বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৫

কখন ফোন আসে

মোবাইল ফোন এখন অপরিহার্য। এই যন্ত্রটি ছাড়া মানুষের এক দিন, এক ঘণ্টা, এক মিনিটও চলে না। কিন্তু খেয়াল করে দেখেছেন কি, এই মোবাইল ফোনে কলগুলো ঠিক কখন কখন আসে?
আঁকা: ষুভ 
ভিড় বাসে
প্রচণ্ড ভিড়, লোকজনে ঠাসা লোকাল বাস। আপনি বাসে কোনোভাবে উঠতে পেরেছেন। উঠেছেন তো ঠিকই, কিন্তু দাঁড়ানোর জায়গাটুকুও নেই। আপনি একজনের পায়ের ওপর, আরেকজন আপনার পায়ের ওপর জিমন্যাস্টিকসের ব্যালান্সকে হার মানিয়ে, নিউটনের গতিসূত্রকে প্রায় বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। না, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেননি, অনেকটা লতাগাছের মতো নিজেকে ঝুলিয়ে, প্রায় তিন শ হাত দূরের একটা লৌহবস্তুতে নিজের হাত আটকে নিরন্তর ব্যালান্স করে চলেছেন। এ রকম, ঠিক এ রকম অবস্থায় আপনার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠবে। ভাইব্রেশন হবে। ঝোলাঝুলিতে আপনি এতটাই ব্যস্ত থাকবেন যে রিংটোন বা ভাইব্রেশন—কোনোটাই বুঝে উঠতে পারবেন না। আপনার পাশের সহযোদ্ধা প্রথমে নিজের পকেট হাতড়াবে, তারপর বলবে, ‘এই যে ভাই, আপনার ফোন...’। নিজের ফোন বাজতে শুনে আপনি কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাবেন। বুঝে উঠতে পারবেন না, ফোনটা আপনি ধরবেন কি না। ধরলে কী উপায়ে ধরবেন? আপনার ঝুলন্ত সহযোদ্ধা তখন আপনাকে সাহায্য করতে নিজের পিঠটা এগিয়ে দেবেন। সেই পিঠে নিজের খানিকটা ভার ছেড়ে, অনেকটা নির্ভার হয়ে, জিনস প্যান্টের টাইট পকেট থেকে অনেক কসরত করে আপনি ফোনটা যখন বের করবেন, দেখবেন রিং এসেছে ফোন অপারেটর থেকে। আপনি জানেন, ফোনটা ধরলেই তারা গান শোনাবে। মানুষের চাপে যখন আপনার প্রাণ প্রায় যায় যায়, তখন আর যা-ই হোক গান শুনতে আপনার ইচ্ছা করবে না!
বাথরুমে
সারা দিন আপনার সঙ্গে ফোনটা অঙ্গাঙ্গিভাবেই জড়িয়ে ছিল। ফোনটাকে বহন করেছেন কখনো পকেটে করে, কখনো হাতে নিয়ে। দিনের কাজ শেষে ফিরেছেন বাসায়। ফোনটা নিয়ে কিছুক্ষণ ফেসবুক, কিছুক্ষণ এই গেম সেই গেম করেছেন, তারপর সেটা রেখে ঢুকেছেন বাথরুমে। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে চোখেমুখে ফেনা মাখিয়েছেন সাবানের। সেই সময়, ঠিক সময় আপনার ফোন বেজে উঠবে। একসঙ্গে এক হাজার সম্ভাব্যতার কথা মনে আসবে আপনার। রুনা কি ফোন দিল? নাকি মাহি? টিচার কি ফোন দিল, নাকি বস? নাকি ফ্যামিলির কেউ? চোখে সাবানের জ্বালা নিয়ে অর্ধভেজা আপনি ঘরে ঢুকে ফোনটা ধরবেন। আর তখনই ও–প্রান্ত থেকে কেউ একজন মিহি সুরে আপনাকে সালাম দেবে। তারপর জানাবে কী করে কোথায় গেলে পাঁচ শ কেজি সোনা আপনি পাবেন। আপনি থরথর কাঁপতে থাকবেন। জি হ্যাঁ, আপনি এবার কোটিপতি হতে যাচ্ছেন! কারণ, আপনাকে রিং করেছে স্বয়ং জিনের বাদশাহ!
আঁকা: ষুভ 
বৃষ্টির মধ্যে রিকশায়
একটা সময় ছিল যখন শুধু বর্ষাকালে বৃষ্টি হতো। সেই দিন আর নেই। এখন যেকোনো ঋতুতে, যেকোনো অবস্থায় হুড়মুড় করে বৃষ্টি নেমে আসতে পারে। এ রকম ঝুমবৃষ্টির মধ্যে প্রায় হাতে-পায়ে ধরে আপনি একটা রিকশায় উঠতে পেরেছেন। নীল পলিথিনের সুরক্ষার চাদরে আপনি নিজেকে ঢেকে ফেলেছেন। কিন্তু ঢেকে ফেললে কী হবে, এদিক থেকে ওদিক থেকে বৃষ্টি আপনাকে প্রতি মুহূর্তে জাপটে ধরতে চাইছে। আপনি রিকশার হুডের তলায় গুটিসুটি মেরে গভীর দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন। দুশ্চিন্তা আপনার সঙ্গের ল্যাপটপটা নিয়ে, যদি সেটা ভিজে যায়! দুশ্চিন্তা আপনার স্মার্টফোনটা নিয়ে, যদি সেটাও ভিজে যায়! মাত্র ছয় মাস আগেই ভিজে গিয়ে একটা ফোন অন্ধ হয়ে গেছে আপনার। আপনি তাই যতটা না নিজেকে বাঁচাচ্ছেন, তার চেয়ে বেশি বাঁচানোর চেষ্টা করছেন আপনার ল্যাপটপ আর স্মার্টফোন! এই সময়, ঠিক এই সময় আপনার ফোন বেজে উঠবে। রিং হচ্ছে, আপনি এড়িয়ে যাচ্ছেন। ফোনটা বের করছেন না পকেট থেকে। রিং হচ্ছে, ভাইব্রেশন হচ্ছে, আপনি এড়িয়ে যাচ্ছেন। ফোনটা বের করছেন না পকেট থেকে। প্রথমবার রিঙের পর আবার বাজতে শুরু করল ফোন। আপনি দোয়া করছেন, আর যেন না বাজে ফোনটা। কিন্তু তৃতীয়বারের মতো বেজে ওঠে সেটা। আপনি আর এড়াতে পারেন না। স্ক্রিনে অপরিচিত নম্বর। কে হতে পারে, ভাবতে ভাবতেই আপনি ফোনটা ধরেন।
: হ্যালো দোওওস্ত, কী অবস্থা, বল!
: কে বলছেন?
: আর রে, তুই আমাক চিনতে পারলি না?
: কে?
: আরে, আমি তোর হাফপ্যান্ট কালের বন্ধু! মিজান!
: ও, মিজান! আসলে আমি খুব ঝামেলার মধ্যে আছি...এদিকে বৃষ্টি হচ্ছে তো...
: তাই নাকি? ঢাকায় বৃষ্টি হয়? তাইলে তো বন্ধু ঢাকা এইবার ডুইবা যাবে! কী করতে যে তোরা ঢাকায় থাকিস। চইলা আয় চইলা আয়! আর শোন, আমাদের এইখানে তো ভোট। কে দাঁড়াইছে জানিস...হ্যালো, শুনতে পাস না নাকি...
আপনি জানেন, এই আলাপ বন্ধ হওয়ার নয়। আপনি এও জানেন, এই আলাপের মধ্যে ফোন কেটে দেওয়ার ক্ষমতাও আপনার নেই। আপনি তাই ‘হুঁ’ আর ‘হ্যাঁ’ বলে শুনতে থাকবেন আপনার হাফপ্যান্ট-কালের বন্ধুর নানান প্যাঁচালাপ। বৃষ্টিতে আপনি ও আপনার প্রিয় ফোন ভিজতে থাকবে।
বসের সামনে
অফিসে ঢুকতে না-ঢুকতেই জানতে পারলেন, বস আপনাকে খুঁজছে। আকাশ থেকে পড়লেন আপনি। পড়ি কি মরি করে ছুটলেন বসের ঘরে। বস অন্য কারও সঙ্গে কথা বলছেন। আপনি উঁকি দিলেন, বস যেন দেখেও দেখলেন না। কলজে শুকিয়ে গেল আপনার, আজ বোধ হয় আজাব নেমে আসবে। হয়তো চাকরিটাই নট হয়ে যাবে! এ সময় ফোন বেজে উঠবে আপনার। পকেট থেকে বের করে দেখবেন প্রেমিকা বা বউ রিং করেছে। অন্য যেকোনো রিংই আপনি কেটে দিতে পারতেন, কিন্তু এই রিংটা এড়াবেন কীভাবে? আপনি বসের দিকে তাকালেন, বস কথা বলছেন; আপনি ফোনের দিকে তাকালেন, ফোন বেজে চলেছে। আপনি বসের দিকে তাকিয়ে ফোনটা ধরলেন। ওপাশের কণ্ঠ, ‘কী, এতক্ষণ লাগে কেন ফোন ধরতে?’ আপনি ফিসফিস করে বললেন, ‘বিজি আছি, জান! একটু পরে রিং দিই?’
: কী হইছে? কী বলো, অ্যাঁ? তোমার কথা তো শুনতে পাই না!
: বলছি, বিজি আছি!
: কী, কই আছ তুমি? তুমি অফিসে যাও নাই?
: অফিসেই আছি...বসের সামনে...একটু পরে রিং দিই?
: ও, এখন তো একটু পরেই রিং দিবা। আগে তো সারা রাত কথা বলতা। আমি ঘুমাইতে চাইলে বলতা আজ কোনো ঘুম না, আজ খালি প্রেম! মোবাইলের চার্জ ফুরায়ে গেলে চার্জারে দিয়ে কথা বলতা! কত রঙের কত ঢঙের সব কথা! আর এখন...এখন তুমি একটুও সময় দাও না আমাকে। আমি কি কিছু বুঝি না নাকি...
আপনি কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই বস আপনার দিকে তাকাবেন। ফোনের ওপারে এক বস, ফোনের এপারে আরেক বস। আপনার অবস্থাটা হবে দুই বসের মাঝে পিষ্ট একটা স্যান্ডউইচের মতো!


প্রথম প্রকাশ: রস+আলো
লিংক:  http://www.prothom-alo.com/roshalo/article/658879

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন