শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

বসন্ত এসে গেছে

আঁকা: সাদমান মুন্তাসিররাইসা বলল, ‘আমি শাড়ি পরে আসব, তুমি?’
ফাস্টফুডের দোকানে এসি চলছে। এসির আরামে আমার ঘুম চলে আসছে। ঝিমুনির মধ্যেই বললাম, ‘অ্যাঁ?’
: আরে, কী পরবা তুমি?
: কী পরব?
: কালকে পয়লা ফাগুন না! বসন্ত বসন্ত…পরবা না কিছু স্পেশাল?
: হুম।
: কী হুম? একটা পাঞ্জাবি পরবা, বুঝতে পেরেছ?
: আচ্ছা।
: হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পরবা কিন্তু।
: ঠিক আছে।
রাইসা হেসে চলে গেল। কিন্তু বিপদে ফেলে গেল আমাকে। আমার কোনো হলুদ পাঞ্জাবি নেই। রাতুলের আছে। দিলাম রাতুলের মেসে হানা।
: তোর না একটা হলুদ পাঞ্জাবি ছিল?
: কী বলিস, কবে?
: কবে মানে? তোর না এক্স জিএফ গিফট করছিল লাস্ট বসন্তে!
: কে, মিলা?
: হ্যাঁ হ্যাঁ, মিলা। তোর ওই জিএফ হিমুর হেবি ফ্যান ছিল, তোকে একটা পকেট ছাড়া হলুদ পাঞ্জাবি দিছিল না?
: তাই তো দোস্ত! কিন্তু পাঞ্জাবিটা কই? আমি তো এইখানেই রাখছিলাম!
‘এইখানে’ বলতে রাতুল যেটা দেখাল সেটা দেয়াল ধরে কাপড়ের ভারে কোনোমতে দাঁড়িয়ে থাকা আধভাঙা একটা আলনা। তাতে রাজ্যের কাপড় স্তূপ হয়ে কেওক্রাডং হয়ে আছে। আমরা কেওক্রাডং বিজয়ের আশায় তিন ঘণ্টা খাটলাম। তাতে অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস বেরিয়ে এল—দুটি নতুন কিন্তু ধুলামাখা ফুলহাতা শার্ট, তিনটা অব্যবহৃত স্যান্ডো গেঞ্জি আর একটা টাই। টাইটা পেয়ে রাতুল আবেগে অস্থির হয়ে পড়ল। প্রথম চাকরির ইন্টারভিউয়ে যাওয়ার জন্য নাকি রাতুলের এক্সেরও আগের এক্স রুনা টাইটা তাকে গিফট করেছিল। কিন্তু সময়মতো খুঁজে না পাওয়ায় সেটা পরা হয়নি। আর সে কারণেই নাকি রুনার সঙ্গে ব্রেকআপ হয়েছিল। টাইটা হাতে নিয়েই রাতুল ফোন দিল কাউকে। বলল, ‘রুনা, বাবু, আমি না তোমার সেই টাইটা খুঁজে পেয়েছি। চলো না বাবু, কালকে বসন্তে দেখা করি!’
ওদিক থেকে রুনা কী বলল কে জানে, রাতুল ‘ইয়াহু’ বলে লাফ দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘থ্যাঙ্কস বন্ধু, থ্যাঙ্কস! পয়লা ফাগুনে আমাকে আর সিঙ্গেল থাকতে হবে না!’
রাতুলের আনন্দ দেখে খুশি হওয়ার বদলে আমার ভীষণ মেজাজ খারাপ হলো। বললাম, ‘কোথায় কোথায় তুই জামাকাপড় রাখিস, জানিস না? তোর হলুদ পাঞ্জাবিটা না পেলে রাইসার সাথে দেখা করতে যেতে পারব না! বুঝতে পারছিস?’
: দোস্ত, কোনো চিন্তা করিস না! তোর জন্য আমার ভাঙা প্রেম জোড়া লাগতে যাচ্ছে, আর তুই একটা হলুদ পাঞ্জাবির জন্য টেনশনে থাকবি? তোকে আজকেই আমি হলুদ পাঞ্জাবি গিফট করব। চল!
ঢাকা শহরে মানুষ ও মার্কেটের অভাব নেই। হাতের কাছে যে মার্কেট পেলাম তাতেই ঢুকে গেলাম। কিন্তু কোথাও হলুদ পাঞ্জাবি নেই। পরের মার্কেট—হলুদ পাঞ্জাবি—নেই। তার পরেরটাতেও নেই। পাঁচ ঘণ্টা চষে বেরিয়ে আমাদের চেহারা হলুদ হয়ে গেল, কিন্তু হলুদ পাঞ্জাবি আর পাওয়া গেল না। দোকানিদের এককথা, ‘গতকালকেও ছিল, কিন্তু সব শেষ। বসন্ত বলে সবাই হলুদ পাঞ্জাবি ডাবল দামে কিনে নিয়ে গেছে।’
হঠাৎ রাইসা ইনবক্সে নক করল। তাতে হলুদ শাড়ির দুটি ছবি। ও লিখেছে, ‘বলো তো কোনটা পরব?’ আমি লিখলাম, ‘পার্থক্য কী? দুইটাই তো হলুদ!’
: দুইটা হলুদ মানে? দেখতে পাচ্ছ না, একটা রানি হলুদ আরেকটা…
: আরেকটা রাজা হলুদ?
: থাক! তোমাকে আর বলতে হবে না! শোনো, তোমার পাঞ্জাবির ছবি পাঠাও, ওটার সাথে যে শাড়িটা বেশি ম্যাচ করবে সেটা পরব, ঠিক আছে?
আমার মাথার চুল খাড়া হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি লিখলাম, ‘আরে আরে, শোনো না! আমি তো এখনো বাইরে। আর পাঞ্জাবি তো বাসায়। বাসায় গিয়ে পাঠাই?’
: অবশ্যই পাঠাবে কিন্তু। তোমার পাঞ্জাবি দেখে আমার শাড়ি ঠিক করব। তারপর সেই শাড়ি বুঝে ব্লাউজ, টিপ, নেইলপলিশ, স্যান্ডেল, চুড়ি, আইশ্যাডো সব ঠিক করব! বুঝেছ?
আমি রাতুলের দিকে তাকালাম। রাতুল বলল, ‘দোস্ত, আইডিয়া!’
: কী?
: ফটোশপ!
: মানে?
রাতুল গুগলে সার্চ দিয়ে খুঁজে খুঁজে বের করল হলুদ পাঞ্জাবির ছবি। সেই ছবিটা কেটে আমার ঘরের বিছানার ছবির ওপর সেঁটে দিলো। বলল, ‘কী? বোঝা যাচ্ছে কিছু?’
আমি সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা পাঠিয়ে দিলাম রাইসাকে। ওদিক থেকে এল লাভের ইমোটিকন। তারপর নীরবতা। বুঝলাম, রাইসা ঝঁাপিয়ে পড়েছে তার ম্যাচিং নিয়ে। কিন্তু আমার কী হবে? হলুদ পাঞ্জাবি ছাড়া কালকে রাইসাকে মুখ দেখাব কী করে?
এবারও উদ্ধারকর্তা রাতুল। বলল, ‘তোর সাদা পাঞ্জাবি আছে না?’
: আছে।
: ব্যস! তাইলে তো হয়েই গেছে!
: কী?
: চল রং কিনি!
রং কিনে আমরা যখন বাসায় ফিরলাম তখন রাত বারোটার মতো বাজে। ফেসবুকে বসন্ত নিয়ে হাউকাউ শুরু হয়ে গেছে। অথচ আমাদের চলছে রং নিয়ে ভংচং। মেঝেতে সাদা পাঞ্জাবির ওপর করে চলেছি হলুদ রং। সেই রং লাগছে আমাদের শরীরেও। আর রংগুলো উঠছে না দেখে খুব খুশি রাতুল। বলছে খুব পাকা রং, ওঠার কোনো চান্স নাই! বৃষ্টি হলেও নাই!
: বসন্তে বৃষ্টি হবে ক্যান?
: আবহাওয়ার কোনো গ্যারান্টি আছে? ওয়েদার এখন মেন্টাল কেস! দেখ না কী সুন্দর হয়েছে তোর হলুদ পাঞ্জাবি!
আমি তাকিয়ে দেখলাম। আসলেই খুব খারাপ হয়নি। পাঞ্জাবি শুকাতে দিয়ে ঘুমাতে গেলাম। ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখলাম, আমি আর রাইসা দুজনে পয়লা ফাগুনে হাত ধরাধরি করে হাঁটছি। রাইসার পরনে হলুদ পাঞ্জাবি আর আমার পরনে হলুদ শাড়ি। হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি, রাইসার পাঞ্জাবি থেকে গলগল করে রং উঠে যাচ্ছে। রাইসা চিৎকার করে বলছে, ‘ফ্রড! তুমি একটা ফ্রড!’
ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠলাম আমি। ভীষণ মাথাব্যথা। চোখেও মনে হচ্ছে ঝাপসা দেখছি। ব্রাশ করতে গিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে আঁতকে উঠলাম। চোখ আগুনের মতো লাল। আর মুখভর্তি ঘামাচি। এত ঘামাচি কোনোকালে আমার উঠেছিল কি না সন্দেহ! পরক্ষণেই বুঝলাম, এগুলো ঘামাচি না, বসন্ত! গুটিবসন্ত। ওদিকে রাইসার ফোন, ‘হ্যালো, শুভ বসন্ত, হীরক!’
আমি বললাম, ‘শুভ গুটি বসন্ত, রাইসা!’

পুট্টুস নামের কুট্টুসটা

অলংকরণ: তুলি
তার মানে তোমরা বলছ কুট্টুসদের তোমরা চেনো না? দেখোইনি কোনো দিন? আরে বাবা, এই তো সেদিনই আমার সঙ্গে তাদের দেখা হয়ে গেল। আমাকে দেখেই ডাগর ডাগর চোখে তাকিয়ে খিলখিল করে পেট চেপে হাসতে শুরু করল। 
আচ্ছা শোনো, বাড়ি থেকে বেরিয়ে কু-ঝিকঝিক ট্রেনে চেপে তোমরা যদি ঠিক ঠিক যেকোনো একটা দিকে নামতে পারো, আর নেমেই যদি যেতে পারো এক শ বাইশ কিলোমিটার, আর যেতে যেতেই যদি সন্ধ্যা হয়ে আসে, আর সন্ধ্যা হলেই যদি সূর্যটা ডুবতে শুরু করে, আর যেখানে সূর্য ডোবে ডোবে সেখানে যদি উঁচু একটা টিলা মতন থাকে, তখন তুমি শুধু ওই টিলার ওপর দাঁড়িয়ে দেখো-কী হয়!
যেই না ডুববে সূর্যটা, অমনি চলে আসবে কুট্টুসেরা। তোমাদের যে পুতুলগুলো আছে, কুট্টুসেরা তার চেয়ে এই একটু হয়তো বড়। মানুষের মতোই মাথা আর শরীর। মাথার ভেতর চোখ-মুখ সবই আছে, শুধু নাক নেই। কুট্টুসগুলো তাই কোনো কিছুর গন্ধ পায় না।
আর জানো তো কট্টুসগুলোর একটা করে চিকন চিকন লেজও আছে! চিকন, কিন্তু কী যে শক্ত! কুট্টুসগুলো তো কখনো কখনো ওই লেজের ভরেই দৌড়ায়। আবার কখনো কখনো গাছের সঙ্গে লেজটা লেপটে সিলিং ফ্যানের মতো বনবন করে ঘোরে। অনেকক্ষণ ঘোরা হলে ধপ ধপ করে মাটিতে ছিটকে পড়ে আর তখন তারা ঠিকমতো হাঁটতেও পারে না। টলতে টলতে চলতে চলতে ওরা তখন খিলখিল করে হাসে। কুট্টুসগুলো কিছু হলেই হাসে। সারা বছর হাসে!
আচ্ছা, তোমরা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করছ না আমার কথা! ভাবছ আমি কার কাছ থেকে জানলাম এত সব! আরে, পুট্টুসের সঙ্গে যে আমার বন্ধুত্ব। এখন আবার বোলো না যে পুট্টুস কে? পুট্টুস হলো কুট্টুসদের মধ্যে সবচেয়ে দুষ্টু। আমি যেদিন প্রথমবার গেলাম কুট্টুসদের কাছে সেদিনই পুট্টুস লেজের সাহায্যে তিড়িং করে লাফিয়ে বিড়িং করে আমার ঘাড়ে উঠে বসল। বসেই বলল, ‘হ্যাল্লো! আমি হলাম পুট্টুস! তুমি কে?’
আমি যে-ই না আমার নাম বলতে যাব অমনি পুট্টুস বলল, ‘থাক থাক। তোমার আর নাম বলতে হবে না। তুমি গল্প জানো?’
আমি রাগের স্বরে বললাম, না।
পুট্টুস বলল, জানো না? গল্প না জানলে তুমি এখান থেকে যাবে কীভাবে?
: মানে?
: মানে…কুট্টুসদের কাছ থেকে যেতে গেলে তাদের গল্প শোনাতে হবে।
পুট্টুসের সঙ্গে অন্য কুট্টুসগুলো তখন খিলখিল করে হেসে উঠল। আর মুখে বলল, ঠিক ঠিক!
আমি পড়লাম মহাবিপদে। ভাবলাম পুট্টুস তো পিচ্চি, তাকে একটা পুরোনো গল্প শুনিয়ে দিই। শুরু করলাম ডালিমকুমারের গল্প। পুট্টুস বলল, উহহু, এই গল্প তো পুরোনো। নতুন কোনো গল্প বলো…
: একটা ছিল জাদুর চেরাগ…
: ধুর! এটাও পুরোনো। চেরাগের ভেতর থাকে জিন। নতুন কোনো গল্প বলো না…!
: এক ছিল ব্যাঙ আর রাজকন্যা…!
: থামো থামো। কী সব পুরোনো গল্প বলছ তুমি?
: তোমরা তো সব গল্পই জানো। আর তাহলে নতুন গল্প কোথায় পাব?
: যতক্ষণ নতুন গল্প না শোনাতে পারবে, ততক্ষণ কোথাও যেতে পারবে না তুমি! 
ভয়ংকর বিপদ। আমি তো আর তোমাদের মতো না যে ধুমধাম করে গল্প বানিয়ে ফেলব! কিন্তু নতুন গল্প না বলতে পারলে তো এরা যেতেও দেবে না। তাই অনেক চিন্তা করে বললাম, এক দেশে ছিল এক পুট্টুস!
পুট্টুস লেজ নাড়িয়ে বলল, রাজা না রানি না, দৈত্য না ভূত না…এক দেশে ছিল এক পুট্টুস? দারুণ তো। নতুন নতুন মনে হচ্ছে। বলো, তারপরে বলো…
আমি বললাম, পুট্টুসটা ছিল ভীষণ চঞ্চল আর ভারী দুষ্টু!
: ও তাই নাকি? বাহ! দুষ্ট পুট্টুসের গল্প?
: সে শুধু সবার কাছে গল্প শুনতে চাইত!
: তাই নাকি? তারপর?
আমি কু-ঝিকঝিক ট্রেনে চেপে কী করে কুট্টুসদের সঙ্গে দেখা করলাম তা বলতে থাকলাম। কী করে পুট্টুস আমার ঘাড়ে উঠে আমার গল্প শুনতে শুরু করল সেটাও বলতে থাকলাম। পুট্টুস গল্প শুনতে শুনতে বলতে থাকল, বাহ্! দারুণ! দারুণ! খুবই নতুন গল্প! এমন গল্প আগে কখনো শুনিনি।
পুট্টুসকে পুট্টুসের গল্প শুনিয়ে সেদিন আমি বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। আজকে খবর পেলাম পুট্টুস নাকি তাদের সঙ্গী-সাথি নিয়ে বাংলাদেশ ভ্রমণে বেরিয়েছে। সবার বাড়িতে ঢুকে ঢুকে নাকি বলছে, ‘হ্যাল্লো, আমার নাম পুট্টুস। তুমি কি গল্প জানো? নতুন কোনো গল্প?’
আচ্ছা, তোমাদের কাছে নতুন গল্প আছে তো? পুট্টুস তো তোমাদের বাড়িতেও আসতে পারে, তাই না?

আমরা 'ভাগ্যবান' দুর্ভাগা

গল্প ১
মাসুদ রানার হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম
গোপন এক মিশন নিয়ে সেই সকাল থেকে মাসুদ রানা বসে আছে কারওয়ান বাজারে। তার চওড়া কপালে তিন-চারটা ব্রণ, যার একটা এরই মধ্যে পেকেও গেছে। ব্যথা হচ্ছে অল্প অল্প। রানা বুঝতে পারছে না ব্রণটায় খোঁটাখুঁটি করা ঠিক হবে কি না। কারণ, সে এখন রয়েছে বিশেষ একটা অ্যাসাইনমেন্টে।
গত রাতেই জরুরি খবর দিয়ে মতিঝিল অফিসে ডাকা হয়েছিল তাকে। আর গিয়েই চক্ষু চড়কগাছ রানার। রাহাত খানের নাকের নিচে ঝুলছে এক অতিকায় গোঁফ। কাঁচা-পাকা ভ্রুজোড়াও আর নেই, তাতে কলপের কালি। গুনগুন করে গান গাইছেন রাহাত খান, ‘ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে…’।
নিজের চোখ আর কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না রানা। এ কী দেখছে, এ কী শুনছে সে! রাহাত খান একটা ফাইল এগিয়ে দিলেন রানার দিকে। ফাইলের রং লাল। ওপরে বড় বড় করে লেখা, ‘টপ সিক্রেট!’
ফাইলটা খুলতেই রানা দেখল, এক তরুণীর ছবি। অনিন্দ্যসুন্দরী। চোখে-মুখে জাদু। রানা দেখল, রাহাত খানের মুখে লজ্জা মেশানো হাসি! মানে কী এসবের?
রাহাত খান বললেন, ‘নিচে একটা চিঠি আছে। প্রতি সকালে ও কারওয়ান বাজারে সবজি কিনতে আসে। চিঠিটা তাকে পৌঁছে দিতে হবে, বুঝেছ?’
রানা চাকরি বাঁচানোর ভয়ে আর কিছু বলল না। ফাইলটা বন্ধ করে রেখে দিল নিজের কাছে। বেরিয়ে যাচ্ছিল রানা। ডাক দিলেন রাহাত খান, ‘রানা! সাবধান! এ আমার জীবন-মরণের প্রশ্ন!’
: জি, অবশ্যই!
: আর শোনো, কয়েকটা নীল পদ্মও নিয়ে যেয়ো। আজকালকার জেনারেশন তো, আমি এসব ঠিক বুঝেও উঠতে পারি না...বোঝোই তো! তোমরাই ভরসা!
: কোনো চিন্তা করবেন না, স্যার!
রানা এখন কারওয়ান বাজারে অপেক্ষা করছে কপালে ব্রণের ব্যথা আর গোপন মিশনের উৎকণ্ঠা নিয়ে। তার হাত পেছনে লুকানো। কারণ, সে হাতে দুলছে কয়েকটি নীল পদ্ম।
.গল্প ২
আজ মিসির আলীর বিয়ে
কাজী বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ! এবার বর বাবাজি, উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে সালাম দিন।’
মিসির আলী উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে সালাম দিতে গেলেন। কিন্তু দিতে গিয়ে হঠাৎই তীব্র টান অনুভব করলেন পায়ের রগে। হঠাৎই ব্যথা। ব্যথাটা চিড়িক করে একেবারে মাথায় গিয়ে ঠেকল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ধপাস করে পড়ে গেলেন।
মিসির আলী বুঝতে পারলেন, তিনি জ্ঞান হারাচ্ছেন। এ সময় তাঁর নিজের মানসিক অবস্থা নিয়েই ভাবনা আসার কথা, তিনি এখন এক্স ওয়াই জেড সংখ্যা ধরে অমীমাংসিত রহস্যের মীমাংসা করবেন। কিন্তু অত্যন্ত বিচলিতভাবে তিনি খেয়াল করলেন, তাঁর মাথার ভেতর এ সময় অন্য একটা মুখ ভেসে উঠছে। এই মুখ ফারিয়ার। ফারিয়াকে তিনি আজ এই কিছুক্ষণ আগে বিয়ে করেছেন! ফারিয়ার মুখের ওপর দিয়ে মিসির আলীর সব রহস্য, সব অমীমাংসা যেন নিমেষেই হারিয়ে যাচ্ছে। মিসির আলী মনে মনে বললেন, ‘হায় হায়, বউয়ের চেহারা এভাবে সামনে চলে এলে তো আমি কোনো কাজ করতে পারব না!’ তিনি মন ফেরানোর চেষ্টা করলেন। ১০০ থেকে উল্টো গণনা শুরু করলেন। ভালোই আসছিলেন। কিন্তু আটকা পড়লেন পঁচিশে। ফারিয়ার বয়স ২৫। ফারিয়া বলে ‘সুইট টোয়েন্টি ফাইভ’। ‘সুইট’ বলার সময় ফারিয়ার ঠোঁট অদ্ভুত রকমের গোল হয়। তা দেখতে কী যে ভালো লাগে! মিসির আলীর সব হিসাব তালগোল পাকিয়ে গেল। মিসির আলী বললেন, ‘হায় হায়! হায় হায়!’
জ্ঞান হারানো অবস্থাতেই মিসির আলী ফারিয়ার কণ্ঠ শুনতে পেলেন। ফারিয়া তাঁকে ডাকছে, ‘অ্যাই মিসির, মিসির! অ্যাই, ওঠো না...অ্যাই বাবুটা, ওঠো বলছি!’
মিসির আলী কী করবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি জানেন ফারিয়ার এই ডাকে সাড়া দিলে তাঁর জীবনের বাকি রহস্যগুলো চিরকাল অমীমাংসিতই থেকে যাবে। কিন্তু তারপরও এই ডাক উপেক্ষা করার শক্তি তিনি অনুভব করছেন না। ফারিয়া ডেকেই যাচ্ছে, ‘মিসির, অ্যাই মিসির, বাবু আমার, ওঠো...।’
গল্প ৩

বিদায় হিমু
খালু হুংকার দিয়ে বললেন, ‘বিদায় হিমু, বিদায়!’
খালুর হাতে চকচকে ল্যুগার। হিমু একটা ঢোক গিলল। বিপদের সময় বাদলই হোক আর রূপাই হোক, কারও কোনো খবর পাওয়া যায় না। যা করার এখন নিজেকেই করতে হবে। হিমুর পরনে পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির রং মেরুন। মেরুন রঙের পাঞ্জাবিটাতে পাঁচটা পকেট। দুইটা বাইরে আর তিনটা ভেতরে। ভেতরের একটা পকেটে তার প্রিয় ওয়ালথার পিপিকেটা নাক গুঁজে আছে। সেটা একবার বের করতে পারলেই...!
হিমু তার হাতটা পাঞ্জাবির পকেটের ভেতরে নিয়ে যেতেই খালু চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘উঁহু,  চুপ করে ডেরিয়ে থাকো! নড়েছ কি মরেছ!’
‘খাইছে!’ বলে উঠল হিমু। এবার তাহলে কী করা যায়? খালুর হাতটা তিরতির করে কাঁপছে। যেকোনো সময় ঠাস করে গুলি বেরিয়ে যাবে। তাহলে খালুর বাড়ি থেকে এত টাকাপয়সা চুরি করে আর লাভই–বা     কী হবে?
‘না হিমু, আরও কত কত দিন তোমাকে বাঁচতে হবে! কত রকমভাবে ভোগ করতে হবে জীবনটা।’ মনে মনে ভাবে সে। বাবা ডায়েরি ভর্তি যতই উপদেশবাণী লিখে যাক, যতই বলুক, ‘বাবা হিমালয়, পৃথিবীকে তুমি সমান দুই ভাগে বিভক্ত করিতে পারো। এক ভাগ ভোগ আর এক ভাগ যোগ। তুমি এই দুইটির কোনোটিতেই প্রবেশ করিবে না। তোমাকে চলিতে হবে তিন নম্বর পথে...।’
‘হুহ্! তিন নম্বর পথ! আমি ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা নাকি?’
খালু এগিয়ে আসছেন। না, আর অপেক্ষা করা যায় না। হিমু তীব্র বেগে লাফিয়ে পড়ল সামনে। এক লহমায় মেরুন পাঞ্জাবির ভেতর থেকে তার হাতে উঠে এল ওয়ালথার পিপিকে। এবার খালু আর হিমু মুখোমুখি। দুজনের হাতেই শোভা পাচ্ছে দুটি পিস্তল। গুলি ছুটবে যেকোনো সময়...!
পাদটীকা: আমরা সৌভাগ্যবান! আমরা জানি, ওপরের গল্পগুলো ভুল। কিন্তু আমাদের শিশুরা দুর্ভাগা! তারা জানেও না, তাদের পাঠ্যপুস্তকে কোনটা ভুল আর কোনটা ঠিক!

বইমেলায় পুলিশ

রস+আলো রিমান্ডে
রস+আলোর পাঠক, আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, শুরু হয়ে গেছে আমাদের সবার প্রিয় একুশে বইমেলা। আপনারা নিশ্চয়ই এ-ও জানেন যে এবারের বইমেলার বই পুলিশও পড়ে দেখবে। কোথাও কোনো অসংগতি আছে কি না, তা বোঝার জন্য। কিন্তু আপনারা নিশ্চয়ই এটা জানেন না যে বই পড়তে আমাদের পুলিশদের কেমন লাগছে! রস+আলোর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে সেসব অজানা তথ্য। জানাচ্ছেনআহমেদ খান: বইমেলার শুভেচ্ছা। কেমন আছেন?
: খুব প্রেশারে আছি, ভাই।
: বুঝতেই পারছি। জননিরাপত্তামূলক কাজ করেন আপনারা, প্রেশার তো একটু বেশি থাকবেই।
: আরে নাহ্‌! সেসব তো গা-সওয়া হয়ে গেছে। এখন যোগ হইছে নতুন প্রেশার—বই পড়া!
: বই পড়তে ভালো লাগছে না?
: সব বই কি আর পড়া যায়, বলেন? গতকালকে পড়তে হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী অধিবিদ্যার ফলাফল। সাড়ে তিন শ পৃষ্ঠার বই। সব কথা গেল টুপির ওপর দিয়ে! দাঁত যে এখনো মাড়িতে আছে, সেইটা ছোটবেলায় নিমের দাঁতন ব্যবহার করার ফল!
: আর কী পড়েছেন?
বাস্তুতত্ত্ব পড়লাম। বিরাট বিজ্ঞান। ঘরের আসবাবপত্র কীভাবে রাখতে হয়, জানাই ছিল না এদ্দিন। বইয়ের সেই জ্ঞান বাসায় ফলাতে গিয়ে অবশ্য ধরা খাইছি! যেই না বাসার খাট চেঞ্জ করা ধরছি, বউয়ে দিছে কড়া ধমক। বলেছে, আমি নাকি অল্পবিদ্যা ভয়ংকরি, কথায় কথায় পালঙ্ক ধরি!
: আপনি কী বললেন?
: আমি আর কী বলব, একটা বই ধরায়ে দিছি তারও হাতে। বলেছি, আমার হয়ে তুমিই বুক রিভিউ করে দাও এইটার।
: কী বই?
: অক্সফোর্ড ডিকশনারি, এই রকম মোটা। সাত দিন অন্তত চুপ থাকবে! এর মধ্যেই ১১টা বাজে ও উসকানিমূলক শব্দ বাইর করে ফেলছে! এইগুলা নিয়ে টিম মিটিংয়ে বসব অতি দ্রুত।
: তাহলে অক্সফোর্ড ডিকশনারি বাতিল হয়ে যাবে নাকি?
: বলা তো যায় না কিছু। এইটা নির্ভর করতেছে অনেক কিছুর ওপর। অত সহজে তো আমরা ছাইড়া দিতে পারি না।
: তা তো ঠিকই। তা আজকে কিছু পড়ছেন না?
: পড়ব না আবার? এইটাই তো চাকরি! আজ পড়ছি তরুণ কবির কবিতার বই ঘটি নিয়ে লটঘট। নামের মধ্যেই একটা বেয়াড়া রকমের উসকানি আছে। কিন্তু উসকানিটা ঠিক কোথায়, ধরতে পারতেছি না। উসকানিটা ধরতে পারলেই কবিরে ধরব! তার লটঘট তখন চটপট চম্পট দিবে!
: বাহ্‌! আপনি তো দেখছি এর মধ্যেই ছন্দে ছন্দে কথা বলা শুরু করে দিয়েছেন!
: বই খুবই ভয়ংকর জিনিস রে ভাই। খুবই প্রভাবিত কইরা ফেলে! জানেন না আমাদের কমিশনার স্যারের কাহিনি?
: না তো। কী হয়েছে তাঁর?
: স্যারের মাথায় অল্পবিস্তর ছিট দেখা দিয়েছে!
: বলেন কী?
: হুম। এই ছিটের নাম হিমু ছিট। হ‌ুমায়ূন আহমেদ বলে এক রাইটার আছেন, সেই রাইটারের একটা ক্যারেক্টার আছে হিমু। জানেন আপনি?
: জি, জানি।
: কমিশনার স্যার জানতেন না। না জানলেই বোধ হয় ভালো হইতো।
: কেন?
: আমাদের বস এক রাত্রে হিমুর সাত-সাতটা বই পইড়া ফেলছেন। তারপর কাউকে কিছু না বইলা নদীর পাড়ে মাটি খুঁড়ে গর্ত করে সেই গর্তের ভেতর ঢুকে বসে আছেন। শুধু মাথাটা বাইরে। প্রকৃতির সাথে নাকি থাকতে চান। আমি ভাবতেছি, উনি প্রকৃতির সাথে আছেন ভালো কথা, কিন্তু এর মধ্যে যদি প্রকৃতির ডাক আসে, তাইলে তখন কেমনে কী?
: তাই তো! তখন তো ঘটি নিয়ে লটঘট করারও উপায় নাই!
: একদম না। আমরা সবাই মিলে স্যারকে ওঠাতে গেছিলাম মাটি থেকে।
: উঠেছেন?
: না। হিমুর আরও বই চাইতেছেন। ওদিকে আরেকজনও নাকি হিমু অ্যাফেক্টেড হইছে। পুলিশের ইউনিফর্ম পইরা খালি পায়ে নাকি ঘুরতেছে। বলেন, কেমনে কাজ চলবে?
: সত্যিই মুশকিল!
: আরও মুশকিল আছে! ধরেন নজরুল তাঁর সাম্যবাদী কবিতায় লিখছেন, ‘বন্ধু, যা খুশি হও,/ পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা খুশি পুঁথি ও কেতাব বও...’—এই রকম আরও অনেক অনেক লাইন এই দুখু মিয়ার আছে। দুখু মিয়া লেইখা গেছেন আর দুঃখে পড়ছি আমরা!
: কেন, দুঃখ কেন?
: দুঃখ না? ধরেন কাজী নজরুল ইসলামের লেখার ভেতর তো উসকানির শেষ নাই! এখন বলেন, নজরুল ইসলামকেও কি ব্যান করব আমরা? বলেন, সিদ্ধান্ত দেন?
: না না, এইটা তো আপনাদের সিদ্ধান্ত। আপনারা কী বলেন?
: আমরা আর কী বলব? ছোটবেলা থেইকা পড়াশোনা কইরা পুলিশে ভর্তি তো হইছিলাম যেন আর পড়াশোনা করতে না হয়! আর এখন দেখেন, নতুন কইরা আবার পড়াশোনা! কদ্দুর আর ভাল্লাগে কন? একটু পরেই একটা গবেষণাগ্রন্থ পড়তে হবে। নাম শুনবেন? বিলুপ্তপ্রায় পান্ডা ও সবুজ কচি বাঁশ! বলেন, এই বই পড়তে কেমন লাগার কথা?
: ইন্টারেস্টিং হতে পারে। বাঁশ, পান্ডা, গুন্ডা—এগুলো তো আপনাদের জন্য ইন্টারেস্টিং হওয়ার কথা!
: ইন্টারেস্টিং না? দাঁড়ান এইখানে, এই যে নেন বইটা, পড়েন। পইড়া আমারে রিভিউ দেন। এই বইয়ের মধ্যে কোনো উসকানি আছে কি না দেখেন, পড়েন!
: না না, কী বলেন এই সব! শোনেন, আমার কথা শোনেন...
: কোনো শোনাশুনি নাই! দাঁড়ায় দাঁড়ায় চুপচাপ বইটা শেষ করেন!
: ভাই শোনেন, মামা...
: রাখেন আপনারা মামা! এই, কে আছিস, একটা দড়ি নিয়ে আয়! আইজকা রিপোর্টাররে বাইন্ধা এইখানেই বই পড়ামু! আরও ১০টা বই নিয়া আয়। মোটা মোটা বই নিয়া আয়...

পাদটীকা: এরপর কী হয়েছে, তা আর জানার চেষ্টা করবেন না। আমরা সেসব প্রকাশে অক্ষম।

জীবনানন্দ দাশের গরু কেনা

এমন সঙ্কটে জীবন বাবু কখনো পড়েন নি। এই একটু আগে বন্ধু মহসীন এসে তাঁকে ধরেছেন। এবার আর ছাগ নয়, এই ঈদে তারা আস্ত একটা গরুই কুরবানি দেবে। জীবনানন্দ যেন তাকে সাহায্য করে গরু কেনায়। সম্ভব হলে জীবনানন্দ দাশ আকাশ থেকে পড়তেন। সম্ভব হলো না। তিনি বসেছিলেন ভাঙা হাতলের বুড়োমার্কা চেয়ারে। সেখান থেকে শুধু পিছলে গেলেন। ডাগর চোখে মহসিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি গরু কিনব কীভাবে? আমি তো জীবনেও গরু কিনিনি মহসিন! মহসিন বলল, তুই কখনো হাজার বছর বেঁচেছিস?
ftu

জীবন বাবু পিটপিট চোখে এবার তাকালেন। মহসিন বলল, বাঁচিস নি তো? কিন্তু লিখেছিস তো হাজার বছর আমি পথ হাঁটিতেছি...তাহলে? জীবনে যা করিস নি তা যদি লিখতে পারিস তাহলে একটা গরু কিনতে পারবি না! 

জীবন বাবু বললেন, কিন্তু গরু কিনতে আমিই কেন? 
মহসিন বলল, শোন সকলেই যেমন কবি নয়, তেমনি সকলই কিন্তু গরু নয়। তুই যদি কবিকে চিনতে পারিস তাহলে গরুকেও চিনতে পারবি। গরু আর কবিদের মধ্যে পার্থক্য বিশেষ নাই! 
: কী বলিস এসব? 
: ঠিকই তো বলি। গরু যেমন খাওয়ার সময় খেয়ে নেয় হাপুস-হুপুস তারপর সারাদিন বসে ঝিমায় আর জাবর কাটে...কবিরাও তেমনি সারাদিন এটা-ওটা দেখে আর সারা রাত বসে বসে সেগুলো নিয়ে জাবর কাটতে থাকে...আর কাগজ-কলম বা ল্যাপটপ নিয়ে কবিতা লিখে যায়। কবিতা লেখা আর জাবর কাটার মধ্যে পার্থক্যটা কী বল? না না তুইই বল, পার্থক্যটা কী? শোন, গরু উপকারী...কবিও মোটামোটি উপকারী...বিশেষত এদের কবিতার লাইন প্রেম করতে গিয়ে মাঝে মাঝে ভালোই কাজে লাগে। এবার আর কথা না, চল আমার সাথে। আজকে একটা ভালো গরু কিনতেই হবে।

পরের দৃশ্য গরুর হাটে। ধানসিঁড়ি হাট। আর হাটের ভেতর হাজার হাজার মানুষ, নাকি লাখ লাখ? জীবনানন্দ দাশের তব্দা খাওয়ার অবস্থা। এত মানুষ? তিনি একটু নির্জনতা পছন্দ করেন। কিন্তু শুধু তো মানুষ না। মানুষের মধ্যেই সারি সারি গরু। নানান ধরনের গরু। যেন মানুষ আর গরুর এক মহামিলনমেলা। আহা! কিন্তু জীবনানন্দের বড় অস্বস্তি হচ্ছে। এত মানুষের ভিতর বা এত গরুর ভিতর তিনি কী করবেন?

মহসিন তাকে টানতে টানতে প্রথমেই নিয়ে গেল একটা মাটিরঙা গরুর সামনে। গরুটা তাকিয়ে আছে ছলোছলো চোখে। অন্তত জীবনানন্দের তাই মনে হলো। মহসিন কিছু দর-দাম করে ওঠার আগেই চোখের সামনেই গরুটা বিক্রি হয়ে গেল। তাতে গরুটা খুশিই হলো কিনা বলা মুস্কিল। হতেও পারে। এখানে তীব্র রোদ। খাদ্যের অভাব। সব মিলিয়ে গরুটা হয়তো ভাবছে নতুন ঠিকানাই তার জন্য শুভ। টুংটাং করে নিজের গলার ঘণ্টি বাজিয়ে সে যেতে লাগল ক্রেতার সাথে। আহারে, গরুটা জানে না কী পরিণতি তার সামনে। জীবনানন্দ বলে উঠলেন--

গরুঞ্জনা, ওই দিকে যেও নাকো তুমি 
দিও নাকো দড়ি ওই বুড়োটার হাতে; 
ফিরে এসো গরুঞ্জনা 
লোক-জঞ্জাল ভরা এই ধানসিঁড়ি মাঠে...

গরুটি হাম্বা করে দুইবার ডেকে জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলে গেল। মহসিনের মুখে আফসোস। বলল, ভালো গরু ছিল। মিস হয়ে গেল! চল, চল ওই গরুটাকে দেখি...দেখেছিস তার লেজ কী সুন্দর... 

কিন্তু সৌন্দর্যের চেয়ে বরং জীবনানন্দ দাশ তাকে দেখল দুখী হিসেবে। কেমন মায়া মায়া চেহারা। মাথা এক দিকে করে জাবর কেটে চলেছে বিষাদগ্রস্থ চোখে। আহা! জীবনানন্দের বুকটা ডুকরে উঠল। 

হয়তো তার গাভিটি শুয়ে ছিল পাশে-- বাছুরটিও ছিলো
ঘাস ছিলো, হাম্বা ছিলো--জঙ্গলে--তবু সে দেখিল 
কোন কসাই? জাবর কাটা হলো না তার 
অথবা জাবর কাটে নাই বহুকাল-- ধানসিঁড়ি হাটে শুয়ে জাবর কাটিছে এবার।

মহসিন গরুর দাম জিজ্ঞেস করতেই কয়েক লক্ষের অঙ্ক জীবনানন্দের কানের পাশ দিয়ে সাঁই করে বেরিয়ে গেল। একটা গরুর দাম ২৫ লাখ? বাপরে বাপ! এতো মানুষের চেয়ে ঢের বেশি দামী। ভুল লিখেছেন ভুল লিখেছেন তিনি। নিজেকে দুষতে শুরু করলেন। তাঁকে লিখতে হতো-- 

আমি যদি হতেম বুনোগরু 
বুনোগাভী হতে যদি তুমি 
লক্ষ টাকা দাম হয়ে চড়িতাম ধানসিঁড়ি তৃণভূমি!

দাম শুনে মহসিনেরও অবস্থা খারাপ। ভিড়ের মধ্যে জীবনানন্দকে টেনে প্রায় পালিয়ে আরেক পাশে চলে আসে সে। এখানে কিছু গরু আছে। আকৃতিতে ছোট ছোট। প্রকৃতিতে নরম। তবে একটা গরুর দশা ভিন্ন। সে তার খুঁটি ধরে একা একা ঘুরে চলেছে। আর কিছুক্ষণ পরপর হাম্বা হাম্বা ডেকে চলেছে। জীবনানন্দ দাশ বলে উঠলেন-- 

হায় গরু, সোনালী কানের গরু, এই খটখটে খড়ের দুপুরে 
তুমি আর কেঁদো নাকো বাঁকাত্যাড়া খুটিটিকে ঘুরে ঘুরে।

গরু জীবনানন্দ দাশের কথা আমলে নিলো। ঘোরা বন্ধ করে দুইবার কান ঝেড়ে গোবর ঢালা শুরু করল। তাতে বাতাস কিছুটা ভারী হয়ে আসল বটে। আর তখনই আওয়াজ উঠল হাটজুড়ে, পালাও পালাও! কাহিনি বুঝতে মহসিন ছুটন্ত একজনকে ধরে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? কী হয়েছে ভাই? লোকটি বিস্ফোরিত চোখে বলল, হাটের সবচেয়ে ষণ্ডা ষাঁড়টা খুঁটি উপড়ে ছুটে গেছে। এখন যাকে পারছে তাকেই শিং দিয়ে গুঁতিয়ে পেছনের হাড়হাড্ডি ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলছে...জানে বাঁচতে চাইলে পালাও...

সঙ্গে সঙ্গে গগনবিদারী হাম্বা রব এলো। আরও একদল লোক স্যান্ডেল ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে লুঙ্গি ফেলে দৌড় দিল। অনেক ধুলো আর বাতাসের ভেতর একটা ষাঁড়ের নিঃশ্বাসের প্রায় গরম বাতাস অনুভব করলেন জীবনানন্দ দাশ। দৌড় দিলেন তিনি। দৌড়াতেই থাকলেন। আর যতবার পেছন ফিরে তাকালেন দেখলেন একটা ষাঁড় তার পেছনে তেড়ে আসছে। জীবনানন্দ দাশের পরনের লাল ফতুয়া ষাঁড়টার হয়তো মনে ধরেছে।

সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। আর কবিরা যখন হাঁটে তখনো কবি। যখন ঘুমায় তখনো কবি। আর যখন প্রাণভয়ে দৌড়ায় তখনও তো কবি। তাই দৌড়াতে দৌড়াতে জীবনানন্দ দাশ বলে উঠলেন--

হাজার বছর ধরে দৌড়াইতেছি আমি ধানসিঁড়ি মাঠে 
খড়-বিচালি, কচি ঘাস থেকে থকথকে গোবর সাগরে 
অনেক ছুটেছি আমি; ধুলো ওড়া বালিময় ধূসর তল্লাটে 
এখন রয়েছি আমি; আরো দূর না গেলে যাবো বুঝি মরে

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিক হৈ-হল্লায় যেন নরক গুলজার
আমারে তাড়া করিয়াছে কোথাকার কোন এক ষণ্ডামার্কা ষাঁড়॥

জনৈক পুলিশের বুক রিভিউ


book-stall-620

বইয়ের নাম : কবি 
লেখক : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়প্রকাশক : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র  
রেটিং : ২/১০

প্রথমেই বলে রাখা ভালো লেখক বইয়ের নাম দেওয়ায় একটা বিরাট কেস খাইছে! বইয়ে নিতাই নামের নায়ক সেই ব্যাটা মোটেও কবি না। সে আসরে আসরে গান গাইয়া বেড়ায়। আর গান বাঁধে। কবির কাম সেইটা না। কবি আমি নিজ চক্ষে দেখছি। আমাদের থানার পাশেই এক কবির বাস। সে ব্যাটা সারাদিন দাড়ি চুলকায় আর মোবাইল গুঁতায়। 

নিতাইয়ের দাড়িও নাই মোবাইলও নাই। তাছাড়া নিতাইয়ের ভেতর নীতিবোধও নাই। সে কোন গানের আসর থেইকা ফিরে আইসা নিজের উত্তরীয় না ফুত্তরীয় দেখায়া বলে এইটা তারে নাকি প্রাইজ দিছে। চোরের মায়ের এমন বড় গলা তার। কিন্তু এই উত্তরীয় জিনিসটা কী আমি বুঝতে পারি নাই। তখন এসআই মিজানকে জিজ্ঞেস করলে উনি বলেন যে, উত্তরীয় হইল উত্তরার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির এক ধরনের গেঞ্জি। 

এসআই মিজানের এই সব জ্ঞান খুবই ভালো। অনেক কবিতাও তিনি লিখছেন। পুলিশদের ঠোলা বলে যে গালি দেওয়া হয় সেটার বিরুদ্ধে তার একটা খুবই হট কবিতা আছে। শুনলে গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যায়। 

যাই হোক, কবি বইয়ের নিতাই  খুবই মিনমিনা একটা নায়ক। নায়ক হিসাবে কলঙ্ক আসলে। এইটা একটা আফসোস যে নায়ক জসিমের পর আর কোনো নায়ক আসলো না এই বাংলায়। না সিনেমায় না এইসব গল্প উপন্যাসে। তারাশঙ্কর যদি নায়ক জসিমকে নিয়া একটা পাওয়াফুল বই লিখতো কতই না ভালো হইত। আফসোস আর আফসোস!  

এই নিতাই যে শুধু মিনমিনা তাই না, এর চরিত্রেরও দোষ আছে। বসন্ত না কী এক নাম তার সাথে লটঘট আবার ঠাকুরঝি না কি তার দিকেও হালার পুতের নজর। জসিমরে আমি কোনো দিন এক সিনেমায় দুইটা নায়িকার সাথে প্রেম করতে দেখি নাই। আমার মনে হয় বইটা থেইকা একটা নায়িকারে বাদ দেয়া যাইতে পারে। তাতে সমাজে একের অধিক প্রেম করাটাকে প্রোমোট করা হয় না। 

তাছাড়া বইটার নামও চেঞ্জ করা উচিত। 'কবি' না রাইখা 'ভণ্ড কবিয়াল' বা 'কবিয়াল ভণ্ড' রাখা যাইতে পারে। তাছাড়া এই নতুন লেখক তারাশঙ্করকে ডেকে লেখালেখির ব্যাপারটা আরেকটু বোঝানো যাইতে পারে। গোটা বইয়ে সে লিখছে--'হায়, জীবন এত ছোট কেনে...জীবন এত ছোট কেনে...!" দশটা দিন জুতমতো রিমান্ডে নিলে হালার পুতে বুঝবে জীবন আসলে ছোট না। তখন কুতকুত করতে করতে বলবে, 'হায় জীবন এত বড় কেনে...জীবন এত বড় কেনে...!'