শুক্রবার, ৬ জুন, ২০১৪

আবু নাসিম বা লখিন্দর কোনোটিই তার নাম ছিল না... (দুই)


দুই.
এই ফাঁকে একবার রঞ্জনার কথাও বলা দরকার। না বললে, আমরা যারা লখিন্দরের ওই বারান্দায়, তার কণ্ঠ শুনতে উৎকর্ণ তাদের কিছুটা অসুবিধা হয়। রঞ্জনাকেও আমরা আবিষ্কার করি ওই এফডিসিতে। লখিন্দরেরও আগে। ডিরেক্টর লতিফ সাঁইয়ের হাত ধরে 'প্রেম-পীরিতি' ছবিতে তাকে প্রথম দেখা যায়। রঞ্জনার বয়স তখন মাত্র সতের। প্রথম ফিল্মটা তার ফ্লপ, দ্বিতীয়টাও ফ্লপ, তৃতীয়টাও ফ্লপ, এবং এভাবে ক্রমাগত আটটি ফ্লপের পর রঞ্জনার নবম সিনেমাটি হিট হয়। সিনেমার নাম 'আকাশ কেন নীল'। সুইট প্রেমের গল্প। আছাড়ি বিছাড়ি প্রেম। আর এই সিনেমার নায়ক সুপার ডুপার হিট মেগাস্টার আমান খান। আমান খান তখন তার খ্যাতির চূড়ায়, রঞ্জনা যেন তাকে পেয়ে সিনেমা সমুদ্রে টাইটানিক পেয়েছিল। এই টাইটানিক ডুবেছিল যে-বরফের টুকরায় তা কি লখিন্দর?
অনেকে তেমন বলে, কিন্তু আমরা ঠিক ঠাওর করতে পারি না। আমরা শুধু জানতে পারি, আকাশ কেন নীল ফিল্ম দিয়ে রঞ্জনার পায়ের নিচে যেমন মাটি হয় তেমনি মাথার ওপর ছাদও হয়। নিকেতনে। আর সেই ছাদের তলায় প্রায়শ পাওয়া যায় আমান খানকে। তখন রঞ্জনার বয়স একুশ। যদিও সে নিজেকে আঠারো বলেই পরিচয় দিতো। আর এর পাক্কা চার বছর পর, একটা ঈদের ফিল্ম, 'মনও না চায় সজনী', করতে গিয়ে লখিন্দরের সাথে পরিচয় রঞ্জনার। এই সময়টুকুর মধ্যে পার্থক্য শুধু এইটুকু হয়েছিল যে রঞ্জনা নিকেতন থেকে উত্তরায় শিফট হয়ে গিয়েছিল। আর আমান খানের লাল একটা গাড়ি সেই ফ্ল্যাটের গ্যারেজে ফিক্সড হয়ে গিয়েছিল। আর তখন, চট্টগ্রামের সমুদ্রে হঠাৎ একটা ঝড় উঠেছিল। একটা ছোট্ট জলোচ্ছ্বাস। যাতে ভেসে যেতে চাইলেও কেবল লখিন্দরের সাঁতারের জোরে বেঁচে ফিরেছিল রঞ্জনা। অথচ লখিন্দর কোনোদিনও আর জানতে চায় নি, রঞ্জনা কেন একা একা ওই দুর্যোগের মধ্যে সমুদ্রের দিকে গিয়েছিল! আর রঞ্জনাও বলে নি যে আসলে একা যায় নি। তার ভেতরে প্রথিত ছিল আরো একটি জীবন। যে জীবনটাকে পরে লখিন্দর নিজের পরিচয়ই দিতে চেয়েছিল।
আমান খানের থেকে লখিন্দরের এইখানেই একটা পার্থক্য ছিল। লখিন্দর তার ক্যারিয়ার নিয়ে কখনো পরোয়া করে নি। অথচ, পরোয়া না করার পরও, লখিন্দরের একচোখা ঈশ্বরের কৃপায় হোক অথবা নিতান্ত ভাগ্যের জোরেই হোক, লখিন্দরের পায়ের নিচে এসে লুটিয়ে পড়েছিল সিনেমার সবটুকু। যেভাবে একদিন লুটিয়ে পড়েছিল রঞ্জনাও। আর এই দুটোর কোনোটাই আমান খান সহ্য করতে পারে নি। আমান খান ভেবেছিল গেঁয়োভূত লখিন্দর একটা চুটকিতেই হারিয়ে যাবে। কিন্তু অনেকের মতো আমান খানও ভাবতে পারে নি আমানের যা কিছু খ্যাতি, যা কিছু অর্জন এমনকি রঞ্জনাও একদিন লখিন্দরের মুঠিতে চলে আসবে!
আমরা এখন যখন আমান খানকে খুঁজি তখন নয়তলার ওই বারান্দায় আধশোয়া লখিন্দরের প্রলম্বিত ছায়াই দেখতে পাই। এখন এমন বিভ্রম হয় যেন ওখানে অনেক দিন আগের আমান খানই শুয়ে আছে।
তবে এসব অলঙ্করণে আমাদের পিপাসা দূর হয় না। আমরা দ্রুত রঞ্জনা, আর বিশেষত লখিন্দরের কাছে ফেরত যেতে চাই। কারণ আমরা জেনেছি লখিন্দরের নয়তলার ওপরে, পানির ট্যাঙ্কের ভেতরে বস্তাবন্দী অবস্থায় রঞ্জনাকে পাওয়া গেছে। এই রঞ্জনা এখানে কীভাবে এল জানতে চাইলে আমাদের বোধহয় আরো একবার লখিন্দরের সূত্র ধরে ফিরে যেতে হবে এফডিসিতে, আর বাংলা সিনেমার এক অভাবনীয় স্বর্ণযুগে। আর সেদিকটাতে তাকালে দেখতে পাই লখিন্দর এফডিসির ক্যান্টিনে বা গাছতলার একটা বেঞ্চে বসে আছে।
'
লখিন্দর' ফিল্ম রিলিজের পর, এমনকি ওরকম মার মার কাট কাট হিটের পরও, নয় মাস লখিন্দরের হাতে কোনো কাজ ছিল না। এটা এখন অবিশ্বাস্যই মনে হয়, যে আমাদের এই সময়ের সবচেয়ে ব্যস্ত নায়কও একসময় এফডিসির ক্যান্টিনে বসে ধারের সিঙারা খেয়েছে। অথচ তার আগে সে একটা হিট ফিল্ম প্রসবও করেছে। তবে, এ সময়ের মধ্যে, লখিন্দর কি একেবারেই কাজহীন ছিল? তা বলা যায় না। বরং বলা ভালো লখিন্দর মনের মতো কাজ পাচ্ছিল না। এরমধ্যেই তার কাছে বেশ কিছু ফিল্মের অফার আসছিল, কিন্তু তার সবই ছিলো সেকেন্ড লিডের। সেকেন্ড লিড মানে সেকেন্ড হিরো। লখিন্দর সেকেন্ড হিরো হতে চায় নি। কারণ ওইসব সিনেমার বেশিরভাগের লিড হিরো ছিলো আমান খান।
আমান খান ওই চল্লিশেও ছিলো সর্বগ্রাসী হিরো। সে কোনো একটা ফিল্মে থাকলে অন্য কোনো হিরো দূরে থাক, হিরোইনকে পর্যন্ত দেখা যেতো না! লখিন্দর আমান খানকে শ্রদ্ধা তো করতোই কিন্তু তারচেয়ে বেশি ভয় পেতো। আমান খানের ক্যারিয়ারটা লখিন্দরের কাছে ছিলো ঈর্ষণীয়। আর আমান খানের ছিলো স্টাইল! হ্যাট আর সানগ্লাশ। অনেকটা ওয়েস্টার্ন নায়কের মতো। চোখ ধাঁধিয়ে যেতো দেখে। লম্বা কলারের শার্ট, মাথায় ক্যারিবীয় হ্যাট আর দামী সানগ্লাশ মিলিয়ে আমান খান যখন তার দামী লাল গাড়িটা থেকে নামতো, নেমে তার ট্রেডমার্ক হাসিটা দিতো, এমনকি এফডিসিতেও হুলুস্থুল পড়ে যেতো। ডিরেক্টর থেকে শুরু করে স্পটবয় পর্যন্ত উত্তেজনায় কাঁপতো। আর উৎসুক জনতা, ভক্তরা তো ছিলোই। আমান খানকে দেখার জন্য, একটু ছোঁয়ার জন্য তাদের ভেতর নিত্য মারপিট হতো। আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা এফডিসির গেটে তারা অপেক্ষা করতো।
একবার এক মধ্যবয়সিনী নাকি রক্ত দিয়ে আমান খানকে চিঠি লিখে হাসপাতালে ভর্তি ছিলো দীর্ঘদিন। এটা ছিলো ঢাকা থেকে অনেক দূরের একটা মফস্বলে; আর কী আশ্চর্য আমান খান ছুটে গিয়েছিল তার কাছে। ওই মধ্যবয়সিনী নাকি চর্মচোখে আমান খানকে দেখেই দ্বিতীয়বারের মতো জ্ঞান হারিয়েছিল। তারপর সাতদিন অনর্গল কথা বলে চলেছিল। হাসপাতালে। এমনকি বাড়িতে এসেও। তার ঘরভর্তি ছিল নাকি শুধু আমান খানের পোস্টার। আর প্রতিটা পোস্টারে ছিল একাধিক লিপিস্টকের দাগ।
প্রোডাকশন বয়ের হাত থেকে নেয়া ফেটে যাওয়া দুধের ঘন চা খেতে খেতে লখিন্দরের এসব গল্প শুনতে হতো। কখনো ভালো লাগতো, কখনো বিমর্ষবোধ করতো। শুনতে শুনতে লখিন্দরও কল্পনায় নিজেকে হ্যাট সানগ্লাশ আর লাল গাড়িতে দেখতো। রঞ্জনাকে দেখতো কিনা তা জানার নাগাল আমরা অবশ্য পাই না। মানুষের ভেতরে, খুব বেশি ভেতরে ঢোকার আমাদের অধিকার থাকে না। কিন্তু রঞ্জনার ব্যাপারে খুব আলগা কোনো ভাবনা কখনোই আমরা লখিন্দরের ভেতরে লক্ষ্য করি না। না অতীতে, না বর্তমানে... এমনকি ভবিষ্যতেও তেমন একটা দেখবো বলে আশা করতে পারি না। অথচ এমনটা হলে দর্শকশ্রোতা হিশেবে আমাদের ভালোই লাগতো। আমাদের মনো হতো একটা জমাটি প্রেমের গল্পের ভেতর আমরা ঢুকে যেতে পারছি। কিন্তু আসলে ফিল্মে যেমন-যতোটা মানুষের প্রেম থাকে তেমন-ততোটা প্রেম তো আর সত্যিকারের জীবনে থাকে না। আর থাকে না বলেই পর্দা রূপালী হয়ে যায়। মনে হয় এই তো দারুণ জীবন। একটা ছুনছুনে মজা আর খনখনে আফসোস বেশ হতে থাকে। আর ওই আফসোসের দৌলতেই আমরা আবার টিকিট কাটি, একই ফিল্ম বারবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখি!
লখিন্দর অবশ্য তখনো এতসব বোঝে না। আর আমাদের মনে হতে পারে লখিন্দর বোধহয় পরেও কখনো এসব বোঝে নি। সে শুধু কল্পনা করতে পারতো একটা লালগাড়িতে হ্যাট আর সানগ্লাশ চাপিয়ে সে ছুটে যাচ্ছে মফস্বলে। কোনো এক সরু নদীর ধারে। ওই সরু নদীর ওপর, একটা একতলা বাড়ি, ওপরে টিন, দেয়ালগুলো দালানের; সেই দালানের ভেতর একটা রূপসী তার কথা ভেবে ভেবে চোখের পানি ফেলছে আর এমনকি ওই মধবয়সিনীর মতো আঙুল কেটে আঙুলকে কলম বানাচ্ছে। সাদা পাতায় বড় বড় করে তার নাম লিখছে... লখিন্দর!

লখিন্দর?
কিন্তু লখিন্দর কি তার নাম?
না।
তার নাম কি তাহলে আবু নাসিম?
ধুর! এমন অফিল্মি নাম কেউ ফিল্মে রাখে?
কিন্তু ওই যে রূপসী সে তাহলে কী নাম লিখবে সাদা কাগজে... রক্ত দিয়ে? তার পিতৃপ্রদত্ত নাম?
লখিন্দর ভাবে কিছুক্ষণ, তারপর আর ভাবতে পারে না। অথবা ভাবতে চায় না। অনেকেই তাকে তখন লখিন্দর নামেই ডাকতে শুরু করেছে। লখিন্দর তাতে আর বাধা দেয় না। কারণ আবু নাসিম নামটা তার কখনোই বলার মতো মনে হয় নি। কিন্তু নাম একটা জবরদস্ত আমান খান। নামের ওপরেই কি হিট ফ্লপ নির্ভর করে?
আমান খান। তার আগের নাম কী ছিল কে জানে? অন্তত লখিন্দর জানে না।
সে শুধু ভাবে আমান খান নামটাকে। আর ভাবে আমান খানের হিট প্রসবের কথা। আমান খানের লাস্ট বারোটা ছবি ছিলো হিট। এরকম একের পর এক হিট, সুপার ডুপার হিট, ব্লকব্লাস্টার হিট, ইন্ড্রাস্ট্রিতে আর কেউ দেয় নি। ভবিষ্যতেও যে কেউ দিতে পারবে না এ ব্যাপারে সকলেই নিশ্চিত। আমার খান তাই ইন্ড্রাস্ট্রির দেবতা হয়ে উঠেছে তখন। একেক ঈদে তার নিজেরই ছবি আসছে দুইটা তিনটা করে। অন্য ছবিগুলো মার খাচ্ছে পটাপট!

আর এরকম সময়ে লখিন্দর নিয়ে এল এক সলো। মানে লখিন্দর নিয়ে এল বলা ভুল, বরং বলা যায় লখিন্দরকে আবার নিয়ে এল পাদপ্রদীপে। ওই আমান খানের যুগে। যা এখন ভাবলে শরীরে কাঁটা দেয়। শিহরণ আসে মনে। মন বলে, আসলে কোনো কিছুই তো স্থায়ী না... এই অ-স্থায়ীর ভেতর মানুষ হারিয়ে ফেলে, মানুষ পেয়ে যায়। আমাদের লখিন্দর পেয়ে গিয়েছিল। আর আমান খান কি হারিয়ে ফেলেছিল? বলা মুস্কিল। বলা কঠিন!

আমান খানের ট্র্যাডিশনাল প্রেমের ছবির বিপরীতে সেবারের ঈদে মুক্তি পেলো লখিন্দরের ছবি। এর কোনো তুলনাই হয় না। আমান খানের ছবি মেগাস্টার হাইবাজেট, ইন্ডিয়ায় তিনটা গানের শুট করা আর সবচেয়ে বড় কথা আমান খান আর রঞ্জনা জুটি যেখানে উপস্থিত, সেখানে লখিন্দরের সিনেমার অবস্থা দুর্দশাময়... এক লখিন্দর আরেক বান্দর ছাড়া ফিল্মে তেমন কিছুই নেই। সিনেমার নাম 'দুধ ভাই'। ফিল্মের গল্পও উদ্ভট। ফিল্মে পাকচক্রে লখিন্দর আর বাঁদর এক মায়ের দুধ খেয়ে বড় হয়। ফলে তারা দুধভাই। এই দুই দুধভাইয়ের মিলন-বিচ্ছেদ-মিলনই সিনেমার উপজীব্য। এমন কাহিনির ফিল্ম লখিন্দর করতোই না কখনো, কিন্তু তার খুব হাত টান যাচ্ছিল, চারদিকে ঋণের বোঝা পাহাড় হয়ে যাচ্ছিল, ফলে ওস্তাদ কেরামতালি যখন তাকে রোলটা অফার করলো সে আর না বলতে পারলো না। ওস্তাদ কেরামতালির কারবারই এই রকমের। এর আগে সে দুইটা সিনেমা বানিয়েছিল, একটা ছিল সাপের আর অন্যটা ছিল ঘোড়ার গল্প। মানুষের তার সিনেমায় তেমন কিছু করার থাকে না। কিন্তু, তবু, সেটে, কেরামতালি লখিন্দরকে একটা সিনের ব্যাপারে বলেছিল এই সিনটা যদি ঠিকঠাক দেওন যায় তাইলে পাবলিক ঘরে বইসা থাকবো না। হামলায়ে এই ফিল্মের টিকেট কাটবো!
লখিন্দর বিশ্বাস করেছিল কেরামতালিকে। না করে তার কীইবা করার ছিল। ফলে নদীর ধারে, যখন তারা সিনটা শুট করছিল, সিনটা ছিল এই রকম দৌড়াতে দৌড়াতে সে ছুটে যাবে ট্রেনিং দেওয়া বাঁদরটার দিকে আর তাকে জড়িয়ে ধরবে, আর ধরার পর বুঝবে বাঁদরের পিঠে আসলে ছয় ছয়টা গুলির আঘাত, তখন তাকে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে হবে... এমন ভাবে, যেন পর্দার ওইপাড়ে যারা থাকবে তারাও ডুকরে উঠতে বাধ্য হয়। আর তারপর অনেক লাউড মিউজিক হবে আর লখিন্দর তার দুধভাইয়ের মৃত শরীরটা ছুঁয়ে প্রতিশোধের কসম খাবে। আর কসমটা এমনভাবে খাবে যেন পর্দার ওইপাশের মানুষগুলোর চোয়ালও শক্ত হয়ে যায়, মুঠি বন্ধ হয়ে আসে!

কঠিন সিন, বলাই বাহুল্য!
তবে, লখিন্দর উতরে যায়। বা আসলে বলা ভালো লখিন্দর ফাটিয়ে দেয়। আমরা তো এটা জানি যে লখিন্দর আসলে ভালো অভিনয়টা পারতো। মেলোড্রামা যেমন পারতো তেমনি তারমধ্যে সংযত অভিনয়ের গুণটাও ছিল। সিনের পর ওস্তাত কেরামতালি ছুটে এসে লখিন্দরকে জড়িয়ে ধরেছিল। পিঠ চাপড়ে দিয়েছিল, একশ টাকা বকশিস দিয়েছিল। আর সবাইকে দেখিয়ে বলেছিল, দেখে নে... এই যে আমাগো নিউ স্টার। মেগাস্টার!

ওস্তাদের কথা ফলে গিয়েছিল। লখিন্দর মেগাস্টারই হয়ে গিয়েছিল। আর মেগাস্টার হওয়ার জন্য যে প্রথম ধাপ সেটা সে রেখেছিল ওই দুধভাই ফিল্মের মাধ্যমেই। ঈদে, আমান খানের বিগবাজেট ফিল্মের বিপরীতে, সিনেমাটা ব্যবসা করলো এমনভাবে যে বাজিমাত। টানা তিনমাস হল থেকে নামলো না দুধভাই। চোখ মুছতে মুছতে মানুষজন হলে ঢোকে আর চোখ মুছতে মুছতে বেরোয়। টানা বারোটা হিট দেওয়ার পর আমান খানের প্রথম একটা সিনেমা ফ্লপ হলো আর হিট সুপার হিট হয়ে গেল লখিন্দরের দুধভাই।

আর ওই প্রথম লখিন্দর একটা ভয়ের স্বপ্ন দেখলো গভীর রাতে। দেখল আমান খান তার পেটের মধ্যে একটা ভোজালি ঢুকিয়ে দিচ্ছে ঠিক ফিল্মি সিনের মতো। তবে, এই ভোজালিটা আসল আর তার পেট থেকে গলগল করে বের হয়ে আসা রক্তটা আসল। আর সে যে মরে যাচ্ছে ওই মরে যাওয়াটা আসল।

ঘুম ভেঙে গেলে লখিন্দরের মনে হতে থাকে সত্যিই তার মৃত্যুটা খুব এগিয়ে এসেছে। মনে হতে থাকে যে কোনো দিন। আর ওই অবস্থায় টেলিফোন বেজে ওঠে। তীব্রস্বরে। তার মনে হতে থাকে এই গভীর রাতে নিশ্চয় মৃত্যুর পরোয়ানাই এসেছে তার কাছে। ফোন ধরলে হয়তো ওইপ্রান্ত থেকে একচোখা ঈশ্বরের কোনো প্রতিনিধি তাকে টেনে নিয়ে যাবে দূরে কোথাও, কোনো গহীন খাদে, অথবা অতল জলের ভেতর। লখিন্দরের ঘাম হতে থাকে। হাতের তালু ভিজে ওঠে। আর ভেজা তালু নিয়ে, তবুও, লখিন্দর ফোনটা তোলে। এবং শুষ্ক কণ্ঠে বলে, হ্যালো...

আমরা পরে জানতে পারি এই ফোনটা আসলে মৃত্যুর পরোয়ানা ছিল না, ফোনটা ছিল রঞ্জনার। কিন্তু আরও পরে যখন আমাদের কাছে অনেক কিছু পরিস্কার হবে তখন আমাদের সন্দেহ হতে থাকবে যে রঞ্জনাই কি মৃত্যুর পরোয়ানা ছিল?
অথচ এই রঞ্জনাকেই যখন আমরা দেখি লখিন্দরের নয়তলার ট্যাঙ্কের ভেতর, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তখন আমাদের প্রশ্নগুলো আবার উল্টে যেতে থাকে। আর আমরা দেখি নির্লিপ্তপ্রায় লখিন্দর তার বারান্দায় আধশোয়া হয়ে মার্টিনি খাচ্ছে। আর বাইরে তখন পুলিশের সাইরেনের আওয়াজ ভাসছে। পুরো বাংলাদেশ যেন ছুটে আসছে লখিন্দরের শহরতলীতে। তবে তার আগে আমাদের মন চলে যায় ওই ফোনালাপে। কী কথা হচ্ছিল তখন সেই ফোনে, তখন... যখন রঞ্জনা প্রতিষ্ঠিত আর এক দুর্ভেদ্য দুর্গের ভেতর যেন বন্দী আর লখিন্দর যখন পেয়ে যাচ্ছে সেই সোনার হরিণ আর একমাত্র স্বাধীন...

কী কথা হচ্ছিল তাদের মধ্যে?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন