রবিবার, ২৭ জুলাই, ২০১৪

পাহারা

১.
অবশেষে আপনারা একটা গাড়ি কিনতে পারলেন। লালরঙা গাড়ি। বাচ্চারা তো বাচ্চা আপনার বৌ পর্যন্ত আনন্দে আত্মহারা! গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ঢাকা ছেড়ে। পুরনো, কত দিনের দেখা সেই একই ধানখেত খালবিল অন্য রকম লাগতে লাগলো।

হ্যাঁ, আপনারা একজন ড্রাইভারও রাখলেন। কয়েসুদ্দিন নাম। বয়স পঞ্চাশ হয়ে যাবে নাকি? কিন্তু শক্তপোক্ত। মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। পান খায়। ঠোঁট কালচে লাল। মাথার চুল উত্তম কুমারের মতো। সব মিলিয়ে কিছুটা উদ্ভট।

কয়েসুদ্দিন দীর্ঘদিন ধরে গাড়ি চালান। প্রায় পঁচিশ বছর। এর আগে দীর্ঘ সময় মাইক্রোবাস চালিয়েছেন। তার হাত পাকা।

একদিন জানলেন কয়েসুদ্দিন তার মাইক্রোবাসে কত কত দিন লাশও বহন করেছেন। আপনার কৌতুহল বেশি, জিজ্ঞেস করলেন, লাশ বহন করতে আপনার ভয় লাগতো না?

কয়েসুদ্দিন হাসে। উত্তর দেয় না। আপনিও নাছোড়, আবার জিজ্ঞেস করলেন একই কথা। কয়েসুদ্দিন ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে উঠে যায়। যাবার আগে বলে, নাহ স্যার ভয় লাগতো না! লাশের গাড়িতে পাহারা থাকতো!

আপনি অবাক হলেন। বললেন, পাহারা? কীসের পাহারা?

কয়েসুদ্দিন তাকিয়ে থাকে, উত্তর দেয় না।

আপনার কৌতুহল মেটে না। কয়েসুদ্দিন বলে, একদিন দেখাবো স্যার!

২.
ঈদে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন আপনারা। সপরিবারে। স্ত্রী কন্যা পুত্র। যমুনা পার হতেই মধ্যরাত কাবার হবার যোগাড়! এত জ্যাম। সিরাজগঞ্জ পার হয়ে জ্যামটা একটু কমে এসেছে। কয়েসুদ্দিন গাড়ির গতি কিছুটা বাড়িয়েছে। আপনি আপত্তি করছেন না। পুত্রকন্যারা ঘুমিয়ে গেছে, স্ত্রীর চোখও ঢুলুঢুলু। বাইরে হালকা কুয়াশাও আছে। হেডলাইটের আলো বেশি দূর যাচ্ছে না। এদিকে গাড়ির ভেতর গুমোট একটা ভাব। সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে আপনার। গাড়ি থামাতে বলবেন কিনা বুঝতে পারছেন না, এমন সময় কয়েসুদ্দিন ঘাড়টা ঘুরিয়ে তাকালো আপনার দিকে। এমন করে না সে। আপনি একটু অবাক হলেন, জিজ্ঞেস করলেন, কী কিছু বলবেন?
গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। কয়েসুদ্দিন যেন তাকিয়েই আছে আপনার দিকে। আপনি বললেন, সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালান! এ্যাকসিডেন্ট করবেন তো!

কয়েসুদ্দিন ধীরে ধীরে বলল, স্যার, দেখেন... পাহারা...

কয়েসুদ্দিন জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাতে ইশারা করে। আপনি তাকান জানালার ওপাড়ে। আর ওই অন্ধকার রাতের ভেতর দেখতে পান দুটো সাদা ঘোড়া, আপনার গাড়ির দুপাশে, গাড়ির সমান গতিতে ছুটতে ছুটতে আসছে। তুলোর মতো সাদা দুটো ঘোড়া। ছুটছে।

আপনার যেন শ্বাসরোধ হয়ে আসতে চায়। আপনি তাকান কয়েসুদ্দিনের দিকে। কয়েসুদ্দিন অল্প একটু হাসে। আধো অন্ধকারে সে-হাসি অসুস্থ মনে হয় আপনার। আপনি একটু জোর গলায় বলেন, কী এগুলো কী?

'পাহারা স্যার।' কয়েসুদ্দিন বলে। তারপর তাকায় বাইরে। ফিসফিস করে। 'ভয় লাগে না স্যার। ভয় লাগে না। গাড়িতে লাশ থাকলেই এরা পাহারা দিতে চলে আসে!'

লাশ থাকলে মানে?
চিৎকার করে ওঠেন আপনি। বলেন, এই গাড়িতে লাশ কোথায়...?

কয়েসুদ্দিন যেন একটু হাসে। আর তখনই আপনি দেখতে পান বিপরীত দিক থেকে একটা নাইটকোচ বুনো হাতির মতো আপনাদের দিকেই ধেয়ে আসছে।

তীব্র হর্ন আরো আলো ছাড়া শুধু ঘোড়ার খুড়ের শব্দ শুনতে পান আপনি। খুড়ের শব্দ যেন বলছে, পাহারা... পাহারা... পাহারা... পাহারা...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন