এক
থা টাল্লি।
এমনই
নাম ভেবেছিলেন লেখক পরিচালক
রাজ কুমার হিরানি। কিন্তু
বাইরে থেকে দেশে যখন ফিরলেন
তখন শুনলেন সালমান খানের
সিনেমার নাম 'এক
থা টাইগার'।
'এক
থা টাল্লি'
নামটা
পছন্দ করে ফেলেছিলেন রাজু
হিরানি। অন্য কোনো নামও ভাবতে
পারছিলেন না তিনি। স্ক্রিপ্টের
কাজ তখন তোড়জোড় চলছে। আর হিরানির
কাজের ধরন যেমন একটা স্ক্রিপ্টের
অনেক গভীর পর্যন্ত কাজ করতে
চান তেমনভাবেই কাজ করে চলেছেন
এই নতুন সিনেমাটার। পরে যার
নাম তিনি রাখলেন পিকে।
রাজ
কুমার হিরানি ভারতীয় চলচ্চিত্রের
হাতেগোনা সে-ই
কয়েকজন পরিচালকের একজন যার
নাম সিনেমা চলে। যার সিনেমা
শেষ পর্যন্ত তারই থাকে। একটা
নায়কের সিনেমা,
বা একটা
গানের সিনেমায় পরিণত হয় না।
রাজ কুমার হিরানি তার প্রত্যেক
সিনেমায় একটা নতুন গল্প বলার
চেষ্টা করেন;
এবং এখন
পর্যন্ত তার প্রত্যেকটা
সিনেমাতেই (মুন্না
ভাই এমবিবিএস,
লাগে রাহো
মুন্না ভাই,
থ্রি
ইডিয়টস) তিনি
সফল হয়েছেন। প্রত্যেকটা
সিনেমায় ব্যবসা-সফল
এবং ক্রিটিকদের বাহবা পেয়েছে।
লক্ষী এবং সরস্বতীর এমন সমন্বয়
ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে
তুলনারহিত। ফলে পিকে সিনেমাতেও
দর্শকরা তেমনই কিছুর আশা করেছে
এবং বলতে হয় এই পিকেতেও রাজ
কুমার হিরানি আসলে সফল। কিন্তু
এই যে 'আসলে
সফল' বলা
এখানেই হিরানির কোথাও যেন
একটা ব্যর্থতা লুকিয়ে আছে।
ব্যবসা সফল হওয়ার পরেও তাঁর
পেছনের যে তিনটা সিনেমা
সর্বস্তরে সফলতা কুড়িয়েছিল
তেমন সফলতা পিকে পাবে কিনা
তার একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।
হিরানির জন্য যা নতুন একটা
ব্যাপার নিশ্চয়ই।
পিকে
সিনেমায় নাম ভূমিকায় অভিনয়
করেছেন আমির খান। সে এলিয়ান।
ভিনগ্রহ থেকে রাজস্থানে এসে
পড়ে। যে ডিভাইসের মাধ্যমে সে
ফিরে যেতে পারবে তা হারিয়ে
ফেলে আর সেটা উদ্ধার করতে সে
শেষ পর্যন্ত সৃষ্টিকর্তার
শরণাপন্ন হয়। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার
শরণাপন্ন হতে গিয়ে দেখে এই
সব ধর্ম ব্যবসায়ীদের কথা ও
কাজের নানান অসঙ্গতি। আর এইসব
অসঙ্গতি ধরতে তার সাথে যুক্ত
হয় জগৎ জননী অর্থাৎ আনুশকা
শর্মা। আনুশকা রিপোর্টার।
সে একটা মুসলিম ছেলেকে ভালো
বাসতো। কিন্তু ধর্ম ব্যবসায়ীর
কথায় তার বাবা সেই মুসলিম
ছেলেকে মেনে নিতে পারেন না।
ধর্ম ব্যবসায়ী জানায় সেই ছেলে
ধোকা দেবে। আনুশকা শর্মাও
ঘটনাচক্রে ধোকার কথাটা বিশ্বাস
করে ফেলে। পিকে নিজের সেই
ডিভাইস যেমন উদ্ধার করে তেমনি
আনুশকাকেও তার ভুল ধারণা থেকে
মুক্ত করে। এবং পিকে নিজে জগৎ
জননীকে ভালোবেসে ফেললেও নিজের
ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে জগ্গুর
আসল ভালোবাসাকে ফিরিয়ে আনতে
সাহায্য করে। তারপর পিকে চলে
যায়। এই মোটামুটি গল্প। গল্প
বলা হয় জগৎ জননীর পয়েন্ট অব
ভিউ থেকে। পিকের গল্প শোনাচ্ছে
জগ্গু, সেই
গল্পের ভেতর পিকে আবার তার
নিজের গল্প শোনাচ্ছে--
ফ্ল্যাশব্যাক
থেকে ফ্ল্যাশব্যাকে দর্শকেরা
যেন উড়ে যেতে থাকে। কিন্তু
তাতেও গল্পের খামতি থেকে যায়।
আমির খান যে গ্রহ থেকে এসেছে
তা স্বাভাবিকভাবেই সিনেমায়
দেখানো হয় নি। আমির খান সেখানে
কী করতো, কে
রয়েছে তার,
কেমন তার
জীবন যাপন এসবের কিছুই আমরা
জানতে পারি না সিনেমাটা দেখে।
শুধু জানতে পারি সেই গ্রহে
তারা নেংটো হয়ে থাকে। ফলে আমির
যখন নিজের গ্রহে ফিরে যাবার
আকুতি প্রকাশ করে,
ইমোশনাল
হয়ে যায়, সে
আবেগ তখন আমাদের স্পর্শ করে
না। পিকের ব্যাকস্টোরি না
জানার কারণে তার প্রতি আমাদের
কোনো সিমপ্যাথি তৈরি হয় না।
তার কান্না এবং তার কান্না
কান্না সংলাপ আমাদের কাঁদায়
না। ফলে যে গ্যাজেট খুঁজে
পাওয়া নিয়ে এই গল্পের কাঠামো
তৈরি তা দারুণ রকম ফ্যাকাশে
হয়ে পড়ে।
আরেকটা
মুস্কিল হচ্ছে পিকের গল্প
কোথাও স্থির হয় না। কোথাও জমাট
বাঁধে না। এই তার গ্যাজেট
হারালো, এই
সে ভাষাহীন,
এই সে
অন্যের হাত ধরে ভাষা বোঝার
চেষ্টা করছে আবার সঞ্জয় হাত
ধরে ভাষা বোঝার চেষ্টা না করে
পিকে কেন শুধু মেয়েদেরই হাত
ধরতে চাইছে তা গল্পে স্পষ্ট
হয় না-- ফলে
হাত ধরা নিয়ে ভালো কোরিওগ্রাফের
একটা গান থাকলেও তা আরোপিত
মনে হয়। মনে হয় লেখক পরিচালক
চেয়েছেন বলেই এমনটা হচ্ছে,
গল্পের
প্রবাহে ঘটছে না। একটার পর
একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে কিন্তু
ঘটনাগুলোর যে উদ্দেশ্য তা
জোরালো না হওয়ার কারণে কোনো
ইম্প্যাক্ট না ফেলেই মিলিয়ে
যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমরা
ধারাবাহিক কিছু মন্তাজ দেখে
যাচ্ছি আসলে।
রাজ
কুমার হিরানির অন্য সিনেমাগুলোর
সাথে তুলনা করলে পিকের সংলাপে
ভার বেশি। হিরানির সংলাপ
সাধারণত হাস্যরসে ভরপুর থাকে,
এই সিনেমাতেও
তা আছে, কিন্তু
বিষয় হিশেবে ধর্মকে বেছে নেয়ার
কারণে অনেক জায়গায় লেখক
পরিচালককে সাবধান থাকতে হয়েছে।
সে সাবধানী মনোভাবটা সংলাপেই
সবচেয়ে প্রকট হয়ে উঠেছে। অনেক
বেশি এক্সপ্লেনেশনের কারণে
সংলাপগুলোতে তুলনামূলভাবে
জড়তা এসেছে বেশি। হিরানি অন্য
সিনেমার গান্ধিগিরি,
জাদু কা
ঝাপ্পি, আল
ইজ ওয়েল এই ধরনের পাঞ্চের মতো
এই সিনেমাতেও 'রঙ
নাম্বার' এর
পাঞ্চ রাখার চেষ্টা হয়েছে।
কিন্তু আমাদের মনে হয় না এই
পাঞ্চটা ওইগুলোর মতো জনপ্রিয়
হতে পারে। বরং 'লাভ
ইজ ওয়েস্ট অব টাইম'
পাঞ্চটি
এবং থিমটি অধিক জনপ্রিয় হবার
সম্ভাবনা রাখে। কিন্তু এই
পাঞ্চ খুব বেশি ব্যবহৃত হয়
না সিনেমায়। আসলে ভালোবাসার
দিকটা খুব বেশি উন্মোচিতই হয়
না গল্পে। ফলে দর্শক কিছুটা
হতাশ হয়ে যেতে পারে।
কেউ
কেউ বলছেন পিকে ভালো কারণ
সিনেমাটাতে ভালো ম্যাসেজ
আছে। হয়তো ভালো,
কিন্তু
ম্যাসেজের জন্য আর সিনেমা
দেখতে বসা কেন?
টক শো
দেখলেও তো ম্যাসেজ পাওয়া যায়।
যে সিনেমায় কিচ্ছু পাওয়া যায়
না সে সিনেমাতেই ম্যাসেজ
পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
আমির
নিজে দাবী করেছেন পিকেতেই
তিনি তার সেরা অভিনয়টা করেছেন।
এটা শুনে আমাদের আগ্রহ আরে
বেড়েছিল। কিন্তু সিনেমাটা
দেখতে দেখতে মনে হলো হয় আমির
নিজের সিনেমা দেখা বন্ধ করে
দিয়েছেন-- তার
আবার 'সারফারোশ',
'লাগান',
'রঙ দে
বাসান্তি' বা
হালের 'তালাশ'
দেখা
উচিত। এমনকি 'থ্রি
ইডিয়ট'ও
দেখতে পারেন। পিকের অভিনয় ওই
সব সিনেমা থেকে ছাড়িয়ে গেছে
বলে আমাদের মনে হয় নি। তবে
সিনেমাটা দেখতে দেখতে এও মনে
হচ্ছিল আমির হয়তো অভিনয় নিয়ে
ওরকম কথা বলেছেন নিতান্তই
ব্যবসায়ী উদ্দেশ্য থেকে।
নাম
পিকে হলেও সিনেমাটার গল্প এক
সময় আনুশকা শর্মার হয়ে যায়;
এবং শেষ
পর্যন্ত তারই থাকে। সিনেমার
একেবারে শেষের অংশে,
এক বছর
পরের দৃশ্যে পিকেকে পৃথিবীতে
আবার ফিরিয়ে এনে চমক ও তাকে
প্রটাগনিস্ট বানানোর উদ্ভট
চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তা
চমকেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। পিকে
আর কখনোই পিকে চরিত্রের গল্প
হয়ে ওঠে নি।
আসলে
রাজ কুমার হিরানি বলিউডের
জনপ্রিয় ফর্মুলা দিয়েই হেঁটেছেন।
সিনেমায় তাই সৃষ্টিকর্তার
অস্বিত্বে প্রশ্ন না করে আপাত
সহজ ধর্মব্যবসায়ীদের টার্গেট
করেছেন। ভারতীয় সিনেমার দর্শক
কিছু দিন আগেই অক্ষয়-পরেশ
রাওয়ালের 'ও
মাই গড' সিনেমাটা
না দেখলে এই টার্গেট হয়তো
আনকোরা লাগতো,
কিন্তু
তা আর হয় নি। ইন্ডাস্ট্রিতে
এমন গুজবও আছে যে পিকের
প্রযোজক-পরিচালক
'ও
মাই গড' সিনেমার
পরিচালককে মোটা অঙ্কের টাকা
সেধেছিলেন সিনেমাটা বন্ধ
রাখার জন্য। আমরা সে সব গুজবে
কান না দিয়ে বরং চোখ রাখি পিকের
বলিউডি ফর্মুলায়। সিনেমার
শুরুতে সঞ্জয় দত্ত আর শেষে
রানবীর কাপুরের ছোট্ট উপস্থিতির
চমকও ওই ফর্মুলার কথাই মনে
করিয়ে দেয়। বলিউডের আরেকটি
জনপ্রিয় ফর্মুলা হলো কেউ একজন
এসে কারো ব্যক্তিগত সমস্যা
দূর করে দেবে। পিকেতে যে কাজটি
আমির আনুশকার জন্য করেন। এই
ফর্মুলায় প্রচুর সিনেমা আগে
হয়ে গেছে, পরেও
হবে নিশ্চয়। অবশ্য ফর্মুলা
খারাপ কিছু না। এমন অনেক সিনেমা
রয়েছে যা ফর্মুলায় তৈরি কিন্তু
ভালো।
নতুন
কিছু না দিলেও পিকে নিঃসন্দেহে
ভালো সিনেমা,
তবে সত্যটা
হলো পিকে আসলে রাজ কুমার হিরানির
এখন পর্যন্ত বানানো সবচেয়ে
খারাপ সিনেমা॥
পিকে
লেখক- অভিজাত জোশি, রাজ কুমার হিরানি
পরিচালক- রাজ কুমার হিরানি
অভিনয়- আমির খান, আনুশকা শর্মা, সঞ্জয় দত্ত, সুশান্ত শিং রাজপুত, বোমান ইরানি।
ছবি- গুগল