সোমবার, ৮ জানুয়ারী, ২০১৮

আপনার নাম হিমু?

ওসি সাহেব দেখতে দশাসই। চোখ দুটো ছোট ছোট হওয়ায় চেহারায় হাতি-ভাব আছে। পান-মসলা খাওয়ার অভ্যাস আছে বোধ হয়, কিছুক্ষণ পরপরই মুখ নাড়াচ্ছেন। বুকের ওপর নাম লেখা—মোজাফ্‌ফর! প্রথম ‘ফ’য়ের নিচে হসন্ত আছে। বাংলায় এই হসন্ত দোর্দণ্ড প্রতাপে টিকে আছে, এমনটা বলা যায় না। হসন্তের অবস্থা অনেকটা ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের মতো, আছে কিন্তু কেউ ব্যবহার করে না।
: কী হলো, কথা বলছেন না কেন? আপনার নাম হিমু?
আমি কী জবাব দেব বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ আগে রাস্তা থেকে আমাকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। বসে আছি থানায়। ওসি সাহেব হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছেন। মনে হচ্ছে উত্তেজিত। সন্দেহ হচ্ছে উত্তেজনা আমাকে নিয়েই। পুলিশ যখন উত্তেজিত হয়, তখন পা ফেলতে হয় সাবধানে। আমি সাবধানে শুধু পা নয়, পুরো শরীরটাই ফেললাম। কুঁইকুঁই করে জানতে চাইলাম, ‘কেন বলুন তো?’
: যা প্রশ্ন করেছি, তার উত্তর দেন! প্রশ্নের জবাবে প্রশ্ন করবেন না। আমরা তাস খেলতে বসিনি যে আমি একটা তাস ফেলব তার বদলে আপনি একটা তাস ফেলবেন! প্রশ্ন করছি, জবাব দেন! আপনি হিমু?
: হিমু না, হীরু বলতে পারেন।
আমি এখনো জিনিসটাকে মাঝামাঝি রাখার চেষ্টা করছি। পানি কোন দিকে গড়াচ্ছে, বুঝতে পারছি না। পানি যেদিকে গড়াবে সেদিকে ছাতা ধরার নিয়ম। আমার কাছে কোনো ছাতা নেই। ওসি সাহেবের বিরক্তি সম্ভবত চরমে পৌঁছেছে। বললেন, ‘হীরু! এটা কেমন নাম?’
: অত্যন্ত খারাপ নাম, স্যার। আমার দূরসম্পর্কের এক আত্মীয় আমাকে এই নামে ডাকত। আমার খুবই রাগ হতো। রাগ থেকে আমি একবার তাদের বাড়িতে ডাস্টবিনের ময়লা ছুড়ে মেরেছিলাম!
: সর্বনাশ! তারপর?
: তারপরের ঘটনা স্যার অনেক লম্বা! ওই ময়লার মধ্যে একটা মানিব্যাগ ছিল। মানিব্যাগভর্তি ছিল টাকা! টোটাল টাকা ছিল ৫৭ হাজার ৩২৭! ’৯২ সালের ঘটনা স্যার, তখন ৫৭ হাজার অনেক টাকা। আমি ছুড়লাম ময়লা, তারা পেল গুপ্তধন! এই তো কপাল স্যার!
: মানিব্যাগে কেউ ৫৭ হাজার টাকা রাখে! ফাজলামি করছেন আমার সাথে?
: জি স্যার। মানে স্যার, ফাজলামি না ঠিক, কথায় কথায় কথা বাড়িয়ে স্যার বোঝার চেষ্টা করছি ঠিক কী কারণে আমাকে থানায় ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। আর কী কারণেই বা আমার নাম হিমু কি না জানতে চাওয়া হচ্ছে। এটা ইনফরমেশন নেওয়ার একধরনের পদ্ধতি। পদ্ধতিটার জনক হলেন সম্ভব জার্মানির মিস্টার...
: থাক থাক। আর প্যাঁচাল বাড়াবেন না। সোজা কথায় বলেন, আপনি হিমু কি হিমু না।
: স্যার, আমার গায়ে কি পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবি আছে?
: না।
: স্যার, আমার কি দাড়ি আছে?
: না।
: আরেকটা ইনফরমেশন স্যার, আপনাদের সুবিধার্থে দিচ্ছি, রূপা নামের আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নাই। একচুয়ালি আমার কোনো গার্লফ্রেন্ডই নাই! এ নিয়ে আমার মনে কিঞ্চিৎ দুঃখবোধ আছে।
: মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনি হিমু না?
: জি স্যার। আমি হিমু না। আমার নাম আহমেদ খান হীরক। হীরক থেকে হীরু স্যার। ওই যে আমার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের কথা বলছিলাম স্যার, যার বাড়িতে আমি ময়লা ছুড়ে ফেলেছিলাম। যে ময়লার ভেতর মানিব্যাগ ছিল। যে মানিব্যাগে স্যার ৫৭ হাজার...
: থাক থাক, আর বলতে হবে না। আপনি যদি হিমু না হন তাহলে হিমু নিয়ে লেখেন কেন?
: জি স্যার?
: আমাদের কাছে ইনফো আছে, আপনি হিমুকে নিয়ে লেখেন।
: স্যার, আমি খুবই ছোট এক লেখক, স্যার। পেটের দায়ে লেখি। সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য মাঝেমধ্যে হিমু চরিত্র নিয়ে দু-একটা লেখা লিখেছি। লাভের লাভ কিছুই হয়নি। না লেখাগুলো প্রিয় হয়েছে, না আমি জনপ্রিয় হয়েছি! তার মধ্যে স্যার হিমুর ফ্যানরা আমাকে বকাঝকা করেছে। মিষ্টি মিষ্টি গালমন্দও করেছে!
: অত্যন্ত ঠিক কাজ করেছে।
: জি স্যার, উচিত কাজই করেছে। হিমুকে নিয়ে স্যার আমার লিখতে যাওয়া ঠিক হয়নি। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। হিমু নিয়ে লেখা আমি তাই ছেড়ে দিয়েছি।
: কিন্তু ছেড়ে দিলে তো হবে না মিস্টার হীরক না হীরু, আপনাকে লিখতে হবে!
: মানে স্যার?
: মানে আমার স্ত্রী, তিনি বিরাট হিমুভক্ত। আগামীকাল তাঁর জন্মদিন! রাত বারোটায় আমি তাঁকে একটা চিঠি দিতে চাই। যে চিঠিটা আসলে হিমু লিখবে তার জন্য। কী, পারবেন না?
আমার মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরোল না। ওসি সাহেব বললেন, ‘যতক্ষণ চিঠি লিখে দেবেন না ততক্ষণ আপনি আমার হেফাজতে থাকবেন।’ আমার কণ্ঠ আরও নিচু হয়ে গেল। কোনোমতে বললাম, ‘চা...চা হবে এক কাপ?’
২.
চব্বিশ কাপ চা শেষ হয়েছে, একটা লাইনও বের হয়নি। শূন্য পাতার দিকে তাকিয়ে আছি। হিমু হিসেবে ওসি সাহেবের স্ত্রীর জন্য কী লিখব বুঝতে পারছি না। সময় বয়ে যাচ্ছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বারোটা বাজবে। আর বারোটা বাজলেই আমারও বারোটা বাজবে! কারণ, ওসি সাহেব তখন চিঠিটা তাঁর বাসায় পাঠিয়ে দেবেন। পাঠিয়ে ফোন দিয়ে সুরেলা কণ্ঠে বলবেন, ‘হ্যাপি বার্থ ডে, হ্যাপি বার্থ ডে ডিয়ার, হ্যাপি!’ ও হ্যাঁ, ওসি সাহেবের স্ত্রীর নাম হ্যাপি। ওসি সাহেব মাঝেমধ্যেই এসে তাড়া দিয়ে যাচ্ছেন, ‘কী হলো? কদ্দুর হলো?’ আমি চুপ করে থাকি। চোখের দৃষ্টি দিয়ে ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করি। যেন বলছি, ‘হচ্ছে হচ্ছে...এই তো আর কিছুক্ষণ!’
বারোটা বাজতে যখন আর মাত্র ১০ মিনিট বাকি তখন কিছু একটা লিখে ধরিয়ে দিলাম ওসি সাহেবের হাতে। ওসি সাহেব মহাখুশি হয়ে তাড়ার মধ্যে কী লিখেছি না পড়েই স্ত্রীর উদ্দেশে একজন সহকারীকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। আমি বললাম, ‘আমি তাহলে আসি?’ ওসি সাহেব মধুর কণ্ঠে বললেন, ‘না না, তা কী করে হয়! স্ত্রীর রিঅ্যাকশন না জেনেই চলে যাবেন?’
ওসি সাহেব ঘড়ি দেখছেন, আমি নিজের অন্ধকার ভবিষ্যৎ দেখছি। আমার পেট গুড়গুড় করছে। যেকোনো মুহূর্তে কেলেঙ্কারি হয়ে যেতে পারে।
বারোটা বাজল। ওসি সাহেব ফোন তুললেন কানে। বললেন, ‘হ্যাপি বার্থ ডে...’। কথা শেষ করতে পারলেন না। কেমন যেন চমকে উঠলেন। আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল। পরপর দুবার হার্টের রিদম মিস করে গেল। ওসি সাহেব বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি না...এটা তো অন্যজন লিখেছে! হ্যাঁ হ্যাঁ, উনি তো আমার সাথেই আছেন। কথা বলবে? দাঁড়াও, দিচ্ছি!’
ওসি সাহেব আমার দিকে তাঁর ফোনটা বাড়িয়ে দিলেন। আমি ফোনের বদলে যেন আস্ত একটা বোমা ধরলাম। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম, ‘হ্যালো...।’ ও-প্রান্ত থেকে অত্যন্ত মিষ্টি কণ্ঠ রিনরিন করে উঠল। বলল, ‘এটা আপনি লিখেছেন?’
: জি, মানে হ্যাঁ।
: এটা তো খুবই ভালো হয়েছে!
: জি, মানে সত্যি? শুকরিয়া!
: এত ভালো হয়েছে যে সেটা দিয়ে চুলা জ্বালিয়েছি। চুলা জ্বালিয়ে তাতে চা চাপিয়েছি। আমার গবেট হাজব্যান্ডটাকে নিয়ে আসেন এক্ষুনি। চা খেয়ে তারপর যাবেন!
: কী বলেন এইসব?
: যা বলছি তা শোনেন। এক্ষুনি আসেন। আজকে আমি আপনার আর আমার স্বামীর হিমুগিরি ছোটাব! আসেন এক্ষুনি! আসেন!
ফোনের ভেতর থেকে মিষ্টি কণ্ঠ এক নিমেষে দানবীয় হয়ে উঠল। আমি করুণ চোখে ওসির দিকে তাকালাম। ওসির মুখ ঝুলে গেছে। হিতে এতটা বিপরীত হতে পারে তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। আমি খনখনে কণ্ঠে বললাম, ‘আমাদের দুজনকে ডাকছেন উনি...’
ওসি সাহেব বললেন, ‘ডাবলু, গাড়ি বের করো...’
৩.
শালবনে বসে আছি। আমি আর ওসি সাহেব। ওসি সাহেবের মুখ অত্যন্ত ব্যাজার। কিছুক্ষণ পরপর চাটি মেরে মশা মারার চেষ্টা করছেন। মশা মারা যাচ্ছে না। তবে তারা তাদের গানের আওয়াজ বাড়িয়ে তুলেছে। বনের মধ্যে এ সময় ফুলের গন্ধ ভেসে আসার কথা। গল্প-উপন্যাসে তা-ই হয়। আমরা পাচ্ছি বিজাতীয় আঁশটে দুর্গন্ধ। আকাশে ফুলমুন অবশ্য উঠেছে। চাঁদটাকে দেখে তেমন কোনো আহ্লাদ হচ্ছে না। বরং শীতরাতে এভাবে বসে থাকার জন্য আমরা পরস্পরকে দোষ দিয়ে যাচ্ছি। আমি বলছি, ‘ওসি সাহেব, স্ত্রীর ভয়ে শালবনে বসে আছেন; এটা কি কোনো কাজের কথা?’ ওসি সাহেব বলছেন, ‘লেখকদের ওপর কোনো বিশ্বাস নেই, কোনো বিশ্বাস নেই!’
তবে এ কথাগুলো আমরা মনে মনে বলছি। কারণ, মুখে কিছু বলার মতো মুখ না আমার আছে, না ওসি সাহেবের!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন