রবিবার, ২৭ জুলাই, ২০১৪

পাহারা

১.
অবশেষে আপনারা একটা গাড়ি কিনতে পারলেন। লালরঙা গাড়ি। বাচ্চারা তো বাচ্চা আপনার বৌ পর্যন্ত আনন্দে আত্মহারা! গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ঢাকা ছেড়ে। পুরনো, কত দিনের দেখা সেই একই ধানখেত খালবিল অন্য রকম লাগতে লাগলো।

হ্যাঁ, আপনারা একজন ড্রাইভারও রাখলেন। কয়েসুদ্দিন নাম। বয়স পঞ্চাশ হয়ে যাবে নাকি? কিন্তু শক্তপোক্ত। মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। পান খায়। ঠোঁট কালচে লাল। মাথার চুল উত্তম কুমারের মতো। সব মিলিয়ে কিছুটা উদ্ভট।

কয়েসুদ্দিন দীর্ঘদিন ধরে গাড়ি চালান। প্রায় পঁচিশ বছর। এর আগে দীর্ঘ সময় মাইক্রোবাস চালিয়েছেন। তার হাত পাকা।

একদিন জানলেন কয়েসুদ্দিন তার মাইক্রোবাসে কত কত দিন লাশও বহন করেছেন। আপনার কৌতুহল বেশি, জিজ্ঞেস করলেন, লাশ বহন করতে আপনার ভয় লাগতো না?

কয়েসুদ্দিন হাসে। উত্তর দেয় না। আপনিও নাছোড়, আবার জিজ্ঞেস করলেন একই কথা। কয়েসুদ্দিন ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে উঠে যায়। যাবার আগে বলে, নাহ স্যার ভয় লাগতো না! লাশের গাড়িতে পাহারা থাকতো!

আপনি অবাক হলেন। বললেন, পাহারা? কীসের পাহারা?

কয়েসুদ্দিন তাকিয়ে থাকে, উত্তর দেয় না।

আপনার কৌতুহল মেটে না। কয়েসুদ্দিন বলে, একদিন দেখাবো স্যার!

২.
ঈদে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন আপনারা। সপরিবারে। স্ত্রী কন্যা পুত্র। যমুনা পার হতেই মধ্যরাত কাবার হবার যোগাড়! এত জ্যাম। সিরাজগঞ্জ পার হয়ে জ্যামটা একটু কমে এসেছে। কয়েসুদ্দিন গাড়ির গতি কিছুটা বাড়িয়েছে। আপনি আপত্তি করছেন না। পুত্রকন্যারা ঘুমিয়ে গেছে, স্ত্রীর চোখও ঢুলুঢুলু। বাইরে হালকা কুয়াশাও আছে। হেডলাইটের আলো বেশি দূর যাচ্ছে না। এদিকে গাড়ির ভেতর গুমোট একটা ভাব। সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে আপনার। গাড়ি থামাতে বলবেন কিনা বুঝতে পারছেন না, এমন সময় কয়েসুদ্দিন ঘাড়টা ঘুরিয়ে তাকালো আপনার দিকে। এমন করে না সে। আপনি একটু অবাক হলেন, জিজ্ঞেস করলেন, কী কিছু বলবেন?
গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। কয়েসুদ্দিন যেন তাকিয়েই আছে আপনার দিকে। আপনি বললেন, সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালান! এ্যাকসিডেন্ট করবেন তো!

কয়েসুদ্দিন ধীরে ধীরে বলল, স্যার, দেখেন... পাহারা...

কয়েসুদ্দিন জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাতে ইশারা করে। আপনি তাকান জানালার ওপাড়ে। আর ওই অন্ধকার রাতের ভেতর দেখতে পান দুটো সাদা ঘোড়া, আপনার গাড়ির দুপাশে, গাড়ির সমান গতিতে ছুটতে ছুটতে আসছে। তুলোর মতো সাদা দুটো ঘোড়া। ছুটছে।

আপনার যেন শ্বাসরোধ হয়ে আসতে চায়। আপনি তাকান কয়েসুদ্দিনের দিকে। কয়েসুদ্দিন অল্প একটু হাসে। আধো অন্ধকারে সে-হাসি অসুস্থ মনে হয় আপনার। আপনি একটু জোর গলায় বলেন, কী এগুলো কী?

'পাহারা স্যার।' কয়েসুদ্দিন বলে। তারপর তাকায় বাইরে। ফিসফিস করে। 'ভয় লাগে না স্যার। ভয় লাগে না। গাড়িতে লাশ থাকলেই এরা পাহারা দিতে চলে আসে!'

লাশ থাকলে মানে?
চিৎকার করে ওঠেন আপনি। বলেন, এই গাড়িতে লাশ কোথায়...?

কয়েসুদ্দিন যেন একটু হাসে। আর তখনই আপনি দেখতে পান বিপরীত দিক থেকে একটা নাইটকোচ বুনো হাতির মতো আপনাদের দিকেই ধেয়ে আসছে।

তীব্র হর্ন আরো আলো ছাড়া শুধু ঘোড়ার খুড়ের শব্দ শুনতে পান আপনি। খুড়ের শব্দ যেন বলছে, পাহারা... পাহারা... পাহারা... পাহারা...

শনিবার, ২৬ জুলাই, ২০১৪

আবু নাসিম বা লখিন্দর কোনোটিই তার নাম ছিল না... (তিন)



ছবি: হীরক
.

ওই যুগেও, যখন মোবাইল হয় নি, হতে পারে এমনও ভাবা যাচ্ছিলো না, তখনও, ল্যান্ডফোন এড়িয়েই চলতো লখিন্দর।
ফোন কখনো তৃপ্ত করে নি তাকে, আরাম দেয় নি। হতে পারে কথা বলার সময় মানুষের চোখ দেখতে চাইতো লখিন্দর; বিশ্বাস করতো চোখ দিয়েই আসলে মানুষ হৃদয়ের কথাগুলো বলে। মুখে যা বলে, ভাষার খামতিতেই হয়তো, সম্পূর্ণ বলতে পারে না। লখিন্দর, মানুষ যা-বলে, তার অধিক কথা, জীবনে শুনতে চেয়েছিল-- এখন আমরা এরকম ভাবতে পারি, অবশ্য ভাবতে যদি চাই তাহলে। কিন্তু লখিন্দরের জীবনের অন্য অংশগুলো এতোটা প্রধান আর প্রকট হয়ে ওঠে যে মানুষ নিয়ে লখিন্দরের কী ভাবনা তা খুব বেশিক্ষণ গবেষণা করার সময় আমাদের হাতে থাকে না। এই মধ্যরাতে লখিন্দরও সময় পায় না। তার দুঃস্থ টেলিফোনটা, যে বেশিরভাগ দিনেই মৃত থাকে, সে ক্রমাগত বাজতেই থাকে বাজতেই থাকে ঝনঝন করে। রাতই যেন ঝনঝন করে ভেঙে যায়, এমন মনে হয় লখিন্দরের কাছে।

কিছুক্ষণ আগেই কয়েকজন ফিরে গেছে তার কাছ থেকে। সুপার হিট দুধভাতের আনন্দ হয়েছে। এক টেবিল খাবার গড়াগড়ি গেছে। প্রচুর মদ আর চিংড়ি লটপট করেছে অনেকক্ষণ। এসবই ওস্তাদ কেরামতালির দৌলত ও বদৌলত। তিনি থাকেন নি, কিন্তু তিনি তার নানা গ্রহ-উপগ্রহ রেখে গিয়েছিলেন। লখিন্দরের মধ্যরাত কাটছিল গ্রহ-উপগ্রহদের প্রশংসা শুনে শুনে। প্রশংসা লখিন্দরের আজন্ম পছন্দ; তার মনে হয়েছে এই যে এতো ফিল্ম ফিল্ম করা, এতো ভালো অভিনয়ের চেষ্টা তার একমাত্র উদ্দেশ্য মানুষের কাছ থেকে একটু প্রশংসা একটু পিঠ চাপড়ানি একটু শ্রদ্ধা-ভালোবাসা পাওয়ারই চেষ্টা মাত্র।

মানুষের কাছ থেকে আর হয়তো ওই যে সরু নদীটার পাশে থাকা একটা বিশেষ মানুষ তার কাছ থেকেও। কিন্তু ওই বিশেষ মানুষটি তার ছবিটা, তার বইটা দেখেছে কি? এমন ভাবনা হয় লখিন্দরের। সেই বিশেষের এলাকায় একটা সিনেমা হল তো ছিলো... কিন্তু মানুষটি কি ওই হলে, তার ভাই কিংবা বোনটিকে নিয়ে সিনেমাটা দেখতে গিয়েছিল? যেতে পেয়েছিল? গেলেও সে কি চিনতে পেরেছিল লখিন্দরকে? ভেবেছিল আরে এ তো সেই লোক, যে একদিন, একবেলা, একরাত, তারই উঠানে কাতরভাবে পড়ে ছিল! প্রচণ্ড জ্বরে থরোথরো কাঁপছিলো! আর তাকে সে ওই জ্বরের ভেতরেই কাঁচা মরিচ আর আলুভর্তা দিয়ে টিনের থালায় ভাত মেখে দিয়েছিলো! আর যার নাম সে কখনো জানে নি, জানার সুযোগ হয় নি। না, কেউ কারো নাম জানতে পারে নি। যে-নাম সে এখন ব্যবহার করে না। যে-নামটা সে নিজেও ভুলতে বসেছে। যে-নামটিকে দখল করে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে আরেকটি নাম! এবার কি সে লখিন্দরের নতুন নামটা জানতে পারবে? দুধভাই সিনেমাটা বাংলাদেশের কেউ দেখে নি এমন তো হয় নি! কিন্তু সেই মেয়েটি কি এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে? সে কি দেখবে না ফিল্মের আবু নাসিম উরফ লখিন্দরকে?

লখিন্দরের মনের পাড় খালি ভেঙে ভেঙে যায়। একজোড়া কাজলের মতো চোখ, গাঢ় আর ধীর, একটা অদ্ভুত শীত আর উষ্ণতা, একটা বয়ে চলার ঝোঁক লখিন্দরকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আর লখিন্দরের একটু নেশাও হয়েছিল। ফলে সে কিছুক্ষণ জীবনানন্দ আওড়াতে চেয়েছিল। চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা এরকম কয়েক লাইন বলতে চেয়েছিল... যদিও ওই লাইনগুলো তার আর ভালো লাগে না। ভালো লাগে না কেননা অনেকেই হয়তো ওই লাইনগুলো জানে, এমনকি আওড়ায়ও। ফলে লাইনগুলোকে তার বহু ব্যবহারে বিদীর্ণ মনে হতো। কিন্তু ওই গভীর অন্ধকার আর স্নিগ্ধ আলোর ক্ষণটিকে, ওই মুখোমুখি ছায়াটিকে আর কোনোভাবেই বর্ণনা করার ক্ষমতা লখিন্দরের ছিলো না; আর যাই হোক লখিন্দর তো কবি ছিলো না-- সে তাই নিজের আবেগ প্রকাশের জন্য অন্যের কবিতার আশ্রয় নিতো। যদিও কবিতা খুব বেশি পড়ে নি সে। কিন্তু জীবনানন্দ পড়েছিল কিছুটা। পড়ে পড়ে সে খুব নিঃসঙ্গ হয়ে যেতো। অথবা নিঃসঙ্গ হয়ে যেতে চাইতো। একটা মনোব্যাধির মতো হতো। খালি মরে যেতে বা দূরে কোথাও, কোনো এক অরণ্যের ভেতর চলে যেতে ইচ্ছা হতো। আর তখনই চুল তার কবেকার অন্ধকার তার ভেতর ঢুকে গিয়েছিল। সে অন্য লাইন খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে এ ক'টা লাইনের কাছেই নিজের অপরবাস্তবকে মিলিয়ে ফেলেছিল। সে আরো কিছুক্ষণ এমনভাবে ভাবতে পারতো, বা বলা ভালো ভাবতে চাচ্ছিলো সে কিন্তু ফোনটা বেজেই তো যাচ্ছিলো একটানা। ফলে লখিন্দর একটু টলে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না। তাকে ঘুরে যেতে হয়। আর তারপর ফোনটা ওঠায়। একটা দীর্ঘ শো শো আওয়াজ শোনে লখিন্দর। প্রথম শোনায় মনে হতে পারে কোনো জাত সাপের দ্বেষ। কিন্তু তেমন ভাবতে চায় না লখিন্দর। আমরা জানতে পারি এই রকম শব্দ নিয়ে অন্য এক স্মৃতি রয়েছে তার। আর সেই স্মৃতির কারণেই বোধ করি আওয়াজটা তার ভালো লাগে। এরকম আওয়াজ সে প্রথম শুনেছিল পদ্মায়। একটা অদ্ভুত ভুটভুটিতে করে তারা ফিরছিল। কোথায় গিয়েছিল এখন আর লখিন্দরের মনে নেই। কিংবা থাকলেও আমরা ভেবে নিচ্ছি নেই, কারণ কোথা থেকে লখিন্দর ফিরছে তা আমাদের কাছে কোনো গুরুত্ববহন করে না, বরং ফিরতে গিয়ে কী হয়েছিল তা জানার জন্য আমরা আগ্রহী হয়ে উঠি।

লখিন্দরের স্মৃতি ধরে আমরা দেখি একটা ছিপছিপে নৌকার পাছায় একটা ইঞ্জিন বসানো আছে। ইঞ্জিনটা অনবরত ভুটভুট ভুটভুট আওয়াজ তুলে নৌকার নামটা সার্থক করে চলেছে। পুরো নৌকাটা প্রথম প্রেমকে আঁকড়ে ধরার পর কিশোরীর হৃদয়ের মতো কেঁপে চলেছে। আর তখন এরকম শোঁ শোঁ এক আওয়াজ পায় লখিন্দর। ছইয়ের বাইরে বসে ছিল সে। আওয়াজটা শুরু হয়েই যেন মোচড়াতে থাকলো, মোচড়াতেই থাকলো। আর বিভিন্ন স্কেলে বেড়ে কমে লখিন্দরের ভেতর অদ্ভুত এক সুখ জাগাতে থাকলো।

অথচ নৌকায় তখন চাঞ্চল্য। দুমদাম ছোটাছুটি। কে একজন আল্লাহ আল্লাহ বলে মাঝিকে ডাকতে লাগলো। এসব নৌকায় মাঝির কী করার থাকে লখিন্দর জানে না, জানতেও চাইল না। সে পশ্চিম আকাশে তাকিয়ে এক চমৎকার দৃশ্য দেখলো। একজন ছুটে এসে লখিন্দরকে বলল, ভাইজি, ভীষণ ঝড় আসছে...! ভিত্রে আসেন, ভিত্রে আসেন!

ভিতরে যাওয়া হয় না লখিন্দরের। পশ্চিমাকাশ থেকে যেন এক কালো লোমশ ভালুক ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে যেন। সম্মোহিত হয়ে পড়ে লখিন্দর। অদ্ভুত শোঁ শোঁ আওয়াজ। যেন শিস বাজাচ্ছে ভালুকটা। যেন খুব আনন্দ হচ্ছে তার। লখিন্দরের চোখ আটকে থাকে। আর এই সময় ওই কালো ভালুকটা হঠাৎই, কোনো সংকেত না দিয়েই, ঝাঁপিয়ে পড়ে ভুটভুটিটার ওপর। কেউ একজন ইয়া মাবুদ বলে বোধহয় লাফ দেয়। কিন্তু কোনো শব্দ আর শোনা যায় না। শোঁ শোঁ আওয়াজের তোড়ে পৃথিবীর অন্য সবকিছু নৈঃশব্দে পতিত হয়। লখিন্দর ঠাঁই তাকিয়ে থাকে। নদীটাকে দেখে, ভালুকটাকে দেখে, ভালুকের কালো মসৃণ শরীরটাকে দেখে। ভুটভুটি উড়ে অনেক দূরে গিয়ে পড়ে। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার লখিন্দর তখনও নৌকার গলুইয়ের ওপরেই বসে থাকে। কীভাবে, সেও জানে না। সে শুধু শোঁ শোঁ আওয়াজটা শুনতে পায়। ওই আওয়াজ শুনতে শুনতেই সে তলিয়ে যায়। তলিয়ে যায় পদ্মার অতলে অথবা দুইটা কাজল চোখের ভেতর। যাকে দেখলেই তার মনে হয় চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা... আর শোঁ শোঁ আওয়াজ। একটানা। চলতেই থাকে। চলতেই থাকে।

এরকম সময়েই প্রথম গালিটা শোনে লখিন্দর। জঘন্য গালি, বলতেই হয়। তারপর আবার। এবং আবার। লখিন্দর যেন গালির তোড়ে ভেসে যায়। মনে হয় গালি যেন পদ্মার পানি। গাঢ় আর জাগ্রত। ভেসে ওঠে একবার, তারপর আবার ডুবে যায়। পানি খায় নাকি যেন গালিই খায়-- লখিন্দর বুঝতে পারে না। সে ভাসতেই থাকে ডুবতেই থাকে। আর ভাসতে ভাসতে ডুবতে ডুবতে একটা পারদিয়া নিয়তির দিকে যেতে থাকে। একটা শাখা নদী ছোট নদী রোদজ্বলা পারদের মতো সেই টিনের চালার বাড়িটা লখিন্দর যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। একটা ঝকঝকে বিন্দু। একখণ্ড চুমকির মতো চকমকে। আর ভেতরে তার উঠান... স্নিগ্ধ, একটা মঠের মতো, উঠান। সেখানে রূপালি ঘুমের মতো জেগে ওঠা, মাছের পিঠের মতো ভেসে ওঠা!

লখিন্দর গালি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেল কিনা এরকম ভ্রম আমাদের হতে পারে। আর একই ভ্রম রঞ্জনারও হয়। লখিন্দর কি ঘুমিয়ে গেল? মরেই গেল নাকি? এরকমও ভাবে রঞ্জনা। আর রঞ্জনা বারবার তার পাশে দাঁড়ানো সুপারস্টারের দিকে তাকায়। সুপারস্টারের চোখ-কান-নাক লাল। মেকআপ ছাড়া সুপারস্টারের চোখের নিচে ঢলঢলে চামড়া। কুচকে যাওয়া র্য্যাপিং পেপার যেন। জেল্লা আছে, স্নিগ্ধতা নেই। সুপারস্টার আমান খান। ভ্রু কুচকে আছে। চোখে বিরক্তি, এমনকি ক্রোধও। ফিল্ম ফ্লপ যাওয়ার পর এই ক্রোধ দখল করে আছে তাকে। বিশ্রামে-কামে-আহারে-ব্যবহারে এই ক্রোধ ঠিকরে বেরিয়ে আসে। সে রঞ্জনার দিকে আগুন চোখ বিস্তৃত করে রাখে। রঞ্জনা সেই আগুন ফোন দিয়ে পার করে দিতে চায় লখিন্দরের প্রান্তে। অথচ লখিন্দর, তার সেই বিখ্যাত নির্লিপ্ততা নিয়ে যেন অজ্ঞান হয়ে গেছে, বা সত্যি সত্যি ঘুমিয়েই গেছে। আর ঘুমালে লখিন্দরের যা হয়-- সেই বিখ্যাত স্বপ্নটা বারবার দেখতে থাকে। একসময় তার হাত থেকে রিসিভার পড়ে যায়। রিসিভারটা টেবিল থেকে বাঁকানো তারের সাথে পেঁচিয়ে ঝুলতে থাকে। যেন লখিন্দরের ঘুমের ভেতর তার সেই বিখ্যাত স্বপ্নটা দুলতে থাকে, দুলতেই থাকে। আর এরমধ্যেই লখিন্দরের ঝোঁক কেটে উঠতে চায়, কিন্তু পারে না। ঘাড়টা একটু বাঁকিয়ে চেয়ারেই ঢলে পড়ে। এটা কোনো সিনেমার দৃশ্য হলে হলভর্তি মানুষ আঁতকে উঠতে পারতো-- ভাবতো লখিন্দর বুঝি এইবার পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলো। কিন্তু জীবন সিনেমা নয় হে গুণীজন! জীবনে জীবন এতটা সহজে মৃত্যুর দিকে যেতে পারে না। ফলে আমরা অপেক্ষা করতে থাকি লখিন্দরের জেগে ওঠার।

লখিন্দরের অদ্ভুত নির্লিপ্ততায় একটা দারুণ সাপের মতো, বলা উচিত কাল নাগিনীর মতো গজরাতে থাকে রঞ্জনা। এতটুকুই সে পারে শুধু। সে এবং সুপারস্টার আমান খান। মধ্যরাতও তাদের কাছে দীর্ঘ মনে হয়, শেষ হতে চায় না। যেন কেবল রাতের শুরু। এরপর ক্রমাগত একের পর এক, বলা যায় অনন্ত রাত তাদের সামনে এসে দাঁড়াবে, আর অন্য প্রান্তে ওই ঝোঁকে বুদ হয়ে থাকা লখিন্দর পুবের সূর্য হয়ে দেখা দেবে। হিট মানে তো সূর্যই, হিট মানেই আলো। ফ্লপ কেবল অন্ধকার, কেবলই ঘন তমসা। আমান খান আর রঞ্জনা মুখ থুবড়ে পড়া নিজেদের ফিল্মটার লাশ সারা রাত বহন করতে থাকে। বহন করতে তাদের খুব কষ্ট হয়। কষ্ট হয় কারণ ফিল্মকে তারাও ভালোবেসেছিল, লখিন্দর যেমন বাসে তারচেয়ে একবিন্দু কম তো বাসে নাই প্রভু! তবু, প্রিয় প্রাণই লাশ হয়ে যায়। আর সেই লাশ নিয়েই দাফন করে আসতে হয়। মানুষের নিয়তিই এমন। আমরা জানি আমান খান বা রঞ্জনা এমনকি লখিন্দরও এই নিয়তির বাইরে নয়।

মুখে যেমন তেমনি মনে মনেও ওই রঞ্জনা-- যার শরীর এখন লখিন্দরের ছাদে পানির ট্যাঙ্কের ভেতর বস্তাবন্দী, তার ইহজগতের সমস্ত খারাপ গালির ফেনা তুলতে তুলতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। মনের ক্লান্তি মুখে এসে এবং মুখের ক্লান্তি মনে গিয়ে রঞ্জনাকে একেবারে শ্রান্ত করে তোলে। লখিন্দরের গলার আওয়াজ সে কোনোভাবেই পায় না, না পেয়ে শেষ শক্তি দিয়ে, তার যে-অতীত জীবন, সে-জীবনের যত গাল, বিশেষত তার সৎ বাপ তাকে এবং তার মাকে সবচেয়ে মর্মান্তিক যে-গালিগুলো দিতো সেগুলো সে আওড়াতে থাকে। আর এই আওড়ানোটা ধীরে ধীরে প্রলম্বিত সুরের মতো হতে থাকে। শুনে মনে হতে পারে একটা লম্বা বিলাপ কেউ খুব করুণভাবে গেয়ে যাচ্ছে। তখন গালিগুলো শুনতে বেশ লাগে, মনে হয় গীত। আর অনেক অনেকদিন পরে, লখিন্দরের গ্রীবা ছুঁয়ে রঞ্জনা যখন প্রেম করছে ফিল্মে এমনকি বাস্তবেও তখন এ-দিনটির কথা মনে করে রঞ্জনার খুব হাসি পেয়ে যাবে। শরীর দুলিয়ে ভ্রু নাচিয়ে চোখ কাঁপিয়ে খিলখিল করে হেসেও উঠবে সে, আর লখিন্দরকে গল্প শোনাবে, গালাগালির কথা বলবে, বিলাপের কথা বলবে, বলবে প্রলম্বিত গীতের কথা-- আর লখিন্দরের ভ্রু কুচকে আসবে। বলবে, এভাবে হাসছো কেনো?
তাতে রঞ্জনা আরো হেসে উঠবে। লখিন্দর আর কোনো প্রশ্ন করবে না। তার ধাতে তা নেই। কিন্তু রঞ্জনা চাইবে লখিন্দর প্রশ্ন করুক, সে-রাতে কী ঘটেছিল অনুপঙ্খ মনে থাকবে তার-- একেবারে ছবির মতো। ফলে সে বলার জন্য ছটফট করবে। বলবে, সে রাতে না...
রঞ্জনা নিজের কথা শেষ করতে পারবে না। আবার হেসে উঠবে। রঞ্জনা বলবে, কী মনে নেই তোমার? সে রাতে না তোমাকে আকাশ থেকে পাতালে নামিয়েছিলাম গালি দিয়ে... মনে নাই?

না, লখিন্দরের কিছুই মনে আসবে না। রঞ্জনার উত্তাপ আর প্রেমের ভেতর শুধু ইলিশ মাছের শরীরের মতো একটা টিনের চালার বাড়ির কথা তার মনে আসতে থাকবে। আর লখিন্দর তখন ভাববে, বা আসলে লখিন্দরের বরাতে আমরাই ভাববো যে মানুষের ভাবনার আর স্মৃতির কোনো ঠিকঠাকানা বা সুরতহাল পাওয়া সম্ভব না। মানুষের ভাবনা ঘুমেও জেগে থাকে আবার জেগেও ঘুমিয়ে থাকে।
বারবার মনে করিয়েও লখিন্দর যখন বিস্মরণের ভেতরেই থেকে যাবে, রঞ্জনা তখন লখিন্দরের চিবুকের কাছে ঠোঁট নিয়ে আসবে আর তার খুচরো কিছু চুল লখিন্দরের নাকের কাছে সুড়সুড়ি জাগাবে-- অথচ লখিন্দর তখনও জাগবে না। এখন যেমন তখনও ঠিক তেমনভাবেই সে এক ঘুমের অথবা ঘোরের অথবা ঝোঁকের ভেতরেই থেকে যাবে। আমরা ধারণা করি এই ঝোঁক লখিন্দরের এক প্রণিত ব্যাপার; যা সে শেষ পর্যন্ত অটুট রাখতে পারে কিনা তা একটা জিজ্ঞাসা হয়ে আমাদের ভেতর থেকে যাবে!

দিন যেন পাল্টে যায় লখিন্দরের। সকালে একটা তো বিকেলে আরেকটা পরিচালক-প্রযোজক ঘুর ঘুর করে তার সামনে-পেছনে আশে-পাশে। ছবি ছবি আর ছবি। সাইনিং মানি। নানান ধরনের অফার। ফ্ল্যাট-গাড়ি-বাংলো এমনকি নারী। ঐশ্বর্য যেন পাগলা ষাঁড়ের মতো তাড়া করে আসতে থাকে লখিন্দরের দিকে। আর আমরা খেয়াল করি লখিন্দর যেন বিদগ্ধ ম্যাটাডোর। বুদ্ধি আর প্রজ্ঞার লাল নিশানে তেড়ে আসা ঐশ্বর্যের ষাঁড়কে খেলিয়ে চলে লখিন্দর। একটা সুন্দর বাড়ি একটা ঝকঝকে লাল গাড়ি হয় তার। আর মাত্র দু'টি ফিল্ম সাইন করে সে। দুটি। কারণ ওই দুটিকে তার সম্ভাবনাময় মনে হয়। একটি গ্রামের পটভূমি। বাল্যপ্রেম ও প্রতিশোধের ছবি। ছবির নাম 'বাঁশি'। ছবিতে লখিন্দর রাখাল বিশেষ। মাঠে মাঠে গরু চড়ায়। আর তার চিকন বাঁশের বাঁশিটি বাজায়। সেই বাঁশি শুনে পাগল হয়ে যায় বানু। ছুটে ছুটে আসে বটতলায়। বাতাসে বসন্ত তখন। নাচ গান আর আদর সোহাগের ভেতর দিয়ে প্রেম চলতে থাকে ভরপুর। আর বিরতির আগেই মরে যায় হিরোইন বানু। আর তখন বিরতির পর পুরোটা জুড়ে বানুর হত্যাকারীদের খুঁজে খুঁজে শাস্তি দিতে থাকে গ্রামের সরল রাখাল। যে-বাঁশিতে একদিন সুর ঝরতো সে-বাঁশিতে এখন শুধু রক্ত ঝরে।

লখিন্দর যে একেবারে সন্দেহাতীতভাবে ছবিটি সাইন করে তা কিন্তু নয়। তার মনে বিরতির পর ওই লম্বা সময়টা নিয়ে ভাবনা। অতটা সময় হিরোইনহীন ছবিটার একটা মোটা মাইনাস পয়েন্ট। ফলে প্রযোজকের সাথে এ নিয়ে তার আলোচনা হয়। তর্ক-বিতর্কও হয় এবং শেষ সময়ে ডাক পড়ে রাইটারের। ছবিতে বিরতির পর এমন করা হয় যে একটা একটা প্রতিশোধ নেয়া হয় হিরোর আর সে হিরোইনের সাথে ড্রিম সিকোয়েন্স হয়। কখনো রোমান্স, কখনো অভিমান, কখনো গান। মানে হিরোইন মরেও পর্দাজুড়ে থাকে। আর এভাবে গল্পের প্রয়োজন আর দর্শকের প্রয়োজন উভয়ই মিটে যায়। আর কার্যত 'বাঁশি' ছবিটা রিলিজের আগেই হিট হয়ে যায়। ছবিটার এগারটা গানের মধ্যে সাতটা গানই মানুষের মুখে মুখে ফেরি হতে থাকে। ফলে ছবিটা যখন রিলিজ হয়, হলে ছুটে যাওয়া ছাড়া মানুষের আর অন্য কোনো উপায় থাকে না।

আমান খানের মতো একটা লাল গাড়ির শখ ছিলো লখিন্দরের। গাড়ির শখটা মিটলো তার পরের ছবি 'তোমার বাড়ি আমার বাড়ি' সাইন করে। লাল গাড়ি, মাথায় ওয়েস্টার্ন হ্যাট এবং হ্যাঁ একজন সেক্রেটারি- যে তার ভালো মন্দ দেখভাল করবে। লখিন্দরের পায়ে সফলতা এসে আছড়ে আছড়ে পড়তে থাকে। 'তোমার বাড়ি আমার বাড়ি' সামাজিক সিনেমা। হিট। আর এই হিটের সাথে সাথে রাষ্ট্র তাকে সেরা অভিনেতা হিসেবে সে বছর পুরস্কৃতও করে। 'তোমার বাড়ি আমার বাড়ি' ছবিটা নিয়ে একটু ভেবেছিল লখিন্দর। এই ছবি তাকে একটা ঝা চকচকে লাল গাড়ি আর একটা পুরস্কার এনে দেয়ায় ভাবনাটা এসেছিল তার। ওই দুটো জিনিসের মধ্যে আসলে কোনটা বেশি তাকে আনন্দ দিচ্ছিলো তা ঠিক ঠাওর করতে পারছিল না। তার ইচ্ছা হয়েছিল পুরস্কারটা সাথে নিয়ে সেই ঝা চকচকে লাল গাড়িতে চেপে সে ছুটে যাবে পারদ টিনের মঠ-উঠানের বাড়িটায়। কিন্তু চাইলেই যদি সব কাজ করতে পারতো তাহলে আজ এই আধা অন্ধকারের ভেতর আধশোয়া হয়ে নিজেকে নিজের ছায়ার ভেতর খুঁজতো না লখিন্দর। অথচ তার পানির ট্যাঙ্কের ভেতর বস্তাবন্দী রঞ্জনা এমনকি লখিন্দরের সমস্ত স্মৃতিকে এক গুমোট সিন্দুকের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে।

আর একটু ঘাঁটলেই, আতিপাতি খুঁজলেই আমরা দেখতে পাই পর পর তিনটা সুপার হিট ফিল্ম দেয়ার পর, অন্যদিকে আমান খানের পর পর তিনটা সুপার ফ্লপের পর লখিন্দর আর আমান খানের সামনাসামনি দেখা হয় বাবুভাইয়ের নৈশ-পার্টিতে। কিন্তু সে-বিষয়টা আর আমাদের কাছে তেমন গুরুত্ব পায় না। আমরা ওই ফাঁকে বরং রঞ্জনার দিকে তাকায়। রঞ্জনা একটা লার্জ ভোদকা নিয়ে একটা কোনায় দাঁড়িয়ে দুজনের ওপরেই যেন চোখ রাখছিল।

আর ওদিকে আমান খান আর লখিন্দর মুখোমুখি হয়ে অল্প একটু হাসি বিনিময় হয়। জুনিয়র হিসেবে লখিন্দরই এগিয়ে যায় আমান খানের দিকে। তখনও সুপারস্টারের গরিমা আমান খানের চোখে-মুখে-ত্বকে-পোশাকে। আমান খানের মতো সুপারস্টারের তিন তিনটা ফ্লপেও কিছু যায় আসে না। তার কদর তখনও লখিন্দরের চেয়ে বেশি-- তখনো ভক্তকূলের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ আমান খান।
লখিন্দর প্রশ্ন করে, মানে করতে হয় বলেই করে, আর ক'রেই বুঝতে পারে ভুল করে ফেলেছে, কিন্তু প্রশ্ন ততক্ষণে তীরের মতো বিদ্ধ করেছরে আমান খানকে, অথচ লখিন্দরের প্রশ্নটা ছিল সারল্যের, একেবারে কথার কথা। সে জিগ্যেস করেছিল, কেমন আছেন আমান ভাই?
আর তাতেই পুরো হলঘরটা যেন থমকে গিয়েছিল। আর ওই প্রশ্নের পরই আমান খান প্রথম ভেবেছিল রঞ্জনা আর লখিন্দরকে নিয়ে। একটা অদ্ভুত ষড়যন্ত্রের কথাও সে ভেবেছিল। অথচ মুখে ছোট্ট করে বলেছিল, হ্যাঁ ভালো আছি।

আমরা জেনেছি কথা শোনার সময় লখিন্দর বক্তার চোখ দেখতে ভালোবাসে। সে বিশ্বাস করে মানুষের মনের অব্যক্ত কথা চোখে এসে ঠাঁই নেয়। কিন্তু আমান খানের চোখে যে সব সময়ের সানগ্লাশ! লখিন্দর তাই মুখের জবাবটুকুই শুনেছিল, আমান খানের মনের অতলের ষড়যন্ত্রের খবর সে পায় নি। যদি পেতো, নিশ্চিত করে বলতে পারি, লখিন্দরের নিয়তি অন্যদিকে মোড় নিতো!