বৃহস্পতিবার, ২৬ জুলাই, ২০১৮

শোনো গো দখিনও হাওয়া

রাকার সঙ্গে সম্ভবত আমার প্রেম আছে। 
‘সম্ভবত’ বলে সন্দেহ প্রকাশ এ কারণে যে এই সময়ে প্রেম হওয়ার যেসব সহজ উপকরণ বিদ্যমান, তা আমার আর রাকার মধ্যে নেই। প্রথমত, রাকার ফোন নম্বর আমি জানি না। জানার কোনো চেষ্টা যে তেমন করেছি, তা-ও অবশ্য না। সামাজিক নানান যে যোগাযোগ—টুইটার, মেসেঞ্জার এবং বিশেষত ফেসবুক…এসবে রাকা আমার সঙ্গে নেই। সেই অর্থে এবং অন্য অর্থেও রাকার সঙ্গে আমার কোনো সামাজিক যোগাযোগ নেই। 
তবে অসামাজিক একটা যোগাযোগ আমাদের মধ্যে হয়। 

এটা ঘটে সকাল সাড়ে ছয়টায়, খুব ঘড়ি ধরে বলতে গেলে ছয়টা পঁয়ত্রিশ থেকে সাঁইত্রিশের মধ্যে। আমার মোবাইলে অ্যালার্ম দেওয়া থাকে ছয়টা পঁয়তাল্লিশে। তবে প্রতি সকালেই, ছয়টা পঁচিশে আমার ঘুম ভাঙে। আমি উঠে, দুই কোয়া রসুন একটু মধুর সঙ্গে খেয়ে, এক গ্লাস পানি পেটে চালান করে, সাড়ে ছয়টার মধ্যে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াই। আমার হাতে থাকে সিগারেট এবং আমি তা ততক্ষণ পর্যন্ত জ্বালাই না, যতক্ষণ পর্যন্ত না রাকা এসে সামনের ব্যালকনিতে দাঁড়ায়। আমার আর রাকার ব্যালকনির মধ্যে একটা গলি রাস্তার প্রস্থ, একটা অশ্লীল রংচটা ইলেকট্রিক পিলার, সাতটা কি আটটা কালো চাবুকের মতো কারেক্টের তার এবং তিনটা দিনবিশেষে চারটা কাক থাকে। কাকগুলো তখনো ডাকে না। ডাকবে কি ডাকবে না—এ রকম একটা কাকস্য দ্বন্দ্বের ভেতর স্ব-স্ব ব্যালকনিতে আমরা উপস্থিত হই। হলে, আমি সিগারেটটা জ্বালাই। রাকা শনিবার না হলে সালোয়ার-কামিজে থাকে; ওড়না তখনো বিছানায় আর চুলগুলো সদ্য ঘুম থেকে ওঠা আলসেমিতে পাওয়া থাকে বলে রাকাকে প্রায় ঘরোয়া মনে হয়। এ ছাড়া গলির প্রস্থটাও নিতান্ত কম বলেই মনে হয় রাকা আমার বাসারই আরেকটা ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। তখন রাকা তার টবের গাছগুলোতে পানি দিতে থাকে। এ সময় রবীন্দ্রসংগীত বাজলেও বাজতে পারে যে ‘যখন প্রথম ফুটেছে কলি আমার মল্লিকা বনে…’; কিন্তু রাকা ক্যাকটাস আর অর্কিডের চাষ করে এবং সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ ভালোবাসে না। আমি তার ঘর থেকে কখনো রবীন্দ্রসংগীত শুনতে পাইনি। আমি নিজেও রবীন্দ্রসংগীত—নিজের ফোনে বা মনে—এখন পর্যন্ত বাজিয়ে দেখিনি। আমার হিন্দি গান ভালো লাগে। যখন যে সিনেমার গান হিট হয়, তখন সেই গান আমি কিছুদিন টিভির দৌলতে শুনে থাকি। গুনগুনাই বাথরুমে, কিন্তু রাকার সামনে কখনো এসব গান গুনগুনানোর প্রশ্ন ওঠে না। রাকাকে দেখলে আমার এ ধরনের গান মনে আসে না। 

রাকাকে দেখলে অবশ্য আমার তেমন কিছুই মনে আসে না। ছয়টা পঁয়ত্রিশ বা সাঁইত্রিশ কোনো কিছু মনে আসার জন্য এমনিতেই খুব একটা দুর্দান্ত সময় না। তা ছাড়া হাইপার টেনশন নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর তিনি খুব শক্ত করে বলে দিয়েছেন মনের ওপর থেকে ভার কমাতে। সকালে আমি তাই একটা নির্ভার সিগারেট খেতে খেতে রাকার গাছে পানি দেওয়া দেখি বা কোনো কোনো দিন রাকা ওই সকালেই দু-একটা কাপড় মেলে দেয়। টাওয়েল বা একটা টি-শার্ট। আমার সিগারেট যতক্ষণে শেষ হয়, ততক্ষণে রাকার ব্যালকনির কাজগুলোও ফুরিয়ে আসে। আমি অফিসের জন্য তৈরি হই এবং রাকাকে ভুলে যাই সারা দিনের মতো। 
এই যে বললাম সারা দিনের মতো ভুলে যাই, এটা একটা মিথ্যাচারও হলো। মাঝে মাঝে যে রাকাকে মনে আসে না তা-ও তো না। একদিন অফিস থেকে একটা বোটানিক্যাল ফার্মে ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে রাকার কথা হঠাৎ করেই খুব মনে পড়ল। বেশ কিছু অদেখা অর্কিড ছিল ওখানে। আমি কয়েকটা নেওয়ার কথা ভেবেও মনে মনে বাদ দিয়েছিলাম। ওইভাবে দেখলে এটা তো সত্যি যে মিলি আসলে গাছ পছন্দ করে না। হাঙ্গামা মনে করে। মনে করে যে ব্যালকনিতে গাছ থাকা মানেই মশার একটা কারখানা। চিকুনগুনিয়া বা ডেঙ্গুর উৎপাদনকেন্দ্র। মিলি যা পছন্দ করে না, সচরাচর আমি তা করি না। সংসার এভাবেই চালাতে হয় দেখে এসেছি। আমার বাবাকে দেখতাম মায়ের কথায় উঠত-বসত। মাঝে মাঝে বিদ্রোহ করে মদ খেয়ে ফিরত বাসায়। মায়ের সঙ্গে হাঙ্গামা করত, হাঙ্গামার পর কিছুদিন তাদের মধ্যে গভীর মিল দেখা যেত। তারপর আবার কিছুদিনের খটমট। দেখতাম, বাবা বেশ মানিয়ে মানিয়ে চলছেন। আমি বাবার গুণ পেয়েছি। মিলির সঙ্গে আমিও মানিয়ে চলি। মিলি বিফ পছন্দ করে না বলে আমি অনেক দিন বিফ আনি না বাসায়, মাঝে মাঝে খেতে ইচ্ছা করলে অফিসের লাঞ্চ ফাঁকি দিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে খেয়ে আসি। কারওয়ান বাজারের ভেতরে একটা ছাপরা হোটেলে দারুণ কালাভুনা করে। আমি অবশ্য এ কথা মিলিকে বলিনি কখনো। কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন এই রেস্তোরাঁর কথা সে জানে। একদিন কথায় কথায় বলছিল, তুমি কই কই কালাভুনা খাও…সবই আমি জানি! আমি আর কথা বাড়াইনি। অফিসে মিলির কোনো গোয়েন্দা থাকতে পারে। যদিও কাউকে সন্দেহ করতে ইচ্ছা করেনি। শুধু অফিসের কম্পিউটার থেকে ফেসবুকে রাকার ফেসবুক আইডি খোঁজার যে নিয়ম দাঁড় করিয়েছিলাম, সেখান থেকে সরে আসি। তা ছাড়া রাকা নাম লিখে সার্চ দিলে ফেসবুকে কয়েক শ রাকা এসে পর্দা কাঁপিয়ে দেয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো রাকার চেহারার সঙ্গে আমার ব্যালকনির রাকার মিল পাইনি। আমার ধারণা, রাকার কোনো ফেসবুক আইডি নেই বা রাকা হয়তো ছদ্মনামে ফেসবুক চালায়। তার প্রোফাইল পিকচারে কোনো ফুল, নদী, পাখি, সমুদ্রের ছবি দেওয়া; অথচ এসবের থেকেও রাকা সুন্দর, রাকাকে তা কে বলবে?

বলার সুযোগ তৈরি হলেও আমি বলতে পারব না অবশ্য। মিলির জন্য না, মিলি ছিল না এমন অবস্থায় রাকার মুখোমুখি একবার না, দুই-দুবার হয়েছি। প্রথমবার অফিস থেকে ফিরছিলাম…সন্ধ্যার সোডিয়াম আলোর মধ্যে রাকাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে গিয়েছিলাম আমি। এত দিন ধরে ব্যালকনিতে দেখার পর হঠাৎ সশরীরে রাস্তায় দেখে তাকে আমার অদ্ভুত অপরিচিত মনে হয়েছিল। একবার মুখ ফসকে বলেই ফেলেছিলাম প্রায়, কেমন আছেন…; কিন্তু বলতে গিয়ে বুঝলাম ঠিক এই মুহূর্তে কথা বলা আমাকে দিয়ে হবে না। একটা ঝিমঝিমানির ভেতর দিয়ে বাসায় ফিরেছিলাম। মিলি দেখে বলেছিল, ছিনতাইকারী ধরছিল নাকি? আমি কিছু বলিনি। ভেবেছিলাম, রাকা একধরনের ছিনতাইকারী তো বটেই! 

আরেকবার তাকে পেয়েছিলাম আমাদেরই অফিসের সামনে। 
আমি ঠিক শিওর না, কিন্তু মনে হয়েছিল একটা রিকশায় রাকা চট করে চলে গেল। আমার বুকটা অযথা ধড়াস করে উঠল। আমার সঙ্গে যে সহকর্মী ছিল, খুবই আজব দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল সে। পরে ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি অবশ্য জানালেন, হাইপার টেনশন। রাতে নিয়মিত একটা ওষুধ খেলে এ ধরনের মাথা ঘোরার সমস্যা থাকবে না বলে নিশ্চয়তাও দিলেন। 
আমি এখন নিয়মিত ওষুধ খাই। আমার এক সহকর্মী রসুনের কোয়া খেয়ে উপকার পাচ্ছে বলে রসুনের কোয়াও খাচ্ছি। ইন্টারনেটে তো রসুন নিয়ে প্রচুর প্রতিবেদন। সেসবেও আছে রসুনের নানান উপকারিতার কথা। ডাক্তার ভালো ডায়েট করতে বলেছেন বলে কারওয়ান বাজারের ছাপরা দোকানটাতেও অনেক দিন যাই না।

কিন্তু ব্যালকনিতে না গিয়ে পারি না। ছয়টা পঁয়ত্রিশে একটা সিগারেট নিয়ে না পৌঁছালে মনে হয় সকাল হয় না। রাকা এলে আমি সিগারেটটা জ্বালাই। তারপর যতক্ষণ জ্বলে। খুব অল্প টান দিই আমি। ডাক্তার সিগারেট কমিয়ে দিতে বলেছেন। তবে সকালের সিগারেটটা ছাড়া যাচ্ছে না। 

অবশ্য শুক্রবার সকালে সিগারেট খাই না আমি। সেদিনও সাড়ে ছয়টায় ঘুম ভেঙে যায় আমার। কিন্তু সেদিন আর মধু দিয়ে রসুন খেতে ইচ্ছা করে না। সিগারেট নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়াতে ইচ্ছা করে না। রাকাও সেদিন আসে না ব্যালকনিতে। আমার মতো তার স্বামীরও সেদিন অফিস ছুটি। রাকা সেদিন দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। শাড়ি পরে। স্বামীকে নিয়ে বাইরে খেতেটেতে যায়। আমার কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু আমরাও শপিংয়ে যাই। কখনো কখনো সিনেমায়। মিলি নেট ঘেঁটেটেটে এসবে আপডেট থাকে খুব। শুক্রবারের সকালটা আমার খুব ক্লান্ত লাগে। অথচ অনেক ঘুমাই। শুয়ে শুয়ে ঘুমিয়েই তো থাকি। মাঝে মাঝে জাগি। সকালের কাকগুলো ডাকে। তারগুলো কাঁপে। বাতাস এলে জানালার পর্দা ওড়ে একটু-একটু। আর আমার মনে হতে থাকে রাকার সঙ্গে সম্ভবত আমার প্রেম আছে। এটা ভাবতে গেলে ভালো লাগে। মনে হয় অনেক কিছুর সম্ভাবনা নিয়ে একটা না-হওয়া সৌন্দর্য আমার জীবনের জন্য অপেক্ষা করছে। মনে হয়, না-হয়ে ওঠা প্রেমগুলো দখিনের হাওয়ার মতো রহস্যময়, আর সুন্দর!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন