বিশ্বকাপ ফুটবল যখন দরজায় লাথি মারছে, রেফারির বাঁশি যখন ফ্রু ফ্রু করে স্মৃতিতে হানা দিচ্ছে, আমি তখনো মোবাইলে লুডু নিয়ে ব্যস্ত। বড়জোর একবার চোখ উঠিয়ে ক্রিকেটের স্কোরকার্ড দেখে নিতে পারি। কিন্তু ফুটবল? নাহ্, কক্ষনো না। আমি ফুটবল ঘৃণা করি। মনে হয় এই খেলাটির কোনো গোল নেই... কোনো লক্ষ্য নেই। ২২ জন খেলোয়াড়, তিনজন রেফারি বাতাসভরা এক অযথা শূন্য নিয়ে একবার এদিকে একবার ওদিকে দৌড়ায়। হায়! কেন? কেন?
আমার স্ত্রী ভয়ংকর রকমের ফ্রান্স সাপোর্টার। বিশ্বকাপ শুরু হওয়া নিয়ে এখনই তাঁর মাথা খারাপ হওয়ার দশা। ফ্রান্সের খেলা কবে কবে, তা দেখে তিনি এখনই তাঁর রান্নাবান্নার শিডিউল করে ফেলেছেন। ওই বিশেষ দিনগুলোতে তিনি আলুভর্তার মতো সহজ হিসেবে যেতে চাইছেন। আমি প্রতিবাদ করার চেষ্টা করি, ‘খেলা তো ৯০ মিনিটের, তুমি আগে-পরে আরও কিছু রান্না করতেই পারো!’
: না না। টেনশনে আগে কিছু রান্না করা যাবে নাকি! জিদানের উত্তরসূরিরা যেদিন খেলবে, সেদিন আমি রান্নাঘরে থাকতে পারব, বলো?
: মানে জিদান নিজেও তো ভালোমন্দ খেয়ে খেলা দেখতে বসবে, আমরাও না হয় মাংস-টাংস খেয়ে খেলা দেখতে বসলাম!
: আরে, তুমি কী বোঝো, তুমি তো খেলার কিছু জানোই না। নীলা ভাবি তো ব্রাজিলের খেলার দিন রান্নাই করবেন না। বাইরে থেকে খাবার আনাবেন। কোনো হাঙ্গামা রাখবেন না সেদিন। আমি তো তবু আলুভর্তা করে দেব। তুমি ভাতটা রেঁধে নেবে শুধু।
আমি দাঁতে দাঁত চাপলাম। চার বছর হয়নি বিয়ের, বুঝতে পারছি না এই বিশ্বকাপটা আসলে কী বয়ে আনতে যাচ্ছে। আমি গুগলে সার্চ দিয়ে দেখে রাখি দুই পট চালে কয় পট পানি দিতে হয়।
অবস্থা যে অস্থির, তা খানিকটা আমার কলিগদের দেখলেও বোঝা যায়। নাসিমুল আর ফাহমিদের মধ্যে প্রতিদিন বাগ্বিতণ্ডা চলছে। দুজনের একজন জার্মানির সমর্থক, অন্যজন ইংল্যান্ড। কিন্তু কে যে কোনটা, আমি বুঝতে পারি না। তাদের কথায় খেলোয়াড়দের নাম কম আসে। বরং ঝগড়া চলে হিটলার, আইনস্টাইন, পলাশীর প্রান্তর আর কোহিনূর নিয়ে।
আগেই বলেছি, ফুটবলের কোনো গোল নেই। না হলে দুই ফুটবল সমর্থকের কথা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে নাৎসি বাহিনী পর্যন্ত কী করে যায়?
আমার বস অবশ্য ঘোরতর রোনালদো–ভক্ত। ছুটির দরখাস্ত নিয়ে গেলে তিনি বলেন, ‘এই সপ্তাহেই ছুটি নিচ্ছেন কেন? খেলা শুরু হতে দেরি আছে তো।’
আমি বলি, ‘কী বলেন, স্যার, নারায়ণগঞ্জে তো স্যার কবে থেকে খেলা চলছে!’
: কী বলেন, ওখানেও বিশ্বকাপ চলে নাকি? মিনি?
: না স্যার, মেগা। এটা স্যার চার বছর পরপর না, প্রতিবছরই চলতে থাকে।
: ও তাই বলেন! রসিকতা করছেন, বুঝি নাই! ওই হিসেবে খেলা তো সারা দেশেই চলছে। কিন্তু ওই খেলা আর কত দেখা যায় বলুন? এই বিশ্বকাপটা শুরু হলে কদিনের জন্য শান্তি। একটু খেলা দেখা গেল, একটু আনন্দ করা গেল। কী মনে হয়, রোনালদো এবার কাপ পাবে?
আমার ছুটির দরখাস্ত তখনো সই হয়নি। বলি, ‘অবশ্যই পাবে, স্যার। একক নৈপুণ্যে দল জেতানোর ক্ষমতা তো স্যার ওই একটা খেলোয়াড়েরই আছে। এবার কিছু একটা ঘটবেই। এখানে স্যার, সইটা!’
স্যার সই করতে করতে বলেন, ‘হুম। আরেকটা প্লেয়ার ছিল বুঝলেন, একক নৈপুণ্যের, ম্যারাডোনা! আহা, কী খেলা... একলা টিম বের করে নিয়ে আসত! ম্যারাডোনার খেলা দেখেছেন না আপনি?’
বসরা খারাপ হয় সত্যি। তাঁরা গাধার খাটুনি খাটিয়ে কাজের সাফল্যের ভাগ নিজের ঝুড়িতে পুরে নেন সত্যি, কিন্তু বসরা যে এত নিষ্ঠুর হন, জানতাম না। যে গভীর বেদনা এই বিশ্বকাপের আগমনী দিনগুলোতে লাল কার্ড দিয়ে চাপা দিয়ে রেখেছিলাম, বস সেখানেই ফ্রি-কিক মারলেন। ম্যারাডোনা, হায় ম্যারাডোনা!
এই ম্যারাডোনার জন্যই তো আমার সর্বনাশটা হয়েছে। আমার সর্বনাশটা হয়েছে এই ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনার জন্য।
খেলা বোঝার পর থেকেই টিভিতে চোখ রেখেছিলাম। ম্যারাডোনা ম্যারাডোনা করে চিল্লানি দিয়ে যখন খেলা দেখতে বসলাম, দেখলাম ম্যারাডোনা কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়ছে। আমরাও কাঁদলাম, তারপর থেকে আর কখনো সে কান্না শুকাল না। চার বছর পরপর তাতে আরও পানি জমতে লাগল। অথচ প্রতিবারই শুনতাম, এবার নাকি আর্জেন্টিনা দলে ছোট ম্যারাডোনা আছে। আমরা আশা নিয়ে বসি, গোল খেয়ে উঠি। স্বপ্ন নিয়ে বুক বাঁধি, আর্জেন্টিনা হেরে বিদায় হয়। হারতে হারতে আমরা ক্লান্ত...কতজন চলে গেল আমাদের ছেড়ে। এই ডাল থেকে ওই ডালে চলে যাওয়ার মতো করে কতজন দল বদলাল। আমি পারলাম না। আমি খেলাই বদলে ফেললাম।
এখন আমার প্রিয় খেলা ভার্চ্যুয়াল লুডু। খেলাটাতে আমি জিতি। আর জিতলে কী যে ভালো লাগে! আর্জেন্টিনাকে সাপোর্ট করতে করতে আমি জেতার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।
কয়েক দিনের মধ্যেই ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু। আমি খেলা দেখতে টিভির সামনে বসব না, বসব না, বসব না! শুধু মেসি যদি একটা দারুণ কাটাকুটি করে গোল দিয়ে দেয়, সেটা মিস করব আরকি। অথবা দারুণ একটা কর্নার, দুর্দান্ত ফ্রি-কিক...নাহ্, দেখব না! আমার লুডুই ভালো।
কিন্তু এবার যদি ভালো করে নীল-সাদারা? গাধারা, কখন কী করে, তা-ই তো বোঝে না। আচ্ছা, একবার না হয় উঁকি দেব খেলায়। অহেতুক একটা খেলা। আর কতবার বলব আপনাদের, ফুটবল খেলাটার কোনো গোল নেই!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন