বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৪

য পলায়তি স জীবতি



ভিড় ঠেলে বাস থেকে নেমে এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না ফনি। বড় রাস্তা পেরিয়ে সাবানের কারখানাকে ডানে রেখে একটা সরু গলিতে ঢুকে পড়ে দ্রুত। পিছনে কোনো হইচই হচ্ছে কিনা জানতে খুব ইচ্ছা হয়, কিন্তু ব্যাগটা সাথেই আছে; এটা এখন ব্যাগ না-- আস্ত আগুন, অতএব পলায়নই উৎকৃষ্ট পন্থা!

ফনি চুরি যেমন ভালোবাসে, চুরিই তার পেশা, তেমনি সে ভালোবাসে পালাতেও। আজকের চোর সে না-- গ্রামে তার খ্যাতি ছিলো। এই খ্যাতি, যে-কোনো খ্যাতির মতোই, একদিনে গড়ে ওঠে নি। ফনি যেখানেই চুরি করতে গেছে, আগে ঠিকঠাক দেখে রেখেছে পালানোর উপায়। যেখানে পালানো কঠিন সেখানে চুরি করাকে রেখেছে কম বিবেচনায়।
গ্রামে আয় কম, যন্ত্রণা বেশি। আশপাশের দু’দশ গ্রামজুড়ে যেখানে যা চুরি হোক শালিসে তাকে হাজির থাকতেই হবে-- জেরার পর জেরা, চেয়ারম্যানের জবরদস্তি, থানাপুলিশের ভয়, সত্যমিথ্যা উভয়ক্ষেত্রেই বাঁশের বাড়ি, --যখন একেবারে নিরুপায়, তখন গ্রাম ছাড়ে ফনি। ট্রেনে চেপে নামে নিচ্চিতপুর জংশনে। ট্রেন থেকে সেদিন তার আয় হয়েছিলো দু’ছড়ি কলা, দেড় কেজি মতো আটা আর কৌটায় ভরা গুঁড়াদুধ।

জংশন বড় মজার জায়গা। হাজার পাগলের আড্ডাখানা, ফনির অন্তত তাই মনে হয়। নানান কিসিমের পাগল-- কোটটাইপ্যান্ট পরা থেকে কানাবুদ্ধুল্যাংড়া, কিংবা গহনায় আগাপাছতলামোড়া কোলবালিশ থেকে ব্লাউজবিহীন জুলেখা পর্যন্ত সকলের আনাগোনা। কেউ যাত্রী কেউ কুলি কেউ ভিক্ষুক কেউ সালসাবিক্রেতা কেউ পকেটমার কেউ বেশ্যা কেউ বেশ্যার দালাল কেউ গাঁজাবিক্রেতা কেউ খরিদ্দার-- কিন্তু সবাই পাগলা। জংশন ফনির খুব প্রিয় হয়ে ওঠে-- যত মানুষ তত গ্যানজাম তত্ত ইনকাম। ট্রেন থেকে মানুষ নামছে গলগল, আবার হু হু করে মানুষ উঠছেও-- এত মানুষ কোথা থেকে আসে, কোথায় যায়?

ট্রেনের হুইসেল, কুলির হাঁক, যাত্রীদের ঠেলাঠেলি, মাইকে প্লাটফর্মে দাঁড়ানোর অনুরোধ, চায়ের কাপে চিনি মেশানোর শব্দ, বাদাম ডাব ভাজা পান সিগারেট ফেরির চিৎকার, সব মিলিয়ে এমন ভজংঘট এমন চাঞ্চল্য যে ফনির নেশা লেগে যায়। রাতে ঘুমায় ওভার ব্রিজের ওপর; সে একা না, কম করে তিরিশজনের নিত্য বিছানা ওই লোহার পালঙ্ক। সারাদিন পকেট কেটে, এদিকের মাল ওদিক করে ফনির খুব রোজগার হয় না। অথচ তারই মতো আরো কেউ কেউ দিব্যি ফুরফুরে দিন কাটায়, সকালসন্ধ্যা চাগাঁজাবিড়ি খায়, রাতে অনেকে মশা তাড়ানোর কয়েলও জ্বালে। ফনি চতুরতার সাথে ওদের সঙ্গে মিশে যায়। দেখে কেস ভিন্ন। এদের আয়ের পথ বহুমুখী-- কেবল পকেট কাটা কিংবা মাল সটকানোর মধ্যেই এরা বদ্ধ নয়-- কালোবাজারি মাল থেকে শুরু করে লাইনের স্লিপার চুরি, এরা সবই করে। এরা শুধু ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে না, নিজের কাজে স্বাবলম্বীও! ফনি গ্রামের সহজ সরল চোর, অন্ধকারে গৃহস্থের বাড়ি ঢুকে কাঁসার থালাবাসন ধানচাল হাতানোই ছিলো তার প্রধান জীবিকা, মাঝেমধ্যে দু’একটা হাঁসমুরগিছাগল; জংশনের এই বিশাল কারবারের সাথে মানিয়ে নিতে তার কিছুদিন সময় লাগে। তবে ফনি পুরো বিষয়টা আয়ত্ত করে ফেলতে পারে, জংশনের কারবারে সে চৌকশ হয়ে ওঠে। একজনকে সে গুরুও বানিয়ে ফেলে। গুরু বলে, ফনা তুই মুখ রাখবি মুর... তুই মুর যুগ্য শিরসো!

গুরু তখন পেট ভরে তাড়ি খেয়ে মাতাল। ফনি তাকিয়ে থাকে গুরুর কোমরের দিকে, সেখানে মোটা কালো ডোরা দিয়ে বাঁধা টাকার থলে-- থলেটা সবসময় ফুলে থাকে, ফনি মনে মনে ভিতরের টাকার পরিমাণ আন্দাজের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়, এই ব্যর্থতা তার ভালো লাগে না। গুরু বলে, আরেক গিলাশ খারে ফনা...
ফনি বলে, আর তো পারি না গুরু... বেজায় বাস!
গুরু বলে, দুররো ব্যাটা! আয় লাক টিপ্প্যা আরেক গিলাশ খা... প্যাটে গেলে গুণ আছে!

গুরু ট্রেনের একটা পরিত্যক্ত বগিতে বাস করতো। জংশনের কিছু লাইন বহুদিন থেকে অব্যবহৃত ছিলো, তারই একটাতে গুরু চোকিবিছনাবালিশ পেতে লিকা করেছিলো পদ্মকে। ফনির গুরুভক্তির একটা কারণ পদ্ম। গুরু শুকনা টিংটিঙা বুড়া, অথচ পদ্মর মতোন টসটসা বউ সে রাখছে-- গুরুর কপাল ‘মিলিস্টার’ কপাল-- ওই কপালের সাথে কপাল ঘঁষলে নিশ্চয় কিছু একটা হয়! গুরু বলে, তুর হইবো ফনা, তুরই হইবো... মনতাজ হালার পুতে পারবো না... ব্যাটায় হইছে মাগিবাজ। মাগি ধরছে যে জিন্দা মরছে সে! অর সব ঢুকবো মাগির ফুটায়!
ফনি বলে, গুরু আপনের দুয়া!
গুরু খুব খুশি হয়, বলে, দুয়া করি বড় চুর হ। জীবনটার তামানই হইল চুরি। সকুনেই চুর। আল্লাও চুররে ব্যাটা!
ফনির নেশা একটু টশকায়। বলে, আল্লাও চুর?
গুরু বলে, হুম, হে চুরি করে মাইনষের জীবন... ক, কথা ঠিক কিনা?
ফনি বলে, জ্বে, কথা ঠিক। খুবই উচিত কথা!

তখন দু’জনেরই নেশা চড়া। দু’জনেই আবোল-তাবোল বকে, গালাগালি করতে থাকে যাকে তাকে। বগির ভেতর থেকে ভেসে আসে পদ্মর হাসির খিলখিল আওয়াজ। খিলখিল খিলখিল। ফনি সাগ্রহে শোনে। ভেতরে পারদ বইতে থাকে। গুরু বলে, ওই খানকির বেটি খানকি, চুপ থাক! এত্তো রঙ কিল্ল্যা?
অদ্ভুত ব্যাপার, হাসি থামে না, আরো বেড়ে যায়। ফনির ভেতর ঝিলিক দিয়ে দিয়ে পারদ নাচানাচি করতে থাকে। গুরু মুখ ঝামটায়, বলে, ফনা, মাগি হইল সাপের জাইত। হাদিছে বলছে মাগির ফুটা দুজখের দুয়ার। ওইদিকে দেখলে চোখের জ্যুতিক্ষয় হয়। হ্যাদের বিশ্বাস রাখবি না... দ্যাখছোস না পয়সা বান্ধা রাখি মাঞ্জাতে!
গুরু অনবরত তার কোমরে বাঁধা থলের ওপর চাপড় দিতে থাকে। কিন্তু ফনির সেদিকে আর নজর যায় না। সে তন্ময় হয়ে শোনে গুরুপত্নির হাসি, খিলখিল খিলখিল, পারদ ঝলকায় যেন, ফনি কোন এক ঘোরের ভিতর চলে যায়। গুরুর কণ্ঠ সেই সুদূর থেকে যেন ভেসে আসে। গুরু বলে, সিজিন আসতাছেরে ফনা... আয়-ইনকামের সিজিন... মালগাড়ি পুরা পুরা গহম আসবো, বগি ফাঁসা আর ছালা ভর। গহম তো লয় সুনা পড়বো সুনা। ফনারে...

ফনি একটু দেরি করে বলে, জ্বে?

গুরু বলে, খাড়াইতে পারি না রে ফনা... আমারে উঠা...

ফনি প্রতিরাতে গুরুর এই আব্দারের অপেক্ষায় থাকে। গুরুকে ধরে সে বগিতে ওঠে। গুরু টলতে টলতে বিছানায় শুয়ে পড়ে। পদ্মর পানে রাঙা ঠোঁটে তখনো হাসির আভা। ফনি ইতস্তত করে। যাবার উপক্রম হয়। বলে, থাকেন...
গুরু ততক্ষণে ঘুমে, বা জ্ঞানে, তলিয়ে গেছে। পদ্ম বলে, আপনের নিশা হয় নাই?
ফনি ঘাড় বাঁকায়, লম্বা করে শ্বাস টানে। বলে, হইলে?
খিলখিল করে হেসে ওঠে পদ্ম, বলে, ঠিক যেন জালালি কবুতর। বাকুম বাকুম... আর বাকবাকুম...
ফনির বুকটা ধড়াস করে ওঠে। পদ্মর তীরনজর।
পদ্ম তার ঘাড়টা একটু বাঁকায়। বলে, আচার খাইবেন? আচার খাইলে নিশা পলায়...
ফনি বলে, লাগতো না।
পদ্ম বলে, না লাগলেই ভালা... মুর বাঁচে!

পদ্মর সাথে এমন কথপোকথন ফনির প্রায় দৈনিকই হতো। একদিন আচার নিতে গিয়ে সে জড়িয়ে ধরেছিলো পদ্মকে। সেদিন নেশা বোধহয় বেশিই হয়েছিলো, নাহলে আচারের কী প্রয়োজন? পদ্ম তার শ্যামলা কোমল শরীর ঘুরিয়ে বলেছিলো, মিনসা বড় রসিলা গো... গুরুর নাঙে হাত চালায়!

ফনি আজন্ম লজ্জাহীন।
গ্রামে একবার মাথা ন্যাড়া করে চুন মাখিয়ে তাকে অপমানজনক শাস্তি দেবার চেষ্টা করা হয়েছিলো-- ফনি অপমানিতও হয় নি, লজ্জাও পায় নি-- বরং তার সুখ হচ্ছিল এই ভেবে যে চুরির মালগুলো ধরা পড়ে নি, এত কষ্টের উপার্জন গাঙে ভাসে নি। সেই ফনি পদ্মর কথায় লজ্জা পায়, কোমরে পেঁচানো হাতটা দ্রুত সরিয়ে নেয়। কিন্তু ফনির সেদিন বেজায় নেশা-- পদ্মকে সে আবারো জড়িয়ে ধরে, কাছে টেনে নেয়। পদ্মর শরীরের ঘামের গন্ধ ফনির মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দেয়, পারদ অহস্য রকমের দ্রুতায় ছটফট করতে থাকে; সে আরো কাছে, একেবারে বুকের ওপর, লেপ্টে নেয় পদ্মকে। পদ্ম হাসে না আর, তার মুখ দপ করে নিভে যায়। কেমন বিভ্রান্ত চোখে ফনির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী যেন খোঁজে।
ফনি বলে, তোরে আমি লমু। লমুই। খুদার কসম লাগে!
পদ্মর বুকের ছন্দ বৃদ্ধি হয়, বলে, কই নিবা? তুমার তো ঘর নাই... তুমার ঘর নাই ক্যান?
পদ্মকে নিজের বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে নিতে ফনি বলে, ঘর বানামু।
পদ্ম বলে, তুমার গুরু তুমারে জবাই দিবো।
ফনি বলে, পলামু। দূরে। শহরে পলামু। যাবি না?

পদ্ম আবারো হাসতে শুরু করে। হাসতে হাসতে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় ফনির কুণ্ডলি থেকে। বলে, যান ঘুমান গিয়া! আপনের আইজ নিশা লাগছে বহুত!

একটা ঘরের জন্য সেদিন ফনির সে কী হাহাকার! ঘর, একটা মাত্র ঘর। পদ্মকে নিয়ে থাকার মতো ঘর।
ওভারব্রিজের ওপর শুয়ে শুয়ে তার নির্ঘুম রাত কাটে। বুকে ভিতর টনটনে ব্যথা। পারদের ধাক্কা। গ্রামে যে তার ঘর ছিলো না তা নয়, কিন্তু এই জংসরে কোনোদিন সে-ঘরের কথা তার মনে আসে নি। চাল গলে যাওয়া, দেয়াল ভেঙে ধ্বসে যাওয়া ঘর-- তবু তো ঘর। পরিত্যক্ত বগিগুলো অন্ধকারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে, ফনির ওরকম একটা বগি পেলেও চলে। কিন্তু সেগুলো দখলের জন্য যে ক্ষমতা দরকার, ফনির তা নেই। ফনি বিড়ি জ্বালে, ফসফস করে ধোঁয়া টানে, দূরে জারুল গাছের নিচে আইশারা দাঁড়িয়ে আছে-- দুটো মাতাল ওদের সাথে দরদাম করছে, তৃপ্তি ভাতের হোটেল থেকে কটকটে শব্দে হিন্দি গান ভেসে আসছে, সোবাননগরের ট্রেন লেট-- যাত্রীরা রেলকর্তৃপক্ষের মা-বোন তুলে গালাগালি করছে-- ফনির কোনো কিছুই ভালো লাগে না। সে উঠে বসে, আবার শুয়ে যায়, আবার উঠে বসে। তার বুকগলাজিভ শুকিয়ে খবরের কাগজের মতো হয়ে যায়-- একটা মাতালের সাথে দূর্গার দরদাম ঠিক হয়, তারা জারুল গাছের পিছনে গাঢ় অন্ধকারে চলে যায়। দূর্গার কণ্ঠ শোনা যায়, কামড়াইস ক্যা শুয়োরের পুত... বিচ্চি গালাই দিমু হারামি... তাত্তারি খালাশ কর...
ফনির ভেতরের পারদ চিড়বিড়িয়ে ওঠে। পদ্মকে তার চায়, আর পদ্মর জন্য তার চায় ঘর।

পদ্মর জন্য ফনির পিপাসা বাড়তেই থাকে। যেন দারুণ নেশা মাথার মধ্যে ঘোরপাক খায় চক্কর কাটে। বুকের ভিতর দলার ভার হিংস্র হয়ে ওঠে। সে জন্মাবধি বেড়ে উঠেছে পতিত জীবনে। তিরিশেরও বেশি বছর কেটেছে তার নষ্ট-ভ্রষ্ট যাপন। অর্থের বিনিময়ে, কখনো কথার মোহন চটুলতায়, কত নারীর শরীরও সে প্রেমে কামে ব্যবহার করেছে; কিন্তু এমন পিপাসা এমন নেশা এমন পাথরভার সে কখনো অনুভব করে নি। পদ্মকে একটু দেখার বাসনায়, তার পানে লাল ঠোঁটে অল্প একটু কথা শোনার আকাঙ্খায়, তাকে এই একটিমাত্রবার ছুঁয়ে দেবার কামনায়, সে কাতর হয়ে পড়ে। মনে হয় তার জ্বর হয়েছে, জ্বর আর ভালো হবে না কোনোদিন। তার তৃষ্ণা হিংস্রতার সাথে বেড়েই চলে নিদারুণভাবে। সে তাড়ি খায় গ্লাসের পর গ্লাস, তার নেশা হয় না। সে আরো খায়, তার নেশা হয় না। গুরু বলে, তুর কী হইল রে ফনা? কী হইছে মুরে ক দেকি!
ফনি বলে, কিচ্ছু হয় নাই!
গুরু আহত হয়ে বলে, মুরে কোবি না রে ফনা?
ফনির হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছা করে। বলে, গেরামের লাগি মনটা কেমুন কান্দে!
গুরু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকায়। বলে, উড়াল দ্যায় পক্ষিরে তার ঘুমায় থাকি কায়া-- কাইয়া মানে কি ক দেকি!
বগির ভিতর থেকে থালাবাসনের ঝনঝন শব্দ শোনা যায়। গুরু চিৎকার করে গালি দিয়ে ওঠে, ওই খানকির পয়দা... বেজায় রঙ ধরছে রে লুটির বেটি... রঙ তুর পুট্টিতে ডুকাই দিমু!
ফনির মাথায় আগুন ধরে যায়, হিংস্র আগুন। তার শিরাধমণীরক্তত্বক সব পুড়ে যায়, পুড়ে যেতে থাকে। সকল প্রত্যঙ্গ জ্বলে যায়, জ্বলে যেতে থাকে। বদনার তাড়ি তখনো শেষ হয় নি, লাত্থি মেরে বদনাটাকে ফেলে দেয় সে। গুরুরও নেশা কেবলই ধরেছে, সে রক্তাক্ত চোখে বলে, কী কললিরে ফনা?
ফনি টলমল পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে। হিসহিস করে বলে, অরে তুমি গাইল পারলা ক্যান?
প্রথমে গুরু বুঝতে পারে না কার কথা কীসের কথা বলছে ফনি। যখন পারে ভীষণ হয়ে ওঠে। বলে, কিল্লা জারুয়ার পুত... মুই কি তুর লাঙরে গাইলছি... তুর ক্যান পুট্টি ফাটে?

হঠাৎ ফনি যেন কিছুটা শান্ত হয়ে আসে। মাথাটা ঝিমঝিমায়। বলে, অরে আর গাইলবানা গুরু... এই কইলাম!
গুরুর সর্বশরীর কাঁপে, টলমল সেও উঠে দাঁড়ায়, বলে, খাড়া, তুরে দিতাছি পরে, আগে ঘরের লুটিটার ছাল ছাড়াই নি! ফনা তুরে...
গুরুর কথা জড়িয়ে আসে, সে তার দখল করা বগি ও বউয়ের দিকে এগোতে থাকে। যেতে যেতে ফনির গুষ্ঠির সকলকে করার কসম কাটে। ফনির বাপ যে চৌদ্দরও বেশি এই অজানা তথ্য ফনিকে জানিয়ে যায়।

সে রাতে পদ্মর উপর দিয়ে সুনামি কুনামি সব বয়ে যায়। ওভার ব্রিজের ওপর থেকেও ফনি স্পষ্ট আর্তি শুনতে পায়-- পদ্মর আর্তি, পদ্মর পশুর মতো গোঙরানি। ফনির ইচ্ছা করে গুরুর গলা টিপে ধরতে; তার কাছে আছে আগা বাঁকানো একটা ভোঁতা চাকু, সেইটাই আমূল গেঁথে দিতে ইচ্ছা করে গুরুর হাড়ের ভিতর; কিন্তু ততক্ষণে ফনির নেশা কেটে গেছে, একটা সিগারেট জ্বালে সে, বুঝতে পারে গুরুর সঙ্গে লাগতে যাওয়া বৃথা-- অত জোর নিচ্চিতপুর জংশনে তার নেই, কিংবা জীবনের কোনো অংশেই অত জোর তার ছিলো না। তাছাড়া লাগতে যাবেই বা কেনো? পদ্ম তার কে? এই একটি প্রশ্ন তাকে অদ্ভুতভাবে কিছুক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে। বিজাতীয় অভিমানে ফনি আপ্লুত হয়। পদ্মকে গুরু মেরে ফেলে দিক, দিয়ে রেল ক্রসিঙে ফেলে রাখুক তার লাশ; শরীরে আগুন লাগিয়ে দিক, দিয়ে প্ল্যাটফর্মের ডাস্টবিনে একদলা কাপড়ের মতো নুড়িসুড়ি ঢুকিয়ে রাখুক, তার কী? পদ্ম তার কে?

গুরুর বগিতে অনেক রাত পর্যন্ত নাটক হয়। জংশনের আর সমস্ত নাটকের মতো এ নাটকও গতানুগতিক, কেবল ফনির জন্য এ নাটকটি ছিলো ভিন্ন, বিভীষিকাময়, এবং দীর্ঘ। সে শুয়ে শুয়ে তারা ছড়ানো আকাশ দেখতে দেখতে সস্তার সিগারেট টানে, থুতু ফেলে, পদ্মর গোঙানি আর শোনা যায় না; নাটকের যবনিকা হয়েছে, অথচ নাটক চলতে থাকে, চলতেই থাকে ফনির বুকের ভিতর।

গভীর রাতে কারো স্পর্শে ফনির ঘুম ভাঙে, চোখ খুলে দেখে একটা পানপাতা মুখ বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। পদ্মকে চিনতে ফনির কয়েক মুহূর্ত দেরী হয়, দেরী হয় বাস্তবে ফিরে আসতে। পদ্ম বলে, মুরে নিবি?
ফনির মনে হয় সে স্বপ্ন দেখছে। পদ্ম আরো ঝুঁকে, ফনির শ্বাসের সাথে শ্বাস মিলিয়ে বলে, মুরে নিবি না?

পদ্মর ডান কপালের কাটা থ্যাতলানো অংশ থেকে এখনো রক্ত বেরিয়ে আসছেÑ দূরের থেকে আসা ঘোলা আলোয় রক্তগুলোকে কালচে আর বিচ্ছিন্ন কিছু মনে হয়। পদ্মর ঠোঁটের কোণায় আড়াআড়ি লম্বা গোল স্তব্ধতার মতো লেগে আছে গুরুর প্রতাপ। ফনির পদ্মর বাম বাহুটা আঁকড়ে ধরে বলে, লমু।
পদ্ম বলে, ল পলাইÑ টাউনে।

সেই থেকে ফনি শহরে। ফনি আর পদ্ম। ওই ভোরে তারা চেপে বসেছিলো একটা ট্রেনে, বিকেলের বেশ পরে নেমে এসেছিলো এই শহরে। প্রথম কয়েকটা দিন কাটিয়েছিলো ইস্টেশনে-পার্কে-ফুটপাতে। তারপর আস্তানা জুটেছে একটা অসম্পূর্ণ বিল্ডিঙের তৃতীয় তলায়। নির্মাণাধীন ওই বিল্ডিঙে তাদের সাথে থাকে আরো জনা বিশেক।

কাঁথার বিছানা, দুটো বালিশ, দুটো চাটাই দিয়ে ঘিরে তারা তাদের সংসার পেতেছে। ইঁটের চুলা বানিয়ে ছোট্ট পাতিলে রান্না হয়। ক’দিন আগে রইস তাদের একটা ছেঁড়া মশারিও দিয়েছে। রইসের সাথে ফনির খাতির ভালোÑ রইস-ই ফনিকে শিখিয়ে দিয়েছে এদিকের ব্যবসার নিয়ম-কানুন। রইসের লম্বা চুল, গোলগাল কালো মুখ, পানের খয়েরের রঙে দাঁত স্থায়ি হলুদ, খ্যাকখ্যাক করে হাসে-- হাসলে থুতু ছিটিয়ে সামনের জনের মুখ ভরিয়ে দেয়, তবু তাকে ভালো লাগে ফনির। রইস-ই তাদের ঠাঁই করে দিয়েছে এমন বেহেস্তি জায়গায়। নাহলে ফনির কি আর সাধ্য ছিলো জায়গাটা দখলের! অবশ্য প্রতিদিন তিরিশটা করে টাকা দিতে হয় রইসকে-- তবু তো ঘর! পদ্মর সাথে একটা বিছানা। একসাথে থাকা। এরচেয়ে বেশি চেয়েছিলো ফনি?
শহরটাকে ফনি এখনো ঠিক মতো চিনতে পারে নি-- এখানে দুই কিসিমের মানুষ দেখে সে। একগুলা বেজায় বড়লোক-- তাজমহলে থাকে খায় দায় ঘুমায়, নানান রঙের গাড়িতে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ায়; আর আরেকগুলান তাদের মতো আধ-হওয়া বাড়িতে, বস্তিতে থাকে খায় দায় ঘুমায়, রাস্তায় রাস্তায় ঘুড়ে বেড়ায় নানাপদের ধান্ধায়। দুই কিসিমের মানুষকেই ফনির চোর মনে হয়। ফনির মনে হতে থাকে আরেক কিসিমের মানুষও আছে এই টাউনটায়-- এরা বাসে রিকশায় লেগুনায় সিএনজি মিশুকে খালি দৌড়ায় আর দৌড়ায়Ñ এরাও চোর, তবে এরা চুরি করতে বহুত ডরায়। গুরুর কথা মনে পড়ে ফনির, সকুনেই চুর। আল্লাও চুর।

শহরে পদ্মর রূপের জেল্লা আরেকটু মনে হয় বাড়ে, অন্তত ফনির কাছে তাই লাগে। রাতের বেলা অসম্পূর্ণ বিল্ডিংটিতে যখন পর্দাবিহীন স্বচ্ছ আদিম উন্মাদনা আরম্ভ হয়, ফনিও পদ্মকে টেনে নেয়। কথাবার্তা হয় কম, কেবল ফিসফিসানি। রাস্তার সোডিয়াম আলোর আবছায়ায় ফনির কাছে পদ্ম ক্রমেই অপ্সরি হয়ে ওঠে। আশ-পাশ থেকে খিস্তি-খেউর ভেসে আসে, কেউ কেউ কুকুরের মতো হাঁপায়, জানুর মা প্রতিরাতে বিলাপ করে, জানুর বাপ খ্যাকায়, চুপ থাক মাগি!
পদ্মর বুকে মাথা গুঁজে ফনি তখন প্রশান্তি খোঁজে, ভেতরের পারদকে বয়ে যেতে দেয়। পদ্ম ঘন শ্বাসের সাথে বলে, এইখান থিইকা ল।
ফনি বলে, ক্যান, কী হইছে?
পদ্ম বলে, এমুন থাকতাম না খানকিগো লগে! মুকে ঘরে ল।
ফনি হিসহিসিয়ে ওঠে, বলে, হ... তুর বাপেয় রাজপরসাদ বানাইছে নি!
পদ্ম মুখ ঝামটায়। ফনির মুখ ঠেলে ব্লাউজের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলে, তয় লইলি ক্যান মুরে?
ফনি বলে, মুই লইছি? তুই আলি না বারোভাতারি?

পদ্ম একটা ঘর চায়।
কিন্তু ফনি জানে, চাইলেই ঘর পাওয়া যায় না। তারচেয়ে তারা এখানে বেশ আছে-- বৃষ্টিবাদলের ভয় নাই। তিনবেলা খাওয়া আর মাথা গুঁজবার একটা ঠাঁই হলেই তো হলো, মানুষ আর কী চায়? বিল্ডিংটার পাশেই একটা মেসবাড়িতে পদ্মর জন্য কাজ জুটিয়ে দিয়েছে রইস। দু’জনের আয়ে তাদের ছোট্ট পাতিলটা প্রতিদিন আগুনের উত্তাপ পায়, টিনের থালায় প্রতিদিন ভাত খায়-- গুরু বলতো, দুনিয়াটা চলতাছে দুই কারুণে-- প্যাট আর চ্যাটে, বুঝলিরে ফনা?

ফনি বোঝে, বোঝে বলেই এমন জায়গা সে ছাড়ে না। এখানে পেট শান্ত, দেহ শান্ত। পদ্মর ঘর্মঘ্রাণে মেতে থাকা দেহটা দুইহাতে চটকাতে চটকাতে ফনি বলে, কই যাইগা ক দেকি?
পদ্ম বলে, ঘরে ল। ক্যামুন মরদ... ঘর বানাইতে পারিস না!
ফনি তার ঘাড়টা ঘুরিয়ে খিকখিক করে হাসতে হাসতে বলে, কেমুন মরদ দেখবি?
পদ্ম বলে, থাউক... বড়া মুর মদ্দা ঘুড়া!
ফনি বলে, নিমু, তুরে ঘরেই নিমু। কট্টা দিন সবুর রাখ!

সাবানের কারখানা পেরিয়েই একটু আড়াল দেখে ব্যাগটা খোলে ফনি। কালো রঙের ঢাউস চামড়ার ব্যাগ, চারিদিকে চেইন। দৌড়ে ঘেমে হাঁপিয়ে উঠেছিলো ফনি, উত্তেজনায় তার চোখ চকচক করে-- সবুরের দিন শেষ হয়ে যাবে, ব্যাগে হয়তো অনেক টাকা পাওয়া যাবে। অন্তত বুড়াটা বাসের ভিতর যেমন আগলে রাখছিলো ব্যাগটা, ফনি নিশ্চিত-- ভিতরে জবরদস্ত কিছু আছেই। মাঝের চেইনটা খুলতে গিয়ে ফনির হাত কেঁপে ওঠে, এমন তো কখনো হয় না!
যদি অনেক টাকা থাকে, কত টাকা? অ-নে-ক টাকা, এত টাকা যে সে কখনো দেখে নি, তবে সে একটা ঘর কিনে ফেলবে; ওই বিল্ডিঙের পাশের বস্তিতেই পাওয়া যায়-- টিনের চালা, টিনের দেয়াল; দালাল ভিড়িয়ে সে দেখেও রেখেছে একটা ঘর-- পদ্মকে নিয়ে সংসার পাতবে।

কিন্তু ব্যাগ খুলে ফনি হতাশ হয়, তিন তিনটা মোটা বই-- অমন বুড়া দামড়া যে বই নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, কে জানে! বইয়ের সাথে পায় একটা পাঞ্জাবি একটা শার্ট লুঙ্গি গামছা আর ইয়া বড় আন্ডারওয়্যার। ফনি বুড়ার জন্ম টেনে গালি দেয়। তন্ন তন্ন ব্যাগ খুঁজে একটা হালাল সাবান ছাড়া আর কিছুই পায় না। ফনির হাতের তালু ভিজে ওঠে, মাথার ভিতর দপদপ করে, ব্যাগটাকে কাঁধে ঝুলিয়ে গলির বিপরীত মুখ থেকে বেরিয়ে একটা রিকশায় চেপে বসে সিগারেট ধরায়। তার হতাশ ভাবটা কাটতে থাকে, এমন আশা-নিরাশার ভিতর দিয়েই তার জীবন পেরিয়ে এসেছে তিরিশেরও বেশি বছর। সন্ধ্যার ফুরফুরে বাতাস তার ঘামে মাখা মুখে অদ্ভুত শীতলতা এনে দেয়। অদ্ভুত এক স্থিরতা নিয়ে সে চলতে থাকে সামনের দিকে, যেমন মানুষ যায়।

মানুষের বৈশিষ্ট্য নিয়েই ফনি সামনের দিকে এগিয়ে চলে নিশ্চিন্তে; সে জানে না কত কী বিস্ময় অপেক্ষা করছে তার জন্য, জানে না বলেই তার চলাটা এত স্থির, এত নিশ্চিত।

রিকশায় বসে বসে বইগুলো ওল্টাতে ওল্টাতে সে আবিষ্কার করবে ছয় ছয়টা হাজার টাকার নোট। আনন্দে সে আরেকটা সিগারেট ধরাবে, ঘুরিয়ে নেবে রিকশা। পদ্মর জন্য চুড়ি কিনবে, ঠোঁটের নখের রঙ কিনবে, চুলে বাঁধার বাহারি ফিতাও কিনবে। কিছুদিন থেকে স্যান্ডেলের জন্য ঘ্যানঘ্যান করছে পদ্ম-- সোনালী জড়ির কাজ করা একজোড়া স্যান্ডেলও সে কিনবে। কিছু বাজার সদাই করবে-- চাল ডাল আলু। পেঁয়াজপট্টির পিছনে গিয়ে ক’গ্লাস চোলাইও গিলবে। পান চিবাতে চিবাতে উপস্থিত হবে তাদের আস্তানায়-- এত বাজার দেখে পদ্ম কত খুশি হবে এই ভেবে তার মন চনমনিয়ে উঠবে।

কিন্তু হাতভরা বাজার আর বুকভরা খুশি নিয়ে ফনি যখন উপস্থিত হবে অসম্পূর্ণ ইমারতে তেতালায়, জানবে কাজ থেকে আজ ফেরে নি পদ্ম, জানবে পদ্ম আর ফিরবেও না কোনোদিন, পদ্ম চলে গেছে রইসের হাত ধরে একক কোনো ঘরের সন্ধানে।
তখন কি ফনি এমন নিশ্চিন্তে সিগারেট টানতে পারবে?

ফনি কষে কষে টান মারে সিগারেটে। রাস্তা পেরিয়ে তার রিকশা গলির দিকে এগিয়ে যায়। যে-গলি পেরোলেই ফনির অস্থায়ী ঘর তার জন্য অপেক্ষা করছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন