রবিবার, ১৫ মে, ২০১৬

আব্বুটা


অাঁকা: তুলিঅাঁকা: তুলিআব্বুটা যে কী!
এমন এমন কাজ করে যে আম্মু না রেগে পারে না। আম্মু বলে আব্বুকে, তোমার মতো এমন ভুলোমনের লোক বোধ হয় আর কোথাও নেই!
সত্যিই আব্বুর খুব ভুলোমন। আম্মু হয়তো বলল, শোনো, অফিস থেকে ফেরার সময় ডিম নিয়ে এসো তো!
দেখা গেল আব্বু নিয়ে এল মুরগি। আস্ত মুরগি কক-কক করে বাসা মাথায় তুলল। আর আম্মু গেল মহা খেপে। আব্বু তখন আম্মুকে শান্ত করার জন্য বলবে, আরে শোনোই না...ডিম আনতে বলেছ, মুরগিই তো এনেছি! ডিমে তা দিলে তো মুরগিই হতো! তা ছাড়া মুরগিটা দেখে মেয়েটা যেমন ফিক ফিক করে হাসছে—ডিম আনলে কি তা করত? আমার মেয়ের হাসি আমি সবচেয়ে ভালোবাসি!
বলেই আব্বু আমাকে কোলে তুলে নিয়ে নানা রকম আদর করতে শুরু করবে আর বলবে, গুটুসগাটুস পুটুসপাটুস...কোথায় যায়রে ফুটুসফাটুস!
তখন আমি বলব, চলল ফুটুস মেঘের ঘরে...বৃষ্টি যেথায় নড়েচড়ে...
আমাদের বাপ-বেটির আহ্লাদ দেখে মা-ও তখন হাসে। ডিমের ওমলেটের বদলে রাতে মুরগির ঝোল রান্না হয়। আব্বু খেতে খেতে আম্মুর রান্নার প্রশংসা করে আমার দিকে তাকিয়ে চোখটিপি দেয়। আমিও আব্বুকে চোখটিপি দিতে যাই—কিন্তু আমার একটা চোখ বন্ধ না হয়ে দুটোই বন্ধ হয়ে যায়!
আমি আব্বুর পেছনে লাগি। আমাকেও এক চোখটিপি দেওয়া শেখাতে হবে। আব্বু আমার এক চোখ হাত দিয়ে ধরে রাখে। তারপর অন্য চোখটা টিপি দিতে বলে। কিন্তু আমার দুই চোখই বন্ধ হয়ে যায়। আমার মন খারাপ হলে আব্বু বলে, পারবি পারবি, তুইও পারবি। ইচ্ছাশক্তি থাকলে সব পারবি!
আমি বলি, ‘ইচ্ছাশক্তিতে পাহাড়ে চড়া যায়?’
: ‘হ্যাঁ।’
: ‘ইচ্ছাশক্তিতে আকাশে ওড়া যায়?’
: ‘হ্যাঁ।’
: ‘ইচ্ছাশক্তিতে পানিতে ভাসা যায়?’
: ‘হ্যাঁ।’
আমি আর আব্বু দুজন মিলে আবার চোখটিপি দেওয়া প্র্যাকটিস করতে থাকি।
এর মধ্যেই একদিন নানু এল। কী মজা! নানুর কাছে কত্ত গল্প। নানু আমাকে টিয়ে-হাতি-বাঘের গল্প শোনায়। আমিও নানুকে শোনাই স্পাইডারম্যান আর মিকি মাউসের গল্প। কিন্তু আমরা রাত করি না। কারণ নানুর হার্টের অসুখ। নানুকে তাই নিয়ম করে সবকিছু করতে হয়।
এর মধ্যে একদিন নানুর হার্টের ওষুধ ফুরিয়ে গেল। আম্মু ফোন করে আব্বুকে আনতে বলল ওষুধটা। বারবার মনেও করিয়ে দিল। শেষে এসএমএসেও লিখে পাঠাল। ফেরার সময় অবশ্যই অবশ্যই যেন আব্বু ওষুধটা নিয়ে ফেরে।
সেদিন ফিরতে ফিরতে আব্বুর অনেক রাত হয়ে গেল। সবাই আব্বুর জন্য অপেক্ষা করছি। নানুরও রাতের খাওয়া শেষ। এবার নানু ওষুধ খেয়ে শুয়ে যাবে। আব্বু ফিরল। আম্মু তাড়াতাড়ি বলল, ওষুধ এনেছ?
আব্বু হেসে পকেট থেকে ওষুধ বের করল। আম্মুও হাসল। বলল, আমি ভাবছিলাম তুমি বোধ হয় আজকেও ভুলে যাবে!
কিন্তু খেতে গিয়ে নানু দেখল তিনি যে ওষুধ খান এটা সেই ওষুধ না!
সবার মাথায় হাত। আশপাশের সব দোকান তো বন্ধ হয়ে গেছে। ওষুধটা না খেলে নানুর শরীর খুব খারাপ করবে। এখন কী করা? আম্মু বলল, তুমি কি একটা জিনিসও ঠিক করে আনতে পারো না?
আব্বুর মলিন মুখটা দেখে আমার খুব খারাপ লাগল। আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। আর আব্বু যেমন বলে ইচ্ছাশক্তির কথা ঠিক সেভাবেই ভাবতে থাকলাম। ভাবলাম আব্বু আসলে নানুর ওষুধটা এনেছে। এনে আব্বু ভুলে গেছে। আব্বু যেন নানুর ঠিক ওষুধটা এনে থাকে...সত্যি যেন এনে থাকে!
আমি চোখ খুললাম। দেখলাম আব্বু তার প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পকেট থেকে বেরোচ্ছে একটা ওষুধের পাতা। আব্বু বলল, আরে, এটা কোত্থেকে এল?
আম্মু তাড়াতাড়ি ওষুধটা নানুকে দেখাল। নানু জানাল এটিই তার ওষুধ। আব্বুর বিস্ময় কাটেনি। আম্মু বলল, কোত্থেকে এসেছে বুঝতে পারছ না? ওষুধটা কিনে নিয়ে তুমি নিজেই ভুলে গিয়েছিল! উফ্! তোমার মতো ভুলোমনা লোক আমি আর একটাও দেখিনি!
নানু ততক্ষণে ওষুধটা খেয়ে নিয়েছেন। আম্মুও নিজের কাজে চলে গেল। আব্বু এল আমার সামনে। আমি বললাম, আব্বু দেখো, তোমার কথাই ঠিক! ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সব করা যায়!
আব্বু হাসল। আমি তখন আব্বুর দিকে তাকিয়ে চোখটিপি দিলাম!
আব্বু খুব অবাক হয়ে খেয়াল করল, আমি এখন সত্যি সত্যি এক চোখ টিপি দিতে পারি!
ইচ্ছাশক্তি, আব্বুই তো বলেছে!
প্রথম প্রকাশ- গোল্লাছুট, প্রথম আলো