বুধবার, ১ জুলাই, ২০১৫

বেহুদা সময়ে কাঁকড়া শিকার



বেহুদা সময় নষ্টের মানে নাই কোনো, সমুদ্রের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমেদের এরকম মনে হয়। কারণ অনেকক্ষণ ধরেই সে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে এবং সমুদ্রে নতুন কোনো ঘটনা ঘটছে না।

সমুদ্রের প্রশংসা কম শুনে আসে নি সে। প্রথম শুনেছিল ছোটবেলায়। তখন বয়স সাত কি আট। তাদের এক বন্ধুর বড় ভাই কিভাবে কিভাবে যেন কক্সবাজার গেল বেড়াতে বা বিয়ে খেতে কি আর অন্য ব্যাপারে, সে এলো নূড়ির মালা নিয়ে। পকেটভরা পাথর। ঝনঝন করে। বলল, সমুদ্র তাফাল জিনিস। খালি ডাকে। গোঁ গোঁ করে ডাকে। আর বালু আর পাত্থর। কাঁকড়াও আছে ম্যালা!

কাঁকড়া ব্যাপারটা তখন আকর্ষণ করেছিল আমেদকে। বালুর ওপর দিয়ে কাঁকড়া হেঁটে যাচ্ছে আর বড় একটা পাথর দিয়ে সে কাঁকড়াকে পিষে পিষে মারছে এরকম একটা দৃশ্য সে মনে মনে ভেবেছিল সমুদ্র বিষয়ে। আর বিষয়টা ভাবতে গিয়ে তার খুব ভালো লেগেছিল। কাঁকড়া মারার অদ্ভুত আনন্দ তার ভেতর ছড়িয়ে গিয়েছিল। সে ভেবেছিল কাঁকড়া মারার জন্য সে একবার সমুদ্রে যাবে। কিন্তু তারপরে তার আর কোনোদিন সমুদ্রে যাওয়া হয় নি।

তবে অনেকবার সমুদ্র দেখেছে সে। স্বপ্নে। কিন্তু ওই সমুদ্র ছোট, অনেকখানি পদ্মানদীর মতো। বর্ষায় যে পদ্মা আমেদ দেখেছিল নিশার সাথে—ওইরকম। আর সে স্বপ্নে নিশাও থাকত। দু’জনে হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাচ্ছে সমুদ্রের তীর বা পদ্মার পাড় ধরে। আর হাঁটতে হাঁটতে তখন সমুদ্র বা পদ্মা আর মুখ্য থাকত না। নিশা মুখ্য হয়ে যেত, নিশার ঠোঁটে বাতাসে উড়ে উড়ে আসা চুলগুলো মুখ্যতর হয়ে যেত। আমেদ তখন বারবার আড়চোখে নিশার চুল দেখত। তবে নিশা চোখ পাকাত এই ভেবে যে আমেদ বোধহয় চুলের ওড়াউড়ি না দেখে আড়চোখে বাতাসের বিরুদ্ধে টপ ফুঁড়ে বেরোনো তার বুক দেখছে। নিশা চোখ পাকাত আর হাসতও। মানে একটা প্রশ্রয় থাকত হাসিতে। প্রশ্রয় পেয়ে স্বপ্নের মধ্যেই আমেদের খুব খারাপ লাগত। স্বপ্নের মধ্যেই ভাবত, আহারে, এইরকম টপটোপা মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেল! স্বপ্নের মধ্যেই একটা দুঃখবোধ তাকে ঘিরে পাকিয়ে উঠত, ব্যাকুল করত। আর স্বপ্নেই সে নিজেকে কুঁকড়ে ফেলত। আর নিশাকে নিয়ে সৈকতে গড়াগড়ি যাবার ইচ্ছাটা তখন আরো প্রবল হয়ে উঠত। মনে হতো নিশার চুল সরিয়ে ঠোঁটে একটা কামড় দিয়ে বালির ভেতর ঘুমিয়ে যাবে সে। মৃত্যুর মতন একটা দীর্ঘ ঘুম দেবে। আর মৃত্যুর কথা এলেই সে দেখত নিশা চলে যাচ্ছে দূরে। সিনেমায় যেমন ব্যাক রিওয়াইন্ড হয় সেভাবে নিশা উল্টোদিকে চলে যাচ্ছে চলে যাচ্ছে চলে যাচ্ছে আর একটা বিন্দুতে গিয়ে যখন একেবারেই হারিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনই মনে হয় যে মনেহয় আর কোনো কিছু নেই কেবল একটা কালো আর কুচকুচে বিন্দু অথচ সেখান থেকে ধীরে ধীরে একটা কাঁকড়া হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে আসতে থাকে এগিয়ে আসতে থাকে এগিয়ে আসতে থাকে এগিয়ে আসতে থাকে। আর এগিয়ে আসতে আসতে আসতে আসতে যেন আসা আর শেষ হয় না কাঁকড়ার। আমেদের চোখ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আমেদ যেন ডুবে যেতে থাকে বালুর মধ্যে আর কাঁকড়া এগিয়ে আসতেই থাকে। বালুর ভেতর পাথর খুঁজতে থাকে আমেদ। কিন্তু হাত নাড়াতে পারে না। তার চোখ নাক-চোখ-মুখ সব বালুর ভেতর ডুবে যেতে থাকে। আর একেবারে শেষ মুহূর্তে দেখে কাঁকড়াটা এসে দাঁড়িয়েছে তার চোখের সামনে। চোখের সামনে একটা কাঁকড়া, অথচ পাথর দিয়ে মারতে পারছে না এরকম একটা হতাশা দিয়ে তার স্বপ্নটা শেষ হয়। বা আসলে ঘুম ভাঙে। বা আসলে নতুন একটা স্বপ্নের শুরু হয় তখন।

২.
সমুদ্র নিস্তরঙ্গ। মানুষও প্রায় নেই। অনেক অনেক অনেক দূরে কেউ শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে হয়ত। হয়ত স্বপ্ন দেখছে। আর তার ওপর দিয়ে একটা কাঁকড়া চলে যাচ্ছে। ফলে কিছু না হয়ে ওঠা সমুদ্রে যেন একটা ঘটনা পায় আমেদ। সে তার হাতের পাথরটা নিয়ে ঘুমিয়ে থাকা সেই মেয়েটার দিকে বা না ঘুমিয়ে থাকা কাঁকড়ার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।


প্রথম প্রকাশ: বাংলা নিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কম
লিংক: http://www.banglanews24.com/fullnews/bn/405079.html

গুনগুনের জ্যান্ত টিয়ে


অলংকরণ: মাসুক হেলালমন খারাপ গুনগুনের। বাবার কাছে সে-ই কবে থেকে একটা পাখি চেয়ে আসছে সে। যে পাখিটার চোখ আছে, ঠোঁট আছে, আর আছে ডানা। বাবা গত রাতেই ফিরেছে একটা পাখি নিয়ে। পাখিটা একটা সবুজ টিয়ে। পাখিটার চোখ আছে ঠোঁট আছে এমনকি ডানাও আছে। কিন্তু পাখিটা তাকায় না, ডাকে না, উড়তেও পারে না। পাখিটা প্লাস্টিকের। বাবার মাথায় যে এত বুদ্ধি কম গুনগুন বুঝতেও পারেনি। এখন এই প্লাস্টিকের টিয়ে নিয়ে গুনগুন কী করবে?
গুনগুন ভেবেছিল পাখিকে তার ফ্রেন্ড বানাবে। তার সঙ্গে কথা বলবে, ইচ্ছে হলে গানও গাইবে। কিন্তু এই প্লাস্টিকের পাখিটা নড়ে না, চড়ে না, ওড়ে না! গুনগুনের কান্না চলে আসে। পাখিটাকে বিছানায় ছুড়ে দিয়েই গুনগুন বারান্দায় চলে যায়। তার চোখ ভরা কান্না।
বারান্দায় ছোট্ট একটা আকাশ। আকাশে কোনো পাখি নেই। ইশ্, আকাশ থেকে একটা পাখি এসে বসত যদি বারান্দায়! উঠত যদি ডেকে। বলত যদি, ‘হ্যালো গুনগুন, কেমন আছ?’
ইশ্, এমন যদি হতো!
এমন সময় কে যেন সত্যি সত্যি ডেকে উঠল। বলল, ‘অ্যাই মেয়ে, তুমি আমাকে ছুড়ে ফেললে কেন?’
গুনগুন ফিরে তাকাল। আরে, ওই প্লাস্টিকের টিয়েটা। বারান্দায় দাঁড়ানো! বেশ রাগী রাগী চোখে, ডানা দুটো কোমরে উঠিয়ে, গুনগুনকে দেখছে। গুনগুন অবাক হয়ে বলল, কী, তুমি হাঁটতে পারো?
: পারি না আবার? না পারলে বিছানা থেকে এখানে এলাম কীভাবে?
: মানে তুমি জ্যান্ত পাখি?
: কী মুশকিল! জ্যান্ত না হলে তোমার সঙ্গে কথা বলছি কীভাবে?
: কিন্তু বাবা যে বলল তুমি প্লাস্টিকের?
: ধুর, বাবারা কিছু জানে নাকি বোকা? আর তুমিও বাবাকে এসব বলতে যেয়ো না! বাবারা খুব বোকা তো এসব বিশ্বাস করে না!
: তাহলে তুমি খেলবে আমার সঙ্গে, গান গাইবে, কথা বলবে? আচ্ছা, তুমি উড়তে পারো?
: পারি না আবার?
বলেই টিয়েটা ফড়ফড় করে উড়তে লাগল। উড়ে বারান্দার গ্রিলে গিয়ে বসল। হাততালি দিয়ে উঠল গুনগুন। টিয়েটা এবার গুনগুনের কাঁধে এসে বসল। বলল, কী গান শুনবে বলো?
: টুইংকেল টুইংকেল পারো?
: ধুর, ওইটা তো ওল্ড গান! নতুন কিছু গাই?
: গাও!
টিয়েটা গলা খাকারি দিল। তারপর অদ্ভুত সুরের একটা গান গাইতে শুরু করল। এমন সুর কখনো শোনেনি গুনগুন। গুনগুনের ইচ্ছে হলো একবার জিজ্ঞেস করে টিয়েটা এমন অদ্ভুত গান কোথায় শিখল? কিন্তু গানের সুরে এতই হারিয়ে গেল যে কিছুই মনে থাকল না।
২.
রাতের বেলা বাবা ফিরল খাঁচা নিয়ে। খাঁচায় ভরা এক টিয়ে। জ্যান্ত। কিন্তু টিয়েটা ডাকে না, ওড়ে না, ঠিকমতো তাকায়ও না। টিয়েটাকে দেখেই গুনগুনের মন খারাপ হয়ে গেল। বলল, ‘বাবা, টিয়েটা ছেড়ে দাও।’
: ছেড়ে দেব? তুই না টিয়ে টিয়ে করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছিলি!
: আমার তো টিয়ে আছেই!
: আরে ওটা তো প্লাস্টিকের টিয়ে...জ্যান্ত না!
গুনগুন মুখটিপে হাসে, বাবাবে কিছু বলে না। কিন্তু খাঁচার টিয়েটার দিকে তাকাতেই তার মন খারাপ হয়ে যায়। টিয়ে ডাকে না, কথা বলে না, ওড়ে না। জ্যান্ত হয়েও টিয়েটা জ্যান্ত না।
খাঁচাটা ধরে বাবাকে টানতে টানতে বারান্দায় নিয়ে গেল গুনগুন। তারপর খাঁচার মুখটা দিল খুলে। ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল টিয়েটা। গুনগুন হাসল, বাবা হাসল। উড়ে যাওয়া টিয়েটা দেখিয়ে গুনগুন বলল, ‘এখন থেকে ওই টিয়েটা জ্যান্ত। টিয়েটা এখন উড়বে, কথা বলবে, গান গাইবে; তাই না বাবা?’
: আর তুই? তুই খেলবি কার সঙ্গে? গান গাইবি কার সঙ্গে?
তখনই গুনগুনের ঘরের ভেতর থেকে একটা অদ্ভুত সুরের গান ভেসে এল। বাবা খুবই অবাক। বললেন, ‘এ রকম অদ্ভুত সুরে কে গান গাচ্ছে?’
গুনগুন আবারও মুখটিপে হাসে। কিচ্ছু বলে না। কিন্তু গুনগুন না বললেই কি আমরা জানি না ও রকম অদ্ভুত সুরে আসলে কে গান গাইছে!

প্রথম প্রকাশ: গোল্লাছুট।

যে তিনটি খুনের পর




তখনও তেমন সকাল হয় নি। তবু তুমি একটা উঁচু ছাদের ওপর থেকে সূর্যটাকে দেখলে। সুষম বৃত্তাকার বেলুনের মত, যেন বাতাসে বাতাসে ঠাঁসা। আর তুমি সূর্যের দিকে তাকিয়ে, আরও দূরে একটা জীবনানন্দ দাশের চিল উড়তে দেখে ভাবলে ওটা শকুন কিনা। আর এরকম দ্বন্দ্বের ভেতর, তুমি নয়তলা থেকে লাফ দিলে। নিচে। যেখানে তখনও জেগে ওঠে নাই পৃথিবীর ঘুম।

তুমি লাফ দিলে যেন এক বাজপাখি। আর পড়ে যেতে যেতে, বিরুদ্ধ বাতাসে, তোমার চুল কিছুটা উড়ল, তোমার ফতুয়া ফত ফত করে পাল হয়ে গেল ঢেউ হয়ে গেল আর তখন তোমার মনে পড়ল পুনর্ভবার কথা। যার কথা তুমি কতদিন আর মনে করো নাই। কেন করো নাই এমন ভাবনায় তুমি আচ্ছন্ন হলেও হতে পারতে কিন্তু তোমার মনে পড়ল পুনর্ভবার বুকে ছোট্ট যে একটা ঘাট ছিল আর তাতে ওই সূর্যের মত প্রায় নিখুঁত গোল একটা পাথর ছিল, আর পাথরে পা রেখে পায়ের ফেটে যাওয়া অংশগুলো সেদিন পরিষ্কার করছিল সীমা ভাবী। তার ছাপ শাড়ির আঁচল আলগা হয়ে গিয়েছিল আর ভেতরের লাল ব্লাউজে থরোথরো কাঁপছিল বুক, বুকের ভেতর একটা সোনার চেন কাঁপনে চিকচিক করছিল। তুমি আর আতু একটু দূরে বসে বসে বুকের মাংস দেখে দেখে বালিতে কলমিকাঠি ঘঁষছিলে তীব্রভাবে।

অথচ তোমাদের এসব দেখা বারণ ছিল। কারণ তুমি আর আতু দু’জনেই ছিলে ভালো ছাত্র। তুমি ফার্স্ট আর আতু সেকেন্ড। বরাবর। সেভেন পর্যন্ত। টিচাররা বলত মানিকজোড়। বরাবর আতু তোমার থেকে দু’পাঁচ নাম্বার কম পেত। আর আতু যেন তা মেনেই নিয়েছিল। আতু কখনওই ফার্স্ট হতে চাইত না। হতো না। তোমার তাই আতুকে খুব ভালো লাগত। কিন্তু সীমা ভাবীর মাংস দেখার আগেই আতু একটা বই এনেছিল তোমার কাছে। বইয়ের নাম ‘নিঝুম রাতের গল্প।’ ব্লাউজহীন লালশাড়ি পরা এক লম্বা মেয়ে শুয়ে ছিল প্রচ্ছদে। আর ভিতরে কত যে গল্প আর ছবি। পড়তে পড়তে তুমি পাগল হয়ে গিয়েছিলে। তোমার মনে হয়েছিল এত বিস্ময় এত আনন্দ এত প্লাবন আছে পৃথিবীতে?

তুমি আতুকে বলেছিলে আরও নিঝুম রাতের গল্প আনতে। আতু তার ভাইয়ের তোশক উল্টে উল্টে খুঁজে খুঁজে এনেছিল সীনা সাক্সিনা আর কলিকাতা-৭০০০। রসময় গুপ্ত। লম্বা ছোট নানান সাইজের নিঝুম রাতের গল্প। তুমি বইয়ের ভেতরে বইগুলো ঢুকিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তে। তোমার বিকালগুলো কেমন যেন মেঘে ঢেকে যেত। সব যেন থমকে থমকে যেত। গলা আর বুক শুকিয়ে যেত। কোথাও যেতে আর তোমার ভালো লাগত না। পড়ার যে বইগুলো তোমার ভালো লাগত এতদিন তাদের দিকে আর তাকাতে পারতে না। পৃথিবীর ভেতরের পৃথিবী যেন খুলে গিয়েছিল তোমার। খোসা ছাড়িয়ে যেন বেরিয়ে এসেছিল সরস দানাদার ভুট্টা। তোমার মুখে লেগে থাকতে শুরু করে কচি ভুট্টার দুধকষ।

আর এইটে তুমি সেকেন্ড হলে প্রথম। প্রথম হলো আতু। তোমার চেয়ে সাত নাম্বার বেশি পেয়ে। অপমানে তুমি কাঁদলে কতক্ষণ। বাগানের ভিতর তুমি একা একা ঘুমিয়ে থাকলে একটা দুপুর। চালার কোঠায় লুকিয়ে রাখা নিঝুম রাতের গল্পগুলো তুমি নাভির কাছে লুকিয়ে নিয়ে ফেলে এলে বাজারের বড় ইঁদারায়। ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ফেললে। আর ওই রাতে তুমি এই দুপুরের সিদ্ধান্ত নিলে। ওই বয়সেই তুমি যে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে তা ভাবতে কঠিন লাগে। কিন্তু জীবন তো আসলে কঠিনই এক বিষয়, কঠিন আর জটিল, জটিল ঈর্ষার মোড়কে জমানো এক সাবধানী কাচ যেন জীবন। যাকে কিছুটা লুকিয়ে আর কিছুটা প্রকাশ্যে রাখতে হয়, আর খুব সাবধানে ধরতে হয় যেন হাত না কেটে যায়। তাই তুমি ওই ঘাটে, পাথর ঘাটে, সীমা ভাবীর বুকের মাংস দেখতে দেখতে অপেক্ষা করেছিল। তোমার হাতের কাঠিটা এতটা ঢুকে গিয়েছিল যে বালুর ভেতর থেকে পানি বেরিয়ে আসতে শুরু করেছিল। তুমি গুটিসুটি মেরে সীমা ভাবীর চলে যাওয়ার অপেক্ষা করছিলে। আতু তখন কোমরে গামছা বেঁধে পায়ে পায়ে কেচকি মেরে বসে ছিল। আর সীমা ভাবী পানিতে নেমে ডুব দিতে গেলে আতু উঠে গিয়ে আকুন্দ গাছের নিচে পেশাব করতে বসেছিল। পেশাব করতে গিয়ে সে খুব নাড়াচাড়া করছিল আর তুমি মনে মনে ভেবে নিয়েছিলে তোমার করণীয়।

ঘাটে আর কেউ ছিল না। দেরি হয়ে গিয়েছিল আসলে। প্রতিদিনের গোসল করার মানুষগুলো ততক্ষণে ভাত পর্যন্ত খেয়ে নিয়েছিল দুপুরের, কেউ কেউ হয়ত ঘুমে চলে গিয়েছিল। সীমা ভাবী তাই আলগাভাবেই গোসল সেরে উঠছিল। শাড়ির আঁচলটা অনেকখানি এলিয়ে দিয়ে এমনকি বুকও কচলে নিয়েছিল। তোমাদের দিকে তাকিয়ে বলছিল, তোরা গোসল করবি না নাকি? আয় পানিতে... বেলা তো জোহর পার!

আতু তোমাকে বলেছিল, চল নামি।’ আতুর মুখে ঘাম ছিল। আতুর নামার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তুমি নামো নি। তুমি বলেছিল, ভাবী যাক তাইলে নামব।’

তোমার বলায় কোনও এক রহস্য থাকায় আতু একটু হেসেছিল। ভেবেছিল তুমি বোধহয় পানিতেই কচলাকচলি করবে। তার মুখের মধ্যে আরেকটু নিষিদ্ধতা জমে উঠেছিল। আর ভাবী তখন ডালিতে রাখা কাপড়গুলো উঠিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছিল। ভাবীর ভেজা শরীরে কাপড় সেঁটে লেগে ছিল। কিন্তু তোমরা তখনও এত বড় হও নি যে ভাবির চলে যাওয়ার দিকে নজর দিয়ে থাকবে। ফলে তোমরা পানিতে নামো। আর তুমি আতুকে নতুন একটা খেলার আমন্ত্রণ জানাও। তোমরা একটু সাঁতরে যাও দূরে। আতুকে বলো চুপচাপ ভেসে থাকতে পানিতে। তারপর তুমি আতুর গামছাটা বেঁধে দাও তার দু’পায়ে। আতু কিছু বুঝে ওঠার আগেই ডুবতে শুরু করে। ছটফট করে। পানি ঝাপটায়। হাবুডুবু খায়। আর তারপর আতু ডুবেই যায় একেবারে। আর ভাসে না। পুনর্ভবা তাকে তলিয়ে নেয়। নেয়ার পর তুমি পুনর্ভবাকে ভালোবেসে ফেল। তোমার মধ্যে কোনও ভাবান্তর হয় না। অথবা হয়। তুমি ভাবো আতু মরে গেলে ক্লাসে আসলে তুমিই ফার্স্ট। তুমি ছটফটে বুক নিয়ে পাথরের ওপর এসে বসো। আর তোমার তখন সীমা ভাবীর বুকের মাংসগুলো মনে পড়ে। তুমি সীমা ভাবীর সোনার চেন মনে করে নিজেকে কচলে নাও অনেকটা সময়।

ওটা ছিল তোমার প্রথম খুন। বাতাসে ফতুয়া ভাসিয়ে আতুর মুখটা মনে করার চেষ্টা করলে তুমি। কিন্তু নিচের দিকে পড়তে পড়তে তোমার শুধু সীমা ভাবীর মুখটাই মনে এলো। বিশেষত সেই সোনার চেনটা ঝলকে উঠল স্মৃতিতে। আর সেই ঝলকটা মিলিয়ে যেতে না যেতেই যেন একটা রোদের ঝিলিক হয়ে, তোমার পড়ন্ত শরীরের সামনে, এলো রোদেলা। যাকে ভালোবেসে তুমি রোদ ডেকেছিলে। রোদ, তোমার এই মেঘলামনের একমাত্র অবলম্বন। একমাত্র উৎকর্ষতা। নয়তলা থেকে একটা বাজের মত পড়তে পড়তে তুমি আরও একবার ওই উদয়ীমান সূর্যটাকে যেন দেখতে চাইলে, পারলে না, শহরের আরও বহুতলে এখনও ঢেকে আছে সূর্যটা। অথচ রোদ তো তোমার মনে উঠেছিল ভার্সিটির প্রথম ইয়ারেই। তোমার সাথেই ভর্তি হয়েছিল সে পদার্থ বিজ্ঞানে। তাকে দেখার পর নিজেকে তোমার পদার্থ পড়া অপদার্থ মনে হতে শুরু করে। সে ক্লাশে আসত আলো ছড়িয়ে আর সে যখন চলে যেত, তখন তুমি চলে যাওয়া দেখতে শিখেছো মানুষের, তোমার মনে হতো কেউ যেন সমস্ত কালো অন্ধকার ছড়িয়ে, পৃথিবীর তাবৎ আলো নিয়ে চলে যাচ্ছে। তোমার ভয় হতো তাকে। মনে হতো তার সামনে কথা বলতে গেলেই তোমার জিভ সরবে না। তুমি তোতলাতে শুরু করবে। আর তোমাকে নিয়ে সে খিলখিল করে হেসে উঠবে। আর তোমাকে নিয়ে হেসে উঠলেই তুমি নিশ্চিত মরে যাবে। তুমি তাই শুধু তাকিয়েই থাকতে পারতে তার দিকে। তার খোলা চুল শাদা পিঠের ওপর ছড়িয়ে পড়ে থাকত। আর তুমি তা দেখতে দেখতে যেন হারিয়ে যেতে তলিয়ে যেতে। ফিজিক্সের ক্লাশরুমকে তোমার তখন পুনর্ভবা মনে হতো। মনে হতো কারও ত্বকের ঘ্রাণে তুমি তলিয়ে তলিয়ে যাচ্ছো। অথচ রোদ বসে থাকত তোমার চেয়ে অনেক দূরে। একটা চুপচাপ ঘুঘু হয়ে। অথবা একটা অনির্দিষ্ট দুপুর হয়ে। এভাবেই তোমার প্রথম বর্ষ কেটে গিয়েছিল—শুধু রোদকে দেখে দেখেই, কোনও কথা না বলে। তুমি সাধারণত কারও সাথেই কথা বলতে না, কিন্তু তখন তুমি একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিলে। এমনকি ক্লাশের টিচাররাও তোমাকে ঘাঁটাত না। তুমি সকালে ক্লাশে এসে, রোদেলার অপেক্ষা করতে। আর রাতে হোস্টেলে ফিরে গিয়ে সকাল হওয়ার অপেক্ষা করতে।

একটা বছর কেটে গিয়েছিল। তুমি ভেবেছিলে কোনও একদিন রোদেলার সাথে কথা বলবে তুমি। ভেবেছিলে দৈব কিছু হবে। সিনেমায় যেমন হয় আর কি। হয়ত তোমার সাথে তার ধাক্কা লেগে যাবে। তার হাতের বইপত্র ছড়িয়ে পড়বে। তুমি সেই বইগুলো তুলে দেবে। রোদেলা হয়ত বলবে থ্যাংকস। বা ধন্যবাদও বলতে পারে। ফিজিক্সে পড়লেও তার মধ্যে কেমন একটা অসম্ভব জীবনানন্দ দাশ আছে। তাকে দেখলেই কেমন নির্জন নির্জন লাগে। একটা রোদমরা বিষণ্ণ বিকালের মত লাগে।

অথচ সেই নির্জনতা ভেঙে টু স্ট্রোট মটরসাইকেলের মত খ্যাটখ্যাট করে শব্দ তুলতে তুলতে এলো লোকটা। তোমাদের ডিপার্টমেন্টে কোন ভার্সিটি থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল লোকটা। প্রফেসরের নাম ছিল মনির হোসেন। সারাক্ষণ থাকত সানগ্লাশ পরে। পকেটে সারাক্ষণ পানমশলা। কিছুক্ষণ পরপর পানমশলা মুখে দিয়ে গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে থাকত তোমার রোদের দিকে।

ক্লাশে তোমার ভ্রু কুচকে আসে। তোমার মনে হয় তোমার প্রিয় ঘুঘুটাকে মারতে এসেছে কোনও চতুর শিকারী। আমগাছঘেরা পদার্থের ক্লাশরুম ধীরে ধীরে তোমার কাছে নরক হয়ে ওঠে। প্রফেসর ইচ্ছা করেই দাঁড়াত রোদের পাশে আর তারপর ট্যারা চোখে তাকিয়ে থাকতো তার গ্রীবা আর বাহুর ত্বকের দিকে। চোখ দিয়ে যেন চেটে নিচ্ছে এরকম মনে হতো তোমার।

তখন তোমার আতুকে মনে পড়ে। আতুর কচি মুখটা মনে পড়ে। পাথর ঘাট আর পুনর্ভবাকে মনে পড়ে। তার স্রোতকে মনে পড়ে। আর একটা লাল গামছার কথা মনে পড়ে। কিন্তু এ শহরে কোনও পুনর্ভবা তো নাই। তোমার তাই আফসোস হতে থাকে।

আর এরকম একটা দিনে দৈব তোমাকে ডাকে। তোমার নিয়তি তোমাকে ডাকে। ফিজিক্স যে নিয়তি অতিক্রম করে গেছে সেই নিয়তি তোমার সামনে এসে হাজির হয়। একটা রাঙতারোদের দিনে, কাঁচা হলুদ শাড়ি পরে, তোমার সামনে ঝলমল করে ওঠে রোদ। বলে, একটা বছর হয়ে গেল, আপনার সাথে পরিচয় হয় নি। আপনার কথা কত জনের কাছেই তো শুনলাম। ভাবলাম নিজে গিয়েই পরিচিত হই!
তুমি তোতলাও না। হাসো মৃদু।
রোদ বলে, আপনি এত ভালো ছাত্র! জীবনে নাকি কখনও সেকেন্ড হন নি!
তোমার তখন সীমা ভাবীকে মনে পড়ে। বলো, একবার হয়েছিলাম... ক্লাশ এইটে!
রোদ কপালে চোখ তোলে। বলে, সত্যিই? একবারই সেকেন্ড হয়েছেন সম্পূর্ণ জীবনে? কী আশ্চর্য!

তোমাদের কথা চলতে শুরু করে। তোমার মনে হয় এই মেয়েটার জন্য তুমি সেকেন্ড হতে পারো। শুধু সেকেন্ড না এই মেয়েটার জন্য তুমি ফেলও করতে পারো। কিন্তু তুমি ফেল করো না, ফেল করে রোদ। মনির হোসেনের সাবজেক্টে। রোদ মন খারাপ করে বলে, টিচারটা এত খারাপ! ওই লোকটা বলেছিল আমি যদি ওর কথা না শুনি তাহলে নাকি আমাকে ফেল করিয়ে দেবে... আর লোকটা সত্যি সত্যি...
তুমি বলেছিলে, কী করতে বলেছিল লোকটা?
রোদ কিছু বলে নি। তার মুখটা কেমন মলিন হয়ে উঠেছিল। কপালের চামড়া কুঁচকে এসেছিল লজ্জা আর ঘৃণায়। সাথে সাথে তোমার রোদজ্বলা চকচকে দুপুরটা লহমায় হারিয়ে গিয়েছিল মেঘে।

দুইদিন পর এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে টিচার্স কোয়ার্টারের এক রুমে। যে রুমে বাস করতেন মনির হোসেন। রুমের এটাচ বাথরুমের ভেতর হাতপায়ে গামছা বাঁধা অবস্থায় কয়েকজন আবিষ্কার করে মনির হোসেনকে। গামছাবাঁধা অবস্থায় তাকে উল্টো করে কেউ ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে বড় একটা পানিভর্তি বালতিতে। উদ্ধার করার পরও বেঁচে ছিল মনির হোসেন। কিন্ত সেই বেঁচে থাকাটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না তার। এক অদ্ভুত আতঙ্কের মধ্যেই তার মৃত্যু ঘটে। তুমি সে খবর পাও একটা টং চায়ের দোকানের পাশে। খবরটা পাওয়ার পর একটা পাকোরার অর্ডার দিয়ে গাছের গুঁড়ির ওপর বসে তুমি রোদেলার অপেক্ষা করতে থাকো।

ধেয়ে আসা মাটির দিকে তাকাতে তাকাতে তোমার মনে হয় এটা ছিল তোমার দ্বিতীয় খুন। তোমার মনে হতে থাকে দু’হাত ছড়ালেই তুমি নিশ্চয়ই বাজপাখির মত উড়ে যেতে পারবে। তুমি তোমার দু’হাত বাড়িয়ে দাও ছড়িয়ে দাও বাতাসে। দেখতে থাকো তোমার দিকে ধেয়ে আসছে নিচের সব কিছু। তুমি তবে মনে করতে পারবে না তোমার তৃতীয় খুনটা?

ভাবতেই তোমার মুখ কুচকে ওঠে। এই আনন্দময় ছুটে যাওয়ার মধ্যেই একরাশ কষ্ট যেন তোমাকে গ্রহণ করে। তুমি একবার ওপরে তাকাতে চাও; যেখানে একফোঁটা মোমের মত শাদা তোমার ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট। যেখানে নিশ্চয় এখনো ঘুমিয়ে আছে রোদেলা! তুমি তো তাকে ঘুম পাড়িয়ে এসেছো, তার কি আর জেগে উঠবার ক্ষমতা রয়েছে?

রোদেলাকে তুমি বিয়ে করে ফেলেছিলে। পড়ালেখার পাট চুকাতে না চুকাতেই। তোমার জন্য কঠিন কিছু ছিল না। কখনও দ্বিতীয় না হওয়া ছাত্রের জন্য এখনও চাকরির বাজার সরগরম থাকে। ছাত্র থাকা অবস্থাতেই তুমি স্কলারশিপ পেয়ে গিয়েছিলে আমেরিকা যাবার। রোদেলাকে রেখে একা যেতে হবে বলে সেটি গ্রহণ করো নি তুমি। তুমি গ্রহণ করেছিলে রোদেলাকে। রোদেলার পরিবার আর তোমার পরিবার হাসতে হাসতে তোমাদের বিয়ে দিয়েছিল। বিয়ের রাতে, তোমাদের দেখে, সবাই বলেছিল খুব ভালো জুটি... টোনাটুনি যেন... যেন মানিকজোড়...

আর তখন তুমি হঠাৎ ভয় পেয়ে গিয়েছিলে। তোমার জীবনে তো আরেকটি মানিকজোড় ছিল। তুমি আর আতু। আতু আর তুমি। কিন্তু সেই জোড়ার একজন নেই। তোমার তখন লাল গামছা আর পুনর্ভবা আর পাথরঘাট মনে পড়ে যায়। কাজী বলেন, কবুল?’ তুমি কবুল করে নাও তোমার যা কিছু দোষত্রুটি পাপপূণ্য আর আনন্দধারার মত রোদেলাকে।

তোমরা যেন চাঁদের বুকে ঘর বাঁধলে। সোনাছড়ানো দিন আর রুপাছড়ানো রাত কাটতে লাগল তোমাদের। রোদেলার ত্বক, ত্বকের প্রতিটা লোমকূপ থেকে বেরিয়ে আসা ঘ্রাণ তোমাকে সারাটা দিন আচ্ছন্ন করে রাখত। রোদেলার হাত ধরে নয়তলার ছাদের ওপর উঠে গভীর রাতের তারাগুলোকে মনে হতো একেকটা স্বপ্নের বীজ। তোমরা যেন সেগুলো নিয়ত ছড়িয়ে দিচ্ছো সেগুলো তোমাদের আকাশের অনন্ত উঠানে।

আদুরে বেড়ালের মত রোদেলা তোমার গালে গাল ঘষত আর বুকের ভেতর মাথা গুঁজে রাখত। তোমার মনে হতো একটা সুখের ডাস্টবিন তোমার ওপর উপুড় করে দিয়েছে কেউ। তোমার শরীর বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ভালোবাসা, স্নেহ, আদর আর গলগলে সোনামধু। রোদেলাকে জড়িয়ে ধরে রাখতে তুমি সারাটা সময়। ছেড়ে দিলে, মনে হতো, নিজের সবচেয়ে প্রিয় প্রত্যঙ্গ তোমার হাতছাড়া হয়ে গেছে। তুমি বিচলিত বোধ করতে। মনে হতো কী যেন নেই কী যেন নেই। এই না থাকা, কখনও কখনও, তোমাকে আতঙ্কিত করে তুলত। তুমি ভাবতে, তুমি কি তবে, মানুষ হিসেবে অসম্পূর্ণ হয়ে পড়ছো? তোমার নিজের কাছ থেকেই তুমি গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছো? অথচ তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে আরেকটা স্বতন্ত্র মানুষ? তুমি তলিয়ে যাচ্ছিলে। যেভাবে তলিয়ে গিয়েছিল আতু। আতুকে ভুলতে পারতে না তুমি। রোদেলার বুকে মাথা রেখেও তোমার মাঝে মাঝে আতুর কথা মনে পড়ে যেত। রোদেলাকে তাই একদিন বলেছিলে, সোনা পরো না তুমি?’ রোদেলা হেসেছিল মৃদু। বলেছিল, তুমি বললে পরব। কী পরাতে চাও... কোমরবিছা?’ দুষ্টুমি ছিল রোদেলার মুখে। তুমি বলেছিলে, ‘না একটা পাতলা সোনার চেন... গলায়... যার প্রান্তটা তোমার বুকের ভেতর আমার নাকের মত মুখগুঁজে থাকবে...

সেদিনই আলমারি থেকে একটা সোনার চেন বের করে নিয়েছিল রোদেলা। তুমি রোদেলাকে বলেছিলে, একদিন আমার গ্রাম নিয়ে যাব তোমাকে। একটা নদী আছে সেখানে...

রোদেলা বলেছিল, ‘পুনর্ভবা, না?

তুমি খুব অবাক হয়েছিলে এই ভেবে যে, পুনর্ভবার কথা রোদেলা জানে। তোমার অবাক মুখের ওপর রোদেলা তার আলতো হাসি রেখে বলেছিল, প্রতি রাতেই তুমি পুনর্ভবার কথা বলো। ঘুমের মধ্যে। এক ধরনের ছটফট করতে করতে!

তুমি একটু হাসতে চাও। কিন্তু তোমার মনে হয় মুখের মাংসপেশীগুলোর সাথে হৃদয় কোথাও তাল দিচ্ছে না। তুমি বলো, পুনর্ভবা আমার প্রথম প্রেম।

রোদেলা বলে, আর আমি?

তুমি বলো, তুমি হয়তো প্রথম নও। যদিও তুমি প্রথম বলে আমার ভ্রম হয়...

রোদেলা হেসেছিল বেশ খানিকটা। আর নিজের বলা কথাগুলো তোমার নিজের ভেতরই তখন গুঞ্জরিত হচ্ছিল যে রোদেলা তবে তোমার প্রথম প্রেম নয়! যেন নিজেই তুমি প্রথম আবিষ্কার করো বিষয়টি। ক’রে, তোমার একটু উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। তখন রোদেলা কানে কানে ফিঁসফিঁস করেছিল, অথচ বাসায় কেউ তো ছিল না, তবু তার কণ্ঠ মিশেছিল খাদে, বলেছিল, শোনো এবার আমাদের আমাদের প্রথম ভালোবাসাকে নিয়ে আসতে হবে পৃথিবীতে!’

তুমি প্রথমে বুঝতে পারো নাই রোদেলা কথা। কী এমন বলছে যে তার কণ্ঠ নেমে যাচ্ছে পাতালের দিকে! আর তারপর রোদেলা তোমার কানের লতিটা কামড়ে দেয় অল্প করে। তখন তোমার যেন বোধিপ্রাপ্তি হয় আর তুমি বুঝতে পারো রোদেলা, তোমার নির্জন রোদ, আসলে তোমাদেরই আরেকটা অংশ চাচ্ছে। একটা শিশু প্রার্থনা করছে। তোমার একটু ধাক্কার মত লাগে। সেটা তোমার মুখের রেখাগুলোকে হয়ত আড়ষ্ট করে দেয়। আর রোদেলার চোখ সেই রেখাগুলো ছুঁতে পারে। রোদেলার কণ্ঠ খাদেই থাকে তবু। বলে, তুমি চাও না?’

তুমি চাও কিনা তুমি বুঝতে পারো না। কিন্তু অদ্ভুতভাবে এক অসম্ভব ঈর্ষার ঝলক তোমার ভেতর খেলে যায়। ঈর্ষা? তোমার নিজেকেই প্রশ্ন করতে হয়, ঈর্ষা কেন? তোমার মনে হয় তুমি যেমন রোদেলাকে পেয়ে পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠেছো, রোদেলাকে ছাড়া তুমি যেমন  অসম্পূর্ণ মনে করো নিজেকে—রোদেলা তাহলে তেমন মনে করে না? বরং তোমাকে পেয়েও সে সম্পূর্ণ নয়। তার এখন একটি শিশু চাই? শিশু! আরেকটি মানুষ। শিশু। আরেকটি সত্তা। শিশু! তোমার মাথার ভেতর শব্দটি আছড়ে আছড়ে পড়তে থাকে। পড়তেই থাকে।

মাটি খুব কাছাকাছি। ধেয়ে আসছে যেন তোমারই দিকে। গুগল ম্যাপ যেভাবে আকাশ থেকে ঢুকে যায় ভূমির দিকে, আর ভূমি তখন ধেয়ে আসে যেন ওপরে, তুমিও ঠিক সেভাবেই ঢুকে যাচ্ছো, আর মাটি আর কংক্রিট কটোমটো চোখে ধেয়ে আসছে তোমার দিকে। আর তোমার মনের ভেতর গুঞ্জরিত হচ্ছে একটা শব্দ, শিশু। শিশু। যে শব্দটিকে তুমি কখনও সন্তানে রূপান্তরিত করতে পারো নি। মনে হয়েছে সে তোমার অংশ নয় বরং এক নির্মম প্রতিপক্ষ। যে তোমার রোদেলার ভেতর থেকে এসে, রোদেলার শরীর বেয়ে এসে, রোদেলারই ওপর ভাগ বসাবে। যে তোমার রোদেলার উরু আর জঙ্ঘায়, কোমরে আর গ্রীবায়, ওষ্ঠে আর স্তনে, তোমার দখল পাওয়া সমস্ত স্থানে, তোমার আগে পৌঁছাবে। তোমাকে সেকেন্ড করে দেবে। ক্লাশ এইটে আতু যেভাবে করে দিয়েছিল। তুমি হবে শোচনীয় দ্বিতীয়।

কংক্রিট ছোঁয়ার মুহূর্তটি হঠাৎ তোমার কাছে খুব ধীর হয়ে যায়। সিনেমায় দেখানো স্লো মোশনে যেন তুমি, আসলে তোমার মাথার একপাশ আর শরীরের ভার, কংক্রিটকে স্পর্শ করে। বিকট শব্দ হয় বোধহয়। কারণ তোমার শরীরটা কংক্রিট স্পর্শ করার মুহূর্তেই নয়তলা ভবনের সামনের এই রাস্তাটি হঠাৎ খুব সজাগ হয়ে ওঠে। কয়েকজন ছুটে আসে তোমার দিকে। সূর্যের আলোর একটা ঝলক তোমার চোখকে বিদ্ধ করে। আর ওই শাদা আলোর মধ্যে তোমার রোদেলাকে মনে পড়ে। যার শরীরে একটা শিশু এসেছিল। একটা শিশু, যে তোমার সন্তান, কিন্তু যে তোমার সন্তান ছিল না আসলে। সেটি ছিল নিতান্ত তোমার প্রতিপক্ষ। সে আসছিল তোমাকে দ্বিতীয় করে দেয়ার জন্য। তুমি তাকে আসতে দিতে চাও নি। তুমি তাই তার আসার পথটা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলে। তুমি তাই রোদেলাকে নিথর করে দিতে চেয়েছিলে। আর তুমি যা চাও তুমি তাই করে ফেলতে পারো। অতীতেও করেছো তুমি। তোমাকে খুব বেশি পরিশ্রম করতে হয় না।

কাজটি সহজ ছিল। তোমার মুখ ছুঁয়ে থাকা রোদ্রের মত শাদা ওয়ারঅলা একটা বালিশ তুমি চেপে ধরেছিলে তোমার নির্জন রোদেলার মুখে। যেন জীবনানন্দের কবিতার শ্বাসরোধ করতে চাইছো তুমি, এমন মনে হয়েছিল তোমার। ফুলস্পিডে ফ্যান ঘুরছিল মাথার ওপর। যেন এরোপ্লেনের মত উড়ে যাচ্ছে শীতের পাখি। তুমি বালিশের চাপটা বাড়াতে বাড়াতে দেখছিলে জেগে উঠছে রোদেলা। সে তার বিস্ফোরিত চোখে তোমাকে দেখতে চেয়েছিল, হয়ত চিৎকারও করতে চেয়েছিল, কিন্তু তোমার ধীর ভালোবাসার অনন্য দুটি চোখের শীতল দৃষ্টি দেখে চুপ করে থেকেছিল। চুপ করে নিজের মৃত্যুকে তার শরীরের ভেতর স্থির হতে দিয়েছিল। হাল ভাঙা নাবিকের মত শুধুই দূরে আরও দূরে তাকিয়েছিল। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পেরেছিল।

একটা শাদা বিছানা নয়—যেন ছড়ানো পৃথিবীর মধ্যে একফোঁটা সুখী লাবণ্যের মত শান্ত রোদেলা ঘুমিয়ে ছিল যখন, তখন তোমার ভেতর কেঁপে উঠেছিল। তুমি ঘুমিয়ে পড়তে চেয়েছিলে। শাদা ওয়ারের বালিশটা প্রথমে মাথার নিচে তারপর বুকের ওপর আর তারপর নাকের ওপর চেপে ধরেও তোমার ঘুম আসছিল না। অথচ তোমার মনে হয়েছিল তুমি ঘুমাতে চাও। ঘুমাতে চাও। যেমন ঘুমাচ্ছে তোমার রোদ। তুমি তাই ছাদে উঠে গিয়েছিলে। ছাদে। নয়তলার ছাদে। আর সূর্যের দিকে তাকিয়ে, উঠতি রোদ্রের দিকে তাকিয়ে, তোমাকে এই মাটি ডেকেছিল। যেখানে ছড়িয়ে যাচ্ছে তোমার রক্ত প্রবাহ। গলগল করে ছুটে যাচ্ছে নর্দমার দিকে। তোমার চোখ বুঁজে আসছিল। আর বুঁজে যাওয়া চোখের ভিতর দিয়েই তুমি দেখতে পাচ্ছিলে মেরুন শাড়ি পরে তোমার দিকে ছুটে আসছে কেউ। তুমি তাকে চিনতে না পেরে আবারও ঘুমিয়ে যেতে চাইলে। আর তোমার শরীরটা লুঙ্গিপরা কেউ তুলে ধরে যেন নিয়ে যেতে চাইছে কোথাও। ভ্যানের একটা চাকার ওপর তোমার হাত পড়ে থাকে, ঘষা খায় বারবার, চামড়া জ্বলে যায়, কেউ সেদিকে তেমন খেয়ালই করে না, গুরুত্ব দেয় না। তোমার ঘষে যাওয়া হাতের জন্য মায়া হয়, তুমি হাতটা সরিয়ে আনতে চাও, কিন্তু পারো না। তোমার সিদ্ধান্ত তোমার শরীর মেনে নেয় না।

তোমাকে কোথাও যেন নিয়ে যাবার জোর চেষ্টা হতে থাকে। চারিদিকে খুব হল্লা তোমার ভেতর একবার পৌঁছায় একবার পৌঁছায় না। তোমার কাশি আসে খুব, বদলায় তুমি বমি করে দাও হড়হড় করে। কেউ যেন তোমার মুখটা মুছে দেয় পরম মমতায়। আর তোমার ফাঁকা হয়ে যাওয়া মাথার ভিতর বাতাস ঢুকতে থাকে খুব। চিরবদ্ধ থাকা করোটির জায়গাগুলো বাতাস পেয়ে কেমন নগ্ন হতে থাকে—খুলে ফেলতে থাকে থাকে তাদের অন্তর্বাস। তোমার মনে পড়ে শৈশবে তুমি দীর্ঘক্ষণ আটকা পড়েছিলে এক কবরে। আর শাবল দিয়ে খুঁড়ে তোমাকে যখন বের করতে চায় অন্যরা, শাবলে খোঁড়া গর্তের ফাঁকা দিয়ে হু হু করে ঢুকতে শুরু করেছিল বাতাস আর তোমার তখন খুব আরাম হয়েছিল। তোমার এখন খুব আরাম হতে থাকে। মাথার ভেতর যেন খেলতে থাকে নিষিদ্ধ বাতাস!

চোখ খুলে একটা হাসপাতালের মত জায়গায় নিজেকে একবার দেখ তুমি। শাদা দেয়াল চারিদিকে। দেয়ালগুলো দেখে প্রথমে তোমার খুব ভ্রম হয়। মনে হয় দেয়ালগুলো তুলার মত নরম নরম মেঘ। আর তখন একটা কণ্ঠ শুনতে পাও তুমি, আতু ভাই, আতু ভাই... আপনার ফ্রেন্ড... আমি কিছু জানি না... কখন ছাদ থেকে... আপনি তো জানেনই ওর...

চোখ খুলতে বাধ্য হও তুমি। দেখ একটা ডাক্তার। তুলোর মত এপ্রোন পরা ডাক্তার। ডাক্তার তোমাকে ডাকছে তোমার ধরে। ডাক্তার কি তোমার চেনা? ডাক্তারকে তোমার অচেনা মনে হয়। এমন লোককে কখনও দেখ নি তুমি। কিন্তু একটা কণ্ঠ বারবার তাকে আতু ভাই বলে ডেকে যায়। তাহলে এই ডাক্তারের নাম আতু। তোমার বাল্যবন্ধুর নামে নাম? কণ্ঠটি আবার বলে, আতু ভাই, আপনি ডাকলে তো লাভ নেই। আপনাকে তো ও চিনতে পারে না। আপনি ওর কাছে এখনও সেই ছোট। যাকে পুনর্ভবায় সে গামছা বেঁধে’...

ডাক্তার বলে, তবু। তবু ডাকি। যদি চিনতে পারে। যদি এখন এই ক্রুসাল টাইমে বেরিয়ে আসে সে ভ্রম থেকে। যদি বাঁচবার ইচ্ছাটা তার আবার তৈরি হয়।’

কণ্ঠটি বলে, আজ রাতে আমাকে জাপটে ধরেছিল একবার। একটা বালিশ দিয়ে। আমি বেরিয়ে এসেছিলাম একপাশে কোনওমতে। কিন্তু কখন যে একা একা ছাদে...

ডাক্তারের পাশের কণ্ঠটির দিকে তোমার এবার তাকাতেই হয়। মেরুন শাড়ি পরা কণ্ঠটি কি তোমার চেনা? তুমি শরীরটা দেখ। ওই গ্রীবা আর ত্বক আর ওই ঘ্রাণ... এখনও ওই ঘ্রাণ।

তুমি চেনা আর অচেনার মধ্যে হারিয়ে যেতে থাকো। আর হারাতে হারাতে তুমি তোমার খুন হয়ে যাওয়া বাল্যবন্ধুকে দেখ তোমার মাথায় সেলাই করে দিতে। দেখ তার পাশে রোদেলার উৎকণ্ঠা। ওর মধ্যেই তুমি রোদেলা ঈষৎ স্ফিত উদরের দিকে তাকাতে চাও। শিশুটি কি তাহলে এখনও ওখানেই আছে? তুমি খুব অস্থির বোধ করতে থাকো। তোমার হাতে খুন হয়ে যাওয়া মানুষগুলো কেন তোমাকে ঘিরেই ঘুরছে তুমি বুঝতে পারো না। তোমার একবার সেই প্রফেসরের কথা মনে পড়ে। কে যেন বলেছিল প্রফেসরটি কিছুদিন আগে মারা গিয়েছেন। আর তখন তুমি খুব করে হেসেছিলে। যে মানুষ তোমার হাতে খুন হয়েছিল পাঁচ বছর আগে সে কিছুদিন আগে কিভাবে মারা যায়? পৃথিবী আনন্দময়, তখন তুমি ভেবেছিলে। তুমি রোদেলার দিকে তোমার হাত প্রসারিত করতে চাও। রোদেলা কি তাহলে বেঁচে আছে? তাহলে তার বাল্যবন্ধু আতুও কি বেঁচে আছে? আতু কি তাহলে এই ডাক্তারের সমান বড় হয়ে যেত, এখন বেঁচে থাকলে? আতু কি ডাক্তার হতো, এখন বেঁচে থাকলে?

ডাক্তার বলে, না, হলো না!’

রোদেলার আর্তি শোনা যায়। আর তুমি অন্তত একটি খুন করতে সফল হও।




প্রথম প্রকাশ: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
লিংক: http://www.banglanews24.com/fullnews/bn/384978.html

দ্য টাইগার শো

: হ্যালো, এটা একটা সুন্দর ঝকঝকে দিন, যদিও দূরে একটু মেঘের ঘনঘটা আছে। আর আমরা এখন মিরপুর স্টেডিয়ামে। স্বাগত জানাচ্ছি আমাদের ‘টাইগার শোয়ে’। আমি ব্রায়ান আর সঙ্গে আছে আমার সুন্দরী স্ত্রী লরা।
: হাই! আমি লরা। আর আমাকে সুন্দরী বলার জন্য ধন্যবাদ, সোনা!
: এটা সব সময় কাজে দেয়, আপনারা তো জানেনই। কিন্তু আপনারা জানেন না, এখানে আসাটা ছিল কতটা ঝক্কির!
: হ্যাঁ, এটা খুব ঝামেলার ছিল, আর ভয়ানকও।
: এখানে আসতে আমাদের একটি চলতি বাসে উঠে যেতে হয়েছিল, যার কোনো হাতল ছিল না। রাস্তা ছিল ত্রুটিপূর্ণ, আর খুবই দুর্গম। আমরা একে অন্যের গায়ে ধাক্কা লাগতে লাগতে যখন থামলাম, ভেবেছিলাম আমরা বোধ হয় পৌঁছে গেছি। কিন্তু ও ঈশ্বর! সেটা ছিল একটা ভ্রম! ভয়ানক ভ্রম!
: আমরা আসলে জ্যামে আটকা পড়েছিলাম। আর জ্যামটা ছিল অভাবনীয়। একটা বৃহৎ অজগরের চেয়েও লম্বা আর বড়। জ্যামটার লেজ ছিল কিন্তু কোনো মাথা ছিল না!
: এটা ছিল অস্বস্তিকর। কিন্তু আমাদের কিছুই করার ছিল না।
: আমরা অসহায় ছিলাম।
: তবে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছি।
: এটাই বড় কথা। আমরা পৌঁছাতে পেরেছি।
: এখন মিরপুর স্টেডিয়ামে আমরা দেখব টাইগার বাহিনীকে।
: আমি টাইগার বাহিনী দেখার জন্য খুবই উদ্গ্রীব, সোনা।
: একটু পরেই তারা মাঠে নামবে, তুমি চিন্তা কোরো না। আর নেমেই তারা শিকার শুরু করে দেবে!
: ওয়াও! আমরা কি সরাসরি শিকার দেখতে পারব? এটা হবে খুবই রোমহর্ষক!
: আর রোমাঞ্চকরও! আর ওই যে দেখো, দুটি টাইগার মাঠে।
: ওয়াও! টাইগার দুটোকে কী কিউটই না লাগছে!
: কিউট দেখালেও ওরা খুবই বিপজ্জনক। বয়সে একটু বড় যে টাইগারকে দেখছ, তাঁর নাম টাইগার তামিম। সে চাইলে এক থাবায় শত্রুপক্ষের সব প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিতে পারে।
: বাপরে! শুনেই তো গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে... দেখো দেখো...!
: কিন্তু এখনো অনেক টাইগার বাকি, সোনা! শান্ত হও। টাইগার তামিমের সঙ্গেই যে লম্বা টাইগারটাকে দেখছ, সে আসলে এক চূড়ান্ত আবিষ্কার!
: সে-ও কি থাবায় বল গুঁড়িয়ে দেয়?
: সে উড়িয়ে দেয়। সে পিচের ওপর দাঁড়িয়ে ইচ্ছামতো একেকটা বল ডানে-বাঁয়ে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতা আর সাহসিকতার সঙ্গে উড়িয়ে দিতে পারে। এবং খুবই আশ্চর্যের বিষয়, এসব থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত তার নাম!
: তার নাম শুনতে আমি খুবই উদ্গ্রীব, হানি!
: ঝড়ের বেগে শত্রুপক্ষকে ধ্বংস করে দিলেও তার নাম সৌম্য। মানে শান্ত! এটা আজব আর ভাবনার মতো বিষয়ও!
: আমার খুবই ভয় লাগছে।
: এই রোমাঞ্চের জন্য তো আমরা এসেছি, সোনা। আর ওই যে ওখানে দেখো আরেকটা টাইগার।
: আরে ওটা তো সব্বার চেয়ে বাচ্চা!
: হ্যাঁ কিন্তু সবার চেয়ে বিধ্বংসী! ওর নাম মুশফিক! এই বাহিনীর সবচেয়ে ধারাবাহিক শিকারি।
: দেখে কিন্তু মোটেও তেমন মনে হয় না।
: ওটা তাঁর ক্যামোফ্লেজ। যেন শত্রুপক্ষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ও হামলা করতে পারে।
: বুঝেছি, কিন্তু ওই যে মাঠে যাকে ইচ্ছা তাকে থাবা মারছে, সে কে?
: তার সম্পর্কে বলতে আমার গলাটা কেঁপে উঠছে। দেখো, আমার হাতটাও কাঁপছে, দেখেছ?
: হ্যাঁ, তুমি কি অসুস্থ বোধ করছ?
: এটা একটা ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, লরা। টাইগার সাব্বিরকে মুখোমুখি দেখা!
: সাব্বির? ও কি খুবই ভয়ংকর?
: ওকে দেখে আমার শরীর হিম হয়ে আসছে! ও পিটিয়ে প্রতিপক্ষের সমস্ত বোলারকে স্রেফ ছাতু বানিয়ে দিতে পারে!
: ও ঈশ্বর! ও তাহলে খুবই মারাত্মক!
: আর দেখো প্যানথারের গতিতে একটা টাইগার ছুটছে, ওই যে ওখানে, দেখেছ?
: ওকে খুব একটা খুশি দেখাচ্ছে না...
: ও ওরকমই থাকতে পছন্দ করে। তবে ও যখন দৌড়ে গিয়ে গোলা ছোড়ে, শিকার তখন কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। বোঝার আগেই শিকার মরে যায়। ও ইয়র্কমাস্টার রুবেল। তুমি তো দেখছি তার ওপর থেকে চোখই সরাচ্ছ না?
: হ্যাঁ রুবেল আমার হৃদয় জয় করেছে। আমি কি ওর প্রেমে পড়ে গেলাম?
: ওর প্রেমে সবাই পড়ে যায়। কিন্তু তোমাকে এবার চোখ ফেরাতেই হবে! কারণ, দেখো, ওই যে মাঠের ওই এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে টাইগার সাকিব।
: ওকে আমি চিনি!
: ওকে কে না চেনে? পৃথিবীর প্রায় সমস্ত জঙ্গলে ও শিকার করে এসেছে। মরু থেকে মেরু পৃথিবীর সমস্ত অঞ্চলে ও সেরা। তার আছে র্যাটল স্নেকের মতো শীতল চোখ আর ঠোঁটের কোনায় আছে সম্মোহনী হাসি।
: এই হাসি দিয়েই কি সে বিশ্ব জয় করেছে?
: হ্যাঁ। কিন্তু এই হাসি হাসার আগে সে শত্রুপক্ষকে টেনে নিজের আয়ত্তের ভেতরে নিয়ে আসে। সে তখন হয়ে ওঠে ভয়ংকর শিকারি। তারপর সে শিকারিকে ক্রমাগত আক্রমণ করে বসায় মরণকামড়। তারপর সে হাসে। সে হাসি বড় রোমহর্ষক!
: আমি শিউরে উঠছি, হানি!
: দেখো, ওই যে ওই টাইগারটিকে, টাইগার বাহিনীতে ওই সবচেয়ে নতুন!
: ওকে ঠিক পূর্ণবয়স্ক টাইগার মনে হয় না, মনে হয় যেন শাবক...
: একদম ভুল ধারণা! বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সুন্দরবনবিধৌত সাতক্ষীরা থেকে এসেছে ওই টাইগার। ওকে যতই শাবক মনে হোক না কেন, শিকার করে ও ঠিকই সবার নজর কেড়েছে। ও কাটার নামের একটা গোলা ছোড়ে, তাতে মেশানো থাকে প্রাণঘাতী সায়ানাইড।
: বাপ রে বাপ...
: হ্যাঁ, ওর বিপক্ষে যারাই লড়েছে, সবাই তাকে বাপ বলেই ডেকেছে। এই ক্রিকেট সাফারিতে ও নতুন বাপ। ও মুস্তাফিজুর! এক বিষাক্ত সরল ঘাতক!
: অভাবনীয় আর দুর্দান্ত! এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ টাইগার শো!
: কিন্তু সোনা, আমাদের শো এখনো শেষ হয়নি। এই টাইগার বাহিনীতে রয়েছে এক নেতা!
: সে-ও নিশ্চয়ই খুব দুর্ধর্ষ?
: সে কিলার। কিন্তু তার হৃদয় সিংহের মতো। ওই যে দেখো মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছে কে কীভাবে শিকার করবে! সে ছক কষে নিচ্ছে। তার মস্তিষ্ক চলে এক অদম্য নিয়মে আর অদ্ভুত উপায়ে। সেখানে ভয়ডর বলে কিছু নেই। তার পায়ে আঘাত এসেছে অসংখ্যবার, কিন্তু সে প্রতিবারই লড়াইয়ে ফিরে এসেছে। কখনো হার মানেনি। জয়ের ইচ্ছা তার রক্তের ভেতর টগবগ করে ফোটে। সে এই সম্পূর্ণ টাইগার বাহিনীকে উজ্জীবিত রাখে। এই অঞ্চলের সবাই তাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে...
: কী নাম তার? তার নাম শোনার জন্য আমি ব্যাকুল...
: তার নাম আমার কাছ থেকে না শুনলেও হবে। এই উষ্ণ অঞ্চলের যেকোনো জায়গায় গিয়ে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই তুমি পেয়ে যাবে তার নাম। শুধু জিজ্ঞেস করবে, ‘হেই, তোমাদের সবচেয়ে প্রিয় টাইগার কে?’
: আর এখানেই আজকের মতো শেষ হচ্ছে আমাদের টাইগার শো। কিন্তু শেষ করার আগে আপনাদের কাছে প্রশ্ন, আপনাদের প্রিয় টাইগার কে?


প্রথম প্রকাশ: রস+আলো
লিংকhttp://www.prothom-alo.com/roshalo/article/564718/%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B6%E0%A7%8B#comments

মৃদু মানুষের খনা দর্শন





খনাকে চেনো নাকি?
মানে ওই বচনঅলা?
হ্যাঁ ওই যে যদি বর্ষে মাঘের শেষ ধন্য রাজার পূণ্য দেশ!
হ্যাঁ এরকম বচন দুয়েকটা তো জানিই। দাদা-দাদির কাছ থেকে শুনেছি। নানুও বলত। আব্বাকে বলতে শুনেছিলাম কী কী যেন... এখন তো আর কাউকে বলতে শুনি না।
ও-ই! খনা! খনার বচন!
না, এখন তেমন তো শুনি না আর। তো, এই খনাটা কে?

২.
খনা কে, তা নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই আসলে আমাদের। থাকার তো কোনও কথা নেই। খনার সাথে আমাদের বড় প্রয়োজনটা ছোট হয়ে এসেছে। কৃষক-চাষা-ভূষাদের, খনার কিছু কার্যকরী প্রয়োজন ছিল আগে। কৃষকের ফসল ফলানো আগে যে খুব বেশি প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল ছিল। আর সেই প্রকৃতির কিছু টেনডেন্সির খবর পাই খনার বচনে। কখন বৃষ্টি হলে কী হয় তার ইঙ্গিত যেমন পাওয়া যায় খনার শ্লোকগুলোতে তেমনি মানুষের অবস্থানের তারতম্যের বর্ণনাও আসে তার ছন্দে।
খনা যখন বলে—
যদি বর্ষে মাঘের শেষ
ধন্য রাজার পূণ্য দেশ

তখন আমরা বুঝি মাঘের শেষে বর্ষণ হওয়া বেশ ভালো একটা ঘটনা। এই ঘটনা ফসলের সাথে খুব জড়িত। বর্ষা মানে বৃষ্টি আর সময়মতো বৃষ্টি মানে বাম্পার ফলন। কিন্তু সত্যিই কি তাই? মানে এখন শুধু আকাশের বৃষ্টির ওপর তো ফসল নির্ভরশীল নয়। এখন বরং বিদ্যুৎহীনতায় ডিপটিউবওয়েল নষ্ট হয়ে যাওটাই অধিক ঝামেলার কারণ। কৃষক এখন ঠিক আকাশের মেঘের দিকে তাকিয়ে আল্লাহ মেঘ দে পানি দে বলে কাতর হয় না, রেডিও শুনে জানতে চায় না কখন বৃষ্টিপাত হতে পারে, বরং তার চোখ থাকে সন্ধ্যার পর তার ফসলের মাঠের ডিপসেচের যন্ত্রে ‘কারেন্ট’ পৌঁছাচ্ছে কিনা! যদি না পৌঁছে তাহলে মাঘের শেষের বৃষ্টিও খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারবে না তার ফসলের ওপর।

খনা যখন বলে—
থেকে গরু না বায় হাল
তার দুঃখ চিরকাল

আমরা একটু থমকাই। ভাবি, আহা সত্যবচন বটে। এমন চরিত্র তো এখনও আমাদের মধ্য বিরাজমান। কিন্তু এও সত্য যে এ ধরনের কথা বড় ক্লিশে হয়ে গেছে। নতুন কিছু তেমনভাবে বলছে না তো খনা। বাঙালির বসে আয়েশ করার চিরন্তন ‘গুণে’র খবরই শুধু প্রকাশ করে এখানে খনা। এর অধিক মূল্যমান আর কীইবা আছে উক্ত বচনের?

তাহলে কি খনা ফুরিয়ে গেছে?

এই মোবাইল অ্যাপের যুগে, উড়ে আসা হাজার হাজার তথ্যের ভিড়ে, খনার বচনের আর কী প্রয়োজন? কী প্রয়োজন এমনকি খনার?

আর যার প্রয়োজন দেখি না সময়ে ও সামাজিকতায় তখন তাকে নিয়ে আস্ত একটা নাটক রচিত হয়, তা আবার মঞ্চায়নও হয়, এবং কী অদ্ভুত ব্যাপার তার মঞ্চস্থের সংখ্যা হাফ সেঞ্চুরি হয়ে যায়... ঘটনাটা কী?

আমাদের মতো মৃদু দর্শকের মনে এরকম প্রশ্ন উদয় হয়। আমাদের খারাপ লাগে যে আর্ট আসলে উল্টো পায়েই হাঁটছে। ধীরে ধীরে মধ্যযুগের দিকে উল্টো ভৌতিক পা নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আমাদের খুব ‘ধুর’ বলতে ইচ্ছা করে—কিন্তু আমরা বলি না; বরং টিকিট কাটি। খনার ৫০ দেখার জন্য চুপি চুপি গিয়ে বসি মঞ্চের সারবদ্ধ চেয়াগুলোতে। আমরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিই না যে, ‘খনা দেখতে আসছি’। হলিউডি কোনও অ্যাভেঞ্জার দেখতে গেলে না হয় ফলাও করে জানানো যেত। সঙ্গী সাথীর নামটাম দিয়ে ফাটায়ে দেয়া যেত। কিন্তু খনা? না...

৩.
খনা দেখতে বসে দেখি বরাহকে। মিহিরকে দেখি। সেই সময়ের বাংলাকে দেখি। খনাকে আর দেখি না।

দেখি মিহিরের সাথে লীলাবতীর বিয়ে হয়ে গেছে। আর বিখ্যাত জ্যোতিষী বরাহের কাছে তারা ফিরে আসে। ফিরে আসে? কেন? কারণ মিহিরের ভাগ্য গণনা করে প্রখ্যাত বরাহ দেখেছিলেন বিপদের কথা। তাই নদীতে মিহিরকে তিনি ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। সেই মিহির ফিরে এসেছে বরাহের কাছে। সঙ্গে লীলাবতী। আর এসেই লীলাবতী প্রমাণ করে দিল শ্বশুর বরাহের গণনা ছিল ভুল। মিহির বিপদ নয়, বিপদেরও নয়। লীলাবতী জানাল শুভক্ষণে জন্মেছিল বলে তাকে সবাই খনা নামেও ডাকে। আমরা বুঝতে পারি যে লীলাবতীই আসলে খনা। কিন্তু লীলাবতীকে আর খনা বলতে ইচ্ছা করে না তখন। প্রচলিত খনাকে ছাপিয়ে লীলাবতী প্রকটতর হয়ে উঠেছে ততক্ষণে।

আর আমাদের মধ্যে পুরনো খনার কনসেপ্ট ভাঙতে থাকে। যেন এক মূর্তি ভেঙে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, আর ভেঙে ভেঙে সেখানে লীলাবতীর বিগ্রহ স্থাপিত হচ্ছে।



বরাহ যেন প্রাচীন। মহীরুহই হয়ত। তাঁর পেছনে আছে খ্যাতির একটা লম্বা আচ্ছাদন। আছে অহংও। লীলাবতী যেন নবীন এক চারাগাছ। চকচকে দুটো পাতা নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। আকাশের দিকেই তার গতি। আকাশ ছাড়িয়ে সেই গ্রহ-নক্ষত্রের দিকে সে ধাবমান। লীলাবতীও তো গুণিন। তারও দৃষ্টি তাই আকাশের দিকেই থাকার কথা। কিন্তু অচিরেই লীলার দৃষ্টি পড়ে জমিনে। যেখানে তার শিকড় প্রোথিত। যেখানে জমিনে বিচরণ করে সাধারণ মানুষ, চাষাভূষা মানুষ, আর মৃদু মানুষেরা। লীলা তাদের সাথে মিশতে তাদের সাথে কথা বলতে তাদের কথা ভাবতেই যেন আগ্রহী হয়ে ওঠে। দূরের গ্রহ দূরেই থাকে, লীলা জনমানুষের হয়ে উঠতে থাকে।

অতি গম্ভীর বরাহ’র নিকট যা কোনও দৃষ্টিনন্দন ব্যাপার নয়। বরাহ’র কাজে শ্রম আছে, বিশ্রাম নেই। আড়ম্বর আছে, আরাম নেই। শৃঙ্খলা আছে, স্বাধীনতা নেই। অন্যদিকে লীলাবতী যেন উড়ে চলা এক স্বাধীন বিহঙ্গ। প্রাসাদের দমবন্ধ করা জলদগম্ভীরতা থেকে তার অধিক পছন্দ গ্রামবাংলার মুক্ত জলহাওয়া।

তাই বরাহ আর লীলার দ্বন্দ্ব ছিল অবশ্যম্ভাবী। পিতা আর স্ত্রীর মধ্যে এক নিদারুণ টানাপোড়েনে দাঁড়িয়ে থাকে মিহির। কিন্তু এই দ্বন্দ্ব কি শুধু শৃঙ্খলা আর স্বাধীনতার?

আমরা ভাবি, লীলা যদি পুরুষ হতো তাহলে এই দ্বন্দ্বের যবনিকা কি অন্যরকমভাবে হতে পারত?

লীলাবতী নারী। আর লীলাবতী নারী বলেই বরাহের অনেক বিষয়ে আপত্তি। যদিও লীলার সূত্র চুরি করে নিজের গ্রন্থে ব্যবহার করতে বরাহ’র কোনও আপত্তি থাকে না। কিন্তু তার সকল আপত্তি লীলাবতীর এই বেরিয়ে পড়া, ছুটে যাওয়া, উড়ে যাওয়া, আর শিকড়ের মধ্যে থাকার বিস্তারে।

লীলা জনপ্রিয়। বরাহ কি তার জন্যেও ঈর্ষাকাতর? এ ঈর্ষা বড় প্রাচীন। যুগে যুগে ঘটিয়ে এসেছে কত না বিপত্তি। পুত্রবধুর প্রতি বরাহ এই ঈর্ষা লালন করে। এই ঈর্ষা ছাপিয়ে যায় সম্পর্কের সমস্ত সীমানা। বরাহ, যে ছিল এক মহীরূহ, লীলাবতীর মতো এক কিশলয়ের কাছে ধীরে ধীরে বামুন হতে থাকে। বরাহের লম্বা ছায়া লীলাবতীর দীর্ঘ ছায়ায় ঢেকে যেতে থাকে। তাই ইতিহাস সেদিকেই যেতে থাকে যেদিকে যাওয়ার কথা তার থাকে।

নারী লীলাবতীকে, জনমানুষের প্রিয় লীলাবতীকে, বরাহ’র প্রাচীন পুরুষ সত্তা কোনওভাবেই করায়াত্তে রাখতে পারে না। পারে না বলেই বরাহ লীলাবতীর জিভ চেয়ে বসে। লীলার জিভ—যে জিভ প্রথা মানতে চায় না, যে জিভ মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেয় না, যে জিভ সত্য বলে ফেলে অনায়াসে।

ফলে খনা খুব প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে হঠাৎ করেই। এই কম্পিউটার আর তথ্যের ভিড়ে, খনা, একমাত্র খনাই প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। যখন সত্য লুপ্ত গভীর কোনও জঙ্গলে, যখন মুখোশ আর মিথ্যার বিপুলে পৃথিবী নুয়ে আসে, তখন এসবের বাইরে শিকড়ের সাথে দাঁড়িয়ে থাকে এক সত্যবাদী। লীলাবতী। খনা। দাঁড়িয়ে থাকে একা। আর তার দীর্ঘ শরীর মহীরূহ আর মেঘ ফেলে আকাশ ফুঁড়ে উঠে যায় মহাকাশের দিকে। সত্য এক নির্মোহ সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করে লীলাবতীর মাথায়। খনার ললাটে।

ফলে খনা খুব প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। যখন পহেলা বৈশাখে নারী লাঞ্ছিত হয়, যৌন হয়রানির শিকার হয় অথচ তার কোনও প্রতিকার হয় না, প্রতিকার চাইতে গিয়ে আবারও লাঞ্ছনার শিকার হয় যখন নারী, যখন ধর্ষিত হয় শিশু, যখন নারীকে বিশ্রী রকম উপমায় ভাসানো হয়, নারী যখন একমাত্র বিনোদন হয়ে ওঠে সমাজের, নারী যখন চা-খানা থেকে শুরু করে যে কোনও আড্ডার একমাত্র অশালীন বক্তব্য হয়ে ওঠে, যখন পুরুষ কেবল পুরুষ হয়েই থাকতে চায়—মানুষ হয়ে উঠতে পারে না যখন, যখন পুরো সমাজরাষ্ট্র বরাহ হয়ে যেতে চায় তখন তার বিপরীতে এক অদ্ভুত মহিমায় আর ব্যক্তিত্বে, খনা, একা, সমস্ত ঔজ্জ্বলতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দাঁড়িয়ে থাকে তার গ্রীবায় সত্যের বিচ্ছুরণ আর চোখে অশ্রু নিয়ে। এই অশ্রু কেন? এই অশ্রু কি মিহিরদের জন্য? এই অশ্রু কি ভালোবাসা? আর করুণাও?

আমরা শিহরিত হই। এত আলো আমাদের চোখ সহ্য করতে পারে না। পুরুষ হিসেবে আমাদের অস্বস্তি হয়, আমরা বুঝতে পারি না আমাদের কী করা উচিত। মৃদু দর্শক হিসেবে আমাদের অস্বস্তিও হয়। আর লীলাবতী আমাদের আছড়ে ফেলে আমাদের সৃষ্ট পুংমহলের মিথ্যামহৎ ইমারত থেকে। আমরা কুঁকড়ে যাই। পুরুষ হিসেবে আমাদের কাছে খনা এক বিরোধী সুপ্রিম শক্তি নিয়ে ঝলমল করে ওঠে। কেন্নর মতো আমরা গুটিয়ে যেতে যেতে পুরুষ থেকে ক্রমশ মানুষ হতে শুরু করি। আমরা বুঝতে পারি আমাদের ভেতরটা পাল্টে যাচ্ছে। আমরা পাল্টাতে পাল্টাতে মিলনায়তন থেকে বেরিয়ে আসতে থাকি। লীলাবতী আমাদের ভেতর তীব্র নদীর মতো বইতে থাকে, ধেয়ে যেতে থাকে, আমাদের দৃষ্টি ভাঙতে থাকে। আমরা মৃদুর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করি।

তখন খনায় ফেরত যাওয়া মানে মধ্যযুগে ফেরত যাওয়া আর মনে হয় না। মনে হয় উৎসে ফেরত গিয়েছি। মনে হয় ভষিষ্যতের দিকেই এই যাত্রা। ভবিষ্যত, যা সত্য ও সমতার হবে, এমন একটা স্বপ্ন আমরা লালন করি।

___________________________________

খনা
বটতলা নাট্যদল
রচনা: সামিনা লুৎফা নিত্রা
নির্দেশনা: মুহম্মদ আলী হায়দার
অভিনয়: সামিনা লুৎফা নিত্রা, মুহম্মদ আলী হায়দার, তৌফিক হাসান, ইমরান খান মুন্না, শারমিন ইতি, কাজী রোকসানা রুমা, খালিদ হাসান রুমী, জিয়াউল আবেদীন রাখাল, সেউতি শাহগুফতা প্রমুখ।

----------------------------------
প্রথম প্রকাশ: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
লিংক: http://www.banglanews24.com/fullnews/bn/394814.html