বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৪

য পলায়তি স জীবতি



ভিড় ঠেলে বাস থেকে নেমে এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না ফনি। বড় রাস্তা পেরিয়ে সাবানের কারখানাকে ডানে রেখে একটা সরু গলিতে ঢুকে পড়ে দ্রুত। পিছনে কোনো হইচই হচ্ছে কিনা জানতে খুব ইচ্ছা হয়, কিন্তু ব্যাগটা সাথেই আছে; এটা এখন ব্যাগ না-- আস্ত আগুন, অতএব পলায়নই উৎকৃষ্ট পন্থা!

ফনি চুরি যেমন ভালোবাসে, চুরিই তার পেশা, তেমনি সে ভালোবাসে পালাতেও। আজকের চোর সে না-- গ্রামে তার খ্যাতি ছিলো। এই খ্যাতি, যে-কোনো খ্যাতির মতোই, একদিনে গড়ে ওঠে নি। ফনি যেখানেই চুরি করতে গেছে, আগে ঠিকঠাক দেখে রেখেছে পালানোর উপায়। যেখানে পালানো কঠিন সেখানে চুরি করাকে রেখেছে কম বিবেচনায়।
গ্রামে আয় কম, যন্ত্রণা বেশি। আশপাশের দু’দশ গ্রামজুড়ে যেখানে যা চুরি হোক শালিসে তাকে হাজির থাকতেই হবে-- জেরার পর জেরা, চেয়ারম্যানের জবরদস্তি, থানাপুলিশের ভয়, সত্যমিথ্যা উভয়ক্ষেত্রেই বাঁশের বাড়ি, --যখন একেবারে নিরুপায়, তখন গ্রাম ছাড়ে ফনি। ট্রেনে চেপে নামে নিচ্চিতপুর জংশনে। ট্রেন থেকে সেদিন তার আয় হয়েছিলো দু’ছড়ি কলা, দেড় কেজি মতো আটা আর কৌটায় ভরা গুঁড়াদুধ।

জংশন বড় মজার জায়গা। হাজার পাগলের আড্ডাখানা, ফনির অন্তত তাই মনে হয়। নানান কিসিমের পাগল-- কোটটাইপ্যান্ট পরা থেকে কানাবুদ্ধুল্যাংড়া, কিংবা গহনায় আগাপাছতলামোড়া কোলবালিশ থেকে ব্লাউজবিহীন জুলেখা পর্যন্ত সকলের আনাগোনা। কেউ যাত্রী কেউ কুলি কেউ ভিক্ষুক কেউ সালসাবিক্রেতা কেউ পকেটমার কেউ বেশ্যা কেউ বেশ্যার দালাল কেউ গাঁজাবিক্রেতা কেউ খরিদ্দার-- কিন্তু সবাই পাগলা। জংশন ফনির খুব প্রিয় হয়ে ওঠে-- যত মানুষ তত গ্যানজাম তত্ত ইনকাম। ট্রেন থেকে মানুষ নামছে গলগল, আবার হু হু করে মানুষ উঠছেও-- এত মানুষ কোথা থেকে আসে, কোথায় যায়?

ট্রেনের হুইসেল, কুলির হাঁক, যাত্রীদের ঠেলাঠেলি, মাইকে প্লাটফর্মে দাঁড়ানোর অনুরোধ, চায়ের কাপে চিনি মেশানোর শব্দ, বাদাম ডাব ভাজা পান সিগারেট ফেরির চিৎকার, সব মিলিয়ে এমন ভজংঘট এমন চাঞ্চল্য যে ফনির নেশা লেগে যায়। রাতে ঘুমায় ওভার ব্রিজের ওপর; সে একা না, কম করে তিরিশজনের নিত্য বিছানা ওই লোহার পালঙ্ক। সারাদিন পকেট কেটে, এদিকের মাল ওদিক করে ফনির খুব রোজগার হয় না। অথচ তারই মতো আরো কেউ কেউ দিব্যি ফুরফুরে দিন কাটায়, সকালসন্ধ্যা চাগাঁজাবিড়ি খায়, রাতে অনেকে মশা তাড়ানোর কয়েলও জ্বালে। ফনি চতুরতার সাথে ওদের সঙ্গে মিশে যায়। দেখে কেস ভিন্ন। এদের আয়ের পথ বহুমুখী-- কেবল পকেট কাটা কিংবা মাল সটকানোর মধ্যেই এরা বদ্ধ নয়-- কালোবাজারি মাল থেকে শুরু করে লাইনের স্লিপার চুরি, এরা সবই করে। এরা শুধু ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে না, নিজের কাজে স্বাবলম্বীও! ফনি গ্রামের সহজ সরল চোর, অন্ধকারে গৃহস্থের বাড়ি ঢুকে কাঁসার থালাবাসন ধানচাল হাতানোই ছিলো তার প্রধান জীবিকা, মাঝেমধ্যে দু’একটা হাঁসমুরগিছাগল; জংশনের এই বিশাল কারবারের সাথে মানিয়ে নিতে তার কিছুদিন সময় লাগে। তবে ফনি পুরো বিষয়টা আয়ত্ত করে ফেলতে পারে, জংশনের কারবারে সে চৌকশ হয়ে ওঠে। একজনকে সে গুরুও বানিয়ে ফেলে। গুরু বলে, ফনা তুই মুখ রাখবি মুর... তুই মুর যুগ্য শিরসো!

গুরু তখন পেট ভরে তাড়ি খেয়ে মাতাল। ফনি তাকিয়ে থাকে গুরুর কোমরের দিকে, সেখানে মোটা কালো ডোরা দিয়ে বাঁধা টাকার থলে-- থলেটা সবসময় ফুলে থাকে, ফনি মনে মনে ভিতরের টাকার পরিমাণ আন্দাজের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়, এই ব্যর্থতা তার ভালো লাগে না। গুরু বলে, আরেক গিলাশ খারে ফনা...
ফনি বলে, আর তো পারি না গুরু... বেজায় বাস!
গুরু বলে, দুররো ব্যাটা! আয় লাক টিপ্প্যা আরেক গিলাশ খা... প্যাটে গেলে গুণ আছে!

গুরু ট্রেনের একটা পরিত্যক্ত বগিতে বাস করতো। জংশনের কিছু লাইন বহুদিন থেকে অব্যবহৃত ছিলো, তারই একটাতে গুরু চোকিবিছনাবালিশ পেতে লিকা করেছিলো পদ্মকে। ফনির গুরুভক্তির একটা কারণ পদ্ম। গুরু শুকনা টিংটিঙা বুড়া, অথচ পদ্মর মতোন টসটসা বউ সে রাখছে-- গুরুর কপাল ‘মিলিস্টার’ কপাল-- ওই কপালের সাথে কপাল ঘঁষলে নিশ্চয় কিছু একটা হয়! গুরু বলে, তুর হইবো ফনা, তুরই হইবো... মনতাজ হালার পুতে পারবো না... ব্যাটায় হইছে মাগিবাজ। মাগি ধরছে যে জিন্দা মরছে সে! অর সব ঢুকবো মাগির ফুটায়!
ফনি বলে, গুরু আপনের দুয়া!
গুরু খুব খুশি হয়, বলে, দুয়া করি বড় চুর হ। জীবনটার তামানই হইল চুরি। সকুনেই চুর। আল্লাও চুররে ব্যাটা!
ফনির নেশা একটু টশকায়। বলে, আল্লাও চুর?
গুরু বলে, হুম, হে চুরি করে মাইনষের জীবন... ক, কথা ঠিক কিনা?
ফনি বলে, জ্বে, কথা ঠিক। খুবই উচিত কথা!

তখন দু’জনেরই নেশা চড়া। দু’জনেই আবোল-তাবোল বকে, গালাগালি করতে থাকে যাকে তাকে। বগির ভেতর থেকে ভেসে আসে পদ্মর হাসির খিলখিল আওয়াজ। খিলখিল খিলখিল। ফনি সাগ্রহে শোনে। ভেতরে পারদ বইতে থাকে। গুরু বলে, ওই খানকির বেটি খানকি, চুপ থাক! এত্তো রঙ কিল্ল্যা?
অদ্ভুত ব্যাপার, হাসি থামে না, আরো বেড়ে যায়। ফনির ভেতর ঝিলিক দিয়ে দিয়ে পারদ নাচানাচি করতে থাকে। গুরু মুখ ঝামটায়, বলে, ফনা, মাগি হইল সাপের জাইত। হাদিছে বলছে মাগির ফুটা দুজখের দুয়ার। ওইদিকে দেখলে চোখের জ্যুতিক্ষয় হয়। হ্যাদের বিশ্বাস রাখবি না... দ্যাখছোস না পয়সা বান্ধা রাখি মাঞ্জাতে!
গুরু অনবরত তার কোমরে বাঁধা থলের ওপর চাপড় দিতে থাকে। কিন্তু ফনির সেদিকে আর নজর যায় না। সে তন্ময় হয়ে শোনে গুরুপত্নির হাসি, খিলখিল খিলখিল, পারদ ঝলকায় যেন, ফনি কোন এক ঘোরের ভিতর চলে যায়। গুরুর কণ্ঠ সেই সুদূর থেকে যেন ভেসে আসে। গুরু বলে, সিজিন আসতাছেরে ফনা... আয়-ইনকামের সিজিন... মালগাড়ি পুরা পুরা গহম আসবো, বগি ফাঁসা আর ছালা ভর। গহম তো লয় সুনা পড়বো সুনা। ফনারে...

ফনি একটু দেরি করে বলে, জ্বে?

গুরু বলে, খাড়াইতে পারি না রে ফনা... আমারে উঠা...

ফনি প্রতিরাতে গুরুর এই আব্দারের অপেক্ষায় থাকে। গুরুকে ধরে সে বগিতে ওঠে। গুরু টলতে টলতে বিছানায় শুয়ে পড়ে। পদ্মর পানে রাঙা ঠোঁটে তখনো হাসির আভা। ফনি ইতস্তত করে। যাবার উপক্রম হয়। বলে, থাকেন...
গুরু ততক্ষণে ঘুমে, বা জ্ঞানে, তলিয়ে গেছে। পদ্ম বলে, আপনের নিশা হয় নাই?
ফনি ঘাড় বাঁকায়, লম্বা করে শ্বাস টানে। বলে, হইলে?
খিলখিল করে হেসে ওঠে পদ্ম, বলে, ঠিক যেন জালালি কবুতর। বাকুম বাকুম... আর বাকবাকুম...
ফনির বুকটা ধড়াস করে ওঠে। পদ্মর তীরনজর।
পদ্ম তার ঘাড়টা একটু বাঁকায়। বলে, আচার খাইবেন? আচার খাইলে নিশা পলায়...
ফনি বলে, লাগতো না।
পদ্ম বলে, না লাগলেই ভালা... মুর বাঁচে!

পদ্মর সাথে এমন কথপোকথন ফনির প্রায় দৈনিকই হতো। একদিন আচার নিতে গিয়ে সে জড়িয়ে ধরেছিলো পদ্মকে। সেদিন নেশা বোধহয় বেশিই হয়েছিলো, নাহলে আচারের কী প্রয়োজন? পদ্ম তার শ্যামলা কোমল শরীর ঘুরিয়ে বলেছিলো, মিনসা বড় রসিলা গো... গুরুর নাঙে হাত চালায়!

ফনি আজন্ম লজ্জাহীন।
গ্রামে একবার মাথা ন্যাড়া করে চুন মাখিয়ে তাকে অপমানজনক শাস্তি দেবার চেষ্টা করা হয়েছিলো-- ফনি অপমানিতও হয় নি, লজ্জাও পায় নি-- বরং তার সুখ হচ্ছিল এই ভেবে যে চুরির মালগুলো ধরা পড়ে নি, এত কষ্টের উপার্জন গাঙে ভাসে নি। সেই ফনি পদ্মর কথায় লজ্জা পায়, কোমরে পেঁচানো হাতটা দ্রুত সরিয়ে নেয়। কিন্তু ফনির সেদিন বেজায় নেশা-- পদ্মকে সে আবারো জড়িয়ে ধরে, কাছে টেনে নেয়। পদ্মর শরীরের ঘামের গন্ধ ফনির মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দেয়, পারদ অহস্য রকমের দ্রুতায় ছটফট করতে থাকে; সে আরো কাছে, একেবারে বুকের ওপর, লেপ্টে নেয় পদ্মকে। পদ্ম হাসে না আর, তার মুখ দপ করে নিভে যায়। কেমন বিভ্রান্ত চোখে ফনির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী যেন খোঁজে।
ফনি বলে, তোরে আমি লমু। লমুই। খুদার কসম লাগে!
পদ্মর বুকের ছন্দ বৃদ্ধি হয়, বলে, কই নিবা? তুমার তো ঘর নাই... তুমার ঘর নাই ক্যান?
পদ্মকে নিজের বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে নিতে ফনি বলে, ঘর বানামু।
পদ্ম বলে, তুমার গুরু তুমারে জবাই দিবো।
ফনি বলে, পলামু। দূরে। শহরে পলামু। যাবি না?

পদ্ম আবারো হাসতে শুরু করে। হাসতে হাসতে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় ফনির কুণ্ডলি থেকে। বলে, যান ঘুমান গিয়া! আপনের আইজ নিশা লাগছে বহুত!

একটা ঘরের জন্য সেদিন ফনির সে কী হাহাকার! ঘর, একটা মাত্র ঘর। পদ্মকে নিয়ে থাকার মতো ঘর।
ওভারব্রিজের ওপর শুয়ে শুয়ে তার নির্ঘুম রাত কাটে। বুকে ভিতর টনটনে ব্যথা। পারদের ধাক্কা। গ্রামে যে তার ঘর ছিলো না তা নয়, কিন্তু এই জংসরে কোনোদিন সে-ঘরের কথা তার মনে আসে নি। চাল গলে যাওয়া, দেয়াল ভেঙে ধ্বসে যাওয়া ঘর-- তবু তো ঘর। পরিত্যক্ত বগিগুলো অন্ধকারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে, ফনির ওরকম একটা বগি পেলেও চলে। কিন্তু সেগুলো দখলের জন্য যে ক্ষমতা দরকার, ফনির তা নেই। ফনি বিড়ি জ্বালে, ফসফস করে ধোঁয়া টানে, দূরে জারুল গাছের নিচে আইশারা দাঁড়িয়ে আছে-- দুটো মাতাল ওদের সাথে দরদাম করছে, তৃপ্তি ভাতের হোটেল থেকে কটকটে শব্দে হিন্দি গান ভেসে আসছে, সোবাননগরের ট্রেন লেট-- যাত্রীরা রেলকর্তৃপক্ষের মা-বোন তুলে গালাগালি করছে-- ফনির কোনো কিছুই ভালো লাগে না। সে উঠে বসে, আবার শুয়ে যায়, আবার উঠে বসে। তার বুকগলাজিভ শুকিয়ে খবরের কাগজের মতো হয়ে যায়-- একটা মাতালের সাথে দূর্গার দরদাম ঠিক হয়, তারা জারুল গাছের পিছনে গাঢ় অন্ধকারে চলে যায়। দূর্গার কণ্ঠ শোনা যায়, কামড়াইস ক্যা শুয়োরের পুত... বিচ্চি গালাই দিমু হারামি... তাত্তারি খালাশ কর...
ফনির ভেতরের পারদ চিড়বিড়িয়ে ওঠে। পদ্মকে তার চায়, আর পদ্মর জন্য তার চায় ঘর।

পদ্মর জন্য ফনির পিপাসা বাড়তেই থাকে। যেন দারুণ নেশা মাথার মধ্যে ঘোরপাক খায় চক্কর কাটে। বুকের ভিতর দলার ভার হিংস্র হয়ে ওঠে। সে জন্মাবধি বেড়ে উঠেছে পতিত জীবনে। তিরিশেরও বেশি বছর কেটেছে তার নষ্ট-ভ্রষ্ট যাপন। অর্থের বিনিময়ে, কখনো কথার মোহন চটুলতায়, কত নারীর শরীরও সে প্রেমে কামে ব্যবহার করেছে; কিন্তু এমন পিপাসা এমন নেশা এমন পাথরভার সে কখনো অনুভব করে নি। পদ্মকে একটু দেখার বাসনায়, তার পানে লাল ঠোঁটে অল্প একটু কথা শোনার আকাঙ্খায়, তাকে এই একটিমাত্রবার ছুঁয়ে দেবার কামনায়, সে কাতর হয়ে পড়ে। মনে হয় তার জ্বর হয়েছে, জ্বর আর ভালো হবে না কোনোদিন। তার তৃষ্ণা হিংস্রতার সাথে বেড়েই চলে নিদারুণভাবে। সে তাড়ি খায় গ্লাসের পর গ্লাস, তার নেশা হয় না। সে আরো খায়, তার নেশা হয় না। গুরু বলে, তুর কী হইল রে ফনা? কী হইছে মুরে ক দেকি!
ফনি বলে, কিচ্ছু হয় নাই!
গুরু আহত হয়ে বলে, মুরে কোবি না রে ফনা?
ফনির হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছা করে। বলে, গেরামের লাগি মনটা কেমুন কান্দে!
গুরু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকায়। বলে, উড়াল দ্যায় পক্ষিরে তার ঘুমায় থাকি কায়া-- কাইয়া মানে কি ক দেকি!
বগির ভিতর থেকে থালাবাসনের ঝনঝন শব্দ শোনা যায়। গুরু চিৎকার করে গালি দিয়ে ওঠে, ওই খানকির পয়দা... বেজায় রঙ ধরছে রে লুটির বেটি... রঙ তুর পুট্টিতে ডুকাই দিমু!
ফনির মাথায় আগুন ধরে যায়, হিংস্র আগুন। তার শিরাধমণীরক্তত্বক সব পুড়ে যায়, পুড়ে যেতে থাকে। সকল প্রত্যঙ্গ জ্বলে যায়, জ্বলে যেতে থাকে। বদনার তাড়ি তখনো শেষ হয় নি, লাত্থি মেরে বদনাটাকে ফেলে দেয় সে। গুরুরও নেশা কেবলই ধরেছে, সে রক্তাক্ত চোখে বলে, কী কললিরে ফনা?
ফনি টলমল পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে। হিসহিস করে বলে, অরে তুমি গাইল পারলা ক্যান?
প্রথমে গুরু বুঝতে পারে না কার কথা কীসের কথা বলছে ফনি। যখন পারে ভীষণ হয়ে ওঠে। বলে, কিল্লা জারুয়ার পুত... মুই কি তুর লাঙরে গাইলছি... তুর ক্যান পুট্টি ফাটে?

হঠাৎ ফনি যেন কিছুটা শান্ত হয়ে আসে। মাথাটা ঝিমঝিমায়। বলে, অরে আর গাইলবানা গুরু... এই কইলাম!
গুরুর সর্বশরীর কাঁপে, টলমল সেও উঠে দাঁড়ায়, বলে, খাড়া, তুরে দিতাছি পরে, আগে ঘরের লুটিটার ছাল ছাড়াই নি! ফনা তুরে...
গুরুর কথা জড়িয়ে আসে, সে তার দখল করা বগি ও বউয়ের দিকে এগোতে থাকে। যেতে যেতে ফনির গুষ্ঠির সকলকে করার কসম কাটে। ফনির বাপ যে চৌদ্দরও বেশি এই অজানা তথ্য ফনিকে জানিয়ে যায়।

সে রাতে পদ্মর উপর দিয়ে সুনামি কুনামি সব বয়ে যায়। ওভার ব্রিজের ওপর থেকেও ফনি স্পষ্ট আর্তি শুনতে পায়-- পদ্মর আর্তি, পদ্মর পশুর মতো গোঙরানি। ফনির ইচ্ছা করে গুরুর গলা টিপে ধরতে; তার কাছে আছে আগা বাঁকানো একটা ভোঁতা চাকু, সেইটাই আমূল গেঁথে দিতে ইচ্ছা করে গুরুর হাড়ের ভিতর; কিন্তু ততক্ষণে ফনির নেশা কেটে গেছে, একটা সিগারেট জ্বালে সে, বুঝতে পারে গুরুর সঙ্গে লাগতে যাওয়া বৃথা-- অত জোর নিচ্চিতপুর জংশনে তার নেই, কিংবা জীবনের কোনো অংশেই অত জোর তার ছিলো না। তাছাড়া লাগতে যাবেই বা কেনো? পদ্ম তার কে? এই একটি প্রশ্ন তাকে অদ্ভুতভাবে কিছুক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে। বিজাতীয় অভিমানে ফনি আপ্লুত হয়। পদ্মকে গুরু মেরে ফেলে দিক, দিয়ে রেল ক্রসিঙে ফেলে রাখুক তার লাশ; শরীরে আগুন লাগিয়ে দিক, দিয়ে প্ল্যাটফর্মের ডাস্টবিনে একদলা কাপড়ের মতো নুড়িসুড়ি ঢুকিয়ে রাখুক, তার কী? পদ্ম তার কে?

গুরুর বগিতে অনেক রাত পর্যন্ত নাটক হয়। জংশনের আর সমস্ত নাটকের মতো এ নাটকও গতানুগতিক, কেবল ফনির জন্য এ নাটকটি ছিলো ভিন্ন, বিভীষিকাময়, এবং দীর্ঘ। সে শুয়ে শুয়ে তারা ছড়ানো আকাশ দেখতে দেখতে সস্তার সিগারেট টানে, থুতু ফেলে, পদ্মর গোঙানি আর শোনা যায় না; নাটকের যবনিকা হয়েছে, অথচ নাটক চলতে থাকে, চলতেই থাকে ফনির বুকের ভিতর।

গভীর রাতে কারো স্পর্শে ফনির ঘুম ভাঙে, চোখ খুলে দেখে একটা পানপাতা মুখ বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। পদ্মকে চিনতে ফনির কয়েক মুহূর্ত দেরী হয়, দেরী হয় বাস্তবে ফিরে আসতে। পদ্ম বলে, মুরে নিবি?
ফনির মনে হয় সে স্বপ্ন দেখছে। পদ্ম আরো ঝুঁকে, ফনির শ্বাসের সাথে শ্বাস মিলিয়ে বলে, মুরে নিবি না?

পদ্মর ডান কপালের কাটা থ্যাতলানো অংশ থেকে এখনো রক্ত বেরিয়ে আসছেÑ দূরের থেকে আসা ঘোলা আলোয় রক্তগুলোকে কালচে আর বিচ্ছিন্ন কিছু মনে হয়। পদ্মর ঠোঁটের কোণায় আড়াআড়ি লম্বা গোল স্তব্ধতার মতো লেগে আছে গুরুর প্রতাপ। ফনির পদ্মর বাম বাহুটা আঁকড়ে ধরে বলে, লমু।
পদ্ম বলে, ল পলাইÑ টাউনে।

সেই থেকে ফনি শহরে। ফনি আর পদ্ম। ওই ভোরে তারা চেপে বসেছিলো একটা ট্রেনে, বিকেলের বেশ পরে নেমে এসেছিলো এই শহরে। প্রথম কয়েকটা দিন কাটিয়েছিলো ইস্টেশনে-পার্কে-ফুটপাতে। তারপর আস্তানা জুটেছে একটা অসম্পূর্ণ বিল্ডিঙের তৃতীয় তলায়। নির্মাণাধীন ওই বিল্ডিঙে তাদের সাথে থাকে আরো জনা বিশেক।

কাঁথার বিছানা, দুটো বালিশ, দুটো চাটাই দিয়ে ঘিরে তারা তাদের সংসার পেতেছে। ইঁটের চুলা বানিয়ে ছোট্ট পাতিলে রান্না হয়। ক’দিন আগে রইস তাদের একটা ছেঁড়া মশারিও দিয়েছে। রইসের সাথে ফনির খাতির ভালোÑ রইস-ই ফনিকে শিখিয়ে দিয়েছে এদিকের ব্যবসার নিয়ম-কানুন। রইসের লম্বা চুল, গোলগাল কালো মুখ, পানের খয়েরের রঙে দাঁত স্থায়ি হলুদ, খ্যাকখ্যাক করে হাসে-- হাসলে থুতু ছিটিয়ে সামনের জনের মুখ ভরিয়ে দেয়, তবু তাকে ভালো লাগে ফনির। রইস-ই তাদের ঠাঁই করে দিয়েছে এমন বেহেস্তি জায়গায়। নাহলে ফনির কি আর সাধ্য ছিলো জায়গাটা দখলের! অবশ্য প্রতিদিন তিরিশটা করে টাকা দিতে হয় রইসকে-- তবু তো ঘর! পদ্মর সাথে একটা বিছানা। একসাথে থাকা। এরচেয়ে বেশি চেয়েছিলো ফনি?
শহরটাকে ফনি এখনো ঠিক মতো চিনতে পারে নি-- এখানে দুই কিসিমের মানুষ দেখে সে। একগুলা বেজায় বড়লোক-- তাজমহলে থাকে খায় দায় ঘুমায়, নানান রঙের গাড়িতে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ায়; আর আরেকগুলান তাদের মতো আধ-হওয়া বাড়িতে, বস্তিতে থাকে খায় দায় ঘুমায়, রাস্তায় রাস্তায় ঘুড়ে বেড়ায় নানাপদের ধান্ধায়। দুই কিসিমের মানুষকেই ফনির চোর মনে হয়। ফনির মনে হতে থাকে আরেক কিসিমের মানুষও আছে এই টাউনটায়-- এরা বাসে রিকশায় লেগুনায় সিএনজি মিশুকে খালি দৌড়ায় আর দৌড়ায়Ñ এরাও চোর, তবে এরা চুরি করতে বহুত ডরায়। গুরুর কথা মনে পড়ে ফনির, সকুনেই চুর। আল্লাও চুর।

শহরে পদ্মর রূপের জেল্লা আরেকটু মনে হয় বাড়ে, অন্তত ফনির কাছে তাই লাগে। রাতের বেলা অসম্পূর্ণ বিল্ডিংটিতে যখন পর্দাবিহীন স্বচ্ছ আদিম উন্মাদনা আরম্ভ হয়, ফনিও পদ্মকে টেনে নেয়। কথাবার্তা হয় কম, কেবল ফিসফিসানি। রাস্তার সোডিয়াম আলোর আবছায়ায় ফনির কাছে পদ্ম ক্রমেই অপ্সরি হয়ে ওঠে। আশ-পাশ থেকে খিস্তি-খেউর ভেসে আসে, কেউ কেউ কুকুরের মতো হাঁপায়, জানুর মা প্রতিরাতে বিলাপ করে, জানুর বাপ খ্যাকায়, চুপ থাক মাগি!
পদ্মর বুকে মাথা গুঁজে ফনি তখন প্রশান্তি খোঁজে, ভেতরের পারদকে বয়ে যেতে দেয়। পদ্ম ঘন শ্বাসের সাথে বলে, এইখান থিইকা ল।
ফনি বলে, ক্যান, কী হইছে?
পদ্ম বলে, এমুন থাকতাম না খানকিগো লগে! মুকে ঘরে ল।
ফনি হিসহিসিয়ে ওঠে, বলে, হ... তুর বাপেয় রাজপরসাদ বানাইছে নি!
পদ্ম মুখ ঝামটায়। ফনির মুখ ঠেলে ব্লাউজের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলে, তয় লইলি ক্যান মুরে?
ফনি বলে, মুই লইছি? তুই আলি না বারোভাতারি?

পদ্ম একটা ঘর চায়।
কিন্তু ফনি জানে, চাইলেই ঘর পাওয়া যায় না। তারচেয়ে তারা এখানে বেশ আছে-- বৃষ্টিবাদলের ভয় নাই। তিনবেলা খাওয়া আর মাথা গুঁজবার একটা ঠাঁই হলেই তো হলো, মানুষ আর কী চায়? বিল্ডিংটার পাশেই একটা মেসবাড়িতে পদ্মর জন্য কাজ জুটিয়ে দিয়েছে রইস। দু’জনের আয়ে তাদের ছোট্ট পাতিলটা প্রতিদিন আগুনের উত্তাপ পায়, টিনের থালায় প্রতিদিন ভাত খায়-- গুরু বলতো, দুনিয়াটা চলতাছে দুই কারুণে-- প্যাট আর চ্যাটে, বুঝলিরে ফনা?

ফনি বোঝে, বোঝে বলেই এমন জায়গা সে ছাড়ে না। এখানে পেট শান্ত, দেহ শান্ত। পদ্মর ঘর্মঘ্রাণে মেতে থাকা দেহটা দুইহাতে চটকাতে চটকাতে ফনি বলে, কই যাইগা ক দেকি?
পদ্ম বলে, ঘরে ল। ক্যামুন মরদ... ঘর বানাইতে পারিস না!
ফনি তার ঘাড়টা ঘুরিয়ে খিকখিক করে হাসতে হাসতে বলে, কেমুন মরদ দেখবি?
পদ্ম বলে, থাউক... বড়া মুর মদ্দা ঘুড়া!
ফনি বলে, নিমু, তুরে ঘরেই নিমু। কট্টা দিন সবুর রাখ!

সাবানের কারখানা পেরিয়েই একটু আড়াল দেখে ব্যাগটা খোলে ফনি। কালো রঙের ঢাউস চামড়ার ব্যাগ, চারিদিকে চেইন। দৌড়ে ঘেমে হাঁপিয়ে উঠেছিলো ফনি, উত্তেজনায় তার চোখ চকচক করে-- সবুরের দিন শেষ হয়ে যাবে, ব্যাগে হয়তো অনেক টাকা পাওয়া যাবে। অন্তত বুড়াটা বাসের ভিতর যেমন আগলে রাখছিলো ব্যাগটা, ফনি নিশ্চিত-- ভিতরে জবরদস্ত কিছু আছেই। মাঝের চেইনটা খুলতে গিয়ে ফনির হাত কেঁপে ওঠে, এমন তো কখনো হয় না!
যদি অনেক টাকা থাকে, কত টাকা? অ-নে-ক টাকা, এত টাকা যে সে কখনো দেখে নি, তবে সে একটা ঘর কিনে ফেলবে; ওই বিল্ডিঙের পাশের বস্তিতেই পাওয়া যায়-- টিনের চালা, টিনের দেয়াল; দালাল ভিড়িয়ে সে দেখেও রেখেছে একটা ঘর-- পদ্মকে নিয়ে সংসার পাতবে।

কিন্তু ব্যাগ খুলে ফনি হতাশ হয়, তিন তিনটা মোটা বই-- অমন বুড়া দামড়া যে বই নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, কে জানে! বইয়ের সাথে পায় একটা পাঞ্জাবি একটা শার্ট লুঙ্গি গামছা আর ইয়া বড় আন্ডারওয়্যার। ফনি বুড়ার জন্ম টেনে গালি দেয়। তন্ন তন্ন ব্যাগ খুঁজে একটা হালাল সাবান ছাড়া আর কিছুই পায় না। ফনির হাতের তালু ভিজে ওঠে, মাথার ভিতর দপদপ করে, ব্যাগটাকে কাঁধে ঝুলিয়ে গলির বিপরীত মুখ থেকে বেরিয়ে একটা রিকশায় চেপে বসে সিগারেট ধরায়। তার হতাশ ভাবটা কাটতে থাকে, এমন আশা-নিরাশার ভিতর দিয়েই তার জীবন পেরিয়ে এসেছে তিরিশেরও বেশি বছর। সন্ধ্যার ফুরফুরে বাতাস তার ঘামে মাখা মুখে অদ্ভুত শীতলতা এনে দেয়। অদ্ভুত এক স্থিরতা নিয়ে সে চলতে থাকে সামনের দিকে, যেমন মানুষ যায়।

মানুষের বৈশিষ্ট্য নিয়েই ফনি সামনের দিকে এগিয়ে চলে নিশ্চিন্তে; সে জানে না কত কী বিস্ময় অপেক্ষা করছে তার জন্য, জানে না বলেই তার চলাটা এত স্থির, এত নিশ্চিত।

রিকশায় বসে বসে বইগুলো ওল্টাতে ওল্টাতে সে আবিষ্কার করবে ছয় ছয়টা হাজার টাকার নোট। আনন্দে সে আরেকটা সিগারেট ধরাবে, ঘুরিয়ে নেবে রিকশা। পদ্মর জন্য চুড়ি কিনবে, ঠোঁটের নখের রঙ কিনবে, চুলে বাঁধার বাহারি ফিতাও কিনবে। কিছুদিন থেকে স্যান্ডেলের জন্য ঘ্যানঘ্যান করছে পদ্ম-- সোনালী জড়ির কাজ করা একজোড়া স্যান্ডেলও সে কিনবে। কিছু বাজার সদাই করবে-- চাল ডাল আলু। পেঁয়াজপট্টির পিছনে গিয়ে ক’গ্লাস চোলাইও গিলবে। পান চিবাতে চিবাতে উপস্থিত হবে তাদের আস্তানায়-- এত বাজার দেখে পদ্ম কত খুশি হবে এই ভেবে তার মন চনমনিয়ে উঠবে।

কিন্তু হাতভরা বাজার আর বুকভরা খুশি নিয়ে ফনি যখন উপস্থিত হবে অসম্পূর্ণ ইমারতে তেতালায়, জানবে কাজ থেকে আজ ফেরে নি পদ্ম, জানবে পদ্ম আর ফিরবেও না কোনোদিন, পদ্ম চলে গেছে রইসের হাত ধরে একক কোনো ঘরের সন্ধানে।
তখন কি ফনি এমন নিশ্চিন্তে সিগারেট টানতে পারবে?

ফনি কষে কষে টান মারে সিগারেটে। রাস্তা পেরিয়ে তার রিকশা গলির দিকে এগিয়ে যায়। যে-গলি পেরোলেই ফনির অস্থায়ী ঘর তার জন্য অপেক্ষা করছে।

বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৪

ইজিজি











 
১.
‘মেয়েটি ছোট থেকেই যেন কেমন, আর পাঁচটা বাচ্চার মতো না। চুপচাপ থাকে। যেখানে বসিয়ে রাখা হয়, সেখানেই বসে থাকে। একা একা বিড়বিড় করে। স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড বলতে একমাত্র যা, তা হলো পিঁপড়ার সাথে খেলে। পিঁপড়াকে ডাকে ইজিজি। আর মেয়েটা, ধরা যাক তার নাম মেঘলা, আঙুলে পিঁপড়া নিয়ে অনবরত কথা বলতেই থাকে, বলতেই থাকে। শিশুদের অর্থহীন ভাষাতে বললেও পিঁপড়াগুলো মনেহয় সে ভাষা বুঝতে পারে। পিঁপড়া মেঘলার শরীর বেয়ে কাঁধে উঠে যায়। মেঘলা সুড়সুড়ি পাবার আনন্দে হি হি করে হাসে।’

এ পর্যন্ত লিখে থামে রায়হান। ল্যাপটপের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে অক্ষরগুলো। সিগারেট ধরাবে কি ধরাবে না সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
          ‘কফি কফি...’
          কফির কাপ নিয়ে ঘরে ঢোকে বৃষ্টি। অল্প ক’দিন হলো তারা বিয়ে করেছে। কফির কাপের দিকে তাকিয়ে রায়হানের মনে হয় তার আসলে কফির তৃষ্ণাই পেয়েছিল।
           ‘কী করো?’ কফির কাপ দিতে দিতে বৃষ্টি প্রশ্ন করে।
           ‘আর কি...!’ কাপে ছোট্ট চুমুক দেয় রায়হান। ‘লিখি বেগম সাহেবা... ঈদসংখ্যার গল্প! সম্পাদক মাথা খারাপ করে দিলো, বুঝছো!’
           ‘কী লেখো? শোনাও আমাকে...!’
‘আরে পত্রিকায় ছাপলে পড়ে নিও।’
‘আমি লেখক হলে এমন ত্যাড়ামি করতাম না মিস্টার... শোনাও না প্লি-জ...’
শেষের বাক্যে ঢঙ মিশ্রিত আব্দার ঝরে পড়ে।
           ‘হুম, আচ্ছা শোনো, এটা একটা মেয়ের গল্প...’
‘না না এভাবে না। যেমন লিখেছ তেমনি পড়ে শোনাও।’
‘ওকে!’
মেকি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রায়হান। তারপর পড়তে শুরু করে, ‘মেয়েটা ছোট থেকে যেন কেমন... ’
হাতের ওপর থুতনি রেখে গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে বৃষ্টি।


২.
‘জন্মের বছর দুই শেষ হতে না হতেই মেঘলার মা মারা যান।

দুপুরে ভাত খেয়ে একটু ঘুমানোর অভ্যাস ছিল মেঘলার মায়ের। মেঘলাকে বুকে নিয়ে দুধ দিতে দিতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন। সেই ঘুম ভাঙলো একবুক জ্বালা নিয়ে। শ্বাসের জন্য ঘরের সমস্ত বাতাস টেনে নিতে চাইলেন, পারলেন না। ডাক্তার বদ্যি ডাকার সুযোগ না দিয়ে, মুখে ফেনা তুলতে তুলতে, মারা গেলেন বিকেলে। মেঘলা তখনো দুধ খাচ্ছিল।

মাস তিনেক পরই মেঘলার ছোট খালাকে বিয়ে করেন বাবা। দুধের শিশুটিকে খালা প্রাণ দিয়ে আগলে রাখতেন। বাবা তো সারাদিনই বাইরে বাইরে, এই ব্যবসা সেই ব্যবসা নিয়ে হন্তদন্ত; খালাই তাকে মায়ের আদর-যত্ন দিয়ে বড় করেন। ইশকুলে পাঠান। হ্যাঁ, সাড়ে চার বছর বয়সেই মেঘলা ইশকুল যাওয়া শুরু করে। কিন্তু শিশুসুলভ নটখট, ওজর-আব্দার, চিৎকার ছিল না মোটেই। ইশকুলে গিয়ে, এক কোণের এক বেঞ্চে চুপচাপ বসে পড়তো। কারো সাথে ঝগড়া বা মারামারি নয়, কারো সাথে সদ্ভাবও নয়; তবে ক্লাস থ্রিতে একজন আসে— নাম রুমা। কী সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে। বড় বড় চুল। দু’দিকে দুটো বেণী ঝুলিয়ে, মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে, পড়ে। তাকে দেখলেই মেঘলার মন যেন ভালো হয়ে যায়। মেঘলাকে দেখলে রুমাও ছুটে আসে।

ব্যস, তাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ক্লাসে মেঘলা ফার্স্ট আর রুমা সেকেন্ড। আইশা আপা তো তাদের নাম দিয়ে ফেললেন মানিকজোড়! ফাইভে দু’জন বৃত্তি পেয়ে একই গার্লস হাইস্কুলে ভর্তি হলো। সিক্সটা ভালোই কাটলো, কিন্তু সেভেনে ভীষণ জ্বর হয়ে তিন মাস ইশকুলে যেতে পারলো না মেঘলা।

রুমা তাকে রোজ দেখতে আসতো, পাশে বসে বসে নতুন বাংলা বইয়ের ছড়া কবিতা শোনাতো। কিন্তু রুমাকে আর ভালো লাগতো না মেঘলার। সেভেনে রুমা ফার্স্ট হয়েছিল, আর সে সেকেন্ড— সেকেন্ড হওয়াটা সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিল না।

জ্বর ভালো হলেও মন ভালো হলো না মেঘলার। আর একদিন রুমারা বদলি হয়ে অন্য জায়গায় চলে গেল। অনেক পরে মেঘলা জানতে পেরেছিল রুমা নাকি ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছে। কেন কে জানে, মেঘলার মন সেদিন ভালো হয়ে গিয়েছিল।’

কলিংবেলের শব্দ। বৃষ্টি ল্যাপটপ বন্ধ করে দরজা খোলে। রায়হান।

           ‘কি ঘুমিয়ে ছিলে নাকি?’ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে রায়হান জিজ্ঞেস করে।
           ‘হুম।’
           ‘আজ অফিস থেকে আগেই ছাড়া পেয়ে গেলাম বুঝছো... অন্যসময় হলে একটু আড্ডাবাজি করতাম, কিন্তু ঘরে যে নতুন বউ..’
           ‘থাক আর আহ্লাদ দেখাতে হবে না... চা খাবা?’
           ‘কফি হলে জমে যায়।’
           ‘তুমি জামাকাপড় ছাড়ো, এক্ষুণি কফি দিচ্ছি!’
           ‘ল্যাপটপ বিছানায় কেন?’
           ‘বিয়ের ছবিগুলো দেখছিলাম।’
           ‘ও। ছবিগুলো বেশ তুলেছে, কি বলো?’
           ‘হুম।’


৩.
রায়হান নেই। বিছানার মাঝখানে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে বৃষ্টি। ছবির ফোল্ডারটা ওপেন করে কিছুক্ষণ এ-ছবি ও-ছবিতে ক্লিক করে। কিন্তু পরক্ষণেই ফোল্ডারটা মিনিমাইজ করে রায়হানের লেখার ফাইলটা খোলে। গল্পটা কই? কোন পর্যন্ত যেন পড়েছিল সে? এই তো—

‘মেঘলার খ্যাতি এখন মফস্বল জুড়ে। ভাল ছাত্রী সে ছিলই, এবার মৌসুমী প্রতিযোগীতায় ড্রইংয়ে রাজশাহী বিভাগে প্রথম হয়েছে— এখন যাবে একেবারে ঢাকায়। ঢাকা! এর আগে কখনো সে ঢাকা যায় নি। কী যে উত্তেজনা তার! অবশ্য তার সব উত্তেজনা আর ভালোলাগা ছেলেবেলার সেই খেলার সাথী ইজিজিদের সাথে। হরলিক্সের খালি একটা বয়ামে সে তার বন্ধুদের ঢুকিয়ে রেখেছে। সেটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলে, জানিস ইজিজি, আজ রাতে আমি ইয়া বড় একটা বাসে চড়বো। সাত ঘণ্টা চলার পর পৌঁছাবো ঢাকায়। হ্যাঁরে হ্যাঁ ঢাকা। রাজধানী। ঠাকুর স্যার আমাদের নিয়ে যাবেন। হ্যাঁ অবশ্যই... তোরাও যাবি... তোদের না খালি বড় বড় কথা! সামনে ম্যাট্রিক পরীক্ষা তো কী হয়েছে! দেখিস, আমি স্ট্যান্ড করবো! ওমা... মিষ্টি খাওয়াবো না আবার!’

মোবাইল বাজছে। হাতের কাছেই রাখা। কিন্তু ফোনটা ধরতে একদম ইচ্ছা করছে না বৃষ্টির। ডিসপ্লেতে দেখে রায়হানের নাম। অবশ্য নাম দেখার দরকার ছিল না। রায়হান ছাড়া অন্য কেউ তার নাম্বার জানেও না। আর জানবেই বা কে? সাতকূলে তো তার কেউ নেইও। ফোন রিসিভ করে বৃষ্টি।

‘হ্যালো, কী করছিলে?’
           ‘এইটা জানার জন্য ফোন দিয়েছো?’
           ‘আরে নাহ্, ধন্যবাদ দেয়ার জন্য ফোন দিয়েছি।’
           ‘কোন খুশিতে?’
           ‘আজকের লাঞ্চে চিংড়ি মাছের ভর্তাটা ফাটাফাটি ছিল...’
           ‘চিংড়ি মাছ না, জানো তো?’
           ‘হ্যাঁ হ্যাঁ জানি...’
           ‘লেখক হয়ে এমন ভুল করবে?’
           ‘শোনো, তিন মাসের বৈবাহিক অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বিয়ের পর লেখক আর লেখক থাকে না...’
           ‘কী হয়?’
           ‘হয় প্রেমিক না হয় শ্রমিক হয়ে যায়।’
           ‘তা তুমি কী হয়েছো?’
           ‘প্রেমিক ও শ্রমিক- যুগপৎ!’
           ‘ও আচ্ছা... তাহলে বিয়ের পর প্রেমিক হয়েছেন আপনি, আগে না?’
‘আরে না— আগেও তো প্রেমিক ছিলাম... উফ্ তুমি না খালি ভুল ধরো আমার!’
‘তা প্রেমিক সাহেব কখন আসবেন?’
           ‘তাড়াতাড়ি। যত দ্রুত সম্ভব। ঠিক আছে এখন রাখি।’
           ‘ওকে রাখো। বাই।’
‘বাই।’


৪.
‘মেঘলার ছোট খালা, মানে ছোট মা, মারা যান।

মেঘলা যেদিন ঢাকা থেকে ফিরলো, সেই রাতে। মেঘলা ঢাকায় জিততে পারে নি। সে জানে, সে ভালো ছবি এঁকেছিল। তবু সে পারে নি। ফিরতে ফিরতে ঠাকুর স্যার বলেছিলেন, মেঘলা মা, মন খারাপ করিস না। আমার নজরে তুই-ই সেরা। ওরা কারচুপি করছে করুক। জীবনটা তো আর কারচুপি না।
এ কথাটা মেঘলার খুব মনে ধরেছিল। জীবনটা তো আর কারচুপি না। মেঘলা ঘরে এসে, ব্যাগ থেকে বয়াম বের ক’রে, টেবিলে বইয়ের আড়ালে রেখে, শুয়ে গিয়েছিল।

ছোট মা’র গোঙানি পাওয়া গেল একটু পরেই। এত বছর পর, অনেক ডাক্তার কবিরাজের পর, ছোটমা’র পেটে বাচ্চা এসেছিল। সেই ফোলানো ফাঁপানো পেট ধরে গড়াগড়ি যেতে যেতে ছোট মা চিৎকার করে মেঘলাকে ডাকতে লাগলেন। মেঘলা বোধহয় ঘুমিয়েই গিয়েছিল, শুনতে পেল না। মৃত-বাচ্চা প্রসব করতে করতে, রক্তগঙ্গার ভেতর ছোট মা মারা গেলেন। ডাক্তার নিয়ে বাবা উপস্থিত হলে মেঘলার ঘুম ভাঙলো। ততক্ষণে মহল্লা তোলপাড়! দিক দিক থেকে মানুষ আসছে। মেঘলা বয়ামটা নিয়ে চুপচাপ বসেছিল নিজের ঘরের এক কোণে।

পরদিন সকালে ছোট মা’কে যখন তার মায়ের পাশে কবর দেয়ার কথা ঠিকঠাক হল, মেঘলা নিষেধ করলো তার বাবাকে। মেঘলার চোখে বাবা কী দেখলেন কে জানে, তবে দ্রুতই কবরের স্থান পরিবর্তন করলেন।’

এ পর্যন্ত লেখা। বৃষ্টি ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে বসলো। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ড্রেসিং টেবিলের সামনে। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে বের করলো একটা হরলিক্সের বয়াম। তাতে অসংখ্য পিঁপড়া। বয়ামটা উঁচু করে আয়নার সামনে ধরে বললো, রায়হান কী করে জানলো? তোরা বলেছিস? ...আবার নাকে নাকে বলছিস আমরা কিছুই বলি নি! তোরা না বললে কে বলবে? তোরা ছাড়া কে আছে আমার? কি? বলিস নি? মিথ্যা কথা মিথ্যা কথা মিথ্যা কথা!

টুংটাং। টুংটাং। কলিংবেলের শব্দ। বৃষ্টি তাড়াতাড়ি বয়ামটা ড্রয়ারের ভেতরে রাখলো। আয়নায় নিজের চুলটুল ঠিক করে নিলো। দরজাটা খুললো ঝটকায়। দেখলো কাজের বুয়া।
‘ও তুমি..’
‘হ আফা পোড়া কপাইল্যা আমিই। আর কে আইবো কন... কাম করতে করতে হাতে পইড়লো ফোস্কা, তাও কাম শ্যাষই হইলো না। কী, কাপড় ধোয়ান লাগবো, নাকি খালি ঘর মুছবো— কন।’
কথা বলতে বলতে বুয়া ঘরের ভেতরে ঢোকে। পানি নেয়ার জন্য বাথরুমের দরজা খুলেই চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘ও আল্লা গো... ও আফা গো... দেখেন দেখেন, কত পিঁপড়া কত্ত পিঁপড়া... লাক লাক পিঁপড়া... ও মাগো... আফা ঘরে কি কেরোসিন আছে?’

বুয়া মগে পানি নিয়ে পিঁপড়াগুলোর উপর ঢালতে থাকে। বৃষ্টি দৌড়ে এসে এক ধাক্কায় বুয়াকে সরিয়ে দেয়। চিৎকার করে বলে, ওদের মারবি না খবরদার। যা যা এখান থেকে হারামজাদি! যা।

স্পষ্ট গালিগালাজ করতে করতে বুয়া চলে যায়। যাওয়ার আগে বৃষ্টির কাণ্ড দেখে হতবাক হয়ে যায়। পানিতে ভেসে যাওয়া পিঁপড়াগুলোকে বৃষ্টি তখন ছেঁকে ছেঁকে উদ্ধার করে আনছে পরম মমতায়।


৫.
রাতের খাবারের পর ঝুলবারান্দায় গিয়ে রায়হান সাধারণত একটা সিগারেট খায়। আজ পরপর দুটা টানলো। মাথা কাজ করছে না। গল্পের পরের অংশ ভাবতে চেষ্টা করছে, পারছে না। অথচ কালই গল্পটা পাঠাতে হবে। বৃষ্টি এসে দাঁড়িয়েছে। রান্নাঘরের কাজ বোধহয় শেষ। বিদ্যুৎ গেল। রায়হান উঠে গিয়ে চার্জারলাইট অন করে।

বৃষ্টি বলে, কী হয়েছে, মুড অফ?

রায়হান চার্জারলাইট টেবিলের উপর রাখে। ঘর আধো অন্ধকার। হালকা বাতাস হচ্ছে। ঝুলবারান্দা লাগোয়া ঘরের জানালার পর্দাগুলো অল্প অল্প কাঁপছে। রায়হান বলে, পর্দাগুলো বদলাতে হবে। আরেকটু ভারী পর্দা দরকার।
           ‘এই জন্য তোমার মুড অফ?’
           ‘আরে না... মুড অফ ঠিক না... গল্পটার শেষ পাচ্ছি না, বুঝছো?’
           ‘কোন গল্পের?’
           ‘ওই যে তোমাকে শুনিয়েছিলাম... মেঘলার গল্প!’
           ‘আমি বলি গল্পের শেষটা?’
           ‘তুমিও যে গল্প লেখো তা তো জানতাম না... পেটে লাথ-টাথ মারার ইচ্ছা আছে নাকি! হা হা...!! ’
           ‘বলবো নাকি বলো... মেঘলার ছোট মা মারা গেল... তারপর তো?’
           ‘তুমি পড়েছ?’

রায়হানের কথা যেন ঠিক শুনতে পায় না বৃষ্টি। কেমন ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে সে। তার চোখ ধীরে ধীরে যেন দূর অন্য কোনো দিগন্তের সন্ধানে স্থির হয়ে গেছে।
কেমন রিনরিনে কণ্ঠে বলে, ‘ঢাকা থেকে ফিরলো যে রাতে, সে রাতেই মেঘলার ছোট মা মারা গেলেন। কেন? বাচ্চা হতে গিয়ে। কিন্তু মেঘলার কি কোনো দোষ ছিল তাতে? ছিল না।

ম্যাট্রিকে মেঘলা কথা রাখে— স্ট্যান্ড করে। বাবা খুব খুশি হন। শহর থেকে মিষ্টি আসে। প্যাকেট প্যাকেট মিষ্টি বিলি হয় পাড়ায় পাড়ায়। মেঘলার বয়ামের পিঁপড়াগুলো যে কী ভীষণ খুশি হয়! বয়ামটা টেবিলের ওপর রেখে মেঘলা তাদের জিজ্ঞেস করে, কি মিষ্টি কেমন হয়েছে? ভালো তো হবেই! আব্বা নিয়ে এসছে শহর থেকে। আমি আমার কথা রাখলাম, এবার তোরা তোদের কথা রাখ! কী, না না কিসের শক্ত কাজ! আব্বা রোজ মটর সাইকেল নিয়ে বাজারে যায় না, তাহলে? শোন, ঠাকুর স্যারের ওই কথাটা মনে আছে তো? হ্যাঁ হ্যাঁ জীবনটা কারচুপি না। যে কারচুপি করবে, তার ফল তো ভোগ করতেই হবে! সব জেনে না জানার ভাব করিস না। মনে নাই, ছোটখালা আর আব্বা মিলে মাকে বিষ খাইয়েছিল। আছে, মনে আছে... তাইলে? আরো মিষ্টি পাবি... আরে আমি এনে দিবো! আর এখানে আমি থাকবো নাকি? ঢাকা চলে যাবো! ওখানে কত গাড়ি, কত বাড়ি, কত বইয়ের দোকান... ওখানে অনেক পড়ালেখা করা যাবে। বড় বড় কলেজও আছে। হ্যাঁ হ্যাঁ তোরাও যাবি আমার সঙ্গে, তোরা ছাড়া আমার আর কে আছে?’

‘পরেরদিন সকালে বাবা রোজকার মতো বাইরে যান। যাওয়ার আগে মেঘলাকে জিজ্ঞেস করেন কিছু নিয়ে আসতে হবে কিনা! বৃষ্টি মুচকি হেসে বলে, আব্বা তুমি ফিরে এসো তাহলেই হবে!
বাবা হাসতে হাসতে বেরিয়ে যান মটরসাইকেল নিয়ে। বাজারের মোড়টা পেরোতেই একটা ট্রাক হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হয়ে ধাক্কা দিয়ে মটর সাইকেলটাকে চ্যাপ্টা করে চলে যায়। বাবা হেলমেট পরে ছিলেন না, থাকলেও বাঁচতেন না। ট্রাকের একটি চাকা তার বুক ও মাথার উপর দিয়ে গিয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলে মাথাটা নাকি বেলের মতো ফটাশ আওয়াজে ফেটে যায়।’

জোরে বাতাস হচ্ছে। জানালার পাশে ছোট্ট টেবিলের উপর রাখা সিরামিকের ফুলদানিটা মেঝেতে পড়ে ফটাশ শব্দে। ভাঙে না, মেঝেতেই এদিক ওদিক গড়াগড়ি খায়। রায়হান কিছুক্ষণ ফুলদানিটার এদিক ওদিক গড়াগড়ি দেখে। তারপর জানালা বন্ধ করে দেয়। ফুলদানিটা আবার উঠিয়ে রাখে জায়গা মতো। বলে, তাহলে বাবাও মরলো...?
বৃষ্টি আগের মতোই ঘোর লাগা কণ্ঠে বলে, ‘হ্যাঁ আব্বাও মরলো। আর কোনো বাধা ছিল না। নিজের যা কিছু সঞ্চয় সব নিয়ে ঢাকায় চলে আসে মেঘলা। ঠাকুর স্যার এ সময় খুব হেল্প করেন। মহিলা হোস্টেলে ওঠা, কলেজে ভর্তি করা। এমনকি একটা পত্রিকা অফিসে শিক্ষানবিশ হিশেবে ছোট একটা চাকরিও জুটিয়ে দেন তিনি। ঠাকুর স্যারের জন্য কৃতজ্ঞতায় মন ভরে যায়। কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষার পর, ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির সময়, ঠাকুর স্যার খুব ঘন ঘন আসতে লাগলেন। সপ্তাহে দুবার, তিনবারও। একদিন এক আধা অন্ধকার রেস্তরাঁয় ঠাকুর স্যার হাত ধরে ফেললেন মেঘলার। বললেন, মেঘলা, শোনো, তুমি আর আমার ছাত্রী নও। আর ছাত্রী থাকলেই বা কি, তাই না? তোমাকে আমি বিয়ে করবো। তুমি কী বলো?

মেঘলা আর কী বলবে, চুপ করে তারকার পতন দেখে। হাতটি সে সরিয়ে নেয় না। ঠাকুর স্যার তাতে আরেকটু সাহস পান। বলেন, শোনো, তুমি যদি চাও তবে তোমার কাকিমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবো... তুমি এমনটা চাইতেই পারো, তাই না?

মেঘলা হাসে একটু। তারপর বলে, না ডিভোর্স দেয়ার দরকার নাই। কাকিমা আর আমি একসাথেই সংসার করতে পারবো, পারবো না?
           ‘খুব পারবে, খুব পারবে। তুমি আসলেই খুব বুদ্ধিমান মেয়ে। খুউব বুদ্ধিমান!’

ঠাকুর স্যারের সাথে মেঘলার আর কখনো দেখা হয় নি। শুনেছিল মধ্যরাতে বুকে ব্যথা নিয়ে তিনি মারা যান। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। সম্প্রতি ঠাকুর স্যারের মাংসপ্রীতি খুব বেড়েছিল। নিরামিষভোজী ঠাকুর স্যার হঠাৎই কাবাব আর মুরগির গ্রিলের ভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন।

সেরা বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হতে পারে মেঘলা। না পারার তো কোনো কারণ নেই। সেরা ছাত্রী সে। থার্ড ইয়ারের শেষের দিকে পরিচিত হয় এক ছেলের সাথে। কর্পোরেট কবি। হ্যাঁ এ নামেই তাকে ডাকতো সে। কী যে মিষ্টি ছেলেটার হাসি, চুল। এমনকি তার চোখের চশমাটা পর্যন্ত সুন্দর। শাহবাগ, রমনা, টিএসসি করে খুব বেশি দিন না কাটিয়ে বিয়ে করে ফেললো তারা। দুজনারই কেউ নাই, তাই বিয়েতে কোনো হাঙ্গামা হলো না। ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে উঠে এলো তারা। কিন্তু এই বিয়েতে খুব কষ্ট হলো মেঘলার ইজিজিদের। হ্যাঁ, বয়াম-ভরা সেই পিঁপড়াগুলোর। মেঘলা আগে সারা দিনরাত ওদেরকেই সময় দিতো, ভালোবাসতো, কথা বলতো; কিন্তু স্বামী পাবার পর সেই ভালোবাসা কই, সেই সময় কই? ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ারে, অন্ধকারে, তাদের দিন কাটে। তাদের কোনো কিছু ভালো লাগে না। তাই তারা মেঘলার হাজব্যান্ডকে একদিন সব জানিয়ে দিলো। মেঘলার জীবনের সব ঘটনা এক এক করে বলে ফেললো। তারা ছাড়া মেঘলার জীবনের আর সাক্ষী কে?

মেঘলা কি রাগ করলো? কে জানে! ইজিজিদের সাথে তার খুব ক’রে ঝগড়া হলো। একদিন হাজব্যান্ডকে নিয়ে বেড়াতে বের হলো মেঘলা। রিকশায় ঘুরতে তাদের কী যে ভালো লাগছিল! হঠাৎ কোন দিক থেকে একটা বাস এসে ধাক্কা দিল রিকশাটাকে। মেঘলা কিভাবে কিভাবে যেন রিকশাতেই বসে থাকলো, কিন্তু স্বামী বেচারা পড়ে গেল। গড়াতে গড়াতে গিয়ে আটকালো নর্দমার পাশে। আর একটা মাইক্রোবাস কোনোভাবেই ব্রেক কষতে না পেরে উঠে গেল তার ওপর। সেদিন মেঘলা তার বয়ামটা বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে এলো। এরচেয়ে বেশি কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।’

বিদ্যুৎ এসেছে। ঘর আলোয় ঝলমল করে উঠলো। রায়হান চার্জারলাইট বন্ধ করে। বলে, বাহ, তোমার এ গুণের কথা তো জানতাম না! দারুণ বলেছো গল্পটা। এখন হুবহু লিখতে পারলেই হয়! ফাটিয়ে দেয়া একটা গল্প হবে!
বৃষ্টি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে, রায়হান, এটা গল্প না, সত্যি...!

           ‘দেখো এই ভররাত্রে মশকরা ক’রো না। আমি ল্যাপটপটা নিয়ে আসি। তুমি পাশে থেকে দেখো, গল্পটা ঠিক ঠিক যাচ্ছে কিনা!’

হঠাৎই চিৎকার করে উঠলো বৃষ্টি, ‘বললাম না এটা গল্প না, সত্যি ঘটনা!’ বৃষ্টির চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে। তার এমন চেহারা কখনো দেখেনি রায়হান। রায়হান বিস্ময়ের সাথে জানতে চাইলো, কী হয়েছে তোমার?

বৃষ্টি একছুটে পাশের ঘর থেকে পিঁপড়াভর্তি বয়ামটা নিয়ে আসে। রায়হানের সামনে রাখে। ঘাড় বাঁকা ক’রে, চোখে অদ্ভুত শূন্যতা ধরে রেখে বলে, দেখো... ইজিজির বয়ামটা দেখো। আমার নামই মেঘলা। গ্রামে আমাকে সবাই মেঘলা নামেই চিনতো! ঢাকায় এসে পরিচয় গোপনের জন্য মেঘলা থেকে বৃষ্টি হই আমি। তুমি যাদের কথা লিখেছো, আমি যাদের কথা বলেছি, কাউকেই আমি মারিনি। অবশ্যই আমি মারিনি। না, আমার ইজিজিরাও মারেনি। তারা মরেছে নিজেদের পাপে। ইজিজিরা অনেক ভালো, অনেক ভালো। তুমি আসার আগে তারাই আমার জীবনের সব ছিল, সব। কিন্তু তুমি সাবধান, রায়হান, সাবধান। তোমাকে ভালোবাসার পর তারা কেমন বদলাতে শুরু করেছে। আমার কথাও ঠিকমতো শোনে না। রায়হান, তোমাকে যেমন আমি ভালোবাসি, ওদেরও ভালোবাসি। প্লিজ, তুমি রাগ করো না ওদের মতো..’

রায়হানের দৃষ্টি এলোমেলো। সে একবার বৃষ্টিকে দেখছে, একবার বয়ামটা দেখছে। বৃষ্টির চোখ থেকে করুণ প্রার্থনা ঠিকড়ে পড়ছে।


৬.
কাইসারের সাথে পূর্বপরিচয় ছিল রায়হানের। এক সময় একই এলাকায় বসবাস করতো তারা। কাইসার বাইরে থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে প্র্যাকটিস শুরু করেছে। সাইক্রিয়াটিস্ট। মনোরোগবিশেষজ্ঞ। বৃষ্টিকে কাইসারের কাছে নেয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় রায়হানের জানা ছিল না।

কাইসার একটু পরীক্ষা-টরীক্ষা করলো বৃষ্টিকে। তারপর বললো, সব ঠিক আছে।

বৃষ্টিকে পাশের ঘরে বসতে দিয়ে সিগারেট খাবার কথা বলে দু’জনে একটু আলাদা হলো। চেম্বারের পেছনে ছোটমতো একটা বারান্দা আছে, সেখানেই দাঁড়ালো তারা। নিচ দিয়ে গাড়ির সমুদ্র বয়ে যাচ্ছে লাখ লাখ পিঁপড়ার মতো। উপমাটা ভেবে একটু হাসলো রায়হান। তা দেখে কাইসার জিজ্ঞেস করলো, হাসছো কেন?
রায়হান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললো, রাস্তার গাড়িগুলো দেখো, ঠিক যেন পিঁপড়ার সারি!
কাইসার চুইংগামের র‌্যাপার খুলতে খুলতে বললো, ফরেনে গিয়ে এই লাভটাই হয়েছে শুধু, সিগারেটটা ছাড়তে পেরেছি! যাই হোক, বৃষ্টির যে শারীরিক কোনো সমস্যা নাই এটা তুমিও ভালো জানো। সমস্যা মনের। এখন তুমি যা বলেছো আমাকে, তার সোজা অর্থ দাঁড়ায় তোমার গল্পের চরিত্র আর নিজেকে সে একাকার করে ফেলেছে। এটা ডাবলক্যারেক্টার প্লে করা। বাইরে এরকম অনেক কেস ফেস করেছি, স্টাডি করেছি আমরা। ইনফ্যাক্ট, সাইক্রিয়াটিস্টদের কাছে এরকম কেস বলা যায় নর্মালই।

রায়হান সিগারেটের ছাই ফেলতে ফেলতে বলে, নর্মাল? এইটা নর্মাল? মেঘলাকে রীতিমত আত্মস্থ করে ফেলেছে বৃষ্টি!

          ‘একা একা থাকে বাসায়। তোমার গল্প পড়তে পড়তে একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। ছেলেবেলায় যখন ফিল্ম দেখতাম আমরা, একটা ফিল্ম দেখা শেষ করার পর কিছুক্ষণের জন্য হলেও ওই ফিল্মের হিরো মনে হতো না নিজেকে? কত বাচ্চাদের দেখবে তাদের প্রিয় কার্টুন ক্যারেক্টার প্রিটেন্ড-প্লে করছে! শৈশবে তো আমি নিজেকে স্পাইডারম্যান ভাবতাম! শূন্যে হাত ছুঁড়ে দিয়ে জাল বের হচ্ছে কিনা দেখতাম। বৃষ্টি ঠিক তাই করছে। মেঘলার ভিতর হয়তো নিজের কোনো ছায়া পেয়েছে। বৃষ্টির মাও তো শৈশবেই মারা গেছে... সো... বুঝতেই পারছো!
           ‘আর পিঁপড়া ভর্তি ওই বয়ামটা?’
           ‘মধ্যবিত্ত বাঙালির ঘরে-ঘরেই হরলিক্সের বয়াম আছে। খোঁজ করলে তোমার ঘরেও দু’চারটা পাওয়া যাবে। তোমার গল্প পড়ার পর বৃষ্টি নিজে নিজেই ওই বয়ামে পিঁপড়া ভরেছে, সেটাই স্বাভাবিক না? দুশ্চিন্তা ক’রো না। কিছু মেডিসিন তো দিচ্ছিই, তবে সবচে’ প্রয়োজন রেস্ট আর কী বলে বাংলায়... হ্যাঁ, সহমর্মিতা। ওকে সময় দাও। সাথে সাথে থাকো। ঠিক হয়ে যাবে।’

কাইসারের কাছে বিদায় নিয়ে বৃষ্টি ও রায়হান বেরিয়ে আসে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টি দেখেই বৃষ্টির মন ভালো হয়ে যায়। বলে, দেখো দেখো... বৃষ্টি শুরু হয়েছে... ও কর্পোরেট কবি, আমি কিন্তু ভিজবো... ভিজবো ভিজবো ভিজবো!

রায়হান হাসে। একটা রিকশাওয়ালাও জুটে যায়। রিকশায় বসতে বসতেই ঝেপে বৃষ্টি নামে। রাস্তা জুড়ে শহুরে মানুষদের ছোটাছুটি। সবাই আড়াল চায়, ছাদ চায়। কিছুক্ষণের মধ্যে রাস্তা বেশ ফাঁকা হয়ে আসে। রিকশাওয়ালা তার মাথার ক্যাপ খুলে রিকশার হ্যান্ডেলের সাথে আটকে নেয়। বলে, সার, আইজ ধুমায়ে বিরিস্টি হইবো...
রায়হান বলে, একটু সাবধানে চালাও...!
বৃষ্টি তার হাত সামনে বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা ধরার চেষ্টা করছে। গানও গাইছে নাকি গুনগুন করে?

রিকশা বড় রাস্তা ছেড়ে একটা উপরাস্তায় নেমে আসে। বৃষ্টির গতি রিকশার গতির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এরমধ্যেই রাস্তায় পানি জমতে শুরু করেছে। হঠাৎই, পেছন থেকে রিকশাটাকে, কে যেন ধাক্কা মারে। রিকশাওয়ালা হ্যান্ডেল প্যাডেল ফসকে পড়ে যায়। ছিটকে পড়ে রায়হানও। ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে গড়াতে গড়াতে একবারে নালার পাশে ঘাড়ে বেদম একটা ধাক্কা খেয়ে থামে। ঝটপট ওঠার চেষ্টা করে রায়হান। বৃষ্টির কিছু হলো কিনা দেখার চেষ্টা করে। বৃষ্টির প্রবল ধারার মধ্যে ঝাপসাভাবে দূরে বৃষ্টিকে দেখতে পায়। রিকশায় সে ঠাঁয় বসে আছে। আর তখনই, সেই রাত্রে বলা বৃষ্টির গল্পের শেষ অংশ, মনে পড়ে যায় রায়হানের।

বাম হাতের কব্জিতে সে প্রথম পিঁপড়াটা দেখে, তারপর বাহুতে দেখে আরেকটা। মাথার চুলের ভেতর থেকে অসংখ্য পিঁপড়া যেন বেরিয়ে আসছে যাদুমন্ত্রবলে। কী কারণে ঘাড়টা বাঁকায় জানে না রায়হান, কিন্তু বাঁকিয়েই দেখতে পায় রাস্তার বিপরীত দিক থেকে একটা মাতাল মাইক্রোবাস সোজা তার দিকেই ছুটে আসছে। বিহ্বল রায়হান আরেকবার বৃষ্টিকে দেখতে চায়, তার মনে হয় বৃষ্টি কাঁদছে। তবে এ দেখা তার কল্পনা প্রসূত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা এত বৃষ্টির মধ্যে বৃষ্টির কান্না দেখতে পাবার কথা না রায়হানের।

রবিবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৪

হৃদয় থাকবে শুধু

ছবি: গুগল














একদিন এই পৃথিবীতে আর কোনো
আয়না থাকবে না।

হৃদয় থাকবে শুধু।

একটা ধীর
অপেক্ষার হৃদয় তখন
কাকচক্ষু শান্ত পুকুর হবে।

রূপ দেখতে তুমি
তাতেই ডুব দিও।

ঢাকায় প্রথম আসার পর




















যেন আমি উটকো কেউ
ঢুকে পড়েছি তোমাদের ঘরে
স্যান্ডেলও খুলি নি

তোমরা সবাই তাকিয়ে আছো আমার দিকে
আমার পায়ের দিকেই কি?
আমার পায়ে এক পৃথিবীর কাদা
আমার পায়ে এক সকালের ধুলা

তোমরা আমার চোখ দেখছো কি?
তাতে বিষণ্ণতার ছবি?

আমার চুলে গুমোট করা ঘাম
আমার ঘাড়ে ফুরিয়ে যাওয়া সুখ
আমার নাকে খেলছে যেটুক ঘ্রাণ
অবশিষ্ট সে এক গ্রামের মধু

তোমরা সেটাও ছিনিয়ে নেবে নাকি?
তোমরা কেমন তাকিয়ে আছো লোভে!

রবিবার, ১০ আগস্ট, ২০১৪

দাস

একটা অর্ধেক পাহাড়ের কাছে গিয়ে মন ঘুরে আসে।

মনের বড় দীনকাল চলছে। মন খুঁজেও আর পুরো পাহাড়, ওইসব হিমালয় টিমালয় পায় না। যখন পায় না তখন টিলাকে পাহাড়, ডোবাকে সমুদ্র মনে করে। একটা ঝোপের ভেতর ঢুকে মনে করে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করেছে। অথচ, এইদিন, এই মন, এক ডুবে সত্যিকারের সমুদ্র ডিঙাতে পারতো।

মানুষ একবার সাঁতার শিখলে নাকি তা আর কখনো ভোলে না। কিন্তু সক্ষমতা তো হারায়। হয়তো নিজের শরীরের ভার এতো বেশি হয়ে গেল যে আর তা বহন করা গেল না।

ভার খুব বেশি হয়ে গেছে বলেই মনে হচ্ছে। দুর্ভার। অথচ দুর্বার বলেও তো একটা শব্দ ছিল। দুর্বার আর হওয়া গেল না বলেই মনে হচ্ছে। হায় ভার।

আজ যেমন লেগুনা করে আসছিলাম অফিসে। হ্যাঁ প্রতিদিনের মতোই। প্রথম যখন লেগুনা দেখি শহরে, অথবা শহর যখন প্রথম আসে আমার কাছে, আমার চোখে, ওই লেগুনা দেখে আঁতকে উঠেছিলাম... আরে এ কী জীব? কী এই বাহন...? এরমধ্যে মানুষ কীভাবে ঢোকে!
ভেবেছিলাম, আমি কোনোদিনও ওই লেগুনা নামের বাহনটিতে আর উঠবো না।
ইঠিও নি অনেক দিন।
কিন্তু এখন আমি লেগুনার নিয়মিত যাত্রী। আসতে যেতে বারবার লেগুনার কবর আমাকে ধন্য করে।
আমি ভাবি এভাবেই মানুষ মানিয়ে নেয়। মানিয়ে নিতে শেখে। তবে মানতে মানতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কী হয়? বিদ্রোহ? হাস্যকর। যে মানতে শেখে, যে পোষ মানে তার আবার বিদ্রোহ কী?

দেখলাম লেগুনার দিকে ছুটে আসছে জীবনানন্দ দাশ। নাকি এই দাশ আসলে দাস হবে?
আমাদের এখানে সবাই তো দাস। ছোট দাস বড় দাস, সবচেয়ে বেশি মাঝারি দাস। তো জীবনানন্দ দাস ছুটতে ছুটতে আমাদের লেগুনাকে ধরার চেষ্টা করতে থাকলো। আর আমাদের লেগুনাটা একবার থামে আবার চলে আবার থামে আবার চলে...
জীবননান্দ দাস উঠতে চায় উঠতে পারে না। কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে এই দাস আমার কাছে সাহায্য চায়। মুখে না চোখে। চোখের ভেতর সাহায্যের জন্য আবেদন। আমি এই আবেদন উপেক্ষা করি। বনলতা সেন লেখার সময় তো এই লোক কোনো সাহায্য চায় নি। এমনকি ট্রামের তলায় পড়ার সময়ও না। তবে এখন কেন?

লেগুনাটা থামলো একটু। আর দেখলাম আমদের বোকাসোকা চেহারার জীবনানন্দ দাস লাফ দিয়ে, বলা যায় ম্যাট্রিক্স স্টাইলে, লেগুনার ভেতর ঢুকলো। আমি হুমায়ূন আহমেদ স্টাইলে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। হুমায়ূন আহমেদের স্টাইলটা হলো যেখানে তেমন কিছু বলার নেই চরিত্রের অথচ কিছু একটা না বলালে পরের অংশ যাওয়াটা অনিশ্চিত তখন চরিত্রটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবে... তখন মনে হতে পারে আহারে...

আমি আহারে ভাবলাম তবে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম একটা। ছোট্ট করে। ছোট্ট শ্বাসটা আমার বুকের মধ্যে তৈরি হয়ে ওখানেই মরে গেল। তখন আমার পাশে পাছা রাখতে রাখতে জীবনানন্দ দাস বলল, মাইরা দিলেন?

আমি একটু অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকাই। খেয়াল করেন তাকে তাঁর বলছি। মানে সম্মান দিতে চাচ্ছি। এই সম্মান কিন্তু সে আমার কাছে তেমনভাবে অর্জন করে নি। সে অর্জন করেছিল আমার পূর্বজদের কাছে। মানে সবাই বলছিল আহা জীবনানন্দ দাশ তো জবর ব্যাপার... কবিদের কবি... নির্জনের কবি... এসব বলে বলে আমারও মনে হয়েছিল যে তাকে তাঁর বলাই উচিত হবে। নাহলে কেমনে কী! এত বড় কবি। অবশ্য তাঁর সঙ্গী সাথিরা তাঁকে বড় কবি মানে নি। তাঁকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করেছিল। ওই হাসি ঠাট্টা টিকে নি কারণ আমাদের মনে জীবনানন্দ নিয়ে একটা রোমান্টিকতা আছে। আত্মহত্যার মতো রোমান্টিকতা আমাদের গলিয়ে রেখেছে। তাঁর আত্মহত্যার কথা ভেবেছি আর তাঁর উটের গ্রীবার কাছে মাথা নিচু করে ঘুমিয়ে গিয়েছি। তারপর ধরেন ওই যে অর্থ নয় কীর্তি নয়... তখন মনে হয় যাহশালা সে তো আমাদের ভেতরের কথাই বলছে যেন কীভাবে কীভাবে... আর আমাদের যে এমনই হয় সেটাও তো আমরা জানতাম না। আমাদের ওই অনির্বচনীয় আবেগকে প্রথম জীবনানন্দ দাশই যেন ভাষা দিলো... আমরা খুব আবেগাহত হলাম। ভাবলাম এই তো বিপন্ন বিস্ময়। আমরা খুবই বিস্মিত হলাম। হায় হায়, হালায় কয় কী...!

'আপনে তো আমাকে গালাগালি করতাছেন মনে লয়...!'

আমি জীবনানন্দ দাসের দিকে তাকালাম। আরে এর মুখে তো লোকালেরও লোকাল ভাষা। আমি কী বলবো না বুঝে একটা হাঁচি দিলাম। আসলে হাঁচি তখন দিই নি, এখন লেখায় দিলাম। মনে হলো হাঁচি দিলে এখানে একটা দৃশ্যের মতো কিছু তৈরি করা যায় কিনা। তো দিলাম একটা বড় হাঁচি। আর জীবনানন্দ প্রায় উড়ে যায় এমন দশা। তাড়াতাড়ি ডান হাত দিয়ে লেগুনার রড ধরে নিলো সে। তার চেক শার্ট কুচকে গেল। তবে চেক শার্টই কিনা এ নিয়ে আমার এখন সংশয় আছে। কারণ এখন আমার ঠিক মনে পড়ছে না তার পরনে কী ছিল। লুঙ্গিও থাকতে পারে।

না না, লুঙ্গি ছিল না। লুঙ্গি থাকলে এভাবে দৌড়ে দৌড়ে লেগুনায় উঠতে পারতো না। তো আমি জীবনানন্দ দাসকে বললাম, আপনি কবিদের কবি... আপনি এ ভাষায় কথা বলছেন কেন?

জীবনানন্দ দাস মুচকি মুচকি হাসে আর কিছু বলে না। আমার তখন রাগ হয় কিনা ভাবি। মানে জীবনানন্দ না হয়ে অন্য কেউ হলে তো খুবই রাগ হতো, কিন্তু যে লোক তাকে মাফ করে দেওয়াই উচিত হয়তো। মাফ করলাম না। আরেকটা হাঁচি দিলাম। তবে এ হাঁচিটা আগের হাঁচির মতো ফেক না। মানে সত্যি তখন হাঁচিটা দিয়েছি। জীবনানন্দ আবার হাসে। বলে, শোনেন ভাষা তো আপনেরা বদলায়া দিতেছেন... কবিরা তো আপডেট থাকবার চায়... তাই এখন এইসব ভাষা শিখতেছি... ভাবতেছি বনলতা সেন আবার লিখবো... আপনাদের ভাষায়...

আমি বললাম লেখাই উচিত। রবীন্দ্রনাথের ম্যালা সাহাবি আছে... তারা তো চায় রবীন্দ্রনাথ যেমন আছে তেমনই থাকুক। তাতে রবীন্দ্রনাথ মরে গেলেও কিছু যায় আসে না। আপনার কপাল আপনার তেমন সাহাবি টাহাবি নেই। কিন্তু তাও আপনি যদি নতুন করে বনলতা লেখেন এমন হইচই হবে... সবাই আপনাকে ফাঁসিও দিয়ে দিতে পারে...

আর দেখি কি যে জীবনানন্দ দাসের চোখে ভয়। আবার সেই চোখের খেলা। বড় বড় ডাগড় ডাগড় চোখে তাড়া খাওয়া ভয়। মানে কি, যে লোক ট্রামের সামনে দাঁড়াতে ভয় পায় না তার আবার ফাঁসিতে কি ভয়?

আমি বললাম, ভাই আপনার কি ফাঁসিতে ভয় লাগছে?

জীবনানন্দ দাস বলল, নাহ। ফাঁসিতে ভয় নাই খালি রবীন্দ্রনাথে ভয়...

আমি বললাম, এই জন্যই কি নজরুলকে ধরছিলেন?

জীবনানন্দ বলল, ছাইড়াও তো দিছি ভাই... এত কিছু মনে রাখেন ক্যান? এখন বনলতারে নিয়া ভাবতেছে... আপনাদের বাংলায় আবার তারে লিখতে হবে... এই একটা ঝামেলা! বড়ই চিন্তিত আছি...!

বললাম, আপনি তো দেখি হুমায়ূন আহমেদ স্টাইলে বাংলা বলছেন?

লেগুনাটা ঝাঁকি খেয়ে উঠল। আর জীবননান্দ দাস বলল, ভাষা যা খুশি বলেন... বক্তব্য কী সেইটাই আসল কথা... লাখ লাখ পুতুপুতু ভাষা দিয়া কোনো বক্তব্য না-কওয়ার মধ্যে কোনো গৌরব নাই...!

আমি বললাম, ভাইরে আপনি তো আমার মনের কথা বললেন...!

জীবননানন্দ দাস তখন ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকল। একটা হুমায়ূনি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আসলে ফেলল কিনা বলা মুস্কিল। মানে সন্দেহটা থেকেই গেল। তবে একটু ঝুঁকে এল আমার দিকে, তারপর বলল, শোনেন আমি কিছুই কই নাই। যা কওয়ার আমার মুখ ব্যবহার কইরা আপনে কওয়াইতেছেন...! আপনে একটা বানচোত টাইপের লেখক বইলাই এমন কাজটা করতেছেন... আপনে এত্তগুলা হারামি আছেন...!

আমার খুবই রাগ হলো। সে জীবনানন্দ দাশ হোক আর জীবনানন্দ দাস যে-ই হোক। রাগে আমার শরীর কাঁপতে শুরু করল। ফলে তাকে ধাক্কা দিলাম। খেয়াল করেন তাকে আর সম্মানসূচক চন্দ্রবিন্দু দিচ্ছি না। কারণ যাকে মেরে ফেলার জন্য ধাক্কা দিচ্ছি তাকে আর সম্মান দেখিয়ে কী হবে?

ধাক্কা দিলাম। জীবনানন্দ উল্টে গেল। পড়লো গিয়ে রোডে। লেগুনা থেকে নিচে পড়ে গেলে কারো মরার কথা না। এখন চলতি বাস-টাসই ভরসা।

জীবনানন্দ পার্ট শেষ হওয়ার পর দেখছি প্রথমে যা লিখেছি তার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ওইটুকু কেটেই আর কী করছি... আর এই লেখা কে পড়েই বা উদ্ধার করছে... ফলে যা লেখা আছে তাই থাক। এখন নতুন একটা লিখা লিখতে হবে। বনলতা সেন। জীবনানন্দ দাসের শেষ ইচ্ছা পূরণ করার প্রয়োজন আছে। জীবিত সে কিছু পায় নি, মরেই তার সব প্রাপ্তি...

মন আর টিলার খবর থাক...!

এবার মন যায় নাটোরের দিকে...!!


ব্লাডি আগস্টে












আগস্টে চুপ থাকি
সোলো থাকি খুব।

দেখি অনেক এ ফোর কাগজ ছিঁড়ে কেউ
ছড়িয়ে দিয়েছে ভুঁইফোড় গনগনে গগনে।

আর আকাশটাও দুলছে জিএফের নীল
স্কার্টের মতো
একটা পৃথিবী যে-কোনো সময়
বেরিয়ে আসবে দু'ভাগে।

আর ওই ব্লাডি কাশফুলেরাও দোলে এইসব সেক্সি হাওয়ায়।

শার্ট খুললেই এই আগস্টে খালি লোনলি লোনলি লাগে ॥