শুক্রবার, ৩০ মে, ২০১৪

আবু নাসিম বা লখিন্দর কোনোটিই তার নাম ছিল না... (এক)












এক.



আমরা যখন শেষবারের মতো তার কথা জানবো, জানতে গিয়ে আমাদের মনে হতে পারে এমন জীবনও তাহলে আসলে একটা সমাধানের দিকে যেতে পারে। অথচ দীর্ঘ সময় ধরে, তার মতো, আমাদেরও মনে হতে থাকতে পারে যে আসলে জীবন এমন এক ধাঁধা যার উত্তর তার কাছে তো পর- ঈশ্বরের কাছেও নেই। যদিও লখিন্দরের ঈশ্বর বিশ্বাস কোনো কালেও ছিল না; তবু কথায় কথায় সে ঈশ্বরের কথা বলতো- এবং এক চোখঅলা ঈশ্বরকে কল্পনা করে মজা পেতো। শৈশবের দৈত্যের যে কল্পনা তার ভেতর ছিল, পরে, ঈশ্বর মরে যাওযার পর দীর্ঘদিন ওই কল্পনা তার ভেতর প্রথিত ছিল, বলা যায় অকারণেই ছিল।

লখিন্দরের নাম যে লখিন্দর নয় তা বোঝাই যাচ্ছে। এ কালে এমন নাম কেউ রাখে না। তবু, লখিন্দরকে সবাই লখিন্দর হিশেবেইে চিনতো, জানতো, এবং সবাই ডাকতো পর্যন্ত। লখিন্দর তাতে কষ্ট বা আনন্দ কিছুই পেতো না, কারণ সে ভুলেই গিয়েছিল লখিন্দর ছাড়াও পিতা-মাতা-ভগিনি-ভ্রাতা দ্বারা প্রদত্ত একাধীক নাম তার ছিল। যারা তার বয়সী ছিল তারা যেমন তাকে লখিন্দর ডাকতো ছোটরা, চলতি জুনিয়ররা ডাকতো লখাদা নামে। লখাদাকে নিয়ে অনেকের হুল্লোড়ও ছিল। এই হুল্লোড় লখিন্দর একটা বয়স পর্যন্ত খুব আনন্দের সাথে মেনে নিয়েছিল। পরে, বলা যায় অনেক পরে, নিঃসঙ্গ বারান্দায়, একা একা মার্টিনি গিলতে গিলতে, হুল্লোড়ের কথা ভেবে তার এমনকি গর্বও হতো। কিন্তু দুই সময়ের মাঝখানের ব্যস্ত সময়টাতে, এই হুল্লোড় তার খুব বাজে লাগতো। হুল্লোড় এড়িয়ে চলতে হতো তার। সাধারণ চলাফেরা তাই হয়ে গিয়েছিল দুরূহ। তখন তার একচোখঅলা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা ছিল কৃপার। কিন্তু দৈত্য কি কখনো কৃপা করে? লখিন্দরের খ্যাতি তাই উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছিল, বেড়েই চলেছিল। এটা ছিল বাংলাদেশের মতো বামনে ভরা এক দেশে অসম্ভব খ্যাতির চূড়া। মনে হতো যে লখিন্দর বোধহয় বাঙলাদেশের একমাত্র হিমালয়। লখিন্দরের খ্যাতিতে যমুনায়, বুড়িগঙ্গায়, মেঘনায়, পদ্মায় ঢেউ উঠতো।

বলা বাহুল্য, লখিন্দরের প্রথম বইটার নাম ছিল- লখিন্দর।
না বই পাঠের না। এই বই ছবি। মানে এই বই সিনেমা। লখিন্দর প্রথম মুখে রঙ আর ঠোঁটে লিপিস্টিক মেখে লখিন্দর সিনেমায় ওস্তাদ মিজানুরের দেয়া বানানো নাম আবু নাসিম নিয়ে পর্দায় হাজির হয়। আবু নাসিম নাম মার খায়, কিন্তু লখিন্দর হিট! এই একটা হিট লখিন্দরকে লহমায় এমন উচ্চতায় নিয়ে যায় যে তাকে অনেক দিন আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি। আর যখন সে পেছন ফিরে তাকানোর সময় পায়, ওই যে বারান্দায় বসে বসে, বা আধশোয়া হয়ে মার্টিনি খাওয়ার সময়, তখন তার মাঝে মাঝে, অন্তত একটা খুন করতে ইচ্ছা করে। খুন করার ইচ্ছায় দুয়েকটা ফোনও করে। ওপ্রান্তের বন্ধু এবং শত্রুরা বোঝে রঞ্জনা পর্যায়ের পর লখিন্দরের জীবনে আর নতুন কিছু আসার সম্ভাবনা নেই। ফলে কেবল হুমকিই আসতে পারে এখন। এই আসাটা ক্রমেই যখন রোজকার হয়ে যেতে থাকে তখন অন্যরা গুরুত্ব দেয়া ছেড়ে দেয়। আর এ সময়েই ঘটনাটা ঘটে। রঞ্জনাকে বস্তাবন্দী অবস্থায় একটা পানির ট্যাঙ্কের ভেতর পাওয়া যায়।
কিন্তু এসব তো অনেক অনেক পরের গল্প। এই গল্প শোনার আগে শ্রোতা হিশেবে আমাদের সবাইকেই একটা প্রস্তুতির ভেতর দিয়ে যেতে হবে। আর প্রস্তুতিটা প্রথম আমরা লক্ষ্য করি ঢাকার এফডিসিতে। যেখানে তিন নাম্বার সেটের মেকআপরুমের ভেতর লখিন্দরের গালে তুলির ছোঁয়া লাগে, সিগারেটে পোড়া কালো ঠোঁটে লালচে লিপিস্টিক লাগে। লখিন্দর ভেবেছিল এই লিপিস্টিক সে ব্যবহার করবে না। কিন্তু মেকআপম্যানকে ওইটুকু বলার ক্ষমতা বা যোগ্যতা কিছুই তার ছিল না। লখিন্দর তাই চুপচাপ নিজের ঠোঁটজোড়াকে রমণীয় হয়ে যেতে দেখছিল এবং দেখতে দেখতে ভাবছিল এত গোলাপী ঠোঁট দেখে সেটভর্তি মানুষ নিশ্চয় তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। অনেকখানি লজ্জা আর আড়ষ্টতা নিয়ে লখিন্দর যখন সেটে গিয়ে উপস্তিত হলো... প্রথম দিনের সেট পড়েছে লোহার বাসর... বেহুলা সেখানে উপস্থিত... বেহুলার দিকে তাকাতে পারছিল না লখিন্দর, বিশেষত বেহুলার কাঁচুলির দিকে আর মোটা মোটা উরুর দিকে... আর ডান্স মাস্টার এগিয়ে এসে বলল কীভাবে তাকে ছুটে যেতে হবে বেহুলার দিকে, আর ঠিক কোন মুহূর্তের কোমরটা উঁচিয়ে একটা ঝাঁকি দিতে হবে লখিন্দরের মনে হলো মুহূর্তেই সে ছুটে পালাবে এখান থেকে; তার মনে হলো কাছিমের মতো তার হাত-পাও সেঁধিয়ে যাবে নিজের শরীরের ভেতর। অথচ অভিনয় করার তার অভিজ্ঞতা তো ছিল, পুরো সাতটা বছর সে থিয়েটার করেছিল। আঞ্চলিক থিয়েটারই হোক, তবু, থিয়েটার নিয়ে তার উন্মাদনা তো কম ছিল না। সিরাজউদ্দৌলায় চারটা শো’য়ে সে পাকা দাড়ি লাগিয়ে মীরজাফরের রোল করেছিল, কিন্তু এই তীব্র আলো, বিরাট ক্যামেরা, তারচেয়ে বিরাট সেটের ভেতরে, একটা লোহার বাসর আর বেহুলা আর ডান্স মাস্টার নিয়ে বেকায়দায় পড়ে গিয়ে ছিল সে। নাভির কাছে দীর্ঘক্ষণ ধরে মৌমাছির গুঞ্জন অনুভব করতে থাকে, করতে করতে তার মনে হয় কলেজ জীবনে যদি পড়ালেখাটাও ঠিকমতো করতো, যদি বাম বাম বলে গলা না ফাটাতো, যদি মাও মাও করে একটা সিঙারা দিয়ে দিনটা চালিয়ে না দিতো, তবে, আজ তার এই করুণ দিনের ভেতর নিজের জালে আটকা পড়া মাকড়সার মতো হাল হতো না। অথচ সিনেমায় একটা ঠিকঠাক রোল পাওয়ার জন্য কীই না করেছিল সে। বলা যায় পরিচালক প্রযোজকের দরজায় দরজায় ঘুরেছে। একটা ডাইরেক্টারের মদ বহন করেছে অনেক দিন। দীর্ঘদিন বাজার করে দিয়েছিল এক প্রডিওসারের। আর তারপর এই দিনের জন্য শিকে ছিঁড়েছিল তার। নতুন প্রডিওসার, নতুন ডিরেক্টর, নতুন হিরোইন, নতুন হিরো... তা হিরোর চেহারা ছবি যে লখিন্দরের, তা কিন্তু না। এমনকি তার মাও বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না যে তার বেটার সুরত নায়কের। তবু, লখিন্দরের লেগে থাকার দীর্ঘসূত্রতায়, এবং ভাগ্যের জোরে, আর হয়তো একচোখা ঈশ্বরের ইশারায়, পাঁচশ টাকার সাইনিং মানিতে লখিন্দর সিনেমায় জীবনটা ঝুলে যায়। ঝুলে যায় এই অর্থে যে সিনেমাটা শুরু ও শেষ হতে একটা লম্বা সময় নেয়। সময়টা এতটাই লম্বা যে বেহুলার বিয়ে হয়ে দুই বছরের বাচ্চাও হয়ে যায়। ভাগ্য ভালো যে বেহুলাকে বিযে করে ওস্তাদ মিজানুর; এবং বিয়ে ও বাচ্চা দুই-ই সে গোপন রাখে। এবং বন্ধ হতে হতে, অন্ধকারে যেতে যেতে প্রায় চার বছর পর ছবিটার শুভমুক্তি ঘটে।
আর ঘটতেই একটা ভূমিকম্প হয় যেন। প্রথমে বাংলাদেশের গ্রামগুলো কাঁপে। গ্রামে গ্রামে লখিন্দরের গানগুলোর তরঙ্গ ওঠে। তারপর তরঙ্গগুলো আছড়ে পড়তে থাকে মফস্বলে, মফস্বল থেকে শহরগুলোতে, এবং শহর থেকে খোদ ঢাকাতেই। ঘটনাগুলো এমনভাবে ঘটতে থাকে যে বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাসে আর ঘটনা পূর্বে কখনো ঘটে নি। লখিন্দর বেদের মেয়ে জোছনাকে মাৎ দেয়। সবাই অন্তত তাই বলতে থাকে। বলে যে আসি আসি বলে যে বেদের জোছনা কথা রাখে নি তার চেয়ে হাজার গুণে ভালো এই বেহুলা। সে তার জীবনটাই লখিন্দররে জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছে। আর খালে-বিলে-জলে-জঙ্গলে-বাসরে স্বামীর বিরহে গান গেয়ে গেছে।

লখিন্দর সিনেমায় লখিন্দরের পার্ট ছিলো ওই অতটুকুই বলা যায়। মৃত স্বামী। তার আগে একটা সিন, আর তারপরে একটা। তবু, কীভাবে কে জানে, লখিন্দরও হিট হয়ে যায়। হিট বিষয়টা অনেকটা আগুন লাগার মতো; যখন লাগে তখন সর্বস্বেই লাগে। লখিন্দর একটানে, একচোখা ঈশ্বরের ইশারায়, লাফ দিয়ে ফেলে নয়তলা।

নয়তলা। যেখানে সে শেষ জীবনটা পর্যন্ত কাটিয়েছিল। যে নয়তলার পানির ট্যাঙ্ক থেকে পাওয়া গিয়েছিল রঞ্জনার বস্তাবন্দী লাশ। আর লাশটা পাওয়া গিয়েছিল লখিন্দরের ডিভোর্স দেয়ার পর।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন