শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৪

তাদেরও একটা প্রেমকাহিনি ছিল


তার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল দুপুরে। অথচ কথা ছিল সকালেই দেখা হবার। হয় নি। হয় নি আমার খেয়ালেই। আমি যাই নি।

যাই নি কারণ আমি ভেবেছিলাম সে আসবে না। আসবে না ভাবার অনেক কারণ ছিল। আমার মতো এক ছেলের সাথে কেন তার মতো মেয়ে দেখা করবে তা আমার মাথায় ঢোকে নি। ফলে তার আর আমার যে কমন বন্ধু, স্নেহা, তার কথা আমি বিশ্বাস করি নি। ভেবেছিলাম সে ফাজলামি করছে। সুন্দরী মেয়েরা অসুন্দর ছেলেদের নিয়ে নানা হৃদয়বিদারক ফাজলামি করে-- এরকম কথা হুমায়ূন আহমেদ বইয়ে বইয়ে বলেছে; যেহেতু আমি অসুন্দর কিছুটা ছিলাম কিন্তু তারোধিক সুন্দর ছিল স্নেহা; ফলে এইসব কথা খুব মনে রাখতাম। বন্ধু হলেও আমি স্নেহার সৌন্দর্য ভুলে থাকতে পারতাম না। সে কেমন কেমন করে জানি কথা বলতো, মনে হতো কথায় কোমল স্নেহ মাখিয়ে দিচ্ছে, উড়িয়ে দিচ্ছে কথা, ঘুরিয়ে দিচ্ছে কথা। আর আমার হৃদয়ের দিকে ছুড়ে দিচ্ছে। আর তার বাহু থেকে গ্রীবা থেকে চিবুক থেকে আলাদা আভা ছড়াতো। বুঝতাম ওইটাই রূপ। ওইটাই সৌন্দর্য। স্নেহা সুন্দর, তাই জানতাম সে আমাকে নিয়ে অনেক ফাজলামি করতে পারি, করতেই পারে। এসব ছিল নিপাতনে সিদ্ধ। আমি স্নেহার সকল হৃদয়বিদারক ফাজলামি হাসিমুখে মেনে নিতাম। সেদিনও নিয়েছিলাম।

তখন এমন মোবাইল কিন্তু ছিল না। আমি নাইনে উঠেছি মাত্র। এত বেশি ভাবতেও পারি না। স্নেহা বলে, যেও তুমি। ও কিন্তু আসবে ওই নদীর পাড়ে, ঘাটের যে সিঁড়ি শেষ হয়ে যায় আর ভাঙা একটা পাড় থাকে, ওখানে সে বসে থাকবে... তুমি যেও...

তখনও বান্ধবীরা তুই বলা ধরে নি। আর আমি তো এখনো বলতে পারি না। আমি তাই তোতলাতে তোতলাতে বলছিলাম, ক্যান, ওখানে আসবে ক্যান?
স্নেহা চোখ পিটপিট করে বলেছিল, তা তো সে-ই বলতে পারবে... আমি কী জানি? কিন্তু কী জানি কথা আছে তার তোমার সাথে?

চিন্তায় আমার কপালে ভাঁজ পড়ে। আমার সাথে কথা? তার? অসম্ভব। কোনো মেয়ে আমাকে গোপনে কোনো কথা বলতে পারে তা আমার ধারণারও বাইরের ব্যাপার। আমি তাই ফেলুদা হই। বলি, স্নেহা ক্যান মিথ্যা বলছো?

স্নেহা ব্রু কুচকে ফেলে। বলে, মিথ্যা? তো ঠিক আছে... মিথ্যা তো মিথ্যা... না গেলে যাবা না...!

স্নেহা চলে যায় সন্ধ্যাটা করুণ করে। আর আমার একটা রাত নির্ঘুম কাটে। যারা জেগে রাত কাটাতে পারে না তারা জানে নির্ঘুম রাত কী দুঃসহনীয় হয়। বিছানায় শুয়ে ছটফট আর বারবার পাশ ফেরা। বুকের কাছে কাঁথা টেনে নেয়া আর বারবার ফেলে দেয়া। মনে হয় এই রাত কবে হবে শেষ!

শেষ হয়। ভোর হয়। আজান শোনা যায়। বাড়ির লোক কেউ কেউ ওঠে। কলপাড়ে পানি তোলার শব্দ হয়। ঝাঁট দেয়ার শব্দ। শুকনো পাতা গড়িয়ে যাবার শব্দ। সব শব্দ একেবারে কানের ভেতর বারুদ জ্বালায়। কিন্তু আমি উঠি না। আমার ক্লান্তি লাগে। স্নেহা বলেছে আজ সেই ঘাট শেষে সিঁড়ির কাছে নদীর পাড়ে যেখানে শরতে আসলে দেদার কাশফুল ফোটে আর নৌকাগুলো বেঁকে যায় সেখানে সে আসবে... আমার সাথে দেখা করতে চায় সে... আমাকে কী যেন বলবে...

বিশ্বাস হয় না। সুন্দরীর ফাজলামি ভেবে শুয়ে থাকি অনেকক্ষণ। স্কুল ফাঁকি। পড়ার কোনো তাড়া নেই। আমি শুয়ে শুয়ে ভাবি। যদি সত্যিই আসে। ভয় হয় খুব। বুক ঢিব ঢিব করে। আমি যাই না। যেতে আমার সাহস হয় না। কিন্তু যাবার ইচ্ছাটাও থাকে। মনে হয় স্নেহাকে গিয়ে ডাকি। এই তো দুঘর পরেই বাড়ি। ডেকে বলি তুমিও চলো না আমার সাথে।

কিন্তু স্নেহাকে ডাকতেও ভয় হয়। আমার সকালটা কেমন চিনিহীন পায়েসের মতো হয়ে যায়। আম্মা বলেন, কীরে কী হয়েছে তোর? মুখ এরকম কেন?

আমি মুখ আরো শুকিয়ে ফেলি। বাড়ির ভিতরে প্রেতের মতো হাঁটি। যেন আমি আছি, কিন্তু আমি নেই। যেন ঘরের দেয়ালগুলো ফুঁড়ে বেরিয়ে যাচ্ছি। আবার ঢুকে যাচ্ছি।

স্নেহা বলেছিল, খুশি আমাকে দেখেছে এই তো কদিন আগে। গার্লস হাই স্কুলের সামনে যেদিন ক্রিকেটের ব্যাটটা নিয়ে গেছিলাম, বল খোঁজার নামে, আসলে একটা ভোঁ চক্কর দেয়ার ইচ্ছায়। খুশি আমাকে আগে দেখে নি কারণ খুশিরা এসেছে বদলি হয়ে এই মাঝ বছরে। আর দেখেই নাকি...

স্নেহা এমন বদ, সবটা বলে না। খালি মুচকি মুচকি হাসে। কিন্তু খুশি আমাকে ডাকে কেন? নাকি খুশির কথা শুনে আমার চোখে কোনো চমক দেখে স্নেহা এমন একটা ফাঁদ পেতেছে। সেখানে গিয়ে হয়তো দেখা যাবে স্নেহারাই বসে আছে। আর আমাকে হাতেনাতে ধরে খুব হৈহট্টা করছে। নাহ, যাবো না!

না, যাবো না বলেও কিন্তু যাই আসলে। তবে সেটা বেলা গড়িয়ে। সকালটা পেরিয়ে। ঝা দুপুরে। একটা টিশার্ট আর সবচেয়ে ভালো যে প্যান্ট সেটা পরে। মুখে বড় আপার ফেয়ার এন্ড লাভলিটা লুকিয়ে মেখে। গিয়ে শেষ সিঁড়িটার ওখানে দাঁড়াই। উঁকি দিতেই দেখি পনিটেল। ধক করে ওঠে বুক।

সত্যি খুশি... সত্যি?

মুখ ফিরিয়ে আছে। তার পিঠে স্কুলের নিল কামিজ ঢিলঢিল করছে। ভেতরে সাদা। ওড়না সাদা। তাহলে সত্যি? আমার গলা কেঁপে যায়... ডাকি, খুশি...?
খুশি ঘুরে তাকায়। আর তার কোলের কাছ থেকে, হঠাৎই একটা সাদা বেড়ালছানার মতো বেরিয়ে আসে রঞ্জু। খুশিদের মতোই এইটে পড়ে। আমাকে দেখে খুশি আর রঞ্জু একসাথে বলে, মিঠু ভাই... আপনি?



আমি হাসতে চাই, হাসতে পারি না। কথা বলতে চাই, বলতে পারি না। আমার তখন খুব স্নেহার কথা মনে হয়। যেন সে খুব হাসছে। আর পুনর্ভবা খলবল করে উঠছে। সে হাসিতে আমার রাগ হওয়ার কথা, কিন্তু আমার ভেতর ঝমঝম করছে, মনে হচ্ছে পরিত্যক্ত ওই রেললাইন দিয়ে চলে যাচ্ছে ভারতীয় ওয়াগান। ঝমঝম ঝমঝম!
স্নেহা।

মঙ্গলবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৪

আবু নাসিম বা লখিন্দর কোনোটাই তার নাম ছিল না... (সাত)




সাত.

বাবুভাইয়ের পার্টি মধ্যরাত পেরিয়েও চলেছিল। কিন্তু বাবুভাই চলে যেতেই, যেমন হয় সচরাচর, পার্টিটা ঝিমিয়েও পড়েছিল। মেলা ভেঙে গেলে মাঠজুড়ে যেমন একটা শূন্যতা থাকে, ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে, পার্টিটাকে তখন তেমনই মনে হচ্ছিল লখিন্দরের। আর তার ঘাড়ের পেছনের চুলগুলো ভিজে গিয়েছিল ঘামে। লখিন্দর ঘাম শুকাতে একটা প্রকাণ্ড এসির সামনে দাঁড়িয়ে নিজের হাতের পাত্রের দিকে মন দিয়েছিল। কিন্তু চোখের কোণা দিয়ে সে, হয়তো অকারণেই খেয়াল রাখছিল রঞ্জনাকে।

বাবুভাই চলে গেলে রঞ্জনাও নড়ে ওঠে। একটা মুহূর্তের জন্য সে তাকিয়েছিল লখিন্দরের দিকে। সে দৃষ্টিতে কী ছিল, লখিন্দর চোখপড়া মানুষ হলেও ঠিক ধরতে পারে নি। তারপর এক পা এগিয়ে আমান খানের দিকে এগিয়ে যেতে গিয়েও রঞ্জনা থমকে যায়। বলা যায় ছুটেই বেরিয়ে যায় সে। তার যাওয়াটা দেখে লখিন্দর। লখিন্দরের মনে হয় একটা বর্শা, তার সমস্ত গতি নিয়ে বেরিয়ে গেল, যেন আঘাত করবে লক্ষ্যকে। কিন্তু রঞ্জনার লক্ষ্য কী তা নিয়ে ভাবলো না লখিন্দর। এসব ভাবনা তার কাছে কখনোই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় নি। অথচ, আমরা এখন ভাবি, লখিন্দরের উচিত ছিল এসব ভাবনাকে গুরুত্ব দেয়া। যদি দিতো, আমরা মনে করি, লখিন্দরের প্রলম্বিত ছায়াটিকে এখন আমাদের আমান খানের মতো মনে হতো না। মনে হতো না বারান্দায় বসে মার্টিনি শুষে নেয়া লোকটি দীর্ঘ প্রলয় পেরিয়ে আসা লখিন্দর... যে হারতে হারতে জিতে যেতো প্রায় অলৌকিক উপায়ে। আর আজ সে যেন হেরেই বসে আছে। অপেক্ষা করছে বিজয়ীর। আর তার পানির ট্যাঙ্কের ভেতর হাত-পা বাঁধা অবস্থায় রঞ্জনা... ঘুমাচ্ছে বা জেগে আছে বা আসলে মরে গেছে! আমরা কোনোভাবেই রঞ্জনার এই পরিণতির কথা ভুলতে পারি না। ভুলতে পারি না লখিন্দরের এই নিষ্পৃহতা। রঞ্জনার ঠোঁটের কোণের রক্তবিন্দুগুলো ট্যাঙ্কের পানিতে ধুয়ে ধুয়ে যায়। ট্যাঙ্কের পানি দূষিত হয় ঠিকই কিন্তু তার অধিক দূষণ আমাদের মনে জমে যায়। আমরা দূষিত মন নিয়ে, দুর্ভার নিয়ে করুণা করেই যখন লখিন্দরের দিকে তাকাই, দেখি এসির সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে শুকিয়ে নিচ্ছে আমরা বিচলিত হই। ভাবি, হায় লখিন্দর... শরীর শুকানোর সাথে তুমি যদি তোমার মনটাও শুকিয়ে নিতে... যদি আরো একটু স্পষ্ট দেখার কথা ভাবতে তাহলে জানতে পারতে কী নিদারুণ এক ষড়যন্ত্র তোমার বিরুদ্ধে রঞ্জনার ওই দুধেল বিছানায় রচিত হচ্ছে। কামে আর ক্রোধে, গর্জনে আর বিসর্জনে, ভালোবাসায় আর ঘৃণায় গোখরার সহবাসের মতো লেপটে লেপটে রচনা হচ্ছিল লখিন্দরকে তার উচ্চতা থেকে এক টানে একেবারে অন্ধখাদে নামানোর এক ভয়াল ষড়যন্ত্র। আমরা সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে, যদিও দৃষ্টি দেয়াটা আমাদের উচিত হয় নি, আমরা শিউরে উঠি। থরোথরো কাঁপি। ভাবি তাহলে এই তো মানুষ আসলে। একটা শিশু যা নিয়ে আসে... ক্ষুধা আর তৃষ্ণা, হিংসা আর ঘৃণা, টিকে থাকবার নিদারুণ অভিপ্রায় আর তার বড় হওয়ার সাথে সাথে তার ভেতর যুক্ত হয় কাম... এই তো মানুষ... এর বাইরে তো সে কিছু নয়। এর বাইরে যা-কিছু ভালোবাসা আর বিনয়ের প্রলাপ তা তো এই সভ্যতার হাতুরি... এরাই মানুষ, যারা রঞ্জনার ওই দুধেল বিছানায় সঙ্গমরত, ষড়যন্ত্ররত, টিকে থাকবার বাসনারত... মানুষ তো এর বাইরে কিছু নয়। আমাদের দেখাটা তখন সত্যিকারের দেখা হয়ে ওঠে। আর আমরা ভাবি লখিন্দরও যদি এই দেখাটা দেখতে পেতো। বারবার ভাবি, যদি দেখতে পেতো যদি শুনতে পেতো... আহা যদি পেতো!

কিন্তু পৃথিবীর কিছু নিয়ম তো আছে। যার যখন যা দেখার শোনার জানার কথা, তার বাইরে, সে কখনোই তা দেখতে শুনতে জানতে পারে না। এই নিয়ম কে বানিয়েছে এমন ভেবেছে লখিন্দর খুব। আর এমন ভাবতে হাস্যকরভাবে তার শুধু শৈশবের আঁকা এক চোখঅলা দৈত্যের কথা মনে হয়েছে। দৈত্যটার শরীর মোটা আর থলথলে। একটা মাত্র চোখ আর সাথে মহিষের মতো একাকী শিং। আর এই এসির বাতাস খেতে খেতে তার মনে হলো সেই দৈত্যটা আসলে আমান খান। কিন্তু আমান খানের চোখ আছে দুটি-- পরক্ষণেই ভাবে লখিন্দর-- দুটি নাকি আসলে একটি? আর সারাক্ষণ ঢেকে রাখে সেই চোখ-- একটা গাঢ় সানগ্লাশ দিয়ে। লখিন্দর একবার আমান খানকে নিয়ে ভাবার চেষ্টা করল তখন, কিন্তু তার ভেতরেও হুইস্কির একটা ভোঁদৌড় আছে। মনে হচ্ছিল একটা রকেটবাজি সা করে একবার মাথায় একবার তার পায়ের কাছে আছড়ে আছড়ে পড়ছে। ফলে লখিন্দর একবার বমির কথা ভাবতে পারে, আর বড় জোর ভাবতে পারে পার্টিটা ছেড়ে চলে যাবার কথা।

কিন্তু যাবার কথা তখনো ভাবে নি আমান খান। আমান খানের নেশাটা একেবারে সপ্তমে। কিন্তু রঞ্জনাকে এমন বেরিয়ে যেতে দেখে তার ভ্রু কুচকে গিয়েছিল। বাবুভাই যে জ্বালাটা রেখে গিয়েছিলেন তা তার ভেতরে ছিল, তার দহনও ছিল ধিকিধিক, কিন্তু তাই বলে রাতটাকে তার শুষে নিতেও ইচ্ছা করছিল। আর ওই শোষণের ভেতর এক অদ্ভুত লকলকে বাসনা জাগ্রত হচ্ছিল তার। বাসনা কখনো কখনো নতুন ওই মেয়েটা, যার একটি ফিল্ম বেরিয়েছে, যার নাম দেয়া হয়েছে চুমকি, তার খোলা পিঠের কাছে গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছিল। আমান খানের চোখ লাল হয়েছিল নিশ্চয়, কিন্তু গাঢ় সানগ্লাসের ভেতর দিয়ে তা দেখার উপায় ছিল না। যেমন উপায় ছিল না ওই লকলকে লালসার চেহারাটা দেখার। মেয়েরা নাকি আগে থেকেই এসব টের পায়-- চুমকি হয়তো তাই বেশ কয়েকবার আমান খানের সামনে দিয়ে ঘুরে গেছে। আর আমান খানের ভেতরের লবঙ্গের ঘ্রাণতোলা ধূসর ফলাটা ফুঁসে ফুঁসে উঠেছে। দীর্ঘ সময় মদ্যপান করলে আমান খানের মাঝে মাঝে এমন হয়। সে বাসনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে শুরু করে। কিন্তু এই বাসনা আর চুমকির মাঝে ছিল রঞ্জনার মতো এক শক্ত ও লম্বা দেয়াল। আমান খান তাতে আরো উত্তেজিত হয়ে উঠছিল। কিন্তু রঞ্জনা চলে গেলে, দেয়ালটা সরে গেলে, হঠাৎ সব স্তিমিত হয়ে পড়ে। যেন বাতাসভর্তি একটি বেলুন, একটা পিনের আঘাতে, হঠাৎ করেই চুপসে গেল। আমান খানের হৃদয় এবং ধূসর ফলা যেন নিমিষেই ঘুমিয়ে পড়তে চায়। আর আমান খানের একটা হাই ওঠে। হাই উঠলে আমান খান সাধারণত একটা চুটকি বাজায়, কিন্তু আজ বাজাতে ইচ্ছা করল না তার। বরং কেমন একটা ঘোরলাগা চোখে রঞ্জনার যাবার পথটা দেখতে থাকলো। চুমকি তখন আরো একবারের মতো আমান খানের কাছে এসেছিল, একটা দুর্দান্ত ঘ্রাণ আমান খানের নাক দিয়ে হৃদয়ে যেতে চায়, কিন্তু আমান খানের দরজা-কপাট সব যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর কোনো কিছুই তার ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। আর ভেতর থেকে কোনো কিছুই আর বাইরে আসতে চায় না!

তাহলে বাধাই কি আমান খানের বাসনার উৎস ছিল? আমান খান এসব ভাবে না, বরং তার ভেতর একটা শঙ্কা জন্ম নেয়-- রঞ্জনা কোথায় যাচ্ছে? চলে যাচ্ছে? একা যাচ্ছে? আমান খানকে ছেড়েই? তাহলে কি এত সাহস সে পেয়ে গেল এই এক লহমায়? পেয়ে গেল ওই লখিন্দরের সাথে কয়টা ফিল্মের কথা শুনেই? বাবুভাইয়ের ছায়াই কি এখন তার কাছে সব? আমান খান আর কিছু নয়? সুপারস্টার আমান খান তাহলে আর কিছু নয়?

ক্রোধ হয় আমান খানের। তাকে না বলে রঞ্জনার এই চলে যাওয়া তাকে বিক্ষত করে তোলে। সে তার গ্লাশটা মেঝেতে ছুঁড়ে মারে। শব্দ তো হয় কিছুটা। কিন্তু ঘরভর্তি যে মানুষ তাদের কাছে এই শব্দের তেমন কোনোই গুরুত্ব নেই। কাচ কিছুক্ষণ পরপরই ভাঙছে হেথায়--- এখন মধ্যরাতের পর কেউ কারো কথা শুনবে না, কিছুক্ষণ পরপর কাচ ভাঙবে এমনই তো নিয়ম!

কিন্তু ওই কাচভাঙাটা বেশ খেয়াল করে লখিন্দর। বমির কথা ভুলে যায় সে। একটা মুচকি হাসি কি তখন তার ঠোঁটে ফুটে ওঠে? এই এত আঁধার আর এত লালনীল আলোর ঝলকানিতে ঠিক বোঝা যায় না। কিন্তু মনে হয়, হাসি অথবা একটা কিছু, লখিন্দরের ঠোঁটে ফুটে ওঠে ঠিকই। তাতে, আমাদের চেনা পরিচিত লখিন্দরকে, ভয়ানক দেখায়। মনে হয় এ কোনো গ্রামীণ হিরো নয় বরং হলিউড সিনেমার ঠাণ্ডা মাথার ভিলেন। আর আমাদের তখন খুব আশ্চর্য লাগে। তাহলে নায়কও কখনো কখনো ভিলেন হয়ে উঠতে পারে? আমাদের খুব ঘোর লাগে, অস্থিরও লাগে-- আমরা সুবোধ নায়ক চাই, প্রতিবাদী নায়কও চাই, কিন্তু হ্যাপি এন্ডিং আমাদের দাবী। আর সেই হ্যাপি এন্ডিং-এ নায়ক যেন নায়ক থাকে। নায়ক যেন ভিলেন না হয়ে ওঠে। আমরা নায়ককে নায়ক হিশেবেই চাই, সবসময় চাই! দেখি লখিন্দর এগিয়ে যায় আমান খানের দিকে। হয়তো নায়ক বলেই যায়। একটু ধীর পায়ে। যেন সঞ্চিত শক্তিটা তেমনভাবে খরচ করতে চায় না। আমান খান তখনো ওই ভাঙা কাচ টুকরোগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল। সেগুলোর ওপর লখিন্দরের ছায়া পড়লে আমান খান মুখ তোলে। লখিন্দরকে দেখে তার ভ্রুয়ের মাঝে একটা দাগ তৈরি হয়। লখিন্দর বলে, আপনি ঠিক আছেন তো?

গালি দিতে চায় আমান খান। বলতে চায় শুয়োরের বাচ্চা আমি কেমন আছি তাতে তোর কি... কিন্তু আমান খান বলে না। আমান খান ভালো অভিনেতা বলেই না এই এতদিন ধরে সুপারস্টার। নিজেকে সামলে নিতে তাই তার সময় লাগে না। গালির বদলে লখিন্দরকে হাসি দেয় আমান খান। বলে, আমি ঠিক আছি। তবে তুমি ভালো থাইকো...

শেষের শব্দটা বলার সাথে সাথে পা চালায় আমান খান। বেরিয়ে যায়। টলমল নয়, একেবারে দাপুটে পায়ে। যেভাবে সে এতকাল এই ঢাকাই ফিল্মে চলেছে। খটখট আওয়াজ তুলে। লখিন্দর সে যাওয়াটা দেখে। নায়কের আসা আর যাওয়াটাই মুখ্য সিনেমায়-- এমনকি জীবনেও, লখিন্দর এমন ভাবে। এবং নিজেকে প্রশ্ন করে, বলে, তুমি কি আসতে পেরেছো এখনো? তোমার আসা কি হয়েছে? নাকি তুমি এখনো আসলে অপেক্ষা করছো সেই সত্যিকারের আসার... যে আসাটা ওই আমান খান অর্জন করেছে অনেক অনেক দিন আগেই!

লখিন্দর কোনো উত্তর পায় না ভেতর থেকে। ফলে ভেতরটাকে তার প্রতিপক্ষ মনে হয়। সে প্রতিপক্ষকে জ্বালিয়ে দিতে চেয়ে ঢক করে গেলে আরেক পেগ হুইস্কি। এবং লখিন্দর অপেক্ষা করে প্রতিপক্ষের। আর প্রতিপক্ষ কিছুক্ষণের ভেতরেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। লখিন্দর একবার ওয়াক করে শব্দ করে। তারপর হড়হড় করে করে বের করে দিতে থাকে অর্থহজম খাদ্য ও পানীয়। অচেনা শিরাউপশিরায় খাদ্য ঢুকে পড়ে। আমান খানের ভাঙা গ্লাশের ওপর লখিন্দর বমি করতে থাকে। লখিন্দরের মনে হয় সে মরে যাচ্ছে... আর এমন অনুভূতির ভেতর তার এই প্রথম মনে হয় সে আসলে খুলে খুলে যাচ্ছে। তার ভেতরের সমস্ত দরজা-জানালা-কপাট খুলে যাচ্ছে। লখিন্দর বমির শেষ বিন্দুটি উগড়ে দেয় মেঝেতে। তারপর পকেট হাতড়ে একটা সুগন্ধী রুমাল বের করে সে। সেটা দিয়ে মুখটা মোছে। রুমালটা তার খুব পরিচিত মনে হয়। রুমালের সুগন্ধ তার বমির দুর্গন্ধে ভরে যায়। লখিন্দর একবার হেসে ওঠে। তারপর নিজেকে সামলে নেয়। ফলে আমরা লখিন্দরের দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাই। আর আমান খানের গাড়ির ব্যাকলাইট ধরে চলে যাই রঞ্জনার বিছানা পর্যন্ত। যা দেখার আমাদের অধিকার নেই তাই দেখি ফেলি তখন। যা শোনার আমাদের অধিকার নেই তাই শুনে ফেলি তখন। যা জানার আমাদের অধিকার নেই তাই জেনে ফেলি তখন।

কিন্তু আমাদের ভেতর কোনো অপরাধবোধের জন্ম হয় না। বরং মানুষ আর সভ্যতার অসীম দূরত্ব আরেকবারের মতো আমাদের চোখের সামনে উন্মোচিত হয়।

(চলবে...)

ছবি: গুগল চিত্র

সোমবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৪

মেঘমল্লার : যত্ন করে বানানো না-গল্পের সিনেমা অথবা আমাদের শীত ও উষ্ণতার গল্প





















আমাদের এই কথা বলার পেছনে যা কাজ করেছিল তা হলো আসলে সিনেমাটা নিয়ে তারা খুব কথা বলছিলেন। তারা, মানে যাদের কথার গুরুত্ব আছে। ১২ ডিসেম্বরের আগেই সিনেমাটার একটা স্পেশাল শো রাখা হয় ঢাকার স্টার সিনেপ্লেক্সে। সেখানে সুধীজনেরা সিনেমাটা দেখেন এবং উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। তাঁদের মধ্যে থেকে এরকম একটা ভাষ্যও উঠে আসছিল যে বাংলাদেশের সিনেমা বদল হওয়ার শুরুটা হয়েছে এই মেঘমল্লার ধরে।

আমরা যারা হতাশাবাদী, এবং সিনেমাপাগল, কিন্তু সিনেমাবোদ্ধা নই, আমরা তখন খুব আশাবাদী হয়ে উঠি। আমরা তক্কে তক্কে থাকি কখন সিনেমাটা দেখতে যাবো। আমরা বলতে থাকি যে আমরা যাবো, কিন্তু আমাদের যাওয়া হয় না। আমাদের অপেক্ষা দীর্ঘ হয়।এছাড়াও আরো ব্যাপার ছিল। একটা ব্যাপার যে সিনেমাটার গল্প আবার আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রখ্যাত গল্প রেইনকোট থেকে নেয়া হয়েছে। আমরা উন্মুখ হয়ে থাকি ফলে। আবার ভাবি যে ওই গল্পটার কথা, মানে রেইনকোটের কথা, আমাদের ভুলে যেতে হবে। কারণ আমরা জানি, জানি মানে লোকশ্রুতিতে এই জানা যে, সিনেমার ভাষা আর গল্পের ভাষা বা উপন্যাসের ভাষা আলাদা-- ফলে দুইটার মধ্যে মিলিয়ে ফেললে চলবে না। এই মিলিয়ে ফেলাটা গর্হিত কাজ। ফলে আমাদের কেউ কেউ মূল গল্পটা, ইলিয়াসের গল্পটা, ভুলে যেতে চাই। আর যারা গল্পটি পড়ে নি তাদের আমরা গল্পটা আর সরবরাহ করি না। বলি এখন সময় সিনেমার, গল্পের না।

এখন সময় সিনেমার, গল্পের না। এরকম বলে আমরা বেশ চমকাই, ভাবি তাই কি যে এখন সময় সিনেমারই-- গল্পের সময় কি তাহলে ফুরিয়ে গেল? কিন্তু আমরা এসব বেশি ভাবতে পারি না। কারণ ভাবনার যে অংশ অতিক্রম করলে মানুষ মহৎ হয়ে ওঠে সে অংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে আমরা এখনো শিখি নি। তেমন কলা আমাদের জানা নাই। কিন্তু মেঘমল্লার দেখার জন্য আমরা এক ধরনের প্রস্তুতির ভেতর দিয়ে যেতে থাকি। এই প্রস্তুতিটা আমাদের সুখী করে তোলে। আমরা প্রতিদিনই বলি আজ যাবো আজ যাবো আর দিনশেষে বলি কাল যাবো এভাবে আর আমাদের যাওয়া হয় না। আমাদের গ্লানি বাড়ে। আমরা চাই বাংলাদেশের বাংলা সিনেমাগুলো আমরা দেখবো... এটা এক ধরনের কমিটমেন্ট এবং আশা যে আমাদের ছবিগুলো খুব ভালো হবে দারুণ হবে... তবে আমরা জানি না আসলে দারুণ সিনেমার সূত্র কী? আমরা সূত্র তো জানি না। এই মূর্খতার জন্য আমাদের কাছে অদ্ভুতভাবে কিছু কিছু বাজারি সিনেমাও ভালো লাগে। আবার পৃথিবী কাঁপানো সিনেমাগুলোরও কিছু কিছু খারাপ লাগে। অবশ্য আমরা এসব বলতে পারি না... যদি বোদ্ধারা আমাদের জ্ঞানের খামতিটা ধরে ফেলে! আমরা তাই চুপ থাকি!

আমরা চুপ থাকি কিন্তু আমাদের ভেতর ছটফট করতে থাকে এবং এক সকালেই আমরা ঠিক করি আজই আমরা মেঘমল্লার দেখতে যাবো। আজ না গেলে আর কখনো নয়। মেঘমল্লার দেখতে না গিয়ে আমরা সিনেমাটার ওপর এখন পর্যন্ত যে অবিচার করেছি তার ঋণ শোধ করতে আমরা আরো কয়েকজনকে ডাকি। মেঘমল্লার দেখতে যাবার আমন্ত্রণ জানাই। কেউ কেউ অবশ্য জোটে, তবে অনেকেই পিছলে যায়। দুয়েকজন জোটে বলা যায়, তবে আমাদের দলটা ভালোই হয়। অবশ্য সবাই কমবুদ্ধির দর্শক। কিন্তু আমরা তাতে সন্তুষ্ট হই।

আমরা জেনেছিলাম মেঘমল্লার ঢাকার চারটা সিনেমাহলে মুক্তি দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে বলাকা একটা। বলাকা আমাদের প্রিয়। বলাকায় টিকেটের দাম তুলনায় কম। এই তুলনাটা আমরা সাধারণত স্টার সিনেপ্লেক্সের সাথে করি। আমরা নিজেদের মধ্যে বলি যে স্টারে দেখার চেয়ে মেঘমল্লার বলাকাতেই দেখা ভালো। এই ভালোটা আসলে অর্থনৈতিক। আর সাথে কিছুটা ইংরেজি থ্রিডি সিনেমাপ্রীতি। এই থ্রিডি সিনেমাগুলো আড়াই শ' তিন শ' সাড়ে তিন শ'-তে স্টারে দেখা যায়, এরকম মনে হয় আমাদের কাছে। মেঘমল্লার তো আর থ্রিডি কিছু না। ফলে তাকে আমরা বলাকাতেই কতল করতে চাই। যেমন কিছু দিন আগে পিঁপড়াবিদ্যাকে করেছিলাম। ফলে আমরা বিভিন্নভাবে বলাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিই। আমরা নিজেদের ভেতর খুব আগ্রহ বোধ করতে থাকি। সিনেমাটা জাহিদুর রহিম অঞ্জন বানালেও... বানালেও এ জন্যই যে এটি তাঁর প্রথম সিনেমা, সিনেমা নিয়ে এর আগে শুধু শিক্ষকতা করেছেন, শর্টফিল্ম বা ডকুমেন্টারি কিছু বানিয়েছে কিনা আমরা জানি না, আমরা আগেই বলেছি আমরা বেশ মূর্খ দর্শক আছি! তবে মেঘমল্লারের ট্রেলার দেখে আমরা উচ্ছ্বসিত হয়েছিলাম। সঙ্গে শহীদুজ্জামান সেলিম আছেন, তাঁকে আমাদের টিভি-নাটকের দশক থেকেই ভালো লাগে। এবং আমাদের মতো মূর্খদের কাছেও মনে হয়েছে যে বাংলাদেশের টিভি নাটক অভিনেতাদের যে-কজন নিজের অভিনয়ক্ষমতার সূচককে উত্তরোত্তর ওপরের দিকে নিয়ে গেছেন তার মধ্যে সেলিম একেবারে প্রথম সারির; কখনো কখনো, এমনকি, একমাত্র মনে হয়। কিন্তু মূর্খ হওয়ার কারণে আমরা এত বড় দাবী করতে পারি না। আমরা এরকম দাবী নিজেদের চায়ের আড্ডাতেও ধীরে বলি, যেন অন্য আড্ডারা এসব শুনে না নেয়। শহীদুজ্জামান সেলিম ছাড়াও মেঘমল্লারে অপর্ণা আছেন, তিনি পরিচিত মুখ। আর আছে একটা ছোট মেয়ে। যার কাজ আমরা কখনোই দেখি নি, কিন্তু পরিচালক অঞ্জনের কোনো এক সাক্ষাৎকারে শুনেছিলাম সেই পিচ্চি নাকি অপূর্ব অভিনয় করেছে। ফলে আমাদের খুব লোভ হয়। আমরা, কত দিন, অপূর্ব কিছু দেখি না!

আমরা ঝটফট বলাকার সামনে নামি এবং মেঘমল্লারের পোস্টার দেখার জন্য এদিক ওদিক তাকাই। নাই। পোস্টার নাই। আমরা আশ্চর্য হই বটে তবে আমরা নিজেদের মধ্যে সেই বিস্ময় প্রকাশ করি না। আমরা ভেতরে যাই, টিকেট কাউন্টারে দাঁড়াই। আমরা ছয়টার শো দেখতে চাই। এবং টিকেট কাউন্টার থেকে উত্তর আসে মেঘমল্লার তো চলতাছে না। নাইমা গেছে... 

নাইমা গেছে? মানে কী? আমরা দেখার আগেই সিনেমাটা নেমে যায় কী করে! আমরা এরকম ভাবি। আমরা বিচলিত হই। সংক্ষুব্ধ হই। আমরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি। আমরা জায়গা পেলে পায়চারি করতাম কিন্তু আমরা জায়গা পাই না। তখন কেউ একজন ইন্টারনেট সার্চ করে আর আমাদের জন্য সুসমাচার নিয়ে আসে। তাকে আমাদের ত্রাতা মনে হয়। ত্রাতা বলে, এখনো সময় আছে, সাড়ে সাতটায় শো আছে... স্টার সিনেপ্লেক্সে সাড়ে সাতটায় শো আছে... মেঘমল্লারের শো আছে...

আমরা বেশিক্ষণ ভাবি না। ত্রাতার আহ্বান আমরা সাধারণত কখনোই উপেক্ষা করতে পারি না। এটা আমাদের রক্তের ভেতরেই আছে। আমরা তাই আবার রিকশায় উঠি। স্টার সিনেপ্লেক্সের দিকে আমাদের রিকশা চলতে থাকে। কিন্তু বেশিক্ষণ চলতে পারে না। আমরা বারবার জ্যামে আটকে আটকে যাই। ঘড়িতে ছয়টা এবং রাস্তা পনের মিনিটের হলেও আমরা ভাবতে থাকি যে আমরা শো পাবো কিনা। ঢাকার জ্যাম আমাদের এরকম ভাবায়। আমরা বিচলিত হবো কিনা বুঝতে পারি না। আমরা জ্যামের ভেতর উদ্বিগ্ন হয়ে বসে থাকি। কিন্তু আমাদের রিকশাঅলাগুলো ঢাকার তস্যগলি চেনেন। তাঁরা আমাদের এদিক ওদিক দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বসুন্ধরা সিটির সামনে, অপজিট রাস্তায়, নামিয়ে দেয়। নেমে আমরা মোবাইলে সময় দেখি। দেখি যে আরো বিস্তর সময় আছে। আমরা তখন ভাবি এত সময় নিয়ে আমরা কী করবো?

আমরা ছয়টা টিকেট কাটি। এবং অপেক্ষা করি। অপেক্ষা লম্বা হয়। সাড়ে সাতটায় শো কিন্তু সাতটাও বাজতে চায় না। আমরা খুচরো কাজ করি, টিভি নিয়ে কথা বলি, ঘুরে বেড়াই অযথা তারপর দেখি সাতটা বেজে পার হয়েছে। সাতটা সতেরোর দিকে আমরা হলের করিডোরে ঢুকতে পারি। তিন নাম্বার হলে সিনেমাটা দেখানো হবে, ফলে আমরা সেই সিনেমাহলের দরজার কাছে যাই। এবং একটু ধাক্কা খাই। সাধারণত যেমন দর্শক থাকে দরজার বাইরে, ভেতরে ঢোকার জন্য তাদের মধ্যে যেমন উচাটন থাকে, এখানে এই তিন নম্বরের সামনে তার চিত্রটা একেবারেই বিপরীত। কেউ নাই। আমরা হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে লাইন ধার করি, বলি, আরে কোথাও কেউ নেই!

ফলে এই ফাঁকা ফাঁকা জায়গায় আমরা ছবি তুলি দুয়েকটা। পপকর্ন কিনি। পপকর্ন কিনতে গিয়ে আমাদের কেন যেন মনে হয় মেঘমল্লারের সাথে পপকর্ন ঠিক যায় না। আমরা হাতে পপকর্ন নিয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। তখন আমরা একে অপরকে বলি যে আমাদের খুব অদ্ভুত দেখাচ্ছে। আমরা পপকর্ন নিয়ে মেঘমল্লারের জন্য অপেক্ষা করছি-- এটা যেন কেমন... পপকর্ন না হয়ে ভুট্টার খই হলে কি মিলতো বেশি? মেঘমল্লারের সাথে? আমরা এরকম ভাবি আবার ভাবি না। আমাদের দাঁড়ানোর জোর থাকে না, আমরা বসে পড়ি। বসলে আবার ভালো লাগে না, তখন আমরা উঠে দাঁড়াই। এরকম চলতে থাকে কিছুক্ষণ। আমরা হতাশ হই যে তেমন দর্শক নেই। এটাতে হতাশ হই। এরকম একটা হতাশা এই শীতের মধ্যে ধরে। তখন আমাদের আরো শীত করতে থাকে। আমাদের কারো কারো পকেটে বাহারি টুপি। তারা সেগুলো বের করে আর বলে, এসিটা বাড়ানো... কান ঢাকি কান ঢাকি! কিন্তু আমাদের কারো কারো মনে হয় বাইরে থেকে না আসলে শীতটা আসছে ভেতর থেকে। রক্ত থেকে কী? দর্শক নেই আর আমাদের শীত বাড়ে। আমরা দর্শকের অপেক্ষা করি, দর্শক আসে না।

সাড়ে সাতটা বেজে গেলে আমরা হলের ভেতর ঢুকি। আমরা ঢুকতে ঢুকতে ভাবি হলে বোধহয় কেউ নেই। বোধহয় আমরা ছয়জনে একাই সিনেমাটা দেখবো। তারপর ভাবি ছয়জন তো আসলে একা হতে পারে না। এ নিয়ে আমরা একটু হাসাহাসি করি। হাসতে গিয়ে আমাদের হাত থেকে দুয়েকটা পপকর্ন পড়ে যায়। আমরা সেদিকে মায়ার সাথে তাকাই। আমাদের আবারো মনে হতে থাকে মেঘমল্লার আর পপকর্ন এক সাথে যেতে পারে না যেতে পারে না। কিন্তু আমরা যাওয়াচ্ছি বলেই মনে হয়। আমরা সিটে বসে যাই। বসার আগে দেখি একটা সিটের সারি জুড়ে সাত-আট জনের দর্শক। এই দর্শক সারি দেখে আমাদের ভালো লাগে। আমাদের মনে হতে থাকে যে আমরা আসলে একা নই। আমরা ছয়জনেও একা ছিলাম না, কিন্তু এই দর্শক সারি দেখে ভাবতে ভালো লাগে যে আমরা আসলে একা না। ফলে আমাদের হতাশা কাটতে থাকে। আমাদের শীত যেন কমে আসে। যারা টুপি পরেছিল, বা হুডি উঠিয়ে নিয়েছিল মাথায় তারা সেগুলো ফেলে দেয়। কে জানি বলে, ভিত্রে তো গরম মেলা... 
আমরা তখন যে দর্শক এসেছে তাদের দিকে তাকাই। তাদেরও গরম লাগছে বলেই মনে হয়। এক তরুণী দর্শক তার কার্টিগেন খুলে ফেলে। অথচ এসি তো চলছে। বিজবিজ আওয়াজও হচ্ছে। আমাদের ভালো লাগে। হতাশা কাটতে থাকে। আমাদের ভালো লাগে। আমরা বুকের জিপার খুলে দিই। বাইরের শীত থেকে ভেতরের উষ্ণতাকে উপভোগ করি। আমাদের ভালো লাগে।

আমরা তখন বেশ তাড়াতাড়ি পপকর্ন খেতে থাকি, কারণ সিনেমা তখনো শুরু হয় নি। পর্দায় বিজ্ঞাপন চলছে। আমাদের মনে হয় মেঘমল্লার শুরুর আগেই আমাদের পপকর্ন খেয়ে শেষ করে দেয়া উচিত। মুক্তিযুদ্ধ ও তার অবরুদ্ধতার ভেতর পপকর্ন খুব খাস্তা আর শস্তা মনে হতে পারে, আমরা এরকম ভেবে ভেবে পপকর্ন চিবাতে থাকি। একটু শব্দ হয় চিবানোয়, তাতে আমাদের অস্বস্তিও হয়। ফলে আমরা পর্দায় চলা বিজ্ঞপনের দিকে মনোযোগ দিই। কিন্তু বিজ্ঞাপনগুলো ভালো লাগে না। আমরা তখন নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করি। বলাকা থেকে স্টার সিনেপ্লেক্সে আসায় আমাদের মধ্যে একটা কমপ্লেক্সে তৈরি হয়। আমরা কেউ কেউ ভাবি এর থেকে ইংরেজি কোনো সিনেমা দেখাই হয়তো উচিত। কিন্তু আমরা আমাদের লম্বা প্রস্তুতির কথা ভাবি। আমরা ভাবি মেঘমল্লারের জন্য আমরা যে-সময় আর প্রস্তুতির ভেতর দিয়ে গিয়েছি তাতে মেঘমল্লারই হবে আজকের জন্য প্রথম ও শেষ। এরকম ভাবতে ভাবতে আরো কয়েকজন দর্শক চলে আসেন। তাঁদের দেখে আমাদের খুব ভালো লাগে। শান্তি শান্তি লাগে। ভাবি যে ভালো সিনেমা দেখার লোক তো এখনো কিছু আছে। আগ্রহ আছে। আমাদের শীত প্রায় শেষ হয়ে আসে।

এরকম আরো কিছু লোক যখন এসে যায়, যখন প্রায় সাতটা পঁয়তাল্লিশ আমাদের মোবাইলে, তখন হঠাৎ পর্দায় জাতীয় পতাকা দেখা যায়। আমরা তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে যেতে চাই। আর দাঁড়াতে গিয়ে আমাদের অবশিষ্ট পপকর্ন পড়ে যায়। আমরা পপকর্ন তুলি না, পপকর্ন ছড়িয়ে থাকে। আর আমরা দাঁড়িয়ে থাকি। জাতীয় পতাকা পতপত ওড়ে। জাতীয় সঙ্গীত বাজে। আমাদের খুব মায়া মায়া লাগে।

এরপর সিনেমা শুরু হয়। আমরা বসে পড়ি। পর্দাজুড়ে বাংলাদেশ। গাছের ঝোপ। গাছের ঝোপ কাঁপতে থাকে। আমরা অপেক্ষা করতে থাকি। গাছ কাঁপতেই থাকে। তারপর একটা ট্রাক আর তাতে সদ্য জন্ম দেয়া বাংলাদেশের ছোট পতাকা উড়তে থাকে, এরকম দেখি। বৃষ্টি। রাতের ঘাটে একটা নৌকা এসে থামে। নৌকা থেকে কয়েকজন তরুণ নামে। পূর্ব অভিজ্ঞতা ও ধারণা থেকে বুঝতে পারি এরা মুক্তিযোদ্ধা। যেহেতু আমাদের প্রেক্ষাপট জানা আছে। কিন্তু যাদের জানা নেই তারা কী করে সময় আর স্থান বুঝবে এরকম একটা প্রশ্ন ওঠে আমাদের ভেতর কিন্তু আমরা খুব স্বৈরতায় প্রশ্নটার গলা টিপে ধরি। আমরা অপেক্ষা করি। দেখি একটা বাড়িতে একটা ছেলে খাতায় কিছু একটা আঁকছে আর বিছানায় দাঁড়িয়ে আছে একটা পিচ্চি মেয়ে। তাদের কথাবার্তায় এবং পরে, ঘরের ভেতরে গৃহিণীর উপস্থিতিতে, আমরা কিছু তথ্য জানতে পারি; তাতে আমরা সিনেমার সূত্র ধরার চেষ্টা করি। বুঝতে পারি এ ছেলেটি ওই গৃহিণীর ভাই, পিচ্চির মামা। সে মুক্তিযোদ্ধা। বোনের চাপাচাপিতে মুক্তিযোদ্ধাটি তার পরনের রেইনকোটটি খুলে রেখে গোসলে যায়। রেইনকোটটি সবার অলক্ষ্যে নিতান্ত সাধারণভাবেই ঘরে থেকে যায়। আমরা কেউ সেদিকে খেয়াল করি না আসলে।




বৃষ্টি আর বৃষ্টি। একটা গুমোট আওয়াজ। জানালা আর মশারির বাইরে থেকে দেখা দৃশ্যগুলো পর পর চলতে থাকে। আমরা কিছু জানতে পারি কিছু ধারনা করি। এখানে আমাদের পূর্বধারণার খুব প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আমরা আগের অভিজ্ঞতার সাথে বর্তমান দৃশ্যগুলো জড়িয়ে ফেলে এগোতে থাকি। দেখি শ্যালক মুক্তিযোদ্ধা হলেও বাড়ির কর্তা এসব যুদ্ধে খুব একটা আগ্রহী নন। তিনি কলেজের শিক্ষক। ছাপোষা ধরনের মানুষ। এবং ভীতু। ভীতু কারণ তাদের বাড়িতে কেউ কড়া নাড়লে, এগিয়ে যেতে চেয়েও, তিনি এগিয়ে যান না। তাঁর স্ত্রী যান। দরজা খুলে দেন। এখানে যেমন বাড়ির কর্তার চরিত্রটা বেশ বোঝা যায় তেমনি বোঝা যায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দেশজুড়ে যে অবরুদ্ধভাব ছিল সেটা। আমাদের আবার গরম লাগতে শুরু করে। আমাদের কেউ কেউ শীতের পোশাক খুলে ফেলে। কেউ কেউ খুলবে কি খুলবে না এরকম একটা জায়গায় থাকতে থাকতে সিনেমা দেখতে থাকে। আমরা দেখি যে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ওই বাড়ির কর্তা কলেজ যান নিয়মিত। যদিও কয়েকজন শিক্ষক ছাড়া কলেজে আর কেউই আসে না। স্ত্রীর প্রত্যাশায় রেডিওর ব্যাটারি কিনতে গিয়ে বাড়ির কর্তাটা দোকানদারকে যেন জোর করে জানান ব্যাটারিটা কিনছেন আসলে টর্চের জন্য। আমাদের সামনে তখন একটা চরিত্র যেন দাঁড়াতে চায়, মানে দাঁড়ানোর একটা চেষ্টা যেন করে। আমরা আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকি। আমাদের গরম লাগে। শীত আর লাগে না।



এদিকে বাড়ির কর্ত্রীর তার ভাইয়ের প্রতি মমতা যেমন আছে তেমনি গ্রামে চলে যাওয়ার ইচ্ছাও আছে। তিনি রেডিও শুনতেও চান। তেমন প্রবলভাবে প্রকাশ না পেলেও মনে হয় দেশ নিয়ে তার এক ধরনের উদ্বেগ আছে। আর পিচ্চি মেয়েটা যেন কিছুটা নিঃসঙ্গ। সে একা একা দেয়ালে ছবি আঁকে। তার যে মামা যুদ্ধে চলে গেছে সেই মামাই কি তাকে সময় দিতো? তার সাথে খেলতো? ছবি আঁকতো? এরকম একটা সূত্র সিনেমার প্রথমে পেলেও পরে আর পাই না। সেই মামাই কি তার খেলার সঙ্গী ছিল? হতে পারে। নাও হতে পারে। এ ধরনের প্রশ্ন ওঠে এবং সমাধান না হয়েই চলতে থাকে। সমাধানের জন্য আমাদের ভেতর তেমন কোনো ইচ্ছা জাগে না বরং আমরা সিনেমাটার প্রবাহের সাথে চলতে থাকি। সিনেমার ছবি আমাদের চোখকে শান্তি দেয়। আমাদের মনে হয় বাংলাদেশের সিনেমায় আমরা এত ভালো চিত্র দেখি নি। সিনেমার শব্দ আমাদের কানে প্রয়োজনীয় অস্বস্তি দিতে থাকে। আমাদের খুব ভালো লাগে। আমরা নিজেদের মধ্যে বলি ভালো ভালো খুব ভালো। আমরা দারুণভাবে আশাবাদী হয়ে উঠি। এবার ভালো কিছু হবে। দারুণ কিছু হবে। আমাদের খুব গরম লাগতে লাগে। আমরা সবাই শীতের পোশাক খুলে ফেলি আর তখন ইন্টারভেল হয়।




আমরা বাইরে এসে আবারো কিছুক্ষণ ছবি তুলি। একটা ক্রিসমাস ট্রিকে কেন্দ্র করে আমাদের মোবাইলের ক্যামেরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে তবে আমরা ভাবতে থাকি সিনেমাটা নিয়ে। আমরা বলাবলি করি যে এত ভালো শব্দ আর এত ভালো দৃশ্য... আমরা যেন খুব আরাম পাই, আমরা দারুণ আশাবাদী হয়ে উঠি। আমরা সময় শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই ভেতরে গিয়ে বসি। সিনেমায় তখন বাড়ির কর্তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আর্মি ক্যাম্পে। মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে তার কাছে প্রশ্ন করা হচ্ছে। লোকটি জানান তিনি কিছুই জানেন না। দর্শক হিশেবে আমরা জানি লোকটি সত্য বলছে। ওদিকে তার বাড়িতে তার বউ আর ছোট মেয়েটা একটা শঙ্কা আর অপেক্ষার জীবন কাটায়।

বলে রাখা ভালো বাড়ির কর্তা যখন আর্মির ডাকে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন তখন তার শ্যালকের রেইনকোটটি পরে বের হয়েছিলেন প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে। আর তখন তার মেয়েটি বলেছিল, বাবা তোমাকে দেখতে মামার মতো লাগছে।
কথাটি আমাদের মধ্যে গুঞ্জরিত হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আসলে হয় না। আমরা আশা করি সেই সূত্র আমরা পাবো আমরা পাবো। আমরা রেইনকোট ও তার ভেতরের মানুষের পরিবর্তনের যে প্রত্রিয়া তার ভেতর দিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করি। অপেক্ষা দীর্ঘ হয়, অপেক্ষা শেষ হয় না। অপেক্ষা শেষ হয় না। আমাদের আবার শীত লাগতে শুরু করে। হঠাৎ জাঁকিয়ে শীত পড়ে যেন। যেন হিম পড়ছে। আমরা তাড়াতাড়ি শীতের পোশাক পরি। কিন্তু আমাদের শীত লাগতেই থাকে। শীতের কাপড় ফুঁড়ে শীত আমাদের রক্ত বা হাড় বা অন্য কোথাও, হৃদয়েই নাকি, প্রবেশ করে। আমরা পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু আমাদের খুব শীত করে। আর অবশেষে আমাদের অপেক্ষা যেন শেষ হয়। কিন্তু হয় বলেই মনে হয় আসলে। পর্দায় দেখি কর্তাটি বলে ওঠেন, আমি জানি সব জানি। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে সব জানি। কিন্তু আমি বলব না!




আমরা বুঝতে পারি লোকটা মিথ্যা বলছে, আসলে বিদ্রোহ করছে আর তখন তাকে গুলি মারে আর্মিটি। কর্তাটি, শিক্ষকটি, লোকটি মারা যায়। তার পরনে তখনও সেই রেইনকোট।

তারপর আবার সেই ট্রাকে ফিরে আসি সিনেমায়। গৃহিণী আর তার মেয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। চলে যাচ্ছেন।ছোটগল্প পড়ার মতো আমাদের অতৃপ্তি থেকে যায়। আমরা যেন আরো কিছু চেয়েছিলাম কিন্তু তা দেখা হয় না। মনে হয় সমস্ত সম্ভাবনাই মরে গেল। মরে গেল আসলে কর্তাটি মরে যাওয়ার আগেই। বিরতির পর থেকেই একটু একটু মরে গেল। দারুণ চিত্র আর শব্দ নিয়ে একটা দারুণ সম্ভাবনার গল্প আর গল্প হয়ে উঠল না। আমাদের প্রচণ্ড শীত লাগে। একজন তার ব্যাগের ভেতর থেকে চাদর বের করে পরে। তাকে দেখে আমাদের কষ্ট হয়। দেখি তার ঠোঁটের ওপর বরফের কুচি। তারপর দেখি আমাদের সবার ঠোঁটের ওপর আর চোখের কোণায় বরফের কুচি। আমরা যেন জমে যাচ্ছি। আমরা উত্তাপ খুঁজতে চাই বারবার স্মৃতি ধরে। কিন্তু আমাদের বরফ গলে না।

হল থেকে বের হতে হতে উত্তাপের আশায় আমরা আবার পর্দায় ফিরে যায়। সিনেমায় যেভাবে ফ্ল্যাশব্যাক ফিরে যান পরিচালক সেভাবেই ফিরে যায়। আর ছবিটা মনে মনে আবার দেখি। বারবার দেখি। তখন কিছু ছবি আটকে যায়। কিছু ছবি আটকাতে চেয়েও সরে যায়। এরকম হয়। আমরা শীতাক্রান্ত হতে হতে বারবার উষ্ণতা খুঁজতে থাকি মাত্র শেষ হওয়ার ছবির ছবিতে। আমরা একটা ক্রমছবি পাই। ছবিগুলো ওই বাচ্চা মেয়েটার।




 বাচ্চা মেয়েটাকে দেখি একটা দৃশ্যে বাবা-মার সাথে রাতের খাবার খাচ্ছে। মা খাইয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু বাচ্চাটা খেতে চাচ্ছে না। মা অভিযোগ করেন মাছ মাংস অন্ততপক্ষে ডিম না থাকলে বাচ্চাটা কী করে খাবে? কর্তা একটু অসহায় যেন। বাচ্চাটিকে তার মধ্যেই খেতে বলেন এবং নিজেও খেতে থাকেন।

কর্তার ক্যাম্পে চলে যাওয়ার পর একই রকম একটা দৃশ্যে দেখি বাচ্চাটা নিজে নিজে থালায় ভাত মাখছে। কিন্তু খাচ্ছে না। মা সেটা দেখেন এবং জানতে চান সে ভাত খাবে কিনা। বাচ্চাটা জানায় খাবে না। মা তার হাত ধুইয়ে দেন। বাচ্চার না খাওয়ায় তেমন গুরুত্ব দেন না।একইরকম আরেকটা দৃশ্যে দেখি আরো পরে। সিনেমার শেষের দিকে। দেখি বাচ্চাটা একা একা ভাত খাচ্ছে। তার পাশে বাবা তো নেই, এমনকি মা-ও নেই। বাচ্চাটা একা একা যত্ন করেই খাচ্ছে। আমাদের মনে হয় যুদ্ধের সময়টা আসলে এমনই তো নিষ্ঠুর। ধীরে ধীরে সব কিছু এভাবেই, যুদ্ধে আসলে এভাবেই, বদলে যায়। এই ছবিটা আমাদের মাথায় আটকে থাকে। কিন্তু গল্পটা তো এখানে নয়। মনে হয় গল্পটা অন্য কোথাও। কিন্তু গল্পটা যেখানে সেখানে গিয়েও গল্প পুরোটা পাওয়া যায় না এরকম লাগে। শীত লাগতেই থাকে, শীত কাটে না।

মনে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের দৃশ্যগুলো মূল গল্পের সাথে, আসলে মূল গল্প বলে যদি কিছু থাকে, তার সাথে মেশে নি।
মনে হয় শিক্ষকের মৃত্যুর আগে ও পরের যে অংশগুলো উদ্বেলিত হতে পারতো সেগুলো হয় নি।
মনে হয় সিনেমায় যে প্রশস্ত পটভূমির সুযোগ থাকে তা ব্যবহার করা হয় নি।
মনে হয় যেভাবে গল্পটি বলা হয়েছে, বোধহয় বলার চেষ্টা করা হয়েছে শব্দটিই উপযুক্ত, তা একটা প্রায় পূর্ণদৈর্ঘ সিনেমার জন্য যথেষ্ট নয়।
মনে হয় চিত্র আর শব্দে অনেক যত্নবান, বাংলাদেশের ছবির জন্য পথপ্রদর্শক হওয়া সত্বেও, গল্প বলার জায়গায় রয়ে গেছে স্পষ্ট অযত্ন।

আমরা যত্নের কথা আবার ভাবতে থাকি। তখন আমাদের গরম লাগে। সিনেমাজুড়ে পরিচালকের প্রপস আর চিত্রধারণের যত্নের কথা ভেবে আমাদের চুলের গোরাগুলো ঘামতে থাকে। বসুন্ধরা থেকে বেরিয়ে, বাইরে ডিসেম্বরের হিমবাহ থাকলেও, আমাদের গরম লাগতে থাকে। ভাবি যে আহা কী অদ্ভুত যত্নই না করেছেন অঞ্জন। বাড়ির সমস্ত প্রপস, কলেজের সমস্ত প্রপস, বৃষ্টিধোয়া মেঝে, করিডর এত যত্নের এত যত্নের যে আমাদের গরম কাপড় খুলে ফেলতে ইচ্ছা করে। কিন্তু পরক্ষণেই আমাদের গল্পটির কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে এই গল্প একটা যথেষ্ট লম্বা সিনেমার জন্য নয়। এটুকু দিয়ে একটা বিশ মিনিটের দুর্দান্ত শর্ট-ফিল্ম হতে পারে, সিনেমার জন্য দরকার আরো কিছু। আমরা আবার হতাশ হয়ে পড়ি। আমাদের শরীরে শীত ফিরে আসে। ভাগ্যিস আমাদের সাথে যে শীতের পোশাক আছে সেগুলোর দেহ-লাগোয়া টুপি আছে। আমরা সেই টুপি মাথায় উঠিয়ে নিই। আমরা হুডি উঠিয়ে নিই মাথায়। উঠিয়ে নিয়ে আমরা নিজেদের বাসার দিকে চলে যাই॥


মেঘমল্লার

পরিচালনা: জাহিদুর রহিম অঞ্জন।
অভিনয়: শহীদুজ্জামান সেলিম, অপর্ণা, জয়ন্ত চট্টপাধ্যায় প্রমুখ।

ব্যবহৃত ছবি: গুগল চিত্র


মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৪

শীতের গোসল!


ক্যালেন্ডারের তোয়াক্কা না করে শীত এসে গেছে। দেশজুড়ে বাড়ছে গোসলবিদ্বেষী মানুষ! তারা এখন ‘ধরি গোসল না ছুঁই পানি’ নীতিতে বিশ্বাসী। তাদের জন্যই কুসুম কুসুম গরম কিছু টিপস!
আঁকা: ষুভহটবাথ
সারা দিনই দেশজুড়ে কিছু না কিছু ঘটছে। বিশেষ করে রাজনীতির খবরে দেশ সর্বদাই হট, অর্থাৎ গরম থাকে। আর এই গরম খবর আপনাদের কাছে গরম গরম পৌঁছে দেয় দৈনিক পত্রিকাগুলো। সকাল সকাল পত্রিকাগুলো নিন, বাংলাদেশের রাজনীতির হট নিউজ পড়তে পড়তে খুলে দিন শাওয়ার। এর পরেও যদি ঠান্ডা লাগে, পত্রিকাগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিতে পারেন। শীত পালানোর পথ পাবে না!

পলিবাথদেশজুড়ে পলিথিন লোপাট হওয়ার গুঞ্জন থাকলেও আসলে তা হয়নি। খোঁজ করলেই হাতের কাছে পাবেন প্রচুর পলিথিন। গোসলের আগে একটা বড় পলিথিন জোগাড় করুন। পলিথিন দিয়ে বানিয়ে নিন আপাদমস্তক ঢাকা একটা পোশাক। তারপর ছেড়ে দিন শাওয়ার।

শর্টবাথগামছা লুঙ্গি নিয়ে গোসলের জন্য তৈরি হোন। বালতি থেকে দুফোঁটা পানি উঠিয়ে নিন আঙুলে। আঙুলটা দ্রুত সারা শরীরে বুলিয়ে নিন। তারপর তোয়ালে দিয়ে ভালো করে মুছে নিন পুরো শরীর। হয়ে গেল দিনের সেরা কাজ—শর্টবাথ।
সেলফিবাথ
নদীর তীরে যান। দেখবেন অনেকেই গোসল করছে, তাদের সামনে দাঁড়ান। হাতের মুঠোফোনটা দিয়ে সবার গোসল–কার্যক্রম পেছনে রেখে একটা সেলফি তুলুন। ফেসবুকে আপলোড করুন সেলফিটা। লিখুন—শীতের সকালে সেলফি গোসল। বাস্তবে না হলেও ভার্চুয়ালি গোসল তো হবে!

বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৪

আকাশ আসবে নেমে

একটা লাল ঘুড়ি উড়ছিল আকাশে।

আসলে উড়ছিল না তো। কেটে কেটে কেটে লোট খেতে খেতে পড়ে যাচ্ছিল। আর পড়ে যেতে যেতে যেতে কেমন আলোর মতো ঝিকমিক করে উঠছিল। না আকাশে তেমন সূর্য ছিলো না, তার পরেও।

ঘুড়িটার একটা গন্তব্য ছিল। অবশ্য গন্তব্য যতদূর ততদূর উড়বার গতি বা নিয়তি কিছুই ছিল না তার। ঘুড়িটার গন্তব্য ছিল, গতি ছিল না।

১.
রাত সাড়ে এগারটা।

আমেদ হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। পাঁচ তলার দক্ষিণের ফ্ল্যাটে সে ভাড়া থাকে। পাঁচতলা পর্যন্ত উঠতে তার কষ্ট হয় না কোনোদিনই, আজ হচ্ছে। আজ হচ্ছে কারণ তাকে ছুটে যেতে হচ্ছে। আর এই ছুটে যাওয়া গুনগুনের জন্য। গুনগুন তার ছয় বছর বয়সী মেয়ে। আমেদ জানে সে অফিস থেকে না পৌঁছানো পর্যন্ত, যত রাতই হোক, গুনগুন খাবে না, ঘুমাবে না।

আমেদ প্রতি দিনই চেষ্টা করে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরোতে, পারে না। প্রতি দিনই কোনো না কোনো কাজে সে আটকা পড়ে। আজ শেষ সময়ে একগাদা কাজ তার ল্যাপটপটায় ঢুকেছে-- কিছু তার শেষ করতে পেরেছে কিছু কাল করতে হবে। কাল ছুটির দিন তবুও করতে হবে। অফিসের কাজ বাসায় করা নিয়ে রোদেলার খুব কড়া বারণ ছিল। এখন রোদেলা নেই, বারণ করার মানুষটিও নেই-- কিন্তু আমেদের অপরাধবোধটা থেকে গেছে। যেন দেয়ালের ছবিটা থেকে রোদেলা ঠোঁট শক্ত করে বলছে, কী ব্যাপার, অফিসের কাজ বাসায় এনেছো যে? মেয়েটাকে কে সময় দেবে, অ্যা?

মাঝে মাঝে আমেদের বলতে ইচ্ছা করে, কেন... তুমি দেখবে? ছবি থেকে আমার সাথে কথা বলতে পারছো আর মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছো না? দেখছো না মাকে পাবার জন্য কেমন ছটফট করছে মেয়েটা?

ছবিটা যেন আমেদের কথা বুঝতে পারে। ঘাড়টা বাঁকিয়ে বলে, বারে, দেখছি তো... গুনগুন কখন কী করে... কখন তার গল্প শুনতে ইচ্ছা করে কখন তার ছবি আঁকতে ইচ্ছা করে... সব... সব দেখছি তো! গুনগুন তো আমার লক্ষী মেয়ে... কোনো দুষ্টামি করে না!

আমেদের কণ্ঠ তখন বন্ধ হয়ে আসতে চায়। বলে, তুমি যদি সবই দেখো তাহলে চলেই আসছো না কেন? দেখছো না তোমাকে ছাড়া আমার আর তোমার ওই লক্ষী মেয়েটার কেমন দিন কাটছে...

বাইরে তখন কোনো একটা বিজাতীয় পাখি লম্বা সুরে ডেকে ওঠে। আমেদের বুকটা যেন খালি হয়ে যায়। কেউ যেন শুষে নেয় সব। ছবিটা তখন স্থির। কোনো কথা বলে না। কোনো উত্তর নেই। ছবিটা দেখতে দেখতে কেমন ছাপসা হয়ে যায়।

আমেদ হাঁপাতে থাকে। ছয়তলায় উঠেছে। তার মুখে কষ্টের ভেতরেও হাসি ফুটে ওঠে। ফুলহাতা শার্টের হাতাটা গুটিয়ে ঘড়িটা দেখে নেয়। এগারটা পঁয়ত্রিশ। কলিং বেলে চাপ দেয় আমেদ।

যেন প্রস্তুতি ছিলেন আমেদ মা আয়েশা বেগম। চট করে দরজা খুলে দেন তিনি। আমেদ তাড়াতাড়ি বলে, কী করছে?

আয়েশা বেগম বলেন, কী আর... তোর অপেক্ষা... জানিসই তো সব, তারপরেও এত দেরী করিস কেন?

আমেদ পায়ের জুতোর ভেতর তর্জনী চালিয়ে জুতোটা খুলতে থাকে। বলে, এমনি এমনি কি দেরী করি মা? কত যে ঝামেলা... অফিস তো না যেন...

পাশের ছোট্ট র্যাকে জুতোজোড়া রেখে ভেতরে এগিয়ে যায় সে। কাছেই ডাইনিং টেবিল। চারটা চেয়ার তাতে সাজানো। রোদেলা যে চেয়ারে বসতো সেখানে গুনগুন বসে আছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা খাতার ওপর ঝুঁকে কী যেন করছে। আমেদ এগিয়ে যায়। বলে, মা, কী করছিস?

গুনগুন ভ্রু কুচকে মাথাটা তোলে একবার। ঠোঁটের কাছে পেনসিল নিয়ে বলে, শশশ বাবা, আমি এখন বিজি...!

আমেদ বলে, কী নিয়ে বিজি মা?

গুনগুন ততক্ষণে আবার মাথা গুঁজে দিয়েছে খাতায়। বিরক্ত কয়ে বলে, উফ বাবা তুমি না অনেক কথা বলো... যাও আগে হাত-মুখ ধুয়ে আসো... তোমার জন্য খাবার নিয়ে বসে আছি...

একেবারে যেন রোদেলা, ভাবে আমেদ। যদি এটা সিনেমা হতো এক্ষুনি হয়তো একটা ফ্ল্যাশব্যাক দেখাতেন স্ক্রিপ্ট রাইটার। দেখাতেন এই ডাইনিং টেবিলেই, ওই গুনগুনের চেয়ারে বসে আছে রোদেলা। হাতে হয়তো একটা ম্যাগাজিন, নাহলে হুমায়ূন আহমেদের বই। আর সেই বইয়ের পাতা থেকে চোখ না তুলে রোদেলা বলছে, কী এত হাতিঘোড়ার কাজ করো বলো তো... রাত পার করে ঘরে ফেরা! যাও তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে আসো... খাবার একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেল বোধহয়!

আমেদ বাথরুমের দিকে যায়। তার একবার ইচ্ছা করে গুনগুনের খাতার দিকে উঁকি দিতে। অনেক কষ্টে সে ইচ্ছা দমন করে নেয়। ওই যে ছবি থেকে রোদেলা সব দেখছে-- সে আবার পড়ে বলবে লুকিয়ে লুকিয়ে এভাবে মেয়ের খাতা চেক করা আবার কেমন স্বভাব?

আমেদ বলবে, আরে চেক করা না... কৌতুহলটা দমন হচ্ছিল না... তাই...

রোদেলা বলবে, তোমার কাছে সবসময় এক্সকিউজ থাকেই না! এই তোমার কাছ থেকে শিখে শিখে না আমার মেয়েটার উঁকি দেয়ার বাজে স্বভাবটা হয়!

তারপর রোদেলা হয়তো কিছুক্ষণ আর কথাই বলবে না! শূন্য দেয়ালে নিরর্থক এক ছবি হয়েই অনেকক্ষণ ঝুলে থাকবে। সরু বারান্দা ধরে আসা শীতের বাতাসটাও তাকে কাঁপাবে না। আর এমন হোক তা কখনো চায় না আমেদ। তাই উঁকি না দিয়ে বাথরুমে গিয়ে কলটা ছাড়ে। পানির ঝাপটায় চোখমুখ ধুয়ে ফিরে এসে দেখে আয়েশা বেগম খাবার বেড়ে দিয়েছেন টেবিলে। কিন্তু গভীর মনোযোগে এঁকে যাচ্ছে গুনগুন। আমেদ বলে, মা তোর হয় নি? আমার তো অনেক খিদা পেয়েছে রে...

চট করে গুনগুন উঠে দাঁড়ায়। বলে, কমপ্লিট।

আমেদ বলে, কী কমপ্লিট করলি তাড়াতাড়ি বল... এক্সাইটমেন্টে তো আমার দম আটকে আসছে... 

ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে আসে গুনগুন। খাতাটা বাড়িয়ে দেয়। বলে, আমাদের ফ্যামিলির ছবি আঁকলাম বাবা, এই যে...

গুনগুন তার ছবিটা দেখায়। সেখানে একটা ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে চারটা মানুষ। গুনগুন তার ছোট ছোট কোমল আঙুল দিয়ে দেখায়-- এই যে বাবা তুমি এটা আর তোমার পাশে আমি... আর ওই পাশে ওই যে ওটা মা... আর এই পাশে এই খয়েরি শাড়ি পরে দিদি।

আমেদ আয়েশা বেগমের দিকে তাকায়। আয়েশা বেগম হাসেন। বলেন, নে, এবার তোরা বাপ-মেয়ে খেয়ে নে তো!

আমেদ ছবিটা নিয়ে একবার দেখে ভালোমতো। দেয়ালে টাঙানো রোদেলার ছবিটার দিকে তাকায়। গুনগুন বলে, বাবা, তুমি আর মা পাশাপাশি দাঁড়ালে কে বেশি লম্বা হতো বলো তো? দিদি বলছে তুমি... কিন্তু আমার মা তোমার থেকে উঁচু তাই না বাবা?

আমেদ ছবিটা নামিয়ে রাখে। বলে, হ্যাঁ মা, তোমার মা আমার থেকে অনেক উঁচু...

গুনগুন বলে, আচ্ছা বাবা, এই ছবিটা মার কাছে কীভাবে পাঠাবো বলো তো? আমি তো ছবিটা মার জন্যই এঁকেছি...

আমেদ বলে, তোর মা তো মেঘের ওপাড়ে থাকে বাবা... এই ছবি তো সেখানে যাবে না! তুই বরং জমিয়ে রাখ সব ছবি!

গুনগুন বলে, আচ্ছা।

তারপর ছবিটা নিয়ে ভোঁ দৌড় দেয় ঘরে। ওয়ারড্রোবের নিচের ড্রয়ারটা গুনগুনের দখলে। সেখানে সে ছবিটা ভাঁজ করে রেখে দেয়। আমেদ দেয়ালে টাঙানো রোদেলার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে, রোদ, একদিন তুমি মেঘ থেকে নেমে এসো!

(ক্রমশ...)



 

শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৪

খানেদ আম্পায়ার















১. 

খানেদ আম্পায়ারের নাম তার বাবা রেখেছিল- খালেদ হোসেন। বুলি ফোটার পর দেখা গেল খানেদের 'ন'-এর প্রতি আলগা আকর্ষণ আছে। কেউ তার নাম জিজ্ঞেস করলে বলে, খাঁনেদ। বড় হওয়ার সাথে সাথে খ-এর ওপরের চন্দ্রবিন্দু বিলুপ্ত হলেও 'ন' আর  হয় না। নিজের পরিচয় সে খানেদ বলেই দিতে থাকে।

কিন্তু তাই বলে... আম্পায়ার?

খানেদের যে-গ্রাম ক্রিকেট সেখানে সহজে পৌঁছানোর কথা ছিল না। বাংলাদেশের আইসিসি ট্রফি জেতার আগে তা পৌঁছায়ও নি। ওই ট্রফিটা জয়ের পর বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ক্রিকেটের সত্যিকারের সুনামি বয়ে গেছে, এবং তাতে শিবরামপুর নামের গন্ডগ্রামও যে ভেসে গেছে তার প্রমাণ এই খানেদ আম্পায়ার।

বয়স তখনো তার অল্পই, লুঙ্গি না পরলেও চলে; তবু সবুজ চেকের একটা লুঙ্গি পরে সে নাড়া পোড়ানো ন্যাড়া মাঠে ক্রিকেট খেলত; এবং দেখা গেল ক্রিকেটের আইনকানুন রপ্ত। কী করে রপ্ত? চেয়ারম্যান বাড়িতে তখন একটা টিভি-- আর সেই টিভিতে, বিটিভিতে প্রচারিত ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার খেলাগুলো তীক্ষ্ণভাবে দেখতো খানেদ। অবশ্য দেখতো অনেকেই, কিন্তু দেখতে দেখতে বুঝতো বা বুঝতে বুঝতে দেখতো একমাত্র খানেদই। অন্যকেও বোঝাতো। কতোবার চেয়ারম্যানই চিৎকার করে বলেছে, পায়ের গোড়া দিয়া বল গেল এইটা ওয়াইড ক্যানবে? মুখের সামোন দিয়া গেলে তো কিছু হয় না! ওই খানেদ্দা, এইটা কী?

খানেদ বোঝাতো ওয়ানডের নিয়ম এরকম সেরকম। চেয়ারম্যান গজগজ করতো। খুব বেশি রেগে গেলে ওয়ানডে ক্রিকেটের বাপ-মা তুলে গাল দিতো!

খানেদ চেয়ারম্যানের ঝিলমিল ঝিলমিল রঙিন টিভিতে ওয়ানডে, কখনো কখনো টেস্টও দেখতো। আর তার একটা রেডিও তো ছিল। তাতে ভুলভাবে শুদ্ধভাবে সে খেলা শুনতো। দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে ক্রিকেটের রীতিনীতি মোটামুটি রপ্ত করে নিয়েছিল সে। অথচ, বেচারা খানেদ, ক্রিকেটটা খেলতে পারতো না। তিনটা স্ট্যাম্পের গোড়ায় দাঁড়িয়ে যখন সে অদ্ভুতভাবে ব্যাট ধরতো (শিবরামপুরে সবাই অদ্ভুতভাবেই ব্যাট ধরতো, সেটা ধর্তব্য নয়) দেখে মনে হতো পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজটা খানেদ করছে। সাধারণত দুটো ঘটনা ঘটতো- হয় তার ব্যাট আগে চলে যেতো, বল এসে পৌঁছাতো দেরিতে; না হয় বল আগে চলে যেত, ব্যাট ছুটতো পরে। এ সময়ে মাঠ ঘিরে থাকা গ্রামের দর্শকরা, যারা কোনোদিন ব্যাট ধরেও নি, তারাও ‘হুক্কা হুক্কা’ বলে চিৎকার করতো। ক্রিকেট জানা খানেদের জন্য এটা ছিল যথেষ্ট অপমানের।দুই দল ভাগ করার সময় খানেদকে ‘লুচপুচি’ রাখা শুরু হতেই খানেদ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ক্রিকেট সে চিরকালের মতো ছেড়ে দেবে!
... এরকম একটা সময়ে খানেদের সাথে নিয়তির দেখা হলো। খানেদ তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ করে পড়ালেখার সাথে তালবাহানা শেষ করার কথা ভাবছে... সে ধরেই নিয়েছে একটা জীবন ক্রিকেট দেখেশুনে পার করে দিতে পারলেই স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটবে। তার মাথায় ঘুরছে শচীন টেন্ডুলকার, ওয়াসিম আকরাম, ব্রায়ান লারা। খানেদের স্বপ্ন তাদেরকে সে চর্মচোখে দেখবে, তাদের অটোগ্রাফ নেবে। তাতে জমি চাষে হাত লাগানোর কথা বলে তার বাপ যতোই বাধা দিক!

তখন পাশের গ্রাম আলীনগরের সাথে শিবরামপুর একটা বাজির ম্যাচের আয়োজন করল এক শুক্রবারে। যে দল জিতবে সে পাবে দুইটা নর-রাজহাস। খেলা সেই নাড়া পোড়ানো ন্যাড়া মাঠে। নামাজ পড়ে মানুষজন টুপি মাথায় চলে এল খেলা দেখতে। পনের ওভারের খেলা। টেনিস বল। বল নিয়ে আসা হয়েছে রহনপুরের টেনিস কোর্ট থেকে। ইচ্ছা থাকলেও খানেদের জায়গা হলো না দলে। সে তখন পাকুর গাছের নিচে বসে বসে খেলা দেখার আয়োজন করে। যদি দলে নেয় এমন ভেবে খানেদ তার একমাত্র খাকি প্যান্টটা পরে এসেছিল, হলুদ রঙের একটা গেঞ্জিও পরেছিল। এখন হতাশ হয়ে নিজের গ্রামের সমর্থক হওয়া ছাড়া কোনো কাজ তার নাই। হঠাৎ মাঠে গোল বাধে আম্পায়ারিং নিয়ে। কে কবে কাকে বাজে আউট দিয়েছিল এ নিয়ে বিস্তর ট্যা-ফোঁ যখন হচ্ছে মাঠে, মাঠের বাইরে খেলা দেখতে আসা চেয়ারম্যান তখন সবাইকে শান্ত করে বলল, খানেদ্দা আম্পায়ারি করুক…তাইলে তো আর ঝামেলা থাকে না।

আলীনগরের বাসিন্দারাও কীভাবে কীভাবে যেন জানতো যে খানেদ খেলাটা ভালো বোঝে। তারা রাজি হয়ে গেল। ঠিক হলো, আম্পায়ারকে রাজহাসের ভাগ দেয়া হবে। খানেদ সেই প্রথম আম্পায়ার হিসেবে মাঠে দাঁড়ালো। তখন সেও জানতো না আগামী ক’বছরে এ আম্পায়ারিং তাকে কতো কিছু দেবে, আবার কেড়েও নেবে!



২.

খানেদ যে ভালো আম্পায়ার, বিশ্বস্ত তার সিদ্ধান্ত, ক্রিকেটের আইনকানুন জানা ব্যক্তি এটা রহনপুর ছাপিয়ে জেলা সদর পর্যন্ত ছড়ালো। অন্য খেলোয়াড়রা যখন ক্রিকেট খেলার জন্য খ্যাপ পায়, খানেদ তখন খ্যাপ পায় আম্পায়ারিং করার জন্য। টুর্নামেন্ট শুরু হলেই আয়োজকরা আগে থেকে খানেদকে ঠিক করে। বলে ম্যাচগুলা খেলায়ে দিয়েন খানেদ ভাই…ম্যাচ প্রতি বিশ টাকা।

খানেদ দামদর করে। বিশকে পঁচিশ করে। খানেদ, খানেদ আম্পায়ার হিসেবে দিক পায়।

আন্তজেলা টুর্নামেন্টে আম্পায়ারিং করার জন্য খানেদ ডাক পায় অবশেষে। খানেদ মনে মনে ভেবেছিল এখানে খেলাবে। এখানে দেশের বড় বড় তারকা প্লেয়ার খ্যাপ খেলতে আসে।

প্রথম ম্যাচ খেলাতে গিয়েই খানেদের বুকে তোলপাড়। পাইলট! ছক্কা পাইলট! এর একটা ছক্কাতেই বাংলাদেশ ওয়ানডে স্ট্যাটাস পেয়েছে। এতকাল টিভিতে দেখেছে ভাঙাচোরা গাল, পাতলা সাতলা শরীর; মুখোমুখি দেখে খানেদের আক্কেলগুড়ুম- টিভির পাইলটের থেকে বাস্তবের পাইলট বেশি সুন্দর।

পাইলট উইকেট কিপিং করল না। প্যাড ছাড়া কাভারে ছটফট করে ফিল্ডিং করল। এটাও খানেদের জন্য বিস্ময়। সে ভেবেছিল উইকেট কিপাররা প্যাড গ্লাবস ছাড়া ফিল্ডিং করতে পারে না। অথচ পাইলট সামনে ঝাঁপিয়ে দুর্দান্ত ক্যাচ নিলো একটা, আরেকটা বল স্ট্যাম্পে এতো জোড়ে থ্রো করল যে স্ট্রাম্প উপড়েই গেল। সময়মতো সরে না গেলে খানেদের ঠ্যাংও উপড়ে যেতো! খানেদের মনে হলো, অবিশ্বাস্য!

ওয়ানডাউনে নেমে পাইলট উনপঞ্চাশ রানে আউট হলো। এলবিডাব্লিউ। আউট দিলো খানেদ। তর্জনী শূন্যে তোলার আগে বুকটা একটু কেঁপেছিল খানেদের। স্বপ্নের তারকাকে হাফ সেঞ্চুরি থেকে বঞ্চিত করবে কিনা এমন একটা দ্বন্দ্ব তার ভেতর নিমিষে খেলে গিয়েছিল; কিন্তু সে আম্পায়ার, সঠিক সিদ্ধান্ত দেয়াই তার কাজ, তর্জনী ওঠাতে তাই সে বেশি দেরি করে নি।

পাইলট কিছুক্ষণ পিচে দাঁড়িয়ে, বিস্ময় নিয়ে খানেদকে দেখে, মাঠ ছেড়েছিল এবং পাইলটের দল হেরেছিল।

খেলা শেষে খানেদের খুব ইচ্ছা ছিল পাইলটের সাথে কথা বলার। কিন্তু কাকে বললে এ সুযোগ হবে বুঝতে না পেরে যখন সে মাঠ ছাড়ছে তখন পেছন থেকে কে যেন ডাকলো তাকে।

‘এই যে, কী নাম আপনার?’

খানেদ পেছন ঘুরে দেখে পাইলট। চুইংগাম চিবাচ্ছে। খানেদ যেন ধন্য হয়ে গেল। হড়বড় করে বলল, খানেদ…খানেদ হুসেন!

‘খালেদ, বাহ…আমিও তো খালেদ…খালেদ মাসুদ। মিতা হয়ে গেলেন।’ পাইলট আটকে আটকে কথা বলে। বলার মধ্যে অকারণ দ্রুততাও আছে।কিন্তু খানেদের কান এমন শুনে অভ্যস্থ। পাইলটকে কতবার কথা বলতে শুনেছে সে টিভিতে। কিন্তু পাইলটের কথায় খানেদ কী উত্তর করবে বুঝতে পারে না।

‘আপনি তো ভালো আম্পায়ার…আমার এলবি’র ডিসিশানটা ভালো দিছেন। অন্য কেউ হলে দিতো না। কী করেন?’

খানেদ কিছু তো করে না। ক্রিকেট নিয়েই মেতে থাকে। সেটাও কি বলা যায়?

পাইলট একটা কার্ডে ব্যক্তিগত ফোন নাম্বার লিখল। সেটা দিতে দিতে বলল, ঢাকায় এলে যোগাযোগ কইরেন। আপনি ক্রিকেট ভালো বুঝেন!

কার্ডটা নিয়ে খানেদ কোনোমতে বলতে পারল, একটা সাইন যদি দিতেন…

পাইলট হাসতে হাসতে অটোগ্রাফ দিল। খানেদ এক জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বুক পকেটে নিয়ে মাঠ ছাড়ল।


৩. 

পরের ক’বছরে খানেদ বিভাগীয় টুর্নামেন্টগুলোর কয়েকটা ম্যাচে আম্পায়ারিং করতে পেল। রাজশাহীতে একটা মেসবাড়িতে সে থাকতেও শুরু করল। ক্রিকেট দেখা, ক্রিকেটের বই পড়া তার ধ্যান জ্ঞান। কোনো কিছু করার না থাকলে খানেদ স্টেডিয়ামে গিয়ে ক্রিকেট প্রাকটিস দেখত, বাইরে থেকে বুঝতে পারতো কোন ব্যাটসম্যানের পা চলে না, কোন ব্যাটসম্যানের এলবোতে ঝামেলা। কিংবা কোন বোলারের রানআপটা আরেকটু অন্যরকম হলে আরো ভালো হয় ইত্যাদি।

খানেদের অন্যান্য বন্ধুবান্ধবেরা অনার্স পাশ করেছে, খানেদ ভর্তি হয়ে আছে কিন্তু পাশ করতে পারছে না। মনোবিজ্ঞান নামের একটা সাবজেক্ট সে নিয়েছিল এই ভেবে যে এতে খেলোয়াড়দের মানসিকতা সে ধরতে পারবে। লাভের লাভ হয় নি। কিছু বেহুদা তত্ত্ব ছাড়া বইয়ে কিছু নেই। আগের মতোই খানেদের মনেহয় একটা জীবন পড়ালেখা নামের বাজে জিনিসের পেছনে সে কাটিয়ে দিল- ক্রিকেটের কিছুই হলো না!

এর মধ্যে খানেদের বাপ মারা গেল। মৃত্যু সংবাদ যখন সে পেল তখন একটা দলের ব্যাটিং শেষ হয়েছে, লাঞ্চব্রেক চলছে। খানেদ কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে সাথে সাথে রওনা দিল গ্রামের উদ্দেশ্যে। জ্ঞান হওয়ার আগেই মাকে হারিয়েছিল খানেদ, মায়ের কবরটাও দেখেনি সে- নদীতে নিয়ে গেছে। বাপের মৃত্যুতে নিজ হাতে কবর দিতে পারাটাই শুধু স্বান্তনা হয়ে থাকলো।

চাষের জমি তাদের বেশি ছিল না, কিন্তু সংসারে আর কেউ না থাকায় ওই জমিটুকুতেই খানেদের বেশ চলে যেত। কিন্তু সে তো গ্রামে থাকলো না। ফলে তার জমি শরিকদের বেহাতে যাওয়ার উপক্রম হলো।

খানেদ অবশ্য গুরুত্ব দিল না। তার কাছে জমি মানে বাইশ গজের পিচ।

একদিন খানেদের নামে চিঠি এল। আম্পায়ার তৈরির একটি প্রক্রিয়া শুরু করছে বিসিবি…খানেদ তাতে যোগ দিতে চায় কিনা!

বুক ভরে গেল খানেদের। সে চায়, অবশ্যই চায়। বাংলাদেশের হয়ে ক্রিকেট ম্যাচ সে খেলাবে…শচীন-লারা-মুরালিরা খেলবে…আশরাফুল-সুমন-পাইলটরা খেলবে…এই তো তার স্বপ্ন।

ব্যাগ-বোকচা গুটিয়ে ঢাকায় ছোটে খানেদ।

ঢাকায় এসে খানেদ অবশ্য দিকহারা হয়ে পড়ে। চিঠি নিয়ে যোগাযোগ করলেও তেমন উৎসাহব্যঞ্জক কিছু শুনতে পায় না। এই প্রক্রিয়া কবে শুরু হবে নির্দিষ্ট কোনো তারিখ এখনো স্থির হয় নি। বিসিবি প্রধান অস্ট্রেলিয়ায়, তিনি এলে স্থির হওয়ার সম্ভাবনা আছে। পাইলটের নাম্বারটার কথা মনে পড়ল খানেদের। মূল্যবান তাবিজের মতো করেই সে কার্ডটা যত্ন করে রাখে। কিন্তু ওই নাম্বারে ফোন করেও তো লাভ হবে না। বাংলাদেশ দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গেছে। প্রথম টেস্ট চলছে। উইকেটের পেছনে পাইলটই কান্ডারী!

মিরপুর স্টেডিয়ামের পাশে ছোটখাটো এক মেসবাড়িতে ওঠে খানেদ। খুব বেশি টাকাপয়সা তার কাছে নেই, থাকার কথাও না। কিন্তু তারচেয়ে বড় কথা ঢাকায় কেউ তাকে চেনে না, সেও কাউকে চেনে না।

একদিন স্টেডিয়ামে ঢুকতে গিয়েও ঢুকতে পারে না খানেদ। সাধারণের প্রবেশাধিকার নাকি নেই। চিঠি নিয়ে আরো কয়েকবার যাতায়াত করে দপ্তরে। শেষবার শুনতে পায় আম্পায়ার তৈরির প্রক্রিয়া নাকি বন্ধ আছে, পরে কোনো এক সময় হবে। হলেই খানেদ খবর পাবে।

খানেদের ফিরে যাওয়াই উচিত ছিল। সে ফিরেও গেল। তার এলাকাজুড়ে রাষ্ট্র হয়ে আছে যে ক্রিকেটের জন্যে ঢাকা থেকে ডাক পেয়েছে সে। রসালো আমকে মাছি যেভাবে ঘিরে ধরে, খানেদকে তেমনি ঘিরে ধরলো এলাকাবাসী। কত জনের কত রকমের প্রশ্ন! কেউ জিজ্ঞেস করে, আকরামের সাথে দেখা হয়েছে কিনা? দেখা হলে হাত মিলিয়েছে কিনা? সে কি টিভিতে যেমন দেখায় তেমনি নাকি আরো মোটা? কেউ জিজ্ঞেস করে, দাঁত ভাঙার পর পাইলট দেখতে কেমন হয়েছে? কথা বললে থুতু ছিটে কিনা? ইত্যাদি ইত্যাদি।

একজন  দুম করে বলে বসল, এ মামুর বুটা কাহুকেই দ্যাখেনি বে…ঝুটাঝুট্টি!

ফলে খানেদকে সাদা ক্যারিবিয়ান টুপিটা দেখাতে হলো। জানাতে হলো এটা ছিল সুমনের। তার আম্পারিং-এ মুগ্ধ হয়ে টুপিটা সুমন উপহার দিয়েছে।

জনতা শান্ত হলো। কেউ কেউ জানালো, তারা আগে থেকেই জানতো যে খানেদ আম্পায়ার এমন একটা কাজ করবেই করবে।

একজন প্রবল বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল, টিভিতে তুমাকে কখন দেখতে পাবো?

টুপির ব্যাপারে মিথ্যা বলার পর আরো মিথ্যা কথা বলতেই পারতো খানেদ। আরো অনেক গল্পর বানাতে পারতো সে। কিন্তু তা না করে বলল, আরো ভালোমতো আম্পায়ারি শিখতে হবে…তাইলে আইসিসি ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচ খেলানোর হুকুম দিবে! তখন দেখতে পাবি!

ছোকরা মতোন একজন  বলল, টিভিতে যে বুটারা আম্পায়ারি করে তুমি তো তাদের থেক্যা ম্যালা ভালো করো…

এই বিশ্বাসটা খানেদেরও ছিল। সে জানতো আইসিসি প্যানেলের কিছু আম্পায়ারের থেকে সে ভালো আম্পায়ারিং করতে পারবে। আর  ওই বিশ্বাসের জোরেই সে তার শেষসম্পদ জমিটুকু বিক্রি করে দিলো শরিকদের কাছে। আম্পায়ারিং তাকে আরো শিখতে হবে, আর  আরো শিখতে হলে ঢাকায় থাকতে হবে, আর  ঢাকায় থাকতে হলে টাকার দরকার। তার জীবনের টাকার দরকার ওই ওইটুকুই।


৪. 

মিরপুরবাসী খানেদ উত্তেজনায় ঘুমাতে পারছে না। আগামীকাল তার টেস্ট অভিষেক। হ্যাঁ, এখন সে একজন  ভালো আম্পায়ার। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত তিন জাতি টুর্নামেন্টের ওয়ানডে দিয়ে তার পথচলা শুরু। এ পর্যন্ত সাতটি ওয়ান ডে সে খেলিয়েছে। তার স্বপ্নের শচীন টেন্ডুলকার তারই সামনে ক্রিজে দাঁড়িয়ে তার কাছ থেকে গার্ড চেয়েছে। খানেদের তখন বুক ঢিবঢিব করছিল। একটু বামে ব্যাটটা সরাতে হাত-ইশারা যখন করছিল সে, তার মনে হচ্ছিল এখন যদি ভুল গার্ড দিয়ে ফেলে! তার একটু ভুলের জন্য কি শচীন আউট হয়ে যাবে?

শচীন সেদিন আউট হয় নি। স্বভাবসুলভ সেঞ্চুরি করে অপরাজিত থেকেছিল। অনেক বড় ব্যবধানে জিতেছিল ভারত।

মাঠভর্তি দর্শক আর  খানেদকে ঘিরে এতো তারকা যে খানেদের মাঝে মাঝে সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগে। এই রফিক তার সামনে এলবিডাব্লিউর আবেদন করছে, এই জয়সুরিয়া উড়িয়ে মারছে, এই সুমন ফিফটি করে ব্যাট উঁচিয়ে ধরেছে…

স্বপ্ন, সব যেন স্বপ্ন! কোথাকার কোন শিবরামপুর থেকে উঠে এসে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলাচ্ছে সে। আর  কাল খেলাবে প্রথম টেস্ট। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভার্সেস বাংলাদেশ। লারাদের উত্তরসুরীদের সাথে সাকিব-মুশফিকরা!

ভোর হচ্ছে। খানেদ বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তার পা কাঁপছে, হাত কাঁপছে, বুক কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে সে ট্রাউজার-গেঞ্জি পরে, মাথায় চাপায় সাদা ক্যারাবিয়ান টুপি।

বাইরে নরোম আলো। দরজা খুলেই খানেদ যেন মিরপুর মাঠে প্রবেশ করে। সবুজ ঘাস শিশিরে ভেজা। চারপাশ ঘিরে দর্শকদের হৈ-চৈ। সাদা পোশাকের বাইশজন মাঠের মধ্যে। এই সাদার মতো উজ্জ্বল রঙেলা আর  কী আছে!

খানেদ তার পকেটে হাত দেয়। আছে, পাইলটের অটোগ্রাফ সম্বলিত সেই কার্ডটা তার পকেটে আছে। এই কার্ডটা সে কখনো কাছ ছাড়া করে না।

টসের জন্য মধ্য মাঠের দিকে এগিয়ে যায় খানেদ। তার সাদা জুতো শিশিরে ভিজে ভিজে যায়।



পাদটিকা:

বিচক্ষণ পাঠক একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন যে ৪ নম্বর অংশটি আমি বানিয়ে বানিয়ে লিখছি। যেন একটা স্বপ্নদৃশ্য। নিজের ঘরের দরজা ঠেললেই খানেদ পৌঁছে যাচ্ছে মিরপুরে... গ্যালারিভর্তি দর্শক তার প্রবেশে উল্লাস করে উঠছে! এমন তো হয় না আসলে...কিন্তু লিখতে লিখতে মনে হচ্ছিল, আহা এমনটাই যদি হতো! আমাদের শিবরামপুরের খানেদ যদি সত্যি আন্তর্জাতিক আম্পায়ার হয়ে উঠতো!

কিন্তু খানেদ হয়ে ওঠে নি। জমি বেচে ঢাকায় স্থায়ী হতে চেষ্টা করেছিল সে। চেষ্টা করেছিল বিসিবির আম্পায়ার তৈরি প্রক্রিয়ার ভেতর প্রবেশ করতে। কিন্তু মিরপুর স্টেডিয়ামের গেইট পেরিয়ে ওই সবুজ মাঠে যেমন তেমনি অজানা কারণেই খানেদ সে প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকতে পারে নি।

অনেক অনেক সময় চলে যায়- ঢাকা চিরকাল অপরিচিতই থেকে যায় খানেদের কাছে; তারপর একদিন পরিচিত যে-গ্রাম, শিবরামপুর, সেখানে ফেরত আসে সে, চিরকালের মতো। এর মধ্যে একবার পাইলটের সাথে দেখাও হয় তার। আশ্চর্যের ব্যাপার, পাইলট তাকে চিনতে পারে। পাইলট তখন একটা একাডেমি প্রতিষ্ঠা নিয়ে দারুণ ব্যস্ত। সেই একাডেমিতে একটা কাজও জুটিয়ে দিতে চায়। কিন্তু খানেদ কেন যেন রাজি হয় না। হয়তো আগের মতো আর  স্পৃহা পায় না।

খানেদ এখন নিজ বসতভিটায়, পেছনের ফাঁকা জায়গায়, সবজি চাষ করে। ছোট্ট একটা টিভি তার আছে। সকাল সন্ধ্যা তাতে ক্রিকেট চলে।

খানেদের সবজি বাগানে টেস্টের লাল বলের মতো টমাটো ফলে। ক্রিকেট স্ট্যাম্পের মতো চিচিংয়ে ফলে। বেগুন ফলে, ঢেরস ফলে। সকালবেলা সবজিগুলোর গায়ে বিন্দু বিন্দু শিশির জমে থাকে। সেদিকে তাকিয়ে খানেদের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

পাশের রাস্তা দিয়ে ধুলো উড়িয়ে হৈ-চৈ করতে করতে বাচ্চা-কাচ্চারা ইশকুলে যায়। খানেদকে দেখে তারা দাঁড়িয়ে পড়ে। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার আগে বাংলাদেশের পতাকাকে দেখে হাত তুলে তারা যেভাবে সালাম করে, একইভাবে খানেদের সামনেও তারা হাত তোলে, সালাম করে। সে সালামের উত্তর দিতে গিয়ে খালেদের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।

ওইসব শিশুদের কাছে আমাদের সাধারণ খানেদ হলো বিশ্বসেরা খানেদ আম্পায়ার। পাকুর গাছের নিচের মাঠটাতে ক্রিকেট হলে তাই এখনো তারা খানেদকে ডাকে। খানেদ সে-ডাক কখনো উপেক্ষা করতে পারে না।