শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৫

ছুটির দিনের সকাল


.সারা সপ্তাহ ব্যস্ত থাকার পর সবাই ছুটির দিনটির জন্য অপেক্ষা করেন। ধারণা করেন, এই দিনটি, অন্তত সকালটি তিনি একেবারে নিজের মতো করে কাটাবেন। নিজের মতো করে ঘুমোবেন। নিজের মতো করে ঝিমোবেন। কিন্তু আসলে কী ঘটে ছুটির সকালগুলোয়?

সকাল ৬টা ৪৫ মিনিটআপনার মোবাইলে অ্যালার্ম দেওয়া থাকে সাতটায়। সপ্তাহের অন্য দিনগুলোয় অ্যালার্ম বাজলেও আপনি উঠতে পারেন না। কিন্তু ছুটির দিনে অ্যালার্ম বাজার আগেই আপনার ঘুম ভেঙে যাবে—এই ভেবে যে এক্ষুনি হয়তো অ্যালার্ম বেজে উঠবে! বিছানায় আঁতিপাঁতি করে মোবাইল ফোন খুঁজে যখন অ্যালার্ম বন্ধ করতে যাবেন, তখন দেখবেন ছুটির দিনের কথা ভেবে আপনি আগের রাতেই অ্যালার্ম বন্ধ করে রেখেছেন। আপনার আশঙ্কা অমূলক। আপনি বিরক্ত হয়ে নিজেকে আবার বালিশে সঁপে দেবেন।
সকাল ৭টা ১৫ মিনিট
সাতটার অ্যালার্মে জেগে আবার ঘুমিয়ে, আবার জেগে আবার ঘুমিয়ে ৭টা ১৫ মিনিটে আপনি অন্য দিনগুলোয় বিছানা ছাড়েন। ছুটির দিনে ৭টা ১৫ মিনিটে আপনার কোনো কারণ ছাড়াই আবার ঘুম ভেঙে যাবে। আপনি মোবাইল ফোনে সময় দেখবেন এবং অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে কোলবালিশে লেপ্টে যাবেন।
সকাল ৭টা ২০ মিনিট
অন্য দিনগুলোয় এ সময় আপনি বাথরুমে থাকেন। আজ ছুটির দিন সেটা আপনি জানলেও প্রকৃতি তা জানতে পারে না। প্রকৃতি এই সময়ে আপনাকে তার মতো করে ডাকতে শুরু করবে। আপনার শরীর চাইবে সেই ডাকে সাড়া দিতে, কিন্তু আপনি চাইবেন ঘুমিয়ে থাকতে। প্রকৃতির ডাক, আপনার শরীর ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রচণ্ড মনঃশক্তি নিয়ে বেশ খানিকক্ষণ ধস্তাধস্তি করবেন আপনি। এবং শেষে বুঝতে পারবেন, প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করার কোনো ক্ষমতা আপনার অবশিষ্ট নেই। আপনি হতাশ হয়ে বিছানা-বালিশ ফেলে বাথরুমের দিকে যাবেন। এ সময় আপনার চোখ বন্ধ থাকবে। কারণ, আপনি ভালো করেই জানেন একবার চোখ খুলে গেলে ঘুম উড়ে যাবে। ছুটির দিনের ঘুমকে কোনোভাবেই উড়তে দেওয়া যাবে না। বাথরুমের পুরো সময়টা আপনি পারতপক্ষে চোখ বন্ধ করেই কাটাবেন। এবং যত দ্রুত সম্ভব নিজেকে আবার বিছানায় ভাসিয়ে দেবেন।
সকাল ৮টা ৫ মিনিট
বিছানার তীব্র কাঁপুনিতে আপনার ঘুম ভেঙে যাবে। আপনি প্রথমে আপনার অবস্থান নির্ণয় করতে পারবেন না। তারপরই আপনার ছুটে যেতে ইচ্ছা করবে বাইরে। কারণ, আপনি ধারণা করবেন বোধ হয় ভূমিকম্প হচ্ছে! পরক্ষণেই আপনার মনে হবে ভূমিকম্প হলে পুরো ঘর কাঁপার কথা কিন্তু আসলে কাঁপছে শুধু বিছানাটা। আপনি আবারও আঁতিপাঁতি করে আপনার মোবাইল ফোনটা খুঁজবেন এবং অল্প চোখ খুলে দেখবেন গতরাতে মোবাইল ফোনটার রিংটোন বন্ধ করলেও ভাইব্রেশন বন্ধ করা হয়নি। মোবাইল ফোনে আননোন নম্বর। কেন কেউ এত সকালে ফোন করে—এ রকম ভেবে আপনি ফোন কেটে দিয়ে আবারও ঘুমোনোর চেষ্টা করবেন। কিন্তু অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসবে আবারও। আপনার ঘুমের দুনিয়া আবারও কেঁপে কেঁপে উঠবে। পরিচিত নম্বরকে দু-তিনবার উপেক্ষা করা গেলেও অপরিচিত নম্বর উপেক্ষা করা মুশকিল! কারণ, আপনি বুঝতে পারছেন না কে ফোন করেছেন। হয়তো আপনার বস, হয়তো আপনার প্রেমিকা, কে জানে! অগত্যা আপনি ফোনটা ধরবেন। আর সঙ্গে সঙ্গে ওদিক থেকে চিৎকার করে কেউ একজন বলবেন, ‘হ্যালো হ্যালো...ভাই, এইটা কোন জায়গা...হ্যালো?’
আপনি অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে গলায় বিনীত ভাব রেখে বলবেন, ‘কে বলছেন?’
ওপাশের কণ্ঠটা আরও উত্তেজিত হয়ে বলবে, ‘আমি আক্কাস, হ্যালো ভাই, এইটা কোন জায়গা, হ্যালো ভাই, শুনতে পাইতাছেন?’
: আপনি কাকে চান?
: আপনারেই চাইতাছি! ভাই, আপনি লতিফ ভাই না? ভাই, এইটা কোন জায়গা...হ্যালো ভাই, এইটা রহনপুর না?
: জি না ভাই, রং নম্বর!
আপনি ঠাস করে ফোনের লাইন কেটে আবার ঘুমোতে চাইবেন। কিন্তু আপনার মনে সন্দেহ হতে থাকবে যে ওই নম্বর থেকে আবারও ফোন আসতে পারে। আবারও হয়তো বিছানা কেঁপে উঠবে। আপনি তাই মোবাইল ফোনটা বন্ধ করে দেবেন। এবার ঘুমোবেন। কিন্তু আপনার একটু অস্বস্তি হতে থাকবে। কারণ, মোবাইল ফোনটা বন্ধ। যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ ফোন আসে? আপনি এবার মোবাইল ফোনটা অন করবেন। ভয়ে ভয়ে মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে ঘুমোতে চেষ্টা করতে থাকবেন। আর তখনই মোবাইল ফোনটা একবার কেঁপে উঠবে। না, কারও রিং নয়। আপনার মোবাইল ফোন অপারেটর আপনার জন্য এসএমএস পাঠিয়েছে। কোনো এক গায়কের অশ্রুতপূর্ব গান শুনতে হলে আপনাকে কী করতে হবে, সে বিষয়ে তারা বিস্তারিত জানিয়েছে সেই এসএমএসে।
আপনি বড়জোর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে পারবেন। তারপর ঘুমোনোর জন্য তীব্রভাবে চোখ বন্ধ করবেন।
সকাল ৮টা ৫০ মিনিট
ঘুমটা ধীরে ধীরে জমতে শুরু করেছে আপনার। এই দুই ঘণ্টাব্যাপী চলতে থাকা নানা বাধাবিপত্তির বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত আপনার ঘুমের জয় হয়েছে। আপনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। কী স্বপ্ন সে বিষয়ে অবশ্য বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না। কিন্তু আপনি দারুণ উপভোগ করতে শুরু করেছেন ছুটির দিনের এই আলসেমিভরা ঘুম। ঠিক সেই সময়ে বিদ্যুৎ চলে যাবে। মাথার ওপর ঘুর্ণমান ফ্যানটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসতে থাকবে আর আপনার ঘুম কাটতে থাকবে। ফ্যানটা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই আপনার ঘুম চটকে যাবে। আপনি চোখ মেলে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে চাইবেন না। ছুটির দিনের সকালে, তীব্র গরমের মধ্যে একটা ফ্যান ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এর চেয়ে রোমহর্ষক দৃশ্য আর কী হতে পারে!
কিছুক্ষণের মধ্যেই গরম, রাগ আর হতাশা আপনার শরীর বেয়ে ঘাম হিসেবে টুপটাপ ঝরতে শুরু করবে। আপনার আর থাকা হবে না বিছানায়। আপনি বিছানা ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে চোখ বন্ধ করে বসবেন। গরম, তীব্র গরম! বারান্দায় ঢুলতে ঢুলতেই আপনি উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করবেন বিদ্যুৎ এল কি না। কিন্তু বিদ্যুৎ আসবে না। আপনি একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন যে গত সপ্তাহের মতো আজকেও আর ঘুমোনো হবে না আপনার। আপনি বিভিন্ন বিষয় আর বিভিন্ন ব্যক্তিকে কোনো কারণ ছাড়াই গালাগালি করতে করতে দাঁত ব্রাশ করতে শুরু করবেন। আর যতক্ষণে ঘুমের কবর দিয়ে দাঁত ব্রাশ শেষ হবে, ততক্ষণে দেখবেন বিদ্যুৎ চলে এসেছে। আর বিদ্যুৎ আসার সঙ্গে সঙ্গেই হুড়মুড়িয়ে আসবে বৃষ্টি।
আপনার খিদে পাবে, তবে ঘরে কোনো খাবার থাকবে না। নাশতার জন্য আপনাকে বাইরে যেতে হবে। তবে বাইরে ঝুমবৃষ্টি। কোনোভাবেই আপনি বাইরে যেতে পারবেন না। বৃষ্টিতে ধীরে ধীরে শীতল হয়ে আসবে আবহাওয়া। হিম হিম বাতাস বইতে শুরু করবে। ঘুমের একেবারে উপযুক্ত আবহাওয়া। কিন্তু আপনি ঘুমোতে পারবেন না। কারণ, আপনার পেটে খিদে।

প্রথম প্রকাশ: রস+আলো

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন