মন দিয়ে নিজের কাজ করে। এখন সে অনেক ভালো আছে। বিয়ের এই মৌসুমে সে বিয়েও করতে যাচ্ছে। দু-এক দিনের মধ্যেই সে মাশরাফিকে দাওয়াত দিতে যাবে!

এক যে ছিল দুই


এক যে ছিল দুই। শরীরটা বাঁকানো, কিন্তু মনটা ভীষণ সরল। আর সরল মন হলে যা হয়, দুইয়ের মনে ভীষণ দুঃখ। দুঃখটা হলো সেসব সময় দ্বিতীয় হয়। প্রথম হয় এক। এককে তাই দুইয়ের ভীষণ হিংসা। দুই যদি এক হতো! আহা, কী মজাটাই না হতো! দুই তাহলে সব সময় প্রথম হতো। সবার আগে দুইকে ডাকা হতো।
দুই ভাবল, এটা এখনো হতে পারে। হতে পারে যদি এক না থাকে।
দুই ঠিক করল, এককে বেঁধে সমুদ্রে ফেলে দেবে। আর তাই দুই চলল একের সন্ধানে।
যেতে যেতে যেতে বনের মধ্যে দেখল বিরাট একটা ড্রাগন। ড্রাগনের চোখে আগুন। ড্রাগনের নাম হুতাশন। হুতাশন বলল, ‘শোনো দুই, এককে হারানো খুব কঠিন কাজ! কারণ এক হলো এক! সে সবকিছুতেই এগিয়ে থাকে!’
দুই বলল, ‘তাতে কী? আমিও ফার্স্ট হব! আমি ছড়া বলতে পারি, নামতা গুনতে পারি!’
হুতাশন বলল, ‘এগুলো পারলে তো হবে না শুধু! যুদ্ধও পারতে হবে! একের আছে একচোখা দৈত্যের বিরাট বাহিনী!’
মনটা দমে গেল দুইয়ের। হুতাশন বলল, ‘তবে চিন্তা নেই। আমি তোমাকে আমার ক্ষমতা দিয়ে দিচ্ছি।’ বলেই হুতাশন দুইয়ের চোখে হাত বুলিয়ে দিল। দুইয়ের চোখটা যেন কেমন করে উঠল। হুতাশন মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘এখন চাইলেই তুমি তোমার চোখ দিয়ে আগুন বের করতে পারবে!’
দুইয়ের বিশ্বাস হলো না। কিন্তু একটু কটমট করে তাকাতেই তার চোখ দিয়ে বেরিয়ে এল আগুন। দুইয়ের খুশির সীমা নেই।
এবার দুই চলল এককে ধরতে। কিন্তু কিছু দূর যেতে না যেতেই সে পথ হারিয়ে ফেলল। যাওয়ার কথা পাহাড়ে, গেল সে সমতলে। চারদিকে শুধু নীল নীল গাছ। গাছের মাথায় লাল লাল ফুল। আর সেসব নীলগাছের ভেতর থেকে ছুটে আসতে থাকল একটা বেবুন...না একটা হাতি...না একটা ময়ূর...সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত প্রাণী। দুইকে দেখেই প্রাণীটা জাপটে ধরে বলল, ‘তুই আমার দোস্ত!’
দুই অবাক হয়ে বলল, ‘দোস্ত? কিন্তু আমি তো তোমাকে চিনিই না!’
প্রাণীটা বলল, ‘এখন চিনে নাও। আমার নাম বেহাহাম!’
‘বেহাহাম? এটা আবার কেমন নাম?’
‘খুবই ভালো নাম। বেবুনের বে, হাতির হা, আর ময়ূরের ম মিলিয়ে নাম বেহাম!’
‘কিন্তু আরেকটা হা? সেটা কীসের জন্য?’
সঙ্গে সঙ্গে বেহাহামের চোখ জ্বলে উঠল। নাকের ওপর পড়ল ভাঁজ। দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ‘সেটা এই হায়েনার জন্য!’
এবার বেহাহামের শরীরে হায়েনার চিহ্ন। ঝাঁপিয়ে পড়ল দুইয়ের ওপর। বলল, ‘কত্ত দিন কিচ্ছু খাই না! এবার তোকে আমি খাব দোস্ত!’
দুই ছুটল প্রাণভয়ে। কিন্তু পারল না। তাকে জাপটে ধরে ফেলল বেহাহাম। হাঁ করে যেই না বেহাহাম দুইকে খেতে যাবে, অমনি দুই শক্ত চোখে তাকাল বেহাহামের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এল আগুন। ঝলসে গেল বেহাহামের মুখ। কেঁপে উঠল বেহাহাম। চিৎকার করে বলল, ‘পুড়ে গেলাম পুড়ে গেলাম...মরে গেলাম রে! একবার আমাকে জ্বালিয়ে মেরেছে এক...আর এবার আমাকে পুড়িয়ে মারল দুই!’
একের কথা শুনে দুই তাড়াতাড়ি বেহহামকে বলল, ‘এক কে তুমি চেনো? কোথায় আছে এক?’
বেহাহাম মুখের আগুন নিভিয়ে বলল, ‘জানি। কিন্তু তুমি যদি কথা দাও আমাকে আর পোড়াবে না, তাহলেই শুধু বলব এক কোথায়।’
‘আর পোড়াব না!’
‘অমুক পাহাড়ে তমুক মাথার সমুক গুহায় থাকে এক। ওখানে কেউ যায় না একচোখা দৈত্যগুলোর ভয়ে।’
দুই বলল, ‘আমি যাবই!’
চলল চলল চলল দুই! অনেক অনেক দিন পথ চলল দুই!
তারপর একদিন দেখা মিলল অমুক পাহাড়ের। সেখানে খুঁজতে খুঁজতে তমুক মাথা আর সমুক গুহাও পেয়ে গেল এক। ব্যস, আর কোথায় যায়! দুই ছুটল সেই গুহায়। কিন্তু গুহার কাছে যেতেই দেখল কে যেন চুপচাপ বসে আছে ঝরনার পাশে। কাঁদছে পিঠ ফুলিয়ে। মনটা খারাপ হলো দুইয়ের। বলল, ‘এই যে, তুমি কাঁদছ কেন? মা বকেছে?’
সে মাথা নাড়াল। দুই এগিয়ে গেল। বলল, ‘কে তুমি? কী করো এখানে? কেন কাঁদছ?’
সে বলল, ‘আমি এক। আর আমি খুব একা তো তাই কাঁদছি!’
দুই অবাক। বলল, ‘তুমি এক? তুমি একা?’
‘হুম। সবাই মনে করে সব সময় প্রথম হই বলে আমার বোধ হয় খুব অহংকার! সবাই ভাবে আমার অনেক একচোখা দৈত্য আছে! আসলে কী জানো, আমার ওসব কিচ্ছু নেই। আর আমি চাই সবাই আমার কাছে আসুক, আমার সঙ্গে খেলুক! কিন্তু কেউ আসে না, জানো! আসলে কেউ আমাকে ভালোবাসে না।’
দুইয়ের মনটা একের জন্য খুব খারাপ হলো। এত কষ্টে থাকে এক! এই কষ্টের কাছে তো দুইয়ের কষ্ট কোনো কষ্টই না! দুই এবার একের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আমি দুই! আজ থেকে তুমি আর একা থাকবে না এক...আজ থেকে তোমার বন্ধু হলো দুই!’
এক ভীষণ অবাক হয়ে দুইয়ের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরে ফেলল। বলল, ‘সত্যি আমরা বন্ধু?’ দুই মাথা নাড়াল।
আর এরপর থেকে এক আর দুইয়ের খুব বন্ধুত্ব হয়ে গলে চিরদিনের জন্য।