বুধবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৬

নতুন বছরের প্ল্যান

.ঘুম ভাঙল বউয়ের চিত্কারে। দুই বছর আগে হলেও এই চিত্কারে আমি ধড়ফড় করে উঠতাম; ভাবতাম, মেজর কোনো সমস্যা। এখন জানি, এই চিত্কার আমার বউ আরশোলা দেখেও যেমন দিতে পারে, তেমনি ফেসবুকে পুরোনো কোনো বান্ধবীর ছবি দেখেও দিতে পারে। আমি ঘুমের মধ্যেই বললাম, ‘কী হইছে?’
: কী হইছে মানে! নতুন বছর চলে আসছে না?
: তোমার পায়ে পাড়া দিয়ে আসছে নাকি? সকাল সকাল এত চিত্কার ক্যান?
: তুমি বুঝবা না, উজবুক! নিউ ইয়ার নিয়ে আমি প্ল্যান করেছি।
আমার ঘুম ছুটে গেল। গত ঈদে শপিং নিয়ে আমার বউ প্ল্যান করেছিল। এত কাপড়চোপড় কিনেছিল, এত কাপড়চোপড় কিনেছিল যে সেগুলো টেনে নিয়ে আসতে আমার পিঠ বাঁকা হয়ে গিয়েছিল। পরে ডাক্তার বলেছিলেন, ‘শপিং ব্যাকপেইনের জন্য ক্ষতিকর।’
আমি আমার বউকে অবশ্য বোঝাতে পারিনি। শপিংয়ে আমার পিঠ গেছে, নতুন বছরে এবার কী যায়, কে জানে?
: শোনো, আমার প্ল্যান খুব সিম্পল!
: আচ্ছা!
: থার্টি ফার্স্টের আগেই আমরা থাইল্যান্ড চলে যাব, কী বলো?
: কীভাবে যাবে, হেঁটে না সাঁতরে?
: কেন? যেভাবে সবাই যায়, সেভাবে যাব...প্লেনে!
: কিন্তু তার জন্য তো ভিসা-পাসপোর্টের দরকার আছে, নাকি?
: আমার তো পাসপোর্ট আছেই!
হঠাৎ বউয়ের কী যেন মনে পড়ল। আবারও সে চিত্কার দিয়ে উঠল, ‘তোমাকে বলেছিলাম পাসপোর্টটা করিয়ে নিতে; এখনো করাওনি? তুমি কি আমার কোনো কথা শুনবে না? সারা জীবন আমাকে জ্বালিয়েই যাবে, জ্বালিয়েই যাবে?’
: ইয়ে, আসলে করাব করাব করে...আসলে সময়...মানে...
: উফ্! তুমি আমার সমস্ত প্ল্যানে পানি ঢেলে দিলে!
আমার বউয়ের চোখে পানি চলে আসার উপক্রম। অন্য যে কারও চোখের পানিতে মানুষের কষ্ট হয়, কিন্তু বউয়ের চোখের পানিতে স্বামীর ভেতর একধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়। তার তখন মৌলিক সব চাহিদাতেই টান পড়ে। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ‘থাইল্যান্ড না হলে চলো কক্সবাজার যাই!’
: কক্সবাজার তো একবার গিয়েছিই!
: ভালো লাগেনি?
: ভালো তো লেগেছে কিন্তু...
: আরে ভালো লাগা সিনেমা আমরা বারবার দেখি না? চলো, আবার কক্সবাজার যাই!
: ঠিক আছে। কিন্তু প্ল্যান আমি করব।
আমি আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এবার আমার ব্যাকপেইনটা হয়তো পারমান্যান্ট হয়ে যাবে। বিকেলবেলা একটা লম্বা তালিকা ধরিয়ে দিল বউ। তাতে কয়টার সময় কোথায় গিয়ে বাস ধরব, কোথায় নামব, কোথায় খাব, কোথায় ঘুমাব, কোন এলাকায় কতক্ষণ থাকব—সব বিস্তারিত উল্লেখ আছে। আমার মনে হলো আমি কোনো একটা ট্রেনিংয়ের মধ্যে পড়ে গেছি। মনে অনেক কথা গুঞ্জরিত হলেও বউয়ের চোখ আবার ছলছল হয়ে উঠতে পারে ভেবে বুকে পাথর বাঁধলাম।
থার্টি ফার্স্ট নাইটে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে বিরাট বিরাট তিনটা ব্যাগ। কক্সবাজার বেড়াতে যাচ্ছি না পারমান্যান্টলি থাকতে যাচ্ছি, বুঝতে পারছি না। অটোরিকশায় চেপে বড় রাস্তা দিয়ে যেতে কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ আমাদের দাঁড় করাল।
: কোথায় যান?
: কক্সবাজার। ছুটি কাটাতে।
: ব্যাগে কী?
: জামাকাপড়।
: এত বড় বড় ব্যাগে জামাকাপড়? সত্যি করে বলেন, কী আছে ব্যাগে।
: সত্যিই, জামাকাপড়!
: নেমে আসুন। দেখি, ব্যাগগুলা দেখি...
দুই নম্বর ব্যাগে বঁটি পাওয়া গেল। আমি অত্যন্ত অবাক হয়ে তাকালাম বউয়ের দিকে। বউ বলল, ‘আমি প্ল্যান করছিলাম যে কক্সবাজারে পিকনিক করব! নিজেরা রান্না করব, তাই...’
তিন নম্বর ব্যাগে একটা বেশ বড়সড় ছুরি পাওয়া গেল। বউ যতই ছুরিটাকে নির্দোষ পেঁয়াজ কতলকারী বলুক না কেন, পুলিশরা তা মেনে নিল না। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার—এক নম্বর ব্যাগে বাসের টিকিট পাওয়া গেল না! বউ তার প্ল্যান মোতাবেক বাসের টিকিট কোথায় রেখেছে, তা মনে করতে পারল না। পুলিশ বলল, ‘থানায় চলুন!’
আমি বললাম, ‘স্যার, আসলে আমরা অপরাধী না...’
পুলিশ আমার দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে বলল, ‘এখন গভীর রাত। আপনারা যদি অপরাধী না হন, তবুও তো আপনাদের ছাড়া ঠিক হবে না! আর আপনারা যদি অপরাধী হন, তাহলে আপনাদের কেন ছাড়ব?’
এ রকম গভীর তাত্পর্যপূর্ণ কথা শোনার পর রাতটা আমরা থানাতেই কাটালাম এবং আমার মনে হলো আমার ব্যাকপেইনটা আবার ফিরে আসছে। বউকে বললাম, ‘এটা নিশ্চয়ই আমাদের প্ল্যানের অংশ ছিল না?’
বউয়ের চোখ ছলছল করে উঠলে আতঙ্কিত আমি প্রসঙ্গ পাল্টে আবার প্ল্যান করতে বসলাম। প্ল্যানটা ছিল এ রকম—থানার এ রকম শক্ত চেয়ারে বসে কী করে ঘুমানো যায়!

রস+আলোতে প্রকাশ-
http://www.prothom-alo.com/roshalo/article/724135/%E0%A6%A8%E0%A6%A4%E0%A7%81%E0%A6%A8-%E0%A6%AC%E0%A6%9B%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%A8

প্রেমিকাদের বিয়ে


আঁকা: আসিফ
অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্য যে আমি প্রথম প্রেমে পড়ি ক্লাস সিক্সে; পাশের বাড়ির টুনা আপার। টুনা আপা খিলখিল করে হাসে আর আমার মাথা ঝিমঝিম করে। কিন্তু এটা যে প্রেম তা বুঝে ওঠার আগেই ঠাস করে টুনা আপার বিয়ে হয়ে গেল! তার গায়েহলুদে আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলাম আর বিয়েতে গিয়ে খাসির রেজালা দিয়ে ধুমসে পোলাও খেলাম।
দ্বিতীয়বারের ঘটনা ক্লাস নাইনে। এইটের সোমাকে দেখলাম এবং দেখেই আমার ভেতরে কে যেন গেয়ে উঠল—কোথা হতে আনলে গো এমন রূপের বন্যা!
সোমার বৃত্তি পরীক্ষার কোচিং ক্লাস। আমি ঘুম থেকে উঠে রাস্তার পাশে দাঁড়াই। সোমা ছাতা মাথায় আসে। আমি তার ছাতার তলায় ঢুকে যাই। একদিন তার ছাতা ধরতে গিয়ে হাত ছুঁয়ে ফেললাম। পরবর্তী তিন দিন সেই সুখে ঘুমালাম না পর্যন্ত। নিজের হাত নিজেই ধরে বসে থাকি। বন্ধুরা জোর করে সেই হাত সাবান-পানি দিয়ে ধুয়ে দিলে আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারলাম! তিন মাসের মাথায় সেই সোমার বিয়ে হয়ে গেল!
সোমার বাবার সঙ্গে আমার সরাসরি কথা বলার উপায় ছিল না। তাই একটা চিঠি লিখলাম তাঁকে। চিঠিটা ছিল এ রকম—
শ্রদ্ধেয় আঙ্কেল,
সালাম নেবেন। আপনি কি জানেন ১৮ বছর বয়সের নিচে কোনো মেয়ের বিয়ে দিতে হয় না! শুনেছি, সোমার বিয়ে। সোমার বয়স কত? বাল্যবিবাহ আইনে তো আপনাকে জেলের ভাত খেতে হবে!
আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী
বিয়ের এক বছর পর সোমার সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল। তার কোলে তখন ফুটফুটে একটা মেয়ে। সোমা বলেছিল, যেদিন ওর বিয়ে হয়ে যায়, সেদিনই চিঠিটা ওর বাবা নাকি পেয়েছিলেন। বাল্যবিবাহ ও জেলের ভাত খুব স্ট্রাইকও করেছিল বাবার মাথায়। কিন্তু বিয়েটা তো হয়েই গিয়েছিল...চিঠিটা যদি আর একটু আগে আসত...!
এই আফসোস নিয়েই কলেজে উঠেছিলাম আর প্রেমে পড়েছিলাম তানিয়ার। ছিপছিপে গড়নের হরিণ চোখের মেয়ে। তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেই কেটে গিয়েছিল একটা বছর। প্রেম নিবেদনের যখন উপযুক্ত সময় এল, তিনটা বই আর এক প্যাকেট চকলেট নিয়ে সেদিন কলেজে গেলাম। কলেজ সরগরম। চারদিকে উত্তেজনা! ছাত্রনেতা রবুর সঙ্গে নাকি তানিয়া পালিয়ে গেছে! রবুর মতো ষন্ডার ভেতর তানিয়া কী পেল, ভাবতে ভাবতেই এক শ বছরের নিঃসঙ্গতায় কাটল আমার কলেজজীবন।
বন্ধুরা তখন এক অদ্ভুত তত্ত্ব দেওয়া শুরু করল। আমি নাকি সেই প্রাণী, যার সঙ্গে যে কারও প্রেম হলেই তার নাকি বিয়ে হয়ে যায়! প্রেমিকার বিয়ে দিতে আমি নাকি এক্সপার্ট!
বন্ধুদের নিষ্ঠুরতায় আমার মনে তীব্র জেদের সঞ্চার হয়, প্রেম আমাকে করতেই হবে! এবং তারচেয়েও বড় কথা, প্রেমিকাকেই বিয়ে করতে হবে! বন্ধুরা যা বলে তা ভুল প্রমাণ করে ছাড়ব! এই তীব্র জেদের ভেতর এল মিলা। কিন্তু দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে, তার বিয়ে আগে থেকেই ঠিক হয়ে ছিল। শুধু ডেট ফিক্সড হয়নি। মিলা এল, আমি প্রেমে পড়লাম এবং মিলার বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়ে গেল। মিলার সঙ্গে তিন দিনের প্রেম ভেঙে খানখান হয়ে গেল। ভাঙা মন নিয়ে ভাবলাম, বন্ধুরা যা বলে তা-ই বোধ হয় ঠিক! আমি যাকে ভালোবাসি তারই নিশ্চয়ই বিয়ে হয়ে যায়!
মন খারাপের এই কালে এগিয়ে এল বন্ধুরাই। আমার এক বন্ধুর কাজিন, নাম ফারিয়া, তার বিয়ে হচ্ছে না। দেখতে খারাপ, পড়ালেখায় খারাপ ইত্যাদি কিছুই না। কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে ফারিয়ার বিয়ে হচ্ছে না। বন্ধু আমার হাত ধরল। বলল, ‘এখন তুই-ই যদি কিছু করতে পারিস!’
: আমি এখানে কী করব?
: তুই যদি ফারিয়াকে ভালোবাসিস তাহলে ওর নিশ্চয়ই বিয়ে হয়ে যাবে!
: কী বলিস এই সব?
: চেষ্টা করে দেখ না বন্ধু! দোহাই লাগে!
ফারিয়াকে নিয়ে এক সপ্তাহ ঘুরলাম। টিএসসি, শাহবাগ, সিনেপ্লেক্স। ফুচকা-কফি-বিরিয়ানি। অষ্টম দিনে ভাগ্যের শিকে ছিঁড়ল। ফারিয়ার জন্য সম্বন্ধ এল সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে। আমি ‘আই লাভ ইউ’ বলার পনেরো দিনের মাথায় ফারিয়ার বিয়ে হয়ে গেল। ফেসবুকে এখনো তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। সে লিখে পাঠায়, ‘ভাইয়া, তুমি না থাকলে যে আমার কী হতো!’ আমি বুকে পাথর চাপা দিয়ে একটা স্মাইলি পাঠিয়ে কনভারসেশন শেষ করি!
এর মধ্যে হুট করেই ডেকে পাঠালেন ছোট চাচি।
: শোন, তোর নামে যা শুনলাম তা কি সত্যি? তোর প্রেমিকা হলেই নাকি মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়?
: জি। কথা সত্যি!
: আউটস্ট্যান্ডিং!
: এখানে আউটস্ট্যান্ডিংয়ের কী আছে? এটা তো খুবই কষ্টের ব্যাপার!
: কষ্টের কোথায় গাধা? এ ক্ষমতা তো সবার থাকে না! তোর আছে। তুই তো হিরো, ট্র্যাজিক হিরো! ইতিহাসে তোর নাম লেখা থাকবে!
: ইতিহাসে নাম থাকার দরকার নেই। একটা প্রেমিকাকেও বিয়ে করতে পারলাম না, আর ইতিহাস!
: রোমিও পেরেছিল? মজনু পেরেছিল? তুই হলি আমাদের আধুনিক রোমিও, মজনু!
: আমি এসব হতে চাই না! আমি প্রেম করে একটা বিয়ে করতে চাই!
: চুপ থাক, গাধা। শোন, আমার এক বান্ধবীর মেয়ে, নাম ঝর্ণা, তাকে একবার ‘আই লাভ ইউ বলে’ আয় তো!
: মানে কী চাচি?
: আরে, বলে আয় না! আমার বান্ধবী একটা সুপাত্র খুঁজছে! তোর কোনো প্রেমিকার খারাপ কোনো বিয়ে হয়েছে, অ্যাঁ? যা, ঝরনাকে ‘আই লাভ ইউ’ বলে আয়! তাহলে মেয়েটার নিশ্চয়ই ভালো কোনো জায়গায় বিয়ে হয়ে যাবে!
: চাচি, এই সব কী বলেন আপনি?
: যা বলছি তাই কর। ফটর ফটর করে কথা বলিস না!
গেলাম চাচির বান্ধবীর বাসায়। পেলাম জামাই–আদর। ঝর্ণা এল, সঙ্গে এল তূর্ণা! দুজনেই রূপসী। কিন্তু তূর্ণা যেন একটু বেশি সুন্দর। আমি ঝর্ণাকে ‘আই লাভ ইউ’ বললাম, কিন্তু মনে মনে ভালোবেসে ফেললাম তূর্ণাকে। ঝর্ণাকে নিয়ে ফুচকা খাই, কিন্তু তূর্ণার জন্য মনটা পোড়ে। শেষ পর্যন্ত তূর্ণার ফেসবুকে লিখেই দিলাম, ‘তূর্ণা, আই লাভ ইউ! আমি ঝর্ণাকে না, আসলে তোমাকে ভালোবাসি!’
পরের ঘটনাটা অত্যন্ত হতাশার। আর দুর্ভাগ্যের। আর বেদনার। আর কষ্টের। তূর্ণা আজ কাজি অফিস থেকে তার প্রাইভেট টিউটরকে বিয়ে করে ফিরেছে। অনেক নাটকের পর তূর্ণার বাসায় তাদের মেনেও নিয়েছে। ওদিকে ঝর্ণা আমাকে এসএমএস করেছে। অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে লিখেছে, ‘আর একটা মাস পর তূর্ণাকে ভালোবাসলে কী খুব ক্ষতি হয়ে যেত, হীরক?’
বেদনাহত আমি এর উত্তরে কী লিখব! প্রেমিকার বিয়ে দিতে দিতে হৃদয় এখন চীনের প্রাচীরের মতো শক্ত হয়ে গেছে। তবু ঝর্ণার এসএমএসে বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। এই মোচড়ের উৎস কোথায়? তাহলে কি আমি ঝর্ণাকেও ভালোবাসি?
ভাবছি, আর প্রেম নয়, এবার একেবারে বিয়েই করে ফেলব। আচ্ছা, বউ হিসেবে ঝর্ণা কি খুব খারাপ হবে?
 
রস+আলোয় প্রকাশিত-
http://m.prothom-alo.com/roshalo/article/736726/%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A7%87

মেয়র কেন আসামী

  
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ সারা বাংলাদেশে একযোগে চলিতেছে...
আঁকা: তুলি
শুরু: মা মা, আমি পাস করেছি!
: সত্যি বলছিস? সত্যি বলছিস তুই? আজ অনেক আনন্দের দিন! তুই বিএ পাস করে এই বংশের মুখ উজ্জ্বল করেছিস! আজ যদি তোর বাবা বেঁচে থাকত...
: বাবা বেঁচে থাকলে খুব খারাপ হতো, মা! আমাকে বোধ হয় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিত এই বাড়ি থেকে...
: কী বলছিস তুই, রাজু?
: ঠিকই বলছি, মা। কারণ...কারণ, আমি বিএ পাস করতে পারিনি। আমি...আমি মেয়র পদে পাস করেছি। আমি মেয়র হয়েছি মা, মেয়র হয়েছি!
: কী, তুই মেয়র হয়েছিস...তুই মেয়র হয়েছিস...তুই মেয়র হয়েছিস!
: হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি মেয়র হয়েছি। মেয়র হয়েছি। কারণ, এই শহরটাকে আমি ফুলবাগানের মতো সাজাব!
: যে নিজের পড়ার টেবিলটাকে সাজিয়ে রাখতে পারে না, সে শহর সাজাবে?
: সাজাব মা, সাজাব! দেখে নিয়ো...
: দোয়া করি বাবা, তুই মেয়রের মতো মেয়র হ! মেয়রের মতো মেয়র! আজ যদি তোর বাবা বেঁচে থাকত...

চক্রান্ত: ওই ওই ওই ওই, মোখলেশ! শুনছস, কিছু শুনছস...
: ওস্তাদ, আমি আপনার পাশেই খাড়ায়া আছি! এত জোরে চিক্কুর পাইরেন না!
: এত জোরে চিক্কুর না পারলে জোশ আসে না জানস না! ওই ওই ওই...রাজু মেয়র হইছে! রাজু মেয়র হইছে...
: এক কথা দুইবার না কইলেও কি জোশ আসে না, ওস্তাদ?
: চুপ থাক বেয়াদ্দব, চুপ থাক! রাজু হইছে মেয়র, এইটা আমি কিছুতেই মাইনা নিমু না...কিছুতেই না!
: কী করবেন, ওস্তাদ?
: চক্রান্ত করব, চক্রান্ত...হু হা হা হা হা হা... : ওস্তাদ, দাঁত মাজেন নাই?
: আর একটা কথা বললে তোরে আমি...শোন, এই নে, এইটা তুই মেয়রের টেবিলে লুকায়া রাইখা আসবি!
: এইটা কী? এইটা কি কোনো অস্ত্র?
: হ অস্ত্র! এইটার নাম নেইলকাটার...হু হা হা হা হা...
: ওস্তাদ, অখনই দাঁত মাইজেন...
প্রেম
: লিমা, আমি মেয়র হয়েছি, তুমি কিছু বলবে না?
: আহ্...বলতে তো কত কিছুই চাই! কিন্তু তুমি জানো না, সব সেন্সর হয়ে যাবে?
: তাহলে?
: তাহলে চলো, আমরা বৃষ্টিতে ভিজে গান করি!
: কিন্তু এই শীতকালে বৃষ্টি কোথায় পাবে?
: ড্রিম সিকোয়েন্স আছে না! তুমি মেয়র, আমি প্রিয়া, আমি প্রিয়া, আমি প্রিয়া...তুমি মেয়র, আমি প্রিয়া...
ষড়যন্ত্র
: মিস্টার মেয়র, ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট!
: কিন্তু পুলিশ সুপার, আমার...আমার অপরাধ কী?
: আপনার অফিসের টেবিলের চার নম্বর ড্রয়ারের পাঁচ নম্বর কোনা থেকে এই নেইলকাটারটি পাওয়া গেছে...
: নাআআআআ...বিশ্বাস করুন, এই নেইলকাটারটি আমার নয়, আমার নয়...
: মিস্টার মেয়র, আইন তার নিজের পথেই চলবে! সেন্ট্রি, নিয়ে এসো ওকে!
ঘটনা উন্মোচন
: বল, ওই নেইলকাটার তোর, বল...তুই-ই আসামি...বল!
: না না না! আমাকে যতই মারুন, আমি কখনোই স্বীকার করব না ওই নেইলকাটার আমার, কখনোই না!
: রাজু...রাজু...রাজু!!!
: মা, লিমা, তোমরা এখানে? সব মিথ্যা, মা। সব মিথ্যা, লিমা। ওই নেইলকাটার আমার নয়। আমি আসামি নই। আমি নির্দোষ।
: আমি জানি, রাজু। আমি সব জানি! মোখলেশ আর তার ওস্তাদের সব কথোপকথন আমি লুকিয়ে লুকিয়ে শুনেছি! ওই নেইলকাটার আসলে ওস্তাদের!
: কী?
: হ্যাঁ, এটাই সত্যি! ওস্তাদ তোমাকে ফাঁসানোর জন্যই এই কাজ করেছে!
: ওওওওস্তাআআআদ...! আমি আসছি!!!
বদলা
: আরে, আমার আস্তানা ভাইঙা-চুইরা ওইটা কে ঢোকে! আরে আরে, মাইরা ফালাইব তো! আরে, রাজু তুই?
: হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি রাজু! আমি মেয়র! আমি আসামি না...ওয়া ভিসুউউউমা...
: ওরে বাবারে! তুই সব জাইনা গেছস নাকি?
: তুই ষড়যন্ত্র করে আমার টেবিলে নেইলকাটার রেখে আসছিলি...ইয়া ঢিসুউউউউম!
: ওক্...তোরে এসব কইল কেডা?
: চটাস! চটাস! ঠাস! ...বল তুই আমাকে আসামি বানিয়েছিস, বল?
: বানাইছি বাপ, বানাইছি...আমিই তোরে আসামি বানাইছি! আমিই তোর টেবিলে নেইলকাটার রাখছি! আর মারিস না! শীতকালে লাগে বেশি! কিন্তু এইবার...এইবার তোর কী হইব! এই যে দেখ, আমার হাতে কাঁটাচামচ! এইবার তোর চোখ উঠায়া নিব আমি!
: ওস্তাদ, ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট!
: অ্যাঁ, পুলিশ?
: রাজু...আমার রাজু...
: মা, তোমরা এখানেও চলে এসেছ?
: হ্যাঁ, চলে এসেছি, বাবা! এবার তোর আর লিমার হাত এই যে এক করে দিলাম! বেঁচে থাক বাবা তোরা দুজন! আজ যদি তোর বাবা বেঁচে থাকত...
: উফ্, মা!

সমাপ্ত

খবর: পৌরসভার নবনির্বাচিত মেয়রদের মধ্যে ৪৩ জন বিভিন্ন মামলার আসামি। তাঁদের মধ্যে ২৩ জনের বিরুদ্ধে
হত্যা বা হত্যাচেষ্টা মামলা আছে। (সূত্র: প্রথম আলো, ৮ জানুয়ারি ২০১৬)

রস+আলোয় প্রকাশিত-
 http://m.prothom-alo.com/roshalo/article/736762/%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A7%9F%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%A8-%E0%A6%86%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%BF

সামাজিক (যোগাযোগের) বিয়ে


আঁকা: সাদমান মুনতাসির
বলা নেই কওয়া নেই দুম করে হিমেল চীনে চলে গেল।
আমরা যারা তার বন্ধু, তারা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। বন্ধু-বন্ধুতে গলায় গলায় ভাব থাকলেও ভেতরে ভেতরে আমাদের জোর প্রতিযোগিতা। চীন সফর করে হিমেল কি সেই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে গেল? কী কারণে গেল সে? ব্যবসা নাকি স্কলারশিপ? কিছুই জানার উপায় নেই, চীনে ফেসবুক চলে না। হিমেলের কোনো স্ট্যাটাস নেই, কোনো আপডেট নেই। না জানি কোন সোনার হরিণ পেয়ে গেল সে! ঈর্ষায় আমরা এমন জ্বলতে লাগলাম যে এমনকি ফেসবুকিংও অসহ্য মনে হতে লাগল।
হিমেল দেশে ফিরে এল পাক্কা ১০ দিন পর। এসেই ফোনে তার বাসায় দাওয়াত দিয়ে বসল। কী উপলক্ষ, কী বিষয়, কিছুই জানতে পারলাম না। হিমেলকে জিজ্ঞেস করলে বলল, ‘সারপ্রাইজ সারপ্রাইজ!’
কী আর সারপ্রাইজ হবে! দেশের বাইরে গিয়েছিল, আমাদের জন্য বড়জোর চকলেট নিয়ে ফিরেছে। গতবার বাপ্পি গেল নেপাল, আমাদের জন্য নিয়ে ফিরল চুইংগাম। সেই চুইংগাম ঢাকা শহরের মোড়ে মোড়ে পাওয়া যায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফ্রি চকলেটের লোভেই যথাসময়ে হিমেলের বাসায় হাজির হলাম। হয়েই হার্ট অ্যাটাকের জোগাড়! ড্রয়িংরুমে একটা চীনা পুতুল। পুতুলের চোখ পিটপিট করে, পুতুল ঘোরে, হাঁটে। হঠাৎ শুনি পুতুল কথাও বলে। ‘ইয়াংচু চিয়াংচু’ ধরনের ভাষা। হিমেল বলল, ‘বন্ধু, পরিচিত হ, তোদের ভাবি...চিয়ানা!’
আমরা ধাক্কা খেলাম। ভাবি? হিমেল শেষ পর্যন্ত কিনা একটা পুতুলকে বিয়ে করল? বাপ্পি মুখ ফসকে বলেই বসল, ‘চায়না থেইকা পুতুল বিয়া করলা, বন্ধু?’
হিমেল হেসে উঠল। চীনা পুতুলটা ঘাড় নাড়িয়ে বলল, ‘আপনেরা কিয়ামন আছেন সকলে?’
আমাদের হার্টের রিদম আরেকবার মিস করল। এ তো পুতুল নয়...জ্যান্ত মানুষ! মানে হিমেল চীনে গিয়ে চীনা বউ নিয়ে এসেছে? কী অদ্ভুত! কী সর্বনাশ! এখন আমাদের কী হবে? চীনের জিনিস বলতে আমরা এত দিন চীনাবাদাম আর চীনামাটির বাসন-কোসন দেখেছি। আরও দেখেছি মোবাইল ফোন আর রেডিও। কিন্তু এটা তো আস্ত পুতুলের মতো মেয়ে! যাকে হিমেল বিয়ে করে ফেলেছে। হিমেলের এত সৌভাগ্য! অসম্ভব! আমাদের মাথা ঝনঝনিয়ে উঠল। আমরা ফটাফট প্রশ্ন করে গেলাম আর হিমেল তার চেয়েও ফটাফট উত্তর দিয়ে চলল। মাঝখানে বসা চীনা কন্যা টেনিস খেলা দেখার মতো একবার আমাদের মুখের ওপর, একবার হিমেলের মুখের তার দৃষ্টি আছড়াতে লাগল।
আমরা বললাম, ‘শেষ পর্যন্ত চীনে বিয়ে?’
: প্রেম তো কোনো বর্ডার মানে না, বন্ধু!
: তাই বলে আমাদের জানাবি না?
: কিছু জানানোর আগেই বিয়েটা করতে হলো। চিয়ানার বাবা খুব হার্ড! ঢাকাই ফিল্মের নায়িকাদের বাবার মতোই!
: কী করে পরিচয়?
: সামাজিক পরিচয় বন্ধু...সামাজিক যোগাযোগের বিয়ে!
: সামাজিক যোগাযোগ মানে? চীনে তো ফেসবুক চালুই নেই!
: তোরা কি মনে করিস ভিপিএন শুধু আমরাই ব্যবহার করতে জানি? আর হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার কি সামাজিক যোগাযোগ না?
: এখন কী করবি?
: সংসার করব। প্রেম করেছি, বিয়ে করেছি, এবার তো সংসারের পালা!
: চায়না কিছুই টেকে না, না মোবাইল ফোন, না ইলেকট্রনিকস জিনিস! বিয়েটা টিকবে তো?
: টিকবে। চায়নার মানুষেরা তাদের মোবাইল ফোনের মতো না, তারা তাদের বিখ্যাত প্রাচীরটার মতো, না টিকে উপায় নেই!
আমরা অত্যন্ত আহত হলাম। বন্ধুর সব সহ্য করা যায়, শুধু সুন্দরী বউ সহ্য করা যায় না, সে বউ যদি বিদেশি হয়, তা হলে তো কোনো কথাই নেই। আমরা চি-চা-চি করে এক অদ্ভুত ভাষায় হিমেলের চায়না বউয়ের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। পুরো রাস্তায় আমরা নিজেদের মধ্যে কোনো কথা বললাম না। বন্ধুর বিদেশি ও সুন্দরী বউ দেখে আমরা বাক্হত। অনেকক্ষণ পর বাপ্পি আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘চীনা দূতাবাসটা কোথায়, তুই জানিস?’
: হুম, জানি।
: যাবি?
: তুইও যাবি?
: হুম।
পরদিনই চীনা দূতাবাসে ভিসার জন্য আবেদন করলাম আমরা। আর চোখ-কান খোলা রাখতে শুরু করলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে। বিয়ে যদি একটা করতেই হয়, তা হলে তা সামাজিক যোগাযোগেরই বিয়ে হোক!

রস+আলোয় প্রকাশিত-
http://m.prothom-alo.com/roshalo/article/743026/%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%AF%E0%A7%8B%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%AF%E0%A7%8B%E0%A6%97%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87

না লিখতে পারা একটা সবুজ নাকফুলের গল্প


একটা নাকফুলের গল্প লিখব বলে অনেক দিন ধরে ভাবছি।

গল্পটা যেহেতু শুনেছিলাম শাহগুফতার কাছে তাই একদিন সিগারেট খেতে খেতে তার অনুমতি নিয়ে রেখেছিলাম। যদিও গল্পে শাহগুফতা থাকবে কিনা এ নিয়ে আমার ভেতরে একটা সন্দেহ আছে। কারণ শাহগুফতার নাকে কোনো ফুটো নেই। সে নিজে নাকফুল ব্যবহার কনে না। এবং যে নাকফুল ব্যবহার করে না তাকে নিয়ে নাকফুল শিরোনামে গল্প লেখা উচিত হবে কিনা এমন ভাবনা আমার মধ্যে দুলে গিয়েছে কয়েকদিন।
তবে এই যে বললাম দুলে গিয়েছে এটা আসলে সঠিক বলা হলো না; সত্যিকারার্থে কোথাও তেমন কিছু দোলে নি। বরং ভাবনাটা একটু এসেছিল। তার সঙ্গে এও ভাবনা ছিল যে শাহগুফতার নামটা বড়। এই নাম গল্পে ব্যবহার করা সুবিধাজনক না। নায়িকার নাম দুই তিন অক্ষরের মধ্যে হলে লিখতে পড়তে সুবিধা।

কিন্তু পরেই ভাবলাম গল্পে তো শাহগুফতা নায়িকা না বরং কথক, ফলে তার চরিত্রটা থাকতে পারে। তখন মনে হলো গল্পটাতে আমি থাকবো কিনা। গল্প-টল্প লিখলে আমার উপস্থিতি আসলে কথক হিশেবেই থাকে সাধারণত অথচ এখানে সে কাজ করবে শাহগুফতা। নিজের সাথে কিছুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্ব হয়। শাহগুফতা না আমি, আমি না শাহগুফতা! কিন্তু ওই শীত শীত কালে শাহগুফতার কাছে যে আমি গল্পটা শুনেছলিাম তারপর থেকেই মনে হয়েছিল গল্পটা লিখে ফেলব। অথচ লেখা হচ্ছে না। এই বসন্ত কি রাইটার্স ব্লক-- এরকম একটা আতঙ্ক তৈরি হতে হতেও হয় না।

শাহগুফতাকে বলি লিখব গল্পটা। আপনি যেটা বলেছিলেন।

শাহগুফতা মনে করতে পারে না। তাকিয়ে থাকে। আমি বলি, ওই যে ওই নাকফুলের গল্পটা। সবুজ একটা নাকফুল!

তখন শাহগুফতার মুখে একটা ছায়া এসে চুপ করে দাঁড়ায়। যারা গল্পটা জানে না তারা বুঝতে পারে না এই ছায়ার উৎস, কিন্তু আমার একটা বিচলন হয়। ভাবি যে শাহগুফতাকে না বললেই পারতাম। চুপচাপ গল্পটা লিখে ফেললেও তো হতো। গল্পটা প্রথম যখন সে বলেছিল তখনও এমন একটা ছায়া তার মুখে ছিল। চোখে ত্রস্ততা ছিল। ভয় ছিল কি ঠোঁটে? সব মিলে এরকম একটা অদ্ভুত অবস্থা ছিল তখন। আর আমি খুব লোভীর মতো, গল্পটা শুনতে শুনতে, গল্পটার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে ভাবছিলাম গল্পটা লিখে ফেলতে হবে। গল্পটাতে একটা দারুণ গল্প আছে। তখন শাহগুফতার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে একটু স্বার্থপর তো লাগইে, কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে বলি কে জানি বলেছে লেখকদের এমন স্বার্থপর হতেই হয়। সৃষ্টি মানেই স্বার্থপরতা। পরে বুঝতে পারি আসলে এমন কথা অন্য কেউ বলে নি-- নিজেকেই নিজে বলে আসছি অনেক দিন থেকে। বলতে বলতে এখন নিজের কথা মনে হচ্ছে অন্যের কথা। আর শাহগুফদা, অন্যের কথা বলতে বলতে মনে হয় যেন নিজের কথা বলছে। তার মুখে ছায়া, তার চোখ টলমল।

গল্পটাতে কী কী ছিল তার একটা ধারাবাহিকতা তৈরি করা জরুরি, কিন্তু ঠিক যেন সময়ই পাচ্ছি না। বা সময় হয়তো পাচ্ছি কিন্ত উদ্যম পাচ্ছি না। নাকি আসলে সাহস পাচ্ছি না, এরকমও ভাবি। তারপর ভাবি গল্পটা কোথা থেকে শুরু করবো, কীভাবে বলব! ছোট গল্পের শুরুটা প্লটটা খুব নাকি গুরুত্বপূর্ণ-- কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোতেও খুব বেশি গুরুত দিতে পারছি না। শুধু ভাবছি ওই ছেলেটার কথা। যে একটা নাকফুল নিয়ে হাজির হয়েছিল শাহগুফতার কাছে। অধরচন্দ্র মাঠে সারি সারি শোয়ানো ছিল বাতাস ভারী করা অমিমাংসিত লাশ। শাহগুফতারা রানা প্লাজা ধ্বসে বেঁচে মরা আর মরে বেঁচে ওঠাদের সেবা দিতে দিতে নিজেরাই অসুস্থ হয়ে পড়ছিল আর তখন ছেলেটা একটা নাকফুল নিয়ে এসেছিল শাহগুফতার সামনে। অথচ ছেলেটার হাতে বা পকেটে বা কোথাও সে নাকফুলটা ছিল না। শাহগুফতাকে বলেছিল, আফা, তিন মাসও হয় না আমরা বিয়া করছি! বিয়ার দিন ওরে একটা সবুজ পাথরের নাকফুল দিছিলাম। যত্ন কইরা বউ আমার নাক ফুলটা পরছে আর খোলে নাই!

শাহগুফতা তখন নাকি তাকিয়েই ছিল শুধু। আসলে গত একটা সপ্তাহে যে সব ঘটনার ভেতর দিয়ে শাহগুফতারা গিয়েছিল তাতে সব বিস্ময় সব উদ্দীপনা তারা হারিয়ে ফেলেছিল। একটা একটা শরীরকে ছিঁড়েফেড়ে বাঁচানোর তাগিদে যন্ত্রের মতো হৃদয়হীনের মতো তারা স্থূল হয়ে উঠেছিল। শাহগুফতা তখন নাকি শুধু নির্লিপ্তভাবে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকতে পেরেছিল। আর শাহগুফতার পিপাসা লেগেছিল। তখন নাকি, শত শত লাশের ভেতর, খুব পিপাসা লাগতো তাদের। কিন্তু তারা ঠিকমতো পানি খেতে পারতো না। কেমন অপরাধবোধ হতো। মনে হতো লাশগুলো তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, আর তারাও তো আসলে পানি খেতে চেয়েছিল ওই বড় বড় চাইয়ের তলায় চাপা পড়ে-- পানি পায় নি তারা, হয়তো রক্ত খেয়েছিল না হয় নিজের প্রসাব-- শাহগুফতাদের হাতে ধরা পানির বোতল এসব চিন্তায় স্থির হয়ে যেতো। গলা টিস্যু পেপারের মতো শুকিয়ে থাকতো। পিপাসা, পিপাসা লাগতো খুব।

ছেলেটা তখন নাকি অনুনয় করেছিল। বলেছিল, আফা, একটু যদি দেখতেন! মুর্দাগুলার ভিত্রে আমার সুমীও যদি থাকে। তারে পাই নাই, কিন্তু তার শরীলটা যদি পাই, তার কবরটা যদি দিতে পারি! আফা, কোনো মুর্দারই মুখ শরীল দেইখা বুঝার উপায় নাই... কিন্তু আমার সুমীর নাকে ওই সবুজ নাকফুলটা তো আছে, যদি দেখতেন, এই লাশগুলানের ভিত্রে আমার সুমী আছে কিনা!

গল্প শোনার এই জায়গায় এসে আমি ভেবেছিলাম গল্পটা আমাকে লিখতে হবে। তার আগে রানা প্লাজা ইত্যাদি নিয়ে যা শুনেছি যা দেখেছি তাতে এত করুণ পরিস্থিতি আছে যে সেসব লেখার সাহস আমি পাই নি। কিন্তু গল্পের এই জায়গাতে এসে ওই অদ্ভুত ধ্বংসাবস্থার মধ্যে আমি এক অনন্য সম্পর্কের গল্প পেয়ে যাই। মনে হয় ওই ছেলেটা, যার নাম গল্পে দেবো শফিক, সে বলার জন্য একটা উপযুক্ত চরিত্র। প্রধান চরিত্রগুলো যেমন হয় ভালোবাসায় ভরপুর অথচ দার্শনিকসুলভ নির্লিপ্ত, শফিকের মধ্যে যেন তা আছে। আর যেটুকু খামতি থাকবে লেখক হিশেবে তা আমি পুরিয়ে দিতে পারি, সে স্বাধীনতা তো আমার আছেই। আর সুমীকেও দেখতে পাই লেখকের চোখে। যেন এক উচ্ছ্বল, হাসিতে ভরা, লালসাদা মিশেল রঙের সালোয়ার-কামিজ পরা বউ। সদ্য বিয়ে হওয়ায় সংসারের আনন্দটুকুই আছে উদ্ভাসিত মুখে, ভারটা এখনো কাঁধে আসে নি। সুমী হাসলে গালের একপাশে একটা টোল হয়তো পড়বে। মানে এটা লেখক হিশেবে আমি একটু যুক্ত করে দেবো। এরকম ছোটখাটো গ্রহণ বর্জন লেখকরা করেই থাকে। তারপর শফিক আর সুমীকে নিয়ে, বিশেষত তাদের সংসার নিয়ে গল্পটা লিনিয়ারভাবে হয়তো বলে যাবো, এরকম ভাবি কিছুক্ষণ। ভাবি যে খোলা মাঠে শোয়ানো লাশের পাশে শফিক। একটা নাকফুলের স্মৃতি নিয়ে সে তার বউয়ের লাশ শনাক্ত করতে এসেছে। কিন্তু পারছে না। একটা জোর বাতাস হয় কোথাও। আর সেই বাতাসে লাশগুলোর ওপর জড়ানো কাপড়গুলো সরে সরে যায়, শফিক একসাথে সবগুলো লাশের ভাঙাচোরা বিগলিত মুখে দেখে। আর তখনই তার হঠাৎ খুব বমি পায়...

আমার খটকা লাগে। বমির অংশটা ভালো লাগে না। ফলে আমি শাহগুফতার কাছে আবার যাই। মানে তাকে প্রশ্ন করে জেনে নিতে চাই একচুয়েল অবস্থাটা। বলি, তখন শফিক কী করে?

শাহগুফতা বলে, কোন শফিক?

আমার মনে পড়ে শাহগুফতা জানে না আমি ছেলেটার মনে মনে নাম দিয়ে ফেলেছি। তবে তা আর জানাই না শাহগুফতাকে। আমি বলি, ওই যে ছেলেটা তার বউয়ের জন্য এসেছে। একটা সবুজ নাকফুল যার বউয়ের নাকে আছে।

শাহগুফতা বলে, ছেলেটা তো কিছু করে না। আমাকে তার বউকে খুঁজতে বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

আমি বলি, কান্নাকাটি করে না?

শাহগুফতা বলে, না করে না। কিন্তু তার মুখে কান্নার চেয়েও কষ্ট দেখতে পাই। যেন ভেঙেচুরে গেছে ভিতর ভিতর। তার শরীরের সমস্ত প্রত্যঙ্গ যেন আহত হয়েছে।

আমি বলি, আপনি তখন কী করলেন?

শাহগুফতা তাকিয়ে থাকে, কিছু বলে না। আমি ভাবি আর বলবে না হয়তো। অধরচন্দ্র মাঠে মৃত্যুর বিভীষিকার মধ্যে কাজ করতে করতে শাহগুফতার মানসিক ঝামেলা হয়েছিল। রাতে ঘুম হতো না তার, আর হলেও ধ্বংসস্তূপ আর আর্তির দৃশ্যশব্দে ঘুম ভেঙে যেতো। একটা অদ্ভুত আশঙ্কা যেন সব সময় তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতো। পরে, এসব থেকে মুক্তির জন্য, তাকে বেশ কিছুদিন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। আমার মনে হলো শাহগুফতার মুখের ভেতর ওই আশঙ্কাটা আবার ছায়া ফেলে যাচ্ছে। তখন আমার মনে হলো সে আর কিছু বলবে না। কিন্তু তারপর কী হয়েছিল সেটা জানা আমার জন্য জরুরি হয়ে পড়েছিল। না হলে আমি আর গল্পটা লিখব কীভাবে!

আমি তাই অপেক্ষা করতে থাকলে শাহগুফতা জিয়াকে আরেকটা চা দিতে বলে। আমি আরেকটা সিগারেট নিই তখন। আর অপেক্ষা করতে থাকি যে শাহগুফতা এবার হয়তো বলবে। তবে বলে না। সে মনোযোগ দিয়ে চা খায়। আর আমি ধারণা করতে থাকি কী কী হতে পারে তারপর। কিন্তু আমার মাথায় কিছুই আসে না। হাসপাতাল ছেড়ে আমার দৃশ্য শুধু রানা প্লাজার দিকে চলে যায়। যেহেতু টিভিতে বেশিরভাগ সময় রানা প্লাজাকেই আমি দেখেছিলাম। ফলে ওই দৃশ্য কল্পনা করতেই আমার জন্য সহজ হয়। আমি যখন ক্যামেরাম্যানদের ক্যামেরা ধরে রানা প্লাজার গভীর অন্ধকারে ঢোকার চেষ্টা করি তখন শাহগুফতা কথা বলে ওঠে। খেয়াল করি বলতে গিয়ে তার গলা একটু কেঁপে যায়। যেন যা বলছে তার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ নেই। যা বলছে তা যেন বলতে চায় না, বলতে গিয়ে যে দৃশ্য তার ভেতর আসছে তা যেন দেখতে চায় না। কিন্তু আমি তাকে থামতে বলি না। শাহগুফতার কণ্ঠ কাঁপে। বলে, হীরক ভাই, আমি কিন্তু ছেলেটাকে নিয়ে যাই। ওই লাশগুলোর পাশে। একটা একটা করে মহিলা লাশের নাক খুঁচে খুঁচে দেখি কোথাও কোনো নাকফুল আছে কিনা! গলে যাওয়া মাংসের ভেতর একটা ছোট্ট দানার মতো কিছু পাবার জন্য আমরা উৎসাহ নিয়ে একই কাজ করে যাই প্রতিটি লাশের নাকের সঙ্গে...

আমার খুব অবিশ্বাস হয়। যতটা না অবিশ্বাস হয় শাহগুফতার কথায়, তারচেয়ে বেশি হয় নিজের ওপর। গল্পের এই জায়গাটা আমি বিশ্বাসযোগ্যভাবে কী করে লিখব? আমার যা অভিজ্ঞাত না তা কীভাবে লেখা সম্ভব! শাহগুফতা সবগুলো লাশের গলে যাওয়া নাকের মাংস চেপে চেপে একটা সবুজ নাকফুল খুঁজছে আর শফিক তার পাশে পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে! দু’জনেই নির্বিকার। মৃত্যুর মিছিলের মধ্যেই সম্ভবত এরকম নির্লিপ্ত থাকতে পারে মানুষ, কিন্তু এই অসম্ভব ব্যাপার আমি লিখব কেমন করে?

শাহগুফতা বলে, আট নম্বর লাশটার নাক খুঁজতে গিয়ে পুরা নাকটাই খুলে যায়। যেন একটা গলানো প্লাস্টিক। যেন শুটকি মাছ। যেন...

আর ঠিক তখনই শফিক আর্তি করে ওঠে। বলে, আফা সাবধানে... আফা...

হাতে উঠে আসা সেই মাংসটা দু’আঙুল দিয়ে ডলতে থাকে শাহগুফতা, ডলতেই থাকে। যেমন সে একটু আগেও ডলে ডলে এসেছে আরো সাত সাতটি লাশের নাক। ডলতে ডলতে হঠাৎ তার দুই আঙুলের মধ্যে কী যেন মটোর দানার মতো লাগে। তার আঙুলের গতি বেড়ে যায়। শফিকের মধ্যে উৎকণ্ঠা বাড়ে। গলে যাওয়া মাংসগুলো ঝরে যায় আঙুল থেকে। পড়ে থাকে শুকনোর চামড়ার মতো মেঝেতে। শাহগুফতার আঙুলে থাকে একটা নাকফুল। শাহগুফতা তার বোতল থেকে পানি ঢালে, পরিস্কার করে নাকফুলটা। দুপুরের আলোয় ঝিলিক দিয়ে ওঠে পাথর। সবুজ।

শাহগুফতা নাকফুল নিয়ে তাকায় শফিরে দিকে। শফিক হাঁটুমড়ে বসে পড়ে সুমীর লাশের পাশে। আর এই প্রথমবারের মতো সে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। সে আওয়াজ স্কুলমাঠ ছাড়িয়ে রানা প্লাজার গভীর খাদেও পৌঁছায়। সেখানে জমে থাকা বাতাস আরেকবারের মতো গুমড়ে ওঠে। শফিক সুমীকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েও পারে না সবার বাধায়। সবার ভয় হয় নাক খুলে আসার পর এবার হয়তো সুমীর সমস্ত মাংসই খুলে আসবে শরীর থেকে। শফিক তখন সুমীর নাকের মেঝেতে ঝরে পড়া মাংসগুলো কুড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর ফোঁপাতে থাকে।

শাহগুফতা নিজের হাতটা তুলে আলগোছে একবার দেখে নেয় আর তখনই তাকে বলি এই কথাটা যে আমি তার স্মৃতিটা নিয়ে একটা গল্প লিখতে পারি। সে তখন একটু আহত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি এই গল্পটা আমি অবশ্যই অবশ্যই লিখব। কিন্তু যতবারই লিখতে চাই না কেন লিখতে পারি না। কোথা থেকে শুরু করব সেটা বুঝে উঠতে পারি না। কোথায় যে শেষ হবে তাও থাকে অজানা। কিন্তু বুঝতে পারি সবুজ নাকফুলের একটা গল্প না লিখতে পারলে আমি বোধহয় আর সুস্থ হবো না!

শাহগুফতাকে কি আমি গল্পটা আবার বলতে বলবো?
 
 
গল্পপাঠে প্রকাশিত
.................................