শনিবার, ২০ জুন, ২০১৫

পানি খেও



এই গরমে কোথায় আছো, কেমন আছো? পানি খেও।
এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালীর তালপাখাটা
ঘাম জমলে শরীরজুড়ে মাঝে মাঝে চালিয়ে নিও। পানি খেও।
ক্যালেন্ডারের জুন মাসটা পাগল হয়ে ঢালছে রোদ
ডাগর চোখে ডাবের দিকে একটু হলেও তাকিয়ে থেকো, পানি খেও।
মিসরি চিনির আছে যত ঝকমারির শরবতেরা
লেবুপানি রুহআফজা সঙ্গে থাকুক বরফেরা
পানি খেও, পানি খেও।
আর না হলে ঢুকে যেও শপিং মলে, আপত্তি নেই।
টাকা গেলে স্বামীর যাবে, কার কী তাতে?
তুমি না হয় দেখে দেখে জিনিস কিনো, ঘাম শুকিয়ে
শরীরটাকে হিম বানিয়ে
তবেই শপিং মল ছাড়িও, কী আসে যায়?
একটা মাস কতটা আর তপ্ত হবে?
একটা গরম কতটা আর কষ্ট দেবে?

[হেলাল হাফিজের 'প্রস্থান' কবিতা অবলম্বনে]

:: মোদি যেন এক ভাস্কদাগামা ::

মোদি। ঢাকা।২০১৫

মোদি যা দেখলেন:
১। ঢাকা নাকি জ্যামের শহর, এমন শুনে এসেছিলেন মোদি। কিন্তু প্লেন থেকে নেমে দুই দিনের বিস্তর ঘোরাঘুরিতেও তিনি জ্যামের জ্যা দেখলেন না। তিনি বুঝলেন ঢাকার জ্যাম আসলে মিডিয়ার সৃষ্টি।
২।মোদি ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলেন খোদ দিল্লিতে বসে যে সব ইন্ডিয়ান জিনিস পাওয়া যায় না, ঢাকার বাজারে তা হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। সাবান-শ্যাম্পু থেকে শুরু করে শাড়ি চুড়িদার, পেঁয়াজ-ডাল থেকে শুরু করে বাস-ট্রাক-মোটর সাইকেল সব সব পাওয়া যায় এখানে। ছোট্ট একটা ঢাকার ভেতর অতিকায় ইন্ডিয়া কী অসারণভাবে ঢুকে আছে তা দেখে মোদির চোখে আনন্দে পানি এসে গিয়েছিল। তখন তিনি লুকিয়ে তিস্তার পাড়ে গিয়ে কেঁদেছিলেন। আশা ছিল তাতে তিস্তার পানি কিছুটা বাড়বে! কিন্তু তাতেও আপত্তি মমতা দির। তিনি ছুটে এসে টিস্যু দিয়ে মোদিজির চোখ মুছিয়ে দিয়েছিলেন।
৩। মোদি এসে দেখলেন এদেশের মানুষের আনন্দের সীমা নাই। প্রবল কষ্টে এরা কষ্টা পায় না। রগড়ের বিষয় পেলে তো দূর, সিরিয়াস ব্যাপারকেও এরা মজাতামাশায় উড়িয়ে দেয়। এদেশে তিস্তা আর সীমান্তহত্যার মতো ভয়ানক ভাবনা থাকা সত্বেও এরা মোদির টুইটার আর ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে চিড়িয়াখানার বানরের মতো নিজেদের মধ্যে খিলবিল করে। বানর-হনুমান প্রভৃতি মোদি খুব পছন্দ করেন। দেখা হওয়ামাত্র তিনি তাই সব বানরের উদ্দেশ্যে হাত নাড়িয়ে অভিবাদন জানিয়েছেন। মনে মনে বলেছেন, তিস্তাচুক্তি সই না করেও এদের মন জয় করা কত সহজ- স্রেফ বাঙলায় একটা টুইট করে একেবারে কেল্লাফতে!

মোদি যা দেখাতে চাইলেন:
মোদি দেখাতে চাইলেন বাংলা টুইট, ইংরেজি স্ট্যাটাস, জীবনানন্দের কবিতা, ক্রিকেট, সাকিব আল হাসান, সালমা, ওয়াসফিয়া আর বিকাশ (বিক্যাশ নয়)।
মোদিনোট: মোদি যেন এক ভাস্কোদাগামা। আমাদের আবিষ্কার করে গেলেন। আমাদের জানিয়ে গেলেন যা আমরা জানি!

শুক্রবার, ৫ জুন, ২০১৫

একটি ঘরোয়া বাজেট এবং...


গতকালই বাজেট পেশ করেছেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী। কিন্তু এই বাজেটই শেষ বাজেট নয়। প্রত্যেক ঘরে ঘরে প্রতি নিয়ত বাজেট পেশ চলতে থাকে। এরকম একটা ঘরোয়া বাজেটে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক-

স্ত্রী: জনাব স্বামী, শুভেচ্ছা জানাই। আজ এই সুন্দর সন্ধ্যায় আপনি আমার বাজেট শোনার জন্য সময় দিয়েছেন আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। না হলে এই সময়ে সাধারণত আপনি বাইরে বাইরে থাকতেই পছন্দ করেন। আপনাকে পাওয়া যায় চায়ের টং দোকানে। আপনি তখন বর্তমান রাজনীতি আর ক্রিকেট নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করতে বিশেষ আনন্দ পান। আর যে-ই না ঘরে ঢোকেন তখনই আপনার মুখ হঠাৎ করেই বাংলার পাঁচের মতন হয়ে যায়। ভাবা যায় না যে-মানুষটা একটু আগে এত হাসছিল...

স্বামী: মাননীয় স্ত্রী, কাজের কথায় এলে খুশি হবো। টিভিতে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ চলছে। আপনি কথা শেষ করলে সেইটা দেখতে ইচ্ছা রাখি!

স্ত্রী: ও তার মানে আপনি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ দেখতে এসেছেন... আমার বাজেট শোনার জন্য না?

স্বামী: মহোদয়া, দয়া করে আপনার বাজেট পেশ করবেন কী?

স্ত্রী: হ্যাঁ করব। আবারো আপনাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাজেট শুরু করছি। প্রথমেই বলে নেয়া দরকার গত অর্থবছরে আমার দিক থেকে বাজেট ছিল অত্যন্ত কম।

স্বামী: এই কথায় আমার ডাউট আছে মাননীয় স্ত্রী!

স্ত্রী: ডাউট থাকলে পরে বলবেন। তার আগে আমার বাজেট মন দিয়ে শুনুন। এইবার বাজেটে প্রথম যে-খাতে নজর দেয়া উচিত তা হলো মেক-আপ খাত। মেক-আপ খাতে গতবছর নজর না দেয়ায় আমার দুয়েকটা চুল দেখছি সাদা...

স্বামী: মাননীয় স্ত্রী, আপনার বয়স হয়েছে এই জন্যই...

স্ত্রী: চুপ থাকুন আপনি। এই অর্থবছরে মেক-আপের জন্য অবশ্যই অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। মাসে চার দিন চুল কাটাতে, প্রতিদিন ফেসিয়াল, ম্যানিকিউর পেডিকিওর, ভ্রুচর্চা ইত্যাদির জন্য প্রতিমাসে ৫০ হাজার টাকা হিসেবে ১২ মাসে ৬ লাখ টাকার বরাদ্দ ধরা হয়েছে।

স্বামী: কী বলছেন মাননীয় স্ত্রী?

স্ত্রী: ঠিকই বলছি। প্রয়োজনে আপনার চা-সিগারেট ও আড্ডার টাকা কমিয়ে মেক-আপ বাজেটকে মেক-আপ করতে হবে। এই বাজেট পাশ হওয়া অত্যন্ত জরুরী। আর মেক-আপ বাজেটের পরেই যে বাজেট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা হলো শপিং বাজেট। শপিং শুধুই কেনাকাটা নয়, শপিং হলো সামাজিক মেলামেশা, শপিং ঘোরাফেরা, শপিং হলো বিনোদন। তাই একটি মানুষের শপিং অধিকার হলো সবচেয়ে বড় অধিকার। এই অধিকারের জোরেই বলছি গত অর্থবছরে যেমন আমাকে শপিঙের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল এই অর্থবছরেও যেন তেমনটাই থাকে। মাসে অন্তত তিনটা শাড়ি জামদানি ঘরে আমদানি না হলে ফ্ল্যাটের অন্যান্য ভাবিদের কাছে মাথা হেট হয়ে যায়। তাদের সোজা সোজা কথাবার্তাকেও বাঁকা মনে হয়। মনে রাখবেন, শাড়িই নারীর ভূষণ! পারলে তিনের অধিক শাড়ি আর সালোয়ার কামিজ গোটা সাতেক প্রতিমাসে কিনে রাখতেই হয়। এ ব্যাপারে আপনার বিশেষ সহযোগীতা কামনা করছি। আপনার যদি মনে হয় এই খাতে অধিক টাকা ব্যয় হতে পারে এবং ঘরের অন্য বাজেটের ওপর প্রভাব পরতে পারে তাহলে আপনার যাতায়াত খাতে যে বাজেট আছে সেখানে হাত দিন। সেই খরচটা কমিয়ে আনুন। প্রতিদিন যাতায়াত বাবদ কেন আপনার একশর অধিক টাকা লাগবে সেটা জানিয়ে একটা মিনি বাজেট আপনি আমাকে পরে দিতে পারেন। মাননীয় স্বামী, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?

স্বামী: জ্বি আমি শুনছি জনাবা। তবে আমার গলা কিছুটা শুকিয়ে গেছে। আমি কি একগ্লাস পানি পেতে পারি?

স্ত্রী: পানি ফ্রিজে আছে, আপনি উঠে গিয়ে নিয়ে আসতে পারেন, তবে এখনি পানি খাওয়া আপনার ঠিক হবে না। আপনাকে শোনানোর জন্য আরো কিছু বাজেট খাত রয়েছে আমার কাছে। আমার পরের বাজেট খাত অত্যন্ত গুরুতর। এ ব্যাপারে আগে কখনোই ঠিকমতো দৃষ্টি দেয়া হয় নি। ফলে এখন ভুগতে হচ্ছে।

স্বামী: কোন খাতের কথা বলছেন আপনি মাননীয়া?

স্ত্রী: পেট খাত।

স্বামী: মানে খাওয়া-দাওয়ার খাতের কথা বলছেন কি?

স্ত্রী: জ্বি না মাননীয় স্বামী। আপনার আইকিউ চিরজীবন খ্যাত লেভেলেই থেকে গেল দেখে আমি খুব বেশি অবাক হচ্ছি না। আপনার আর উন্নতি হবার নয়। গাছ বেড়ে ওঠে, একদিন পাতা থেকে ফুল আর ফল দেয়। আপনি নিতান্তই নিস্ফলা ফরমালিন হয়ে থেকে গেলেন!

স্বামী: ফরমালিন খুবই কাজের জিনিস মহোদয়া! কিন্তু পেটখাত বলতে আপনি আসলে কী বোঝাতে চাচ্ছেন যদি একটু খুলে বলতেন?

স্ত্রী: আপনার আরেকটি বাজে স্বভাব সবকিছুকেই আপনি খোলাখুলি পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান। কথা ব্লাউজ না যে খুলে বলতে হবে! পেটখাত মানে আমি আমার পোষা প্রাণীগুলোর কথা বলছি। আমার গুগলু বিড়ালটার বেশ কিছু দিন থেকেই মন খারাপ। তার বিনোদনের বিশেষ অভাব। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাকে কিছুদিন সিঙ্গাপুর ঘুরিয়ে আনবো। আর আমি গেলে আমার জানের টুকরা বেবিডগটা যাবেই। সো, আমাদের তিনজনের সিঙ্গাপুর যাওয়ার ব্যবস্থাও আপনাকে করতে হবে। আর এই ব্যবস্থাটাকে নিয়মিত করে নিয়ে আসতে হবে। তিন মাসে অন্তত একবার পাঁচ ছয়দিনের জন্য আমার পেটগুলোর বিদেশভ্রমণ জরুরি। এই বিষয়ে মাননীয় স্বামী আপনার কোনো ধানাই-পানাই শুনতে আমি রাজি নই।

স্বামী: কিন্তু এত টাকা আমি কীভাবে...

স্ত্রী: সেইটা আপনার হেডেক মাননীয় স্বামী, আপনি আপনার হুদাহুদি বুড়িগঙ্গা ঘুরাঘুরি আর বন্ধুদের সাথে বারেবারে বার যাওয়া কমিয়ে দিলেই এটা হওয়া সম্ভব!

স্বামী: আমি তো ওগুলোতে আমার বিজনেস ডিল করে থাকি...

স্ত্রী: আপনি কোথায় কী ডিল করেন তার সবই আমি জানি! ডিল করে যখন বাসায় ফেরেন তখন আপনার চোখ থাকে ঝাপসা! কান থাকে গরম! আর গলা থাকে বিড়ালের বাচ্চার মতোন। সারাদিন ডিলের পর আপনি সারা রাত মিউ মিউ করেন! অতএব আপনার ডিল আপনাকে... বুঝতে পেরেছেন?

স্বামী: জ্বি জনাবা। আমি কি এবার পানি খেতে পারি? অত্যন্ত গরম পড়েছে। সঙ্গে গলাটাও শুকিয়ে গেছে। কিছু যদি মনে না করেন তাহলে এবার উঠি...

স্ত্রী: আমারও ওঠার সময় হয়ে গেছে। তবে তার আগে বাজেটের শেষ অংশ হিসেবে এখন আমি যে-খাতটির কথা বলব তা হলো বাপের বাড়ি ভ্রমণ বিষয়ক খাত। এই খাতটি গত অর্থ বছরের চেয়েও আরো স্মুথলি ডিল করতে হবে। আপনি জানেন প্রত্যেক সপ্তাহেই আমার বাপের বাড়িতে নানা রকমের অনুষ্ঠান লেগে থাকে। সেই সব অনুষ্ঠানে...

স্বামী: মাননীয়া স্ত্রী আমার অত্যন্ত পিপাসা পেয়েছে... পানি খাওয়া বিশেষ দরকার!

স্ত্রী : ঠিক আছে আপনাকে উঠবার অনুমতি দেয়া স্বামী মহোদয়!

স্বামী উঠে দাঁড়াতেই তলপেটে চাপ অনুভব করল। পেশাব চেপেছে ভীষণ। ওদিকে পিপাসাতে গলা খসখস করছে। পানি না পেশাব এই রকম দ্বন্দ্বে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে স্বামী আগে পেশাব করে এল। তারপর ফ্রিজ খুলল। কিন্তু ফ্রিজের দরজা খুলতেই নিজেকে বাথরুমে আবিষ্কার করল? স্বামীর মাথা অনেক আগে থেকেই ঘুরাচ্ছিল, এখন একেবারে চক্কর দিয়ে উঠল। এইটা যদি বাথরুম হয় তাহলে সে পেশাব করে এল কোথায়?

আমার আঙুলগুলোর মধ্যে একটি নষ্ট হয়ে গেছে




আমার হাত। হাতে ছড়ানো শাপলার মতো পাঁচটি আঙুল। সুষম বণ্টন তাদের। একটির চেয়ে আরেকটি সুন্দর। একটির চেয়ে আরেকটির দৈর্ঘ যতটুকু দীর্ঘ বা খর্ব হওয়া উচিত ঠিক ততটুকুই। আমি আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আমার আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রোমাঞ্চিত হই। আমার মনে হয় কবজির মতো জায়গাটা আসলে বৃন্ত আর আঙুলগুলো ফুলের পাঁপড়ি। আমি হাঁটতে হাঁটতে আমার ঝুলন্ত হাতের দিকে তাকিয়ে ফুলের ঘ্রাণ পাই।

ফুলের পাঁপড়িগুলো, আসলে আঙুলগুলো আমি চিনতে শিখেছিলাম শৈশবেই। প্রথমে যে নামটা শিখেছিলাম তা হলো বুড়ো আঙুল। আঙুলের সাথে বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকেই সখ্যতা থাকে। বুড়ো আঙুলের সাথে সে সখ্যতাটা একটু বেশি। এটা চুষে চুষে একটা লম্বা সময় বাচ্চাদের যায়। তো এই আঙুলের নাম যখন জানতে পারলাম বুড়া তখনই তাকে বেশ আপন মনে হতে লাগল। কারণ আমাকে মাঝে মধ্যে বুড়া বলে ডাকা হতো। আমি একটা আত্মীয়তা পেলাম আঙুলটার সাথে।

কনিষ্ঠাকে চিনলাম কিন্নি আঙুল বলে। তাও খুব অদ্ভুতভাবে। পাড়ায় খেলার সময়। আমরা লুকাচুন্নি খেলছিলাম। একটা গোল করে তার মধ্যে চোর বসিয়ে আমরা সবাই লুকিয়ে পড়ছিলাম। আর বারবার চোর হচ্ছিল প্রিমা। আমাদের বয়স তখন চার পাঁচ হয়তো। প্রিমা কোনোভাবেই আমাদের খুঁজে না পেয়ে হঠাৎ কেঁদে ফেলল। আমি বেরিয়ে এলাম আড়াল থেকে। গোলে গিয়ে দাঁড়ানোর বদলে প্রিমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। প্রিমা আমাকে দেখেই মাটি থেকে একমুঠ ধুলা উঠিয়ে ছুঁড়ে দিলো আমার মুখে। মেয়েদের নিষ্ঠুরতার সাথে সেই প্রথম আমার পরিচয়। আমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর প্রিমা দৌড়ে পালিয়ে গেল বাড়ির দিকে্ আমি কাঁদবো কিনা অনেকক্ষণ বুঝতে পারলাম না। রবি এসে বলল, তুই আর প্রিমার সাথে কথা বলিস না! আড়ি নিয়া নিস!
আমি তাকালাম রবির দিকে। আড়ি কীভাবে নিতে হয় আমি জানি না। রবি তার কিন্নি আঙুলটা বের করে দেখালো। কিন্নি আঙুলের সাথে কিন্নি আঙুলের ঠোকাঠুকি হলেই আড়ি হয়ে যায়। আমি রবির কিন্নি আঙুলের দিকে আমার কিন্নি আঙুলটা বাড়াতেই রবি আঁৎকে উঠল। সর্বনাশ! দুজনের কিন্নি আঙুল ছুঁয়ে গেলেই তো আড়ি। তখন আমরা অন্তত তিন দিন কথা বলতে পারবো না। রবির সাথে কথা না বলে থাকা মুস্কিল। প্রত্যেক দুপুরে ওকে নিয়েই তো আমি আম চুরি করতে যাই। অতএব, নো আড়ি।

কিন্তু পরদিন প্রিমা এলেই রবি আমার কিন্নি আঙুলটা ধরে বাড়িয়ে দিল প্রিমার দিকে। আমি আড়ি চাই। প্রিমাও চায় কিনা বোঝা গেল না। কিন্তু প্রিমার যে প্রিয় বন্ধু সে প্রিমার কিন্নি আঙুলটা বাড়িয়ে দিল। আমাদের দুজনের আঙুল স্পর্শ করল আড়ির উদ্দেশ্যে। আড়ি আড়ি আড়ি। কিন্তু মজা হলো আমার আর প্রিমার আড়িটা শুধু থাকল রবিদের সামনে। আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম। লুকিয়ে লুকিয়ে আমসত্ত বিনিময়ও করতে থাকলাম। আমাদের ঠিকঠাক বয়স হলে আমরা হয়তো ওই আড়ির জন্য প্রেমেই পড়ে যেতাম। তাই আড়ি কিন্তু ভালো। ভালো আমার প্রিয় কিন্নি আঙুল, মানে কনিষ্ঠাও।

আমাদের বাড়িতে মুজিবের একটা ছবি ছিল। তখন এরশাদের সময় বলে মুজিবের ছবিটা খুব একটা যত্নে ছিল না। ফ্রেমে বেশ ধুলোবালি জমেছিল আবার ছবিটাও কিছুটা বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। ছবিটায় মুজিব একটা আঙুল তুলে বুক চিতিয়ে কী যেন বলছিল। বোধহয় ইয়াহিয়াদের শাসাচ্ছিল। ছবির নিচে লেখা ছিল 'তোমার তর্জনীতে বাংলাদেশ'।
ততদিনে বাংলা বেশ পড়তে পারি। কিন্তু তর্জনীতে বাংলাদেশ ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না কিন্তু মুজিবের ওই তর্জনী দেখে, তর্জনীর মহিমা বুঝতে পারি। তর্জনী এক শক্তিশালী আঙুল। তর্জনী এক প্রত্যয় ও অবজ্ঞা। হ্যাঁ অবজ্ঞাও মনে হতো তখন। তখন কোনো বন্ধু আমার দিকে তর্জনী তুললে আমার খুব রাগ হতো। সেলু একবার আমার দিকে তর্জনী তুলেছিল দেখে আমি ওর তর্জনী ভেঙে দিতে চেয়েছিলাম। ওর ওই আঙুলটা ধরে ঘুরিয়ে দিয়েছিলাম। সেলু কঠিন চিৎকার না করলে ওইদিন সে তার তর্জনী হারিয়ে ফেলতো। আমার মনে হয় মানুষ তর্জনী হারিয়ে ফেললে মর্যাদা হারিয়ে ফেলে। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। শক্তি হারিয়ে ফেলে।
কিন্তু সব তর্জনীতে শক্তি থাকে না। একটু বড় হয়ে যখন নানা উপপাতি নেতাদের সমাবেশে গিয়েছি দেখেছি তারা কী নির্মমভাবে মুজিবের তর্জনী হেলনী নকল করার চেষ্টা করছে। চেষ্টা করছে এবং ব্যর্থ হচ্ছে। সব তর্জনী হয়ে ওঠে না। তবে তাতে তর্জনীর মহিমা বিন্দুমাত্র কমে না। ছড়িয়ে রাখা আঙুলগুলোর দিকে তাকালেই মনে হয় একটা অনড় প্রত্যয় তর্জনী হয়ে এক ঔদ্ধত্ব হয়ে ফুটে আছে।

আরেকটু বড় হলে, কৈশোরের শেষের দিকেই, হঠাৎ অনামিকা কাল তৈরি হয় যেন। অনামিকা নামটাই কী অদ্ভুত না? তর্জনীর পর, মধ্যমা, আর তারপরেই অনামিকা। আঙুলটির নাম নেই। আর এই নাম না থাকা প্রকাশ করে যে নামটি সে নামটি কী সুন্দর। অনামিকা। অনামিকা। আর এই আঙুলটি যেন তোমার হৃদয়ের কথা বলে। তোমার হৃদয়কে প্রকাশ করে। সবাইকে দেখায় দেখো এই ছেলেটির একটি হৃদয় আছে। আর সে হৃদয়ের মধ্যে কোনো এক নারী রয়েছে। আর রয়েছে বলেই সে এই আঙুলটিতে একটি বন্ধনের চিহ্ন দিয়ে রেখেছে।
আমার অনামিকা প্রথম বেঁধেছিল যে নারী তার স্পর্শ মনে পড়ে। একটা ঘাস ছিঁড়ে সে সেটি খুব অদ্ভুত উপায়ে আমার অনামিকায় পরিয়ে দিয়েছিল। তখন খটখটে দুপুর ছিল। কিন্তু আমার মনে পড়ে অনামিকায় ঘাসের বাঁধন পড়তেই দুপুরটা লহমায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। রোদজ্বলা আকাশটা হিম শীতল হয়ে গিয়েছিল। পরে জেনেছিলাম, হৃদয়ের উত্তাপ এমন বিভ্রম ঘটায়। আর অনামিকা হৃদয়ের কথা বলে। হৃদয়ের আয়না হয়ে দাঁড়ায়। অনামিকা হৃদয় আর জগতকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে মুচকি মুচকি হাসে। অনামিকাকে তাই ভালোবেসে ফেলি। অনামিকার দিকে তাই অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি। অনামিকা নাকের কাছে ধরলে হৃদয়ের ঘ্রাণ পাই। ঘ্রাণে যেন কাঁঠালিচাঁপার স্বাদ থাকে। আমি ঘুমিয়ে পড়ি, আমার অনামিকা জেগে থাকে।

বাকী থাকে মধ্যমা। মধ্যমাকে আমার মনে হয়েছিল একটা নৌকার মাস্তুল। মনে হয়েছিল মধ্যমা আমার এই সমস্ত অসমতাকে এক স্থির বিন্যাস দেয়। আমাকে দীপ্ত রাখে। আমার আঙুলকে সচল রাখে। কিন্তু এই দুর্দান্ত ধী একটি আঙুলের দিকে আমি আর তাকাতে পারি না। আমার মনে হয় আমার এ আঙুলটি নষ্ট হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আমার এই মধ্যমায় ধরেছে কোনো নীরব পচন। যা থেকে খুলে খুলে আসছে মাংস। যে আঙুল থেকে আমি ঘ্যাণ পেতাম এতকাল সেখানে এখন নর্দমার দুর্গন্ধ পাই। আঙুলটি আর ধীয়ের থাকে না। স্রেফ এক কুৎসিত চিহ্ন হয়ে থেকে যায়। অথচ আমার আঙুলটি পশ্চিম ঘুরতে যায় নি। অথচ আমার এই সুন্দর আঙুলটি উড়তে চায় নি। অথচ আমার এই সুন্দর মধ্যমা কোনোদিনই স্খলিত হতে চায় নি। আমি কখনই চাই নি আমার কোনো আঙুল fuck নির্দেশ করবে। আমি জানি আমার আঙুলগুলো এরচেয়ে অনেক সৌন্দর্যমন্ডিত। আমার আঙুলে দ্রোহ-প্রেম-বিশ্বাস-হৃদয়-ছোটবেলা সব আছে, কেবল fuck নেই। অথচ এরপরেও আমি আমার মধ্যমা কোথাও দেখাতে পারি না। আঙুলের বিন্যাসে যেন মধ্যমা ধীরে ধীরে গুটিয়ে যাচ্ছে। অথচ মধ্যমা আর তর্জনীর ফাঁকে সিগারেট না গুঁজলে আমার ধূমপান হয়ে ওঠে না। মধ্যমা চিবুকে না ছোঁয়ালে আমার চিন্তা গাঢ় হয় না। আমি মধ্যমার বিস্তার চাই। আমি চাই আমার এই ফুলের পাপড়ির মতো মধ্যমা কোনো দুঃস্থ চিহ্ন না হয়ে শিল্প হয়ে উঠুক। আমি আমার আঙুলকে নষ্ট করে ফেলতে চাই না।



ছবি: গুগল