বৃহস্পতিবার, ২৬ জুলাই, ২০১৮

মাহমুদার কাছে যাওয়া না যাওয়া

কাকের ডাকে ভেঙে যাওয়া কর্কশ সকালটা মাহমুদার ফোনে হঠাৎই ঝনঝনিয়ে যায়। কোথা থেকে, কেন, কীভাবে, কী হয়েছে-এসবের বিন্দু পরিমাণ কিছু না বুঝেই খাবি খেতে খেতে ধারণা করতে পারি, মাহমুদা ফিরেছে। হয়তো একেবারেই ফিরেছে। ছুটির সকালের ঘুমটা চটকে যায়। মাহমুদা বলে, এক্ষুনি আসো! 
আমি প্রস্তুতি নিতে থাকি। মাহমুদা… যাকে আমি ভালোবেসেছি সাকল্যে তিনবার। দুটি অভিন্ন মানুষ হওয়া সত্ত্বেও এই তিনটি ভালোবাসা এতটাই পরস্পরবিরোধী যে কখনো কখনো মনে হয় এই ব্যক্তিগুলো আসলে একে অপরকে চেনেই না।
মাহমুদা কানাডা চলে যাওয়ারও অনেক আগে, আমাদের যে একমাত্র মাঠ ছিল মফস্বলে, যেখানে শীতের রাতে ব্যাডমিন্টন আর গ্রীষ্মের বিকেলে বুড়িচু হতো, আমি আর মাহমুদা তাতে নিষ্ঠাবান খেলোয়াড় ছিলাম। মাহমুদা এক ক্লাস ওপরে বলে তখন নীলড্রেস গার্লস হাইস্কুল আর আমি ছেড়ে দিতে চাওয়া ছোট হয়ে আসা হাফপ্যান্ট। মাহমুদাকে তখন পাড়ার সম্পর্কে ‘মামা’ ডাকি আমি, বলি মাহমুদামা…আর সে আমাকে আমার নাম ধরে আলস্য ও তাচ্ছিল্য মিলিয়ে অদ্ভুতভাবে ডাকে। খুব রাগ করতে চাই আমি, কিন্তু মাহমুদামার ওপর রাগ করে এমনকি তার বাবাও থাকতে পারে না। আমি তাই শুধু ঘোরলাগা চোখে তাকে দেখি আর বুড়িচু খেলায় একদিন বউ ধরতে গিয়ে তার কামিজ ধরে টান দিই। তাতেই ভেতরের সাদা সেমিজ বেরিয়ে এলে এক নিষিদ্ধ সুন্দর আমাকে জাপটে ধরে অনেক দিনের জন্য। আমি মাহমুদামাকে ভালোবেসে ফেলি।
ভালোবেসে ফেলি, কিন্তু বলার জন্য যে সাহস ও জেদ, তার কোনোটাই আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে না। অথচ মাহমুদামার চিহ্ন ধরে আমি ঠিকই পৌঁছে যাই আমবনে, নদীতে, ব্রিজে। বাতাসে তার ছেড়ে যাওয়া আমলার ঘ্রাণ। আর আমার ভেতর বাড়তে থাকে তালা। গোপন এবং গোপন নিয়ে শৈশবের কবাট বন্ধ হতে থাকে। আমি আরও চুপচাপ হয়ে যাই, হয়ে উঠি আরও বেশি কল্পনাপ্রবণ। কিন্তু তত দিনে মাহমুদামা কলেজ ছুঁয়ে ফেলে। আর আমি তার ঘ্রাণও ছুঁতে পারি না। আমার হাফপ্যান্টগুলো অবহেলায় আলনায় মাথা গুঁজে পড়ে থাকে। নতুন প্রেমের মতো দুটো ফুলপ্যান্ট আমাকে সব সময় আঁকড়ে ধরে রাখে। মাহমুদামার সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে। বাড়তে বাড়তে একদিন ভুলে যাই তাকে আমি ভালোবেসেছিলাম!
এরপর অনেকটা সময় শহরে কলেজপড়ুয়া মাহমুদার কোনো খোঁজ আমি রাখি না। আমি তাকে ভুলতেই বসেছিলাম। কিন্তু মাহমুদার বিয়ের খবরের সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেও যখন মফস্বলে ফিরল, তখন তাকে একবার দেখতে যাওয়ার সাবেকি ইচ্ছা আমার হলো। বাড়িতে বিয়ের ধূম…তার মধ্যে মাহমুদা কেমন উচ্ছ্বল…ভীষণ ঈর্ষা হলো আমার। মনে হলো, মেয়েটাকে শক্ত করে ধরে নিয়ে চলে যাই নিমবনে। চোয়ালটা সাঁড়াশি হাতে চেপে ধরে বলি, ভালোবাসি! তারপর কামড়ে খুবলে নিই কণ্ঠনালি! বুকের ভেতর রক্তের দ্রিম দ্রিম শুনি ফুলপ্যান্টের দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে। আবারও ভুলে যাই, মাহমুদাকে আমি শৈশবে একবার ভালোবেসেছিলাম। ভুলে যাই, এই একটু আগে তীব্র ঈর্ষা নিয়ে মাহমুদাকে আমি আমার সমস্ত দিয়ে ভালোবাসতে চেয়েছিলাম! 
মাহমুদা বলে, ‘ওহহো, তুমি? কেমন আছ?’ 
আমি একটা লম্বা উত্তর দিতে চাই, কিন্তু তার আগেই সেখান থেকে সরে যায় মাহমুদা। বুঝতে পারি, আমার উত্তরের কোনো প্রয়োজন আসলে তার নেই।
অনেক অনেক অনেক দিন পর, মাহমুদাকে পাই ফেসবুকে। কী আশ্চর্য! মাহমুদা কানাডায় থাকে…কী আশ্চর্য, মাহমুদার সঙ্গে এখন চাইলেই কথা বলা যায়! মাহমুদাকে ‘তুমি’ করে বলা যায়, চাইলে তুইও। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, মাহমুদা জানত আমার হাফপ্যান্ট পরা শৈশব আমি তাকেই উৎসর্গ করেছিলাম। প্রত্যুত্তরে আমি হেসে জানাই, আমার ফুলপ্যান্ট পরা কৈশোরও আসলে মাহমুদাতেই ছিল! মাহমুদা হাসে। আবার কাঁদেও। হাসে আর কাঁদে। কাঁদে আর হাসে। তার ডাক্তার স্বামীটি একটা পাকিস্তানি মেয়ের প্রেমে পড়েছে। তাকে নিয়েই এখন সে থাকে। কানাডায়, বলতে গেলে, মাহমুদা এখন, একার চেয়েও অনেক বেশি একা।
আমার ভেতর থেকে হাফপ্যান্ট ফুলপ্যান্ট জেগে ওঠে। মাহমুদা কেন একা হবে? আমার শৈশব, আমার কৈশোর আর আমার যৌবন…সবই মাহমুদার!
দুই. 
রিকশা নিয়ে ছুটি। গত এক বছরের ফেসবুক চ্যাটে আমরা এখন পরস্পরকে আগের চেয়ে ঢের বেশি চিনি জানি। মাহমুদা কানাডার রান্না খুব পছন্দ করে। অবশ্য সবচেয়ে পছন্দ করে সামুদ্রিক খাবার। অক্টোপাস খেয়ে তার কী ভীষণ উচ্ছ্বাস! 
আমি অবশ্য পারি না। কোথাও গিয়ে একটু বেশি খেলে, কিংবা সীমালঙ্ঘন করতে গেলেই কেমন যেন গা গুলায় আমার। মাহমুদা চ্যাটবক্সেই বলে, ‘গাঁজা খেয়েছ কখনো?’ 
: একবার। আর কখনো খাইনি। 
: আমি মাঝে মাঝে টানি কিন্তু। 
: আচ্ছা। 
: তোমাকে যদি বিয়ে করি, গাঁজা খেতে দেবে আমাকে? 
: আমাকে বিয়ের প্রসঙ্গ আসছে কেন? 
: কেন? আমাকে বিয়ে করবে না তুমি? তুমি তো আমার কথা ভেবে ভেবে শৈশব-কৈশোর গলিয়ে ফেলেছ, জানি না আমি? নাকি আমি ডিভোর্সি? 
: তোমার ডিভোর্স এখনো হয়নি! 
: হয়ে যাবে, চিন্তা করো না। সাপ খেয়েছ কখনো? 
: নাহ! 
: হারাম, না? 
: মদও তো হারাম! 
: তাহলে? 
: ইচ্ছা করেনি। সামনে এনে দিয়েছিল…কী সুন্দর রং! কিন্তু খেতে পারিনি। 
: সংস্কার? 
: কী জানি! 
: আগামী সপ্তাহে দেশে যাব, তৈরি থেকো! 
: সাপ খাওয়াবে? 
: না, অক্টোপাস! 
: হি হি হি। 
: আই হেট স্ট্রবেরি, মনে রেখো!
তিন. 
বনানীর এই গলিটায় আগে কখনো আসিনি। গলির শেষ বাড়িটাই ৪৭। মাহমুদার নিজের বাড়ি এখন। রিকশা বাড়িটার সামনে এসে থামতেই ফোন। 
: পৌঁছে গেছ? 
: নীরবতা। 
: কোথায় আছ? 
: নীরবতা। 
: কথা বলছ না কেন? 
: নীরবতা। 
: হ্যালো হ্যালো…হ্যালো…! মাহিন…হ্যালো! 
রিকশা ঘুরে যায় আমার। ফোনের ওপার থেকে মাহমুদার ডাক ভেসে আসতেই থাকে। রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। আমি বলি, আমাদের নিয়ে চলেন! রিকশাওয়ালা আমার আশপাশ দেখে রিকশায় টান দেয়। মাহমুদা এখনো ডাকছে। ডেকেই যাচ্ছে। কিন্তু এই মাহমুদাকে কেমন যেন অচেনা মনে হয় আমার। আমরা ফিরে আসতে থাকি। আমরা মানে আমি আর আমার শৈশব আর কৈশোর। তারা মাহমুদাকে চিনেছিল এবং সম্ভবত তারাই কেবল মাহমুদাকে ভালোবেসেছিল!

শোনো গো দখিনও হাওয়া

রাকার সঙ্গে সম্ভবত আমার প্রেম আছে। 
‘সম্ভবত’ বলে সন্দেহ প্রকাশ এ কারণে যে এই সময়ে প্রেম হওয়ার যেসব সহজ উপকরণ বিদ্যমান, তা আমার আর রাকার মধ্যে নেই। প্রথমত, রাকার ফোন নম্বর আমি জানি না। জানার কোনো চেষ্টা যে তেমন করেছি, তা-ও অবশ্য না। সামাজিক নানান যে যোগাযোগ—টুইটার, মেসেঞ্জার এবং বিশেষত ফেসবুক…এসবে রাকা আমার সঙ্গে নেই। সেই অর্থে এবং অন্য অর্থেও রাকার সঙ্গে আমার কোনো সামাজিক যোগাযোগ নেই। 
তবে অসামাজিক একটা যোগাযোগ আমাদের মধ্যে হয়। 

এটা ঘটে সকাল সাড়ে ছয়টায়, খুব ঘড়ি ধরে বলতে গেলে ছয়টা পঁয়ত্রিশ থেকে সাঁইত্রিশের মধ্যে। আমার মোবাইলে অ্যালার্ম দেওয়া থাকে ছয়টা পঁয়তাল্লিশে। তবে প্রতি সকালেই, ছয়টা পঁচিশে আমার ঘুম ভাঙে। আমি উঠে, দুই কোয়া রসুন একটু মধুর সঙ্গে খেয়ে, এক গ্লাস পানি পেটে চালান করে, সাড়ে ছয়টার মধ্যে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াই। আমার হাতে থাকে সিগারেট এবং আমি তা ততক্ষণ পর্যন্ত জ্বালাই না, যতক্ষণ পর্যন্ত না রাকা এসে সামনের ব্যালকনিতে দাঁড়ায়। আমার আর রাকার ব্যালকনির মধ্যে একটা গলি রাস্তার প্রস্থ, একটা অশ্লীল রংচটা ইলেকট্রিক পিলার, সাতটা কি আটটা কালো চাবুকের মতো কারেক্টের তার এবং তিনটা দিনবিশেষে চারটা কাক থাকে। কাকগুলো তখনো ডাকে না। ডাকবে কি ডাকবে না—এ রকম একটা কাকস্য দ্বন্দ্বের ভেতর স্ব-স্ব ব্যালকনিতে আমরা উপস্থিত হই। হলে, আমি সিগারেটটা জ্বালাই। রাকা শনিবার না হলে সালোয়ার-কামিজে থাকে; ওড়না তখনো বিছানায় আর চুলগুলো সদ্য ঘুম থেকে ওঠা আলসেমিতে পাওয়া থাকে বলে রাকাকে প্রায় ঘরোয়া মনে হয়। এ ছাড়া গলির প্রস্থটাও নিতান্ত কম বলেই মনে হয় রাকা আমার বাসারই আরেকটা ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। তখন রাকা তার টবের গাছগুলোতে পানি দিতে থাকে। এ সময় রবীন্দ্রসংগীত বাজলেও বাজতে পারে যে ‘যখন প্রথম ফুটেছে কলি আমার মল্লিকা বনে…’; কিন্তু রাকা ক্যাকটাস আর অর্কিডের চাষ করে এবং সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ ভালোবাসে না। আমি তার ঘর থেকে কখনো রবীন্দ্রসংগীত শুনতে পাইনি। আমি নিজেও রবীন্দ্রসংগীত—নিজের ফোনে বা মনে—এখন পর্যন্ত বাজিয়ে দেখিনি। আমার হিন্দি গান ভালো লাগে। যখন যে সিনেমার গান হিট হয়, তখন সেই গান আমি কিছুদিন টিভির দৌলতে শুনে থাকি। গুনগুনাই বাথরুমে, কিন্তু রাকার সামনে কখনো এসব গান গুনগুনানোর প্রশ্ন ওঠে না। রাকাকে দেখলে আমার এ ধরনের গান মনে আসে না। 

রাকাকে দেখলে অবশ্য আমার তেমন কিছুই মনে আসে না। ছয়টা পঁয়ত্রিশ বা সাঁইত্রিশ কোনো কিছু মনে আসার জন্য এমনিতেই খুব একটা দুর্দান্ত সময় না। তা ছাড়া হাইপার টেনশন নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর তিনি খুব শক্ত করে বলে দিয়েছেন মনের ওপর থেকে ভার কমাতে। সকালে আমি তাই একটা নির্ভার সিগারেট খেতে খেতে রাকার গাছে পানি দেওয়া দেখি বা কোনো কোনো দিন রাকা ওই সকালেই দু-একটা কাপড় মেলে দেয়। টাওয়েল বা একটা টি-শার্ট। আমার সিগারেট যতক্ষণে শেষ হয়, ততক্ষণে রাকার ব্যালকনির কাজগুলোও ফুরিয়ে আসে। আমি অফিসের জন্য তৈরি হই এবং রাকাকে ভুলে যাই সারা দিনের মতো। 
এই যে বললাম সারা দিনের মতো ভুলে যাই, এটা একটা মিথ্যাচারও হলো। মাঝে মাঝে যে রাকাকে মনে আসে না তা-ও তো না। একদিন অফিস থেকে একটা বোটানিক্যাল ফার্মে ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে রাকার কথা হঠাৎ করেই খুব মনে পড়ল। বেশ কিছু অদেখা অর্কিড ছিল ওখানে। আমি কয়েকটা নেওয়ার কথা ভেবেও মনে মনে বাদ দিয়েছিলাম। ওইভাবে দেখলে এটা তো সত্যি যে মিলি আসলে গাছ পছন্দ করে না। হাঙ্গামা মনে করে। মনে করে যে ব্যালকনিতে গাছ থাকা মানেই মশার একটা কারখানা। চিকুনগুনিয়া বা ডেঙ্গুর উৎপাদনকেন্দ্র। মিলি যা পছন্দ করে না, সচরাচর আমি তা করি না। সংসার এভাবেই চালাতে হয় দেখে এসেছি। আমার বাবাকে দেখতাম মায়ের কথায় উঠত-বসত। মাঝে মাঝে বিদ্রোহ করে মদ খেয়ে ফিরত বাসায়। মায়ের সঙ্গে হাঙ্গামা করত, হাঙ্গামার পর কিছুদিন তাদের মধ্যে গভীর মিল দেখা যেত। তারপর আবার কিছুদিনের খটমট। দেখতাম, বাবা বেশ মানিয়ে মানিয়ে চলছেন। আমি বাবার গুণ পেয়েছি। মিলির সঙ্গে আমিও মানিয়ে চলি। মিলি বিফ পছন্দ করে না বলে আমি অনেক দিন বিফ আনি না বাসায়, মাঝে মাঝে খেতে ইচ্ছা করলে অফিসের লাঞ্চ ফাঁকি দিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে খেয়ে আসি। কারওয়ান বাজারের ভেতরে একটা ছাপরা হোটেলে দারুণ কালাভুনা করে। আমি অবশ্য এ কথা মিলিকে বলিনি কখনো। কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন এই রেস্তোরাঁর কথা সে জানে। একদিন কথায় কথায় বলছিল, তুমি কই কই কালাভুনা খাও…সবই আমি জানি! আমি আর কথা বাড়াইনি। অফিসে মিলির কোনো গোয়েন্দা থাকতে পারে। যদিও কাউকে সন্দেহ করতে ইচ্ছা করেনি। শুধু অফিসের কম্পিউটার থেকে ফেসবুকে রাকার ফেসবুক আইডি খোঁজার যে নিয়ম দাঁড় করিয়েছিলাম, সেখান থেকে সরে আসি। তা ছাড়া রাকা নাম লিখে সার্চ দিলে ফেসবুকে কয়েক শ রাকা এসে পর্দা কাঁপিয়ে দেয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো রাকার চেহারার সঙ্গে আমার ব্যালকনির রাকার মিল পাইনি। আমার ধারণা, রাকার কোনো ফেসবুক আইডি নেই বা রাকা হয়তো ছদ্মনামে ফেসবুক চালায়। তার প্রোফাইল পিকচারে কোনো ফুল, নদী, পাখি, সমুদ্রের ছবি দেওয়া; অথচ এসবের থেকেও রাকা সুন্দর, রাকাকে তা কে বলবে?

বলার সুযোগ তৈরি হলেও আমি বলতে পারব না অবশ্য। মিলির জন্য না, মিলি ছিল না এমন অবস্থায় রাকার মুখোমুখি একবার না, দুই-দুবার হয়েছি। প্রথমবার অফিস থেকে ফিরছিলাম…সন্ধ্যার সোডিয়াম আলোর মধ্যে রাকাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে গিয়েছিলাম আমি। এত দিন ধরে ব্যালকনিতে দেখার পর হঠাৎ সশরীরে রাস্তায় দেখে তাকে আমার অদ্ভুত অপরিচিত মনে হয়েছিল। একবার মুখ ফসকে বলেই ফেলেছিলাম প্রায়, কেমন আছেন…; কিন্তু বলতে গিয়ে বুঝলাম ঠিক এই মুহূর্তে কথা বলা আমাকে দিয়ে হবে না। একটা ঝিমঝিমানির ভেতর দিয়ে বাসায় ফিরেছিলাম। মিলি দেখে বলেছিল, ছিনতাইকারী ধরছিল নাকি? আমি কিছু বলিনি। ভেবেছিলাম, রাকা একধরনের ছিনতাইকারী তো বটেই! 

আরেকবার তাকে পেয়েছিলাম আমাদেরই অফিসের সামনে। 
আমি ঠিক শিওর না, কিন্তু মনে হয়েছিল একটা রিকশায় রাকা চট করে চলে গেল। আমার বুকটা অযথা ধড়াস করে উঠল। আমার সঙ্গে যে সহকর্মী ছিল, খুবই আজব দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল সে। পরে ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি অবশ্য জানালেন, হাইপার টেনশন। রাতে নিয়মিত একটা ওষুধ খেলে এ ধরনের মাথা ঘোরার সমস্যা থাকবে না বলে নিশ্চয়তাও দিলেন। 
আমি এখন নিয়মিত ওষুধ খাই। আমার এক সহকর্মী রসুনের কোয়া খেয়ে উপকার পাচ্ছে বলে রসুনের কোয়াও খাচ্ছি। ইন্টারনেটে তো রসুন নিয়ে প্রচুর প্রতিবেদন। সেসবেও আছে রসুনের নানান উপকারিতার কথা। ডাক্তার ভালো ডায়েট করতে বলেছেন বলে কারওয়ান বাজারের ছাপরা দোকানটাতেও অনেক দিন যাই না।

কিন্তু ব্যালকনিতে না গিয়ে পারি না। ছয়টা পঁয়ত্রিশে একটা সিগারেট নিয়ে না পৌঁছালে মনে হয় সকাল হয় না। রাকা এলে আমি সিগারেটটা জ্বালাই। তারপর যতক্ষণ জ্বলে। খুব অল্প টান দিই আমি। ডাক্তার সিগারেট কমিয়ে দিতে বলেছেন। তবে সকালের সিগারেটটা ছাড়া যাচ্ছে না। 

অবশ্য শুক্রবার সকালে সিগারেট খাই না আমি। সেদিনও সাড়ে ছয়টায় ঘুম ভেঙে যায় আমার। কিন্তু সেদিন আর মধু দিয়ে রসুন খেতে ইচ্ছা করে না। সিগারেট নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়াতে ইচ্ছা করে না। রাকাও সেদিন আসে না ব্যালকনিতে। আমার মতো তার স্বামীরও সেদিন অফিস ছুটি। রাকা সেদিন দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। শাড়ি পরে। স্বামীকে নিয়ে বাইরে খেতেটেতে যায়। আমার কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু আমরাও শপিংয়ে যাই। কখনো কখনো সিনেমায়। মিলি নেট ঘেঁটেটেটে এসবে আপডেট থাকে খুব। শুক্রবারের সকালটা আমার খুব ক্লান্ত লাগে। অথচ অনেক ঘুমাই। শুয়ে শুয়ে ঘুমিয়েই তো থাকি। মাঝে মাঝে জাগি। সকালের কাকগুলো ডাকে। তারগুলো কাঁপে। বাতাস এলে জানালার পর্দা ওড়ে একটু-একটু। আর আমার মনে হতে থাকে রাকার সঙ্গে সম্ভবত আমার প্রেম আছে। এটা ভাবতে গেলে ভালো লাগে। মনে হয় অনেক কিছুর সম্ভাবনা নিয়ে একটা না-হওয়া সৌন্দর্য আমার জীবনের জন্য অপেক্ষা করছে। মনে হয়, না-হয়ে ওঠা প্রেমগুলো দখিনের হাওয়ার মতো রহস্যময়, আর সুন্দর!

হলুদ হিমু তামাটে সোনা

মাজেদা খালা বললেন, ‘তোর জানাশোনা কোনো ওঝা আছে?’
হিমু বসে ছিল সোফায়। দেয়ালে একটা বড়সড় টিকটিকি। সেটার লেজ নেই। লেজ যে নেই, এটা নিয়ে তার বিকারও নেই। হিমু বলল, ‘টিকটিকিটা পুরুষ না মহিলা?’
মাজেদা খালা একবার টিকটিকি একবার হিমুর দিকে তাকিয়ে মেজাজ হারিয়ে ফেললেন। মেজাজ হারিয়ে ফেললে মাজেদা খালার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। একবার মেজাজ হারিয়ে খালা ইন্ডিয়া চলে গিয়েছিলেন, পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই। শিবগঞ্জ বর্ডার দিয়ে। বিএসএফদের সঙ্গে ঝগড়া করে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন যে ওরা ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ ফর্মে মাজেদা খালাকে ভেতরে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
ইন্ডিয়া যাঁকে সামলাতে পারেনি, বড় খালু তাঁকে সামলে রাখেন। বড় খালু বললেন, ‘আহ্, তুমি এত উত্তেজিত হয়ো না তো, মাজু!’ বড় খালু আদর করে মাজু বলে ডাকেন খালাকে। এই ডাক শুনলেই হিমুর হাসি পায়।
খালা বললেন, ‘ওই, তুই হাসিস কেন, অ্যাঁ? খালা-খালুকে নিয়ে ফাজলামি করে হাসতে তোর খারাপ লাগে না? তোকে ডেকেছি একটা সমস্যার সমাধান করতে, আর তুই আছিস টিকটিকির জেন্ডার নিয়ে?’
মাজেদা খালার সমস্যা অভিনবই বলা যায়। খালা তাঁর ভল্টে গাদা গাদা অলংকার রাখেন। কারণ একটাই, বাইরের ভল্টে তাঁর বিশ্বাস নেই। হিমু অবশ্য বলে কর ফাঁকি দেওয়ার জন্যই নাকি এই ব্যবস্থা। তবে হিমু বললে তো হবে না। বড় খালু প্রতি বছরই কর দেওয়ার জন্য পুরস্কার পান। গতবার তো পেয়েছেন ‘করপুণ্য শিরোমণি’ পদক! অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে এই সনদ গ্রহণ করছেন এমন একটা ছবি ড্রয়িংরুমে শোভা পাচ্ছে। তার পাশেই লেজহীন টিকটিকিটা ঘাপটি মেরে আছে। পুরুষ না নারী, তা বোঝা যাচ্ছে না।
যা হোক, মাজেদা খালা গত রাতে ভল্ট খুলে দেখেন, তাঁর হাতের বালা, কানের দুল, গলার মালা সবই কেমন যেন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। তিনি সেগুলো বের করেন এবং বের করেই পরপর তিনবার ফিট হয়ে যান। তাঁর ভল্টের সব সোনা নিমেষেই যেন তামা হয়ে গেছে। মাজেদা খালা জবান হারিয়ে বিজাতীয় উচ্চারণে অ অ করে স্বরবর্ণে দীর্ঘ সময় আটকে থাকেন। রাত ১০টা থেকে ১২টা খালুর বিশেষ পানীয় পানের সময়। এ সময় ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্টও যদি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন, তিনি বিরক্ত হন। মাজেদা খালার আর্তিতে তিনি অত্যন্ত রুষ্ট হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যান। খালাও তাঁর পেছন পেছন বাসা থেকে বেরিয়ে যান। ইতিমধ্যে সোনা তামা হয়ে যাওয়ার খবর প্রথমে মহল্লা, পরে এলাকা, তারও পরে পুরো শহর রাষ্ট্র হয়ে যায়। নানাজন খালা-খালুকে নানা ধরনের কথা বলতে থাকে। খালা-খালু সেসবে কর্ণপাত না করে একটা রাত মনের দুঃখে পাঁচতারা হোটেলে কাটিয়ে সকালে যখন ফিরে আসেন তখন দেখেন বিছানার ওপর রাখা অলংকারগুলো আর তামার নেই, সব সোনার হয়ে গেছে!
এমন ভৌতিক কাজকারবার খালা-খালু আগে কখনো দেখেননি। এই ঘটনার একটা সুষ্ঠু সমাধানের জন্য হিমুকে তঁাদের ডাকা।
খালা বললেন, ‘শোন, একটা ভালো ওঝা নিয়ে এসে ঘরটা খুব ভালো করে ঝাড়া দরকার! হিমু, তোর তো নানা ধরনের মানুষের সাথে পরিচয়। চিনিস না ভালো কোনো ওঝাকে?’
: উত্তর বাড্ডার এক ওঝা আছে। চোখ বন্ধ করে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব বলে দিতে পারে।
: আরে ভূত তাড়াতে পারে কি না, সেইটা বল।
: ভূতও তাড়াতে পারে। ভূতসমাজে ওই ওঝার ছবি দেখানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মতো করে। বড় ভূত ছোট্ট বাচ্চা ভূতদের বলে, ‘ভাঁলো কঁরে দেঁখে রাঁখ, এঁ থাঁকলে চঁটাস কঁরে সঁটকে পঁড়বি!’
: তাই নাকি?
: হুঁম। খুঁবই ডেঁঞ্জারাঁস ওঝাঁ!
: তুই নাকিস্বরে কথা বলছিস কেন?
: উত্তেজনায় খালা। ভূত তাড়াব, তার উত্তেজনা আছে না?
: তুই ওঝাকে এক্ষুনি ডাক! আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি! ঠিকানা দে...
খালা ড্রাইভারকে ফোন করতে শুরু করলেন। বললেন, ‘শোনো, উত্তর বাড্ডা...এক্ষুনি গিয়ে নিয়ে আসো! কী নাম...কী নাম রে হিমু?’
: রুমাল বাবা।
: রুমাল বাবা? এটা কেমন নাম?
: উনি পোশাক বলতে শুধু একটা রুমাল পরে থাকেন তো, তাই...
: মানে? সারা গায়ে একটা রুমাল?
: খুব বেশি গরম পড়লে অবশ্য সেটাও পরেন না।
: সর্বনাশ! কী বলিস এই সব? এ রকম একটা মানুষ আমার গাড়িতে বসবে নাকি? গাড়ি ডেটল দিয়ে ধুলেও তো আমি আর ওই গাড়িতে কোনো দিন বসতে পারব না!
: তাহলে অটোতে আসুক।
: না না, ওই লোক বাসায় এলে সারা বাসা আমাকে ধুতে হবে!
: কিন্তু এভাবে কি ভূতের সাথে বসবাস করা ঠিক হবে, খালা?
: ধর, এটা ভূত না-ও হতে পারে, অন্য কিছু...এই শোন, তোর মিসির আলীর সাথে পরিচয় আছে না?
: না।
: কী বলিস? তোদের দুজনের তো একই রাইটার! পরিচয় নাই কেন?
: দুয়েকবার দেখা হয়েছে। অত্যন্ত আলাভোলা মানুষ। আমাকে তার মনে নাই।
: তুই নিজেও তো কম আলাভোলা না! বিয়েটা পর্যন্ত করছিস না। এই সমস্যাটা শেষ হলে তোকে একটা বিয়ে দিয়ে দেব।
: হুম। আজকে দিলে অবশ্য তোমাদের মতোই একই তারিখে বিবাহবার্ষিকী হবে। মন্দ হবে না ব্যাপারটা।
: মানে?
: মানে আজকে তোমাদের বিবাহবার্ষিকী, এ জন্যই সোনা তামা হয়ে যাওয়ার নাটক সাজিয়েছ। এই নাটকের কাহিনি শুনে তোমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই বাসায় আসতে শুরু করেছে। এর মধ্যেই বাসা গমগম করছে।
: তুই সব সময় সবকিছুতে একটু বেশিই বুঝিস!
: কই আর বুঝলাম! টিকটিকিটা পুরুষ না নারী, তা-ই তো বুঝতে পারলাম না এখনো। তবে এটুকু বুঝেছি, গত রাতে তুমি আর খালু পাঁচতারা হোটেলে গিয়ে নিশ্চয়ই ৩০ বছর একসঙ্গে থাকার জন্য ছোট্ট একটা কেক কেটেছ।
: তুই যা! তোকে থাকতে হবে না এই বাড়িতে।
: কাচ্চি না খেয়েই চলে যাব? পুরান ঢাকার কাচ্চি! ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে!
: এই সব বুজরুকি করেই তুই তোর এত এত ফ্যান জুটিয়েছিস, না? ফালতুর ফালতু! নিজেদের বিবাহবার্ষিকীতে এমন করে দাওয়াত কে দেয়, অ্যাঁ?
: তোমরা তো দিলে! বাংলাদেশের অন্য মানুষেরাও দেওয়া শুরু করবে নিশ্চয়ই। আসল ঘটনা ঢাকতে এখন জবরজং ঘটনা কত যে দিকে দিকে সাজানো হচ্ছে। আমার কিন্তু দেখতে ভালো লাগে। মনে হয় আনন্দধারা বহিছে ভুবনে। খালা, আমি তাহলে গেলাম।
হিমু বেরিয়ে যায়। যেতে যেতে মনে হয়, মুখের ওপর খালার মজাটা নষ্ট করে দেওয়া বোধ হয় ঠিক হলো না। বেচারারা একটু মজা করতে চেয়েছিল...এখন তো কতজনই মজা করছে। খালা-খালু করলেই বা দোষ কী?

দেখা যাক কে জেতে!

‘কী মনে হয় তোমার, আর্জেন্টিনা এবার বিশ্বকাপ পাবে?’
আমি ব্রাজিল সাপোর্টার। এ ধরনের প্রশ্ন সাধারণত একটা ফুৎকারে উড়িয়ে দিই। কফির কাপে ঝঞ্ঝা তুলে বলি, ‘কিসের কী? আর্জেন্টিনা ওই ভলিবল খেলে জিতেছে, আর না! ম্যারাডোনার দিন কবেই শেষ। আর মেসি তো কোনো দিন আর্জেন্টিনারই হয়নি!’
বুকে এসব কথা লকলক করে উঠলেও মুখে বলা গেল না। কারণ, প্রশ্নকর্তা স্বয়ং রিফকার বাবা; আমাকে চা খেতে খেতে সুধালেন। রিফকার মুখে শুনেছি, তিনি বীভৎস রকম আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। রিফকা পইপই করে বলে দিয়েছে, ‘বিশ্বকাপের আগে বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছো, খেলা নিয়ে কথা উঠবেই! তুমি কিন্তু কোনোভাবেই বুঝতে দেবে না যে তুমি ব্রাজিল। নাহলে আমাদের বিয়ে তো দূরের কথা, কোনো দিন আর দেখা করাও সম্ভব হবে না!’
: কী হলো, কথা বলছ না কেন? খেলা দেখো না?
: জি।
: মানে কী? সত্যি খেলা দেখো না! তোমাদের হবেটা কী? ফুটবল খেলা যে দেখে না সে আবার তরুণ হয় কীভাবে? তোমার তো মনে হচ্ছে এখনই সব ঘুণে ধরেছে! স্যাড, সো স্যাড!
: না না আঙ্কেল, খেলা দেখি তো!
: কী, ক্রিকেট? ওই ভদ্রলোকের খেলা? শোনো, খেলা কী করে ভদ্রলোকের হয় বলো তো? খেলা হবে ঠেলাঠেলি আর হুড়োহুড়ির!
: জি, তা তো বটেই!
: ফুটবল! নামেই একটা ইয়ে আছে! মানে পা তো আছেই, তার সঙ্গে একটা বেশ কষে লাত্থালাত্থির ব্যাপার আছে! এখানে ওসব ভদ্রলোকগিরি চলে না। কোন দল তুমি?
এই যাহ্‌! এবার বোধ হয় আর সামলানো যাবে না। আমি ব্রাজিল, এটা বলা যাবে না! আবার আমি ব্রাজিল হয়ে আর্জেন্টিনার কথা বললে আমার কি আর কুল থাকবে! আমি বললাম, ‘ওই তো...’
: ওই তো মানে? ব্রাজিল?
: জি? না না না! কী যে বলেন!
এবার রিফকার বাবার মুখে একটা হাসি ফুটল, ‘তাহলে?’
: জিদানকে ভালো লাগত তো...
: ফ্রান্স? আরে ফ্রান্স হলো শিল্পের জায়গা। তারা যে কেন ফুটবলের মতো একটা হাড্ডাহাড্ডিতে ভ্যাবাচেকা খাচ্ছে, বুঝলাম না! তুমি ফ্রান্স করো নাকি?
: না না, আঙ্কেল! ওই জিদানকে ভালো লাগত তো!
: সে তাহলে অন্য কারণে! তোমার মাথাতেও তো দেখছি চুল কম!
: জি? সে হিসেবে তো ব্রাজিলের ওই রোনালদো...!
: ছি ছি ছি! কোথায় কার নাম নিচ্ছো তুমি! রোনালদোকে আজ কেউ মনে রেখেছে নাকি?
: কী বলেন, আঙ্কেল! বিশ্বকাপ কাঁপিয়ে দিয়েছিল! ব্রাজিলকে কয়টা কাপ...
: তুমি ব্রাজিল নাকি তাহলে?
: না না না। কী যে বলেন না আঙ্কেল! সেই দিন আছে নাকি ওদের!
: হুম। একটা জিনিস মনে রাখবে, হলুদ কিছুই ভালো না! কারও দাঁত হলুদ হলে তাকে আমরা কী বলি, অ্যাঁ? বলি, নোংরা! তারপর ধরো হলুদ পদার্থ, ঢাকার জলাবদ্ধতায় যেসব ভেসে বেড়ায়, সেগুলো দেখে গা গুলিয়ে ওঠে না, অ্যাঁ?
: কিন্তু আঙ্কেল, হিমুও তো হলুদ পাঞ্জাবি পরে!
: কী? হিমু? হিমু আবার এর মধ্যে এল কোথা থেকে! এই ছেলে, তুমি ব্রাজিল নাকি?
: না না না, আঙ্কেল! কী যে বলেন!
: তুমি তো তোমার দল বললে না এখনো!
: দল! মানে...আসলে...ব্যাজিও...
: ইতালি? এরা যে কখন কী করে! কিন্তু তোমার দল তো এবার বিশ্বকাপেই নাই! আহা রে, তোমার কষ্টটা বুঝতে পারছি! বুকটা খাঁ খাঁ করছে, না?
: না না না, আঙ্কেল! ইতালি তো আমার দল না!
: ইতালি না? তাহলে?
: জার্মানি গতবার কাপ পেয়েছিল তো...
: জার্মানি? ওই হিটলারের দেশ!
: আঙ্কেল, ওই দেশে তো আইনস্টাইনও জন্মেছিলেন।
: তাতে কী? জার্মানির চেয়ে খারাপ কোনো দল আছে নাকি? একেকটা যন্ত্র! দেখোনি, গতবার ফাইনালে ওরা কী করেছিল! কিচ্ছু খেলা পারে না...
: আর তাতেই আর্জেন্টিনা উড়ে গিয়েছিল, আঙ্কেল!
: অ্যাঁ? কী? এই ছেলে, তুমি ব্রাজিল নাকি?
: না না না, আঙ্কেল! কী যে বলেন!
: শোনো, রিফকা আমার একমাত্র মেয়ে! আমি আর সে দুজনই আর্জেন্টিনার সাপোর্টার! আমার মনে হয়, এবারের বিশ্বকাপে তোমারও আর্জেন্টিনা সমর্থন করা উচিত! কী বলো তুমি?
: জি...মানে...
: আমি তো ঠিক করেই রেখেছি, রিফকা মায়ের হাত আমি কোনো মেসিভক্তের হাতেই তুলে দেব। মেসির খেলা তোমার কেমন লাগে?
: ভিনগ্রহের খেলোয়াড় তো আঙ্কেল...
: ভালো বলছ না খারাপ বলছ?
: ওই আর কি আঙ্কেল...
: ‘ওই আর কি’ মানে? তুমি জানো, মেসি কেমন খেলোয়াড়! দেখেছ কখনো তাঁর খেলা? ম্যারাডোনার পর এই একটা খেলোয়াড়ই ফুটবল খেলতে পারে। বাকিরা সব বউছি খেলে মাঠের মধ্যে।
: এইটা একটু আঙ্কেল বাড়াবাড়ি বললেন!
: কিসের বাড়াবাড়ি বললাম, অ্যাঁ? মেসিকে তোমার ভালো লাগে না! এই ছেলে, তুমি ব্রাজিল নাকি?
: হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ব্রাজিল! আর আমি চিরদিন ব্রাজিলই থাকব! আপনাদের মতো আর্জেন্টিনাকে সাপোর্ট করতে পারব না! একটা কথা মনে রাখবেন আঙ্কেল, বিএনপি থেকে দলবদল করে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া যায়, আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিতে, কিন্তু ব্রাজিল থেকে কেউ কখনো আর্জেন্টিনা হতে পারে না!
: আমি আমার মেয়ের বিয়ে কোনো দিন কোনো ব্রাজিল সমর্থকের সঙ্গে দেব না!
: আমিও চিরদিন সালমান খানের মতো ব্যাচেলর থাকব, আঙ্কেল! বিয়ে করব না, তবু কোনো দিন আর্জেন্টিনা হব না!
মিটিং ভেস্তে গেল। রিফকা কাঁদল বিস্তর। আমি আর রিফকার বাবা তেল-জল হয়ে থেকে গেলাম। দেখা যাক, কে জেতে!

ফুটবল খেলার কোনো গোল নেই

বিশ্বকাপ ফুটবল যখন দরজায় লাথি মারছে, রেফারির বাঁশি যখন ফ্রু ফ্রু করে স্মৃতিতে হানা দিচ্ছে, আমি তখনো মোবাইলে লুডু নিয়ে ব্যস্ত। বড়জোর একবার চোখ উঠিয়ে ক্রিকেটের স্কোরকার্ড দেখে নিতে পারি। কিন্তু ফুটবল? নাহ্, কক্ষনো না। আমি ফুটবল ঘৃণা করি। মনে হয় এই খেলাটির কোনো গোল নেই... কোনো লক্ষ্য নেই। ২২ জন খেলোয়াড়, তিনজন রেফারি বাতাসভরা এক অযথা শূন্য নিয়ে একবার এদিকে একবার ওদিকে দৌড়ায়। হায়! কেন? কেন?
আমার স্ত্রী ভয়ংকর রকমের ফ্রান্স সাপোর্টার। বিশ্বকাপ শুরু হওয়া নিয়ে এখনই তাঁর মাথা খারাপ হওয়ার দশা। ফ্রান্সের খেলা কবে কবে, তা দেখে তিনি এখনই তাঁর রান্নাবান্নার শিডিউল করে ফেলেছেন। ওই বিশেষ দিনগুলোতে তিনি আলুভর্তার মতো সহজ হিসেবে যেতে চাইছেন। আমি প্রতিবাদ করার চেষ্টা করি, ‘খেলা তো ৯০ মিনিটের, তুমি আগে-পরে আরও কিছু রান্না করতেই পারো!’
: না না। টেনশনে আগে কিছু রান্না করা যাবে নাকি! জিদানের উত্তরসূরিরা যেদিন খেলবে, সেদিন আমি রান্নাঘরে থাকতে পারব, বলো?
: মানে জিদান নিজেও তো ভালোমন্দ খেয়ে খেলা দেখতে বসবে, আমরাও না হয় মাংস-টাংস খেয়ে খেলা দেখতে বসলাম!
: আরে, তুমি কী বোঝো, তুমি তো খেলার কিছু জানোই না। নীলা ভাবি তো ব্রাজিলের খেলার দিন রান্নাই করবেন না। বাইরে থেকে খাবার আনাবেন। কোনো হাঙ্গামা রাখবেন না সেদিন। আমি তো তবু আলুভর্তা করে দেব। তুমি ভাতটা রেঁধে নেবে শুধু।
আমি দাঁতে দাঁত চাপলাম। চার বছর হয়নি বিয়ের, বুঝতে পারছি না এই বিশ্বকাপটা আসলে কী বয়ে আনতে যাচ্ছে। আমি গুগলে সার্চ দিয়ে দেখে রাখি দুই পট চালে কয় পট পানি দিতে হয়।
অবস্থা যে অস্থির, তা খানিকটা আমার কলিগদের দেখলেও বোঝা যায়। নাসিমুল আর ফাহমিদের মধ্যে প্রতিদিন বাগ্‌বিতণ্ডা চলছে। দুজনের একজন জার্মানির সমর্থক, অন্যজন ইংল্যান্ড। কিন্তু কে যে কোনটা, আমি বুঝতে পারি না। তাদের কথায় খেলোয়াড়দের নাম কম আসে। বরং ঝগড়া চলে হিটলার, আইনস্টাইন, পলাশীর প্রান্তর আর কোহিনূর নিয়ে।
আগেই বলেছি, ফুটবলের কোনো গোল নেই। না হলে দুই ফুটবল সমর্থকের কথা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে নাৎসি বাহিনী পর্যন্ত কী করে যায়?
আমার বস অবশ্য ঘোরতর রোনালদো–ভক্ত। ছুটির দরখাস্ত নিয়ে গেলে তিনি বলেন, ‘এই সপ্তাহেই ছুটি নিচ্ছেন কেন? খেলা শুরু হতে দেরি আছে তো।’
আমি বলি, ‘কী বলেন, স্যার, নারায়ণগঞ্জে তো স্যার কবে থেকে খেলা চলছে!’
: কী বলেন, ওখানেও বিশ্বকাপ চলে নাকি? মিনি?
: না স্যার, মেগা। এটা স্যার চার বছর পরপর না, প্রতিবছরই চলতে থাকে।
: ও তাই বলেন! রসিকতা করছেন, বুঝি নাই! ওই হিসেবে খেলা তো সারা দেশেই চলছে। কিন্তু ওই খেলা আর কত দেখা যায় বলুন? এই বিশ্বকাপটা শুরু হলে কদিনের জন্য শান্তি। একটু খেলা দেখা গেল, একটু আনন্দ করা গেল। কী মনে হয়, রোনালদো এবার কাপ পাবে?
আমার ছুটির দরখাস্ত তখনো সই হয়নি। বলি, ‘অবশ্যই পাবে, স্যার। একক নৈপুণ্যে দল জেতানোর ক্ষমতা তো স্যার ওই একটা খেলোয়াড়েরই আছে। এবার কিছু একটা ঘটবেই। এখানে স্যার, সইটা!’
স্যার সই করতে করতে বলেন, ‘হুম। আরেকটা প্লেয়ার ছিল বুঝলেন, একক নৈপুণ্যের, ম্যারাডোনা! আহা, কী খেলা... একলা টিম বের করে নিয়ে আসত! ম্যারাডোনার খেলা দেখেছেন না আপনি?’
বসরা খারাপ হয় সত্যি। তাঁরা গাধার খাটুনি খাটিয়ে কাজের সাফল্যের ভাগ নিজের ঝুড়িতে পুরে নেন সত্যি, কিন্তু বসরা যে এত নিষ্ঠুর হন, জানতাম না। যে গভীর বেদনা এই বিশ্বকাপের আগমনী দিনগুলোতে লাল কার্ড দিয়ে চাপা দিয়ে রেখেছিলাম, বস সেখানেই ফ্রি-কিক মারলেন। ম্যারাডোনা, হায় ম্যারাডোনা!
এই ম্যারাডোনার জন্যই তো আমার সর্বনাশটা হয়েছে। আমার সর্বনাশটা হয়েছে এই ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনার জন্য।
খেলা বোঝার পর থেকেই টিভিতে চোখ রেখেছিলাম। ম্যারাডোনা ম্যারাডোনা করে চিল্লানি দিয়ে যখন খেলা দেখতে বসলাম, দেখলাম ম্যারাডোনা কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়ছে। আমরাও কাঁদলাম, তারপর থেকে আর কখনো সে কান্না শুকাল না। চার বছর পরপর তাতে আরও পানি জমতে লাগল। অথচ প্রতিবারই শুনতাম, এবার নাকি আর্জেন্টিনা দলে ছোট ম্যারাডোনা আছে। আমরা আশা নিয়ে বসি, গোল খেয়ে উঠি। স্বপ্ন নিয়ে বুক বাঁধি, আর্জেন্টিনা হেরে বিদায় হয়। হারতে হারতে আমরা ক্লান্ত...কতজন চলে গেল আমাদের ছেড়ে। এই ডাল থেকে ওই ডালে চলে যাওয়ার মতো করে কতজন দল বদলাল। আমি পারলাম না। আমি খেলাই বদলে ফেললাম।
এখন আমার প্রিয় খেলা ভার্চ্যুয়াল লুডু। খেলাটাতে আমি জিতি। আর জিতলে কী যে ভালো লাগে! আর্জেন্টিনাকে সাপোর্ট করতে করতে আমি জেতার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।
কয়েক দিনের মধ্যেই ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু। আমি খেলা দেখতে টিভির সামনে বসব না, বসব না, বসব না! শুধু মেসি যদি একটা দারুণ কাটাকুটি করে গোল দিয়ে দেয়, সেটা মিস করব আরকি। অথবা দারুণ একটা কর্নার, দুর্দান্ত ফ্রি-কিক...নাহ্, দেখব না! আমার লুডুই ভালো।
কিন্তু এবার যদি ভালো করে নীল-সাদারা? গাধারা, কখন কী করে, তা-ই তো বোঝে না। আচ্ছা, একবার না হয় উঁকি দেব খেলায়। অহেতুক একটা খেলা। আর কতবার বলব আপনাদের, ফুটবল খেলাটার কোনো গোল নেই!

সোমবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৮

ছাতনং রাজনীতিনং তপঃ

রাত। তার ওপর অন্ধকার।
আড়াই মাস ধরে এ রাস্তায় সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। রাস্তা খোঁড়া। এদিকে-ওদিকে কৃষ্ণগহ্বর। আমি বিড়ালের মতো পা ফেলি। মোবাইল ফোনে কল। বাবার বজ্রকণ্ঠ, ‘কই তুই?’
: জি, রাস্তায়।
: আমি আর কতক্ষণ বসে থাকব?
: কোথায় বসে আছেন তার ওপর নির্ভর করছে। আইনস্টাইনের থিওরি অনুযায়ী আগুনের পাশে বসে থাকলে এক ঘণ্টাকে অনন্তকাল মনে হতে পারে। আবার সুন্দরী কোনো মেয়ের পাশে বসে থাকলে...
: চুপ থাক, গাধা! তোকে ফিজিকস পড়ানোই ভুল হয়েছে। পদার্থবিদ্যা পড়ে একটা অপদার্থ হয়েছিস।
আমি চট করে আশপাশে তাকিয়ে নিলাম। বকতে শুরু করলে বাবার কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। ফোন লাউডে দেওয়া নেই তো কী হয়েছে? বাবার কণ্ঠ যাকে বলে বাজখাঁই। ফোন পেরিয়ে কান ছুঁয়ে বুকে শেল মারে।
: কী হলো, চুপ করে আছিস কেন? আমি আর কতক্ষণ বসে থাকব? কখন আসবি তুই?
: আমি? আমি তো এখন বাড়ি যাব না আব্বা। নতুন চাকরি, ছুটি নাই।
: তোকে বাড়ি যেতে হবে না। আমিই তোর ঘরে বসে আছি। তুই আসবি কখন? অফিস শেষে সোজা মেসে আসিস না?
আমার বুক-মুখ-কলিজা-ফ্যাপ্‌সা-সব শুকিয়ে গেল। বাবা আমার মেসে? আমার রুমে?
ঘটনা সাংঘাতিক। আমি চিঁ চিঁ করে বললাম, ‘আপনি ঢাকায়?’
: তোর ফিজিকস কী বলে? তোর মেসে বসে থাকার জন্য আমাকে কি হনুলুলুতে থাকতে হবে?
আমি কথা না বাড়িয়ে পা বাড়ালাম। আর বাড়াতে গিয়ে একটা গর্তে নিউটনের প্রথম সূত্র মেনে আমি এক ‘গতিশীল বস্তু সুষম গতিতে সরল পথে’ যেতে যেতে রাস্তার ময়লা পানিতে গোসল সেরে নিলাম।

২.
বাবা আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। আমি বাথরুমে ৩০ মিনিট টানা নবধারা জলে শুদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করেছি। কাজ বোধ হয় হয়নি। ভ্রুর সঙ্গে সঙ্গে বাবা মাঝেমধ্যে নাকও কুঁচকাচ্ছেন। আমার ভেতরে ভরবেগের নিত্যতার সূত্র কাজ করছে। বললাম, ‘খারাপ কিছু ঘটেছে নাকি?’
: কী আর ঘটবে? ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এই দুনিয়ায় আর আছেইটা কী খারাপ হওয়ার!
: জি।
: এখন যা ঘটবে সব ভালো ঘটবে।
: জি আচ্ছা।
: তোর জিনিসপত্র সব গুছিয়ে রেখেছি, ভোরের ট্রেনে বাড়ি যাচ্ছি আমরা।
: জি? কী বলেন! নতুন চাকরি।
: চাকরি গেলে চাকরি পাওয়া যাবে। কিন্তু তোর যে গাধার স্বভাব, তাতে বিয়ের সুযোগ গেলে আর পাওয়া যাবে না।
: বিয়ে?
: জীবনে প্রথমবার শুনলি মনে হয়! তোর বয়সী অন্য ছেলেরা বিয়ের জন্য এখন বাপ-মায়ের সামনে ‘আচ্ছা চালতা হু, দুয়ায়ো মে ইয়াদ রাখনা’ গায়। আর তুই এখনো নিউটনের বিগব্যাং নিয়ে পড়ে আছিস!
: বিগব্যাং থিওরি নিউটনের না...
: যারই হোক। আর তোর ওই আইনস্টাইন-হকিংয়েরাও বিয়ে করেছিল, তোকেও করতে হবে।
: মানে বিয়ে আসলে একটা খুবই অগুরুত্বপূর্ণ জিনিস...
: ওই অগুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা তোর বাবা করেছিল বলেই তুই এখন সামনে বসে পটরপটর করতে পারছিস। যা আরেকবার গোসল দিয়ে আয়!
: জি?
: আরেকবার গোসল দিয়ে আয়। গোসলের পর শরীরে ভালো করে পারফিউম মাখবি। আর এরপর সুয়ারেজের লাইনের পাশে থাকলে আমার ফোন ধরার দরকার নেই। যা...

৩.
গভীর রাত।
বাবা আর আমি এক বিছানায় শুয়ে আছি। বাবা বললেন, ‘জেগে আছিস?’
: হুম।
: মন খারাপ? নাকি ভয় পাচ্ছিস?
: জি না, ভয় পাচ্ছি না।
: হুম। আচ্ছা শোন, তোর সিভি করা আছে না?
: জি।
: সিভিটা সঙ্গে করে নিয়ে যাস।
: আচ্ছা।
: কনেপক্ষ দেখতে চেয়েছে।
: জি আচ্ছা।
: আর শোন। সিভিতে একটা জিনিস যোগ করে রাখিস, লিখিস যে তুই ছাত্ররাজনীতি করতি।
: মানে? কেন? আমি তো কোনো দিন রাজনীতিটিতি করিনি।
: আরে আস্তে বল। দেয়ালে ভ্যান গঘের ছবি থাকলেই দেয়াল কালা হয় না! আজকাল ছাত্ররাজনীতি না করা পাত্রের ভ্যালু নাই। সবাই মনে করে যে পাত্রের কোনো ক্ষমতাই নাই। পাত্রের কোনো যোগাযোগ নাই। তাই ওরা যখন তোর সম্পর্কে জানতে চাইল, তখন বলেছি যে তুই রাজনীতির ঠেলায় ঠিকমতো পড়ালেখাই করতে পারিসনি। দুইটা মামলা আছে, এ-ও বলেছি।
: কী বলো বাবা!
: আরে তোকে এত কিছু ভাবতে হবে না! আমাদের আইনাল আছে না, আরে ওই যে, ক্লাস এইটের পর আর পড়ল না! একবার জেলেও গেল মাস্টার পিটিয়ে, ও তো এখন বিরাট ছাত্রনেতা। আইনাল বলেছে, সে সব সামলে নেবে। তুই গেলেই তোকে নিয়ে একবার পাত্রীদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসবে। তোকে ‘বড় ভাই’ বলে একবার যদি আইনাল ডাকে, তাহলে দেখিস আর কোনো চিন্তা থাকবে না। আইনাল তো তোর চেয়ে বয়সে ছোটই। তুই রিকোয়েস্ট করলে ডাকবে নিশ্চয়, তাই না?
: হুম।
: যাক, তাহলে আর চিন্তা থাকল না। পাত্রী খুব ভালো। ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অনেক দিন হল পলিটিকসও করেছে। পাওয়ার আছে, বুঝলি! আচ্ছা, তুই সিভিটা ঠিক করে রাখিস কিন্তু।
বাবা এবার নিশ্চিন্তে ঘুমাতে লাগলেন। আমি পিসি খুলে সিভিটা এডিট করতে শুরু করলাম। আইনালের ওপর অবশ্য অনেক কিছু নির্ভর করছে। আইনস্টাইন না, সময় এখন আইনালদের!

সোমবার, ৮ জানুয়ারী, ২০১৮

জীবনানন্দ দাশের গরু কেনা

জীবনানন্দ দাশের গরু কেনা

৪৮৪৬২২:২১, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৬
AddThis Sharing Buttons
এমন সঙ্কটে জীবন বাবু কখনো পড়েন নি। এই একটু আগে বন্ধু মহসীন এসে তাঁকে ধরেছেন। এবার আর ছাগ নয়, এই ঈদে তারা আস্ত একটা গরুই কুরবানি দেবে। জীবনানন্দ যেন তাকে সাহায্য করে গরু কেনায়। সম্ভব হলে জীবনানন্দ দাশ আকাশ থেকে পড়তেন। সম্ভব হলো না। তিনি বসেছিলেন ভাঙা হাতলের বুড়োমার্কা চেয়ারে। সেখান থেকে শুধু পিছলে গেলেন। ডাগর চোখে মহসিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি গরু কিনব কীভাবে? আমি তো জীবনেও গরু কিনিনি মহসিন! মহসিন বলল, তুই কখনো হাজার বছর বেঁচেছিস?
ftu

জীবন বাবু পিটপিট চোখে এবার তাকালেন। মহসিন বলল, বাঁচিস নি তো? কিন্তু লিখেছিস তো হাজার বছর আমি পথ হাঁটিতেছি...তাহলে? জীবনে যা করিস নি তা যদি লিখতে পারিস তাহলে একটা গরু কিনতে পারবি না! 

জীবন বাবু বললেন, কিন্তু গরু কিনতে আমিই কেন? 
মহসিন বলল, শোন সকলেই যেমন কবি নয়, তেমনি সকলই কিন্তু গরু নয়। তুই যদি কবিকে চিনতে পারিস তাহলে গরুকেও চিনতে পারবি। গরু আর কবিদের মধ্যে পার্থক্য বিশেষ নাই! 
: কী বলিস এসব? 
: ঠিকই তো বলি। গরু যেমন খাওয়ার সময় খেয়ে নেয় হাপুস-হুপুস তারপর সারাদিন বসে ঝিমায় আর জাবর কাটে...কবিরাও তেমনি সারাদিন এটা-ওটা দেখে আর সারা রাত বসে বসে সেগুলো নিয়ে জাবর কাটতে থাকে...আর কাগজ-কলম বা ল্যাপটপ নিয়ে কবিতা লিখে যায়। কবিতা লেখা আর জাবর কাটার মধ্যে পার্থক্যটা কী বল? না না তুইই বল, পার্থক্যটা কী? শোন, গরু উপকারী...কবিও মোটামোটি উপকারী...বিশেষত এদের কবিতার লাইন প্রেম করতে গিয়ে মাঝে মাঝে ভালোই কাজে লাগে। এবার আর কথা না, চল আমার সাথে। আজকে একটা ভালো গরু কিনতেই হবে।

পরের দৃশ্য গরুর হাটে। ধানসিঁড়ি হাট। আর হাটের ভেতর হাজার হাজার মানুষ, নাকি লাখ লাখ? জীবনানন্দ দাশের তব্দা খাওয়ার অবস্থা। এত মানুষ? তিনি একটু নির্জনতা পছন্দ করেন। কিন্তু শুধু তো মানুষ না। মানুষের মধ্যেই সারি সারি গরু। নানান ধরনের গরু। যেন মানুষ আর গরুর এক মহামিলনমেলা। আহা! কিন্তু জীবনানন্দের বড় অস্বস্তি হচ্ছে। এত মানুষের ভিতর বা এত গরুর ভিতর তিনি কী করবেন?

মহসিন তাকে টানতে টানতে প্রথমেই নিয়ে গেল একটা মাটিরঙা গরুর সামনে। গরুটা তাকিয়ে আছে ছলোছলো চোখে। অন্তত জীবনানন্দের তাই মনে হলো। মহসিন কিছু দর-দাম করে ওঠার আগেই চোখের সামনেই গরুটা বিক্রি হয়ে গেল। তাতে গরুটা খুশিই হলো কিনা বলা মুস্কিল। হতেও পারে। এখানে তীব্র রোদ। খাদ্যের অভাব। সব মিলিয়ে গরুটা হয়তো ভাবছে নতুন ঠিকানাই তার জন্য শুভ। টুংটাং করে নিজের গলার ঘণ্টি বাজিয়ে সে যেতে লাগল ক্রেতার সাথে। আহারে, গরুটা জানে না কী পরিণতি তার সামনে। জীবনানন্দ বলে উঠলেন--

গরুঞ্জনা, ওই দিকে যেও নাকো তুমি 
দিও নাকো দড়ি ওই বুড়োটার হাতে; 
ফিরে এসো গরুঞ্জনা 
লোক-জঞ্জাল ভরা এই ধানসিঁড়ি মাঠে...

গরুটি হাম্বা করে দুইবার ডেকে জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলে গেল। মহসিনের মুখে আফসোস। বলল, ভালো গরু ছিল। মিস হয়ে গেল! চল, চল ওই গরুটাকে দেখি...দেখেছিস তার লেজ কী সুন্দর... 

কিন্তু সৌন্দর্যের চেয়ে বরং জীবনানন্দ দাশ তাকে দেখল দুখী হিসেবে। কেমন মায়া মায়া চেহারা। মাথা এক দিকে করে জাবর কেটে চলেছে বিষাদগ্রস্থ চোখে। আহা! জীবনানন্দের বুকটা ডুকরে উঠল। 

হয়তো তার গাভিটি শুয়ে ছিল পাশে-- বাছুরটিও ছিলো
ঘাস ছিলো, হাম্বা ছিলো--জঙ্গলে--তবু সে দেখিল 
কোন কসাই? জাবর কাটা হলো না তার 
অথবা জাবর কাটে নাই বহুকাল-- ধানসিঁড়ি হাটে শুয়ে জাবর কাটিছে এবার।

মহসিন গরুর দাম জিজ্ঞেস করতেই কয়েক লক্ষের অঙ্ক জীবনানন্দের কানের পাশ দিয়ে সাঁই করে বেরিয়ে গেল। একটা গরুর দাম ২৫ লাখ? বাপরে বাপ! এতো মানুষের চেয়ে ঢের বেশি দামী। ভুল লিখেছেন ভুল লিখেছেন তিনি। নিজেকে দুষতে শুরু করলেন। তাঁকে লিখতে হতো-- 

আমি যদি হতেম বুনোগরু 
বুনোগাভী হতে যদি তুমি 
লক্ষ টাকা দাম হয়ে চড়িতাম ধানসিঁড়ি তৃণভূমি!

দাম শুনে মহসিনেরও অবস্থা খারাপ। ভিড়ের মধ্যে জীবনানন্দকে টেনে প্রায় পালিয়ে আরেক পাশে চলে আসে সে। এখানে কিছু গরু আছে। আকৃতিতে ছোট ছোট। প্রকৃতিতে নরম। তবে একটা গরুর দশা ভিন্ন। সে তার খুঁটি ধরে একা একা ঘুরে চলেছে। আর কিছুক্ষণ পরপর হাম্বা হাম্বা ডেকে চলেছে। জীবনানন্দ দাশ বলে উঠলেন-- 

হায় গরু, সোনালী কানের গরু, এই খটখটে খড়ের দুপুরে 
তুমি আর কেঁদো নাকো বাঁকাত্যাড়া খুটিটিকে ঘুরে ঘুরে।

গরু জীবনানন্দ দাশের কথা আমলে নিলো। ঘোরা বন্ধ করে দুইবার কান ঝেড়ে গোবর ঢালা শুরু করল। তাতে বাতাস কিছুটা ভারী হয়ে আসল বটে। আর তখনই আওয়াজ উঠল হাটজুড়ে, পালাও পালাও! কাহিনি বুঝতে মহসিন ছুটন্ত একজনকে ধরে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? কী হয়েছে ভাই? লোকটি বিস্ফোরিত চোখে বলল, হাটের সবচেয়ে ষণ্ডা ষাঁড়টা খুঁটি উপড়ে ছুটে গেছে। এখন যাকে পারছে তাকেই শিং দিয়ে গুঁতিয়ে পেছনের হাড়হাড্ডি ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলছে...জানে বাঁচতে চাইলে পালাও...

সঙ্গে সঙ্গে গগনবিদারী হাম্বা রব এলো। আরও একদল লোক স্যান্ডেল ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে লুঙ্গি ফেলে দৌড় দিল। অনেক ধুলো আর বাতাসের ভেতর একটা ষাঁড়ের নিঃশ্বাসের প্রায় গরম বাতাস অনুভব করলেন জীবনানন্দ দাশ। দৌড় দিলেন তিনি। দৌড়াতেই থাকলেন। আর যতবার পেছন ফিরে তাকালেন দেখলেন একটা ষাঁড় তার পেছনে তেড়ে আসছে। জীবনানন্দ দাশের পরনের লাল ফতুয়া ষাঁড়টার হয়তো মনে ধরেছে।

সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। আর কবিরা যখন হাঁটে তখনো কবি। যখন ঘুমায় তখনো কবি। আর যখন প্রাণভয়ে দৌড়ায় তখনও তো কবি। তাই দৌড়াতে দৌড়াতে জীবনানন্দ দাশ বলে উঠলেন--

হাজার বছর ধরে দৌড়াইতেছি আমি ধানসিঁড়ি মাঠে 
খড়-বিচালি, কচি ঘাস থেকে থকথকে গোবর সাগরে 
অনেক ছুটেছি আমি; ধুলো ওড়া বালিময় ধূসর তল্লাটে 
এখন রয়েছি আমি; আরো দূর না গেলে যাবো বুঝি মরে

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিক হৈ-হল্লায় যেন নরক গুলজার
আমারে তাড়া করিয়াছে কোথাকার কোন এক ষণ্ডামার্কা ষাঁড়॥