বুধবার, ১৬ মার্চ, ২০১৬

এই কাকাতুয়া লইয়া আমি কী করিব?

অাঁকা: তুলি: এই নাও তোমার কাকাতুয়া! এ রকম কাকাতুয়ার আমার দরকার নাই!
আমি মিলির দিকে তাকালাম। মিলির হাতে খাঁচা, খাঁচার ভেতর কাকাতুয়া। মিলির চেহারা হয়ে আছে কাকতাড়ুয়া। আমি বললাম, ‘হঠাৎ! কী হয়েছে?’
: কী হয়েছে মানে? মানুষ জন্মদিনে কত কী দেয়, আর তুমি দিলে কী—একটা কাকাতুয়া!
: আমি তো সবার মতো না! কাকাতুয়া একটা একসেপশনাল গিফট! তোমাকে রোজ কানের কাছে শোনাবে—মিলি, তোমাকে ভালোবাসি...মিলি তোমাকে ভালোবাসি!
: তাহলে তো ভালোই হতো। এই কাকাতুয়ার মুখে বাংলা কোনো শব্দ নাই। সারা দিন হিন্দি শব্দ আর হিন্দি আইটেম সংয়ে মাথাটা আমাদের আউলায় দিছে!
: কী বলছ! কাকাতুয়া হিন্দি বলছে!
: হ্যাঁ। তাকে যে বারান্দায় রাখা হয়, সেখান থেকে পাশের বাসার টিভি রুম খুব কাছে। আর ওই বাসায় সারা দিন হয় হিন্দি সিরিয়াল না হয় হিন্দি সিনেমা চলছে! এখন আমাদের ঘুম ভাঙে তোমার এই কাকাতুয়ার গানে!
: গান তো খুবই ভালো জিনিস! বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, সকালে গান মানুষকে সতেজ আর...
: রাখো তোমার সতেজ! কী গান গায় জানো?
মিলি আর কিছু বলার সুযোগই পেল না, কাকাতুয়াটা গেয়ে উঠল, ‘ইউ আর মাই ছাম্মাক ছাল্লো...ইউ আর মাই ছাম্মাক ছাল্লো!’
মিলি আমার দিকে তাকিয়ে হতাশ হয়ে বলল, ‘বুঝতে পেরেছ? সেদিন ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “ও কাকাতুয়া, তোমার নাম কী?” ও কী বলে জানো?’
: কী?
: তুমিই জিজ্ঞেস করে দেখো!
আমি কাকাতুয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘নাম কী তোমার?’
কাকাতুয়া চোখ পাকিয়ে বলল, ‘রিশতেমে হাম তুমহারা বাপ লাগতাহে, নাম হে কাকাতুয়া!’
আমি বিস্মিত। এ তো গড়গড় করে হিন্দি বলছে! মিলি করুণমুখে বলল, ‘অনবরত বলছে! তুমি তো জানোই, আব্বুর গায়ের রং একটু শ্যামলা। আব্বুকে দেখামাত্র এটা বলে ওঠে, “কিতনে আদমি থে কালিয়া! কিতনে আদমি থে কালিয়া!” আর আম্মু সামনে গেলেই বলছে, “পেয়ার কিয়া তো ডারনা ক্যায়া...পেয়ার কিয়া তো ডারনা ক্যায়া!” আব্বু ভীষণ খেপছে এটার ওপর! আর আব্বু এ-ও জানতে পেরেছে যে এই পাখিটা তুমি আমাকে দিয়েছ!’
: সর্বনাশ!
: আরও সর্বনাশ আছে! আব্বু বলেছে, যে ছেলের কাকাতুয়া এ রকম হিন্দি বকে, সে ছেলেও নাকি হিন্দি বকে! সারা দেশই নাকি হিন্দি বকাউল্লায় ভরে গেছে। আব্বু বলেছে, তোমাকে যেন বলি, এই কাকাতুয়াকে তুমি বাংলা শেখাবে!
: কী?
: হ্যাঁ। আমাকে বলেছে, ওই ছেলে যদি কাকাতুয়াটাকে বাংলা শেখাতে না পারে, তাহলে আমি যেন আর কোনো দিন তার চেহারা না দেখি!
: এসব কী বলো তুমি?
: ঠিকই বলছি। এবার বুঝতে পারছ তো তোমার একসেপশনাল গিফটের ফ্যাঁকড়া? হয় এটাকে বাংলা শেখাও, না হলে আমাকে ভুলে যাও!
মিলি গটগট করে চলে গেল। কাকাতুয়াটা বলে উঠল, ‘নিকাল গায়া নিকাল গায়া!’
মানুষ ভালোবাসার জন্য কত কীই–না করে। কেউ দৈত্যকে মেরে রাজকন্যা নিয়ে আসে, কেউ সাগর সেঁচে মুক্তা আনে, কেউ তাজমহল বানায়, কেউ রাজমহল বানায়, আবার কেউ কেউ বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যায়! কাকাতুয়াটাকে নিয়ে আমার উন্মাদ হওয়ার দশা হলো। শুরু হলো আমার কাকাতুয়াকে বাংলা শেখানো।
কিন্তু কী করে শেখাব বাংলা? আমি তার সামনে গিয়ে বলি, ‘ক...’
কাকাতুয়া বলে, ‘ক্যায়া?’
: ক! ক!
: ক্যায়া, ক্যায়া?
আমি নিশ্বাস ফেলি। কলবেল বাজলে কাকাতুয়া বলে, ‘মেহমান আয়া, মেহমান আয়া!’ তারপর একা একা সুর করে গান গায়, ‘বালাম পিচকারি, জো তুনে মুঝে মারি...’
আমি আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলি। হায় মিলি! কী কুক্ষণে তোমাকে এই উপহার আমি দিয়েছিলাম!
আমার মেসের রুমে টিভি নেই, বাংলা শেখাতে তাই চালু করলাম এফএম রেডিও। কাকাতুয়াকে বললাম, ‘খুব মনোযোগ দিয়ে শোনো! তোমাকে এগুলো বলতে হবে!’
কাকাতুয়াও ঘাড় বাঁকিয়ে প্রস্তুত। তখনই কোনো এক আরজে বলে উঠল, ‘হাই লিসেনারস, তোমড়া শুনবা একটা মাস্তিভরা ট্র্যাক, যেটা আমারও খুব হট অ্যান্ড হট ফেবারিট! সো, চলো রক করি আর স্মৃতির দুয়ারে নক করি অ্যান্ড সাথে সাথে আমাকে এসএমএস কড়তেও ভুল্লো না কিন্তু!’
আমি চট করে রেডিওটা বন্ধ করে দিলাম। এই বাংলা তো হিন্দির থেকেও ভয়ংকর! আমি আবার চেষ্টা করি। বলি, ‘বলো অ-তে অজগরটি আসছে তেড়ে...’
কাকাতুয়াটা বলে, ‘বেবি ডল মে সোনেদি...’
আমি বলি, ‘আ-তে আমটি আমি খাব পেড়ে...’
কাকাতুয়া হাই তুলে বলে, ‘মুঝে নিদ আয়া রাহাহে...’। বলেই সে ঘুমিয়ে পড়ল। আমি পড়লাম বিপাকে। জীবনে যে এমন যন্ত্রণারও মুখোমুখি হতে হবে, তা কখনো ভাবিনি। নিয়ে এলাম আমাদের বন্ধু পারভেজকে। পারভেজ কবিতা লেখে। কী লেখে আমরা বুঝতে পারি না। কিন্তু কঠিন কঠিন শব্দ যেহেতু থাকে তার কবিতায়, সেহেতু কবি হিসেবে তাকে আমরা গুরুত্ব দিই। বললাম, ‘পারভেজ, এখন তুই-ই ভরসা!’
: কোনো চিন্তা কোরো না, দোস্ত। আমার কবিতা শুনে পুরা জাতি ভাষা শিখতে আছে, তুমার একটা পাখি কোন ছার!
পারভেজ তার বিক্রি না হওয়া কবিতার বই নিয়ে কাকাতুয়ার সামনে বসল। শুরু করল কবিতা পড়া। গ্যাস বেলুন, হাহাকার, মস্তিষ্ক, নিরেট, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, চক্রাতিচক্র—ইত্যাদি শব্দ তার আবৃত্তিতে ঘুরেফিরে আসতে থাকল। এদিকে কাকাতুয়াটা আচানক জ্ঞান হারাল খাঁচার ভেতর একটা লাফ দিয়ে। মাথায় পানি-টানি ঢেলে কোনোরকমে তার জ্ঞান ফেরানো হলো। পারভেজ তার দ্বিতীয় কবিতাটা পড়তে যাবে, তখন বললাম, ‘থাক দোস্ত, তুই আর কিছু পড়িস না। তোর কবিতা শুনতে শুনতে আমারই কেমন বুক ধড়ফড় করে, মাথা ঝিমঝিম করে, আর ওটা তো সামান্য একটা কাকাতুয়া!’
পারভেজ চলে গেল। আমাকে ফেলে গেল অথৈ সমুদ্রে। আমার রুমের উল্টো দিকের রুমটায় থাকেন রাব্বি ভাই। রাব্বি ভাই নিজেকে গায়ক হিসেবে পরিচয় দেন। প্রতি সকালে উঠে দীর্ঘক্ষণ ‘আআআআআ’, ‘ওওওওওও’ প্রভৃতি করে খুব কর্কশ স্বরে রেওয়াজ করেন। আমি ভাবলাম, কবিতায় যদি না হয়, তাহলে গানই তো একমাত্র ভরসা!
রাব্বি ভাই বিপুল উৎসাহে রাগ-বিরাগ শুরু করলেন আর কাকাতুয়া ঝিমাতে শুরু করল। অবস্থা বেগতিক দেখে রাব্বি ভাইকেও বিদায় দিলাম। বুঝলাম, মিলির সঙ্গে আমার ব্রেকআপ হতে আর দেরি নেই!
এ রকম সময়ে মেসে আগমন ঘটল আরেকটা কাকাতুয়ার। হিমেল ভাই কাকাতুয়াটা পেয়েছে তার ফুফুর বাসা থেকে। আমার কাকাতুয়াটা নতুন কাকাতুয়াটাকে দেখে ভীষণ খুশি। সে হিন্দিতে তাকে নানা রকম কথা বলে। কিন্তু নতুন কাকাতুয়া হিন্দি জানে না বলেই মনে হলো। নতুন কাকাতুয়াটা বাংলায় বলল, ‘কী?’
আমার কাকাতুয়াটা গম্ভীর হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকল। তারপর বলল, ‘ভালোবাসি ভালোবাসি!’
নতুন কাকাতুয়াটাও তখন বলল, ‘ভালোবাসি ভালোবাসি!’
আমরা মুগ্ধ হয়ে দুই কাকাতুয়ার বাংলা কথোপকথন শুনতে থাকলাম। মিলির সঙ্গে বোধ হয় আর আমার ব্রেকআপটা হলো না!

ঘুড়ির নাম ঘোরাঘুড়ি

অলংকরণ: তুলিঅলংকরণ: তুলিড্রয়িং খাতায় ঘুড়ি আঁকল তুলতুল। ঘুড়ির ভেতর বড় বড় চোখ, চোখের নিচে মুখ। রং চড়াল তাতে। বাহ্! দারুণ তো! ছুটল তুলতুল ভাইয়াকে দেখাতে। ভাইয়া তখন গেম খেলছে কম্পিউটারে। ঠাস ঠাস করে বাটন চাপায় ব্যস্ত।
: ভাইয়া দেখো, ঘুড়ি এঁকেছি!
: খুব ভালো।
: এই ঘুড়িটার নাম কী জানো? নাম হলো ঘোরাঘুড়ি। এতে চেপে আকাশে ঘোরা যায়!
: ভাগ তো এখন! শুধু বানিয়ে বানিয়ে কথা!
ঠাস ঠাস করে গেম খেলতেই থাকল ভাইয়া। তুলতুলের মনটা একটু খারাপ হলো। তার ঘুড়িটা দেখলই না ভাইয়া!
দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে বাসার সবাই ঘুম। তুলতুল একা কী করে? ছবি আঁকবে? কিসের ছবি? মেঘের ছবি? সাদা সাদা তুলতুলে সব মেঘ? মেঘের ছবি আঁকবে বলে ড্রয়িং খাতা যেই খুলেছে তুলতুল, অমনি খাতার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল ইয়া বড় এক প্রজাপতি।
প্রজাপতি? আরে নাহ! ওটা তো তারই আঁকা ঘুড়ি। চোখ আছে। মুখ আছে। বলছে, ‘কোনো কিছুর গন্ধই পাচ্ছি না! আমার নাক আঁকোনি কেন মেয়ে?’
: নাক?
: হ্যাঁ নাক! নাক ছাড়া আমি গন্ধ শুঁকব কীভাবে?
: তুমি কি ঘোরাঘুড়ি?
: নয়তো কী! আমি শুধু উড়ে উড়ে, ঘুরে ঘুরে বেড়াই!
: উড়তে পারো? ঘুরতে পারো?
: নয়তো কী! চলো!
বলেই ঘুড়িটা তুলতুলকে ধরে দিল টান। একঝটকায় চড়িয়ে নিল পিঠে। তুলতুল তো খুবই অবাক। বলল, আরে আরে যাচ্ছ কোথায়?
: মেঘের দেশে। তুমি না মেঘের ছবি আঁকবে!
: তুমি জানলে কীভাবে?
: সবই জানি! শুধু গন্ধ শুঁকতে পারি না। তুমি তো আমার নাক আঁকোনি।
বলতে বলতে ফড়ফড় করে ঘুড়ি বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। ওরে বাবা! উঁচু থেকে দেখতে সবকিছু কী অদ্ভুতই না লাগছে! একটু ভয়ও হচ্ছে তুলতুলের। কিন্তু তুলতুল কিচ্ছু বলল না ঘুড়িকে। ঘুড়িটা উড়তে উড়তে চলে এল অনেক উঁচুতে। এখান থেকে নিজের বাসাটা দেখতেও পাচ্ছে না তুলতুল। শহরের সব দালানকোঠা যেন পুতুলের বাড়িঘর। অনেক নিচে ছোট ছোট পিঁপড়ের মতো গাড়ি। তুলতুলের চুল উড়ছে। খিলখিল করে হাসছে সে।
এমন সময় তার ঘাড়ের কাছে কী যেন লাগল ঠান্ডামতো। ঘাড় ঘোরাতেই দেখল সাদা ভালুকের মতো এক টুকরা মেঘ। লাফিয়ে উঠল তুলতুল। মেঘ! কী মজা! হাত বাড়িয়ে তুলতুল ধরল মেঘটাকে। কিন্তু ধরামাত্র মেঘটা পানি হয়ে গেল। হাত গেল ভিজে। কী ঠান্ডা মেঘ!
তখনই উড়ে এল একঝাঁক পাখি। তুলতুলকে দেখে তারা কিচিরমিচির করে উঠল। তুলতুল বলল, ‘দেখো, আমিও তোমাদের মতো উড়তে পারি পাখি!’
পাখিগুলো তুলতুলকে ঘিরে ঘুরতে থাকল। একপাশে মেঘ আর চারদিকে পাখি নিয়ে অনেকক্ষণ আকাশে উড়ল ঘোরাঘুড়ি আর তুলতুল। সন্ধ্যা নামতেই তারা ফিরে এল বাসায়। ঘরে আসতেই ঘোরাঘুড়িটা ছোট হয়ে ফুড়ুত করে ঢুকে গেল ড্রয়িং খাতায়। ঠিক তখনই এল ভাইয়া। ভাইয়ার মন খারাপ। গেম খেলায় সে জিততে পারছে না। ভাইয়াকে দেখে তুলতুলের মনটাও খারাপ হয়ে গেল। আচ্ছা, ভাইয়াকেও যদি ঘোরাঘুড়ির পিঠে বসানো যায়? ভাইয়া নিশ্চয় ভীষণ খুশি হবে!
: ভাইয়া, তুমি কি মেঘ দেখতে চাও?
: নাহ!
: ভাইয়া, চাইলে তুমি কিন্তু উড়তেও পারো...
: আমি তো পাখি না যে উড়ব!
: কিন্তু পাখির মতো উড়তে কী যে মজা ভাইয়া! আমি বললে ঘোরাঘুড়ি তোমাকেও ওড়াবে!
: ঘোরাঘুড়ি?
: হুম। আমার ড্রয়িং খাতাটা খোলো...
: কী হবে খাতা খুললে?
: আরে খোলোই না!
ভাইয়া ড্রয়িং খাতাটা খুলল। আর তক্ষুনি চলে গেল ইলেকট্রিসিটি। অন্ধকার ঘরে ভাইয়া কিছুই দেখতে পেল না। কিন্তু তার মনে হতে থাকল সে যেন একটা কিছুর ওপর চেপে বসেছে। আর জিনিসটা তাকে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ভাইয়া দেখল মাথার ওপর আকাশ! আর আকাশভরা তারা!
ভাইয়া বলল, ‘আরে আরে, এটা কী?’
পাশ থেকে তুলতুল বলল, ‘ভয় পেয়ো না ভাইয়া, এটাই আমার ঘোরাঘুড়ি!’

সরস রচনা : ইয়েবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ বিয়ে বন্ধুর জন্য ক্ষতিকর!

..কন্যার বাপ সবুর করতে পারত, কিন্তু কন্যা সবুর করতে চাইল না। সোজা বলল, ‘হয় শিহাবের সাথে বিয়ে দাও, নয় তো আমাকে কানাডা পাঠিয়ে দাও।’
কন্যার বাপ অপেক্ষাকৃত সহজ অপশনটা বেছে নিলেন। শিহাবের সঙ্গে রুনার বিয়ে হয়ে গেল।
শিহাব আমাদের বন্ধু। আমরা ছিলাম চৌমাথা। না না রাস্তার নয়, বন্ধুত্বের। শিহাব, হিমেল, বাবু আর আমি। আমরা রাস্তায়, ক্লাসে, টং দোকানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হো হো হা হা করে কাটিয়ে দিতাম। আমরা শেষের দিকে এমনকি ফেসবুকিংও একসঙ্গে করতাম। নিয়মটা ছিল এ রকম—অফিস থেকে বের হয়ে নির্দিষ্ট একটা চায়ের দোকানে বসতাম চারজনে। তারপর নিজেদের মুঠোফোন বের করে ঢুকতাম ফেসবুকে। নিজেদের অ্যাকাউন্টে ঢুকে আমরা পরস্পরের ছবি ও স্ট্যাটাসে লাইক দিতাম। বিচিত্র কোনো খবর পেলে নিজেদের ইনবক্স করতাম। এ রকমভাবে কয়েক ঘণ্টা জম্পেশ আড্ডা দিয়ে তবেই আমরা ঘরে ফিরতাম।
ছুটির দিনগুলোয় আমরা শিহাব আর হিমেলের মোটরসাইকেলে চেপে বেরিয়ে পড়তাম। সারাটা ছুটির দিন আমরা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-গাজীপুর ঘুরে একযোগে চেকইন দিতাম। সেলফি তুলতাম।
সেলফি তুললাম শিহাবের বিয়েতেও। হইহল্লা কম করলাম না। বাসরঘরে শিহাবকে ঢুকিয়ে দেওয়ার সময় সবাই মিলে বললাম, ‘দেখিস, বউ পেয়ে বন্ধুদের আবার ভুলে যাস না!’
শিহাব বলল, ‘মাথা খারাপ!’ বলেই সে তাড়াতাড়ি ঢুকে গেল ঘরে। আর বেরোল না। মানে পরের সারাটা জীবনে তাকে আমরা আর আমাদের মধ্যে পেলাম না। অফিস থেকে বের হয়ে সে সোজা বাসায় চলে যায়। আমাদের সঙ্গে বড়জোর এক কাপ চা খায়। খেতে খেতেই রুনার ফোন আসে। ওদিক থেকে কী বলে কে জানে! দেখি যে শিহাবের মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায়। বলে, ‘আসতেছি তো, এই তো...আরে না না ওদের সাথে না...কোনো আড্ডাবাজি না...জ্যামে জ্যামে!’
ফোন রেখে আমাদের দিকে আলগা সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা করতে করতে সে বলে, ‘একটা দাওয়াত আছে জন্মদিনের। তাড়াতাড়ি যেতে হবে বন্ধু!’
শিহাব চলে যায়। বাবু খুবই রাগ করে। বলে, ‘শিহাব একটা...!’ আমরা উদাস মনে আড্ডা দিই। নিজেদের মুঠোফোন বের করে ফেসবুকে ঢুকে ততোধিক উদাস উদাস স্ট্যাটাস দিই। শিহাব দূর থেকে লাইক দেয় সেসব স্ট্যাটাসে।
ছুটির দিনগুলোয়ও শিহাব আর আমাদের সঙ্গে যেতে পারে না। তারা শপিংয়ে যায়। সিনেমায় যায়। বিপদে পড়ি আমরা। শিহাব না এলে তো তার মোটরসাইকেলও আসে না। আমরা তিন প্রাণী, একটা মোটরসাইকেল। আমরা চাপাচাপি করে বসি তাতে। ট্রাফিক সার্জেন্ট রক্তচোখে তাকায়। একদিন কানে পর্যন্ত ধরাল। হিমেল বলে, ‘শিহাব নাই তাতে কী! দেখ, আমাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। আমরা এখন একটা বাইকে এ রকম ঠেলাঠেলি করে বসি, এক ব্রেকে একসঙ্গে ঝাঁকি খাই।’
আমরা বলি, ‘হু।’ কিন্তু আমাদের মন পড়ে থাকে শিহাবে।
এভাবে একটা বছর কাটতে না কাটতেই বাবুর বিয়ে হয়ে গেল। সেদিনও আমরা খুব হইচই করলাম। সেলফি তুললাম। শিহাবও এল। শিহাবের সামনেই বাবুকে বললাম, ‘বাবু দেখিস, শিহাবের মতো হয়ে যাস না!’
বাবু বলল, ‘মাথা খারাপ!’ বলেই বাবু তাড়াতাড়ি বাসরঘরে ঢুকে গেল। এবং, সে-ও আর বেরোল না! অফিস থেকে বেরিয়ে সে-ও আর আড্ডা দেয় না আমাদের সঙ্গে। এক কাপ চা খাওয়ারও সময় পায় না। শিহাব আর বাবু একসঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগেই অবশ্য তাদের ফোন আসে। তারা প্রায় কোনো উত্তর না করে শুধু ‘হু হু’ আর ‘জ্যাম জ্যাম’ বলতে থাকে। হিমেল অত্যন্ত মেজাজ খারাপ করে। তারপর বলে, ‘এটাই ভালো হইছে, বন্ধু। এখন শুধু তুই আর আমি। আমার বাইক নিয়া সারা ছুটি ঘুইরা বেড়াব। সার্জেন্টও আর কান ধরাইতে পারবে না! শুধু তুই আর আমি!’
আমি বলি, ‘হু।’ কিন্তু আমি জানি আমার মতোই হিমেলেরও মন পড়ে থাকে শিহাব আর বাবুতে।
ছুটির দিনগুলোয় শিহাব আর বাবু তাদের স্ত্রীসহ শপিংয়ে যায়, সিনেমায় যায়। হিমেল আর আমি বিছনাকান্দি গিয়ে চেকইন দিই, সেলফি তুলি। সেই সেলফিতে আগের মতো জোশ থাকে না। হিমেল জোশ আনার চেষ্টা করে। বলে, ‘ব্যাচেলর লাইফ হলো শ্রেষ্ঠ লাইফ। এর ওপর কোনো লাইফ নাই!’
আমি শুকনা মুখে বলি, ‘হু...!’
হিমেল বলে, ‘আমি চিরদিন ব্যাচেলর থাইকা যাব!’
আজ হিমেলের বিয়ে। খুব ধুমধাম হচ্ছে। আমরাও খুব হইচই করছি। শিহাব আর বাবু তাদের বউ নিয়ে এসেছে। সবাই মিলে দেদার সেলফি তুলছি। বাসরঘরে হিমেলকে ঢুকিয়ে দেওয়ার সময় বললাম, ‘দেখিস বন্ধু, শিহাব আর বাবুর মতো আমাদের ভুলে যাস না!’
হিমেল বলল, ‘মাথা খারাপ!’ বলেই সে খুব তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে গেল।
আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। বললাম, ‘যে যাই বলুক, ব্যাচেলর লাইফই হলো শ্রেষ্ঠ লাইফ।’
তবে আমার কথায় ‘হু’ বলার মতো কেউ তখন আশপাশে ছিল না!

প্রপোজ করার অব্যর্থ উপায়


সবাই তো ভালোবাসা চায়, কেউ পায় কেউ পায় না...কিন্তু কেন পায় না? পায় না কারণ তারা জানে না কী করে প্রপোজ করতে হয়। এমনভাবে প্রপোজ করুন যেন আপনার প্রিয় মানুষটি আপনাকে ‘না’ বলতে না পারে।
অাঁকা: জুনায়েদউপায় ১মোবাইল ফোন গেমযাকে ‘আই লাভ ইউ’ বলতে চান, তার মুখদর্শন হচ্ছে না আপনার? মানে তিনি আপনার সঙ্গেই থাকে কিন্তু সব সময় তাকিয়ে থাকেন মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে? ক্যান্ডিক্র্যাশ সাগা আর ক্ল্যাশ অব ক্ল্যানসকে তিনি তামা তামা বানিয়ে ফেলেছেন! মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের ওপর এত দ্রুত আঙুল চলে যে সেখানে যেকোনো সময় আগুন জ্বলে উঠতে পারে? তাহলে আজই তাকে নিয়ে উঠুন ছয়তলার কোনো ছাদে। তারপর এক ঝটকায় তার ফোনটি কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলার ভঙ্গিতে বলুন, ‘জানপাখি, যদি আমাকে ভালো না বাসো, তাহলে এই মোবাইল ফোন তার প্রাণপাখি হারাবে!’
তারপর দেখুন কী হয়!

রিস্ক ফ্যাক্টরএ অবস্থায় প্রিয় মানুষটি খুব বেশি গেম ফ্রিক হলে মোবাইল ফোনের জন্য আপনাকেও ধাক্কা মারতে পারে ছাদ থেকে। সে ক্ষেত্রে গোপনে হলেও সঙ্গে প্যারাশ্যুট রাখুন।
উপায় ২ফেসবুক-লাইক
প্রিয়জনটি কি খুব বেশি ফেসবুকে থাকে? কে কটি লাইক দিল তা গুনে গুনে রাখে? ঘণ্টায় ঘণ্টায় সেলফি আপ করে? আপনি তাকে জানান, আপনার রয়েছে সাড়ে তিন শ ফেক আইডি। যদি সে আপনাকে ভালোবাসে তাহলে প্রতিদিন প্রতিটি পোস্টে সে সাড়ে তিন শটি করে এক্সট্রা লাইক পাবে। লাইকের প্রস্তাব দিয়ে দুহাত বাড়িয়ে বলুন, ‘ডু ইউ লাভ মি?’
তারপর দেখুন কী হয়!
রিস্ক ফ্যাক্টর
সাড়ে তিন শ ফেক আইডি রাখার দায়ে অচিরেই আপনি আপনার মূল্যবান আসল আইডিটি হারাতে পারেন। সে ক্ষেত্রে মার্ক জাকারবার্গকে পরিস্থিতি জানিয়ে আগে থেকে চিঠি লিখে রাখুন।
উপায় ৩
গান-অত্যাচার
ছেলেবেলায় এমনকি আপনার মা-বাবাও আপনার কাছে কখনো গান শুনতে চাননি? বাথরুমে আপনি গুনগুন করলে ছাদে বসা টিকটিকির লেজ পর্যন্ত খসে যায়? রাতে আপনি গান গাইলে মশার কয়েলের পর্যন্ত দরকার হয় না? তাহলে আপনার জন্যই এই উপায়! আপনার প্রিয় মানুষটিকে আটকে ফেলুন কোনো ঘরে। তারপর আপনি আপনার মতো গান শুরু করুন। কানে হাত দিয়ে, বালিশ চাপা দিয়ে, এমনকি কম্বল চাপা দিয়েও আর সহ্য করতে না পারলে আপনি বলুন, ‘এই গান ততক্ষণ চলবে, যতক্ষণ না আমাকে “আই লাভ ইউ” বলবে!’
তারপর দেখুন কী হয়!
রিস্ক ফ্যাক্টর
প্রিয় মানুষটি যদি গালাগালে এক্সপার্ট হন তাহলে আপনার বিপদ। গান দিয়ে তখন কোনোভাবেই গালাগাল সামলাতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে দুই কেজি ফ্রেশ তুলা কানের জন্য সংরক্ষণ করুন।
উপায় ৪
প্রশ্নপত্র
আপনার প্রিয় মানুষটি কি পড়াশোনায় একেবারেই ভালো নয়? পাঁচটি সাবজেক্টে পরীক্ষা দিলে সাতটি সাবজেক্টে ফেল করে? সমাধান আপনার হাতে। নেট ঘেঁটে, শিক্ষা দপ্তরে হেঁটে, খুব করে খেটে জোগাড় করে ফেলুন ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র। তাকে বলুন, ‘প্রিয়ে, আমি তোমারে ভালোবাসি বলেই সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে নিয়ে এসেছি এই প্রশ্নপত্র! তুমিও যদি আমাকে ভালোবাসো তাহলে এই সমস্ত প্রশ্নপত্র তোমার...কথা দিচ্ছি সারা জীবন এভাবেই ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র সাপ্লাই দিয়ে যাব! পরীক্ষায় পাস করা তোমার আর কেউ আটকাতে পারবে না!’
তারপর দেখুন কী হয়!
রিস্ক ফ্যাক্টর
প্রিয়জন খুব সৎ হলে আপনাকে পুলিশে দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে এটিএম কার্ড সঙ্গে রাখুন।
উপায় ৫
নৌকা
আপনার প্রিয়জন কি সাঁতার জানেন? ভালো করে খোঁজ নিন। না জানলে আজই প্রস্তাব দিন নৌকা ভ্রমণের। একটি ডিঙি, একটি বইঠা এবং প্রিয়জন ও আপনি। নদীর মাঝখানে গিয়ে তাকে বলুন, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি! তুমি কি আমাকে ভালোবাসো? যদি না বাসো, পরোয়া করি না। বইঠা ফেলে আমি এই নৌকা এখনই ডুবিয়ে দেব!’
তারপর দেখুন কী হয়!
রিস্ক ফ্যাক্টর
হতে পারে আপনার প্রিয়জনও পরোয়া করেন না। ফলে তিনি নিজেই রাগ করে পানিতে লাফ দিলেন। তাই গোপনে হলেও লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে রাখুন।

সংসদ সুখের হয় বিরোধীর গুণে

বড় মামা আরেকবার জিব বের করে চুকচুক করলেন। বললেন, ‘বিগ মিসটেক!’
আমরা যারা তাঁর ভাগনে-বাহিনী, তারাও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মাথা ঝাঁকিয়ে ভাবটা এমন করলাম, যেন খুবই বুঝতে পেরেছি এই বিগ মিসটেকের কারণ। আসলে আমরা এর কিছুই জানি না। তবে মামা সকাল থেকেই এ রকম গম্ভীর মুখে বসে আছেন আর কিছুক্ষণ পরপর ‘বিগ মিসটেক’ বলে যাচ্ছেন। মামা বললেন, ‘এত বড় ভুল কী করে করলাম?’
‘কী ভুল মামা?’ জানতে চাইলাম আমরা।
: ইলেকশনে দাঁড়ালাম না! এবারের ইলেকশনে দাঁড়ালাম না!
: ইলেকশনে?
: হ্যাঁ, ছেলেবেলায় মানুষজনের কত রকমের শখ থাকে! কেউ ডাক্তার হবে, কেউ ইঞ্জিনিয়ার হবে, কেউ বিজ্ঞানী হবে, আমি হতে চেয়েছিলাম এমপি! মেম্বার অব পার্লামেন্ট! ভেবেছিলাম, আমিও সংসদে যাব। ‘মাননীয় স্পিকার’ বলে কথা বলতে শুরু করব। দেশের-দশের কথা বলব...এলাকার মানুষজনের সেবা করব!
মামার এই শখের কথা শুনে আমরা খুবই উল্লসিত হলাম। মামা যদি এমপি হতে পারে, তা হলে আমাদেরও কম দাম না! আমরা হব এমপি মামার ভাগনে গ্রুপ! আমরা খুবই আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা হলে মামা, দাঁড়ালেন না কেন? আমরা তো ছিলামই। আমরা মিটিং করে, মিছিল করে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে চেয়েচিন্তে আপনার জন্য ভোট চাইতাম। আপনাকে পাস করাতামই করাতাম! কেন দাঁড়ালেন না, মামা?’
মামা মৃদুকণ্ঠে বললেন, ‘ভয়ে...ভয়ে দাঁড়াইনি!’
আমরা আকাশ থেকে পড়লাম, ‘ভয়ে দাঁড়াননি? কিন্তু কীসের ভয়ে? কার ভয়ে?’
মামা আরেকবার নিশ্বাস ফেললেন। সোফায় পা তুলে বসলেন। একবার রান্নাঘরের দিকে উঁকিও দিলেন। হয়তো দেখে নিলেন মামি কী করছেন। আমরা তাড়া দিয়ে জানতে চাইলাম, ‘কার ভয়ে, মামা? আমরা থাকতে কাকে ভয়?’
মামা বিড়বিড় করে বললেন, ‘আর কাকে, তোদের মামিকে!’
: মামিকে? কিন্তু মামিকে ভয় পাওয়ার সঙ্গে ইলেকশনে দাঁড়ানোর কী সম্পর্ক, মামা? মামি মামির জায়গায়, সংসদ সংসদের জায়গায়, তাই না?
মামা চোখ গরম করে বললেন, ‘সংসদ দেখেছিস কখনো?’
আমরা ইতস্তত করলাম। সত্যিই তো সংসদের ভেতরটা আমরা কখনো দেখিনি। টিভিতে লাইভ-টাইভও দেখিনি তেমন একটা। বললাম, ‘না মামা, দেখিনি।’
: তা হলে? জানিস ওখানে কী হয়? কত রকমের বিল পাস হয়, কত রকমের বক্তৃতা হয়? আর সেই সব বিল আর বক্তৃতা নিয়ে কত রকমের কথা-কাটাকাটি ঝগড়া-বিবাদ হয়, জানিস কিছু? হাত চাপড়ানো, ফাইল চাপড়ানো...কথায় কথায় উঠে দাঁড়ানো, চিৎকার চেঁচামেচি কত কী! সঙ্গে কথার মারপ্যাঁচ, বিরোধী দলের ওয়াকআউট... জানিস এসব?
আমরা মামার কথার লাইন ধরতে পারছিলাম না। বললাম, ‘না মামা, জানি না। কিন্তু এগুলোর সঙ্গে মামির কী সম্পর্ক?’
মামা আরেকবার উঁকি দেন রান্নাঘরের দিকে। তারপর ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘আছে আছে, সম্পর্ক আছে! তোদের মামি...সে-ও তো ধর এক বিরোধী দল! সংসদে বিরোধী দল যেমন সবকিছুর বিরোধিতা করে, ঘরে তোদের মামিও তো তেমনি আমার সবকিছুতে বিরোধিতা করে। বিরোধী দল সংসদে টেবিল চাপড়ায় আর তোদের মামি থালাবাসন চাপড়ায়...সংসদে বিরোধী দল যেমন ওয়াকআউট করে, তোদের মামিও তেমনি ওয়াকআউট করে বাপের বাড়ি চলে যায়! গত দশ বছর তোদের মামির সঙ্গে সংসার করতে করতে বিরোধী দল নিয়ে আমার ভেতর ট্রমা তৈরি হয়েছে। বিরোধী দল মানে তোর মামিকে দেখলে আমার বুক ধকধকিয়ে ওঠে...মাথা ঝিমঝিমায়...কিছু একটা ভুল করলেই তোদের মামির মুখটা এমন করে চোখের সামনে ভেসে ওঠে যে মনে হয় আমার হার্টের রিদম মিস হয়ে যাবে! আমি ভেবেছিলাম নির্বাচনে পাস করে সংসদে গেলে ঘরে আর সংসদে দুই-দুইটা বিরোধী দল আমি কী করে সামাল দেব! এক বিরোধী দলই যখন সারা জীবনের কান্না, তখন দুই বিরোধী দলে আমার কী অবস্থা হবে বুঝতে পেরেছিস?’
আমরা বুঝতে পেরেছি বলে মাথা ঝাঁকালাম। আসলেই মামিটা বিরোধী দল। মামাকে কেমন শক্ত শক্ত কথা শোনায়। মামির ভয়ে মামা সিগারেট খাওয়া পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছে। তাতে অবশ্য মামারই লাভ হয়েছে! যা হোক, সবই বুঝলাম...কিন্তু এখন আবার বিগ মিসটেক বিগ মিসটেক বলে বুক চাপড়াচ্ছেন কেন? হঠাৎ কী হলো?
মামা আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর আরেকবার রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সংসার যেমন সুখের হয় রমণীর গুণে, তেমনি সংসদ সুখের হয় বিরোধী দলের গুণে! সংসদে এখন সুখ আর সুখ! পত্রিকায় খবর এসেছে, সংসদের দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু ওখানে একবারও বিরোধিতা নেই বিরোধী দলের! যে বিল সরকারি দল পাস করাতে চেয়েছে সেই বিলই পাস হয়েছে। বিরোধী দল কিচ্ছু বলেনি! টেবিল চাপড়ায়নি, চিৎকার করেনি, ওয়াকআউট করেনি। কিচ্ছু করেনি! এই দুই বছরে বিরোধী দল কিচ্ছু করেনি! এর মানে বুঝিস তোরা?’
আমরা মাথা নাড়ালাম, ‘না।’
মামা বললেন, ‘এর মানে হলো সংসদ এখন সুখী সংসার! কোথাও কোনো ঝামেলা নেই, কোথাও কোনো বিবাদ নেই! আর আমার সংসার দেখ! উঠতে বসতে ভুল করি আর তোদের মামির ঝাড়ি খাই! আমি যদি নির্বাচনে দাঁড়িয়ে পাস করে সংসদে যেতে পারতাম তা হলে আর এই সংসারমুখী কখনো হতাম না! গৌতম বুদ্ধ সংসার ত্যাগ করে নির্বাণ লাভ করেছিলেন, আমি না হয় সংসার ত্যাগ করে সংসদে একটা পদ লাভ করতাম! সংসদে দাঁড়িয়ে আরাম করে বলতে পারতাম, ‘মাননীয় স্পিকার...’! মিসটেক রে, বিগ বিগ মিসটেক!
বড় মামা সত্যিই যে বিগ মিসটেক করে ফেলেছেন তাতে আমরাও সায় দিলাম। সত্যি এমন সুযোগ বিরল। আবার কবে আসবে কে জানে! তখন মামা নির্বাচন করতে পারবেন কি না, কে জানে! তত দিনে মামাকে তো সংসারের বিরোধী দল মানে মামিকেই সামলাতে হবে! মামাকে নিয়ে আমরা সত্যিই দুশ্চিন্তায় পড়লাম।
মামা বললেন, ‘সংসদে এবারের বিরোধী দল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে! এবার যদি আমার সংসারেও একটু সুখ আসে। তোরা তোদের মামিকে বল, সারা দিন সিরিয়াল না দেখে এক-আধটু যেন সংসদও দেখে!’
আমরা আকাশ থেকে পড়লাম, ‘কেন, মামি সংসদ দেখে কী করবে?’
: সংসদ দেখলেই না তোদের মামি বুঝতে পারবে বিরোধী পক্ষে থেকেও কত সহজ, শান্তিপূর্ণ, আর কিছু না করে দিন কাটানো যায়! তোর মামির ব্যাপারে এখন তো বিরোধী দলই ভরসা। বলবি তোরা একটু তোদের মামিকে?
আমরা বললাম, ‘অবশ্যই বলব, মামা। আপনার জন্য আমরা সব করতে পারি। আমরা তো আপনারই দলে!’
এমন সময় হঠাৎই মামির কণ্ঠস্বর ভেসে এল রান্নাঘর থেকে, ‘কই তুমি? তুমি না বললে, রান্নায় হেল্প করবে?’
মামির কণ্ঠ শুনেই মামা হঠাৎ হড়বড়িয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, ‘মাননীয় স্পিকার...মাননীয় স্পিকার! আমি এক্ষুনি আসছি...এক্ষুনি আসছি আমি!’
মামা ছুটে গেলেন রান্নাঘরের দিকে। যাওয়ার আগে অবশ্য আরেকবার বললেন, ‘শোন, সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে আর সংসদ সুখের হয় বিরোধী দলের গুণে, কথাটা তোরা মনে রাখিস!’
আমরা হয়তো মনেও রাখতাম! কিন্তু ততক্ষণে রান্নাঘর থেকে বিরিয়ানির ঘ্রাণ ভেসে আসতে লাগল। আমরা সঙ্গে সঙ্গে দলবদল করে বিরোধী দল অর্থাৎ মামির দলে যোগ দিয়ে ফেললাম।

এক যে ছিল দৈত্য

অনেক অনেক অনেক অনেক বছর আগে এই পৃথিবীতে এক দৈত্য বাস করত। দৈত্যটার ছিল বিশাল এক পেট আর ইয়া বড় বড় তিনটা মাথা। কিন্তু তিন–তিনটা মাথা হলে কী হবে, দৈত্যটার চোখ ছিল মাত্র একটা। সবাই তাকে একচোখা দৈত্য বলে ডাকত।
অতীত নথিপত্র ঘাঁটলে দেখা যায় সে সময় এই দৈত্যটা ডাংগুলি খেলা পরিচালনা করত। যদিও এই দৈত্যটার জন্মের আগে থেকেই পৃথিবীতে ডাংগুলি খেলা চলছিল। কিন্তু দৈত্যটা এমন ভাব করত যেন তার জন্যই ডাংগুলি বেঁচে আছে! সে নিজেকে ডাংগুলির মাতবর মনে করত। দৈত্যের মাথা তিনটা তো জোরে জোরেই বলত—আমরাই মোড়ল, আমরাই মোড়ল!
দৈত্যটা এই মোড়লদের সুবিধা হয় এমন সব নিয়মকানুন বানাত। হঠাৎ হঠাৎ বলত, আজ থেকে ক্রিকেট হবে এ রকম, আজ থেকে ক্রিকেট হবে ও রকম! ছোট দলগুলো মন খারাপ করে দৈত্যের কথা মেনে নিত। কিন্তু তার কথা মেনে নিলে কী হবে, ছোট দলগুলো ভালো খেলতে খেলতে এমন পর্যায়ে গেল যে মোড়ল দলগুলোকেও হারাতে শুরু করল। দৈত্য দেখল, এ তো চরম বিপদ! সে তখন ছোট দলগুলোকে বড় বড় টুর্নামেন্ট থেকে বাদ দিতে লাগল। যেভাবেই হোক তার মাথার দলগুলোকে বাঁচাতে হবে! কিছুতেই যেন না হারে!
কিন্তু ছোট দলগুলো কম বিচ্ছু না। একেকটা দলে একেকটা প্রতিভাধর খেলোয়াড় আসতে শুরু করল। তারা দৈত্যের তিনটা মাথারই ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াল। তিন মাথা এককাট্টা হয়ে অনেকক্ষণ ধরে গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করে অদ্ভুত অদ্ভুত সব আইন পাস করতে শুরু করল। কিন্তু তারপরও দলগুলোকে, দলের খেলোয়াড়গুলোকে থামানো গেল না। তখন দৈত্য তার শেষ অস্ত্রটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল খেলোয়াড়দের ওপর। বলল, ‘এই খেলোয়াড়, যে দারুণ দ্রুতগতিতে বল করে, যার বাউন্সার বারবার আমার মাথাগুলোতে আঘাত করছে; সে ত্রুটিপূর্ণ। আর ওই খেলোয়াড়, যার বল মোড়লদের স্পিনারদের থেকেও ভালো ঘুরছে, সে-ও ত্রুটিপূর্ণ।’ তাদের বাদ দেওয়ার জন্য দৈত্য উঠেপড়ে লাগল। সে ঠিক করেছে, তার মাথা তিনটার জন্য যে খেলোয়াড়ই হুমকি হয়ে আসবে, তাদেরই বাদ দিয়ে দেবে। যেন ক্রিকেটের সব কাপ-প্লেট-পিরিচ তার মোড়ল মাথারাই পায়।
দেখতে দেখতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেল ছোট দলগুলোর। তারা বলল, ‘আমাদের বারবার বাদ দেয় যে দৈত্য, আজ থেকে আমরাই তাকে বাদ দিলাম। আমরা আর কোনো খেলায় দৈত্যকে ডাকব না। আমরা নিজেরা নিজেরা খেলব।’ তারপর তারা নিজেদের মতো করে ডাংগুলি খেলা শুরু করল।
মাতবর দৈত্য আর মোড়ল মাথারা দেখল, এ তো খুব মুশকিল! অন্য দলগুলো যদি তাদের সঙ্গে না খেলে তাহলে তারা কার সঙ্গে খেলবে? অপেক্ষা করতে করতে তারা নিজেদের সঙ্গেই খেলতে শুরু করল। কিন্তু তিন মোড়লের খেলায় খেলার চেয়ে ঝগড়া বেশি হতে শুরু করল। দৈত্যের তিনটা মাথা পরস্পরের সঙ্গে এতটাই বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়ল যে দৈত্যের সার্বক্ষণিক মাথাব্যথা হতে শুরু করল। এই মাথা বলে, ‘তুই খারাপ!’ ওই মাথা বলে, ‘তোর জন্যই এই সব!’ আরেক মাথা শুধুই চিৎকার করতে থাকল ‘মওকা মওকা’ বলে!
এত অশান্তি সহ্য হলো না দৈত্যর! সে এক দিন একটা ফাঁকা মাঠে গিয়ে ডাংগুলি লাঠি দিয়ে পিটিয়ে নিজের তিনটা মাথাই ফাটিয়ে ফেলল। মাথার কচকচানি ফুরাতেই সে আবার ছোট দলগুলোর কাছে এল। কিন্তু ছোট দলগুলো দৈত্যকে হেসেই উড়িয়ে দিল। আর মনের দুঃখে সে যে কোথায় নির্বাসনে গেল, কেউ আর বলতে পারে না!
মাতবর দৈত্য আর তিন মোড়ল মাথা ছাড়া পৃথিবীর ডাংগুলি আবার আনন্দদায়ক হয়ে উঠল। পৃথিবীর ছোট-বড় সব দল সমান সুযোগ পেয়ে ডাংগুলি খেলে সুখে-শান্তিতে, মিলেমিশে বসবাস করতে শুরু করল।

হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা যখন বাংলাদেশে


বাসে উঠতেই দেখলাম লোকটাকে। বাসের সবচেয়ে পেছনের সিটে কোনায় কোনোরকমে বসে আছে। অদ্ভুত ধরনের আলখেল্লা-টাইপের পোশাক, মাথায় লম্বাটে টুপি। ঢাকায় এ রকম পোশাকের লোক সচরাচর দেখা যায় না। তার পাশের সিটটা ফাঁকা পেয়েই বসে গেলাম। লোকটার ঝোলাভর্তি বাঁশি।
: আপনি বাঁশি বাজান নাকি?
: হ্যাঁ, আমি বাঁশিওয়ালা।
: আচ্ছা, আচ্ছা। ঢাকাতেই থাকেন?
: না, আমি জার্মানির হ্যামিলিন থেকে এসেছি।
: মানে, মানে আপনি হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা? সেই খারাপ লোকটা? যে মেয়রের কাছ থেকে ইনাম না পেয়ে শহরের শিশুদের বাঁশির সুরে ভুলিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিল?
: হুম।
: ছি ছি ছি! আপনার লজ্জা করল না? এতগুলো শিশুকে, যাদের কোনো দোষই নেই, ভুলিয়ে-ভালিয়ে তাদের নিয়ে চলে যেতে!
: তোমাদের লজ্জা করে না?
: আমাদের? আমাদের আবার কিসের লজ্জা?
: তোমরা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর শিশুদের হত্যা করে চলেছ...তোমাদের লজ্জা করে না?
আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। এ তো দেখি আমাদের দেশের খবর রাখে! হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, ‘তোমাদের নদী-পুকুরের তলায় মৃত শিশু, তোমাদের বস্তার ভেতর মৃত শিশু, তোমাদের পানির ট্যাংকে মৃত শিশু। তোমাদের ডাস্টবিনগুলোয় নোংরা-আবর্জনা কম, শিশুর লাশ বেশি। লজ্জা তো তোমাদের পাওয়ার কথা!’
: না, আমরা আসলে...
: পৃথিবীজুড়ে সবাই যখন শিশুদের অধিকারের কথা বলছে, শিশুকে আরও কীভাবে নিরাপদে রাখা যায়, বিকশিত করা যায়—তার কথা বলছে, তখন তোমরা শিশুদের গলা টিপে ধরছ, শিশুদের কুপিয়ে খুন করছ, কেটে টুকরো টুকরো করে ভাসিয়ে দিচ্ছ নদী-খাল-বিলে। আদিম যুগে যখন মানুষ এত কিছু জানত না তখনো তারা তাদের শিশুদের রক্ষা করত সব প্রতিকূলতা থেকে। তোমরা তো এখন আদিম যুগের থেকেও খারাপ হয়ে গেছ! তোমাদের শরীর মানুষের, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে তোমরা হয়ে গেছ হায়েনা! না, হায়েনাও তার শিশুদের রক্ষা করে, তোমরা এমন পশু হয়ে উঠেছ যে কিছুদিনের মধ্যেই তোমাদের দাঁত বড় বড় হয়ে যাবে, কানগুলো লম্বা লম্বা সুচালো হয়ে যাবে আর একটা বিকট লেজ বেরিয়ে আসবে পেছন থেকে!
: না, না, কী যে বলো! আমরা মানুষই আছি...এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা...
: কোনো ঘটনাই বিচ্ছিন্ন নয়। কোনো হত্যাই বিচ্ছিন্ন নয়। কোনো শিশুহত্যাই বিচ্ছিন্ন নয়!
পরের স্টপেজে বাস থামে। হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা উঠে দাঁড়ায়।
: কোথায় যাচ্ছ তুমি?
: আমার কাজ করতে।
: কী কাজ তোমার?
বাঁশিওয়ালা তাকায়, কিছু বলে না। নেমে যায় বাস থেকে। আমার মনে গভীর সংশয় দানা বাঁধে। বাঁশিওয়ালা কোথায় যাচ্ছে? পাশের ফাঁকা সিটে, যেখানে একটু আগেই হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা বসে ছিল, সেখানে এক টুকরো ভাঁজ করা কাগজ পড়ে আছে। কাগজটা খুলতেই দেখি, একটা ছোট্ট চিঠি। দেখে মনে হলো, চিঠিটা লেখা হয়েছে হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালাকে।
প্রিয় হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা,
তুমি এখন কোথায় আছ? আমার বন্ধু রাফি বলেছে, তোমার নাম লিখে চিঠিটা বাক্সে ফেলে দিলেই নাকি তুমি চিঠিটা পেয়ে যাবে! আমরা সবাই মিলে তাই এই চিঠিটা লিখছি। আমরা তোমার গল্পটা পড়েছি। তুমি বাঁশির সুর তুলে শিশুদের দলবেঁধে নিয়ে যেতে পারো।
হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা, আমরা এখন এখানে কেউ নিরাপদ না। বড়রা আমাদের মেরে ফেলছে। আমাদের খুব ভয় লাগছে। তুমি প্লিজ চলে এসো। এসে, তোমার বাঁশি বাজিয়ে বাংলাদেশের সব শিশুকে নিয়ে যাও। আমরা অন্য কোথাও গিয়ে থাকব! তুমি কি আমাদের কথা শুনবে?
ইতি
রাতুল, মিতু, রিমঝিম আর রাফি
চিঠিটা শেষ হতেই, কানের ভুলও হতে পারে, আমি বাঁশির সুর শুনতে পেলাম। বাস থেকে নামতে চাইলাম আমি, কিন্তু তার আগেই বাসটা ছেড়ে দিল। আমি কান পেতে বাঁশির সুর শুনতে থাকলাম।