সোমবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৭

যে কারণে আমি কপিরাইটার

ইচ্ছা ছিল, আমি হব পাইলট।
পাঁচ-ছয় বছর বয়সে কেউ জানতে চাইলে কিংবা না চাইলে আমি ইনিয়ে-বিনিয়ে বলতাম, ‘বড় হলে আমি পাইলট হব।’ আমার ধারণা ছিল, আকাশ যেহেতু ফাঁকা, রাস্তার কোনো বালাই নেই, ফলে প্লেন চালানো নিশ্চয়ই একটা সহজ ব্যাপার হবে। ফলে যে বয়সে অন্যরা হাফ প্যাডেলে সাইকেল চালানো শিখছে, সে বয়সে আমি কাগজের প্লেন বানিয়ে তা উড়িয়ে বেড়াচ্ছি।
প্লেন চালানোর সাধে আমার সাইকেল চালানো শেখা হলো না। আমার বন্ধুবান্ধব এমনকি আত্মীয়স্বজন পর্যন্ত এ নিয়ে যখন হাসাহাসি শুরু করল, তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, পাইলট হতে পারি না-পারি, প্লেন চালাতে পারি আর না-পানি, সাইকেল আমাকে চালাতে পারতেই হবে।
বয়স তখন একটু বেড়ে গিয়েছিল, হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্ট ধরেছি, তার সঙ্গে চুলে নিজস্ব স্টাইলে সিঁথি করা ধরেছি। এত কিছু ধরাধরির মধ্যে নতুন করে আর সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরতে পারলাম না। একবার অবশ্য চেষ্টা করেছিলাম। প্যাডেলে চাপ দিয়ে রাস্তার দিকে যেই না এগোতে যাব, তখন দেখি, পাশের ড্রেনটা লাফিয়ে আসবি তো আয় আমার সাইকেলের নিচেই চলে এল! আমি ধপাস! আকাশে তখন শুধুই চিল উড়ছিল। সেদিনই বুঝতে পারলাম, রাস্তায় সাইকেল চালানোর মতোই আকাশে প্লেন চালানো নিতান্তই প্রকৃতিবিরুদ্ধ এক ব্যাপার। অতএব, পৃথিবীতে পাইলট হওয়ার মধ্যে কোনো গৌরব নেই!
এরপরই আমার মাথার ভেতর ভূত চাপল ক্রিকেটের। ভূত এ জন্য যে খেলাটা আমি দারুণ ভালোবাসতাম। কিন্তু খেলাটা আমাকে ভালোবাসত না। আমরা মহল্লার যেখানে খেলতাম, তার আশপাশের একাধিক বাসার বারান্দা কিংবা জানালায় দর্শক হিসেবে থাকত তরুণী আর কিশোরীরা। তাই আমি মাঝেমধ্যেই ক্রিকেট মাঠে নায়ক হয়ে উঠতে চাইতাম। কিন্তু না পারলাম একটা ছক্কা হাঁকাতে, না পারলাম বোল্ড করে একটা উইকেট দখল করতে! তবে খেলাটা বেশ ভালো বুঝতে পারার কারণে কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে সবাই মিলে আম্পায়ার বানিয়ে দিতে চাইল। মাঠে গেলেই দুই দল ভাগ হয়ে আমাকে কয়েন বাড়িয়ে দেয়! আমি ‘কয়েনের খ্যাতাপুড়ি’ বলে ফিরে আসি সেই মাঠ থেকে চিরতরে। আমার ইচ্ছা ছিল মাশরাফি হওয়ার, আর ওরা কিনা আমাকে বানাতে চায় আলিম দার!
হাইস্কুল থেকে কলেজের প্রত্যেক শিক্ষক আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছেন। হবে না, আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না! আত্মীয়স্বজনের মধ্যেও হতাশা। ছেলেটা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারল না। অবস্থা যখন চরম খারাপ, দশ দিক থেকে যখন হাহাকার ভেসে আসতে শুরু করল, তখন ঠিক করলাম, আমি একটা ব্যান্ড করব। ব্যান্ডের নাম হবে ‘বায়স ব্যান্ড’। এ কথা দু-একজনকে বলতেই তারা ব্যান্ডে আগ্রহী না হয়ে ব্যান্ডের নাম নিয়ে আগ্রহী হয়ে পড়ল। বারবার জানতে চাইল ‘বায়স’ মানে কী! আমি ‘কাক’ বলতেই তারা হাসল। বলল, ‘তোর যা গলা, তাতে নাম ঠিক আছে!’
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।’ আমিও একলা চলা শুরু করলাম। রেওয়াজ ছাড়া গান সম্পন্ন হয় না। আমি সকাল-বিকেল সম্ভব হলে রাতেও রেওয়াজ শুরু করলাম। তিন দিনের মাথায় পাড়ার মানুষেরা আমার বাড়িতে চড়াও হলো। বাবা-মাকে স্পষ্ট জানিয়ে গেল, হয় আমার রেওয়াজ বন্ধ করতে হবে, নাহয় আমার বিরুদ্ধে সালিস বসবে। আমি রেওয়াজ ছেড়ে দিলাম। আমার বায়স ব্যান্ড ছেড়ে দিলাম। গিটার কিনব ভেবে যে টাকাটা জমাচ্ছিলাম, সেটা দিয়ে ছিপ-বড়শি কিনে পুরোদস্তুর মৎস্যশিকারি হয়ে উঠলাম।
ঠিক এ রকম সময়েই আমার জীবনে এল হিমেল। হিমেল এল তার নতুন প্রেমের পুরোনো সমস্যা নিয়ে। এক বছরের জুনিয়র এক মেয়ের প্রেমে পড়েছে সে। কিন্তু কীভাবে প্রপোজ করবে বুঝতে পারছে না। মেয়েটার জন্য একটা চিঠি লিখে দিতে হবে আমাকে। এমন করে লিখতে হবে, যেন মেয়েটা ‘না’ করতে না পারে। আমি আমড়া কাঠের ঢেঁকি। হিমেলের শুকিয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ঠিক আছে, একটা সপ্তাহ সময় দে।’
এই এক সপ্তাহে হাতের কাছে যা আছে পড়ে ফেললাম। হুমায়ূন আহমেদ থেকে শুরু করে জীবনানন্দ দাশ! সুনীল থেকে এমনকি কঠিন কঠিন লাইনের নজরুল পর্যন্ত! অষ্টম দিন চিঠি লিখলাম হিমেলের হয়ে—অত্যন্ত সাহিত্যরসে ভরা চিঠি। কোনো লাইনই অবশ্য আমার নয়। একেকটা লেখকের একেকটা লাইন স্ট্রেট বসিয়ে দিলাম।
ফল হলো ভয়ানক! নবম দিনে হিমেলের সঙ্গে আমাকে এবং আমার লেখা চিঠিটা নিয়ে এলাকার অভিভাবকেরা বসলেন। ভরা বাজারে আমার লেখা চিঠিটা উচ্চস্বরে পড়ে শোনানো হলো। সবাই বিস্তর হাসাহাসি করল। মেয়ের বাবা বললেন, ‘এমন ইতরমার্কা চিঠি কেবল হীরকই লিখতে পারে!’ বলা বাহুল্য, হিমেলকে দুইটা ধমক দিলে সে জানিয়ে দিয়েছিল যে চিঠিটা আমিই লিখেছিলাম। দশবার কান ধরে ওঠ-বস আর ‘এমন গর্হিত কাজ কখনো করব না’—এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেদিনের মতো মুক্তি পেয়েছিলাম। আর ভেবেছিলাম, আমার পত্রলেখকের কাজ বোধ হয় এখানেই শেষ। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, তারপর থেকে গোপনে সবাই আমার কাছে আসতে শুরু করল! হিমেলকে যেমন ঝাকানাকা চিঠি লিখে দিয়েছি, তেমন যেন লিখে দিই। আমি জীবনানন্দ দাশের কবিতা, হুমায়ূন আহমেদের হিমুগিরি, আর সুনীলের সুখব্যথা মেরে মেরে চিঠি লিখতে শুরু করলাম।
সেই লেখা আজও থামেনি। মজার ব্যাপার, কেউ কেউ আমাকে এখন রাইটার বলেন। আমি তাদের ভুল শুধরে দিই; বলি, আমি একজন কপিরাইটার!


রস+আলোয় প্রকাশিত

রবিবার, ১ অক্টোবর, ২০১৭

ইচিং বিচিং

অলংকরণ: তুলি

ইচিং বিচিং দুই ভাই। শুয়ে ছিল কড়ইয়ের ডালে। পায়ের ওপর ঠ্যাংটা তুলে ভাবছিল আজ কী খাওয়া যায়! কলা খেতে খেতে জিভের স্বাদ কলার খোসার মতো হয়ে গেছে!
ইচিং বলল, চল, আজ নতুন কিছু ট্রাই করি! আজ থেকে আমরা মানুষের খাবার খাব। মানুষের থেকে আমরা কিছুতে কম নাকি? মানুষের মতো হাত-পা-মুখ সবাই আছে আমাদের। আবার বাড়তি একটা লেজও আছে! অতএব, আমরা মানুষের মতো খাবার খেতেই পারি!
জঙ্গল থেকে ইচিং বিচিং ছুটল লোকালয়ে। ভরদুপুরে তারা পৌঁছাল এক মফস্বলে। পৌঁছানোমাত্র সাঁই সাঁই করে তারা উঠে গেল মহল্লার ছাদে। খুঁজতে শুরু করল মানুষের খাবার!
ইচিং একবার এই বাড়িতে উঁকি দেয় তো আরেকবার বিচিং উঁকি দেয় ওই বাড়িতে। না, কোথাও কেউ কিচ্ছু খাচ্ছে না। এ সময় কেউ ঘুমাচ্ছে, কেউ বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে। ইচিং বিচিং হতাশ। এমন সময় ইচিং বিচিং দেখল একটা ছোট্ট ছেলে পা টিপে টিপে ছাদে উঠে এল। হাতে আচারের বয়াম।
ইচিং বয়ামটা দেখিয়ে বলল, নিশ্চয় ওটা খেলার জিনিস! এক্ষুনি ছেলেটা ছাদে ওটা গড়িয়ে দিয়ে খেলতে শুরু করবে!
বিচিং বলল, না না। ওটা নিশ্চয় দূরে দেখার দুরবিন…এক্ষুনি চোখে ওঠাবে!
কিন্তু ইচিং বিচিং অবাক হয়ে গেল যখন তারা দেখল ছেলেটা বয়ামের মুখটা খুলে ভেতর থেকে কী সব বের করে গপাগপ খেতে শুরু করল। ছেলেটা এত মজা করে খাচ্ছিল যে ইচিং বিচিংয়ের জিভেও পানি চলে এল।
কী করবে তারা যখন ভাবছে, তখন ভেতর থেকে মায়ের কণ্ঠ ভেসে এল—দীপ্র, তুই কি আবার আচার নিয়ে পালিয়েছিস? দীপ্র বলল, না তো! বলেই বয়ামটা রেখে ছুটল নিচে। ইচিং বিচিং ভাবে, এই সুযোগ। এক্ষুনি ওটা খেতে হবে!
যে–ই ভাবা সেই কাজ! ইচিং বিচিং এক লাফে চলে এল বয়ামের সামনে। খুলে ফেলল বয়ামের মুখ। আহ্, ভেতরে কী দারুণ গন্ধ! বিচিং তাড়াতাড়ি বয়ামের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ফেলল। তুলে নিল একমুঠো আচার। নিয়ে যে–ই না বের করতে গেল, তখনই হাতটা আটকে গেল বয়ামের ভেতর। হায় হায়, কী মুশকিলের কথা! ইচিং ধরে টান দেয়, বিচিং ধরে টান দেয়…না না, হাত বেরই হচ্ছে না! উল্টো আচারের বয়াম উল্টে যাওয়ায় ইচিং বিচিংয়ের শরীর ভরে গেল তেলে!
বিচিং বলল, ইচিং, তুই আমাকে বাঁচা…হাতটা বের করে দে!
: কিন্তু কীভাবে? হাত কাটা ছাড়া তো কোনো উপায় দেখছি না!
ইচিংয়ের কথা শুনে বিচিং আরও ভড়কে গেল। তাহলে সে কি বাঁচবে না? বিচিং ভেউ ভেউ করতে কাঁদতে শুরু করল আর তখনই সেখানে দীপ্র এসে হাজির হলো। দুই–দুইটা বানর দেখে দীপ্র প্রথমে ভয়ই পেল। কিন্তু যখন দেখল বানর দুইটা তারই আচার চুরি করে খাচ্ছে, তখন ভীষণ রেগে গেল সে। কিন্তু দীপ্র রাগলে কী হবে, ইচিং বিচিংয়ের অবস্থা তখন খারাপ। বিচিং তার হাতটা দেখিয়ে দীপ্রকে বলল, ছোট্টবন্ধু, তুমি কি বলবে হাতটা আমি কীভাবে বের করব? ঢোকানোর সময় হাতটা সুন্দরভাবে ঢুকলেও এখন আর বেরই হচ্ছে না!
দীপ্র খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল, বয়াম থেকে হাতটা বের করা তো খুবই সহজ!
: খুবই সহজ? আমাকে শিখিয়ে দাও প্লিজ…
: শেখাব। কিন্তু তার আগে তোমাদের দুজনকেই কথা দিতে হবে, হাতটা বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বয়ামটা তোমরা আমাকে ফেরত দেবে!
: হ্যাঁ হ্যাঁ কথা দিলাম। এখন আমার হাতটা ছাড়াও তাড়াতাড়ি! কী করতে হবে আমাকে বলো বলো?
দীপ্র একটু হাসল। তারপর বলল, কিচ্ছু করতে হবে না তোমাকে। শুধু মুঠি খুলে নাও তুমি!
: কিন্তু তাতে তো আচার বের হবে না?
: তা না করলে তোমার হাতই বের হবে না!
বিচিং পড়ল মহা চিন্তায়। হাত বাঁচাবে না আচার? ইচিং বলল, দীপ্র যা বলছে তা–ই কর…
বিচিং মুঠো খুলে আচার আবার বয়ামে রেখে দেয়। আর তারপরেই হাতটা বয়াম থেকে বের করে নিতে পারে। ইচিং বিচিং দুজনেই তো অবাক! এটা কীভাবে হলো?
দীপ্র বলল, খুবই সোজা। আচার নিয়ে মুঠিটা বন্ধ করায় সেটা বড় হয়ে গিয়েছিল…তাই তো বের হচ্ছিল না বয়াম থেকে!
ইচিং বিচিং একসঙ্গে বলল, বাহ্! কী দারুণ তোমার বুদ্ধি!
দীপ্র বলল, এবার বয়ামটা দাও।
ইচিং বিচিং মন খারাপ করে বয়ামটা ফেরত দিয়ে দিল। মানুষের খাবার তাদের খাওয়া হলো না। ইচিং বিচিং যখন চলে যাচ্ছে, তখন দীপ্র বয়াম থেকে আচার বের করে দিয়ে দিল ওদের হাতে। বলল, খেয়ে দেখো, মায়ের হাতের আচার!
ইচিং বিচিং ঝটকায় আচার মুখে পুড়ে নিল। আহ্! এমন স্বাদের জিনিস তারা আগে কখনো খায়নি।