মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০১৭

একদিন এক ভ্যাটকানো রাস্তায়

অাঁকা: িশখাঅাঁকা: িশখামুসলিম ভাইদের প্রতি সালাম, হিন্দু ভাইদের প্রতি নমস্কার এবং অন্যান্য ধর্মের লোকদের প্রতি আবু মজমাদারের শুভেচ্ছা। আজকে আমি আপনাদের সামনে নিয়া হাজির হইছি আজব এক জিনিস। এই যে আমার কালো ব্যাগ দেখতে পাচ্ছেন ব্রাদার, কী মনে হয়, এর ভিতর কী আছে? কী আছে? জায়গায় দাঁড়ায়া আওয়াজ দেন ভাই, কী মনে হয়, এই ব্যাগের ভিতর আছে কোন সে আজব জিনিস! সাপ নাকি শাপ? ব্যাঙ নাকি ব্যাংক? ভুল করলেন ভাইটি আমার! আকরাব আকরাব! খোল খোল, এই ব্যাগ…খোল! এই যে দেখেন ভাই, ভালো কইরা দেখেন, দেখেন, না, কোনো থলের বিড়াল না এইটা, কোনো রকেট বামও না, দাঁতের মাজনও না এইটা কিন্তু ভাই! কোনো সর্বরোগহারী অব্যর্থ মলমও কিন্তু না! তাইলে কী এইটা? আকরাব! আকরাব!! এইটা হইল ভ্যাট! ভ্যাট!!

এই দাঁড়া…খাড়া এইখানে, কই যাস তুই! এ বড় পিছলা ভাই! খালি হাত থেইকা ফসকায়া যাইতে চায়, আর খালি দৌড়ায় আর বড় বড় লম্ফঝম্ফ দেয়! আমার ওস্তাদ এরে সেই এভারেস্টের গুহার ভিতরে প্রথম আবিষ্কার করছিল! তারপর থেইকা এই ভ্যাট খালি লাফাইতে চায়! ওস্তাদরে বলছিলাম, ওস্তাদ, এই ভ্যাট নিয়া আমরা কী করব? এরে কি অলিম্পিকে পাঠায়ে দিব? এ তো লাফাইতে লাফাইতে বাইড়া যাইতেছে! অলিম্পিকে দীর্ঘ লম্ফে খাড়াইলে নিশ্চয় স্বর্ণপদক পাইব!

ওস্তাদ কী বলছিল, জানেন? ওস্তাদ বলছিল, ওরে নাদান, ওরে আমার পেয়ারের আবু, তুই এখনো এই ভ্যাটরে চিনতে পারস নাই! এরে অলিম্পিকে পাঠানোর দরকার নাই! কী নাই? অলিম্পিকে পাঠানোর দরকার নাই! এরে তুই নিজের কাছেই রাখ। আর বছর বছর সময়মতো তোর কালো ব্যাগ থেইকা বাহির কর! দেখবি, এই ভ্যাট তোর জন্য স্বর্ণপদক না হীরার পদক নিয়া আসবে! হীরার পদক!

তা এই হীরার পদক আনা ভ্যাট দিয়া আপনারা কী করবেন, ভাই? আছে কোনো চিন্তা? এই ভ্যাট কী উপকারে লাগব আপনাদের, ভাবছেন কিছু? ভাবেন নাই। আমি তাইলে কই। বাড়ির গিন্নি-বউ-মা-বোনেরা রান্নায় বেশি তেল দিয়া দিতাছে না? কী, দিতাছে? না দিতাছে না, কন! উত্তর দেন না ক্যান? দিতাছে না? আর সেই বেশি তেল খাইয়া আপনার পেট খারাপ, মন খারাপ, মাথা খারাপ! সারা দিন বস আর পাতিবসদের জি স্যার জি স্যার বলিয়া তেল দেওয়ার পর আর কোনো তেলই আপনার সহ্য হইতেছে না! তেল খাইলেই বদহজম। গ্যাস্ট্রিক আর বদঢেকুর! আর এই সব থেইকা মুক্তির উপায় হইল এই ভ্যাট!

এই ভ্যাট রান্নার ওই তেলের সঙ্গে আমি যুক্ত কইরা দিতাছি! আর দেখেন, তখনই আপনি বাড়িতে বলতে পারবেন তেলের দাম বাইড়া গেছে, তেল খাওয়া নিষেধ! যে কাজ আপনি নিজে এত দিন বইলা করাইতে পারেন নাই, দাম বাইড়া গেছে শুনলেই বাড়িতে তেল খাওয়া দেখবেন অটোমেটিক কইমা গেছে! এখন দরকারি জিনিসের দাম অনেক বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু এই ভ্যাট শুধু কোম্পানির প্রচারের জন্য এইবার মাত্র ১৫ পার্সেন্ট…১৫ পার্সেন্ট…১৫ পার্সেন্ট!
আপনারা যদি আরও মনে করেন এই ভ্যাট আপনাদের কী কাজে লাগবে, তাইলে ব্রাদার, একটু খেয়াল করেন। আপনার প্রতিদিনের জিনিসপত্রের সঙ্গে এই ভ্যাট লাগায়ে দিলেই আপনার প্রয়োজনীয় সব জিনিসের দাম হাতের নাগালের বাইরে চলে যাবে! তখন কী হবে? কী ভাই, উত্তর দেন না কেন? কী হবে তখন? এই দেশে যখন আপনি আর হাতের নাগালে জিনিস পাবেন না, তখন তা কিনতে চলে যাবেন দেশের বাইরে। একই জিনিস দেশের বাইরে থেকে আপনারা কিনে আনবেন অনেক সস্তায়। সপ্তাহে সপ্তাহে তখন আপনাদের বিদেশ ভ্রমণ নিশ্চিত! কী, আপনারা বিদেশ ভ্রমণ করতে চান না, ভাই? চান কি চান না, বলেন? যাঁরা বিদেশে যাইতে চান, জায়গায় খাড়ায়া আওয়াজ দেন খালি। কোম্পানির প্রচারের জন্য এই ভ্যাট এইবার শুধু ১৫ পার্সেন্ট…১৫ পার্সেন্ট…১৫ পার্সেন্ট…
এই যে বছরে এতগুলা উৎসব আর প্রতিটা উৎসবে নতুন নতুন জামাকাপড় কিনার হিড়িক। উৎসব আসা মানেই আপনার পকেট থেইকা টাকা পাখির মতো ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ কইরা উইড়া যাইতেছে। এইটা যদি বন্ধ করতে চান, তাইলে এই ভ্যাট হইল আপনার জীবনের শেষ চিকিৎসা মানে দ্য লাস্ট ট্রিটমেন্ট! এই ভ্যাট লাগানো মাত্রই আপনাদের পোশাকের দাম এক লাফে লম্বা হইয়া যাবে। আর দাম লম্বা হইলেই আপনার পরিবারের মানুষদের বুঝায়ে বলার সুযোগ পাইবেন আপনি। বলবেন, গত বৈশাখের পাঞ্জাবি এই বৈশাখে প্রয়োজনে শার্ট বানায়ে পরো! আপনাকে আর নতুন জিনিস কিনতেই হইব না, ব্রাদার! আকরাব! আকরাব! এক্সট্রা খরচ থেইকা যে এইবার বাঁচতে চায়, সে জায়গায় খাড়ায়া আওয়াজ দেন খালি। কোম্পানির প্রচারের জন্য এই ভ্যাট এইবার শুধু ১৫ পার্সেন্ট…১৫ পার্সেন্ট…১৫ পার্সেন্ট…
ভ্যাট! ভ্যাট!! ভ্যাট!!! আছেন কোনো সহৃদয় ব্যক্তি, আছেন? থাকলে জায়গায় খাড়ায়া আওয়াজ দেন! কোম্পানির প্রচারের জন্য এইবার শুধু ১৫ পার্সেন্ট…১৫ পার্সেন্ট…১৫ পার্সেন্ট!!!

বাঘমামা

বনে আর কোনোভাবেই মন টিকছে না বাঘমামার। কোথাও একটু ঘুরতে গেলে ভালো হতো! শেয়াল এসে বুদ্ধি দিল। বলল, ‘ঘুরতে যখন যাবেন তখন রাজধানীতেই যান...মানে ঢাকায়!’
: ঢাকা? কিন্তু আমি তো কিছুই চিনি না।
: কোনো চিন্তা করবেন না। আমি আপনাকে ট্রেনে উঠিয়ে দেব। পু-ঝিকঝিক করতে করতে আপনি পৌঁছে যাবেন ঢাকায়। ঘুরবেন ফিরবেন খাবেন দাবেন...আরামই আরাম।
সে রাতেই বাঘমামা উঠে গেল ট্রেনে। বসল একটা কামরায়। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বাঘমামা বলল, ‘শোনো, বনটা কিন্তু দেখে রেখো। আমি খুব দ্রুতই চলে আসব।’
শেয়াল বলল, ‘কোনো চিন্তা করবেন না। আমি সব দেখে রাখব।’
পোওওও আওয়াজ তুলে ট্রেনটা চলে গেল। আর শেয়ালটা হাসতে হাসতে পৌঁছাল বনে। চিৎকার করে ডেকে বনের সবাইকে বলল, ‘বনের পশুপাখি গাছপালা সবাই মন দিয়ে শোনো...আজ থেকে আমিই বনের রাজা। আমি যা বলব আজ থেকে তা-ই হবে।’
শেয়াল বনের রাজা হবে শুনে পশুপাখিদের খুব মন খারাপ হলো। বাঘমামার মতো কি আর কেউ বনটাকে আগলে রাখতে পারবে?
ওদিকে বাঘমামা নামল ট্রেন থেকে। গভীর রাত। রাস্তায় শুধু হলুদ হলুদ আলো। কিন্তু বাঘমামার পেটে খুবই খিদে। ছটফটিয়ে বাঘমামা ঢুকল এক হোটেলে। বলল, ‘হালুম, খাবার আছে কোনো?’
হোটেলের লোকজন বাঘমামাকে দেখে যে যার মতো দৌড়ে পালাল। শুধু সবচেয়ে ছোট্ট যে সে বলল, ‘বসেন আরাম করে। এখন শুধু কাচ্চি আছে, খাবেন?’
বাঘমামা বলল, ‘কাচ্চি-মাচ্চি যা পাচ্ছি তা-ই খাব!’
ছোট্ট ছেলেটা এক প্লেট কাচ্চি বিরিয়ানি দিল বাঘমামাকে। বাঘমামা হাপুস-হুপুস করে খেলো। তেল একটু বেশি কিন্তু খুব আরাম পেল খেয়ে। তারপর হেলতে-দুলতে গিয়ে শুয়ে পড়ল রাস্তার মাঝখানে। একটা হাই তুলে, থাবা দিয়ে নাকটা একবার চুলকে ঘুমিয়ে পড়ল সেখানেই।
সকালে বাঘমামার ঘুম ভাঙল চিৎকারে। চোখ মেলেই দেখল অনেক মানুষ তাকে ঘিরে রেখেছে দূর থেকে। তারা বলছে, ‘এটা নিশ্চয় চিড়িয়াখানার বাঘ, পালিয়ে এসেছে!’
একজন বলল, ‘কিন্তু একে ধরব কীভাবে?’
আরেকজন বলল, ‘দূর থেকে ইনজেকশন মেরে বাঘটাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে। তারপরেই ঢুকিয়ে দিতে হবে চিড়িয়াখানার খাঁচায়!’
এসব শুনে তো বাঘমামার মাথা ঘোরার দশা। হালুম বলে লেজ গুটিয়ে সে দিল এক দৌড়। মানুষগুলো ছুটতে শুরু করল তার পেছনে। বাঘমামা আরও জোরে দৌড়াতে শুরু করল—দৌড় দৌড় দৌড়!
দৌড়াতে দৌড়াতে বাঘমামা ঢুকে পড়ল গুনগুনদের বাসাতে। গুনগুন তখন ড্রয়িংরুমে বসে পড়ছিল। বাঘমামা ঢুকেই বলল, ‘আমাকে বাঁচাও। ওরা আমাকে চিড়িয়াখানায় বন্দী করে দেবে।’
গুনগুন একটু ভেবে বলল, ‘শোনো আমি যা বলব তা-ই করবে, ঠিক আছে?’
বাঘমামা মাথা নাড়িয়ে শান্ত স্বরে বলল, ‘ঠিক আছে।’
একটু পরেই লোকগুলো এল ছুটতে ছুটতে। গুনগুনের পাশেই বাঘমামাকে দেখে বলল, ‘অ্যাই মেয়ে, এই বাঘটাকে দাও। আমরা চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাব!’
গুনগুন তখন ফোকলা দাঁতে হেসেই খুন। বলল, ‘কে বাঘ? ওটা তো আমার বিল্লি!’
: কী বলো, ওইটা বাঘ। দেখছ না ওটার গায়ে ডোরাকাটা!
: ওই ডোরা তো আমিই কেটেছি...কেটে বাঘ সাজিয়েছি।
: না না ওটা বাঘ। হালুম-হুলুম বাঘ।
: না না ও তো বিল্লি। ওর নাম মিনি। মিনি ডাকো তো একবার...
বাঘমামা তখন ডেকে উঠল—মিউ মিউ!
লোকগুলো তো ভীষণ অবাক। সত্যিই তো, এমনভাবে তো বেড়ালই ডাকে। বাঘ হলে তো ডাকত হালুম বলে। লোকগুলো চলে গেল। আর তখনই বাঘমামা আর গুনগুনের বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
আর বন্ধু হলে তো বন্ধুর উপকার করতেই হয়। গুনগুন তাই তার বাবাকে বলে বাঘমামাকে বনে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল। ট্রেনে চেপে পরের দিনই বাঘমামা পৌঁছাল বনে। আর বনে গিয়ে দেখল এর মধ্যেই শেয়াল গাছ কাটাচ্ছে, ডাল ভাঙছে, সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে। বাঘমামা রেগে গিয়ে দিল ভীষণ ধমক। যারা গাছের মগডালে বসে ডাল কাটছিল তারা টুপটাপ খসে পড়ল। শেয়াল ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘আপনি এখানে কীভাবে এলেন? আপনাকে ওরা চিড়িয়াখানায় বন্দী করেনি?’
বাঘমামা বলল, ‘না। বুদ্ধিমান ছোট্ট বন্ধু আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তোমাকে এবার কে বাঁচাবে?’
বাঘমামা এক থাবায় উড়িয়ে দিল শেয়ালকে। বনের বাইরে দূরে কোথায় যে শেয়ালটা পড়ল কেউ জানে না। বনের সবাই একসঙ্গে তালি দিয়ে উঠল। বাঘমামা ফিরে এসেছে, বনটা এবার বাঁচবে!
গোলপাতায় লেখা বাঘমামার চিঠি আজকে গুনগুন পেয়েছে। চিঠিতে মামা সবাইকে তাদের দারুণ সুন্দর বনটা ঘুরতে যেতে বলেছে। গুনগুন ঠিক করেছে পরের ছুটিতেই তারা বন ঘুরতে যাবে। আর সঙ্গে নিয়ে যাবে বাঘমামার ঢাকার প্রিয় খাবার কাচ্চি বিরিয়ানি।

বাবা হওয়া সহজ নয়

 পৃথিবীতে হাঁটাবাবা, ছালাবাবা, কানাবাবা, ছানাবাবা, পাগলাবাবার মতো হাজারো বাবা থাকার পরও আমি সেই ছেলেবেলা থেকে শুধু সাধারণ এক বাবা হতে চেয়েছিলাম। এর কারণও আছে। খুব অল্প বয়সেই নিজের বাবাকে দেখে বুঝেছিলাম, বাবা হওয়া মানেই বিরাট স্বাধীনতা। একে তো বাড়ির সবাইকে ধমকেধামকে দৌড়ের ওপর রাখা যায়, তার ওপর খেয়ালখুশিমতো বাড়ি থেকে বের হওয়া থেকে শুরু করে ইচ্ছামতো বাড়িও ফেরা যায়। কারও কিচ্ছু বলার নেই।

তাই ছেলেবেলায় কেউ যখন জানতে চাইত, ‘বলো তো হীরক, বড় হয়ে তুমি কী হবে?’ আমি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-বিজ্ঞানী প্রভৃতি ছকবাঁধা জবাবের ধার দিয়েও যেতাম না। সপাট বলতাম, ‘বড় হয়ে আমি বাবা হব।’

আমার উত্তরে কেউ হাসত, কেউ ধমক দিত। কিন্তু আমি লক্ষ্যচ্যুত হইনি। বাবা হওয়ার দুর্মর বাসনা নিয়েই আমি বেড়ে উঠেছি। তার পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ ছিল ক্লাস নাইনে। এইটের সোমাকে যেদিন প্রথম (এবং শেষ) এবং দীর্ঘ প্রেমপত্রটি লিখলাম সেদিনই, সেই চিঠির শেষ লাইনে লিখেছিলাম, ‘সত্যি বলছি সোমা, আমি আর অন্য কিছু নয়, শুধুই বাবা হতে চাই!’

সোমা আমার চিঠিটা পৌঁছে দিয়েছিল তার বড় বোনের হাতে। বড় বোন মারফত চিঠিটা যেই না সেজ ভাইয়ের হাতে পৌঁছাল, অমনি আমার পিঠে ফুটে উঠল লাল-নীল-বেগুনি দাগ। পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে কলেজজীবনে রুনাকে এই কথা জানালাম একটু অন্যভাবে। আশ্রয় নিলাম কবিতার। লিখলাম, ‘রুনাঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো না কো তুমি, ও তো বড় হাবা/ আমাকে সুযোগ দাও, আমি হবো ভালো এক বাবা!’

রুনার এক বড় ভাই আছে, সেই ভাই যে এসআই তা আমার জানা ছিল না। যখন জানলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। একটা পুরা রাত মা-মশাদের সঙ্গে কাটানোর পর সকালে যখন আমার বাবা আমাকে নিয়ে আসছেন, তখন ভেতরের বাবা হওয়ার আশাটা একেবারেই ম্রিয়মাণ।

কিন্তু বাবাই আবার আমার বাবা হওয়ার খেয়ালটা চাগিয়ে দিলেন। এক অবসরে তিনি আমার বিয়ে দিয়ে দিলেন। বললেন, ‘নে বাবা, এবার বাবা হবি না কাকা হবি তোর ব্যাপার!’

বাবা ছেড়ে দিলে কী হবে, আত্মীয়স্বজন তো ছাড়ে না। দেখা হলেই বলে, ‘কী, কদ্দুর? বাবা কবে হবি?’
আরে, কী মুশকিল! আমি তো ছারপোকা নই যে কিছুক্ষণের মধ্যেই বংশবিস্তার করে ফেলব! সবকিছুর একটা সময় আছে, একটা ক্ষণ আছে। আত্মীয়রা তাকিয়ে থাকে কৌতূহলে। আমি ইনিয়ে-বিনিয়ে বলি, ‘এই তো!’
ওরা বলে, ‘আরে না না, দেরি করিস না একদম। বাবা হওয়া তো সহজ কিছু না। অনেক ঝক্কি। সন্তানকে বড় করতে হবে, তার লালনপালনের দিকে লক্ষ রাখতে হবে, ভালো স্কুলে পড়াতে হবে, সব পরীক্ষায় যেন গোল্ডেন পায়, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে!’
: গোল্ডেন এ প্লাস?
: হ্যাঁ, গোল্ডেন এ প্লাস না পেলে সন্তানকে পড়িয়ে আর লাভ কী? এখন তো সবাই গোল্ডেন এ প্লাস পায়, আর তোর ছেলে পাবে না?
: ছেলে? মেয়েও তো হতে পারে।
: হতে পারে, অসুবিধা কী! ছেলে হোক মেয়ে হোক গোল্ডেন এ প্লাস কিন্তু লাগবেই লাগবে!
: আচ্ছা।
: শুধু আচ্ছা না, ভালোমতো রেডি হ। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতে হবে।
: ইংলিশ মিডিয়ামে?
: না তো কী, বাংলা মিডিয়ামে পড়াবি ছেলেকে?
: মেয়েও তো হতে পারে।
: হোক না, আপত্তি কিসের? কিন্তু ছেলে হোক মেয়ে হোক ইংলিশ মিডিয়াম কিন্তু লাগবেই লাগবে!
: আচ্ছা আচ্ছা।
: আচ্ছা আচ্ছা কী? তোর ইংরেজি খুবই পুওর। এখন থেকেই ইংরেজি পড়া শুরু কর, না হলে তোর বাচ্চার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলতে পারবি না। বাচ্চা তোকে মূর্খ বলবে। সন্তান তোকে মূর্খ বললে শুনতে ভালো লাগবে?
: না।
আমি পরের দিনই ২৭দিনেইংরেজিশিক্ষাবইটা কিনে নিয়ে এলাম। মনে মনে বললাম, ‘বাবা হওয়া দেখছি সহজ বিষয় না!’
আর ওদিকে ২৭ দিনে ইংরেজি শেখার আগেই সুখবরটা চলে এল। ডাক্তার আমার দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললেন, ‘আপনি তো বাবা হতে চলেছেন!’
ডাক্তারের ফিসফিসানি দেখে আমি ভড়কে গেলাম। আমি বাবা হতে চলেছি নাকি আমার ফাঁসি হতে চলেছে? আমি বললাম, ‘জি, এটা তো খুশির খবর।’
ডাক্তার ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘বাবা হতে যাচ্ছেন, এটার মানে জানেন তো? এখন থেকে অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করতে হবে আপনাকে। এটা ফাঁসির চেয়ে কম কী?’
: আচ্ছা।
: আর সব সময় স্ত্রীর টেক কেয়ার করবেন।
: জি, নিশ্চয়ই করব।
: তার খাওয়ার প্রতি নজর রাখবেন!
: জি জি, রাখব।
: আর তার সঙ্গে একদম ঝগড়া করবেন না, বুঝতে পেরেছেন?

সবই ঠিক ছিল, কিন্তু বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া না করে থাকাটা হয়ে পড়ল খুব মুশকিলের। সারা সপ্তাহ অফিস করে সপ্তাহান্তে বউয়ের সঙ্গে একটু ঝগড়াই তো ছিল আমার একমাত্র বিনোদন। এই বিনোদনে ব্যাপক টান পড়ল। বউ আর আমার কথোপকথন হতে থাকল এই রকম-
বউ: তুমি একটা দায়িত্ব–কর্তব্যহীন উজবুক!
আমি: ঠিকই তো। আমারও নিজেকে এমনই মনে হয়।
বউ: তোমার চেয়ে গাধারাও জ্ঞানী।
আমি: আলবত। আমার তুলনায় গাধা হলো জ্ঞানতাপস।
কিছুদিনের মধ্যে বউও প্রতিবাদহীন গোবেচারা আমাকে আর মেনে নিতে পারল না। কেমন ভেজিটেবল মার্কা হয়ে গেল আমাদের কথাবার্তা।
: খেয়েছ?
: হুম।
: ওষুধ খেয়েছ?
: হুম।
: আচ্ছা, ঘুমিয়ে পড়ো।
: আচ্ছা।
এই নিরুত্তেজনার জীবনে সাময়িক উত্তেজনা হিসেবে এল অনাগত সন্তানের নামকরণ।সোনামণিদের১০১টিসুন্দরনাম বইটা নিয়ে দেখা করতে এল কয়েকজন বন্ধুবান্ধব। বউকে দেখলাম সে অনলাইনে নাম খুঁজে চলেছে। আমি বললাম, ছেলে হলে তীব্র, মেয়ে হলে তুলতুল। বউ সপাটে ‘না’ করে দিল। এই নিয়ে অনেক দিন পর একটু ঝগড়াও হলো। মনে একটু প্রশান্তি নিয়ে সে রাতে ঘুমাতে গেলাম।
নির্দিষ্ট দিনে আমি বাবা হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকলাম ওটির সামনে। নাটক-সিনেমায় যেমন দেখেছি তেমন করে পায়চারি করতে লাগলাম। হাত কামড়ানো, পা কামড়ানো অবস্থা। তখন এক বন্ধু এসে বলল, ‘ভয় পাস না, নবজাতকদের স্মৃতি থাকে না। তোকে দেখে নিতান্তই যে উদ্বাস্তুর মতো লাগছে, তা তোর সন্তান কোনোভাবেই মনে রাখতে পারবে না!’
তারপরও হাত দিয়ে মাথার চুলটা যেই ঠিক করতে যাব অমনি দরজা খুলে গেল। নার্স আমার কোলে সদ্যোজাত মেয়েটিকে দিতেই আমি মনে মনে বলতে গেলাম, ‘আমি পাইলাম। আমি ইহাকে পাইলাম।’ কিন্তু তার অাগেই মেয়ে কাঁদতে শুরু করল। আত্মীয়স্বজন ছুটে এল। ‘সর সর, ছাড় ছাড়! কেমন বাবা হয়েছিস? মেয়েটাকে কোলেও নিতে পারছিস না?’
আমি দেখলাম আমার মেয়ে অন্যদের কোলে দিব্যি খুশ হালে আছে। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, বরং শুরু। এরপর যখনই মেয়েকে কোলে নিতে চাই, মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে চোখমুখ কুঁচকে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। আত্মীয়স্বজনের ধমকের মুখে পড়ি। তারা বলে, ‘কেমন বাবা তুই? মেয়েটাকে কাঁদাচ্ছিস কেন? তুই তো দেখছি এখনো বাবাই হতে পারলি না!’
সত্যি, মেয়ে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনো বোধ হয় বাবা হতে পারিনি। কিন্তু আমিও লেগে আছি, হাল ছাড়িনি। বাবার কসম, বাবা আমি হবই!