সোমবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৬

কাছে আসার সাহসী গল্প

..: মিস মালবিকা! মিস...
: শুনতে পাচ্ছি। বলেন, কী বলবেন!
: কেমন আছেন, মিস...?
: কেমন আছি মানে? আপনি হেলে আমার ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছেন, এখন আর কেমন থাকব?
: আপনিও কিন্তু হেলেছেন! ভূমিকম্পে আমরা দুজন দুজনের দিকে হেলে একেবারে কাছে চলে এসেছি! কী সৌভাগ্য আমাদের...!
: িকসের সৌভাগ্য? মানুষগুলো এমন খারাপ করে আমাদের বানিয়েছে...! যেনতেনভাবে লেক ভরাট করেছে, বাজে পাইলিংয়ের সঙ্গে আবার বাজে রড-সিমেন্টও ব্যবহার করেছে! আমার তো ভয় হচ্ছে, যেকোনো সময় একেবারে হুড়মুড়িয়ে না পড়ে যাই!
: ভয় পাবেন না...আমি তো আছিই!
: আপনি আছেন বলেই আরও বেশি ভয় পাচ্ছি! আপনার ওজনে না একেবারে চাপা পড়ে যাই!
: তবে যা-ই বলেন, আমার কিন্তু খারাপ লাগছে না!
: তা লাগবে কেন? যেদিন আপনাকে তৈরি করল, রং করে জেল্লা বাড়াল, বাইরে একটা ঝাড়বাতি লাগিয়ে দিল, সেদিন থেকেই তো আপনি কেমন-কেমন চোখে আমার দিকে তাকান! আসলে আমার বাইরের রংটা পিংক করাই ভুল হয়েছে!
: কী যে বলেন! পিংকে আপনাকে দারুণ দারুণ মানায়...কবি বলেছেন, ‘প্রহর শেষের আলোয় দেখা সেদিন চৈত্র মাস...তোমার পিংকে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ!’ আমার ঠিক ওই সর্বনাশা দশাই হয়েছিল! তিন দিন তিন রাত আপনার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারিনি।
: পরে চোখ তো ঠিকই ফেরালেন...ওই যে পাশের ফ্ল্যাটটা যখন অরেঞ্জ কালার করল! আসলে আপনারা সব পুরুষ বিল্ডিংই একই রকম! খালি ছোক ছোক করেন!
: না না, আমি কিন্তু সবার মতো নই! জানেন, আপনার পাশাপাশি থাকতে থাকতে কত দিন ভেবেছি, আপনাকে একটু ছুঁয়ে দেখি...
: ওই তো শুধু ছোঁয়াছুঁয়িরই ইচ্ছা!
: কিন্তু আমার তো হাত নাই। তাই...
: তাই গেটের বাগানবিলাসটাকে ঠেলে দিলেন আমার দিকে। একটু বাতাস হলেই ও কখনো আমার ঝাউগাছ ছুঁয়ে দিয়ে যায় আবার কখনো আমার কার্নিশটা ছোঁয়!
: কবি বলেছেন, ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে একটুকু কথা শুনি...তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ব্যালকনি!’
: রাখেন আপনার ব্যালকনি! দিনের বেলা যেমন তেমন রাতের বেলায় সব কটা লাইট জ্বালিয়ে আপনি আমার দিকে টুকটুক করে তাকিয়ে থাকেন! অসহ্য! আর সেবার! সেবার তো বিয়ের মরিচবাতি আমার ছাদেও উঠিয়ে নানা রকম রং-তামাশা করলেন! ছি ছি ছি! লোকে কী ভেবেছিল!
: লোকে ভেবেছিল এই দুই বিল্ডিংয়ের মধ্যে কত মধুর সম্পর্ক! একেবারে মেড ফর ইচ আদার!
: শোনেন, আমার সঙ্গে আপনি এ রকম সিনেমা মার্কা কথা বলবেন না দয়া করে!
: তাহলে কী বলব?
: ভালোমতো কথা বলবেন। আপনি জানেন, আমার আত্মীয়স্বজন সব গুলশান-বনানীতে থাকে? বনানীর সবচেয়ে সুন্দর যে বিল্ডিং, তিনি আমার খালু। ওই ফ্ল্যাটে পুলিশ সুপার থাকেন, আপনি জানেন? বেশি তেড়িবেড়ি করলে আপনার বাড়ির পানির লাইন, ডিশের লাইন, গ্যাসের লাইনসহ আরও যেসব লাইন-বেলাইন আছে, সব বন্ধ করে দিতে পারি আমি...কী হলো হাসছেন কেন?
: হাসছি, কারণ, দেখছি আপনি এখনো আমাদের পরিস্থিতি বুঝতে পারেননি। আমরা এখন হেলে পড়া বিল্ডিং। আমাদের ভেতর থেকে লোকজন সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই আমরা পরিত্যক্ত হয়ে যাব। তখন আমার কথা শোনার জন্য শুধু আপনিই থাকবেন, আর আপনার কথাও আমাকেই শুনতে হবে!
: এতে এত খুশি হওয়ার কিছু নাই। আমি কোনো দিনই আপনাকে পাত্তা দেব না!
: শোনেন, কবি বলেছেন, ‘বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু।’ তাই আমাকে আপনি বন্ধু ভাবতেই পারেন!
: এখন বন্ধু ভাবতে বলছেন, আরেকটু পরে বলবেন তুমি করে বলতে...
: কী করে বুঝলেন?
: বুঝব না? আপনাদের মতো বিল্ডিংদের সব সূত্র আমার মুখস্থ। ‘তুমি’ বলতে বলতে আপনারা ঝট করে বলে বসবেন আই লাভ ইউ!
: আই লাভ ইউ!
: কী?
: হ্যাঁ। আই লাভ ইউ! কবি বলেছেন, ‘ভালোবাসি ভালোবাসি...এই সুরে কাছে দূরে...’
: রাখেন আপনার কবি বলেছেন বলেছেন! সবই তো নিজের মতো বানিয়ে বলছেন!
: শুধু ভালোবাসাটা বানানো নয়! আমি তোমাকে...আরে আরে দুনিয়া তো দেখি আবার কেঁপে উঠছে!
: হায় হায়, আবার ভূমিকম্প!
: আর বোধ হয় বাঁচলাম না! মানুষেরা আমাদের বানানোর পর কত সুন্দর সুন্দর নাম দেয়, রংচং করে, সুন্দর সুন্দর লাইট দিয়ে সাজায়...কিন্তু বানানোর আগেই যদি আমাদের নিয়ে ভাবত! বানানোর সময় যদি একটু গুরুত্ব দিত...তাহলে আর এই দিন দেখতে হতো না!
: শোনেন, আমরা তো বোধ হয় ধসেই যাচ্ছি, তার আগে আপনাকেও আমার কিছু বলার আছে...
: কী?
: আমিও আপনাকে, মানে তোমাকে ভালোবাসি...
: কী! সত্যি বলছ?
: হ্যাঁ, কিন্তু এবার কিছু একটা করো! এত কাঁপন তো সহ্য করতে পারছি না! আরে আরে, আমরা কি আবার সোজা হয়ে যাচ্ছি?
: এক ভূমিকম্পে হেলে পড়েছিলাম, আরেক ভূমিকম্পে আবার দাঁড়িয়ে যাচ্ছি? মানে কী? তাহলে আমাদের প্রেম, আমাদের রিলেশনের কী হবে? আমি তো ভেবেছিলাম আমাদের বিয়ে হবে...আমাদের বাচ্চা হবে ছোট ছোট ডুপ্লেক্স! তারা আমাদের মা-বাবা বলবে! কত স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি! মানি না মানি না, এ ভূমিকম্প মানি না...মালবিকা!
: চুপ করো, গাধার মতো চেঁচিয়ো না। জানো না, কবি বলেছেন, ‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানিয়া লয় না, দূরেও ঠেলিয়া দেয়...!’
: হায়! কবিরা কেন যে এত কথা বলে! কেন! কেন!! কেন!!!


প্রকাশ- রস+আলো
লিংক: http://www.prothom-alo.com/roshalo/article/839674/%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%86%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%B8%E0%A7%80-%E0%A6%97%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA

সোমবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৬

তিতাস একটি 'যদি'র নাম


অাঁকা: রাজীবঅাঁকা: রাজীবকদিন আগে তিতাস গ্যাস লিমিটেডের অভিযোগকেন্দ্রে ফোন করে গ্যাসের ভাঙা পাইপের কথা জানালে অদ্ভুত জবাব পাওয়া যায়। কেউ একজন জানান, ‘যদি’ লেবার থাকেন, তাহলে তাঁরা গিয়ে কাজ করবেন। তবে ‘যদি’ মোতাবেক লেবার হয়তো পাওয়া যায়নি, ফলে পরের দিনই পাইপটি বিস্ফোরিত হয়ে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে বনানীর ওই ফ্ল্যাটটিতে।
নিচের কাল্পনিক ‘যদি ফোনালাপ’টি কোনোভাবে বাস্তব ঘটনার সঙ্গে ‘যদি’ মিলে যায়, তবে তার জন্য ‘যদি’ এবং কেবল ‘যদি’ই দায়ী থাকবেন।
: হ্যালো, কে বলছেন?
: কে বলছি বুঝতে পারছ না, না? দিনে কয়টা মেয়ের সঙ্গে কথা বলো?
: কথা বলাই তো আমার কাজ। যদি কথা না বলি, তাহলে কাজ কীভাবে করব?
: তুমি সত্যিই আমাকে চিনতে পারোনি? আমি তোমার বউ বলছি!
: বউ? আচ্ছা...যদি আপনার নাম রুনা হয় আর যদি আপনার সঙ্গে আমার তিন বছর আগে এক বৃষ্টিভেজা রাতে বিয়ে হয়ে থাকে, তাহলে আপনি আমার বউ!
: চুপ করো গবেট!
: এটাও ঠিক আছে! যদি আপনি আমাকে ধমক দিতে পারেন, তাহলেও আপনি আমার বউ!
: শোনো, ইতরামি ছাড়ো। তোমাকে ফোন দিয়েছি অফিশিয়ালি অভিযোগের জন্য!
: যদি সত্যি কোনো ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলেই শুধু অভিযোগ...
: সত্যি ঘটনা মানে? তুমি দেখে যাওনি সকালে, আমাদের চুলায় কী রকম গ্যাস আসছে? এই রকম গ্যাসের আগুনে রান্না তো দূরের কথা হোমিওপ্যাথির শিশির এক শিশি পানিও গরম হয় না!
: যদি পানি গরম না হয়, তাহলে ঠান্ডাই খাও!
: তবু তোমরা গ্যাস বাড়াবে না?
: তুমি জানো, দেশজুড়ে গ্যাস নিয়ে কী কাণ্ড হয়ে যাচ্ছে! যদি তুমি শুধু তোমার চুলার গ্যাস নিয়েই পড়ে থাকো, তাহলে দেশ এগিয়ে যাবে কীভাবে?
: বড় বড় লেকচার দেওয়া বন্ধ করো! গ্যাসের লাইন আজকে এসেই তোমরা ঠিক করে দিয়ে যাবে!
: যদি আজকে সোমবার হয়, তাহলে মুশকিল!
: কেন? সোমবারে কী?
: জানো না, সোমবারে রস+আলো বের হয়। যদি রস+আলোতে আমাদের নিয়ে কিছু লেখে, তাহলে সেগুলো পড়তে হবে! সেগুলো বুঝতে হবে, সমালোচনা করতে হবে!
: আমি সোমবার মঙ্গলবার জানি না, চুলা জ্বলছে না! তোমরা কখন লোক পাঠাবে, সেটা বলো!
: লোক পাঠাও বললেই তো আর লোক পাঠানো যায় না। অনেক রকম হিসাব-নিকাশ আছে। যদি এখন লোক পাঠাই তাহলে, একরকম হিসাব। যদি রাতে লোক পাঠাই, তাহলে আরেক রকম হিসাব! যদি রাস্তায় জ্যাম থাকে, তাহলে একরকম। যদি বৃষ্টি হয়, তাহলে আরেক রকম হিসাব! যদি...
: আর একবার যদি ‘যদি যদি’ করেছ...
: করতে হয়। উপায় নেই। আমরা তো টিকেই আছি যদির ওপর। পুরা দুনিয়াটাই টিকে আছে যদির ওপর। তাই মনে মনে ধরে নাও যদি গ্যাস না-ই আসে চুলায়, তাহলে কী করবে। মাটির চুলা ইউজ করতে পারো...যদি রাতের বেলা লাকড়ি নিয়ে ফিরি আমি...
: আর যদি ওই লাকড়ি তোমার পিঠে ভাঙি? আর মধ্যরাতে যদি ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা আর না খুলি? যদি ফোন করে তোমার বদরাগী চাচাকে ডাকি?
: কী বলো এসব? শোনো...
: আর যদি সব ছেড়েছুড়ে বাপের বাড়িই চলে যাই?
: আহা আহা, করছ কী! যদি এভাবে হুমকি দিতে থাকো, তাহলে তো...
: শোনো, এক ঘণ্টার মধ্যে যদি ব্যবস্থা না হয়, তাহলে তোমার যদিগিরিতে তুমি নিজেই ধরা খাবে, বুঝলে? এখন আমি রাখলাম!
: কিন্তু যদি ধরো যে যদি...আর যদি...না মানে যদি...যাহ্! যদি এভাবে ফোন কেটে দেয়, তাহলে কথা বলি কীভাবে?

প্রকাশ-রস+আলো

আফসোস আর পেরেসানি!

..দাদা গো! দেখছি ভেবে অনেকখানি—
এই ক্রিকেট নয় তো ভালো
ব্যাটিং বোলিং হয়তো ভালো
দৌড়ঝাঁপ আর রানও ভালো
ক্রিকেট নিয়ে গানও ভালো
মারলে দল সেটাও ভালো
তখন এটা এবং ওটাও ভালো—
ঝাঁপিয়ে পড়া ক্যাচটা ভালো
ঘূর্ণি বলের প্যাঁচটা ভালো
ফুলটস সব জুসি ভালো
সাকিব তামিম মুশি ভালো
মেডেন দেওয়া ওভার ভালো
মাশরাফি তো সবার ভালো
ছয় অথবা চার কি ভালো!
কিন্তু এমন হার কি ভালো?
—হায়! আফসোস আর পেরেশানি!
(সুকুমার রায়ের ‘ভালো রে ভালো’ ছড়া অবলম্বনে)

প্রকাশ-রস+আলো
লিংক- http://www.prothom-alo.com/roshalo/article/812038/%E0%A6%86%E0%A6%AB%E0%A6%B8%E0%A7%8B%E0%A6%B8-%E0%A6%86%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%87%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BF

এক যে ছিল দৈত্য!

অনেক অনেক অনেক অনেক বছর আগে এই পৃথিবীতে এক দৈত্য বাস করত। দৈত্যটার ছিল বিশাল এক পেট আর ইয়া বড় বড় তিনটা মাথা। কিন্তু তিন–তিনটা মাথা হলে কী হবে, দৈত্যটার চোখ ছিল মাত্র একটা। সবাই তাকে একচোখা দৈত্য বলে ডাকত।
অতীত নথিপত্র ঘাঁটলে দেখা যায় সে সময় এই দৈত্যটা ডাংগুলি খেলা পরিচালনা করত। যদিও এই দৈত্যটার জন্মের আগে থেকেই পৃথিবীতে ডাংগুলি খেলা চলছিল। কিন্তু দৈত্যটা এমন ভাব করত যেন তার জন্যই ডাংগুলি বেঁচে আছে! সে নিজেকে ডাংগুলির মাতবর মনে করত। দৈত্যের মাথা তিনটা তো জোরে জোরেই বলত—আমরাই মোড়ল, আমরাই মোড়ল!
দৈত্যটা এই মোড়লদের সুবিধা হয় এমন সব নিয়মকানুন বানাত। হঠাৎ হঠাৎ বলত, আজ থেকে ক্রিকেট হবে এ রকম, আজ থেকে ক্রিকেট হবে ও রকম! ছোট দলগুলো মন খারাপ করে দৈত্যের কথা মেনে নিত। কিন্তু তার কথা মেনে নিলে কী হবে, ছোট দলগুলো ভালো খেলতে খেলতে এমন পর্যায়ে গেল যে মোড়ল দলগুলোকেও হারাতে শুরু করল। দৈত্য দেখল, এ তো চরম বিপদ! সে তখন ছোট দলগুলোকে বড় বড় টুর্নামেন্ট থেকে বাদ দিতে লাগল। যেভাবেই হোক তার মাথার দলগুলোকে বাঁচাতে হবে! কিছুতেই যেন না হারে!
কিন্তু ছোট দলগুলো কম বিচ্ছু না। একেকটা দলে একেকটা প্রতিভাধর খেলোয়াড় আসতে শুরু করল। তারা দৈত্যের তিনটা মাথারই ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াল। তিন মাথা এককাট্টা হয়ে অনেকক্ষণ ধরে গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করে অদ্ভুত অদ্ভুত সব আইন পাস করতে শুরু করল। কিন্তু তারপরও দলগুলোকে, দলের খেলোয়াড়গুলোকে থামানো গেল না। তখন দৈত্য তার শেষ অস্ত্রটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল খেলোয়াড়দের ওপর। বলল, ‘এই খেলোয়াড়, যে দারুণ দ্রুতগতিতে বল করে, যার বাউন্সার বারবার আমার মাথাগুলোতে আঘাত করছে; সে ত্রুটিপূর্ণ। আর ওই খেলোয়াড়, যার বল মোড়লদের স্পিনারদের থেকেও ভালো ঘুরছে, সে-ও ত্রুটিপূর্ণ।’ তাদের বাদ দেওয়ার জন্য দৈত্য উঠেপড়ে লাগল। সে ঠিক করেছে, তার মাথা তিনটার জন্য যে খেলোয়াড়ই হুমকি হয়ে আসবে, তাদেরই বাদ দিয়ে দেবে। যেন ক্রিকেটের সব কাপ-প্লেট-পিরিচ তার মোড়ল মাথারাই পায়।
দেখতে দেখতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেল ছোট দলগুলোর। তারা বলল, ‘আমাদের বারবার বাদ দেয় যে দৈত্য, আজ থেকে আমরাই তাকে বাদ দিলাম। আমরা আর কোনো খেলায় দৈত্যকে ডাকব না। আমরা নিজেরা নিজেরা খেলব।’ তারপর তারা নিজেদের মতো করে ডাংগুলি খেলা শুরু করল।
মাতবর দৈত্য আর মোড়ল মাথারা দেখল, এ তো খুব মুশকিল! অন্য দলগুলো যদি তাদের সঙ্গে না খেলে তাহলে তারা কার সঙ্গে খেলবে? অপেক্ষা করতে করতে তারা নিজেদের সঙ্গেই খেলতে শুরু করল। কিন্তু তিন মোড়লের খেলায় খেলার চেয়ে ঝগড়া বেশি হতে শুরু করল। দৈত্যের তিনটা মাথা পরস্পরের সঙ্গে এতটাই বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়ল যে দৈত্যের সার্বক্ষণিক মাথাব্যথা হতে শুরু করল। এই মাথা বলে, ‘তুই খারাপ!’ ওই মাথা বলে, ‘তোর জন্যই এই সব!’ আরেক মাথা শুধুই চিৎকার করতে থাকল ‘মওকা মওকা’ বলে!
এত অশান্তি সহ্য হলো না দৈত্যর! সে এক দিন একটা ফাঁকা মাঠে গিয়ে ডাংগুলি লাঠি দিয়ে পিটিয়ে নিজের তিনটা মাথাই ফাটিয়ে ফেলল। মাথার কচকচানি ফুরাতেই সে আবার ছোট দলগুলোর কাছে এল। কিন্তু ছোট দলগুলো দৈত্যকে হেসেই উড়িয়ে দিল। আর মনের দুঃখে সে যে কোথায় নির্বাসনে গেল, কেউ আর বলতে পারে না!
মাতবর দৈত্য আর তিন মোড়ল মাথা ছাড়া পৃথিবীর ডাংগুলি আবার আনন্দদায়ক হয়ে উঠল। পৃথিবীর ছোট-বড় সব দল সমান সুযোগ পেয়ে ডাংগুলি খেলে সুখে-শান্তিতে, মিলেমিশে বসবাস করতে শুরু করল।

প্রকাশ-রস+আলো
লিংক- http://www.prothom-alo.com/roshalo/article/797980/%E0%A6%8F%E0%A6%95-%E0%A6%AF%E0%A7%87-%E0%A6%9B%E0%A6%BF%E0%A6%B2-%E0%A6%A6%E0%A7%88%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF

শ্যালা নদীতে কয়লাভর্তি জাহাজ ডোবার তিনটি ভুয়া ও একটি আসল কারণ


আঁকা: ষুভআঁকা: ষুভভুয়া কারণ-১
কয়লাভর্তি জাহাজটি ছিল ওভারলোডেড। তবে ওভারলোডেড হওয়া সত্ত্বেও জাহাজটি তাসকিনের বলের বেগে বীরদর্পে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিল। এই এগিয়ে যাওয়া সহ্য হলো না শকুনি মামার। শকুনি মামা তার আরও দুইটা শকুন বন্ধু নিয়ে বসে পড়ল জাহাজের মাথার ওপর। তখনই, ঠিক তখনই, শকুনি মামাদের ভার সহ্য করতে না পেরে ১৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ডুবে গেল কয়লাভর্তি জাহাজটি।
ভুয়া কারণ-২
কয়লাভর্তি জাহাজটি আসলে টাইটানিক জাহাজের খালাতো বোনের মামাতো দেবরের ছোট নাতির বন্ধুর চাচাশ্বশুরের মেজ জামাইয়ের বড় ভাগনের প্রতিবেশী, ফলে ডুবে ডুবে পানি খাওয়া এদের বংশের মধ্যেই আছে। শ্যালা নদীর একটি বিশেষ জায়গায় যাওয়ামাত্র বংশীয় ডায়বেটিসের মতো বংশীয় হাবুডুবু জাহাজটির রক্তে চনমন করে ওঠে। লোকে বলে, রক্তের টান উপেক্ষা করা যায় না। জাহাজটিও সেই টানে তলিয়ে যায় গভীর থেকে আরও গভীরে।
ভুয়া কারণ-৩
জাহাজটি পাশের দেশের বলিউডি সিনেমার ইরফান খানের খুব ভক্ত। কারণ, এই ইরফান খান ডিঙির ওপর ভেসে লাইফ অব পাই-এর মতো একটা সম্পূর্ণ সিনেমা করেছেন। কিছুদিন আগেই সেই ইরফান খান ঢাকায় এসে জানিয়েছেন, তিনি এবার ডুব সিনেমায় ডুব দিচ্ছেন। এটা শোনামাত্র জাহাজটির আর তর সয়নি। প্রিয় নায়ক যা করতে যাচ্ছে, তা সে নিজেই আগে করে ফেলতে চেয়েছে। ফলে, টুপ করে ডুব দিয়েছে...
আসল কারণ
জাহাজ নয়, আসলে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিল সুন্দরবনের সবচেয়ে সুন্দর বাঘ বাঘু। বাঘুর প্রেমে পড়েছে প্রতিবেশী মিস বেঘা। কিন্তু যেদিন মিস বেঘাকে বাঘু প্রেম নিবেদন করতে যাবে, সেদিনই তার শুরু হলো তীব্র দাঁতব্যথা। সুন্দর বাঘ বাঘু ঠিক করেছিল, শ্যালা নদীর তীরে বেঘার লেজে লেজটি রেখে সে গান গেয়ে মনের কথা জানাবে। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে গাইবে—‘তুমি আমার জীবন...আমি তোমার জীবন! দুজন দুজনার কত যে আপন, কেউ জানে না!’ কিন্তু দাঁতের ব্যথায় বাঘু এখন গোঁ গোঁ ছাড়া কোনো আওয়াজই করতে পারে না। দাঁত থাকতে দাঁতের যত্ন সে নেয়নি—এই ভাবনা থেকে দীর্ঘ ই-মেইল করলে কর্তৃপক্ষ নিয়মিত দাঁত মাজার জন্য বাঘুকে এক জাহাজভর্তি কয়লা খুব দ্রুতই পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু শ্যালা নদীর ডলফিনেরাও যে দাঁতের ব্যথায় কাতর, তা কে জানত! কয়লাভর্তি জাহাজ দেখে তারা উল্লাসে ফেটে ডুবিয়ে দেয় সেটাকে। এবার তাদের দাঁত হবে আরও মজবুত, আরও ঝকঝকে!
কিন্তু ডলফিনেরা উল্লাস করলে কী হবে...ওদিকে নড়বড়ে ব্যথাযুক্ত দাঁতসহ হুমকির মুখে পড়েছে বাঘুর প্রেম!

প্রকাশ-রস+আলো

সংসারের ইস্যু


প্রচ্ছদ: রাজীবঅফিস শেষ করে বাসায় ফিরতে না–ফিরতেই বউ বলল, ‘মরিচ এনেছ?’
আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল। লাঞ্চের সময় বউ ফোনে পইপই করে বলে দিয়েছিল, মরিচ আনতে। আমিও তখন ‘আচ্ছা আচ্ছা’ বলে কথা দিয়েছিলাম—ফেরার সময় কারওয়ান বাজার থেকে ঝাল দেখে মরিচ কিনে আনব। এখন বেমালুম ভুলে বসে আছি। এ থেকে মুক্তির উপায় কী?
মানুষ দেখে শেখে। আমিও চারদিক দেখেই শিখছি। ফলে মরিচ ইস্যুটা এখন ঢাকতে হবে অন্য কোনো ইস্যু দিয়ে। বউয়ের দিকে তাকিয়ে সরল মুখে বললাম, ‘মরিচ তো আনতেই গিয়েছিলাম...কিন্তু একটা ঘটনা ঘটে গেল!’
: কী ঘটনা?
: দেখা হয়ে গেল শিহাবের সঙ্গে।
: শিহাবের সঙ্গে দেখা হয়েছে তো কী হয়েছে! সে কি বলল মরিচ কেনা যাবে না?
: তা বলবে কেন?
: তাহলে?
তাই তো, তাহলে? কিছু একটা বানাতে হবে। শিহাব ইস্যু দিয়ে মনে হচ্ছে পার পাওয়া যাবে না। বললাম, ‘আরে, আর কী বলব, শোনো...শিহাবের সঙ্গে যে-ই না দেখা হলো অমনি কথা উঠল তোমার বান্ধবী রুনাকে নিয়ে!
: কেন? রুনার কথা আবার এল কোথা থেকে?
: শিহাব নাকি রুনার ছোট বোন রাশাকে দেখেছে।
: তাতে কী?
: আরে, শিহাব না তার জন্য পাত্রী খুঁজছে!
পাত্রীর কথা শুনে আমার বউয়ের মুখে এক ধরনের কৌতূহল ফুটে উঠল। যাক, পাত্রী ইস্যুটা বোধ হয় কাজে আসছে! কথা বাড়িয়ে চললাম তাই।
: শিহাব বলল রাশা নাকি দেখতে খুব সুন্দর!
: হবেই তো! কার বান্ধবীর বোন দেখতে হবে না!
: হ্যঁা, সেদিন মার্কেটে নাকি দেখেছে।
: কাকে?
: রাশাকে।
: কিন্তু রাশা তো এক মাস হলো নিউইয়র্কে!
আঁকা: তুলিএই যা! ধরা বোধ হয় খেলাম! কী দারুণ যাচ্ছিল ইস্যুটা। এবার? বললাম, ‘আরে, মার্কেটে দেখেছে মানে মার্কেটে তার এক বন্ধুর ফেসবুকে দেখেছে! নিউইয়র্ক থেকে রাশা নাকি ছবি পোস্ট করেছে!’
: ও, তাই বলো। ছবি তো না সব কটা সেলফি! সেলফি যে এমন তুলেছে...
আমার বউ সেলফি নিয়ে লম্বা বক্তৃতা শুরু করে দিলো। বুঝলাম সেলফিও খুব ভালো ইস্যু। এই ইস্যুতে লম্বা সময় কথা হতে পারে। তাতে মরিচ ইস্যুটা একেবারে ঢাকা পড়তে কোনো বাধা থাকে না! ফলে আমি বউকে নানাভাবে সেলফি বিষয়ে উসকাতে থাকলাম। বললাম, ‘না না, সেলফি কি আর সবাই তুলতে পারে! তা ছাড়া সেলফির আগেও ছবি ছিল এই দুনিয়ায়...সেলফির পরেও ছবি থাকবে, তাই না?’
: ঠিক তাই। রাশার এটা বোঝা উচিত—মানুষ এনেছে সেলফি...সেলফি আনেনি মানুষ কোনো!
: বাহ্‌, কী দারুণ বলেছ! দারুণ!
: কাজী নজরুলের কাছ থেকে কোট করেছি! আমি শুধু সেলফি ঢুকিয়ে দিয়েছি!
: তোমার তুলনা হয় না! ইউ আর গ্রেট!
: কিন্তু শিহাবের ব্যাপারে কী যেন বলছিলে?
: কই? কখন?
তখন মনে এল, আমি আসলে ইস্যু দিয়ে ইস্যু ঢাকার চেষ্টা করছি। এবং মরিচ ইস্যু আসলে ঢাকছিলাম শিহাব ইস্যু দিয়ে। তাড়াতাড়ি বললাম, ‘শিহাব...শিহাব...হ্যঁা হ্যঁা, শিহাব তো তোমার খুব প্রশংসা করছিল!’
: প্রশংসা করছিল?
: হ্যঁা, বলল, আমি নাকি খুব লাকি...তাই তোমার মতো বউ পেয়েছি!
দেখলাম বউয়ের মুখটা একটু রঙিন হয়ে উঠছে। ভাবলাম আসলেই সব ইস্যুর বড় ইস্যু হলো প্রশংসা! মনে মনে ভাবলাম, এ যাত্রায় বেঁচেই গেলাম তাহলে!
: তা কী নিয়ে প্রশংসা করছিল শিহাব?
বুঝলাম, বউ আমার আরও প্রশংসা শুনতে চায়। আবারও বানিয়ে বানিয়ে বলা শুরু করলাম।
: আরে, একটা প্রশংসা করল যে বলতে পারব? তোমার চিন্তাভাবনা-রান্না...
: রান্না?
: হঁ্যা, ওই যে আমার লাঞ্চে তুমি আলুভর্তা করে দিয়েছিলে। শিহাব তো সেটা খেয়েছিল, একেবারে আঙুল চেটেপুটে খেয়েছিল। বলছিল, তেমন ঠিক পরিমাণের ঝাঁজ আর ঝালের আলুভর্তা নাকি সে অনেক দিন খায়নি...!
বউ হাসছিল আমার কথা শুনে। বোঝাই যাচ্ছিল, তার খুবই আনন্দ হচ্ছে মনে মনে। সে আনন্দ লুকিয়ে রাখার চেষ্টাও করছিল না। কিন্তু ‘ঝাল’ শব্দটা শোনামাত্র হঠাৎই তার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল।
: ঝাল...মানে মরিচ...অ্যাই, তুমি মরিচ আনোনি? কেন আনোনি? আমি মরিচ ছাড়া এখন অত সুন্দর আলুভর্তা কী করে বানাব?
আমার বুকটা আরেকবারের মতো ধড়াস করে উঠল। বউ বলল, ‘যাও, এক্ষুনি মরিচ নিয়ে আসো!’
: কিন্তু শোনো, বাইরে তো বৃষ্টি হচ্ছে...
: বৃষ্টির ইস্যু দিয়ে তুমি আমার মরিচকে আটকে রাখতে পারবে না! বৃষ্টি হোক আর ঝড় হোক, মরিচ আমার লাগবেই! যাও!
ছাতাটা নিয়ে আমি মরিচ আনার উদ্দেশ্যে বের হলাম। বুঝলাম, হায়! ইস্যু দিয়ে আসলে ইস্যু ঢেকে রাখা যায় না!

প্রকাশ-