মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৩

একটি অবৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি














সময়ের আগে, ভোরবেলা, ঘুম ভাঙলো প্রধানমন্ত্রীর।

এখনো আলো ফোটে নি। টেবিল ঘড়িতে সময়টা দেখে বিরক্ত হলেন তিনি। এ সময়ে তাঁর ঘুম ভাঙার কথা না। সারাদিন এতো কাজ থাকে, এতদিকে ছুটতে হয়, এত সব সামলাতে হয় যে একটু জিরোবারও সময় পান না; এরমধ্যে যদি ঘুমটাও ঠিকভাবে না হয় তাহলে আর টিকবেন কীভাবে?
নাকটা কুচকালেন তিনি। কোথায় যেন একটা গন্ধ। কিসের গন্ধ?
গতরাতে শোয়ার পর গন্ধটা একটু পেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু আমলে নেন নি। ইদানিং কোনো কিছুই তাঁর আর আমলে নিতে ইচ্ছা করে না।
কিন্তু এই ভোরে গন্ধটা একবারে চেপে বসেছে যেন। ঘর ভারী করে ফেলেছে দুর্ঘন্ধটা। তিনি ঝটপট উঠলেন বিছানা থেকে। খাটের নিচটা দেখার চেষ্টা করলেন। কোনো চিকা মরে আছে নাকি? কেউ চিকা মেরে গেছে কিনা, কে জানে!

না, কোনো চিকা টিকা নাই। তাহলে? গন্ধটা অসহ্য লাগছে তাঁর। মনে হচ্ছে সহ্য করতে পারবেন না। নাকে শাড়ির আঁচল চেপে তিনি বাইরে বেরিয়ে আসেন। বাইরের বাতাসে কিছুটা সুস্থবোধ করেন। মনে হয় প্রাণটা ভরে গেল। বাতাসটা দারুণ হালকা হয়ে আছে।
কিন্তু পরক্ষণেই বদগন্ধটা আবার পেলেন তিনি। তীব্র। মনে হলো ধাক্কা দিলো তাঁকে। তিনি সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন নিচে। বাইরেটা অনেকখানি খোলা। বেশ বড় মাঠের মতো। প্রহরীরা তাঁকে দেখে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। সালাম দিলো। প্রধানমন্ত্রী সালাম নিলেন। বললেন, আপনারা কোনো গন্ধ পাচ্ছেন?

এক প্রহরী লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লেখে। সে নিজেকে জাহির করার সুযোগ হাতছাড়া করলো না। বলল, শীত এসে গেছে মহামান্য। বাতাসে শীতের গন্ধ।
-শীতের গন্ধ?
-হ্বী। শীতের গন্ধ মহামান্য। শুকনা শুকনা। মনে হয় পারস্যের গোলাপের মমি!
-আপনি সত্যি প্রহরী, না অনুচর?

কবি-প্রহরী চুপ করে থাকলো। সে ভাবলো প্রতিভা জাহির করতে গিয়ে আজ বোধহয় চাকরিসহ প্রাণটা খোয়াতে হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী দয়ালু। বা তিনি আজ অন্যকিছুতে ব্যস্ত। হতে পারে গন্ধ নিয়ে তিনি চিন্তামগ্ন। তিনি পায়ে পায়ে প্রধান ফটকের দিকে এগিয়ে গেলেন। প্রহরীরা তাঁর পিছু নিলো। প্রধানমন্ত্রী পেছন ফিরে প্রহরীদের আসতে নিষেধ করলেন। কিন্তু প্রধানপ্রহরি বলল, মহামান্য, আপনার সাথেই আমাদের থাকতে হবে!

প্রধানমন্ত্রী সাধারণত বিরক্ত হোন না। প্রহরীদের সাথে তো হনই না। কিন্তু আজ হলেন। হতে পারে গন্ধটা তাঁকে ঠিকমতো চিন্তা করতে দিচ্ছে না। তিনি কড়াকণ্ঠে বললেন, কে এখানে প্রধানমন্ত্রী? আপনারা, নাকি আমি?

প্রহরী-প্রধান চুপ করে থাকল। প্রধানমন্ত্রী বললেন, একটা গন্ধ আমাকে ঘিরে রেখেছে, আপনারা বুঝতে পারছেন না। হতে পারে শীতে আপনাদের নাক বন্ধ। আমাকে একটু হাঁটতে হবে, আমাকে বাইরে যেতে হবে...

প্রহরী-প্রধান বলল, জ্বি জ্বি অবশ্যই যাবেন মহামান্য। তবে আমরা যদি আপনার পিছে পিছে থাকি তাহলে তো প্রব্লেম হবে না। না থাকলেই বরং প্রব্লেম!

প্রধানমন্ত্রী ছোট্ট একটু শ্বাস ফেলে বললেন, আসুন। পেছনে পেছনে আসুন...

প্রধানমন্ত্রী বেরিয়ে এলেন রাস্তায়। রাস্তা ফাঁকা। সকালবেলার রাজধানী এখনো জাগে নি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জানতেন এ নগরী নাকি কখনো ঘুমায় না! ফাঁকা রাজধানী দেখে তাঁর ভালো লাগল না। তিনি আশে-পাশে তাকালেন। নাহ, কেউ নেই। কিন্তু গন্ধটা আছে, বাজে একটা গন্ধ। আততায়ীর মতো গন্ধ।
প্রধানমন্ত্রী জোরে হাঁটা শুরু করলেন। তিনি হয়তো চাইলেন জোরের সাথে হেঁটে গন্ধটাকে অতিক্রম করবেন।

প্রধান সড়ক ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী একটা গলিরাস্তায় ঢুকলেন। রাস্তায় শুকনো পাতা পড়ে রয়েছে। শুকনো পাতা তাঁর পছন্দ না, তিনি পছন্দ করেন কচি সবুজ পাতা। সবুজ সবুজ পাতা দেখার জন্য তিনি ওপরে তাকালেন। কিন্তু হায়, শীতে সব পাতা ঝরে গেছে। গাছ পত্রপুষ্পহীন। কিছু কিছু গাছ পুড়ে কয়লা হয়ে আছে। গাছদের এমন দুঃস্থাবস্থা দেখে প্রধানমন্ত্রীর খুব খারাপ লাগল। কষ্ট হতে লাগল। গন্ধটা যেন আরো জেঁকে বসলো তাঁর বুকে। তিনি কয়েকবার বড় বড় প্রশ্বাস ফেলে গন্ধটাকে তাড়িয়ে দিতে চাইলেন, কিন্ত পারলেন না।

গলিরাস্তাটা পেরিয়েই দেখলেন একটা পোড়া বস্তি। একদিন গাড়ি করে এ বস্তির পাশ দিয়ে তিনি গিয়েছিলেন। তিনটা পরিবার এখানে বাস করতো। তাঁর গাড়ি দেখে পরিবারগুলো থেকে লোকজন বেরিয়ে এসেছিল। পরিবারগুলোর অনেকগুলো শিশুপুত্রকন্যা ছিল। তাঁর গাড়ি দেখে ছেলেমেয়েগুলো হাত তুলে, পতাকাকে যেমন সালাম করে, অবিকল একইরকমভাবে তাঁকে সালাম করেছিল। তাঁর খুব ভালো লেগেছিল। বুক ভরে এসেছিল। কোনো কারণ ছাড়াই চোখের কোণাটা ভিজে উঠেছিল। তিনিও হাত তুলে ছেলেমেয়েগুলোর সালাম গ্রহণ করেছিলেন।
আজ ওই বস্তির ঘরগুলো নেই। তার বদলে রাস্তায়, দেয়ালে পোড়া পোড়া বিচিত্র দাগ। প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টই একটা হাহাকার অনুভব করলেন। তিনি আরো জোরে হাঁটতে শুরু করলেন। পেছনের প্রহরীরা তাঁর সাথে তাল সামলাতে পারছিল না।

প্রধানমন্ত্রী গলিরাস্তা ছেড়ে একটা পুরনো ও বিখ্যাত বাজারের সামনে দাঁড়ালেন। বাজার খালি। কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। বুকের ভেতরের হাহাকারটা আবার ফিরে এলো তাঁর। আর গন্ধটা তো ছিলোই। এখন মনে হচ্ছে গন্ধটা তাঁকে কবর দিয়ে ফেলবে। খুবই কুৎসিত একটা গন্ধ। পচা, জঘন্য একটা গন্ধ।

এমন সময় বিস্ময়টা দেখলেন প্রধানমন্ত্রী। দেখলেন অপরদিকের রাস্তা ধরে একা একা হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে আসছেন প্রধান বিরোধী নেতা। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু যেন একটা খুঁজছেন তিনি। কেমন যেন ছটফট করছেন।

প্রধানমন্ত্রী এগিয়ে গেলেন প্রধানবিরোধীর কাছে। প্রধানবিরোধী বললেন, আপা, গন্ধটা পাচ্ছেন?
প্রধানমন্ত্রী বললেন, আপনিও গন্ধ পাচ্ছেন?
-হ্যাঁ খুবই তীব্র আর বাজে গন্ধ!
-একদম জঘন্য গন্ধ। মনে হচ্ছে মরে যাবো।
-হ্যাঁ মনে হচ্ছে মরে যাবো! কীসের গন্ধ?

প্রধানমন্ত্রী চারদিকে তাকালেন একবার। খা খা রাজধানী। তিনি ছোট্ট করে শ্বাস নিয়ে বললেন, প্রথমে আমিও বুঝি নি। কিন্তু হেঁটে হেঁটে দেখতে দেখতে বুঝলাম গন্ধটা এই দেশের... দেশটা পঁচে যাচ্ছে, গলে যাচ্ছে!
প্রধান বিরোধী বললেন, ঠিক গন্ধটা দেশের। পচন শুরু হওয়া দেশের। বাংলাদেশের।
প্রধানমন্ত্রী বললেন, এখন আমরাই পারি দেশটার পচন রোধ করতে।
প্রধানবিরোধী বললেন, হ্যাঁ আমরাই আবার শাপলা গোলাপ ফোটাতে পারি।

প্রধানমন্ত্রী বললেন, হ্যাঁ আমরা চাইলেই নতুন পাতা গজাবে গাছে গাছে। দিকে দিকে আবার কোকিল ডাকবে।

প্রধানমন্ত্রী আর প্রধানবিরোধী দু'জন দু'জনের দিকে তাকালেন, মনে হয় অনেক দিন পর তাকালেন। তারপর তারা হাত ধরলেন, বোধহয় অনেক দিন পর হাত ধরলেন। প্রথমে তাদের সংকোচ হচ্ছিল, কেমন জানি লাগছিল। কিন্তু হাতটা ধরার সাথে সাথে কোথা থেকে একটা সুগন্ধ ভেসে এলো। তাঁরা আবার পরস্পরের দিকে তাকালেন। একটু হাসলেন। আর মনে হলো রাজধানী হেসে উঠল, দেশটা হেসে উঠল।

তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে একটা সুগন্ধ এবার জড়িয়ে থাকল জ্যোতির্ময় হয়ে। হতে পারে সুগন্ধটা কোনো গোলাপের, বা কাঠালিচাপার, বা বাংলাদেশের।


(বি:দ্র: এটি একটি অবৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি মাত্র। ভবিষ্যতের কোনো রাষ্ট্র, কোনো রাজধানী, কোনো প্রধানমন্ত্রী ও প্রধানবিরোধী নিয়ে এ গল্প রচিত।)


সাক্ষাৎকার

আমি চাই কেউ একজন আমার সাক্ষাৎকার নিক ।
আমার সামনে মাথাটা ঝাঁকিয়ে, গ্রীবাটা বাঁকিয়ে জিগ্যেস করুক নাম!
জানতে চাক আমার বুকের মধ্যে সুতাসাপ হয়ে যে নদী ঘুরপাক খায় বারবার
পুনর্ভবা নামের সাথের যে-সখ্যতা তার
বুৎপত্তি কোথায়?

আমি চাই আমার ধূসরে ডুব দিয়ে কেউ একজন বলুক নির্জন ।
বলুক এই বেঁচে থাকা বিসুখের ঝিনুকের ।
আমি চাই কেউ একজন ফিসফিস করে জাগিয়ে তুলুক অগ্নিলাভা। বলুক,
তুমি তো বাস্তব নও ।
আমি চাই আমার না-থাকা আবিষ্কৃত হোক ।
আমার না-দেখা দৃশ্যতে বদলে যাক ।
আমার ইনসমনিয়াকে কেউ বলুক ঘুম ।

আলজাজিরা বিবিসি না,
আমি চাই আমার সাক্ষাৎকার নিক আমার খুব প্রিয় পরিচিত কেউ ।


২৮।১২।২০১৩

শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৩

‘পথের পাঁচালী’ আবার দেখার পর


এটা প্রথমেই স্বীকার করে নিতে হয় যে আমি চলচ্চিত্র বোদ্ধা নই। আমার কাছে ‘টাইটানিক’ যেমন ভালো লাগে তেমনি ‘মনপুরা’ও ভালো লাগে; চলচ্চিত্রে আমি খুবই অসমঝদার দর্শক; ফলে হিন্দি মারমার কাটকাট ছবিও আমি আগ্রহ নিয়ে দেখি। পৃথিবীর তাবৎ অসাধারণ চলচ্চিত্রের আমি প্রায় কিছুই দেখি নি। ফলে এটা বলতেই হয় যে দর্শক হিশেবে আমার কোনো জাত-পাত নেই।

তাহলে এই জাতহীন দর্শক হঠাৎ ‘পথের পাঁচালী’ নিয়ে পড়ল কেনো?

কারণটা অস্বস্তি। ক’দিন আগে, হঠাৎ করেই, আবারও পথের পাঁচালী দেখলাম; এবং দেখার পর থেকে এক ধরনের অস্বস্তি ও তাড়না অনুভব করছি। ওই অস্বস্তি ও তাড়না যদি দূর হয়- এমন আশাতেই লিখতে বসা।

‘পথের পাঁচালী’ আগেও দেখেছি, এবং ভালো লেগেছে। সেই ভালো লাগাটা, কবুল করছি, কিছুটা কপটই। বিভ‚তিভ‚ষণের উপন্যাস, সত্যজিৎ-এর চিত্রনাট্য ও পরিচালনা, ভালো লাগে নি বা কম ভালো লেগেছে- তা বলি কীভাবে? তাছাড়া বিশ্বজোড়া খ্যাত ও পুরষ্কৃত এই ছবি; যদি বলি ভালো লাগে নি, আমার বোদ্ধা বন্ধুরা কি বলবে না যে আসলে আমি চলচ্চিত্রের মাথাটাও বুঝি না? তাই সিনেমাটা যতোটা ভালো লেগেছিল দেখে, তারচেয়েও বেশি ভালো লাগার কথা বলেছিলাম, বলতে হয়েছিল।

আগেই বলেছি, আমি চলচ্চিত্র বোদ্ধা নই এবং এ লেখাটিও ‘রিভিউ’ বলতে বাজারে যা বোঝায় তা নয়। বলা যায়, এটা নিতান্তই ব্যক্তিগত অনুভূতি, অস্বস্তি ও তাড়না, থেকে লেখা। কেননা কিছু দৃশ্য আমার মাথার ভেতর এখনও ঘুরপাক খাচ্ছে, ছটফট করছে।

প্রথম যে দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছি তা কিন্তু মোটেও অপু ও দূর্গার রেল দেখার দৃশ্য নয়। ওই দৃশ্যটা বিখ্যাত বটে, আমার ভেতর আলোড়নও তৈরি করেছে, কিন্তু তারচেয়েও বেশি যে দৃশ্যটা মাথায় আঠার মতো লেপ্টে আছে তা হলো ঘুম থেকে উঠে অপুর পুকুরপাড়ে যাওয়া। পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে নিশ্চিত মনে কয়লা দিয়ে দাঁতমাজার মতো খুব সাধারণ একটা দৃশ্য আমাকে বেশ ওলোট-পালোট করে দেয়। দৃশ্যটা এতোই সাধারণ যে, চলচ্চিত্রে ব্যবহারের পর দৃশ্যটা লহমায় অসাধারণ হয়ে যায়। ব্যক্তিগতভাবে আমি দৃশ্যটার সাথে নিজেকে ‘রিলেট’ করতে পারি। আশঙ্কা করি, বর্তমান প্রজন্ম এই ‘রিলেট’টা করতে পারবে না। ফলে তাদের কাছে এই দৃশ্যটার কোনো অর্থ থাকবে না, বা অন্য অর্থ বের করবে। কিন্তু আমার কাছে দৃশ্য স্রেফ শৈশবে ফিরে যাওয়ার ‘টাইম মেশিন’। দেখতে পাই ঘুম থেকে উঠে দাঁতের মাজন নিয়ে চলে গেছি পুনর্ভবা নদীর তীরে। ধোঁয়া ওঠা খুব শান্ত ও নিস্তরঙ্গ সকালে মুখের মধ্যে আঙুল গুঁজে পানির দিকে অর্থহীন তাকিয়ে, বা পানিপোকা দেখে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেয়ার মতো দৃশ্যগুলো এখন পরাবাস্তব মনে হয়। ওই দৃশ্যে ফিরে যাবার জন্য নিজের ভেতর আকুতি তৈরি হয়।

আরেকটা দৃশ্যের কথা মাথার ভেতর বিদ্যুতের মতো ঝলকে ঝলকে যাচ্ছে- সেটা হলো নিশ্চিন্তপুর গ্রামে ময়রার মিষ্টি ফেরি করতে আসা। ময়রাকে দেখেই অপু ও দূর্গার ছুটে গিয়ে দাঁড়ায়। দূর্গা বাবার কাছ থেকে অপুকে দুটো পয়সা নিয়ে আসতে প্রলুব্ধ করে। অপু বাবার কাছে গিয়ে পয়সা না পেয়ে ফিরে এলে অপেক্ষমাণ ময়রা আবার চলতে শুরু করে- আর তার পিছু নেয় অপু, দূর্গা ও একটা কুকুর। দৃশ্যটিতে একটা কুকুরের নিপুন সংযোজনে পুরো দৃশ্যটি একেবারে নগ্ন হয়ে আমাদের চোখের সামনে চলে আসে। মনে পড়ে যায় আমার শৈশবের ফেরিওয়ালাগুলোকে... বরফঅলা, চাটনিঅলা, কটকটিঅলার পিছু পিছু পয়সাহীন ঠিক কুকুরের মতোই কতো যে ঘুরেছি তার ইয়ত্তা নেই। বাংলাদেশের দরিদ্র শৈশবগুলো তো এরকমই ছিল, ঠিক এরকমই ছিল।
এই দৃশ্যটি সত্যজিৎ দেখিয়েছেন পুকুরের পানির ওপর অপু-দূর্গাদের প্রতিবিম্বের মাধ্যমে- আগে আগে ময়রা যাচ্ছে, পেছনে পেছনে অপু, দূর্গা এবং কুকুর। পানির প্রতিবিম্বে দৃশ্যটি দেখানোর নিশ্চয় কোনো অনন্য ব্যাপার রয়েছে, বা নেই- আমি বোদ্ধা নই বলে এগুলো বুঝি না, কিন্তু পানির কম্পিত প্রতিবিম্বে দৃশ্যটি দেখার ফলে ভেতরে ভেতরে কেমন একটা বেদনা তৈরি হয়। অমন একটা দৃশ্যের অংশ আমি নিজে ছিলাম বলেই হয়তো বেদনাটা পাক খেতে থাকে, খেতেই থাকে।
এরপর দৃশ্যটা আমাদের পেীঁছে দেয় বড় বাড়িতে। যেখানে সবাই হুল্লোড় করে মিষ্টি কেনে- মৃদু আহ্বানেই দূর্গার বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে আর বাহির-দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে অপু। তার হয়তো ভেতরে যেতে ইচ্ছা করে- দূর্গা যেমন গেছে; কারণ ভেতরে গেলে দূর্গার কপালে যেমন একটা মিষ্টি জুটে যায়, তেমনি অপুর কপালেও জোটার সম্ভাবনা থাকে; কিন্তু অপু যায় না। অপু দরজার বাইরে থেকে দূর্গাদের দেখতে থাকে। অপুকে দেখে মনেহয় যেন আমি নিজেই দাঁড়িয়ে আছি ধনী কোনো আত্মীয়ের বাড়ির বাইরে। ভেতরে যেতে ইচ্ছা করছে, প্রবলভাবে করছে, কিন্তু কী এক অভিমান কী এক বাধা আমাকে কিছুতেই যেতে দিচ্ছে না- না, কিছুতেই দিচ্ছে না। ফলে আজন্ম দরজার বাইরে, অপুর মতোই, দাঁড়িয়ে রইলাম- এখনো যেমন আছি। ওই দৃশ্যে অপু হঠাৎ স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে। অপুর জন্য আমার মায়া হয়, নিজের জন্যেও হয়।

আচ্ছা আরেকটা দৃশ্য আছে না- ওই যে বৃষ্টি শুরু হচ্ছে। তার আগে বেশ কিছু রুদ্ধ সময় গেছে। বৃষ্টিটা আসে ‘রিলিফ’ হয়ে। বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা পড়ে পুকুরপাড়ে অবস্থিত এক লোকের টাকে। এই দৃশ্যটা আমার ভালো লাগে নি; চলচ্চিত্রটির যা আমেজ, এতোক্ষণ পাশ পাশ ধরে যে ছবিগুলো চলচ্চিত্রটা তৈরি করেছে, তার সঙ্গে এই টাকে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার দৃশ্যটি ‘বহিরাগত’ মনে হয়। এতে আমার ভেতর কোনো হাস্যরসও তৈরি করে না- সম্ভবত প্রস্তুত না থাকার কারণেই করে না। তবে পরক্ষণেই দেখি পুকুরভরা বৃষ্টির ফোঁটা। বৃষ্টিতে প্রকৃতির থেকে থেকে কেঁপে ওঠা। আর দেখি অপু-দূর্গার হুটোপুটি ছোটাছুটি... এক সময় জবুথবু হয়ে বৃষ্টিতে ভেজা আর বৃষ্টি ধরে যাওয়ার জন্য ছড়া কাটা। দৃশ্যটা এতো সাধারণ আর স্বাভাবিক যে মনে হয় চলচ্চিত্র নয়, জানালা দিয়ে অপু আর দূর্গার বৃষ্টিস্নান দেখছি। দৃশ্যটির সাথে বারবার নিজেও ভিজে যাই। আবার বৃষ্টিতে ভেজার আকাক্সখাও তৈরি হয়। দূর্গা যখন হাঁচি দেয়, নিজের নাকের কাছেও তখন সুড়সুড় করে শীত অনুভব করি।

আরেকটা খণ্ডদৃশ্য মনে পড়ছে- দূর্গা মারা গেছে। ঝড়-বৃষ্টিতে ভিটে বাড়ি ভেঙে-চুরে-গলে গেছে। অপু তেল আনতে যাচ্ছে। দাওয়া থেকে বাইরে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে অপু ফিরে আসে। তারপর ঘরের ভেতর থেকে একটি ছাতা নিয়ে বের হয়। তেলের বোতল হাতে ঝুলিয়ে, বগলে ছাতা দেবে, অপু চলে যায়।
বৃষ্টিকে অপুর ভয় পাবার কথা নয়- তাহলে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছাতা নেয়া কেন? দিদির মৃত্যু কি তাকে সাবধানী করে তুলেছে? নাকি ওই মৃত্যু তার বয়স বাড়িয়ে দিলো? অপুর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নগুলো খচখচ করে, করতেই থাকে।

‘পথের পাঁচালী’তে বিখ্যাত অনেক দৃশ্য আছে। অপু-দূর্গার প্রথম রেল দর্শন, দূর্গার চুরি করা মালাটা অপুর দেখতে পাওয়া এবং পানা-পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে সত্যটাকে মহাকালের অতলে ডুবিয়ে দেয়া, ভিটে ছেড়ে যাবার পর ঘরের ভেতর সাপের ঢুকে যাওয়া। দূর্গার জন্য বাবার শাড়ি নিয়ে আসা ইত্যাদি। প্রতিটি দৃশ্যই অসাধারণ, খুবই অনন্য। কিন্তু ওপরের ওই সাধারণ দৃশ্যগুলো আমাকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে- তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। শৈশবের দিকে ধাক্কা মারছে।
অপু

বিশ বছর পরের একদিন




তোমার হাত ঘড়িটা তোমাকে ভাবাচ্ছে।

অনেকক্ষণ ধরেই ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে আছ। অ্যানালগ ঘড়ি। এক সময় বাবা পরতেন। বাবার মৃত্যুর পর তাঁর সব কাপড়-চোপড় দান করে দেয়া হয়েছে; শুধু ঘড়িটা ঠাঁই পেয়েছে তোমার হাতে। ঘড়িটা এখন আর সুদৃশ্য নেই। বরং বলা যায়, এই সময়ের জন্য ঘড়িটা বেশ বিসদৃশ। ঘড়ির রূপালি রঙ করা বেল্ট আর রূপালি নেই। চটা উঠেছে। দেখে মনে হয় বয়ষ্ক ঘড়ি। আর অবশ্যই তা তো বয়ষ্ক। কিন্তু, যত বয়স তার চেয়েও বেশি বয়সের মনে হচ্ছে ঘড়িটাকে।

নিজের সাথেই তুলনা করছ নাকি?

তোমারও তো অবস্থা তথৈবচ। বয়স চলিস্নশ নাকি, নাকি পঁয়চলিস্নশ? অথচ দেখায় পঞ্চান্ন বা তারো বেশি। গাল ভেঙ্গে গেছে। বুকের চারটি পাঁচটি লোমে পাক ধরেছে। তারচেয়েও বড় কথা কপালের উপর পড়ে থাকা একগোছা চুলে সাদা রঙ, দু'জুলফি ধরে চুনকাম। বলা যায় চটা উঠেছে।
কিন্তু এসব তো তুমি মেলাচ্ছ না। ঘড়িটার দুটি কাটা খাড়াখাড়ি ভাবে গিয়ে থেমে আছে। ঘড়িতে বাজছে বারটা তিরিশ; এবং ঘড়িটা থেমে আছে। কাটা চলছে না, কাটা চলছে না। দেখে মনে হচ্ছে না, তোমার জীবনের কথাই বলছে ঘড়িটা! জীবন দুইদিকে দুহাত প্রসারিত করে, কোথায় যেন হারিয়ে গেছে; এবং থমকে গেছে। চলছে না চলছে না।

তাহলে কী চলছে?

অযাপন?

জীবন মানে যে চলা। বাবার প্রিয় একটা সিনেমা ছিল। হিন্দি। নাম চালতে কি নাম গাড্ডি। চলার নামই গাড়ি। অনেকপরে তুমি ঠিক করেছিলে যে আসলে চলার নামই জীবন। চালতে কি নাম জিন্দেগি!

কিন্তু চলছে না তো। থেমে আছে। এভাবে আর কতক্ষণ কতদিন!

অবশ্য এখান থেকে উঠে গেলেই অন্যরকম চলা শুরু হবে। আট বছর থেকে থমকে থাকা জীবনটা জঙ্গম হবে। এখানে লোকজন আসবে, তোমাকে খুঁজবে। ওরা তো তোমাকে কাচ ঘেরা অফিসটায় ঢুকতে দেখেছে- তোমাকে না পেয়ে ফোন দেবে। অবশ্য ফোন দিয়ে এখন আর তোমাকে পাওয়া যাবে না। ফোন নেই। কদিন আগেই তা হারিয়েছ। হারিয়েছ? এতটা বেপোরায়া বেখেয়ালি তুমি কীভাবে হতে পারো?

পারো না কি?

ছেলেবেলায় কালো ছোট্ট খেলনা পিস্তলটা তো সারাদিন চোখে চোখে রাখতে। পিস্তলটা বিদেশ থেকে এক আত্মীয় এনে দিয়েছিল এই জন্যই কি? বিদেশ থেকে অবশ্য খেলনা ট্রেনও এসেছিল, পুতুলও। ওগুলোর প্রতি তেমন মোহ ছিল না। কিন্তু মোহময় ছিল পিস্তলটা। কী দারুণ পিস্তল! হাফপ্যান্টের পকেটের ভিতর থাকতো পিস্তলটা। নলটা শুধু অসভ্যের মত উঁকি দিয়ে চোখ রাখত বাইরে। মনে হতো বাইরে কে কী করছে তা দেখতে আগ্রহের সীমা তার নেই!
রাতে ঘুমাতে যেতে পিস্তল নিয়ে। বালিশের পাশে রাখতে। সত্যিকারের ব্যবহারকারীরা বালিশের পাশে পিস্তল রাখে ভয়ে, তুমি রাখতে ভালোবাসায়। ইশকুল যাওয়ার সময় নিয়ে যেতে। চোর-পুলিশ খেলার সময় দারুণ ব্যবহার হতো পিস্তলটার। ওই পিস্তলটার বদৌলতে ইশকুলের খেলায় নেতা হয়ে উঠছিলে। তখনো জানো নি, পিস্তল মহার্ঘ; যে কোনো খেলায় তা তোমাকে নেতা করে দিতে পারে।

সেই পিস্তলটা কি ফয়সাল চুরি করে নি? মোটা ফয়সাল। মাংস মাংস মাংস আর মাংস ফয়সাল। ইশকুলের পাশেই ডোমদের শূয়োর চরতো, ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করত, ময়লার মধ্যে ডুবে থাকত আপদমস্তক; ফয়সালকে তেমনই শূয়োর মনে হতো। যার বাবাও ছিল শূয়োর বিশেষ। কালোবাজারি ও ঋণখেলাপি। যদিও ফয়সালকে তুমি কখনো শূয়োরের বাচ্চা বলে গালি দাও নি। কিন্তু দিতে পারলে ভালো লাগত। সবচেয়ে ভালো লাগত ফয়সালের বাবাকে গালিটা দিতে পারলে। যদিও ফয়সালের দাদাও শূয়োর কিনা এ ব্যাপারে তুমি কোনোদিনই নিশ্চিত হতে পারো নি।

তো ফয়সাল তোমার বাড়ি এসেছিল। তখন তো যাতায়াত হতো, না? এর বাড়ি সে যেত, তার বাড়ি তুমি যেতে। সামাজিক যোগাযোগের জন্য তখন কোনো সাইট টাইট ছিল না। সামাজিক যোগাযোগ হেঁটে হতো, সাইকেলে হতো, ট্রেনে-বাসে হতো। বাসের পাশের সিটে বসে থাকা লোকটা জিজ্ঞেস করত, কোথায় থাকেন? কী নাম? কী করা হয়? ইত্যাদি। একসময় বেরোতো তোমার চাচাকে বা মামাকে বা বাবাকে সে চেনে। তুমিও তার কাউকে না কাউকে চেনো। পরিচয় হয়ে যেত। একসাথে চা খাওয়াও হতো। বাড়ির দাওয়াত লেন-দেন পর্যন্ত হতো। তবে শেষ পর্যন্ত আর কারো বাড়ি যাওয়া হতো না। পথের দাওয়াত পথেই ফুরাতো, ঘরোয়া হতো না।

তো এক ঘরোয়া দাওয়াতে ফয়সালকে নিয়ে তার মা এসেছিল। দাওয়াতে, নাকি এমনি? ঠিক মনে পড়ছে না তো! ওই যে বললাম বয়সের চেয়েও বয়স তোমার বেশি। তবে ফয়সাল এসেছিল তার শূয়োরের মতো আগাগোরা কোলবালিশ হয়ে যাওয়া শরীরটা নিয়ে। সে হাঁটলে থপ থপ আওয়াজ হতো। সে জোর করে তোমার পয়সা আর ডাক টিকিটের সংগ্রহ দেখতে চেয়েছিল; তুমি জানতে কোনো একটা প্যাঁচ সে করছে। তুমি পয়সা আর টিকিট দেখাচ্ছিল খুব সতর্কভাবে। যেন একটিও না হারায়। কিন্তু ফয়সালের নজর ছিল আসলে অন্যদিকে। পয়সা ও টিকিট ঠিকঠাক মতো রেখে আসার ফাঁকেই পিস্তলটা হাওয়া করে দিয়েছিল ফয়সাল; ঘুণাক্ষরেও টের পাও নি তুমি। হাসতে হাসতে তাদের বাড়ি যাওয়ার কথা বলতে বলতে মাকে নিয়ে ফয়সাল, কিংবা ফয়সালকে নিয়ে মা চলে গিয়েছিল।

আর কিছুক্ষণ পরেই, পিস্তলটা খুঁজে পাওয়া যায় না। কক্ষণোই পাওয়া যায় না।

বাড়ির সবাই ভেবেছিল তুমি অনেক কান্নাকাটি করবে। সবাইকে ভুল প্রমাণ করে তুমি দিব্যি ইশকুলে গেলে, সকাল-সন্ধ্যা পড়তে বসলে, পাড়ার ক্রিকেট ম্যাচে অংশ নিলে, নদী সাঁতরে সাঁতরে আঙুলের ডগা ফ্যাকাশে করে ফেললে।

পিস্তলের কথা সবাই ভুলে গেল, তবে তুমি মনে রাখলে। ক্ষেত্রবিশেষে তোমার স্মৃতিশক্তি ভালো।

হিমার কথা যেমন তুমি ভোলো নি। একক্লাশ আগে পড়ত। তবে সমবয়সী তো। যে বুড়ি চু খেলা তোমার কোনোদিন ভালো লাগে নি, হিমার জন্য তা-ও তো খেলতে; এবং চাইতে হিমার বিপরীত দলে থাকতে। তাহলে হিমার চাটি খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না! হিমা, নরম কোমল, হিমা পাতলা লম্বা, হিমা মসৃণ। ববকাট চুলে একটা টায়রা দিয়ে গার্লস-ইশকুলের নীল ড্রেস পরেই সে খেলতে চলে আসতো। তখন সিক্স কি সেভেনে পড়ত। না না সেভেনে। তুমি তো তখন হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্টে গেছ। খাকি প্যান্ট আর সাদা শার্ট পড়ে হাই-ইশকুল যাওয়া ধরেছ। মায়ের আজন্ম করে দেয়া চুলের পাট ভেঙে নতুন নতুন চুল আঁচড়ানো শিখছ। আয়নার সামনে বেশ কিছুক্ষণ কাটে তখন তোমার। লুকিয়ে একটা ফেয়ার এন্ড লাভলির টিউবও শেষ হয়ে গেছে। একুশ টাকা জোগাড় হচ্ছে না বলে আরেকটা কেনা হচ্ছে না, এই যা!

ঠোঁটের উপর সরু গোঁফ উঠেছে। সেগুলো গোঁফ না বলে লোম বলাই ভালো। সেগুলো কাটা প্রয়োজন, কিন্তু সুযোগ হচ্ছে না। পায়খানায় একটা কেঁচি নিয়ে কয়েকদিন চেষ্টা করা হয়েছে; কিন্তু কাজটা বিপদজনক মনে হয়েছে তোমার কাছে। আধা-ঘন গোঁফ নিয়ে ক্রিকেট ছেড়ে বুড়ি চু'র মাঠে বেশি যাও তুমি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলা দেখ। ভাগ্য ভালো থাকলে হিমার বিপরীত দলে সুযোগ হয়। ভাগ্য আরো ভালো থাকলে হিমার ইশকুল ড্রেস সরে গিয়ে কাঁধের কাছে বেরিয়ে আসে সাদা সেমিজ। এই সাদা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। অন্ধ করে দেয়। কয়েক ঘন্টা কয়েক বেলা কয়েক দিন আর কিছু দেখতে পাওয়া যায় না।

একদিন খেলতে খেলতে বুলার টানে হিমার ইশকুল ড্রেসের পিছনের হুক ছিঁড়ে যায়। সাদা পিঠ বেরিয়ে যায়। সাদা, নাকি অন্য কোনো রঙ? ওই রঙ আসলে কী তা কি কোনোদিন বলা যায়, বোঝানো যায়? পিঠটা বেরিয়ে যায়। পিঠের একটা অংশ বেরিয়ে যায়। হিমা তো কেঁদে ওঠে; রাগে কেঁদে ওঠে, ভয়ে কেঁদে ওঠে। তার মা মেরে ফেলবে এমন আশঙ্কায় সে খড়ের গাদার পিছনে লুকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ।

তুমি তো তাকে আবিষ্কার করেছিলে, তাই না?

আবিষ্কারটা কেমন ছিল? খড়ের গাদা ঘুরে মুরগির ডিম পাবার মতো? কখনো কখনো সাপের ডিমও তো পাওয়া যেত। চেনা যেত। সাপের ডিম আর মুরগির ডিম আলাদা করা যেত। সেদিন যায় নি। হিমাকে আর কিছু থেকে আলাদা করা যায় নি। হিমার নাভির কাছের তিলটাকেই মনে হয়েছিল পরশ পাথর; তা ছুঁয়েই তুমি সোনা হয়ে যাচ্ছিলে! কিন্তু হিমা তোমাকে আরো সোনার সন্ধান দিয়েছিল; তোমার মনে হয়েছিল তুমি বোধহয় মারা যাচ্ছ, মরেই গেলে কয়েকবার; নাগরদোলার চূড়া থেকে নামতে গিয়ে হঠাৎ যেমন শূন্য হয়ে যায় শরীর, বুক খালি হয়ে যায়, দুলে ওঠে মাথা--ঠিক তেমনই দোলা দিয়েছিল হিমা, হিমার সমস্ত কাঞ্চন; সেই দোলা নিয়ে তুমি তো ছিলে হাজার হাজার দিন।

হিমার গ্রীবার সুঘ্রাণ তুমি কি এখনো পাও না ঘুমালে?

সেদিনের পর থেকে বুড়ি চু বদলে গেল, ফেয়ার এন্ড লাভলি বদলে গেল, চুলের ভাঁজ বদলে গেল। মাঠের পেছনের খড়ের গাদা বদলে গেল। খড়ের গাদা একটুকরো মেঘ হয়ে গেল। বারবার মেঘ হয়ে গেল। মাঝে মাঝে পাখি হলো। আর এক সন্ধ্যায় ঠিক ঠিক বৃষ্টি হয়ে গেল। বর্ষা হয়ে গেল। তারপর আবার বদলে গেল সব কিছু।

তখন কলেজ। রাজনীতি এলো। বান্ধবী এলো। গাঁজা এলো। হিমা কি দূরে সরে গেল? দূরে চলে গেল? নাহ্‌! তখনো হিমা ছিল, এখনো যেমন আছে। আছে না? এখনো স্বপ্ন কাতর হয়, এখনো বাতাস ঝিমঝিম করে ওঠে। ওঠে না কি?

কিন্তু হিমার যে বিয়ে হলো? অন্য কোথায় চলে গেল। দূরে কোথায় চলে গেল।

তাতে কি? সিগারেট খাওয়া বাড়লো, সিনেমা দেখা বাড়লো, মাস্টারবেশন বাড়লো। ফেয়ার এন্ড লাভলির টিউব কেনা বন্ধ হলো। এছাড়া সব ঠিকঠাক থাকলো। মিছিল হলো। বাংলা মদও হলো একদিন। গাঁজা হলো মাঝে মাঝে। ব্যাং কাটা হলো, অণুবীক্ষণ আঁকা হলো বিস্তর। জীবনের ঘড়ি চলতে থাকলো টিকটক টিকটক।

তবে এখন আর চলছে না। বন্ধ। অন্ধ ঘড়িটার মতো বন্ধ। দুহাত প্রসারিত করে বন্ধ।

রক্তের প্লাবনের ওপর ফয়সাল ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তে। তার অতিকায় ভুঁড়িটা ফেটে কাদার মতো ছড়িয়ে আছে। অথচ মুখটা কী শান্ত আর সৌম! ফয়সালকে এর আগে এত ভালো করে দেখা হয় নি তোমার। এখন আর তাকে শূয়োর শাবক মনে হচ্ছে না!

তুমি ফয়সালের ঘর থেকে চুরি করা আসল পিস্তলটা ফেলেই দিলে মেঝেতে। এখন এটার আর দরকার নেই। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। তোমাকে একটা ফোন-ফ্যাক্সের দোকান খুঁজতে হবে।

নম্বরটা মনে আছে তো? ০১৯১৩২৭৭২৮৩। হ্যাঁ হ্যাঁ, ক্ষেত্রবিশেষে তোমার স্মরণশক্তি ভালো।

হিমাকে জানাতে হবে ফয়সাল মারা গেছে। তার আইনসম্মত পুরুষটি মারা গেছে। মারা গেছে। মারা গেছে। যদিও অনেক আগেই উচিত ছিল মারা যাওয়া!

এতদিন পর।

তুমি নম্বরটাতে চেষ্টা করেই যাচ্ছো, করেই যাচ্ছো, ওপ্রান্ত থেকে কেউ ফোন ধরছে না। বৃষ্টি ভিজিয়ে দিচ্ছে তোমাকে। ফোনওয়ালা তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার ফোনের দিকে; ফোনটাও ভিজে যাচ্ছে। আকাশ পাতাল সব ভেসে যাচ্ছে বৃষ্টিতে। আর তুমি থেমে আছো, অনড় অন্ধ ঘড়িটার মতো।
ভুলে গেছ মৃত মানুষ ফোন ওঠায় না।


( মাসিক 'উত্তরাধিকার' এ প্রকাশিত)

লিংক: 
http://uttaradhikar.banglaacademy.org.bd/magazine/1419/Asshin%201419/index.html#/126

যবনিকা


নীলাকে ভালোবেসেছিলাম। 
তারপর ক্রমাগত অনেককে। আমার জীবনে ভালোবাসা এসেছে অক্লান্ত। একেকটি ভালোবাসা একেক ভাবে। প্রত্যেকটি ছিল আগেরটির চেয়ে উজ্জ্বল, চমত্‍কার। জীবনকে মনে হত ইক্ষু। প্রতি গাঁটে গাঁটে মিষ্টতা। আমি যেন প্রজাপতি; গাঁদা থেকে রজনীগন্ধা থেকে গোলাপ। নীলার পর কুসুম, কুসুম কন্টকাকীর্ণ হলে স্নিগ্ধ স্নিগ্ধা। মনে হয়েছিল বনলতা সেন। পাখির নীড়ের মত চোখ। আমি কিন্তু থেমে যাইনি। স্নিগ্ধার মুখোমুখি অন্ধকার হবার আগেই রূপসী রোদেলা। আহ্, জীবনটা একেবারে খাস্তা- মুরমুরে... তিল মেশানো খাজা। একটু কামড় দিয়ে মুখে নিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে স্বাদ নাও। সে স্বাদের ঘোর ঘুরপাক খেতেই থাকে। রোদেলা যেতে না যেতেই বৃষ্টি হাজির। খাসির রেজালা সাথে দই। আঙুল চেটেপুটে খাও। উফ্... 
তারপরই ঘটে গেল বিভত্‍স ঘটনাটা। 
জীবনটা থমকে গেল। একই জায়গায় ঘুরছে তো ঘুর... 
আর লিখতে পারব না। নীলা এসে গেছে। 
হ্যাঁ, সেই নীলা। ওর সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। 


অতঃপর, সব কিছুর যবনিকা ॥


(প্রকাশ: রস+আলো)

সিগারেট


শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিলাম। দিতে পারলাম আর কি! কঠিন ছিল। কঠিন হবে না? এত দিনের অভ্যাস। ঘুম থেকে উঠে, ঘুমাতে যাবার আগে। জেগে থাকা অবস্থায় একটু সুযোগ পেলেই। অফিস থেকে নানা অজুহাতে বেরোনো। এ নিয়ে কম হাঙ্গামা! তাছাড়া অর্থহানি, স্বাস্থ্যহানিও বটে। অতএব ছেড়ে দিলাম। দেয়াই তো উচিত। কেউ নিষেধ করেনি; বন্ধু বান্ধবরা তো বাহবাই দিল- যদিও মনে হল কেউ কেউ ভাল ভাবে নেয়নি। তাতে কি বা এল গেল! আমি পেরেছি এটাই বড় কথা। নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ে দিতে ইচ্ছা করে। নিজেকে এখন মুক্ত স্বাধীন মনে হচ্ছে। পেরেছি। কঠিন ছিল। কিন্তু পেরেছি। মুন্নিকে বলে দিয়েছি ওর সাথে আর মোবাইলে কথা বলব না। প্রেম ট্রেম সব শেষ। মেয়েটার সবই ভাল ছিল, কিন্তু যখন তখন খালি খালি সিগারেট ছেড়ে দেবার কথা বলত। ওকেই ছেড়ে দিলাম। কঠিন ছিল, কিন্তু পারলাম। পারব না কেন? 


সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ ধূমপান হৃদ রোগের কারণ। 


( প্রকাশ: রস+আলো)

সপুংশক কানাডা


        আমেদ বাজারে ছিল, কেনো ছিল সে জানে না। আলগোছেই বাড়ি থেকে বের হয়ে সে গলিটুকু পার হয়ে বাজারে দাঁড়িয়েছিল। এখন চার রাস্তার মাঝে বোকার মত দাঁড়িয়ে আছে। সে যে বোকার মত দাঁড়িয়েছে তাও সে বুঝছে না। রাস্তার পাশের টংচায়ের দোকানে বসা লোকেরাও তাকে পাত্তা দিচ্ছে না, তারা তখন আমলিগ-বেনপি করছে; দেশোদ্ধারের মহান কার্যের ভিতর আমেদ যে গুরুত্ব পাবে না, এটা জানা কথা। আমেদের ভাবনা পরিষ্কার ছিল না তার ময়লা পাজামার মত। যদিও সে পাজামা পরতে চায় নি, কিন্তু কেনো পরেছে সেটা স্পষ্ট নয়। তার গায়ে একটা টি-শার্ট, যা পাজামার সাথে একেবারেই মিলছে। টি-শার্টে বড় বড় অক্ষরে ইংরেজিতে এফ.ইউ.সি.কে লেখা। টি-শার্টটা আমেদ উপহারই পেয়েছিল, এমন মনে হয়। লিজা বা এলিজা বা এলিটা নামের তরুণী কিছুদিন আমেদের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেছিল; ওই মেয়েরই প্রবল সম্ভাবনা আছে এ টি-শার্টটি দেয়ার। একদিন শপিংব্যাগ ভর্তি কাপড়-চোপড় নিয়ে আমেদের বাসায় উপস্থিত হয়েছিল সে। বেশ ক’টা টি-শার্ট, পার্টি শার্ট, জিন্স প্যান্ট, আন্ডারওয়ার, রেজর-শেভিং ক্রিম ঘরের মধ্য-মেঝেতে রেখে জানতে চেয়েছিল সব পোশাক গায়ে লাগবে কিনা! আমেদও পরখ ক’রে ক’রে জানিয়েছিল আন্ডারওয়ারটার ঢিলে হওয়ার সম্ভাবনা। বলেছিল মেয়েটার আন্দাজ ঠিক হয়নি। মেয়েটা উল্টো দারুণ কেতায় জানিয়েছিল যদিও সে দেখেনি জায়গাটা.. তবু তার আন্দাজ ভুল হবার নয়। মেয়েটি দেখতে চেয়েছিল। আমেদ তার পুরোনো আন্ডারওয়ার নিয়ে এসে মাপ ধরে দেখিয়েছিল মেয়েটিকে। বোঝাই যায় মেয়েটি তাতে খুশি হয়নি। পরে আরেকদিন দশ প্যাকেট সিগারেট আর বেশ ক’প্যাকেট কন্ডোম নিয়ে এসে মেয়েটি জানিয়েছিল যে এগুলো তার কাজে লাগবে, কারণ সে বাইরে খুব একটা বের হয় না; একা থাকে আর তার বাসায় ছেলের চেয়ে মেয়েরই যাতায়াত বেশি। কথাগুলো যুক্তিযুক্তই মনে হয়েছিল আমেদের; ফলে একটি সিগারেটের প্যাকেট বাইরে রেখে সবগুলো চালান করেছিল ড্রয়ারে। মেয়েটি বলেছিল যে তার এক প্যাকেট কন্ডোমও বাইরে রাখা উচিত। এবং উচিত ভেবেই আমেদ তাও বাইরে রেখেছিল। পরের একটি সপ্তাহেও প্যাকেটটা না খোলায় মেয়েটি দুঃখ পেয়েছিল কিনা আমেদ ভাবেনি; তবে মেয়েটিও আর আসেনি। দু’একবার সেলালাপ হয়েছিল আর তাতে মেয়েটি আমেদকে জানিয়েছিল সে কানাডা চলে যাচ্ছে, নপুংশকের দেশে আর থাকবে না সে। আমেদের নতুন একটা জ্ঞান লাভ হয়েছিল তাতে যে কানাডা সপুংশক অঞ্চল। আর এই জ্ঞান নিয়ে অনেকদিন পর একটা কিছু লিখে ফেলেছিল কবিতার মত সে, বা কবিতাই, বা অন্য কিছু। তাতে আমেদ খুব বিস্মিত হয়েছিল; তার মনে হয়েছিল সে লিখতে ভুলে গেছে। সাদা কাগজ, কম্পিউটারের লেখার সাদা অংশ দেখলে একসময় খুশি হয়ে উঠতো সে, এখন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। দ্রুত সে-স্থান ত্যাগ করে। লেখাটি লেখার পর থেকে লিজা বা এলিজা বা এলিটা নামের মেয়েটিকে আমেদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তার মনে হতে থাকে লেখাটি তাকে শোনানো দরকার; যদিও লেখা শোনানোর কাজটি সে কখনোই উপভোগ করেনি। কিন্তু এক্ষেত্রে উল্টোটাই ঘটে যায়। লেখাটি শোনানোর জন্য উদগ্রিবতা পেয়ে বসে; ঝোঁকের মত বা নেশার সমূল টানের মত। সেল ফোনে বারবার চেষ্টা করতে থাকে মেয়েটিকে পাবার জন্য। অপরপ্রান্ত থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের টোন ভেসে আসে; আর সেলফোন সম্পর্কে সীমিত জ্ঞানের কারণে আমেদ বুঝতে পারে না সেলটি বন্ধ থাকছে বা রিঙটা কেটে দেয়া হচ্ছে! আমেদের সেল চেষ্টা চলতেই থাকে। অবশেষে না পেয়ে সে সিগারেটের প্যাকেটগুলোই শেষ করতে পারে মাত্র, আর সপুংশক কানাডাকে তার দূরের মনে হতে থাকে। তবে একটা সন্ধ্যা একটু অন্য রকম হয়ে যায়। ওই মেয়েটা হাতে একটা বোতল নিয়ে হাজির হয়। বোতলটা নাকি উৎকৃষ্ট মদের, মেয়েটা জানায়। আমেদ মদ পছন্দ করে। তবে ঠিক জানে না কোনটা উৎকৃষ্ট আর কোনটা নিকৃষ্ট। মেয়েটি অভ্যস্ত আর বিশ্বস্ত হাতে পাত্রে মদ ঢালে, বরফকুচি ও কোমলপানীয় মিশিয়ে পরিবেশন করলে বলা যায় চমৎকৃতই হয় আমেদ। আমেদ জানায়, সে একটা কবিতা বা না-কবিতা বা অন্য একটা কিছু শোনানোর জন্য তাকে ফোনে খুঁজেছে। প্রত্যুত্তরে মেয়েটি তার ভাঙাচোরা দাঁত নিয়ে হাসে। আমেদ সে হাসিতে, বলা যায়, মুগ্ধই হয়। সিগারেট জ্বেলে মদের পাত্রটা তুলে আমেদ লেখাটা পড়ার উদ্যোগ নিলে মেয়েটা জানায় মদ্যপানের পর বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে এ লেখাটা শুনতে আগ্রহী। আমেদ লেখাটা রেখে দেয় টেবিলের উপর, অবশ্য তার মনে হতে থাকে টেবিলে কাগজের বদলে সে রেখেছে নিজের হৃদয়। আর এমন মনে হওয়ায় হাসিও আসে তার, তাতে ছলকে যায় মদ, লুঙ্গি ভিজে যায়। মেয়েটি হায় হায় ধরনের উৎকণ্ঠায় আমেদের লুঙ্গি চেপে ধরে, তবে ভিজে যাওয়া অংশের চেয়ে সে অন্যদিকেই মনযোগী হয়ে ওঠে। মেয়েটি লুঙ্গির গেরো ফসকিয়ে আমেদের দিকে একবার তাকায়। জানায় লুঙ্গিটা চেঞ্জ করতে হবে। লিজা বা এলিজা বা এলিটা এবার লুঙ্গি নিচের দিকে নামাতে থাকে যদিও আমেদের বসে থাকার কারণে নামাতে পারে না বেশি, শুধু সামনেটা অনেকখানি উন্মূক্ত হয়ে পড়ে। তাতে মেয়েটা আহলাদিত হওয়ার মত শব্দ করে ওঠে। যেন উপহারে পেয়েছে সোনার অলংকার! সে  উন্মূক্ত দুই উরুতে তার ফ্যাকাসে হাত ঘষতে থাকলে আমেদ উঠে দাঁড়ায়। তাতে অনিবার্যভাবে লুঙ্গিটা নিচে পড়ে, কিন্তু মেঝেতে না প’ড়ে তার কিছু অংশ আটকে থাকে টেবিলের উপর লেখার কাগজটি ঢেকে। আমেদ জানায় তার একটা পোশাক দরকার কিন্তু মেয়েটা তাকে পোশাকহীন দেখতেই আগ্রহী এমন জানালে আমেদের হাতে সিগারেটের ছ্যাঁকা লাগে। অ্যাশট্রে খুঁজে না পাওয়ায় সিগারেটের শেষ অংশটুক আমেদ ধরেই থাকে তার আঙুলের ফাঁকে। আমেদ দুলে উঠলে মেয়েটা তাকে আঁকড়ে ধরতে চায়; তার শরীর থেকে বা নিঃশ্বাস থেকে বা অন্য কোথাও থেকে সুগন্ধ আসছিল যা আমেদের কাছে দুর্গন্ধ বিশেষ মনে হয়। ঘরের দড়িতে টাঙানো একটা পাজামা আমেদ টেনে নেয় পরার জন্য, আর তাতে মেয়েটাকে এমন বিস্মিত মনে হয় যেন একটা বানরকে নিজ উদ্যোগে পোশাক পরতে দেখছে সে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসার ফাঁকে আমেদ দেখে তার লেখাটি থেকে লুঙ্গি সরিয়ে মেয়েটা তা ছেঁড়ার চেষ্টা করছে, কম্পিত হাতে তা কষ্টের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমেদ লেখাটির জন্য শোক অনুভব না ক’রে এক ধরনের আনন্দ ঘোরের ভিতর চৌরাস্তায় কানাডা ও নপুংশতা নিয়ে আরেকটি লেখার প্রস্তুতি নিজের ভিতর অনুভব করতে থাকে ।। 

(নতুন ধারা’য় প্রকাশিত)

জল জীবন

জলকে বলি, থামো। 
কী অযথা সারা জীবন নিচের দিকেই নামো? 
আগুন দেখো, কেমন তার উর্ধ্বে নাচানাচি- 

কলকলিয়ে ছলছলিয়ে জল 
বলল, জীবন এমনি অবিকল 
থাকতে যে চায় মাটির কাছাকাছি- 

জীবন মানে মাটি ছুঁয়ে থাকতে পারা 
চোখের মধ্যে কয়টি ফোঁটা রাখতে পারা ।। 

৭ আগষ্ট ২০১২ 

মদ্যপ-দ

এক. 
বরফে রক্ত? পান কর ভাই- মদই কেবল মিত্র 
পাপের কথা ভাবছো এত, তুমি কত পবিত্র? 

দুই. 
হেথায় এসো, প্রাণটা জুড়াও হেথায় সাকি নেই তো কি- 
আমি আছি তুমি আছো আর রয়েছে আঙুর-সখি! 

তিন. 
ডিঙির দোলা যায় কি পাওয়া সামুদ্রিক ও পানসিতে? 
'মদ খেও না' কথার কথা, সে কথায় নেই কান দিতে। 

চার. 
সাহস করে একটু ঢালো- জ্বলে জ্বলুক কন্ঠনালী 
হৃদয় জ্বলুক- এই তো চাই- করো পুরো বোতল খালি! 

পাঁচ. 
দুখের রঙ নীল কে বলে- দুখের রঙ লাল রে ভাই 
নিত্য তাকে গ্লাসে ঢালি, নিত্য তাকে স্বর্গে পাঠাই ।।

মেঘ ডাকে

মেঘ ডাকে মেঘ ডাকে 
খুকু তাই শুনছে 
কয়বার কাকে ডাকে 
বসে বসে গুনছে ! 

এক দুই তিন চার 
মেঘ ডাকে হুররে- 
মেঘ ডাকে গুরু গুরু 
গুর গুর গুররে ! 

মেঘ ডাকে তারো আগে 
বিদ্যুত্ চমকায় 
খুকু খুব সাহসী তো 
ভয় ডর কম খায় । 

মেঘ ডাকে কাকে ডাকে 
আমাকে না তোমাকে- 
ও বাড়ির রুমু ঝুমু 
তানিয়া না সোমাকে ? 

মেঘ ডাকে খুকু তাই 
ফিট ফাট তৈরি 
চুলে বাঁধা লাল ফিতা 
গায়ে জামা খয়রি- ॥ 


('জল পড়ে পাতা নড়ে'র নভেম্বর ২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত)
২৪.০৮.২০১২ 
বানেশ্বর, রাজশাহী

ছোঁয়া ও স্পর্শ সংক্রান্ত

ছোঁয়া আর স্পর্শের মধ্যে পার্থক্য আছে 
ছোঁয়ায় ছুঁয়ে থাকা যায় অনেকক্ষণ 
এমন কি শতাব্দীও পার হয়ে যেতে পারে 
শৈবাল যেভাবে পাথর ছুঁয়ে থাকে তেমন 
আদিমও হতে পারে মানুষের ছোঁয়া 

স্পর্শ ক্ষণিকের 
বৃষ্টির মত স্বল্পায়ু 
সঙ্গমের মত মাত্র অথচ 
অভিজ্ঞতার মতই গভীর 

হৃদয় স্পর্শ দিয়েই ছুঁতে হয়॥ 

১৩.০৬.২০১২

করমালির একরাত


সন্ধ্যা হবার আগেই রাস্তার বাতিগুলো জ্বলে উঠেছিলো। তবে করমালি যেদিকে দাঁড়িয়ে, সেদিকে সন্ধ্যাও ঝাঁপ দেয় আগে, বাতিও জ্বলে না। এবং না জ্বলাটাই একধরনের নিয়মের অংশ হয়ে গেছে। করমালি পান চিবাচ্ছিলো, পান চিবানোর সময় নিজেকে তার ছাগলই মনে হয়, বিশেষতঃ থুতনির নিচে আধমুঠোরও কম দাড়ি থাকায়, কিন্তু তবু পানসে চিবায়, চিবানোর ভিতর একধরনের তৃপ্তি পায়। পরনে তার এককালের সাদা, বর্তমানের ধূসর তেলটে পাজামা থাকে বেশিরভাগ দিনেই, আজ অবশ্য কালো রঙের প্যান্ট পরে আছে সে, গত পরশুই এটা সে উদ্ধার করেছে মুনার ঘর থেকে- একটু ঢোলা হয়, কিন্তু খারাপ মানায়নি; সঙ্গে নীলচে শার্টের হাতা গুটানো; বুকের বোতামটা ছেঁড়া ব’লে, এবং আরো একটি বোতাম লাগানোর প্রয়োজন পড়েনি ব’লে বুকের হাড়- খাঁচা চেপে থাকা কর্কশ পশমগুলো দেখা যাচ্ছে, কিংবা করমালি দেখাচ্ছে; এই পশম আর মাথাভর্তি বাবরি চুল নিয়ে তার গর্ব আছে, যা প্রায়ই তার বউ আইশার কাছে জাহির করে। এবং কেবল আইশার কাছেই করে, কারণ অন্যেরা তাকে গ্রাহ্য করে না। আইশাও যে খুব করে তা বলা অসত্যই হবে, মুখের উপর ঝামটি মেরে বলে, ‘মাগিগো শরীল বেইচ্যা খাও… এমন মরদের পশমও দিছে আল্লায়… পশমে তুমার
পুকা লাগবো কইলাম।’ কিন্তু কোনো কোনো রাতে সেই পশম নিয়ে আইশা আহলাদ করে, আঙুল বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘আমার মদ্দা ঘুড়া।’ করমালি সিনাটা তখন আরেকটু চওড়া করে। এবং আরেকটু জোরে চেপে ধরে আইশাকে। আইশা শব্দ করে হেসে উঠেই সচেতন হয়ে ফিসফিস ক’রে বলে, রূপসা জাইগা জাবো… ডাঙর হইসে না… হে এখনসবই বোজে। করমালিও হুঁসে ফেরে।
       রূপসা মানে রূপসী তাদের সবেধন মেয়ে, আটটি ক্লাস পার ক’রে ফেলেছে পাশের গার্লস হাইস্কুলে, ক’দিন পরেই মেট্রিক না কি দিতে হবে, এইটা পাশ করলে চাকরি একটা নিশ্চিত- বলেছিলেন এনজিও আফা, তারাই নাকি চাকরি দেবে, তখন আর খব্বিশের ব্যবসা কে করে? কিংবা কে জানে হয়তো করতেও হতে পারে; মেয়ে কি আর সারাজীবন থাকবে? এ জন্য একটা পুত্র-সখও ছিলো করমালির। কিন্তু আল্লায় ননা চাইলে কি গাছের পাতাটিও নড়ে?
      করমালি একটু সচেতন হয়, ছোকরা ধরনের একজন এগিয়ে আসছে এদিকে। ছোকরারা খরিদ্দার হিশেবে ভালো, ঝামেলা করেই না বলতে গেলে, নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে, মেয়ে বাছাবাছিও করে না তেমন একটা, ভয়ে ভয়ে ঘরে ঢুকে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঝামেলা চুকিয়ে চলে যায়, টাকা পয়সা নিয়েও হাঙ্গামা নাইÑ যা চাওয়া যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা-ই পাওয়া যায়। করমালি একটু এগিয়ে যায়। হয়তো জীবনে প্রথম আসছে, সাহস দেওয়ারও দরকার আছে। কতজনকে দেখেছে ঘুরে-ফিরে প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্বেও শুধু সাহসের অভাবে কাম না ক’রে চলে যায়। ছোকরার গায়ে জ্বেল্লাদার শার্ট আর জিনসের প্যান্ট। করমালি বলে,
‘কি লাগবো নাকি?’
ছোকরা এদিক ওদিক তাকিয়ে নিশ্চিত হ’য়ে বলে,
আছে?
করমালিও এবার এদিক ওদিক তাকায়, দিনকাল ভালো না, পুলিশকে টাকা দেওয়ার পরও আগে থেকে জানতে পারা যায় না কখন ‘রেট’ হবে, কখন হবে না। ছোকরার কত বয়স হবে? ২২
না ২৩? না, এত কম বয়সের কেউ পুলিশি ঝামেলাওয়ালা হওয়ার কথা না। বলে, আছে।
ছেলেটা জিজ্ঞেস করে, কত?
মানে রেট কত। বাহ্, পাকা মাল মনে হইতাছে, মনে মনে ভাবে করমালি। এবার সেও একটু পেঁচায়,
‘সব রকমেরই আছে। আপনের কেমুন লাগবো?’
‘কড়া… এক নম্বরটা’ ছেলেটা রূমাল বের ক’রে ঘাম মোছে।
‘এই তো ভয় ধরসে’ ভাবে করমালি। এখন এ্যারে সাইজে আনোন লাগবো। বলে, একদম কড়া মালই আছে। কাইলকাই আসছে। এক নম্বুর।
ছেলেটা উৎসাহী হয়ে ওঠে, বলে, ঠিক আছে… চারটা লাগবে। কত আসবে?

চাইরটা? তারপরেই সন্দেহটা গাঢ় হয় করমালির। জিজ্ঞেস করে, চাইরটা? আপনের কি মাল লাগবো? লেডিছ না?
‘কি?’ প্রশ্ন ক’রেই উত্তর পেয়ে যায় ছেলেটা, বলে, না না… বাবা নাই, বাবা?
ভরযৌবনে বাবা মানে গাঁজা বুঝতো করমালি, এখন জানে বাবা মানে ইয়াবা… হিরোইনের মত কইরা খাইতে হয়, পোলা মাইয়া সবেই খায়; মাইয়ারা নাকি খায় কফির লগে মিলায়া, মেলা টাকা দাম। সে জিনিসি চোখেও দেখেনি করমালি। গত ক’দিন ব্যব্সা বেজায় মন্দ। আরো বোধহয় মন্দের দিকেই যাইবো, ভাবে করমালি। আগে মানুষ মদ খাইয়া মাতাল হইয়া মাইয়ামানুষ খুঁজতো- এখন কি সব
নেশা উঠছে… ডাইল, বাবা, মামা, চাচা খাইয়া কোণায় ঝিম মাইরা বইয়া থাকে। কারো খারায়ও না, মাইয়াও লাগে না। কিন্তু ফন্দি আঁটে করমালি, না আঁইটাও উপায় কি? প্যাট
আছে না…!
ছেলেটাকে সে আরেকটু কোণায় টেনে নেয়। ফিসফিস ক’রে বলে, আছে। কড়াটাই আছে। কিন্তুক সাবধান- চারিদিকে ডিবি আর ডিবি- আমার লগে আসেন…
ছেলেটা এবার সত্যিই ভয় পায়। একে এ লাইনে সে নতুন, তাকে যে সাপ্লাই দেয় তার মোবাইল বন্ধ, খোঁজে খোঁজে সে এই পর্যন্ত আসতে পেরেছে বা আসতে বাধ্য করেছে অমোঘ টান। তার কণ্ঠ আরো নিচে, প্রায় না বলার মত ক’রে বলে, কোথায় যাবো?
করমালি যেন ছোট বাচ্চাকে শাসন করছে এমন ধমকের সুরে বলে, চুপ… কথা কইয়েন না। আমার পিছন পিছন আসেন। কয়টা লাগবো... চাইরটা না?
ছেলেটা করমালি অনুসরণ করতে করতে বলে, হুম।
করমালি রাস্তার ছায়া ছেড়ে একটা গলির ভিতর দিয়ে তার গন্তব্যের দিকে যায়। সরু একটা কলাপসিবল গেটে তালা মারা, গেট খুললেই সিঁড়ি, সিঁড়ির উপরের তিনটা ঘরে বিউটি, মুনা, বেবি, রোজিনারা আছে। করমালি ঠিক করে ছোকরাটাকে বেবির ঘরেই ঢুকিয়ে দেবে, এসব কাজে বেবিই ওস্তাদ, ছোকরার কাছে যা আছে সব বের ক’রে ছাড়বে। অবশ্য তার আগে ওর নিজের
জন্য কিছু হাতিয়ে নিতে হবে। গেটের তালা খুলতেই ছেলেটা বলে, ‘আমি এখানেই দাঁড়াচ্ছি, আপনি নিয়ে আসেন। দাম তো বললেন না?’
করমালি এবার তৈলাক্ত কণ্ঠে বলে, কি কন এইসব? মাথা খারাপ হইছে? এখানে আনোন যাইবো না… আপনি উপরে চলেন, মাল নিয়া যাইবেন গা। আর ভালো মালের দাম তো আপনের জানাই আছে… আপনেরে দেইখাই বুঝছি আপনি পুরান পাবলিক।
কথাটা আনন্দের না, কিন্তু ছেলেটার কেনো যেন আনন্দ হয়, বলে, দাম তো জানাই আছে… আর জিনিসও খুব ভালো চিনি আমি… আমাকে ঠকানোর…
ওরা ভিতরে ঢুকে গেলে আবার গেটে তালা দিতে দেখলে ছেলেটার কথা থেমে যায়। এবার অন্যরকম ভয় অনুভব করে। বলে, তালা দেন কেনো?
‘শালার ডিবিগো কুনো ভরসা নাই’ ব’লে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে করমালি ‘আসেন সমস্যা নাই।’
উপরে উঠে করমালি বেবির ঘরে টোকা দেয়, বেবির হাঁসফাঁস কণ্ঠ ভেসে আসে, কুন জাওরার পুত? করমালি বলে, করম আছি।
ভেতর থেকে বলে, এট্টু খারাইতে ক। হইয়া আইসে…
করমালি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে, হে… পাটি আছে। অহনই পাইয়া যাইবেন। চাইর হাজার ট্যাকা দেন।
ছেলেটা বলে, চার কেনো? চারটা আমরা সাড়ে তিনে নিই। আর মাল না দেখে তো টাকা দিবো না।
করমালি বলে, চাইর-ই দেন… আর মাল কড়া কইলাম না…! আপনেরে খারাপ মাল দিয়া আমার কুনো লাভ আছে? খারাপ মাল নিয়া গেলে কি আপনি আর আসবেন? আমি এখানে খারাই আছি না... দ্যান, ট্যাকা দ্যান, আগে ট্যাকা না দিলে আফা মাল দেয় না।
ছেলেটা একহাজার টাকার চারটা নোট বের ক’রে দেয়। করমালি টাকাগুলো দ্রুত পকেটে ভ’রে নেয়। তারপর আবার হাঁক দেয়, কইরে… হইলো?
ভিতর থেকে বেবির চাপা উত্তর আসে, শুয়োরের পুতে ট্যাবলেট খাইয়া আসছে…
পাশের ঘর থেকে মুনার মুখ বেরিয়ে আসে, অল্প বয়সি কালো রঙের একটা মুখ, বলে, ‘করম ভাই আমার ঘরে দেন।’ মুনার জন্য অকারণ দরদ করমালির আছে এ কথা সত্য, কিন্তু এ কাজ মুনার
নয়, এও সে জানে। বলে, তুই পারতি না। এ কাম তোর না। মুনা বড় বড় চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আর তখনই, সেই মুহূর্তেই, মুনার চোখে চোখ পরা মাত্রই, ছেলেটা হঠাৎ ক’রেই, সব কিছু বুঝে ওঠে। সে কাঁপা স্বরে করমালিকে বলে, আমার বাবা লাগবে না... আপনি টাকা ফেরত দেন। আমার
কাজ আছে… আমি যাবো…
শেষ পর্যন্ত ছেলেটি যেতে পায়- কিন্তু করমালির কাছে অবশিষ্ট আরো আড়াই হাজার টাকা, একটি মোবাইল ফোন আর হাত ঘড়িটা রেখে। সেখান থেকে অকারণেই মুনা দু’হাজার টাকা ভাগ পায়।
পেয়ে আনন্দে করমালিকে একটা পান খাওয়ায়। রাত বেশি না হলেও করমালি ঠিক করে আজ সে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাবে। আল্লা আইজ দু’হাত ভইরা দিছে... তার ইচ্ছা হয় এই খোশসংবাদ তার
বৌ’রে শোনাতে। মুনার পান চিবাতে চিবাতে সে নিচে নামতে থাকে। বেবির ঘর তখনো বন্ধ। গেটের বাইরে মনতাজ দাঁড়িয়ে আছে। আইজ এইদিকটা হেই সামলাক…পারলে দু’টাকা বেশি কামাক... ভাবে করমালি।
তাড়তাড়ি ফিরবে ভাবলেও তাড়াতাড়ি ফেরা হয় না করমালির, তাকে একবার বাংলা পট্টির দিকে যেতে হয়। এমনি দিনে সাধারণতঃ চোলাই মানে চুল্লু দিয়ে কাজ সারে সে, কিন্তু আজ তো বিশেষ দিন; অভাগা ছোকরাটার কথা ভেবে একটু করুণাও হয় তার, কিন্তু এ করুণা জন্ম পেটে বাংলা মদ পড়লে, মনটা তরল হ’লে। সাদা একবোতল বাংলা পুরোটা শেষ করলে তার ক্ষান্তি আসে, নেশা নেশা লাগে। গন্ধটা পান খেয়েও যাবে না মুখের, অন্ততঃ আইশা ঠিক ধরবে যে সে আজ বাংলা খেয়েছে, অতএব আইশার জন্যও কোনো একটা ব্যবস্থা করা উচিত, ভাবে করমালি।
তাই একবার নতুন বাজারের দিকেও তাকে যেতে হয়, সিটি গোল্ডের একজোড়া বালার দাবি আইশার অনেক দিনের, এ দাবি মেটানোর দিন তো আজই। অতএব দুইজোড়া বালা, অপরজোড়া রূপসার।
রূপসার আবার রসমালাই খুব পছন্দ, তাই নিতে হলো রসমালাইও। ছোকরার মোবাইলটা এখনও তার পকেটে; মোবাইলটা না নিলেও পারতো… কিন্তু কিছু নিয়মের বাইরে যেতে পারে না মানুষ, করমালিও।
মোবাইলটা দিয়ে দিতে হবে আলতুকে। আলতু এসব চোরাইমালের কারবার ভালোই বোঝে… করমালির টাকা নিয়ে কথা, তা যেভাবেই আসুক। পা’টা ভার ভার লাগছে, রাস্তাও মনে হচ্ছে চরাই-
উৎরাইয়ে ভরা… আসলে নেশা, বেশ ঝিম মেরে ধরেছে মাথাটা, একপাশ থেকে অন্যপাশে ঘোরাতে যেন দুইদিন লাগে। তা লাগুক… এমন লাগাতেই তো সে চেয়েছিলো…
আবার একটু আফসোস হয় করমালির ওই ছেলেটার জন্য। তারপর নিজেকেই সান্ত্বনা দেয় এই বলে যে ওদের বাপের ম্যালা আছে, এমন দু’দশ হাজার টাকা ওদের জন্য কিছুই না।

বাড়িটা তার নিছক বস্তি নয়; যদিও বস্তির পাশে টিন দিয়ে ঘেরা একটিমাত্র ঘর, একপাশে চুলা, অন্যপাশে বেড়া দিয়ে ঘেরা পায়খানা। বছর তিনেক আগে স্বাস্থ্যকর্মীরা ব্যবস্থা ক’রে দিয়ে গেছে।
এইরাত্রে একমাত্র বাল্বটি জ্বলছে ওদের ঘরের ভিতর, বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, তবে বস্তির ওইদিকেও আলো আছে- এ সমস্ত আলোর উৎস পাশের কারেন্টের পিলারটা; ওরা খাম্বা বলেই
অভ্যস্ত। তো সেই খাম্বা থেকে লাইন টেনে কারেন্টের ব্যবস্থা করেছে আলতু। এসব ব্যাপারে তার জ্ঞান অগাধ, এবং এই ব্যবস্থা ক’রে দেবার জন্য একশ’টি টাকাও দিতে হয়েছে ওকে, তার খরচ বাদেও; আর পুলিশি ঝামেলাও সে-ই দেখে ব’লে প্রত্যেক মাসে তিরিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ যার কাছে যেমন পারে সে তোলে। করমালির সঙ্গে আলতুর আলগা খাতির, সে তিরিশ টাকাই দেয়। ঘরের দরজায়
একটু হোঁচট খায় করমালি। আইশা তখন চোকির উপর পা তুলে মাথায় তেল ঘষছিলো, স্বামীর দিকে তাকিয়ে, তার হাতের ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে, লাল চোখের দিকে তাকিয়ে, আইশা বলে, কামাই
ভালো হইছে মনে লয়… এইজন্যিই কি আগে ফিরলা?
করমালি ঘরে ঢুকে, ঘর খালি দেখে জিজ্ঞেস করে, রূপসা কই?
‘টেনিঙে গ্যাছে গো’ বলে ঠোঁট বাঁকায় আইশা।
‘সাস্থো আফায় আইসা নিয়া গেছে।’
‘কিসের টেরনিং?’ ব্যাগ রেখে চোকিতে বসতে বসতে বলে করমালি। তবে খুব বেশি উদ্যম দেখায় না। কারণ এমন ট্রেনিঙে মাঝে মধ্যেই যায় রূপসীসহ আরো কয়েকজন। স্বাস্থ্য আপা নিয়ে যায়, আবার দিয়েও যায়। কি কি যেন শেখায়- রূপসী এসে প্রথম প্রথম গল্পও করতো; পরিবার পরিকল্পনা, সুস্বাস্থ্য, নিরাপদ পায়খানা, গর্ভকালীন ব্যবস্থা এমন নানান কথা। শুনে করমালির গর্বই হতো কেবল, বুঝতে কিছুই পারতো না। ‘মাইয়ার জন্যি তো রসমালাই আনছি’ করমালি আইশাকে বলে।
আইশা চুলে চিরনি চালাতে চালাতে বলে, মাইয়া আইলে খাইবো… আমার জন্যি তো আর আনো নাই।
‘তোমার জন্যিও আনছি কিছু।’
‘তুমি বাংলা খাইছো নাকি? দেখি, মুখটা কাছে আনো তো!’
‘হ খাইছি। আইজ জবর ইনকাম হইছে রূপসার মা।’
‘নতুন মাগি আইছে নাকি? তুমিও এট্টু টেস্ট করতা…’
‘ধুর… কোন কথায় কি… মাইয়া মানুষ কি আর সাধে কয়? আইজ অন্য ইনকাম হইছে গো…’ ব’লে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে করমালি।
প্যাকেট সে এখনও খোলেনি।
‘হায় খুদা… ছিনতাই করছো?’
‘না গো… দায়ে পইরা দিয়া গেছে।’ গল্প শোনায় করমালি রঙ চঙ মাখিয়ে। নিজের বীরত্বের প্রকাশ ঘটিয়ে। শুধু মুনাকে টাকার ভাগ দেবার কথা চেপে যায়। সব শুনে প্রথমে খিলখিল ক’রে হেসে ওঠে আইশা, কিন্তু পরক্ষণেই বলে, কামটা ঠিক হইছে কি? অতগুলান টেকা!
‘হ্যাদের বাপের ম্যালা আছে। এ কয়টা টেকা হ্যাদের কিস্যু না- বোজো নাই… মাল খাইতে কত্ত টেকা খরচ করে।’
‘তুমি কয় টাকা করছো?’
‘কিয়ে?’
‘কিয়ে আবার, মাল খাইতে?’
‘বেশি না গো সুনা… বেশি না… আর তুমার জন্যি দেখো সিটি গোল্ডের বালাও আনছি…’
‘সত্যি? কই?’
‘আমি কি আর মিছা কথা কই’ বলতে বলতে বালা বের করে ‘মাইয়ার জন্যিও আনছি, তুমার মাপের একমাপ ছুটো, হইবো না?’
‘খুব হইবো’ ব’লে নিজের বালাদুটো হাতে নেয় সে। আসতে আসতে হাতের ভিতর ঢোকায়।
করমালি চেয়ে থাকে, বলে, ‘যুত হইছে, সোন্দর হইছে।’ মেয়ের বালাজোড়া তার হাতে।
এগুলো দেখিয়ে আইশাকে জিজ্ঞেস করে, কি রূপসার পছন্দ্ হইবো না?
এই সময় বাইরে থেকে অনুচ্চ কিন্তু উৎকণ্ঠিত ডাক আসে, করম ভাই… ও করম ভাই… ডাকের মধ্যে কেমন অজানা আতঙ্কের সুর। এই কণ্ঠ আলতুর, কিন্তু আলতুর এই কণ্ঠ কখনো শোনেনি তারা। করমালি আর আইশার বুক কেঁপে ওঠে। করমালি কাঁপা কণ্ঠেই জিজ্ঞেস করে, কে… আলতু না… কি হইছে?
‘বাইরে আসো তাড়াতাড়ি…’
বাইরে বেরিয়েই গিয়েছিলো করমালি আর আইশা।
আর বেরিয়েই আলতুর শরীরে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো রুগ্ন ভগ্ন রূপসীকে দেখে দু’জনেই বোবা হয়ে যায়। আলতু অহেতুকই বলে, চুপ। কারণ কেউ কোনো কথা বলছিলো না আলতু ছাড়া। বলে, ভিতরে লও। কেউ দেখে নাই। মেডিকেলের গলির মুখ থেইকা রিকশায় কইরা নিয়া আসছি। কেউ দেখে নাই। কেউ না। ঘরে লও। চুপ।
ঘরে ঢুকেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠতে চায় রপসী। কিন্তু আইশা তীব্র শক্তিতে চেপে ধরে তার মুখ। ওই ফোঁপানির মধ্যেই জানা যায় মটরসাইকেলের  কথা, চারটা পোলার কথা, স্বাস্থ্য-আপা ওকে রাস্তার পাশে রেখে যাবার পরই ওইসব কুত্তার বাচ্চাদের ঝাঁপিয়ে পরার কথা। কিন্তু এসব কেউ শুনতে চায়নি, এসব সকলেরই যেন জানা।
রূপসী কাঁদতেই থাকে, কিছুটা ব্যথায় আর অনেকটা ভয়ে। আইশা মুখ চেপে থাকতে থাকতে ধমকে ওঠে। আলতু বলে, কেউ দেখে নাই তো…
এবার ঘোরটা যেন কাটে করমালির। আলতুর বাহু টেনে নিয়ে যায় একপাশে, বলে, আল্লার দোহাই লাগে আলতু, কেউ যেন না জানে।
আলতু বড়বড় চোখ ক’রে বলে, এইটা কি বললা করম ভাই…! রূপসা আমার মাইয়া না… তারে রিকশায় কইরা সবার নজর বাঁচাইয়া কি আমি আনছি বেবাকরে কওনের লাইগা…!
করমালির তবুও স্বস্তি হয় না, সে রূপসার দিকে তাকায়- মেয়েটা মুখ গুঁজে ফোঁপাচ্ছে তার মায়ের কোলে। করমালি পকেট থেকে মোবাইলটা বের ক’রে আলতুর হাতে দেয়। বলে, ‘ভাইটি আমার জিনিসখান রাখো… আর আর এই টাকাগুলাও’ বলতে বলতে আবারো পকেটে হাত চালায় সে, যা টাকা বের হয়ে আসে তার সবটাই দিয়ে দেয় আলতুকে। ঝড়ে ডানা ভাঙা পাখির মত আর্তি ওঠে তার কণ্ঠে, ‘আলতু, তুমি আমার জন্যি অনেক করছো… আরেকটা উফকার কইরো ভাই… রূপসার এই কথা কারেও কইয়ো না… কারেও না…।’
আলতু মোবাইল টাকা সবই নির্বিঘ্নে নেয় এবং আবারো বলে, রূপসা আমার মাইয়া না… আমি কমু ক্যান…! তুমরা থাহো, আমি বাহিরটা দেইখ্যা আসি…
আলতু চলে যায়। করমালি এবার তার মেয়ের কাছে বসে। পিঠে হাত বুলাতে গিয়েও বুলাতে পারে না, কেনো পারে না, করমালি নিজেও জানে না। শুধু বৌয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, গোসল করাও। অন্য কোনো জামাকাপড় দেও। আইশা তাকিয়ে থাকে তার স্বামীর দিকে, যার বাঁ হাতে তখনো মেয়ের জন্য
নিয়ে আসা বালা দু’টো আলগোছে দুলছে॥


('নতুন ধারা'য় প্রকাশিত)