বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৫

কখন ফোন আসে

মোবাইল ফোন এখন অপরিহার্য। এই যন্ত্রটি ছাড়া মানুষের এক দিন, এক ঘণ্টা, এক মিনিটও চলে না। কিন্তু খেয়াল করে দেখেছেন কি, এই মোবাইল ফোনে কলগুলো ঠিক কখন কখন আসে?
আঁকা: ষুভ 
ভিড় বাসে
প্রচণ্ড ভিড়, লোকজনে ঠাসা লোকাল বাস। আপনি বাসে কোনোভাবে উঠতে পেরেছেন। উঠেছেন তো ঠিকই, কিন্তু দাঁড়ানোর জায়গাটুকুও নেই। আপনি একজনের পায়ের ওপর, আরেকজন আপনার পায়ের ওপর জিমন্যাস্টিকসের ব্যালান্সকে হার মানিয়ে, নিউটনের গতিসূত্রকে প্রায় বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। না, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেননি, অনেকটা লতাগাছের মতো নিজেকে ঝুলিয়ে, প্রায় তিন শ হাত দূরের একটা লৌহবস্তুতে নিজের হাত আটকে নিরন্তর ব্যালান্স করে চলেছেন। এ রকম, ঠিক এ রকম অবস্থায় আপনার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠবে। ভাইব্রেশন হবে। ঝোলাঝুলিতে আপনি এতটাই ব্যস্ত থাকবেন যে রিংটোন বা ভাইব্রেশন—কোনোটাই বুঝে উঠতে পারবেন না। আপনার পাশের সহযোদ্ধা প্রথমে নিজের পকেট হাতড়াবে, তারপর বলবে, ‘এই যে ভাই, আপনার ফোন...’। নিজের ফোন বাজতে শুনে আপনি কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাবেন। বুঝে উঠতে পারবেন না, ফোনটা আপনি ধরবেন কি না। ধরলে কী উপায়ে ধরবেন? আপনার ঝুলন্ত সহযোদ্ধা তখন আপনাকে সাহায্য করতে নিজের পিঠটা এগিয়ে দেবেন। সেই পিঠে নিজের খানিকটা ভার ছেড়ে, অনেকটা নির্ভার হয়ে, জিনস প্যান্টের টাইট পকেট থেকে অনেক কসরত করে আপনি ফোনটা যখন বের করবেন, দেখবেন রিং এসেছে ফোন অপারেটর থেকে। আপনি জানেন, ফোনটা ধরলেই তারা গান শোনাবে। মানুষের চাপে যখন আপনার প্রাণ প্রায় যায় যায়, তখন আর যা-ই হোক গান শুনতে আপনার ইচ্ছা করবে না!
বাথরুমে
সারা দিন আপনার সঙ্গে ফোনটা অঙ্গাঙ্গিভাবেই জড়িয়ে ছিল। ফোনটাকে বহন করেছেন কখনো পকেটে করে, কখনো হাতে নিয়ে। দিনের কাজ শেষে ফিরেছেন বাসায়। ফোনটা নিয়ে কিছুক্ষণ ফেসবুক, কিছুক্ষণ এই গেম সেই গেম করেছেন, তারপর সেটা রেখে ঢুকেছেন বাথরুমে। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে চোখেমুখে ফেনা মাখিয়েছেন সাবানের। সেই সময়, ঠিক সময় আপনার ফোন বেজে উঠবে। একসঙ্গে এক হাজার সম্ভাব্যতার কথা মনে আসবে আপনার। রুনা কি ফোন দিল? নাকি মাহি? টিচার কি ফোন দিল, নাকি বস? নাকি ফ্যামিলির কেউ? চোখে সাবানের জ্বালা নিয়ে অর্ধভেজা আপনি ঘরে ঢুকে ফোনটা ধরবেন। আর তখনই ও–প্রান্ত থেকে কেউ একজন মিহি সুরে আপনাকে সালাম দেবে। তারপর জানাবে কী করে কোথায় গেলে পাঁচ শ কেজি সোনা আপনি পাবেন। আপনি থরথর কাঁপতে থাকবেন। জি হ্যাঁ, আপনি এবার কোটিপতি হতে যাচ্ছেন! কারণ, আপনাকে রিং করেছে স্বয়ং জিনের বাদশাহ!
আঁকা: ষুভ 
বৃষ্টির মধ্যে রিকশায়
একটা সময় ছিল যখন শুধু বর্ষাকালে বৃষ্টি হতো। সেই দিন আর নেই। এখন যেকোনো ঋতুতে, যেকোনো অবস্থায় হুড়মুড় করে বৃষ্টি নেমে আসতে পারে। এ রকম ঝুমবৃষ্টির মধ্যে প্রায় হাতে-পায়ে ধরে আপনি একটা রিকশায় উঠতে পেরেছেন। নীল পলিথিনের সুরক্ষার চাদরে আপনি নিজেকে ঢেকে ফেলেছেন। কিন্তু ঢেকে ফেললে কী হবে, এদিক থেকে ওদিক থেকে বৃষ্টি আপনাকে প্রতি মুহূর্তে জাপটে ধরতে চাইছে। আপনি রিকশার হুডের তলায় গুটিসুটি মেরে গভীর দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন। দুশ্চিন্তা আপনার সঙ্গের ল্যাপটপটা নিয়ে, যদি সেটা ভিজে যায়! দুশ্চিন্তা আপনার স্মার্টফোনটা নিয়ে, যদি সেটাও ভিজে যায়! মাত্র ছয় মাস আগেই ভিজে গিয়ে একটা ফোন অন্ধ হয়ে গেছে আপনার। আপনি তাই যতটা না নিজেকে বাঁচাচ্ছেন, তার চেয়ে বেশি বাঁচানোর চেষ্টা করছেন আপনার ল্যাপটপ আর স্মার্টফোন! এই সময়, ঠিক এই সময় আপনার ফোন বেজে উঠবে। রিং হচ্ছে, আপনি এড়িয়ে যাচ্ছেন। ফোনটা বের করছেন না পকেট থেকে। রিং হচ্ছে, ভাইব্রেশন হচ্ছে, আপনি এড়িয়ে যাচ্ছেন। ফোনটা বের করছেন না পকেট থেকে। প্রথমবার রিঙের পর আবার বাজতে শুরু করল ফোন। আপনি দোয়া করছেন, আর যেন না বাজে ফোনটা। কিন্তু তৃতীয়বারের মতো বেজে ওঠে সেটা। আপনি আর এড়াতে পারেন না। স্ক্রিনে অপরিচিত নম্বর। কে হতে পারে, ভাবতে ভাবতেই আপনি ফোনটা ধরেন।
: হ্যালো দোওওস্ত, কী অবস্থা, বল!
: কে বলছেন?
: আর রে, তুই আমাক চিনতে পারলি না?
: কে?
: আরে, আমি তোর হাফপ্যান্ট কালের বন্ধু! মিজান!
: ও, মিজান! আসলে আমি খুব ঝামেলার মধ্যে আছি...এদিকে বৃষ্টি হচ্ছে তো...
: তাই নাকি? ঢাকায় বৃষ্টি হয়? তাইলে তো বন্ধু ঢাকা এইবার ডুইবা যাবে! কী করতে যে তোরা ঢাকায় থাকিস। চইলা আয় চইলা আয়! আর শোন, আমাদের এইখানে তো ভোট। কে দাঁড়াইছে জানিস...হ্যালো, শুনতে পাস না নাকি...
আপনি জানেন, এই আলাপ বন্ধ হওয়ার নয়। আপনি এও জানেন, এই আলাপের মধ্যে ফোন কেটে দেওয়ার ক্ষমতাও আপনার নেই। আপনি তাই ‘হুঁ’ আর ‘হ্যাঁ’ বলে শুনতে থাকবেন আপনার হাফপ্যান্ট-কালের বন্ধুর নানান প্যাঁচালাপ। বৃষ্টিতে আপনি ও আপনার প্রিয় ফোন ভিজতে থাকবে।
বসের সামনে
অফিসে ঢুকতে না-ঢুকতেই জানতে পারলেন, বস আপনাকে খুঁজছে। আকাশ থেকে পড়লেন আপনি। পড়ি কি মরি করে ছুটলেন বসের ঘরে। বস অন্য কারও সঙ্গে কথা বলছেন। আপনি উঁকি দিলেন, বস যেন দেখেও দেখলেন না। কলজে শুকিয়ে গেল আপনার, আজ বোধ হয় আজাব নেমে আসবে। হয়তো চাকরিটাই নট হয়ে যাবে! এ সময় ফোন বেজে উঠবে আপনার। পকেট থেকে বের করে দেখবেন প্রেমিকা বা বউ রিং করেছে। অন্য যেকোনো রিংই আপনি কেটে দিতে পারতেন, কিন্তু এই রিংটা এড়াবেন কীভাবে? আপনি বসের দিকে তাকালেন, বস কথা বলছেন; আপনি ফোনের দিকে তাকালেন, ফোন বেজে চলেছে। আপনি বসের দিকে তাকিয়ে ফোনটা ধরলেন। ওপাশের কণ্ঠ, ‘কী, এতক্ষণ লাগে কেন ফোন ধরতে?’ আপনি ফিসফিস করে বললেন, ‘বিজি আছি, জান! একটু পরে রিং দিই?’
: কী হইছে? কী বলো, অ্যাঁ? তোমার কথা তো শুনতে পাই না!
: বলছি, বিজি আছি!
: কী, কই আছ তুমি? তুমি অফিসে যাও নাই?
: অফিসেই আছি...বসের সামনে...একটু পরে রিং দিই?
: ও, এখন তো একটু পরেই রিং দিবা। আগে তো সারা রাত কথা বলতা। আমি ঘুমাইতে চাইলে বলতা আজ কোনো ঘুম না, আজ খালি প্রেম! মোবাইলের চার্জ ফুরায়ে গেলে চার্জারে দিয়ে কথা বলতা! কত রঙের কত ঢঙের সব কথা! আর এখন...এখন তুমি একটুও সময় দাও না আমাকে। আমি কি কিছু বুঝি না নাকি...
আপনি কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই বস আপনার দিকে তাকাবেন। ফোনের ওপারে এক বস, ফোনের এপারে আরেক বস। আপনার অবস্থাটা হবে দুই বসের মাঝে পিষ্ট একটা স্যান্ডউইচের মতো!


প্রথম প্রকাশ: রস+আলো
লিংক:  http://www.prothom-alo.com/roshalo/article/658879

শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৫

ডাইনোসরের বাচ্চা

অলংকরণ: তুলিতুলতুল আর রিমঝিম। একই ফ্ল্যাটে থাকে।
একসঙ্গে স্কুল যায়, একসঙ্গে ফেরে, হোমওয়ার্ক শেষে খেলেও একই সঙ্গে।
খেলা বলতে দেয়াল ছুঁয়ে দৌড়ানো, না হয় লুকোচুরি।
লুকোচুরি খেলতে খেলতে গ্যারেজে একদিন তারা একটা ডিম খুঁজে পেল। ডিমটা টেনিস বলের চেয়েও বড়। রংটা সবুজাভ। তুলতুল বলল, এটা কী?
রিমঝিম খুবই চিন্তিতভাবে বলল, মনে হয় ডিম।
-কিসের ডিম?
-ঘোড়ার ডিম!
-দূর! টিচার বলেছে ঘোড়ার ডিম বলে কিছু নেই।
-তাহলে?
-চলো বাবাকে দেখাই।
বাবারা বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল। তুলতুল বলল, বাবা দেখো, আমরা একটা ডিম পেয়েছি...
বাবারা নিজেদের গল্পে ব্যস্ত। তারা তুলতুলদের কথা ঠিকমতো না শুনেই বলল, তাই নাকি? খুব ভালো।
-ডিমটা নিয়ে আমরা কী করব বাবা?
ফুটবল বানিয়ে খেলো, না হয় পোচ করে খেয়ে নাও। যা খুশি করো। শুধু আমাদের বিরক্ত কোরো না!
বাবাদের কাছ থেকে তুলতুলেরা চলে গেল মায়েদের কাছে। মায়েরা তখন টিভি দেখছিল। রিমঝিম বলল, ‘মা দেখো, আমরা একটা ডিম পেয়েছি। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না এটা কিসের ডিম!’
মা এক ঝলক রিমঝিমের হাতের দিকে তাকিয়েই আবার টিভি দেখতে শুরু করল। বলল, ‘ও রকম ডিম আমি কখনো দেখিনি। তুমি দেখেছ রুনা?’
তুলতুলের মা টিভি থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, ‘নাহ্! আমিও দেখিনি।’
রিমঝিম আর তুলতুল ফিরে এল। তারা এবার নিজেরাই গবেষণা করতে বসল, কার হতে পারে এই ডিম? প্রথমেই তারা বাদ দিল হাঁস আর মুরগিকে। হাঁস-মুরগির ডিম তাদের ফ্রিজেই আছে, ওগুলো দেখতে একদমই এটার মতো না। কোয়েলের ডিমও তারা দেখেছে, দেখেছে টিকটিকির ডিমও। এই ডিমটা ওসব কোনো ডিমের সঙ্গেই মেলে না। তাহলে কি এটা সাপের ডিম? নাকি কুমিরের?
অনেক চিন্তার পর ডিমটা তারা নিয়ে এল নিজেদের ঘরে। মোটা একটা কাঁথার তলায় লুকিয়ে রাখল। আর একটু পর পর কাঁথা সরিয়ে ডিমটাকে দেখতে থাকল। তারা ভাবল, যদি সাপের ডিম হয়, তাহলে এক্ষুনি সাপ বেরোবে, যদি কুমিরের ডিম হয়, তাহলে এখান থেকে কুমির বেরোবে।
কিন্তু কত দিন চলে গেল, সাপ বা কুমির কিছুই বের হলো না কাঁথার ভেতর থেকে। শেষে তারা প্রায় ভুলেই গেল ডিমের কথা।
কিন্তু একদিন কাঁথার ভেতর থেকে অদ্ভুত একটা আওয়াজ শুনল তারা। তাড়াতাড়ি কাঁথাটা সরিয়ে দেখল, ডিম ফুটে বেরিয়ে এসেছে একটা বাচ্চা। বাচ্চাটা হাঁস মুরগি কোয়েল টিকটিকি সাপ বা কুমির কারও না। ছোট্ট বাচ্চাটা একটা ডাইনোসরের। মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে আছে তুলতুল আর রিমঝিমের দিকে। রিমঝিম আর তুলতুল আনন্দের চোটে কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারল না। তারপর ডাইনোসরের বাচ্চাটা নিয়ে তারা ছুটল বাবাদের কাছে। বলল, ‘বাবা বাবা দেখো, ডাইনোসরের বাচ্চা!’
বাবারা নিজেদের মধ্যে গল্পে ব্যস্ত ছিল। তারা খুব নিরাসক্ত গলায় বলল, ‘ও তাই নাকি। খুব ভালো।’
বাবারা ডাইনোসরের দিকে যখন ঘুরেও তাকাল না, তখন তুলতুলেরা ছুটল মায়েদের কাছে। মায়েরা তখন প্রতিদিনের মতোই টিভি দেখছে। রিমঝিম বলল, ‘মা দেখো, আমাদের নতুন খেলার সাথি! ডাইনোসরের বাচ্চা...বলো না মা, ওর নাম কী দেব?’
-দাও না যা খুশি!
-মা তাকাও না...দেখো না, বাচ্চাটা ফোকলা দাঁতে হাসছে!
-আহা, বিরক্ত কোরো না তো!
-মা, বাচ্চাটা কি আমাদের সঙ্গে থাকতে পারবে? আমরা ওর সঙ্গে খেলতে চাই।
-আগে হোমওয়ার্ক, তারপর খেলা।
-আমরা হোমওয়ার্ক করেই ওর সঙ্গে খেলব!
-তাহলে থাকুক। কিন্তু বেশি দুষ্টুমি করবে না!
টিভি দেখতে দেখতে মায়েরা তুলতুলদের দিকে তাকানোর সুযোগই পেল না। পেলে দেখত তুলতুল আর রিমঝিমের মাঝে সত্যি সত্যি একটা ডাইনোসরের বাচ্চা দাঁড়িয়ে হাসছে।
তুলতুল আর রিমঝিম নিজেদের ঘরে নিয়ে এল বাচ্চাটাকে। আজ থেকে বাচ্চাটা তাদের সঙ্গেই থাকবে, তাদের সঙ্গেই খেলবে, তাদের সঙ্গেই স্কুলে যাবে—ভর্তিও করিয়ে দেবে ডাইনোসরের বাচ্চাকে। কিন্তু স্কুলে ভর্তি করাতে গেলে তো একটা নাম দিতে হবে বাচ্চাটার।
বাচ্চাটার নাম নিয়ে মহা চিন্তায় পড়ল তুলতুল আর রিমঝিম। কোনো নামই তাদের পছন্দ হচ্ছে না। আচ্ছা শোনো তো, তোমরা কি ডাইনোসর বাচ্চাটার সুন্দর একটা নাম দিতে পারো?

প্রথম প্রকাশ: গোল্লাছুট

লিংক: http://www.prothom-alo.com/art-and-literature/article/656125/%E0%A6%A1%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%A8%E0%A7%8B%E0%A6%B8%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9A%E0%A6%BE

ছুটির দিনের সকাল


.সারা সপ্তাহ ব্যস্ত থাকার পর সবাই ছুটির দিনটির জন্য অপেক্ষা করেন। ধারণা করেন, এই দিনটি, অন্তত সকালটি তিনি একেবারে নিজের মতো করে কাটাবেন। নিজের মতো করে ঘুমোবেন। নিজের মতো করে ঝিমোবেন। কিন্তু আসলে কী ঘটে ছুটির সকালগুলোয়?

সকাল ৬টা ৪৫ মিনিটআপনার মোবাইলে অ্যালার্ম দেওয়া থাকে সাতটায়। সপ্তাহের অন্য দিনগুলোয় অ্যালার্ম বাজলেও আপনি উঠতে পারেন না। কিন্তু ছুটির দিনে অ্যালার্ম বাজার আগেই আপনার ঘুম ভেঙে যাবে—এই ভেবে যে এক্ষুনি হয়তো অ্যালার্ম বেজে উঠবে! বিছানায় আঁতিপাঁতি করে মোবাইল ফোন খুঁজে যখন অ্যালার্ম বন্ধ করতে যাবেন, তখন দেখবেন ছুটির দিনের কথা ভেবে আপনি আগের রাতেই অ্যালার্ম বন্ধ করে রেখেছেন। আপনার আশঙ্কা অমূলক। আপনি বিরক্ত হয়ে নিজেকে আবার বালিশে সঁপে দেবেন।
সকাল ৭টা ১৫ মিনিট
সাতটার অ্যালার্মে জেগে আবার ঘুমিয়ে, আবার জেগে আবার ঘুমিয়ে ৭টা ১৫ মিনিটে আপনি অন্য দিনগুলোয় বিছানা ছাড়েন। ছুটির দিনে ৭টা ১৫ মিনিটে আপনার কোনো কারণ ছাড়াই আবার ঘুম ভেঙে যাবে। আপনি মোবাইল ফোনে সময় দেখবেন এবং অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে কোলবালিশে লেপ্টে যাবেন।
সকাল ৭টা ২০ মিনিট
অন্য দিনগুলোয় এ সময় আপনি বাথরুমে থাকেন। আজ ছুটির দিন সেটা আপনি জানলেও প্রকৃতি তা জানতে পারে না। প্রকৃতি এই সময়ে আপনাকে তার মতো করে ডাকতে শুরু করবে। আপনার শরীর চাইবে সেই ডাকে সাড়া দিতে, কিন্তু আপনি চাইবেন ঘুমিয়ে থাকতে। প্রকৃতির ডাক, আপনার শরীর ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রচণ্ড মনঃশক্তি নিয়ে বেশ খানিকক্ষণ ধস্তাধস্তি করবেন আপনি। এবং শেষে বুঝতে পারবেন, প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করার কোনো ক্ষমতা আপনার অবশিষ্ট নেই। আপনি হতাশ হয়ে বিছানা-বালিশ ফেলে বাথরুমের দিকে যাবেন। এ সময় আপনার চোখ বন্ধ থাকবে। কারণ, আপনি ভালো করেই জানেন একবার চোখ খুলে গেলে ঘুম উড়ে যাবে। ছুটির দিনের ঘুমকে কোনোভাবেই উড়তে দেওয়া যাবে না। বাথরুমের পুরো সময়টা আপনি পারতপক্ষে চোখ বন্ধ করেই কাটাবেন। এবং যত দ্রুত সম্ভব নিজেকে আবার বিছানায় ভাসিয়ে দেবেন।
সকাল ৮টা ৫ মিনিট
বিছানার তীব্র কাঁপুনিতে আপনার ঘুম ভেঙে যাবে। আপনি প্রথমে আপনার অবস্থান নির্ণয় করতে পারবেন না। তারপরই আপনার ছুটে যেতে ইচ্ছা করবে বাইরে। কারণ, আপনি ধারণা করবেন বোধ হয় ভূমিকম্প হচ্ছে! পরক্ষণেই আপনার মনে হবে ভূমিকম্প হলে পুরো ঘর কাঁপার কথা কিন্তু আসলে কাঁপছে শুধু বিছানাটা। আপনি আবারও আঁতিপাঁতি করে আপনার মোবাইল ফোনটা খুঁজবেন এবং অল্প চোখ খুলে দেখবেন গতরাতে মোবাইল ফোনটার রিংটোন বন্ধ করলেও ভাইব্রেশন বন্ধ করা হয়নি। মোবাইল ফোনে আননোন নম্বর। কেন কেউ এত সকালে ফোন করে—এ রকম ভেবে আপনি ফোন কেটে দিয়ে আবারও ঘুমোনোর চেষ্টা করবেন। কিন্তু অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসবে আবারও। আপনার ঘুমের দুনিয়া আবারও কেঁপে কেঁপে উঠবে। পরিচিত নম্বরকে দু-তিনবার উপেক্ষা করা গেলেও অপরিচিত নম্বর উপেক্ষা করা মুশকিল! কারণ, আপনি বুঝতে পারছেন না কে ফোন করেছেন। হয়তো আপনার বস, হয়তো আপনার প্রেমিকা, কে জানে! অগত্যা আপনি ফোনটা ধরবেন। আর সঙ্গে সঙ্গে ওদিক থেকে চিৎকার করে কেউ একজন বলবেন, ‘হ্যালো হ্যালো...ভাই, এইটা কোন জায়গা...হ্যালো?’
আপনি অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে গলায় বিনীত ভাব রেখে বলবেন, ‘কে বলছেন?’
ওপাশের কণ্ঠটা আরও উত্তেজিত হয়ে বলবে, ‘আমি আক্কাস, হ্যালো ভাই, এইটা কোন জায়গা, হ্যালো ভাই, শুনতে পাইতাছেন?’
: আপনি কাকে চান?
: আপনারেই চাইতাছি! ভাই, আপনি লতিফ ভাই না? ভাই, এইটা কোন জায়গা...হ্যালো ভাই, এইটা রহনপুর না?
: জি না ভাই, রং নম্বর!
আপনি ঠাস করে ফোনের লাইন কেটে আবার ঘুমোতে চাইবেন। কিন্তু আপনার মনে সন্দেহ হতে থাকবে যে ওই নম্বর থেকে আবারও ফোন আসতে পারে। আবারও হয়তো বিছানা কেঁপে উঠবে। আপনি তাই মোবাইল ফোনটা বন্ধ করে দেবেন। এবার ঘুমোবেন। কিন্তু আপনার একটু অস্বস্তি হতে থাকবে। কারণ, মোবাইল ফোনটা বন্ধ। যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ ফোন আসে? আপনি এবার মোবাইল ফোনটা অন করবেন। ভয়ে ভয়ে মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে ঘুমোতে চেষ্টা করতে থাকবেন। আর তখনই মোবাইল ফোনটা একবার কেঁপে উঠবে। না, কারও রিং নয়। আপনার মোবাইল ফোন অপারেটর আপনার জন্য এসএমএস পাঠিয়েছে। কোনো এক গায়কের অশ্রুতপূর্ব গান শুনতে হলে আপনাকে কী করতে হবে, সে বিষয়ে তারা বিস্তারিত জানিয়েছে সেই এসএমএসে।
আপনি বড়জোর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে পারবেন। তারপর ঘুমোনোর জন্য তীব্রভাবে চোখ বন্ধ করবেন।
সকাল ৮টা ৫০ মিনিট
ঘুমটা ধীরে ধীরে জমতে শুরু করেছে আপনার। এই দুই ঘণ্টাব্যাপী চলতে থাকা নানা বাধাবিপত্তির বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত আপনার ঘুমের জয় হয়েছে। আপনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। কী স্বপ্ন সে বিষয়ে অবশ্য বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না। কিন্তু আপনি দারুণ উপভোগ করতে শুরু করেছেন ছুটির দিনের এই আলসেমিভরা ঘুম। ঠিক সেই সময়ে বিদ্যুৎ চলে যাবে। মাথার ওপর ঘুর্ণমান ফ্যানটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসতে থাকবে আর আপনার ঘুম কাটতে থাকবে। ফ্যানটা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই আপনার ঘুম চটকে যাবে। আপনি চোখ মেলে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে চাইবেন না। ছুটির দিনের সকালে, তীব্র গরমের মধ্যে একটা ফ্যান ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এর চেয়ে রোমহর্ষক দৃশ্য আর কী হতে পারে!
কিছুক্ষণের মধ্যেই গরম, রাগ আর হতাশা আপনার শরীর বেয়ে ঘাম হিসেবে টুপটাপ ঝরতে শুরু করবে। আপনার আর থাকা হবে না বিছানায়। আপনি বিছানা ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে চোখ বন্ধ করে বসবেন। গরম, তীব্র গরম! বারান্দায় ঢুলতে ঢুলতেই আপনি উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করবেন বিদ্যুৎ এল কি না। কিন্তু বিদ্যুৎ আসবে না। আপনি একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন যে গত সপ্তাহের মতো আজকেও আর ঘুমোনো হবে না আপনার। আপনি বিভিন্ন বিষয় আর বিভিন্ন ব্যক্তিকে কোনো কারণ ছাড়াই গালাগালি করতে করতে দাঁত ব্রাশ করতে শুরু করবেন। আর যতক্ষণে ঘুমের কবর দিয়ে দাঁত ব্রাশ শেষ হবে, ততক্ষণে দেখবেন বিদ্যুৎ চলে এসেছে। আর বিদ্যুৎ আসার সঙ্গে সঙ্গেই হুড়মুড়িয়ে আসবে বৃষ্টি।
আপনার খিদে পাবে, তবে ঘরে কোনো খাবার থাকবে না। নাশতার জন্য আপনাকে বাইরে যেতে হবে। তবে বাইরে ঝুমবৃষ্টি। কোনোভাবেই আপনি বাইরে যেতে পারবেন না। বৃষ্টিতে ধীরে ধীরে শীতল হয়ে আসবে আবহাওয়া। হিম হিম বাতাস বইতে শুরু করবে। ঘুমের একেবারে উপযুক্ত আবহাওয়া। কিন্তু আপনি ঘুমোতে পারবেন না। কারণ, আপনার পেটে খিদে।

প্রথম প্রকাশ: রস+আলো

সিলগালা মহল্লার বেলকনিরা


Decrease font Enlarge font
রিকশা ঠেলেও এই গলিতে ঢোকা যায় না। দূর থেকে তাই মানুষেরা নামে, হেঁটে হেঁটে তারা ঘরে ফেরে। তাদের হাঁটায় অদ্ভুত চনমনে ভাব। মনেই হয় না অফিস থেকে ফিরছে। এই গলির অফিসফেরত মানুষগুলো বোধহয় অন্যরকম। আর এই গলিতে এলে, গলি ধরে পিঠে পিঠ লাগিয়ে অ্যাপার্টমেন্টে ছোট ছোট ঘরগুলো নিয়ে গড়া এই মহল্লায় এলে, মনে হয় এটা এক অদ্ভুত সুন্দর জায়গা। ছিমছাম। আর অন্যরকম।

অবশ্য কিছুদিন আগেও এরকম অবস্থা ছিল না। মানে গলিটা আর দশটা পাঁচটা গলির মতোই সাধারণ ছিল। সকাল হলেই বাড়ির পুরুষেরা আর কিছু কিছু নারীও হন্তদন্ত বেরুত অফিসের দিকে। তাদের হাঁটায় তাড়া থাকত, তাদের চোখে থাকত ভরসাহীনতা। তাদের হাতে দুপুরের খাবারের ব্যাগ বা টিনের টুকরা থাকত। আর তারা রাস্তায় নেমেই রিকশার খোঁজ করত। তখন এ গলি ছিল অবাধ। রিকশা ভেতর পর্যন্ত ঢুকত। রিকশার বেলের টুংটাং শব্দ এ গলির দুপুরের অখণ্ডতাকে ভেঙে ফেলতে পারত। কোনো কোনো রিকশাওয়ালা অন্ধগলির কোণায় গিয়ে গাঁজা খেত। গাঁজার মাদকীয় গন্ধ তখন ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে ঢুকত। শাড়ি আর ম্যাক্সি পরা গৃহিণীরা এই গন্ধ ঠিক বুঝে উঠতে পারত না। তবে ছুটির দিনের পুরুষেরা প্রায়শ গন্ধটা ধরতে পারত। তারা তখন বেলকনিতে এসে দাঁড়াত, দেখার চেষ্টা করত। রিকশাওয়ালা থাকলে গালাগালি করত, পাড়ার লাফাঙ্গা থাকলে অবশ্য চুপ করে থাকত।



ব্যাপারটা প্রথম খেয়াল করেছিল মিজানুর। সে তখন সিগারেট খেতে তার ভাড়াফ্ল্যাটের তিনতলার বেলকনিতে ছিল। জ্বর জ্বর লাগছিল বলে সেদিন অফিসে যায়নি। সিগারেট ধরিয়ে মুখটা তিতা হয়ে গেলে সে থুতু ফেলতে চেয়েছিল দুপুরের খোলা ও ফাঁকা রাস্তায়। তখন সে খেয়াল করেছিল তিনটা লাফাঙ্গা গোল হয়ে বসে আছে আর তাকিয়ে আছে পাশের একটা ফ্ল্যাটের বেলকনির দিকে। আর তারা হাসছে। তারা কেন হাসছে তা দেখতে মিজানুরও বেলকনির দিকে নজর দিয়েছিল আর তখন দেখেছিল বেলকনিতে একটা সবুজ ব্রা ঝুলছে। বাতাসে মৃদু দুলছে। ব্রায়ের রঙ হিশেবে সবুজ কিছুটা দুর্লভ, মিজানুর আর কারো ফ্ল্যাটে এরকম রঙ ঝুলে থাকতে দেখেনি



তবে রিকশাওয়ালারা যত না তারচেয়ে বেশি পাড়ার লাফাঙ্গারাই থাকত। এরা বিনা ডরে হাতের তালুতে কচলে কচলে গাঁজা বানাত, সস্তা সিগারেটের ততধিক সস্তা তামাক ফেলে তাতে গাঁজা ভরত। ধরাত। টানত। বারবার টানত। কষে কষে টানত। তারপর চোখ লাল করে ফ্ল্যাটের দিকে তাকিয়ে থাকত। ফ্ল্যাটের ভাবীরাই ছিল সম্ভবত তাদের উদ্দেশ্য। বেলকনিতে মেলে দেওয়া মেয়েলী অন্তর্বাসও তাদের উদ্দেশ্য হয়ে থাকতে পারে। অন্তর্বাস দেখলে তারা খ্যাকখ্যাক করে হাসত।

ব্যাপারটা প্রথম খেয়াল করেছিল মিজানুর। সে তখন সিগারেট খেতে তার ভাড়াফ্ল্যাটের তিনতলার বেলকনিতে ছিল। জ্বর জ্বর লাগছিল বলে সেদিন অফিসে যায়নি। সিগারেট ধরিয়ে মুখটা তিতা হয়ে গেলে সে থুতু ফেলতে চেয়েছিল দুপুরের খোলা ও ফাঁকা রাস্তায়। তখন সে খেয়াল করেছিল তিনটা লাফাঙ্গা গোল হয়ে বসে আছে আর তাকিয়ে আছে পাশের একটা ফ্ল্যাটের বেলকনির দিকে। আর তারা হাসছে। তারা কেন হাসছে তা দেখতে মিজানুরও বেলকনির দিকে নজর দিয়েছিল আর তখন দেখেছিল বেলকনিতে একটা সবুজ ব্রা ঝুলছে। বাতাসে মৃদু দুলছে। ব্রায়ের রঙ হিসেবে সবুজ কিছুটা দুর্লভ, মিজানুর আর কারো ফ্ল্যাটে এরকম রঙ ঝুলে থাকতে দেখেনি। তার চল্লিশোর্ধ্ব বউও কখনো কোনোদিন সবুজ ব্রা পরেছে বলে সে স্মরণ করতে পারে না। আসলে তার বউয়ের কোনো ব্রায়ের রঙই সে মনে করতে পারে না। সবুজ ব্রা দেখে মিজানুরও তাই একটু আশ্চর্য হয়। পরক্ষণেই সে নিজেকে সামলে নেয় আর বোঝার চেষ্টা করে লাফাঙ্গাগুলো কেন ওটা দেখে হাসছে। হয়ত তারাও সবুজ রঙের ব্রা কখনো দেখেনি বা হতে পারে ব্রায়ের আকৃতিটা তাদের কাছে হাস্যকর ঠেকেছে। কিন্তু ঘটনা যাই হোক না কেন, মিজানুরের ব্যাপারটা ভালো লাগে না। রিকশাওয়ালারা হলে এতক্ষণ সে ধমক দিত। এদের ধমক দিতে পারছে না দেখে তার বিরক্তি আরো বাড়ে। তার মনে হয় বিরক্তির সাথে সাথে তার জ্বরটাও বেড়ে যাচ্ছে। সে সিগারেট দেয়ালে ঠেসে নিভিয়ে দেয়। খালি প্যাকেটের ভেতর সিগারেটের বাকি অংশটা ফেলে ঘরে ঢুকে যায়।

ঘরে তখন মিজানুরের চল্লিশোর্ধ্ব বউ শুয়ে ছিল। তবে শোয়াটা ছিল অদ্ভুত। এমনভাবে তার বউকে সে রাতেও দেখে না কখনো। সে দেখে তার বউ একটা অফহোয়াইট ব্রা পরে শুয়ে আছে। নিচে পেটিকোট। শাড়ি নেই। মিজানুর অত্যন্ত বিরক্ত হয়। বলে, আরে তুমি এমনে শুয়া আছো ক্যান?
বউ বলে, তো কেমনে শুয়া থাকব?
মিজানুর বলে, কাপড়চোপড় কই তোমার? কাপড় পরো! লজ্জা লাগে না?
বউ বলে, তোমার সামনে কিসের লজ্জা! বাড়িতে তো আর কেউ নাই। যে গরম পড়ছে... আমার খালি হাঁসফাঁস লাগে!
মিজানুর বউয়ের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকে।
বউ বলে, তুমরা তো ব্লাউজ পরো না তাই জানো না। ব্লাউজ পরলে বুকের ওপর পাত্থর চাইপা থাকে!
মিজানুর বলে, গরমে তুমি এইরকমই থাকো নাকি আজকাল?
বউ বলে, তোমরা তো উদাম গায়ে থাকতে পারো, ব্যালকনিতে বুক খুইলা সিগারেট টানতে পারো, আমি কি কখনো তোমারে কিছু বলছি?
মিজানুর বলে, তুমি ব্রা কই শুকাইতে দাও?
বউ বলে, ক্যান?
মিজানুর বলে, যা বলছি কও!
বউ বলে, বাইরে... তারে... ক্যান?
মিজানুর বলে, আর দিবা না। ব্রা বাথরুমে শুকাইবা... ঠিক আছে?

এরপর থেকে অফিস যাতায়াতে মিজানুর প্রথমে নিজের বেলকনির দিকে তাকায়, দেখে ব্রা ঝুলছে কিনা, তারপর দেখে অন্যদের বেলকনি। প্রথম প্রথম মিজানুরের এই দেখা কেউ দেখে না, খেয়াল করে না কেউ। কিন্তু একদিন ব্যাপারটা লক্ষ্য করে রিয়াজ রহিম। সে তখন আরো কয়েকদিন মিজানুরের যাতায়াত দেখে। এবং সপ্তম দিনের দিন সে নিশ্চিত হয় মিজানুর আসলে এ-ফ্ল্যাটে ও-ফ্ল্যাটে মেয়েদের অন্তর্বাস দেখার চেষ্টা করে। আর এটা বুঝতে পেরে মিজানুরের ওপর খুব মেজাজ খারাপ হয় তার, কিন্তু মিজানুরকে সে কিছু বলে না। সে তার ত্রিশোর্ধ্ব বউয়ের কাছে ভাত খেতে খেতে জানতে চায়, তুমি ব্রা মেলো কই?
ত্রিশোর্ধ্ব বউ কথার সূত্র ধরতে পারে না। বলে, কী বললা?
রিয়াজ রহিম মুখের ভাত এলাতে এলাতে বলে, ব্রা পরো না তুমি?
বউ হাসে। রসিয়ে বলে, ক্যান? তুমি য্যান দেখো নাই?
রিয়াজ রহিম রসের ধার দিয়েও যায় না। বলে, দেখি কি দেখি নাই সেইটা কথা না। তুমি ব্রা খাইচা মেলো কই?
বউ তাড়াতাড়ি বলে, ক্যান বাইরে!
রিয়াজ রহিম বলে, ব্যালকনিতে?
বউ মাথা ঝাঁকায়। তারপর বলে, ক্যান কী হইছে?
রিয়াজ রহিম বলে, আর মেলবা না। ব্রা ভিত্রে শুকাবা!
বউ বলে, ক্যান?
রিয়াজ রহিম বলে, মহল্লায় সব বদ লোক তোমাদের ব্রা দেইখা দেইখা চোখের সুখ নেয়!
বউ বলে, কারা?
রিয়াজ রহিম কারো নাম নেয় না। কিন্তু রিয়াজ রহিমের খোঁজ চলতে থাকে। সে খেয়াল করে দেখে তার বউ ব্রা মেলছে কিনা বেলকনিতে। তার সাথে সাথে সে এও দেখে যে অন্য ফ্ল্যাটের আর কে কে ব্রা মেলে বেলকনিতে। আর তার চোখ সবসময় তীরের ফলার মতো বিঁধে থাকে মিজানুরের দিকে। লোকটা বদ। সবসময় বেলকনির দিকে নজর তার। তার দৃষ্টি ধরে রিয়াজ রহিমের নজরও এ-বেলকনি থেকে ও-বেলকনিতে ঘুরঘুর করে।

রিয়াজ রহিমের এহেন তাকানো আমজাদ সাহেবের চোখে পড়ে। তার বউ পঞ্চাশোর্ধ্ব এবং মৃত্যুর সাথে লড়াইরত। তার বউ ব্রা পরার সুযোগ পায় না। তবু আমজাদ সাহেবের মেজাজ খারাপ লাগে। ঘরে তার দুইটা বৌমা। দুইটাই বিশোর্ধ্ব। এরা ঘন ঘন ব্রা পাল্টায় আর মেলে দেয় বেলকনিতে। বাতাসে ব্রাগুলো বেহায়ার মতো ঝুলতে থাকে। আমজাদ সাহেব এতদিন দেখেও কিছু বলেন নি। কিন্তু রিয়াজ রহিম, এমনকি ওই মিজানুরও যেভাবে বেলকনি বেলকনিতে লোলুপ দৃষ্টি হানে তাতে এ মহল্লায় বাস করাই দুরূহ। কিন্তু ফ্ল্যাটটা তার নিজের। চাইলেই মহল্লা চেঞ্জ করা সম্ভব না। তিনি তাই ছেলেদের ডাকেন। বলেন, তোমাদের সাথে কিছু কথা আছে।
ছেলেরা বলে, বলেন আব্বা।
আমজাদ সাহেব বলেন, দরজাটা বন্ধ করে দাও।
ছেলেরা দরজা বন্ধ করে দেয় দ্বিধার মধ্যে। আমজাদ সাহেব বলেন, মহল্লার অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। আগে এটা ভদ্রলোকের মহল্লা ছিল। সেইটা দেখেই এইখানে ফ্ল্যাট কিনছিলাম। কিন্তু এখন সেই দিন আর নাই।
ছেলেরা বলে, কী হইছে আব্বা? কেউ আপনার সাথে দুর্ব্যবহার করছে? নাম বলেন খালি!
আমজাদ সাহেব বলেন, দুর্ব্যবহার না। কিন্তু মহল্লায় এখন লম্পটের কোনো অভাব নাই।
ছেলেরা কিছু বলতে পারে না। মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। আমজাদ সাহেব আবার শুরু করেন। বলেন, এখন তোমাদের বউরা যে...
বিশোর্ধ্ব বউদের কথা আসতেই সচকিত হয়ে ওঠে ছেলেরা। তাড়াতাড়ি বলে, কী হইছে ওদের? ওদের কেউ কিছু বলছে? স্ল্যাং বলছে? টিজ করছে নাকি? কই ওরা তো কিছু বলে নাই! কে করছে?
আমজাদ সাহেব বলেন, ওইসব না। কিন্তু তবু বউমাদের নিষেধ করিও যে ওই ইয়েগুলো যেন বেলকনিতে না মেলে...
ছেলেরা বলে, কী বাবা? কী মেলে ওরা বেলকনিতে?
আমজাদ সাহেব ইতস্তত করেন। বলেন, ওই যে ব্রাগুলা... ওইগুলা যেন বাথরুমেই শুকায়! মহল্লার লোকেরা খালি বদনজর দেয় ওইগুলাতে!

ছেলেরা তাদের বিশোর্ধ্ব বউদের বলে। বউরা নিজেদের মধ্যে আলাপ করে। তারা কিছুদিন ভুল করে বেলকনিতে ব্রা মেলে দিতে থাকে। আর এই ভুল বারবার করছে কিনা তা জানতে ছেলেরা নিজেদের বেলকনিতে নজর রাখা শুরু করে। নিজেদের বেলকনিতে নজর রাখতে রাখতে তারা অন্যের বেলকনিও দেখতে শুরু করে। অন্যের বেলকনি দেখতে দেখতে তারা মিজানুরকে দেখে, রিয়াজ রহিমকে দেখে, তাদের বাবাকেও দেখে। দেখে যে তারাও অন্যের বেলকনি দেখছে। আর বেলকনিতে তখনো কয়েকটা ব্রা, যারা ভুল করে এখনো মেলে দিচ্ছে, সেগুলো দুলছে। আর তারা ভাবে বাবা ঠিকই বলেছিল যে এই মহল্লাটা আর আগের মতো ভদ্র নাই, এমনকি বাবাও আর ভদ্র নাই। এ নিয়ে তারা হতাশ হয়ে পড়ে। সেই হতাশা এমনকি তাদের বউদের মধ্যেও ছড়ায়। আর হতাশা খানিকটা আগুনের মতো। ছড়াতেই থাকে। ছড়াতেই থাকে। ফলে প্রতিটি ফ্ল্যাটেই মহল্লার আগের পরিস্থিতি আর এখনের পরিস্থিতি নিয়ে তুলনামূলক বিচার হয়। আর বিচার করতে করতে সবাই আরো বেশি করে হতাশ হয়ে পড়ে। তবে এ হতাশা-দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে থাকে স্বামীরা। তাদের হতাশা শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো অবারিত হয়ে ওঠে।

পরের সপ্তাহের শেষের দিকে স্বামীরা একটা ব্যাপার একযোগে কিন্তু আলাদা আলাদাভাবে লক্ষ্য করে। তারা দেখে তাদের বিশোর্ধ্ব, ত্রিশোর্ধ্ব, চল্লিশোর্ধ্ব এমনকি পঞ্চাশোর্ধ্ব বউদের বুকের কাছ থেকে কেমন মরা একটা গন্ধ আসছে। যেন তাদের বউদের বুক শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। এরকম গন্ধ ভাগাড় থেকে কখনো কখনো পাওয়া যায়। কিন্তু জীবন্ত মানুষ ও ততধিক জ্যান্ত মাংসপিণ্ড থেকে এরকম গন্ধ কেন আসছে তারা বুঝতে পারে না। তারা তখন তাদের বউদের প্রশ্ন করে। জানতে চায় এরকম গন্ধ কেন? তারা কি নতুন কোনো লোশন ব্যবহার করছে, নাকি তাদের বডি স্প্রের ধরন পাল্টে গেছে? এরকম গন্ধ বড়জোর লাশের শরীর থেকে পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু তাদের শরীরে কেন? তারা কি লাশ হয়ে যাচ্ছে?

বউরা কিছুদিন এই গন্ধের উৎস খুঁজে পায় না। বিশোর্ধ্ব বউরা নিজেদের গন্ধ শুঁকে শুঁকে দেখে। তারাও স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে একটা চিমসা গন্ধ তাদের বুক অধিগ্রহণ করেছে। তখন এ নিয়ে তারা ত্রিশোর্ধ্ব বউদের কাছে যায়। ত্রিশোর্ধ্বরা জানায় তারাও বিষয়টা জেনেছে তাদের স্বামীদের কাছ থেকে আর তারাও নিজেদের শরীর শুঁকে শুঁকে দেখেছে এবং চামচিকার মতো গন্ধটা তারাও পেয়েছে। এটা কি লাশের গন্ধ? এরকম একটা সন্দেহ তাদের মনেও হয়। বিশোর্ধ্ব তখন ত্রিশোর্ধ্বদের বুকের গন্ধ শুঁকে দেখে এবং নাক কুঁচকে ফেলে। তারা সবাই মিলে তখন চল্লিশোর্ধ্ব বউদের নিকটে যায়। সেখানে আগে থেকেই পঞ্চাশোর্ধ্ব বউয়েরা উপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যেও গন্ধ বিষয়ক বিচলন। চল্লিশোর্ধ্ব বউয়েরা জানায় তাদের স্বামীরা জানানোর আগেই তারা নিজেদের মধ্যে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে আর তারা ধারণা করছে এটা ঘটছে এই লম্পটদের মহল্লায় থাকার কারণে। তারা একটা প্রাচীন গল্প তখন বলতে শুরু করে যে একটা দেশে একটা অতিকায় লম্পট ছিল।

কিন্তু অন্যরা তখন বুঝতে পারে না অতিকায় লম্পট বলতে আসলে কী বোঝানো হচ্ছে। তখন বিশোর্ধ্বরা এক ধরনের কল্পনা করে আর ত্রিশোর্ধ্বরা আরেক ধরনের কল্পনা করে। পঞ্চাশোর্ধ্বরা অবশ্য কোনো কল্পনা করে না। হতে পারে তাদের কল্পনাশক্তি শুকিয়ে গিয়েছে।

আর চল্লিশোর্ধ্বরা গল্প বলেই যায় যে ওই রাজ্যে ওই অতিকায় লম্পট তার বদনজর প্রথমে দেয় কলাগাছের ওপর। আর তাতে তিরিশ দিনের মাথায় কলাগাছের নিচের কাণ্ডটা পচতে শুরু করে। এটা ওই রাজ্যের কেউ বুঝতে পারে না প্রথমে। কিন্তু হঠাৎ তারা খেয়াল করে রাজ্যের সব কলা গাছ ধীরে ধীরে গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে। আর পচতে শুরু করেছে। আর মরে যেতে শুরু করেছে।

এরপর ওই অতিকায় লম্পটটা একদিন নদীর মাছের দিকে নজর দেয়। আর একটা মাসের মধ্যে নদীর মাছগুলো পানির ওপরে ভেসে ভেসে ওঠে। প্রথমে তাদের লেজের দিকে পচন ধরে। তারপর সারা শরীর পচে যেতে থাকে। নদী হয়ে ওঠে পচা মাছের ভাগাড়। রাজ্যের সবাই তখন হায় হায় করে ওঠে। নদীর তাবৎ মাছ মরে যায় দেখে রাজ্যজুড়ে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। আর তখন ওই অতিকায় লম্পট নজর দেয় গাভীর ওলানের দিকে। আর মাস খানেকও সময় যায় না গাভীর ওলান থেকে দুধের বদলে পচা বাসি গন্ধ আসতে থাকে। আর কিছুদিনের মধ্যেই ওলানগুলো ফেটে যেতে থাকে। ফেটে ফেটে ওলানের ভেতর থেকে পচা মাংস বেরিয়ে আসতে থাকে। আর তখন গাভীগুলো চিৎকার করতে থাকে। হাম্বা হাম্বা করে বলতে থাকে ওলান ফেটে গেলে গাভীদের আর কী থাকে! আর চিৎকার করতে করতে গাভীগুলোও গন্ধভরা লাশ হয়ে যায়।

বিশোর্ধ্ব ত্রিশোর্ধ্ব আর পঞ্চাশোর্ধ্ব বউয়েরা তখন আৎকে ওঠে প্রায়। জিজ্ঞেস করে, এ থেকে রাজ্যটি প্রতিকার পেয়েছিল কিভাবে?

চল্লিশোর্ধ্ব বউয়েরা তখন জানায় ওই রাজ্যের সবাই মিলে তখন ওই অতিকায় লম্পটটাকে আটকায়। তারপর সুঁই দিয়ে প্রথমে তার চোখ গেলে দেয়। লম্পটের চোখ ফেটে গেলে তখন তার শরীরের অন্যান্য প্রত্যঙ্গে সুঁই ফোটাতে থাকে, ফোটাতেই থাকে। সুঁইয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে চালের রুটির মতো শরীর হয়ে গেলে তখন অতিকায় লম্পট লাশ হয়ে যায়। তারা সবাই মিলে তখন লাশটাকে নিয়ে কাক-শকুনের জন্য ভাগাড়ে ফেলে দেয়। আর তখন নাকি রাজ্যজুড়ে আবার সুগন্ধ ছড়াতে শুরু করে। কলাগাছ বেঁচে ওঠে, মাছেরা নদীতে লাফায়, আর গাভীর ওলান ফুলে ওঠে দুধে!

বিশোর্ধ্বরা বলে, কিন্তু এইটা শুধুই রূপকথা! আর আমাদের সাথে তো এইগুলা সত্যি সত্যি ঘটছে। আমার বুকে নাক দিয়া দেখেন কেমন তেলাপোকার গুয়ের মতো গন্ধ, দেখেন!

বিশোর্ধ্বরা নিজেদের বুকের গন্ধ শোঁকানোর জন্য তোলপাড় শুরু করে দেয়। ত্রিশোর্ধ্বরাও। চল্লিশোর্ধ্বরাও। পঞ্চাশোর্ধ্বরা চুপ থাকে অবশ্য। তবে কেউ কারো বুক শুঁকতে আর রাজি হয় না। তারা শুধু এই লাশের গন্ধ থেকে মুক্তি পেতে চায়। কিন্তু তাদের করণীয় তারা কিছুই জানতে পারে না। তারা শুধু গন্ধ গন্ধ করতে থাকে। আর এই গন্ধ যেন বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে।

পরের তিনটা মাসে বউদের বুক থেকে এতটাই গন্ধ বের হতে থাকে যে মহল্লা পুরোটা যেন একটা লাশাগার হয়ে দাঁড়ায়। তখন সেখানে গাঁজা খেতে আর রিকশাওয়ালারা আসে না, এমনকি পাড়ার লাফাঙ্গারাও গলিতে ঢুকতে নাক কুঁচকায়। তাদের কাছে মনে হয় এই মহল্লাটা আগেই ভালো ছিল, বসার পরিবেশ ছিল, আড্ডা দেয়ার জায়গা ছিল, এখন আর সেরকম অবস্থা নাই। এখন এখানে বসলেই নাড়ি ওল্টানো গন্ধ আসে। পেট ঠেলে বমি চলে আসে গলায়। লাফাঙ্গারা তাই দূরে দূরে থাকতে শুরু করে। বড়জোর দূর থেকে এই মহল্লাটার ওপর নজর রাখে। এর মধ্যে ওই মহল্লায় যাতায়াত থাকে শুধু ময়লা নেয়ার ভ্যান আর তার চালকের। ওই মহল্লায় ঢুকলে, ফুড়ড়ড়ড় করে বাঁশিতে ফুঁ দিলে বিশোর্ধ্ব ত্রিশোর্ধ্ব চল্লিশোর্ধ্ব এমনকি পঞ্চাশোর্ধ্ব বউরা বেরিয়ে আসে। তাদের হাতে থাকে প্যাকেট প্যাকেট পচা থকথকে কিছু। সেগুলো দিয়ে পচা রস চুইয়ে চুইয়ে পড়ে, আর সেসব থেকে এমন গন্ধ ভেসে আসে যে ময়লার ভ্যানঠেলা চালকটারও পেট উল্টে আসতে চায়। সে বারবার জিজ্ঞেস করে, এগুলার ভিত্রে কী আছে?
বউরা বলে, বুকের ময়লা আছে। বুকে অনেক গন্ধ। বুকের মাংস পইচে গেছে!
ময়লার ভ্যানচালকটা তখন একটু লোভী লোভী দৃষ্টিতে পলিথিনের দিকে তাকাতে চায়, কিন্তু পরক্ষণেই আবারও তার বমি আসে। সে তখন তাড়াতাড়ি বুকের গন্ধওয়ালা মৃত মাংস নিয়ে ভ্যান ঠেলে বেরিয়ে যায়। পরদিন আবার আসে। আবার স্তূপ স্তূপ বুকের মাংস জমা হতে থাকে। গন্ধে বাতাস ভারী হতে হতে নিশ্বাস ফেলার উপায় থাকে না।

তখন এই গন্ধের উৎস খোঁজার জন্য একদিন পুলিশ আসে। পুলিশ জানায় সে লাশের গন্ধ আলাদা করতে পারে। এগুলো তার পচা লাশের গন্ধ বলেই মনে হয়। আর বউরাও বলে যে এগুলো পচা মাংসেরই গন্ধ, এমনকি লাশের গন্ধও ঠিক আছে। পুলিশ ঠিকই বলছে, তবে এগুলো তাদের বুকের পচা মাংসের গন্ধ। তাদের বুকে গন্ধ ধরে গেছে। তাদের বুক এক অদ্ভুত পচা রোগে সংক্রমিত হয়েছে। এই রোগ নিরাময়ের জন্য তারা নানা চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু কোনোভাবেই ভালো হয়ে উঠতে পারছে না।

পুলিশ বউদের কথা বিশ্বাস করে না। সে স্বামীদের খোঁজ করে, কোথাও পায় না। বউয়েরা জানায় এই মহল্লার স্বামীরা সব চলে গেছে। বউদের বুকের এত তীব্র পচা গন্ধ তারা সহ্য করতে পারছে না। তারা সবাই মিলে এখন অন্য জায়গায় থাকে। পুলিশ জানায় এসব অবান্তর কথা সে কোনোমতেই মেনে নেবে না। বউদের সবাইকে তার সাথে থানায় যেতে হবে। কারণ সে তার বাপের জন্মেও এমন বুকের মাংসের লাশ হয়ে যাওয়ার গল্প শোনেনি।

তখন চল্লিশোর্ধ্ব বউরা সেই প্রাচীন গল্পটা আবার শোনাতে থাকে পুলিশকে। জানায় অতিকায় লম্পটের কথা। কিন্তু পুলিশটা অবিশ্বাসী। সে কোনোমতেই বউদের কথা বিশ্বাস করে না। বউরা তখন নিজেদের বুক খুলে পুলিশকে দেখায়। পুলিশ দেখে কোথাও কোনো মাংস পচে নেই, কোথাও কোনো সংক্রামণ নেই। পুলিশ তখন হাতকড়া বের করে। আর অ্যারেস্ট করতে চায় সবগুলো বউকে। বউরা তখন পুলিশকে নিজেদের বুকের গন্ধ শুঁকতে বলে। জানায় এই গন্ধ থেকেই ওই মৃত পচা মাংস বেরিয়ে আসে। পুলিশ তখন গন্ধ শোঁকে। আর শুঁকতে শুঁকতে ভ্যাপসা একটা গন্ধ তার নাকের ভেতর অনুভূত হয়। গন্ধটা প্রথমে তার চামচিকার গন্ধের মতো লাগে, পরক্ষণেই মনে হয় এটা বোধহয় তেলাপোকার গুয়ের গন্ধ, কিন্তু একটু পরেই তার মনে হয় গন্ধটা আসলে পচা মাংসেরই।

পুলিশটা তখন খুব দুঃখপ্রকাশ করে। এভাবে বুকের মাংস মরে পচে গেলে কিভাবে রাষ্ট্র বাঁচবে এ বলে বিকার করতে থাকে। রোগটা দ্রুত নিরাময় হওয়া দরকার এরকম ভাবতে ভাবতে পুলিশ এই মহল্লাকে সিলগালার আদলে গেটগালা করে দেয়। যেন মহল্লাটা বিশেষ কিছু। তখন মহল্লার গলির মুখে দুটো দেয়াল তুলে একটা উঁচু লোহার গেট বসিয়ে দেয়। আর গেটের মুখে বড় একটা তালা ঝুলিয়ে দেয়। নির্বিশেষ যাতায়াতের জন্য গেটের সাথে আরেকটা উপগেট থাকে। সেটা দিয়ে মানুষ যাতায়াত করতে শুরু করে। রিকশাকে দূরে নামিয়ে মানুষেরা খুব শান্তভাবে মহল্লার ভেতর ঢুকে একটা ছিমছাম পরিবেশের ভেতর দিয়ে নিজের নিজের ফ্ল্যাটে যাতায়াত শুরু করে। মহল্লাটা আবার যেন বদলে যেতে থাকে। আর একদিন সকালে অনেক রোদ উঠলে বিশোর্ধ্ব ত্রিশোর্ধ্ব চল্লিশোর্ধ্ব এমনকি পঞ্চাশোর্ধ্ব বউরা তাদের ব্রা নিয়ে বেলকনিতে আসে। ব্রাগুলো এতদিন বাথরুমে শুকিয়ে শুকিয়ে ভ্যাপসা আর চিমসা গন্ধের গুদাম হয়ে গেছে। বউরা রোদ ঝলমল বেলকনিতে ব্রাগুলো মেলে খুব আনন্দ পায়। তখন তাদের মনে হয় এমনও হতে পারে যে ব্রায়ের ওই চিমসা গন্ধটাই হয়ত তাদের বুকে প্রসারিত হয়েছিল। আর এটা ভেবে তারা ঠিক করে কয়েকদিন পর তারা আবারো নিজেদের বুক শুঁকে শুঁকে দেখবে।






প্রথম প্রকাশ:

http://www.banglanews24.com/fullnews/bn/429536.html