শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৪

পিঁপড়াবিদ্যা: ফিরে আসছেন কি ফারুকী?













এই কদিন আগেই সবাই মিলে গেলাম দেখতে... আর কি... পিঁপড়াবিদ্যা।
পিঁপড়াবিদ্যা হলো মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর প্রথম বাংলা শিরোনামের সিনেমা-- এরকম করে ভাবা যায়- যেহেতু তার আগের সিনেমাগুলোর নাম 'ব্যাচেলর', 'মেড ইন বাংলাদেশ', থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার', 'টেলিভিশন'। এইসব নাম ছেড়ে হঠাৎ ফারুকী নাম দিলেন এই সিনেমাটার--- 'পিঁপড়াবিদ্যা'। বাংলা নাম বটে... এবং নামের মধ্যে কী যেন একটা আলাদা আলাদা ব্যাপারও আছে, ওই ব্যাপারটা খুঁজতে আমরা টিকিটের কথা ভাবি।

সিনেমাটা রিলিজ হওয়ার আগে, যেমন সব সিনেমারই আসে, তেমনভাবেই সিনেমার ট্রেলার এসেছিল বাজারে। বাজার মানে ইউটিউবে। (ইউটিউব এখন বাজার বটে)। ট্রেলার দেখে কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছিল না সিনেমার। আর এই ট্রেলার দেখেই সবাইকে সিনেমার গল্প লেখার একটা প্রতিযোগীতাও আহ্বান করেছিলেন ফারুকী। অনেকে তাতে অংশগ্রহণও করেছিলো। কোনো এক টিভি চ্যানেলে ফারুকী বলছিলেন যে যারা গল্প পাঠিয়েছে তাদের কিছু গল্প খুবই সুন্দর... খুবই নতুনত্ব আছে গল্পে।

এসব দেখে-শুনে মনে হচ্ছিল, হুদাই এইসব। বিজ্ঞাপনের নতুন স্টাইল আরকি...! তো পরে আবার ভাবলাম বিজ্ঞাপনের নতুন স্টাইল তো খারাপ জিনিস না! নতুন নতুন স্টাইলের বিজ্ঞাপন তো ক্রিয়েটিভিটি।

বলাকা সিনেমা হলে আগে থেকে বলে, টিকিটের ব্যবস্থা করে, আমরা কজন গেলাম। হলের বাইরে বিরাট একটা ব্যানার। ব্যানারে নানা রকম চিত্র ও কথা লেখা থাকলেও মূলত ফারুকীকে হাইলাইট করা হয়েছে। এর পেছনে মূল কারণ 'পিঁপড়াবিদ্যা'য় কোনো স্টার সুপারস্টার তো নাই। না থাকায়, যেমনটা হওয়া সিনেমার জন্য জরুরি, ডিরেক্টরই হেড সব কিছুর, তেমনটাই হয়েছে। এই হওয়া খুব দরকার বলে মনে হয়। এই হওয়া ছড়িয়ে যাওয়া উচিত আরো বেশি। এই পিঁপড়াবিদ্যায় ফলে ডিরেক্টরই স্টার। এইটা ফারুকীর একটা ব্যাপার যে ফারুকী তার তৈরী নাটকেও এবং আগের সিনেমাগুলোতেও প্রধান স্টার। কখনো কখনো একলা স্টার। এটা একটা সিনেমার জন্য এবং সিনেমার সামগ্রিক প্রবাহের জন্য খুব ইতিবাচক মনে হয়।

হলের ভেতরে লোক ছিল বেশ। আর সিনেমা শুরু হতেই তালি আর চাপা হাসি ছিল। যেসব হিউমারে চাপা হাসি চলছিল সেসব শুধু তাৎক্ষণিক হাসি ছিলো না। কিছু হাসি ছিলো ফারুকীর কাজে পরিচিত মানুষের হাসি। তারা জানে ফারুকী এমনে এমনে দেখাবে... ফলে তাদের ভেতর প্রস্তুতি থাকে... আর সেই প্রস্তুতির পর তাদের আশাকে পর্দায় দেখতে পেয়ে হাসে... তারা মনে মনে বা কানে কানে বলে, কইছিলাম না... কইছিলাম না... দেখো... দোখো এখন কী করে...

তারা জানে ফারুকী এমন করে। তারা পূর্ব অভিজ্ঞতা ও বর্তমান হিউমারে হাসে। তারা হাসতে চাইছে বলেও অবশ্য হাসছে এবং তালি বাজাচ্ছে, এরকম মনে হয় আমাদের।

সিনেমায় মিঠু নামের যে ছেলেটা অভিনয় করছিল না তাকে বেশ লাগছিল। তার একটা ইন্টারভিউ পড়ছিলাম সিনেমার আগে... সে বলছিল সে নাকি অভিনয় টভিনয় করতে আসে নি... সে ডিরেক্টর হতে চায়... এরপরে সে ডিরেক্টরের কাজই করবে... তো মিঠুকে দেখে মনে হলো সে অভিনয় করছেও না আসলে... আসলে মিঠু যেমন তার জীবনে তেমনই যেন আছে পর্দায়। এটা ফারুকীর আরেকটা গুণ (কখনো দোষও)... তিনি তার ক্যারেক্টারদের দিয়ে অভিনয় করাযন না। বিশেষত অ্যামেচাররা তার হাতে ভালো খেলে।

এই মিঠু যার চাকরি নাই বাকরি নাই আয় নাই... তার একটা ছোট বোন আর অচল বাবা ও মুখরা মায়ের পরিবার... যে পরিবার অর্থকষ্টে আছে বলে বোনের প্রাইভেট কাল থেকে বন্ধ হয়ে যাবেই বলে মনে হচ্ছে এরকম এক মিঠু সিগারেটের সেলসম্যান থেকে এমএলএম ব্যবসায় ধাবিত হয়। এই মিঠু যখন তার স্বপ্নের কথা বলে যে কোনো বিদেশীনিকে বিয়ে করে বিদেশ চলে যাওয়া তখন হল ফাটিয়ে তালি পড়ে... বুঝতে পারি এসব তরুণের চোখেও তো বিদেশ ও বিদেশীনি লেগে আছে! ফারুকী দক্ষ ডাক্তারের মতো তাদের পালস ধরে থাকেন। মনে হয় বাংলাদেশের এই দরিদ্র কিন্তু স্বপ্নে বিভোর পালসটা ফারুকী খুব সিধেভাবে আছড়ালেন আমাদের সামনে। হল তালিতে ভরে থাকে, হাসিতেও। মিঠুর সংলাপ বলায় আরো হুল্লোড় ওঠে। এই মিঠু একটা চুরির সেকেন্ডহ্যান্ড ফোন কেনে। আর আমরা এখান থেকেই মূলত গল্পে প্রবেশ করি। এই ফোনটি শিনার। শিনা এই গল্পের নায়িকা বটে। এবং সে ওই সিনেমার চরিত্রেও নায়িকা। মডেল, অভিনয়শিল্পী। জনপ্রিয়। মিঠু শিনার চুরি যাওয়া ফোনটাই কেনে। আর শিনা তার ফোনটা খুঁজছে পাগলের মতো, কারণ ফোনে আছে একটা বিশেষ ভিডিও চিত্র। এই চিত্র শিনার বয়ফ্রেন্ড করেছিল। কোথাও না বললেও না দেখালেও বোঝা যায় ভিডিও চিত্রটিতে শিনা ও তার বয়ফ্রেন্ডের বিছানার দৃশ্য আছে। ফলে আমরা উৎকণ্ঠিত হই এবং একটু দমআটকা সচেতনতা নিয়ে অপেক্ষা করি কী ঘটতে যাচ্ছে।

শিনার অনুরোধে ফোনটা ফেরত দেয় মিঠু। শিনা বুঝতে পারে না মিঠু ভিডিওটা দেখেছে কিনা... শিনার ভেতর চাপ তৈরি হয়। আমাদের ভেতরেও। মিঠু অবশ্র নানাভাবে ফেভার চায় শিনার।শিনা তা করেও যায়। আর এক সময় শিনাকে মিঠু জানায় সেই ভিডিওটা সে অন্য কোথাও কপি করে রেখেছে। মিঠু সেই ভিডিওটা নষ্ট করে দেয়ার বদলে শিনার সাথে স্বামী-স্ত্রীর অভিনয় করতে চায়। একটা পর্যায়ে শিনা মিঠুকে ফ্ল্যাট থেকে বের করে দেয়।

আরো গল্প আছে কিছুটা। মানে গল্পের পরিণতি আছে। সেটুকু বলার দরকার দেখি না। পরিণতি দেখাতে গিয়ে ফারুকী বিভিন্ন সিম্বল ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তবু, বিরতির (বিরতিটা পরিকল্পিত নয় বলেই মনে হয়েছে) আগে পর্যন্ত গল্প যেমন সেলাইহীনভাবে যাচ্ছিল... তেমনটা আর পাই না পরে গিয়ে। পরের অংশে শিনার লম্বা অনুপস্থিতি আর বেশ কয়েকবার মিঠুর পয়েন্ট অব ভিউ থেকে বেরিয়ে মিঠুর পুরনো প্রেমিকার স্বামীর পয়েন্ট অব ভিউটা ব্যক্তিগতভাবে আমাকে পীড়া দিয়েছে। আর চূড়ান্ত পরিণতিটা কি খুব বেশি ক্লিশে?
জানি না। কিন্তু কেনে যেন মনে হলো আরো অন্য কিছু কি হতে পারতো? আরো অন্য কিছু কি হতো পারতো?

আবার ভাবলাম এই যে আরো অন্য কিছু কি হতে পারতো বলে দর্শককে এক ধরনের ভাবনার মধ্যে ফেলে দেওয়া এটাও কি ফারুকীর সাফল্য নয়? হয়তো।

১ ঘণ্টা ৩০ মিনিটের কি সিনেমাটা? কিন্তু ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিটের কি হতে পারতো? কিন্তু ফারুকী তা করেন নি কেন? 'টেলিফিল্ম হয়ে গেছে' এরকম শোনার ভয়ে?

ফারুকী কি এখন আর এসব ভয় পান? বিশ্বাস করি না।

পিঁপড়াবিদ্যায় ফারুকী আছেন, প্রবলভাবেই আছেন। যেমন তিনি তাঁর নাটকগুলোতে ছিলেন। সিনেমায় এসে তিনি মাঝেমাঝে আপোস করেছেন বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু পিঁপড়াবিদ্যাটা দেখে মনে হলো ফারুকী ফিরে এসেছেন।

গল্পের নায়িকা শিনা নায়িকা হওয়ায় ফারুকী ইচ্ছা করলেই আরো গ্ল্যামার-গান ইত্যাদি দেখাতে পারতেন, খুব সুযোগ ছিল সিনেমায়, ইচ্ছা করলেই ফর্মুলার মধ্যে থাকতে পারতেন, কিন্তু ফারুকী তা থাকেন নি। তিনি নিজের গল্পটা নিজের স্টাইলেই বলতে চেয়েছেন... তিনি নিজের একটা ভাষা দাঁড় করাতে চাচ্ছেন... এই জন্যই ফারুকীকে দশে দশ দেয়া যায়। তবু কঞ্জুশ শিক্ষকের মতো আরো তিনটা নাম্বার কেটে রাখতে চাই। কাটতে চাই শেষের ওই পনের মিনিটের জন্য।

শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৪

খুন


নিচের দিকে তাকাতেই মাথাটা ঘুরে উঠল। বাপরে... মানুষগুলো বামন হয়ে গেছে সব। আমি যেন তালগাছের মাথায়, বা তারো বেশি। আমি নিজেকে বললাম, এই অসুখের নাম কি হাইফোবিয়া...
আমার ভেতরে যে আরেকটা আমি থাকি সে তাড়াতাড়ি বলল, মূর্খ... এর একটা ভালো নাম আছে ইংরেজিতে। ওইটা এরকম হাইফোবিয়ার মতো সহজ কিছু না... যারতার সাথে ফোবিয়া লাগাইয়া বললেই হইল?
আমি অপেক্ষা করছি। ভাবছি যে ওই নামটা আমার অন্যঅংশটা বলবে। কিন্তু অন্য অংশ নীরব। ছাদও নীরব। তের তলার ওপরে যে ছাদ তাতে একাধীক জন থাকলেও সরবতা আসার কথা না। ঢাকা এখান থেকে বেশ সুন্দর নগরী মনে হয়, ফলে অধিক সময় শব্দহীন থাকার কথা ভাবা যায়।
অবশ্য আমি কতক্ষণ ভাববো সেটা একটা কথা! মানে আমার বেশিরভাগ সময়ই মনে হয়েছে এই যে এত জীবনের টাইট সব গিট তার কারণ ভাবা আর ভাবি। জীবনের মোক্ষ কী? মানে সাধু না হলেও মানুষের একটা গোল থাকে, ভাবে যে অমুক.. সেটা... সেটা কি শেষাবধি ভালো থাকা স্বস্তির থাকা না? মনে হয় যে এত ভাবতে গিয়ে ওই ভালো থাকাটা আর হয় না। মাঝে মাঝে মনে হয় মূর্খের ভালো থাকা অনন্য। তখন মূর্খকে দারুণ ঈর্ষা হয়। তবে এই ঈর্ষার মধ্যে একটা রোমান্টিকতা আছে কিনা তা নিয়ে আরো পরে ভাবি... তখন বুঝি যে যত আর যাই করি এই ভাবনাটা আর আমার থেকে আলাদা হবে না। ফলে সিদ্ধান্ত নিই যে এবার আমিই ভাবনা থেকে আলাদা হয়ে যাবো। ভাবনাগুলোকে এই ফাঁকা তেরতলার ছাদে রেখে নিজে লাফিয়ে পড়ব নিচে... ভাবনার খেতাপুড়ি।
পরিকল্পনা মতোই সব হয়েছে।
না হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমার পরিকল্পনা বরাবরই খুব ভালো হয়। পরবিকল্পনার বাস্তবায়ন হয় তারচেয়েও ভালো। প্রথম খুনটার কথাই ধরুন... হা হা করে উঠলেন নাকি? খুনের মতো অপরাধের কথা অম্লানে বলছি এটা ভেবে তো... শোনেন একটা কথা-- আমার এই খুনটুনের কথা শুনে আপনারা যখন আমার কাছে আসতে চাইবেন, আমাকে পাকরাও করতে চাইবেন তার আগেই আমি এই ছাদ থেকে লাফ দিয়ে একেবারে পগারপাড়...! ফলে প্রথম খুন বা... বুঝতেই পারছেন প্রথম খুন মানে দ্বিতীয় খুনও আছে... এসব বলতে আমার তেমন কিছু যায় আসে না... তো ওই প্রথম খুনটা আমি করি বেশ অল্প বয়সেই। তখন আমি এইটে... খুনটা করেছিলাম জলিলকে। জলিল আমার ক্লাশমেট...
আচ্ছা, সময় তো একটু আছে। পুরো ব্যাপারটাই বলি... আমরা তখন ক্লাশ এইটে পড়ি। প্রচুর পড়ালেখা করছি কারণ বৃত্তি পরীক্ষা দিতে হবে। সকালবেলা এক্সট্রা ক্লাশ করি। সময় ঘনিয়ে আসছে পরীক্ষার, আর আমাদের হাত-পা যেন সেঁধিয়ে আসছে শরীরের ভেতর। আমি আর জলিল পাশাপাশি বাড়ি... ধুমসে পড়ছি। আমরা জানি, আমরা দুজনই, বৃত্তি পাবো--- ট্যালেন্টপুলেই পাবো...!
জেলা সদর চাঁপাই নবাবগঞ্জে গিয়ে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে আসি আমরা। দুই দিন পরীক্ষা। প্রথম দিন দারুণ পরীক্ষা দিলাম দুজনেই। প্রশ্নপত্র মিলিয়ে দেখলাম কে কত নাম্বার পাবো... জলিল জানালো আমি নাকি তিন মার্কস কম পাবো।
দ্বিতীয় দিনের পরীক্ষার আগে ধড়ফড় করে মারা গেল জলিল। কীভাবে? হে হে হে... ওই যে বললাম না পরিকল্পনা... আমার পরিকল্পনা বরাবরই খুব ভালো...!
Like
(চলবে...)

বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৪

পার্ক বাজার


মানোয়া মাঝি ছিল এককালে, এখন একটা জাল থাকার কারণে- সে জেলে।

জালটা দিয়ে বেড়িবাঁধে মাছ মারে সে। সারারাত মাছ মেরে যা জমে তা শহরের বিভিন্ন মহল্লায় ফেরি ক’রে বিক্রি করে। তবে ডান পায়ে হঠাৎই বেকায়দা চোট পাওয়ায় ফেরি করা তার জন্য দুরূহ হয়ে পড়ল। উপায়ন্তর না দেখে ধানমন্ডি পার্কের পাশে সে মাছের ডালা নিয়ে বসে পড়ল।

ধানমন্ডি পার্কে স্বাস্থ্য সচেতনদের যথেষ্ট ভিড়। সকালের দিকে এই ভিড় বাড়তির দিকে থাকে। স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তিদের মাছপ্রীতি প্রবল। মানোয়া মাঝির বিক্রিবাট্টা ভালোই হতে লাগল। ক’দিনের মধ্যে মানোয়া মাঝির মতো আরো কিছু বিপন্ন জেলে জমে গেল পার্কের পাশে। পার্কে আসা লোকজনেরও উৎসাহ বাড়ল। সকালের জগিং শেষে মাছ নিয়ে তারা ঘরে ফিরতে শুরু করল।

 কিছুদিনের মধ্যেই জায়গাটা জমে গেল একেবারে। যারা পেশাদার মাছ বিক্রেতা তারাও সেখানে উপস্থিত। সকাল থেকে বেলা নয়টা পর্যন্ত এক লট মাছ বিক্রি ক’রে তারা পুরনো বাজারে ফিরে যায়। বাজারের থেকে বেশি দাম হাঁকায় পার্কের বাজারে- কাস্টমার খরিদও করে। দেখতে দেখতে পুরোদস্তুর মাছ বাজারে পরিণত হলো জায়গাটা।

 কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে এল কাচা বাজারের ভ্যান। আলু, পটল, বরবটি, করলা- মিস্টি কুমরা, পুঁইয়ের ডগা, লালশাক। আম এল জাম এল কাঁঠাল এল, এল পেয়ারা সফেদা কামরাঙা।

মুস্তফা কশাই এল ভ্যানে করে গরুর মাংস নিয়ে। তার দেখাদেখি এল জিল্লুর কশাইও। পার্কের পাশে রোজ গরু পড়তে শুরু করল। স্বাস্থ্য সচেতনরা খাসির মাংসের অভাব বোধ করতে থাকলে খাসিও এল। নিয়মিত দুটো ছাগলের ছাল ছাড়ানো হতে লাগল সেখানে।

পার্ক বাজারের এক কোনায় ভ্যানে করে লুঙ্গি আর গামছা বিক্রি করতে শুরু করল এমাজুদ্দি। আন্ডারওয়্যার আর স্যান্ডোগেঞ্জি নিয়ে বসলো মতিলাল।

পার্ক বাজার রমরমা।

ফলে সরকারী ছাত্র এল। বখরা।

বিরোধী ছাত্র এল। বখরা।

স্থানীয় ভাই এল। বখরা।

বাজার স্বেচ্ছাসেবক এল। বখরা।

বখরা নিয়ে সরকারে সরকারে, বিরোধে বিরোধে, ভাইয়ে ভাইয়ে, স্বোচ্ছাসেবকে স্বেচ্ছাসেবকে মাঝে-মাঝেই খুনোখুনি হতে লাগল। বখরা বাড়তে থাকল। ফলে মাছ-সবজি-মাংসেরও দাম বাড়ল। স্বাস্থ্য সচেতনরা খুশি- বেশি দাম মানে ভালো জিনিস- ভালো জিনিস মানে ফরমালিন মুক্ত জিনিস!

পার্ক বাজারে মানোয়া মাঝি ও তার মতো জেলেরা শুধু টিকতে পারলো না। সরকারী, বিরোধী, ভাই, স্বেচ্ছাসেবকদের বখরা দেওয়ার পর তাদের নিজেদের জন্য আর কিছু থাকে না। মানোয়া মাঝি মাছ নিয়ে মহল্লায় মহল্লায় ফেরি করা শুরু করল। তার পা ততোদিনে ভালো হয়ে গিয়েছিল।

০১.০৭.২০১৩
ধানমন্ডি

রবিবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৪

আবু নাসিম বা লখিন্দর কোনোটিই তার নাম ছিল না... (পাঁচ)




পাঁচ.

ঘরে ফিরতে রাত হয় লখিন্দরের।

এ এমন নতুন কিছু তো নয়। কিন্তু তবু, গাড়ি থেকে নেমে, নিজের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে, সব কিছু যেন নতুনই লাগে লখিন্দরের। এই সোডিয়াম আলো, ঘোলাটে রাস্তা, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নৈশ-কুকুর সব কিছুই যেন নতুনভাবে নতুনসাজে দাঁড়িয়েছে লখিন্দরের সামনে।
গাড়ি তার ঢুকে যাচ্ছিল গ্যারেজে, ধীর আর শান্তভাবে। তা দেখে, লখিন্দরের মনে হলো, তার জীবনটাও কি এমনই কোনো গ্যারেজের সন্ধান করেছে এতকাল? আর এই এখন সে একটা গ্যারেজে, মোহনীয়ই বলতে হয় তাকে, ঢুকে যেতে পেরেছে? বা ঢুকে হয়তো যায় নি... কিন্তু জায়গাটার সন্ধান যেন পেয়েছে... সে জানে কোথায় এখন তাকে যেতে হবে... সে জেনেছে কি?

লখিন্দর তার প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকায়। আছে। একটা ফুলতোলা রুমাল সেখানে আছে। বেড়ালের পেটের মতো নরোম আর তুলতুলে রুমাল, অথচ কেমন যেন উষ্ণ-- এই উষ্ণতা কি রঞ্জনার নাকি লখিন্দরের হৃদয়ের? হাতের মুঠোর ভেতর রুমালটা নিয়ে লখিন্দর একটু চাপ দেয়, তারপরেই ছেড়ে দেয়। ছেড়ে দেয় কি আসলে? নাকি ছাড়ার ভান করতে থাকে? লখিন্দরকে আমরা যত চিনবো যত দেখবো ততই এই প্রশ্নটা আমাদের উদ্বেল করবে যে সে আসলে আজ পর্যন্ত যা-কিছু ছেড়ে দিয়েছে তার সবই সত্যি নাকি তার অধিকাংশই আসলে এক ধরনের ছেড়ে দেয়ার ভান? এই ভান তার নিজের সাথেই কি? আমরা কিছুই নিশ্চিত হতে পারি না। নিশ্চিত হতে পারে না লখিন্দরও। ড্রাইভার গাড়ি গ্যারেজ করে নেমে পড়ে। লখিন্দর গাড়ির জায়গায় যেন নিজেকেই দেখতে পায়। যেন হেডলাইটের মতো জেগে থাকা এক পলকে নিভিয়ে এই কোমলতার ভেতর-- এটা কি ভ্রুণ তবে-- লখিন্দর নিজেকে গ্যারেজ করে। যেন হাঁটুর কাছে নিজের মাথাটা নিয়ে কুণ্ডলি পাকিয়েছে সে, যেন পেয়ে গেছে যা পাওয়ার; নতুন আর কিছুই পাবার বা পেরিয়ে যাবার তার নেই। যেন এখানেই বন্দর, যেন এখানেই তার নোঙর পড়েছে, যেন এখানেই সে থেকে যেতে চেয়েছিল। যেন, জীবনের এই অংশটার জন্যই, সে বেঁচেছিল।

কিন্তু, পরক্ষণেই, লখিন্দর টলে ওঠে। তার একটা ঝড়ের কথা মনে আসে। যা তার অভিজ্ঞানে এসেছিল ডুবে যাওয়ার ভেতর। আর ডুবতে ডুবতেও তো সে ভেবেছিল এই বুঝি তার গন্তব্য। তাহলে মানুষের গন্তব্য ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হয়? বদলে যায়? মানুষ বদলে যায় না আসলে-- আসলে তার গন্তব্য বদলে যায়?

ড্রাইভার এগিয়ে আসে। লখিন্দরকে কী যেন বলে, লখিন্দর শুনতে পায় না, বা বুঝতে পারে না, বা শুনতে সে ঠিকই পায় বুঝতে সে ঠিকই পারে, কিন্তু শুনতে বা বুঝতে সে চায় না। ড্রাইভার চলে যায় কি? লখিন্দরের মনে হয় ড্রাইভার চলে যাক। তার চোখের সামনে থেকে চলে যাক, তার জীবন থেকে চলে যাক, তার হৃদয় থেকে চলে যাক-- সে তার জীবনে কোনো ড্রাইভার রাখতে চায় না। সে চায় না কেউ তার জীবন চালিয়ে নিয়ে যাক। লখিন্দর ঠিক করে আগামীকাল সকালেই সে ড্রাইভারটাকে বিদায় জানিয়ে দেবে এবং তারপরেই, বিদায় জানাবে রঞ্জনাকে।

আমাদের ভেতর প্রশ্ন জাগে ড্রাইভারের সাথে সাথে রঞ্জনার কথাও কেন মনে আসে লখিন্দরের? সাথে এও মনে হয় লখিন্দর কি আসলে ভয় পেয়েছে? ভয়টা কি বিলীন হবার? কিন্তু সে একটা জীবন পর্যন্ত অন্য একটা জীবনে বিলীনই হতে চেয়েছিল। নাকি লখিন্দর আসলে ভয় পেয়েছে সানগ্লাশের আড়ালে থাকা সাপের মতো সেই শান্ত দুটো চোখকে! আমান খানকে কি লখিন্দর ভয় পায়?

অথচ এই আমান খানের চোখেই লখিন্দর আজ দেখল ভয়। নগ্ন ভয়। আমান খানের চোখে? আমাদের অবিশ্বাসই হয়। অথচ লখিন্দরের সাথে আমরাও কি তা প্রত্যক্ষ করি নি? আমান খানের চোখে ভয়ই বটে। আজ, বাবুভাইয়ের পার্টিতে, রঞ্জনা আর লখিন্দরের ভেতর যখন বয়ে যাচ্ছে কথার স্রোত, লখিন্দরের যখন মনে হচ্ছে সে আসলে ভেসে যাচ্ছে কোথাও... আর তার বারবার মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের সেই গানটা যে আমি ডুবতে রাজি আছি অথচ তার মনে হচ্ছে সে আসলে ভাসতেই রাজি আছে... এরকম স্মৃতি, সঙ্গীত ও দ্বন্দের ভেতর যখন লখিন্দর আর তখনই একজন এগিয়ে আসে তাদের দিকে। মৃদু হাসতে হাসতে। লখিন্দরের চোখের কোণা সেই এগিয়ে আসা ব্যক্তিকে আর তারপরেই আমান খানকে দেখে। আর আমান খানকে দেখে বিস্মিত হতে হয় লখিন্দরকে। ওই মাঝারি আকৃতির মানুষটাকে এগিয়ে আসতে দেখে আমান খান যেন গলে যায়, যেন একখণ্ড মোম মাত্রই আগুনের আঁচ পেয়েছে... গলে যাচ্ছে আমান খান, গলে গলে যেন পায়ের কাছে জমে যাচ্ছে, আর এর বিগলনের উত্তাপ নিয়ে এগিয়ে আসছে সেই মাঝারি বা বেঁটে আকৃতির মানুষটি। মানুষটির পেছনে আরো দুটি মানুষ। তাদের চোখ হিসহিসে, তাকানোর মধ্যে কেমন সাবধানী ভাব... এগুলো কি তবে গানম্যান?

গানম্যান? এই শব্দটা মাথায় আসার সাথে সাথেই পুরো দৃশ্যটা যেন বুঝে ওঠে লখিন্দর। আরো একবার আড়চোখে তাকায় সে আমান খানের দিকে। দেখে আমান খান তার চশমাটা খুলে ফেলেছে-- তার মেকআপহীন চোখের নিচ দুটো মদে মদে ফুলে ঢোলের মতো হয়ে আছে। আর চোখে অদ্ভুত ধরনের এক বিনয়, গলে পড়ার জড়িয়ে থাকার এক আকুতি... তবে সবকিছু ছাপিয়ে ওই চোখ দুটো থেকে যা ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল তা হলো ভয়। লখিন্দর মানুষের চোখকে পড়াই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের মনে করেছিল, আর সেই মুহূর্তে আমান খানের চোখ পড়তে গিয়ে তার মনে হয়েছিল এই যে মাঝারি বা প্রায় বেঁটে আকৃতির লোকটি, যাকে সে একটু আগে চিনতে পেরেছে বলে ধারণা করছে, তার ক্ষমতা তার অর্জন এতটাই ব্যাপক যে আমান খানের মতো প্রতাপও গুঁড়িয়ে যায়; বর্ষায় ভেজা মুড়ির মতো বা অক্ষম পৌরুষের মতো নেতিয়ে পড়ে; লখিন্দর যার কথা এতদিন শুনেছিল, কিন্তু দেখে নি একবারও-- মানুষ এড়িয়ে চলতে চাইলেও যার পার্টির দাওয়াত একবারের জন্যও উপেক্ষা করার কথা ভাবে নি লখিন্দর... তাদের দিকে এগিয়ে আসা সেই মাঝারি আকৃতির মানুষটার আসলে রয়েছে সম্মোহনের শক্তি। ফলে লখিন্দর লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়। আর সেই সম্মোহনের ভেতরেই লখিন্দর দেখে ছুটে যাচ্ছে আমান খান... কুজো হয়ে। যেন চুম্বকের দিকে ছুটে যাচ্ছে প্রাণহীন লৌহখণ্ড... নাকি আসলে মোমখণ্ড ছুটে যাচ্ছে আগুনের দিকে? এইবার বোধহয় গলে একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাবে। হাতটা বাড়িয়ে দেয় আমান খান, কোনোমতে। লখিন্দর দেখে এমনকি রঞ্জনাও যেন কুকড়ে গেছে। লখিন্দরের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে রঞ্জনা, অথবা শ্বাস নেয়, অথবা খুব অস্পষ্ট একটা শব্দ করে। আর শব্দের মধ্যে একটা নাম খেলে যায়, ঘুরে ঘুরে যায় যেন।

--- বাবুভাই। বাবুভাই।

নামটা যেন একটা জলের ঘুর্ণির ভেতর ঘুরতেই থাকে, পাক খায় বারবার। লখিন্দর জেনেছে এই ব্যক্তিটি বাবুভাই না হয়ে অন্য কেউ হতেই পারেন না। তারপরও, রঞ্জনার বলার পর, তার মনে হয় নামটা যেন প্রথমবারের মতো শুনলো। লখিন্দর রঞ্জনার দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে যায়। রঞ্জনার রূপচর্চিত ওই মুখটা তার মুখের খুব কাছাকাছি, গালের রঙের আভাটুকু যেন লখিন্দেরর চোখের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে, সাথে অদ্ভুত এক সুঘ্রাণ-- লখিন্দরের মনে হলো এই ঘ্রাণ রঞ্জনার কোনো অতল থেকে আসছে-- নাভি থেকে কি? হরিণের যেমন কস্তুরি-- মৃগনাভি কি রয়েছে রঞ্জনারও? এই ঘ্রাণে লখিন্দরের আবিষ্ট হয়ে থাকার কথা ছিল অন্তত আধাবেলা, অথচ লখিন্দর দেখে সেই ঘ্রাণ ছাপিয়ে তার চোখ-নাক-কানসহ সমস্ত ইন্দ্রিয় ছুটে চলে যাচ্ছে বাবুভাইয়ের দিকে। যেন বাবুভাই জীবন্ত কোনো মাদক। ধেয়ে আসছে, আর বইয়ে নিয়ে যাচ্ছে মানুষের সমস্ত আবেগ আর অনুভূতি।

বাবুভাইয়ের উদ্দেশ্যে শূন্যে ছুঁড়ে দেয়া আমান খানের হাতটা অবশেষে বাবুভাই ধরেন। হাসেন। হেসেই আমান খানের দিক থেকে মাথা ফিরিয়ে তাকান লখিন্দরের দিকে। এই তাকানোটা যেন এক দিক নির্দেশনা আমাদের জন্য-- যেন আমরা বুঝতে পারি এভাবেই দৃশ্যের সাথে সাথে দৃষ্টি, আর দৃষ্টির সাথে সাথে দৃশ্য বদলে দিতে থাকে মানুষ। আমান খানকে ধরেই রাখেন বাবুভাই, আর তার চোখ পড়ে থাকে লখিন্দরের দিকে। লখিন্দর যেন একটু ঝুঁকে যায়। নিজের অজান্তেই। ঝুঁকে বিনয়ের হাসি হাসতে যায়। আর তখনই জলদকণ্ঠ শোনা যায়। বাবুভাই কথা বলতে শুরু করেন। বলেন, কেমন আছো...

লখিন্দর প্রায় জবাব দিয়েই ফেলছিল। আর তখন, কোনো এক কারণে, সে বুঝল এই প্রশ্ন তাকে করা হয় নি। আর তখনই, তার পেছন থেকে, রঞ্জনা জবাব দিয়ে উঠল, ভালো আছি বাবুভাই... ভালো আছি...
রঞ্জনা এগিয়ে বাবুভাইয়ের আরেকটা হাত ধরে ফেলল। লখিন্দর দেখল এক হাতে আমান খান আর আরেক হাতে রঞ্জনাকে নিয়ে বাবুভাই দাঁড়িয়ে আছেন তারই সামনে-- যেন পুরো ঢাকাই ফিল্ম তার করায়ত্ত্বে, এমনই মনে হয় লখিন্দরের; আর নিজেকে অনতিদূরের নিতান্ত দর্শক ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না সে। এরকম সময়গুলোতে লখিন্দর, এর আগেই তো আসলে এরকম অনেক সময়ই পেরিয়ে এসেছে সে, গুটিয়ে যায় সাধারণত। নিজের উপস্থিতি বোঝানোর জন্য বাড়তি কিছুই করে নি সে কখনো, সাধারণত চুপচাপ চলে গেছে, বা মুখটা হাসি হাসি করে দাঁড়িয়ে থেকেছে এতদিন। কিন্তু এখন সে কি লখিন্দর নয়? এখন সে রাস্তায় বেরোলে কি হুল্লোড় ওঠে না! সাধারণ মানুষ থেকে ঘরের মানুষ সবার কি আলাদা নজর সে আশা করে না? সে কি এখনো সেই স্ট্রাগল অ্যাকটর? এখনো নবাগত? তার পেছনে কি এখন সুপার হিট নেই? তার হাতে কি নেই হিট সুপার হিট হওয়ার মতো আরো ক'খানা ছবি?

লখিন্দরের অপমানবোধ হওয়ার কথা। অথচ তার বদলে, কী আশ্চর্যজনকভাবে, তার ভেতর তৈরি হচ্ছে শ্রদ্ধা। আর নিজের ভেতর এই অনুভূতি দেখে লখিন্দর বিস্মিত হয়। নিজের আরেকটি অংশ, যা এতকাল কোথায় ছিল জানে না লখিন্দর, আবিষ্কার করে। ক'রে, সে অভিনেতা বলেই বোধহয়, আনন্দিত হয়। তার মনেহয় অভিনয় তো অন্য কিছু না বরং নিজের ভেতর নিজেকেই আবিষ্কার করা। আর নিজের এই আরেকটি অংশ আবিষ্কার করার পর তার লোভ জাগে। লোভ জাগে এমন একটা চরিত্রে অভিনয় করতে যা আসলে এক ড্রাগ স্মাগলার, চোরাচালানকারী অথচ সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত একটা ব্যক্তিকে দেখার পর অপমানের বদলে শ্রদ্ধা জাগে। তাহলে সেই চরিত্রটি কেমন হবে? সামাজিকভাবে তার অবস্থান কী হবে? সে কি আর হিরো হয়ে থাকতে পারবে, নাকি ভিলেন হয়ে যাবে?

এখন কাল ভিলেনের, ভাবে লখিন্দর। তবে তা অবশ্যই সিনেমায় নয়, বাস্তবে। অথবা ভিলেনের কালই ছিল সর্বদা। আর ভিলেনের কাল ছিল বলেই রূপালি পর্দায় চোখেমুখেঠোঁটে রঙ এঁকে লখিন্দরদের নায়ক সাজতে হয়। রঙিন পর্দাজুড়ে ভিলেনকে শায়েস্তা করতে হয়। যে কাজ বাস্তবে সম্ভব হয় না মানুষ তাই দেখতে চায় সিনেমায়-- সিনেমা এমনই এক মহার্ঘ! লখিন্দেরর ভেতর এবার শ্লেষ তৈরি হয়। তবে তা ক্ষণকালমাত্র। সামনে বাবুভাইয়ের মতো ওজনদার একজনকে রেখে আর যায় হোক শ্লেষাত্মক থাকতে নেই, এটুকু বোঝে লখিন্দর। শ্লেষের আগে তৈরি হওয়া ওই যে শ্রদ্ধাবোধ সেটা কি উড়ে গেল তবে? না। লখিন্দর বুঝতে পারে শ্রদ্ধাটা তার বেশ শক্ত ইঁটের গাঁথুনিতে উঠেছে-- অত সহজে তা টলবার নয়।

বাবুভাই, দুইহাতে বাংলার দুই মহান হিরো হিরোইনকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যাকে চিনেও চেনে না লখিন্দর, বুঝেও সবটা বোঝে না সে। আর লখিন্দরের সাথে সাথে আমাদেরও উচিত তাকে একটু চিনে নেয়া। অবশ্য বাবুভাইকে না চেনাটা কম জানাটাই আমাদের জন্য কম ঝুঁকির। কিন্তু গল্প শোনা তো সব সময় ঝুঁকিহীন থাকে না, আর থাকে না বলেই লখিন্দর আর রঞ্জনা আর আমান খানের এই গল্পের ভেতর দুজন গানম্যান নিয়ে উপস্থিত হয় বাবুভাই। উচ্চতায় প্রায় নগন্য সাড়ে চার ফিটের এই ব্যক্তির দুই হাতে চার চারে আটটি আঙটি। দামী পাথর আর সোনারূপা মিলিয়ে হাতের আঙুলগুলো ঝিলিক দেয় সব সময়। পরনে শাদা লুঙ্গি, শাদা শার্ট। এতই শাদা যে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখ ধাঁধিয়ে যেতে পারে। ছোট ছোট চুল পাকা গোঁফ চুনে পোড়া ঠোঁট কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে শীতল দুটো চোখ। আর সেই শীতলতায় বাবুভাই তাকিয়ে আছেন লখিন্দরের দিকে। লখিন্দরের মনে হয় এই চোখ দিয়ে সমুদ্রের তলদেশ থেকে গভীর কোনো খাদের ভেতর থেকে ঝিনুকমুক্তো তুলে আনা যায়। লখিন্দরের মনে হয় তার প্রতিটি হৃদস্পন্দন যেন দেখতে পাচ্ছেন বাবুভাই।

এবার বাবুভাই তার ডান হাতটা ছাড়িয়ে নেন। এই শহরের সবচেয়ে অন্ধকারের মানুষ, যিনি কখনোই ক্যামেরার ফ্ল্যাশে ধরা পড়েন নি, আর পড়লেও তার ছবি কখনোই কোথাও ছাপা হয় না... তিনি তার হাত থেকে ছাড়িয়ে নেন আমান খানকে। ছাড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে আসেন আরেকটু। ফলে পিছিয়ে যায় আমান খান-- যেন সিনেমা থেকেই। আর সেই হাতে টেনে নেন লখিন্দরকে। টেনে নেন মানে বাড়িয়ে দেন লখিন্দরের দিকে। আর লখিন্দর নিজেই সেই নাগপাশে, নাগপাশ শব্দটা ভেবেই লখিন্দরের ভেতর শিহরণ তৈরি হয়, নিজেকে বন্দি হতে দেয়। জড়িয়ে যায় যেন। আর এক ফাঁকে তাকিয়ে নেয় আমান খানের দিকে। আমান খান একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেও মনে হয় বাবুভাই আর তার মধ্যে অন্তত তিনটা সমুদ্রের দূরত্ব তৈরি হয়ে যাচ্ছে। আর এই সমুদ্র দূরত্বের এই পাড়ে লখিন্দরকে যেন আঁকড়ে ধরেন বাবুভাই। আর তখনই লখিন্দর শোনে সেই কথাটা। সেই কথা, যা শোনার জন্য ব্যাকূল থাকে এই বাংলার হিরো হিরোইন। সেই শব্দ যা শোনার পর থেকেই লখিন্দরের মনে হচ্ছে তার জীবনের গাড়িটা এবার বোধহয় গ্যারেজ পেয়েছে... বন্দর পাচ্ছে তার জাহাজ... যেন সে জীবনানন্দ দাশ... হাঁটতে হাঁটতে এসেছে নাটোর...

বাবুভাই লখিন্দরের পিঠে আরেকটু চাপ দিয়ে রঞ্জনার দিকে তাকান। অল্প হাসেন। তারপর লখিন্দরের পিঠের ওপর চাপটা কমিয়ে দেন। বলেন, লখিন্দর, তুমাকে আমার ফিল্মে নিলাম...

লখিন্দর এখন তার গ্যারেজের দিকে তার গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবুভাইয়ের ওই কথাগুলো যেন ঘুরতেই থাকে বারবার... লখিন্দর, তুমাকে আমার ফিল্মে নিলাম... তুমাকে আমার ফিল্মে নিলাম... তুমাকে আমার ফিল্মে নিলাম...

বাবুভাই ছিলেন সেই সময়ের ঢাকাই ফিল্মের সবচেয়ে বড় প্রডিওসার। লখিন্দর তখনো জানে না এই বড় প্রডিওসারের বড় সিনেমা করতে গিয়েই বড় একটা ঘটনা ঘটবে তার জীবনে। আর আমরা এখন নিশ্চিত সেই বড় ঘটনার ভেতরে ছড়িয়ে থাকবে রঞ্জনা। তবে সে ঘটনা জানতে আমাদের আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে!

(চলবে...)

ছবি: আহমেদ খান হীরক