বৃহস্পতিবার, ২৬ জুলাই, ২০১৮

দেখা যাক কে জেতে!

‘কী মনে হয় তোমার, আর্জেন্টিনা এবার বিশ্বকাপ পাবে?’
আমি ব্রাজিল সাপোর্টার। এ ধরনের প্রশ্ন সাধারণত একটা ফুৎকারে উড়িয়ে দিই। কফির কাপে ঝঞ্ঝা তুলে বলি, ‘কিসের কী? আর্জেন্টিনা ওই ভলিবল খেলে জিতেছে, আর না! ম্যারাডোনার দিন কবেই শেষ। আর মেসি তো কোনো দিন আর্জেন্টিনারই হয়নি!’
বুকে এসব কথা লকলক করে উঠলেও মুখে বলা গেল না। কারণ, প্রশ্নকর্তা স্বয়ং রিফকার বাবা; আমাকে চা খেতে খেতে সুধালেন। রিফকার মুখে শুনেছি, তিনি বীভৎস রকম আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। রিফকা পইপই করে বলে দিয়েছে, ‘বিশ্বকাপের আগে বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছো, খেলা নিয়ে কথা উঠবেই! তুমি কিন্তু কোনোভাবেই বুঝতে দেবে না যে তুমি ব্রাজিল। নাহলে আমাদের বিয়ে তো দূরের কথা, কোনো দিন আর দেখা করাও সম্ভব হবে না!’
: কী হলো, কথা বলছ না কেন? খেলা দেখো না?
: জি।
: মানে কী? সত্যি খেলা দেখো না! তোমাদের হবেটা কী? ফুটবল খেলা যে দেখে না সে আবার তরুণ হয় কীভাবে? তোমার তো মনে হচ্ছে এখনই সব ঘুণে ধরেছে! স্যাড, সো স্যাড!
: না না আঙ্কেল, খেলা দেখি তো!
: কী, ক্রিকেট? ওই ভদ্রলোকের খেলা? শোনো, খেলা কী করে ভদ্রলোকের হয় বলো তো? খেলা হবে ঠেলাঠেলি আর হুড়োহুড়ির!
: জি, তা তো বটেই!
: ফুটবল! নামেই একটা ইয়ে আছে! মানে পা তো আছেই, তার সঙ্গে একটা বেশ কষে লাত্থালাত্থির ব্যাপার আছে! এখানে ওসব ভদ্রলোকগিরি চলে না। কোন দল তুমি?
এই যাহ্‌! এবার বোধ হয় আর সামলানো যাবে না। আমি ব্রাজিল, এটা বলা যাবে না! আবার আমি ব্রাজিল হয়ে আর্জেন্টিনার কথা বললে আমার কি আর কুল থাকবে! আমি বললাম, ‘ওই তো...’
: ওই তো মানে? ব্রাজিল?
: জি? না না না! কী যে বলেন!
এবার রিফকার বাবার মুখে একটা হাসি ফুটল, ‘তাহলে?’
: জিদানকে ভালো লাগত তো...
: ফ্রান্স? আরে ফ্রান্স হলো শিল্পের জায়গা। তারা যে কেন ফুটবলের মতো একটা হাড্ডাহাড্ডিতে ভ্যাবাচেকা খাচ্ছে, বুঝলাম না! তুমি ফ্রান্স করো নাকি?
: না না, আঙ্কেল! ওই জিদানকে ভালো লাগত তো!
: সে তাহলে অন্য কারণে! তোমার মাথাতেও তো দেখছি চুল কম!
: জি? সে হিসেবে তো ব্রাজিলের ওই রোনালদো...!
: ছি ছি ছি! কোথায় কার নাম নিচ্ছো তুমি! রোনালদোকে আজ কেউ মনে রেখেছে নাকি?
: কী বলেন, আঙ্কেল! বিশ্বকাপ কাঁপিয়ে দিয়েছিল! ব্রাজিলকে কয়টা কাপ...
: তুমি ব্রাজিল নাকি তাহলে?
: না না না। কী যে বলেন না আঙ্কেল! সেই দিন আছে নাকি ওদের!
: হুম। একটা জিনিস মনে রাখবে, হলুদ কিছুই ভালো না! কারও দাঁত হলুদ হলে তাকে আমরা কী বলি, অ্যাঁ? বলি, নোংরা! তারপর ধরো হলুদ পদার্থ, ঢাকার জলাবদ্ধতায় যেসব ভেসে বেড়ায়, সেগুলো দেখে গা গুলিয়ে ওঠে না, অ্যাঁ?
: কিন্তু আঙ্কেল, হিমুও তো হলুদ পাঞ্জাবি পরে!
: কী? হিমু? হিমু আবার এর মধ্যে এল কোথা থেকে! এই ছেলে, তুমি ব্রাজিল নাকি?
: না না না, আঙ্কেল! কী যে বলেন!
: তুমি তো তোমার দল বললে না এখনো!
: দল! মানে...আসলে...ব্যাজিও...
: ইতালি? এরা যে কখন কী করে! কিন্তু তোমার দল তো এবার বিশ্বকাপেই নাই! আহা রে, তোমার কষ্টটা বুঝতে পারছি! বুকটা খাঁ খাঁ করছে, না?
: না না না, আঙ্কেল! ইতালি তো আমার দল না!
: ইতালি না? তাহলে?
: জার্মানি গতবার কাপ পেয়েছিল তো...
: জার্মানি? ওই হিটলারের দেশ!
: আঙ্কেল, ওই দেশে তো আইনস্টাইনও জন্মেছিলেন।
: তাতে কী? জার্মানির চেয়ে খারাপ কোনো দল আছে নাকি? একেকটা যন্ত্র! দেখোনি, গতবার ফাইনালে ওরা কী করেছিল! কিচ্ছু খেলা পারে না...
: আর তাতেই আর্জেন্টিনা উড়ে গিয়েছিল, আঙ্কেল!
: অ্যাঁ? কী? এই ছেলে, তুমি ব্রাজিল নাকি?
: না না না, আঙ্কেল! কী যে বলেন!
: শোনো, রিফকা আমার একমাত্র মেয়ে! আমি আর সে দুজনই আর্জেন্টিনার সাপোর্টার! আমার মনে হয়, এবারের বিশ্বকাপে তোমারও আর্জেন্টিনা সমর্থন করা উচিত! কী বলো তুমি?
: জি...মানে...
: আমি তো ঠিক করেই রেখেছি, রিফকা মায়ের হাত আমি কোনো মেসিভক্তের হাতেই তুলে দেব। মেসির খেলা তোমার কেমন লাগে?
: ভিনগ্রহের খেলোয়াড় তো আঙ্কেল...
: ভালো বলছ না খারাপ বলছ?
: ওই আর কি আঙ্কেল...
: ‘ওই আর কি’ মানে? তুমি জানো, মেসি কেমন খেলোয়াড়! দেখেছ কখনো তাঁর খেলা? ম্যারাডোনার পর এই একটা খেলোয়াড়ই ফুটবল খেলতে পারে। বাকিরা সব বউছি খেলে মাঠের মধ্যে।
: এইটা একটু আঙ্কেল বাড়াবাড়ি বললেন!
: কিসের বাড়াবাড়ি বললাম, অ্যাঁ? মেসিকে তোমার ভালো লাগে না! এই ছেলে, তুমি ব্রাজিল নাকি?
: হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ব্রাজিল! আর আমি চিরদিন ব্রাজিলই থাকব! আপনাদের মতো আর্জেন্টিনাকে সাপোর্ট করতে পারব না! একটা কথা মনে রাখবেন আঙ্কেল, বিএনপি থেকে দলবদল করে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া যায়, আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিতে, কিন্তু ব্রাজিল থেকে কেউ কখনো আর্জেন্টিনা হতে পারে না!
: আমি আমার মেয়ের বিয়ে কোনো দিন কোনো ব্রাজিল সমর্থকের সঙ্গে দেব না!
: আমিও চিরদিন সালমান খানের মতো ব্যাচেলর থাকব, আঙ্কেল! বিয়ে করব না, তবু কোনো দিন আর্জেন্টিনা হব না!
মিটিং ভেস্তে গেল। রিফকা কাঁদল বিস্তর। আমি আর রিফকার বাবা তেল-জল হয়ে থেকে গেলাম। দেখা যাক, কে জেতে!

ফুটবল খেলার কোনো গোল নেই

বিশ্বকাপ ফুটবল যখন দরজায় লাথি মারছে, রেফারির বাঁশি যখন ফ্রু ফ্রু করে স্মৃতিতে হানা দিচ্ছে, আমি তখনো মোবাইলে লুডু নিয়ে ব্যস্ত। বড়জোর একবার চোখ উঠিয়ে ক্রিকেটের স্কোরকার্ড দেখে নিতে পারি। কিন্তু ফুটবল? নাহ্, কক্ষনো না। আমি ফুটবল ঘৃণা করি। মনে হয় এই খেলাটির কোনো গোল নেই... কোনো লক্ষ্য নেই। ২২ জন খেলোয়াড়, তিনজন রেফারি বাতাসভরা এক অযথা শূন্য নিয়ে একবার এদিকে একবার ওদিকে দৌড়ায়। হায়! কেন? কেন?
আমার স্ত্রী ভয়ংকর রকমের ফ্রান্স সাপোর্টার। বিশ্বকাপ শুরু হওয়া নিয়ে এখনই তাঁর মাথা খারাপ হওয়ার দশা। ফ্রান্সের খেলা কবে কবে, তা দেখে তিনি এখনই তাঁর রান্নাবান্নার শিডিউল করে ফেলেছেন। ওই বিশেষ দিনগুলোতে তিনি আলুভর্তার মতো সহজ হিসেবে যেতে চাইছেন। আমি প্রতিবাদ করার চেষ্টা করি, ‘খেলা তো ৯০ মিনিটের, তুমি আগে-পরে আরও কিছু রান্না করতেই পারো!’
: না না। টেনশনে আগে কিছু রান্না করা যাবে নাকি! জিদানের উত্তরসূরিরা যেদিন খেলবে, সেদিন আমি রান্নাঘরে থাকতে পারব, বলো?
: মানে জিদান নিজেও তো ভালোমন্দ খেয়ে খেলা দেখতে বসবে, আমরাও না হয় মাংস-টাংস খেয়ে খেলা দেখতে বসলাম!
: আরে, তুমি কী বোঝো, তুমি তো খেলার কিছু জানোই না। নীলা ভাবি তো ব্রাজিলের খেলার দিন রান্নাই করবেন না। বাইরে থেকে খাবার আনাবেন। কোনো হাঙ্গামা রাখবেন না সেদিন। আমি তো তবু আলুভর্তা করে দেব। তুমি ভাতটা রেঁধে নেবে শুধু।
আমি দাঁতে দাঁত চাপলাম। চার বছর হয়নি বিয়ের, বুঝতে পারছি না এই বিশ্বকাপটা আসলে কী বয়ে আনতে যাচ্ছে। আমি গুগলে সার্চ দিয়ে দেখে রাখি দুই পট চালে কয় পট পানি দিতে হয়।
অবস্থা যে অস্থির, তা খানিকটা আমার কলিগদের দেখলেও বোঝা যায়। নাসিমুল আর ফাহমিদের মধ্যে প্রতিদিন বাগ্‌বিতণ্ডা চলছে। দুজনের একজন জার্মানির সমর্থক, অন্যজন ইংল্যান্ড। কিন্তু কে যে কোনটা, আমি বুঝতে পারি না। তাদের কথায় খেলোয়াড়দের নাম কম আসে। বরং ঝগড়া চলে হিটলার, আইনস্টাইন, পলাশীর প্রান্তর আর কোহিনূর নিয়ে।
আগেই বলেছি, ফুটবলের কোনো গোল নেই। না হলে দুই ফুটবল সমর্থকের কথা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে নাৎসি বাহিনী পর্যন্ত কী করে যায়?
আমার বস অবশ্য ঘোরতর রোনালদো–ভক্ত। ছুটির দরখাস্ত নিয়ে গেলে তিনি বলেন, ‘এই সপ্তাহেই ছুটি নিচ্ছেন কেন? খেলা শুরু হতে দেরি আছে তো।’
আমি বলি, ‘কী বলেন, স্যার, নারায়ণগঞ্জে তো স্যার কবে থেকে খেলা চলছে!’
: কী বলেন, ওখানেও বিশ্বকাপ চলে নাকি? মিনি?
: না স্যার, মেগা। এটা স্যার চার বছর পরপর না, প্রতিবছরই চলতে থাকে।
: ও তাই বলেন! রসিকতা করছেন, বুঝি নাই! ওই হিসেবে খেলা তো সারা দেশেই চলছে। কিন্তু ওই খেলা আর কত দেখা যায় বলুন? এই বিশ্বকাপটা শুরু হলে কদিনের জন্য শান্তি। একটু খেলা দেখা গেল, একটু আনন্দ করা গেল। কী মনে হয়, রোনালদো এবার কাপ পাবে?
আমার ছুটির দরখাস্ত তখনো সই হয়নি। বলি, ‘অবশ্যই পাবে, স্যার। একক নৈপুণ্যে দল জেতানোর ক্ষমতা তো স্যার ওই একটা খেলোয়াড়েরই আছে। এবার কিছু একটা ঘটবেই। এখানে স্যার, সইটা!’
স্যার সই করতে করতে বলেন, ‘হুম। আরেকটা প্লেয়ার ছিল বুঝলেন, একক নৈপুণ্যের, ম্যারাডোনা! আহা, কী খেলা... একলা টিম বের করে নিয়ে আসত! ম্যারাডোনার খেলা দেখেছেন না আপনি?’
বসরা খারাপ হয় সত্যি। তাঁরা গাধার খাটুনি খাটিয়ে কাজের সাফল্যের ভাগ নিজের ঝুড়িতে পুরে নেন সত্যি, কিন্তু বসরা যে এত নিষ্ঠুর হন, জানতাম না। যে গভীর বেদনা এই বিশ্বকাপের আগমনী দিনগুলোতে লাল কার্ড দিয়ে চাপা দিয়ে রেখেছিলাম, বস সেখানেই ফ্রি-কিক মারলেন। ম্যারাডোনা, হায় ম্যারাডোনা!
এই ম্যারাডোনার জন্যই তো আমার সর্বনাশটা হয়েছে। আমার সর্বনাশটা হয়েছে এই ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনার জন্য।
খেলা বোঝার পর থেকেই টিভিতে চোখ রেখেছিলাম। ম্যারাডোনা ম্যারাডোনা করে চিল্লানি দিয়ে যখন খেলা দেখতে বসলাম, দেখলাম ম্যারাডোনা কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়ছে। আমরাও কাঁদলাম, তারপর থেকে আর কখনো সে কান্না শুকাল না। চার বছর পরপর তাতে আরও পানি জমতে লাগল। অথচ প্রতিবারই শুনতাম, এবার নাকি আর্জেন্টিনা দলে ছোট ম্যারাডোনা আছে। আমরা আশা নিয়ে বসি, গোল খেয়ে উঠি। স্বপ্ন নিয়ে বুক বাঁধি, আর্জেন্টিনা হেরে বিদায় হয়। হারতে হারতে আমরা ক্লান্ত...কতজন চলে গেল আমাদের ছেড়ে। এই ডাল থেকে ওই ডালে চলে যাওয়ার মতো করে কতজন দল বদলাল। আমি পারলাম না। আমি খেলাই বদলে ফেললাম।
এখন আমার প্রিয় খেলা ভার্চ্যুয়াল লুডু। খেলাটাতে আমি জিতি। আর জিতলে কী যে ভালো লাগে! আর্জেন্টিনাকে সাপোর্ট করতে করতে আমি জেতার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।
কয়েক দিনের মধ্যেই ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু। আমি খেলা দেখতে টিভির সামনে বসব না, বসব না, বসব না! শুধু মেসি যদি একটা দারুণ কাটাকুটি করে গোল দিয়ে দেয়, সেটা মিস করব আরকি। অথবা দারুণ একটা কর্নার, দুর্দান্ত ফ্রি-কিক...নাহ্, দেখব না! আমার লুডুই ভালো।
কিন্তু এবার যদি ভালো করে নীল-সাদারা? গাধারা, কখন কী করে, তা-ই তো বোঝে না। আচ্ছা, একবার না হয় উঁকি দেব খেলায়। অহেতুক একটা খেলা। আর কতবার বলব আপনাদের, ফুটবল খেলাটার কোনো গোল নেই!

সোমবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৮

ছাতনং রাজনীতিনং তপঃ

রাত। তার ওপর অন্ধকার।
আড়াই মাস ধরে এ রাস্তায় সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। রাস্তা খোঁড়া। এদিকে-ওদিকে কৃষ্ণগহ্বর। আমি বিড়ালের মতো পা ফেলি। মোবাইল ফোনে কল। বাবার বজ্রকণ্ঠ, ‘কই তুই?’
: জি, রাস্তায়।
: আমি আর কতক্ষণ বসে থাকব?
: কোথায় বসে আছেন তার ওপর নির্ভর করছে। আইনস্টাইনের থিওরি অনুযায়ী আগুনের পাশে বসে থাকলে এক ঘণ্টাকে অনন্তকাল মনে হতে পারে। আবার সুন্দরী কোনো মেয়ের পাশে বসে থাকলে...
: চুপ থাক, গাধা! তোকে ফিজিকস পড়ানোই ভুল হয়েছে। পদার্থবিদ্যা পড়ে একটা অপদার্থ হয়েছিস।
আমি চট করে আশপাশে তাকিয়ে নিলাম। বকতে শুরু করলে বাবার কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। ফোন লাউডে দেওয়া নেই তো কী হয়েছে? বাবার কণ্ঠ যাকে বলে বাজখাঁই। ফোন পেরিয়ে কান ছুঁয়ে বুকে শেল মারে।
: কী হলো, চুপ করে আছিস কেন? আমি আর কতক্ষণ বসে থাকব? কখন আসবি তুই?
: আমি? আমি তো এখন বাড়ি যাব না আব্বা। নতুন চাকরি, ছুটি নাই।
: তোকে বাড়ি যেতে হবে না। আমিই তোর ঘরে বসে আছি। তুই আসবি কখন? অফিস শেষে সোজা মেসে আসিস না?
আমার বুক-মুখ-কলিজা-ফ্যাপ্‌সা-সব শুকিয়ে গেল। বাবা আমার মেসে? আমার রুমে?
ঘটনা সাংঘাতিক। আমি চিঁ চিঁ করে বললাম, ‘আপনি ঢাকায়?’
: তোর ফিজিকস কী বলে? তোর মেসে বসে থাকার জন্য আমাকে কি হনুলুলুতে থাকতে হবে?
আমি কথা না বাড়িয়ে পা বাড়ালাম। আর বাড়াতে গিয়ে একটা গর্তে নিউটনের প্রথম সূত্র মেনে আমি এক ‘গতিশীল বস্তু সুষম গতিতে সরল পথে’ যেতে যেতে রাস্তার ময়লা পানিতে গোসল সেরে নিলাম।

২.
বাবা আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। আমি বাথরুমে ৩০ মিনিট টানা নবধারা জলে শুদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করেছি। কাজ বোধ হয় হয়নি। ভ্রুর সঙ্গে সঙ্গে বাবা মাঝেমধ্যে নাকও কুঁচকাচ্ছেন। আমার ভেতরে ভরবেগের নিত্যতার সূত্র কাজ করছে। বললাম, ‘খারাপ কিছু ঘটেছে নাকি?’
: কী আর ঘটবে? ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এই দুনিয়ায় আর আছেইটা কী খারাপ হওয়ার!
: জি।
: এখন যা ঘটবে সব ভালো ঘটবে।
: জি আচ্ছা।
: তোর জিনিসপত্র সব গুছিয়ে রেখেছি, ভোরের ট্রেনে বাড়ি যাচ্ছি আমরা।
: জি? কী বলেন! নতুন চাকরি।
: চাকরি গেলে চাকরি পাওয়া যাবে। কিন্তু তোর যে গাধার স্বভাব, তাতে বিয়ের সুযোগ গেলে আর পাওয়া যাবে না।
: বিয়ে?
: জীবনে প্রথমবার শুনলি মনে হয়! তোর বয়সী অন্য ছেলেরা বিয়ের জন্য এখন বাপ-মায়ের সামনে ‘আচ্ছা চালতা হু, দুয়ায়ো মে ইয়াদ রাখনা’ গায়। আর তুই এখনো নিউটনের বিগব্যাং নিয়ে পড়ে আছিস!
: বিগব্যাং থিওরি নিউটনের না...
: যারই হোক। আর তোর ওই আইনস্টাইন-হকিংয়েরাও বিয়ে করেছিল, তোকেও করতে হবে।
: মানে বিয়ে আসলে একটা খুবই অগুরুত্বপূর্ণ জিনিস...
: ওই অগুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা তোর বাবা করেছিল বলেই তুই এখন সামনে বসে পটরপটর করতে পারছিস। যা আরেকবার গোসল দিয়ে আয়!
: জি?
: আরেকবার গোসল দিয়ে আয়। গোসলের পর শরীরে ভালো করে পারফিউম মাখবি। আর এরপর সুয়ারেজের লাইনের পাশে থাকলে আমার ফোন ধরার দরকার নেই। যা...

৩.
গভীর রাত।
বাবা আর আমি এক বিছানায় শুয়ে আছি। বাবা বললেন, ‘জেগে আছিস?’
: হুম।
: মন খারাপ? নাকি ভয় পাচ্ছিস?
: জি না, ভয় পাচ্ছি না।
: হুম। আচ্ছা শোন, তোর সিভি করা আছে না?
: জি।
: সিভিটা সঙ্গে করে নিয়ে যাস।
: আচ্ছা।
: কনেপক্ষ দেখতে চেয়েছে।
: জি আচ্ছা।
: আর শোন। সিভিতে একটা জিনিস যোগ করে রাখিস, লিখিস যে তুই ছাত্ররাজনীতি করতি।
: মানে? কেন? আমি তো কোনো দিন রাজনীতিটিতি করিনি।
: আরে আস্তে বল। দেয়ালে ভ্যান গঘের ছবি থাকলেই দেয়াল কালা হয় না! আজকাল ছাত্ররাজনীতি না করা পাত্রের ভ্যালু নাই। সবাই মনে করে যে পাত্রের কোনো ক্ষমতাই নাই। পাত্রের কোনো যোগাযোগ নাই। তাই ওরা যখন তোর সম্পর্কে জানতে চাইল, তখন বলেছি যে তুই রাজনীতির ঠেলায় ঠিকমতো পড়ালেখাই করতে পারিসনি। দুইটা মামলা আছে, এ-ও বলেছি।
: কী বলো বাবা!
: আরে তোকে এত কিছু ভাবতে হবে না! আমাদের আইনাল আছে না, আরে ওই যে, ক্লাস এইটের পর আর পড়ল না! একবার জেলেও গেল মাস্টার পিটিয়ে, ও তো এখন বিরাট ছাত্রনেতা। আইনাল বলেছে, সে সব সামলে নেবে। তুই গেলেই তোকে নিয়ে একবার পাত্রীদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসবে। তোকে ‘বড় ভাই’ বলে একবার যদি আইনাল ডাকে, তাহলে দেখিস আর কোনো চিন্তা থাকবে না। আইনাল তো তোর চেয়ে বয়সে ছোটই। তুই রিকোয়েস্ট করলে ডাকবে নিশ্চয়, তাই না?
: হুম।
: যাক, তাহলে আর চিন্তা থাকল না। পাত্রী খুব ভালো। ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অনেক দিন হল পলিটিকসও করেছে। পাওয়ার আছে, বুঝলি! আচ্ছা, তুই সিভিটা ঠিক করে রাখিস কিন্তু।
বাবা এবার নিশ্চিন্তে ঘুমাতে লাগলেন। আমি পিসি খুলে সিভিটা এডিট করতে শুরু করলাম। আইনালের ওপর অবশ্য অনেক কিছু নির্ভর করছে। আইনস্টাইন না, সময় এখন আইনালদের!

সোমবার, ৮ জানুয়ারী, ২০১৮

জীবনানন্দ দাশের গরু কেনা

জীবনানন্দ দাশের গরু কেনা

৪৮৪৬২২:২১, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৬
AddThis Sharing Buttons
এমন সঙ্কটে জীবন বাবু কখনো পড়েন নি। এই একটু আগে বন্ধু মহসীন এসে তাঁকে ধরেছেন। এবার আর ছাগ নয়, এই ঈদে তারা আস্ত একটা গরুই কুরবানি দেবে। জীবনানন্দ যেন তাকে সাহায্য করে গরু কেনায়। সম্ভব হলে জীবনানন্দ দাশ আকাশ থেকে পড়তেন। সম্ভব হলো না। তিনি বসেছিলেন ভাঙা হাতলের বুড়োমার্কা চেয়ারে। সেখান থেকে শুধু পিছলে গেলেন। ডাগর চোখে মহসিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি গরু কিনব কীভাবে? আমি তো জীবনেও গরু কিনিনি মহসিন! মহসিন বলল, তুই কখনো হাজার বছর বেঁচেছিস?
ftu

জীবন বাবু পিটপিট চোখে এবার তাকালেন। মহসিন বলল, বাঁচিস নি তো? কিন্তু লিখেছিস তো হাজার বছর আমি পথ হাঁটিতেছি...তাহলে? জীবনে যা করিস নি তা যদি লিখতে পারিস তাহলে একটা গরু কিনতে পারবি না! 

জীবন বাবু বললেন, কিন্তু গরু কিনতে আমিই কেন? 
মহসিন বলল, শোন সকলেই যেমন কবি নয়, তেমনি সকলই কিন্তু গরু নয়। তুই যদি কবিকে চিনতে পারিস তাহলে গরুকেও চিনতে পারবি। গরু আর কবিদের মধ্যে পার্থক্য বিশেষ নাই! 
: কী বলিস এসব? 
: ঠিকই তো বলি। গরু যেমন খাওয়ার সময় খেয়ে নেয় হাপুস-হুপুস তারপর সারাদিন বসে ঝিমায় আর জাবর কাটে...কবিরাও তেমনি সারাদিন এটা-ওটা দেখে আর সারা রাত বসে বসে সেগুলো নিয়ে জাবর কাটতে থাকে...আর কাগজ-কলম বা ল্যাপটপ নিয়ে কবিতা লিখে যায়। কবিতা লেখা আর জাবর কাটার মধ্যে পার্থক্যটা কী বল? না না তুইই বল, পার্থক্যটা কী? শোন, গরু উপকারী...কবিও মোটামোটি উপকারী...বিশেষত এদের কবিতার লাইন প্রেম করতে গিয়ে মাঝে মাঝে ভালোই কাজে লাগে। এবার আর কথা না, চল আমার সাথে। আজকে একটা ভালো গরু কিনতেই হবে।

পরের দৃশ্য গরুর হাটে। ধানসিঁড়ি হাট। আর হাটের ভেতর হাজার হাজার মানুষ, নাকি লাখ লাখ? জীবনানন্দ দাশের তব্দা খাওয়ার অবস্থা। এত মানুষ? তিনি একটু নির্জনতা পছন্দ করেন। কিন্তু শুধু তো মানুষ না। মানুষের মধ্যেই সারি সারি গরু। নানান ধরনের গরু। যেন মানুষ আর গরুর এক মহামিলনমেলা। আহা! কিন্তু জীবনানন্দের বড় অস্বস্তি হচ্ছে। এত মানুষের ভিতর বা এত গরুর ভিতর তিনি কী করবেন?

মহসিন তাকে টানতে টানতে প্রথমেই নিয়ে গেল একটা মাটিরঙা গরুর সামনে। গরুটা তাকিয়ে আছে ছলোছলো চোখে। অন্তত জীবনানন্দের তাই মনে হলো। মহসিন কিছু দর-দাম করে ওঠার আগেই চোখের সামনেই গরুটা বিক্রি হয়ে গেল। তাতে গরুটা খুশিই হলো কিনা বলা মুস্কিল। হতেও পারে। এখানে তীব্র রোদ। খাদ্যের অভাব। সব মিলিয়ে গরুটা হয়তো ভাবছে নতুন ঠিকানাই তার জন্য শুভ। টুংটাং করে নিজের গলার ঘণ্টি বাজিয়ে সে যেতে লাগল ক্রেতার সাথে। আহারে, গরুটা জানে না কী পরিণতি তার সামনে। জীবনানন্দ বলে উঠলেন--

গরুঞ্জনা, ওই দিকে যেও নাকো তুমি 
দিও নাকো দড়ি ওই বুড়োটার হাতে; 
ফিরে এসো গরুঞ্জনা 
লোক-জঞ্জাল ভরা এই ধানসিঁড়ি মাঠে...

গরুটি হাম্বা করে দুইবার ডেকে জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলে গেল। মহসিনের মুখে আফসোস। বলল, ভালো গরু ছিল। মিস হয়ে গেল! চল, চল ওই গরুটাকে দেখি...দেখেছিস তার লেজ কী সুন্দর... 

কিন্তু সৌন্দর্যের চেয়ে বরং জীবনানন্দ দাশ তাকে দেখল দুখী হিসেবে। কেমন মায়া মায়া চেহারা। মাথা এক দিকে করে জাবর কেটে চলেছে বিষাদগ্রস্থ চোখে। আহা! জীবনানন্দের বুকটা ডুকরে উঠল। 

হয়তো তার গাভিটি শুয়ে ছিল পাশে-- বাছুরটিও ছিলো
ঘাস ছিলো, হাম্বা ছিলো--জঙ্গলে--তবু সে দেখিল 
কোন কসাই? জাবর কাটা হলো না তার 
অথবা জাবর কাটে নাই বহুকাল-- ধানসিঁড়ি হাটে শুয়ে জাবর কাটিছে এবার।

মহসিন গরুর দাম জিজ্ঞেস করতেই কয়েক লক্ষের অঙ্ক জীবনানন্দের কানের পাশ দিয়ে সাঁই করে বেরিয়ে গেল। একটা গরুর দাম ২৫ লাখ? বাপরে বাপ! এতো মানুষের চেয়ে ঢের বেশি দামী। ভুল লিখেছেন ভুল লিখেছেন তিনি। নিজেকে দুষতে শুরু করলেন। তাঁকে লিখতে হতো-- 

আমি যদি হতেম বুনোগরু 
বুনোগাভী হতে যদি তুমি 
লক্ষ টাকা দাম হয়ে চড়িতাম ধানসিঁড়ি তৃণভূমি!

দাম শুনে মহসিনেরও অবস্থা খারাপ। ভিড়ের মধ্যে জীবনানন্দকে টেনে প্রায় পালিয়ে আরেক পাশে চলে আসে সে। এখানে কিছু গরু আছে। আকৃতিতে ছোট ছোট। প্রকৃতিতে নরম। তবে একটা গরুর দশা ভিন্ন। সে তার খুঁটি ধরে একা একা ঘুরে চলেছে। আর কিছুক্ষণ পরপর হাম্বা হাম্বা ডেকে চলেছে। জীবনানন্দ দাশ বলে উঠলেন-- 

হায় গরু, সোনালী কানের গরু, এই খটখটে খড়ের দুপুরে 
তুমি আর কেঁদো নাকো বাঁকাত্যাড়া খুটিটিকে ঘুরে ঘুরে।

গরু জীবনানন্দ দাশের কথা আমলে নিলো। ঘোরা বন্ধ করে দুইবার কান ঝেড়ে গোবর ঢালা শুরু করল। তাতে বাতাস কিছুটা ভারী হয়ে আসল বটে। আর তখনই আওয়াজ উঠল হাটজুড়ে, পালাও পালাও! কাহিনি বুঝতে মহসিন ছুটন্ত একজনকে ধরে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? কী হয়েছে ভাই? লোকটি বিস্ফোরিত চোখে বলল, হাটের সবচেয়ে ষণ্ডা ষাঁড়টা খুঁটি উপড়ে ছুটে গেছে। এখন যাকে পারছে তাকেই শিং দিয়ে গুঁতিয়ে পেছনের হাড়হাড্ডি ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলছে...জানে বাঁচতে চাইলে পালাও...

সঙ্গে সঙ্গে গগনবিদারী হাম্বা রব এলো। আরও একদল লোক স্যান্ডেল ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে লুঙ্গি ফেলে দৌড় দিল। অনেক ধুলো আর বাতাসের ভেতর একটা ষাঁড়ের নিঃশ্বাসের প্রায় গরম বাতাস অনুভব করলেন জীবনানন্দ দাশ। দৌড় দিলেন তিনি। দৌড়াতেই থাকলেন। আর যতবার পেছন ফিরে তাকালেন দেখলেন একটা ষাঁড় তার পেছনে তেড়ে আসছে। জীবনানন্দ দাশের পরনের লাল ফতুয়া ষাঁড়টার হয়তো মনে ধরেছে।

সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। আর কবিরা যখন হাঁটে তখনো কবি। যখন ঘুমায় তখনো কবি। আর যখন প্রাণভয়ে দৌড়ায় তখনও তো কবি। তাই দৌড়াতে দৌড়াতে জীবনানন্দ দাশ বলে উঠলেন--

হাজার বছর ধরে দৌড়াইতেছি আমি ধানসিঁড়ি মাঠে 
খড়-বিচালি, কচি ঘাস থেকে থকথকে গোবর সাগরে 
অনেক ছুটেছি আমি; ধুলো ওড়া বালিময় ধূসর তল্লাটে 
এখন রয়েছি আমি; আরো দূর না গেলে যাবো বুঝি মরে

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিক হৈ-হল্লায় যেন নরক গুলজার
আমারে তাড়া করিয়াছে কোথাকার কোন এক ষণ্ডামার্কা ষাঁড়॥

আজিকে হিমুর বিবাহ : রবীন্দ্রনাথ যদি হিমু সিরিজ লিখতেন

কন্যার বাপ সবুর করিতে পারিত, কিন্তু কন্যা সবুর করিতে চাহিল না। এমন হলুদমার্কা কিউটের ডিব্বা পাত্র সহজে পাওয়া যাইবে না। অতএব আজিকাই বিবাহ।
যদিও কী করিয়া গুণিতে হয় জানা নাই, তবুও বাদল প্রমাদ গুণিল। হিমুর দিকে ড্যাবড্যাব করিয়া তাকাইয়া বলিল, হিমু ভাই, তোমার কি উত্তেজনা হইতেছে? তোমার বিবাহের ক্ষণ যে সম্পন্ন হইয়া যাইতেছে!
himu
হিমু বলিল, মানুষ মাত্রেই উত্তেজনাকর জীব। এরা বাদামের মতো ক্ষুদ্র যে খাদ্য তাহা খাইতে গিয়াও উত্তেজনা অনুভব করে। খুব অল্প টিপি দিয়া বাদামের খোসা ভাঙিয়া তাহার ভেতর হইতে বাদাম বাইর করিতে গিয়াই বুকের ভিতর আলোড়ন অনুভব করে...বিবাহ তো সারা জীবনের টিপি খাওয়া! ইহাতেও উত্তেজনার অন্ত নাই! কিন্তু বাবার ডায়েরিতে লেখা আছে--হিমু, উত্তেজনা হইল নিতান্ত বোকা মানুষদের আবেগ। জানোই তো সাময়িক উত্তেজনা কত বড় বড় অপরাধের জন্ম দিয়াছে এই পৃথিবীতে। তোমাকে ভাইব্রেশনহীন মোবাইলের মতো হইতে হইবে। কল আসিবে ঠিকই, কিন্তু তুমি কাঁপিবে না!
বাদল বলিল, কিন্তু আমি তো কাঁপিতেছি! ডিআইজির কন্যা... একি সহজে ছাড়িবে? অদ্যই শেষ রজনী করিয়া ছাড়িয়া দিবে! ডিআইজির সাথে হুদাই ফাঁপড় লইতে যাওয়া একদমই ঠিক হয় নাই! বিগ মিসটেক!
ডিআইজির কন্যা ততক্ষণে আরেকবার ড্রইংরুমে আসিয়া দাঁড়াইছে। হিমু নির্লিপ্ত থাকিলেও বাদলের প্যান্ট ভিজিবার উপক্রম। সূর্যের চাইতে বালি যে বেশি গরম হয় এ কথা বাদল হুমায়ূনের বইয়ে পড়িয়াছে...কিন্তু এখন দেখিতেছে সূর্যের চাইতে স্যান্ডেলও গরম! ডিআইজির চাইতে ডিআইজির মা-কন্যা সকলেই গরম! মিসটেক, বিগ মিসটেক!
২.
ঘটনা তাহা হইলে গোরা হইতেই শুরু করা যাক।
ঘন শালবনে গভীর রাত্রে একাকী জ্যোৎস্না দেখিতে যাইয়া গতবার বাদলের খুবই প্রবলেম হইয়াছিল। যেখানে মানুষ পৌঁছে না সেইখানে বাতাসে বাতাসে মানুষের বিষ্ঠার গন্ধ যে পৌঁছায়া যাইতে পারে তাহা সম্পর্কে বাদলের কোনো ধারণা ছিল না। শালবনের ভেতর নিজেকে মাটিতে আটকায়া নিয়া সারা রাত্রী সেই গন্ধের ভেতর বাদলকে কাটাইতে হইয়াছে। সঙ্গে মশার বাহুবলিরা ছিল। তাহারা কাটিয়া-কামড়াইয়া বাদলের নাক-মুখ রক্তাক্ত করিয়া ফেলিয়াছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বাদল এইবার জ্যোৎস্না দেখার প্ল্যানে কিছু জিনিস অ্যাড করিয়াছিল। সেই উদ্দেশেই কালো ব্যাগ আর হলুদ হিমুকে লইয়া সে মার্কেটে মার্কেটে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল অ্যারোসল আর পারফিউম কিনিবার নিমিত্তে। হিমুরও আগ্রহের সীমা ছিল না। সে বলিল, অ্যারোসল দিয়া মশা মারায় কোনো আরাম নাই...মশা মারা উচিত কামান দিয়া। হিমুর কথায় বাদল বিহ্বল হইয়া পড়িল। ঢাকার কোথায় কোথায় কামান এখনো জীবিত আছে সেই একটা হিসাব করিয়া হিমুকে নিয়া তারা প্রথমেই জাদুঘর গেটে পৌঁছাইল।
জাদুঘরের আগের দিন নাই। একটা সময় এইখানে আন্দোলন-টান্দোলন হইত। এখন কিছু চিমস্যা মারা পোলাপাইন বইসা থাকে। এদের চোখে না আছে বিগত আন্দোলনের সুরভী, না আছে আগামী প্রাপ্তির ভবিষ্যত! বাদল বলিল, মামা, ওই যে কামান! চলো নিয়া আসিগে!
হিমু বলিল, তুই আমারে মামা বলিতেছিস ক্যান? আমি তো তোর খালাতো ভাই!
বাদল বলিল, উত্তেজনায় গোপাল ভাঁড় হইয়া যাইতেছি হিমু খালু! তাড়াতাড়ি চলো, এক্ষুনি কামান লইয়া শালবন পালাই!
হিমু বলিল, যে কোনো উত্তম কাজ করিবার আগে এক কাপ চা খাওয়া উচিত! এই পিচ্চি চা দে...
দোকানে পিচ্চি ছিল না, বরং পিচ্চির বাপ বয়সী একজন চা বানাইতেছিল। সে অত্যন্ত রুষ্ট হয়ে বলিল, আমারে আপনার পিচ্চি লাগিল?
হিমু বলিল, কামান চুরি করিব। এই উত্তেজনায় গোপাল ভাঁড় হইয়া গিয়াছি! চা দাও পাঁঠা!
পাঁঠা বা পিচ্চি কিছুক্ষণ থম মেরে হিমুদের দিকে তাকাইয়া থাকিল, পরে খালি কাপে গরম পানি ঢালিয়া কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করিতে করিতেই কাকে যেন মোবাইল ফোনে কল করিল।
৩.
বাংলাদেশ পুলিশ আর আগের মতো নাই। এখন তাহারা যথেষ্ট করিৎকর্মা। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা সাইরেন বাজিয়ে জাদুঘরের সামনে হাজির হইল। এবং কামান চুরির দায়ে হিমু আর বাদলকে গ্রেফতার করিল।
ডিআইজি বলিল, চল..চল তোরা!
হিমু বলিল, চায়ের অর্ডার দিয়াছি! চা খাইয়া যাইতেছি!
ডিআইজি বলিল, চা, না? চা তোর আমি ‌ড্যাস দিয়া ঢুকায়া দিবো!
হিমু বলিল, এমনি ঢুকাবেন নাকি ফানেল ব্যবহার করিবেন। পুরান ঢাকায় মনতাজ আলী নামের একজন খুব ভালো ফানেল বানায়!
ডিআইজি বলিল, চোপ! চোপ একদম! তোদের আমি কী করিতে পারি জানিস? শালা, হলুদ পাঞ্জাবি পরিস? কোন গ্রুপের তোরা? কী নাম তোদের? দেখি...দেখি কালো ব্যাগ...
himu-1
ব্যাগের মধ্যে অ্যারোসলের ছয়টা বোতল পাওয়া গেল। সঙ্গে দামী দামী পারফিউমের বোতল। ডিআইজি বলিল, বোমা বানানোর সরঞ্জাম নিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছোস তোরা? আবার কামান চুরি করতে চাইস! কামান চুরি করিয়া কী করিবি, অ্যা?
বাদল মিনমিন করিয়া বলিল, মশা মারিব!
ডিআইজ বলিল, চোপ! চোপ একদম! মশা আমি তোর ড্যাস দিয়া ঢুকায়া দিবো!
হিমু বলিল, কিন্তু এইসব করিবার আগে তো আপনার একবার বাড়িতে যাওয়া উচিত! আপনার স্ত্রী তো রক্তপাতের ভিতর আছে!
ডিআইজি আরও খেপিলেন। খেপিয়া বলিলেন, হিমুগিরি? আমার সাথে হিমুগিরি! কী মনে করছোস আমি হিমু পড়ি নাই... এইগুলা খালি ওই হুমায়ূনের অপন্যাসেই হয়, বুঝলি!
এ সময় ডিআইজির ফোন বাজিয়া উঠিল। ফোন কানে নিতেই সে ঝটকায় হিমুর দিকে তাকাইল। তারপর তাড়াতাড়ি বলিল, আসিতেছি, আমি কুইক আসিতেছি!
ফোন রাখিয়া হিমুকে ডিআইজি বলিল, আমার স্ত্রী বাথরুমে মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া গিয়াছে...মাথা কাটিয়াছে বিস্তর...ভাই একটু আসেন আমার সাথে!
ডিআইজি পরম আস্থায় হিমুর হাত ধরিল। মাথার সাথে সাথে যেমন ধর যাইয়া থাকে, ডিআইজির সাথে সাথে হিমু ও বাদল তেমনি ডিআইজির বাড়ি উপস্থিত হইল। আর হইয়াই বুঝিল বিরাট ভুল হইয়া গিয়াছে। বিগ মিসটেক!
৪.
ডিআইজির স্ত্রী সারিয়া উঠিতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লইল না। কপালে দুখানা সেলাই পড়িল মাত্র। কিন্তু হিমুকে দেখিয়া ডিআইজির কন্যার যে অসুখ বাধিল তা ঘণ্টায় ঘণ্টায়, মিনিটে মিনিটে, কি সেকেন্ডে সেকেন্ডে বাড়িয়া চলিল। ডিআইজি বলিল, শোনেন হিমু, আপনি যদি সত্যি হিমু হইয়া থাকেন তা হইলে এইটুকু জানিয়া রাখেন আমি আমার মেয়েকে অত্যন্ত ভালোবাসি! আর আমার মেয়ে আপনারে অত্যন্ত ভালোবাসিয়া ফেলিয়াছে! সে আর কোনো অপেক্ষায় করিতে চাহে না! আমি আজি রাত্রেই আপনাদের বিবাহ দিতে ইচ্ছুক। আপনার মত কী?
হিমু বলিল, আসসালামুআইলাইকুম!
ডিআইজি বিস্মিত হইয়া বলিলে, সালাম কেন দিতেছেন?
হিমু বলিল, নতুন সম্পর্ক হইতে যাইতেছে আমাদের মধ্যে এই জন্য সালাম!
ঘরে ডিআইজির কন্যা উপস্থিত ছিল, সে হাসিয়া ফেলিল। কন্যার হাসি সুন্দর। কারো কারো হাসি সুন্দর হইয়াও বুকে লাগে না, এই কন্যার হাসি লাগে। শীতরাতের জ্যোৎস্না যেমন একই সাথে সুন্দর ও ভয়াবহ...এই কন্যার হাসিও তেমন! বাড়িতে বিবাহের প্রস্তুতি আরম্ভ হইয়া গেল!

আপনার নাম হিমু?

ওসি সাহেব দেখতে দশাসই। চোখ দুটো ছোট ছোট হওয়ায় চেহারায় হাতি-ভাব আছে। পান-মসলা খাওয়ার অভ্যাস আছে বোধ হয়, কিছুক্ষণ পরপরই মুখ নাড়াচ্ছেন। বুকের ওপর নাম লেখা—মোজাফ্‌ফর! প্রথম ‘ফ’য়ের নিচে হসন্ত আছে। বাংলায় এই হসন্ত দোর্দণ্ড প্রতাপে টিকে আছে, এমনটা বলা যায় না। হসন্তের অবস্থা অনেকটা ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের মতো, আছে কিন্তু কেউ ব্যবহার করে না।
: কী হলো, কথা বলছেন না কেন? আপনার নাম হিমু?
আমি কী জবাব দেব বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ আগে রাস্তা থেকে আমাকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। বসে আছি থানায়। ওসি সাহেব হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছেন। মনে হচ্ছে উত্তেজিত। সন্দেহ হচ্ছে উত্তেজনা আমাকে নিয়েই। পুলিশ যখন উত্তেজিত হয়, তখন পা ফেলতে হয় সাবধানে। আমি সাবধানে শুধু পা নয়, পুরো শরীরটাই ফেললাম। কুঁইকুঁই করে জানতে চাইলাম, ‘কেন বলুন তো?’
: যা প্রশ্ন করেছি, তার উত্তর দেন! প্রশ্নের জবাবে প্রশ্ন করবেন না। আমরা তাস খেলতে বসিনি যে আমি একটা তাস ফেলব তার বদলে আপনি একটা তাস ফেলবেন! প্রশ্ন করছি, জবাব দেন! আপনি হিমু?
: হিমু না, হীরু বলতে পারেন।
আমি এখনো জিনিসটাকে মাঝামাঝি রাখার চেষ্টা করছি। পানি কোন দিকে গড়াচ্ছে, বুঝতে পারছি না। পানি যেদিকে গড়াবে সেদিকে ছাতা ধরার নিয়ম। আমার কাছে কোনো ছাতা নেই। ওসি সাহেবের বিরক্তি সম্ভবত চরমে পৌঁছেছে। বললেন, ‘হীরু! এটা কেমন নাম?’
: অত্যন্ত খারাপ নাম, স্যার। আমার দূরসম্পর্কের এক আত্মীয় আমাকে এই নামে ডাকত। আমার খুবই রাগ হতো। রাগ থেকে আমি একবার তাদের বাড়িতে ডাস্টবিনের ময়লা ছুড়ে মেরেছিলাম!
: সর্বনাশ! তারপর?
: তারপরের ঘটনা স্যার অনেক লম্বা! ওই ময়লার মধ্যে একটা মানিব্যাগ ছিল। মানিব্যাগভর্তি ছিল টাকা! টোটাল টাকা ছিল ৫৭ হাজার ৩২৭! ’৯২ সালের ঘটনা স্যার, তখন ৫৭ হাজার অনেক টাকা। আমি ছুড়লাম ময়লা, তারা পেল গুপ্তধন! এই তো কপাল স্যার!
: মানিব্যাগে কেউ ৫৭ হাজার টাকা রাখে! ফাজলামি করছেন আমার সাথে?
: জি স্যার। মানে স্যার, ফাজলামি না ঠিক, কথায় কথায় কথা বাড়িয়ে স্যার বোঝার চেষ্টা করছি ঠিক কী কারণে আমাকে থানায় ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। আর কী কারণেই বা আমার নাম হিমু কি না জানতে চাওয়া হচ্ছে। এটা ইনফরমেশন নেওয়ার একধরনের পদ্ধতি। পদ্ধতিটার জনক হলেন সম্ভব জার্মানির মিস্টার...
: থাক থাক। আর প্যাঁচাল বাড়াবেন না। সোজা কথায় বলেন, আপনি হিমু কি হিমু না।
: স্যার, আমার গায়ে কি পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবি আছে?
: না।
: স্যার, আমার কি দাড়ি আছে?
: না।
: আরেকটা ইনফরমেশন স্যার, আপনাদের সুবিধার্থে দিচ্ছি, রূপা নামের আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নাই। একচুয়ালি আমার কোনো গার্লফ্রেন্ডই নাই! এ নিয়ে আমার মনে কিঞ্চিৎ দুঃখবোধ আছে।
: মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনি হিমু না?
: জি স্যার। আমি হিমু না। আমার নাম আহমেদ খান হীরক। হীরক থেকে হীরু স্যার। ওই যে আমার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের কথা বলছিলাম স্যার, যার বাড়িতে আমি ময়লা ছুড়ে ফেলেছিলাম। যে ময়লার ভেতর মানিব্যাগ ছিল। যে মানিব্যাগে স্যার ৫৭ হাজার...
: থাক থাক, আর বলতে হবে না। আপনি যদি হিমু না হন তাহলে হিমু নিয়ে লেখেন কেন?
: জি স্যার?
: আমাদের কাছে ইনফো আছে, আপনি হিমুকে নিয়ে লেখেন।
: স্যার, আমি খুবই ছোট এক লেখক, স্যার। পেটের দায়ে লেখি। সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য মাঝেমধ্যে হিমু চরিত্র নিয়ে দু-একটা লেখা লিখেছি। লাভের লাভ কিছুই হয়নি। না লেখাগুলো প্রিয় হয়েছে, না আমি জনপ্রিয় হয়েছি! তার মধ্যে স্যার হিমুর ফ্যানরা আমাকে বকাঝকা করেছে। মিষ্টি মিষ্টি গালমন্দও করেছে!
: অত্যন্ত ঠিক কাজ করেছে।
: জি স্যার, উচিত কাজই করেছে। হিমুকে নিয়ে স্যার আমার লিখতে যাওয়া ঠিক হয়নি। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। হিমু নিয়ে লেখা আমি তাই ছেড়ে দিয়েছি।
: কিন্তু ছেড়ে দিলে তো হবে না মিস্টার হীরক না হীরু, আপনাকে লিখতে হবে!
: মানে স্যার?
: মানে আমার স্ত্রী, তিনি বিরাট হিমুভক্ত। আগামীকাল তাঁর জন্মদিন! রাত বারোটায় আমি তাঁকে একটা চিঠি দিতে চাই। যে চিঠিটা আসলে হিমু লিখবে তার জন্য। কী, পারবেন না?
আমার মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরোল না। ওসি সাহেব বললেন, ‘যতক্ষণ চিঠি লিখে দেবেন না ততক্ষণ আপনি আমার হেফাজতে থাকবেন।’ আমার কণ্ঠ আরও নিচু হয়ে গেল। কোনোমতে বললাম, ‘চা...চা হবে এক কাপ?’
২.
চব্বিশ কাপ চা শেষ হয়েছে, একটা লাইনও বের হয়নি। শূন্য পাতার দিকে তাকিয়ে আছি। হিমু হিসেবে ওসি সাহেবের স্ত্রীর জন্য কী লিখব বুঝতে পারছি না। সময় বয়ে যাচ্ছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বারোটা বাজবে। আর বারোটা বাজলেই আমারও বারোটা বাজবে! কারণ, ওসি সাহেব তখন চিঠিটা তাঁর বাসায় পাঠিয়ে দেবেন। পাঠিয়ে ফোন দিয়ে সুরেলা কণ্ঠে বলবেন, ‘হ্যাপি বার্থ ডে, হ্যাপি বার্থ ডে ডিয়ার, হ্যাপি!’ ও হ্যাঁ, ওসি সাহেবের স্ত্রীর নাম হ্যাপি। ওসি সাহেব মাঝেমধ্যেই এসে তাড়া দিয়ে যাচ্ছেন, ‘কী হলো? কদ্দুর হলো?’ আমি চুপ করে থাকি। চোখের দৃষ্টি দিয়ে ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করি। যেন বলছি, ‘হচ্ছে হচ্ছে...এই তো আর কিছুক্ষণ!’
বারোটা বাজতে যখন আর মাত্র ১০ মিনিট বাকি তখন কিছু একটা লিখে ধরিয়ে দিলাম ওসি সাহেবের হাতে। ওসি সাহেব মহাখুশি হয়ে তাড়ার মধ্যে কী লিখেছি না পড়েই স্ত্রীর উদ্দেশে একজন সহকারীকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। আমি বললাম, ‘আমি তাহলে আসি?’ ওসি সাহেব মধুর কণ্ঠে বললেন, ‘না না, তা কী করে হয়! স্ত্রীর রিঅ্যাকশন না জেনেই চলে যাবেন?’
ওসি সাহেব ঘড়ি দেখছেন, আমি নিজের অন্ধকার ভবিষ্যৎ দেখছি। আমার পেট গুড়গুড় করছে। যেকোনো মুহূর্তে কেলেঙ্কারি হয়ে যেতে পারে।
বারোটা বাজল। ওসি সাহেব ফোন তুললেন কানে। বললেন, ‘হ্যাপি বার্থ ডে...’। কথা শেষ করতে পারলেন না। কেমন যেন চমকে উঠলেন। আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল। পরপর দুবার হার্টের রিদম মিস করে গেল। ওসি সাহেব বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি না...এটা তো অন্যজন লিখেছে! হ্যাঁ হ্যাঁ, উনি তো আমার সাথেই আছেন। কথা বলবে? দাঁড়াও, দিচ্ছি!’
ওসি সাহেব আমার দিকে তাঁর ফোনটা বাড়িয়ে দিলেন। আমি ফোনের বদলে যেন আস্ত একটা বোমা ধরলাম। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম, ‘হ্যালো...।’ ও-প্রান্ত থেকে অত্যন্ত মিষ্টি কণ্ঠ রিনরিন করে উঠল। বলল, ‘এটা আপনি লিখেছেন?’
: জি, মানে হ্যাঁ।
: এটা তো খুবই ভালো হয়েছে!
: জি, মানে সত্যি? শুকরিয়া!
: এত ভালো হয়েছে যে সেটা দিয়ে চুলা জ্বালিয়েছি। চুলা জ্বালিয়ে তাতে চা চাপিয়েছি। আমার গবেট হাজব্যান্ডটাকে নিয়ে আসেন এক্ষুনি। চা খেয়ে তারপর যাবেন!
: কী বলেন এইসব?
: যা বলছি তা শোনেন। এক্ষুনি আসেন। আজকে আমি আপনার আর আমার স্বামীর হিমুগিরি ছোটাব! আসেন এক্ষুনি! আসেন!
ফোনের ভেতর থেকে মিষ্টি কণ্ঠ এক নিমেষে দানবীয় হয়ে উঠল। আমি করুণ চোখে ওসির দিকে তাকালাম। ওসির মুখ ঝুলে গেছে। হিতে এতটা বিপরীত হতে পারে তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। আমি খনখনে কণ্ঠে বললাম, ‘আমাদের দুজনকে ডাকছেন উনি...’
ওসি সাহেব বললেন, ‘ডাবলু, গাড়ি বের করো...’
৩.
শালবনে বসে আছি। আমি আর ওসি সাহেব। ওসি সাহেবের মুখ অত্যন্ত ব্যাজার। কিছুক্ষণ পরপর চাটি মেরে মশা মারার চেষ্টা করছেন। মশা মারা যাচ্ছে না। তবে তারা তাদের গানের আওয়াজ বাড়িয়ে তুলেছে। বনের মধ্যে এ সময় ফুলের গন্ধ ভেসে আসার কথা। গল্প-উপন্যাসে তা-ই হয়। আমরা পাচ্ছি বিজাতীয় আঁশটে দুর্গন্ধ। আকাশে ফুলমুন অবশ্য উঠেছে। চাঁদটাকে দেখে তেমন কোনো আহ্লাদ হচ্ছে না। বরং শীতরাতে এভাবে বসে থাকার জন্য আমরা পরস্পরকে দোষ দিয়ে যাচ্ছি। আমি বলছি, ‘ওসি সাহেব, স্ত্রীর ভয়ে শালবনে বসে আছেন; এটা কি কোনো কাজের কথা?’ ওসি সাহেব বলছেন, ‘লেখকদের ওপর কোনো বিশ্বাস নেই, কোনো বিশ্বাস নেই!’
তবে এ কথাগুলো আমরা মনে মনে বলছি। কারণ, মুখে কিছু বলার মতো মুখ না আমার আছে, না ওসি সাহেবের!
বিপিএলে পাঁচটার মধ্যে চারটার শিরোপাই জিতেছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। তা-ও আবার কোনো এক দল থেকে নয়। যখন যেমন দলই তিনি পান না কেন, কাপ পাইয়ে ছেড়েছেন! মাশরাফি জাদু জানেন। আর এই জাদু জানার কথা ধীরে ধীরে জেনে যাচ্ছে বিশ্ববাসীও। এমন জাদুকর দুটো নেই। তাই অদূর ভবিষ্যতে জাদুকর মাশরাফিকে নিয়ে নানান গল্পকথা, উপকথার চল হবে। দেখে নেওয়া যাক সেসব গল্পকথা আসলে কেমন হবে। লিখেছেন আহমেদ খান
আলিবাবা চল্লিশ চোর
আলিবাবা দাঁড়িয়ে আছে গুহার দরজায়। গুহার ভেতরে আছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। আলিবাবা জানে, কী বললে গুহার মুখটা খুলে যাবে। সে বলল, ‘চিচিংফাঁক!’ বলেই হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকল। কিন্তু দরজা খুলল না। আলিবাবা আবার বলল, ‘চিচিংফাঁক!’ আলিবাবা হাতের বস্তাটস্তা গুছিয়ে নিল, দরজা খুললেই ভেতরের হীরা-জহরত বস্তায় ভরে নেবে। কিন্তু না, এবারও দরজা খুলল না। মুশকিল! আলিবাবার জানামতে এটাই তো ছিল পাসওয়ার্ড! আলিবাবা বিচলিত হয়ে নানান শব্দ করল—আলুফাঁক, পটোলফাঁক, মাল্টাফাঁক! কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না। আলিবাবা বুঝল, পাসওয়ার্ড হ্যাক হয়েছে। এখন উপায় কী? যা থাকে কপালে বলে আলিবাবা বলল, ‘মাশরাফি! মাশরাফি!’ আর সঙ্গে সঙ্গে গুহার ভারী দরজাটা খুলে গেল। ভেতরে জ্বলজ্বল করছে হীরা-জহরত। আলিবাবা হাসল মনে মনে। হ্যাককারীও তার মতোই মাশরাফির ভক্ত!
সুখী মানুষের জামা
লোকটার হলো হাড় মড়মড় রোগ। বিছানায় কোনোভাবেই শুতে পারে না। এ-কাত হলে পাঁজরের হাড় মড়মড় করে ওঠে, ও-কাত হলে পিঠের হাড় ভেঙে যাওয়ার জোগাড়। ঘোড়ার মতো দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে ঘুমায়। ডাক্তার-কবিরাজ বহুত হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত এক চিকিৎসক জানাল, এ রোগ সারবে তখনই যখন লোকটি এক সুখী মানুষের জামা পরবে! লোকটা বেরিয়ে পড়ল সুখী মানুষের খোঁজে। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না সুখী মানুষকে। অনেক ঘুরে ঘুরে যা-ও একজনকে পাওয়া গেল, দেখা গেল তার কোনো জামা-ই নেই। লোকটা বুঝতে পারল, তার রোগ সারানোর আর কোনো উপায় নেই। বিফল মনোরথে ফিরছে যখন লোকটা, তখনই তার মনে পড়ল মাশরাফির কথা। মাশরাফির চেয়ে সুখী আর কে আছে পৃথিবীতে! লোকটা মাশরাফির একটা জার্সি জোগাড় করে গায়ে পরে ফেলল। সেদিন থেকে লোকটার হাড় মড়মড় রোগ সেরে গেল। মাশরাফির জার্সি সে এখন শরীর থেকে খোলেই না।
আঙুর ফল টক নয়
এক শিয়াল মিরপুর থেকে ফিরছিল খেলা দেখে। মাশরাফির অনবদ্য পারফরম্যান্স দেখে শিয়ালের এতই ভালো লেগেছিল যে সে তার শেষ পয়সাটা দিয়ে গ্যালারির সবাইকে আইসক্রিম খাইয়েছে। এখন নিজেরই খিদে পেয়েছে। খিদেখিদে পেট নিয়ে বাসার দিকে যেতে না যেতেই শিয়াল দেখল রাস্তার পাশে ভ্যানের ওপর থোকায় থোকায় আঙুর সাজিয়ে রাখা। দেখতে খুবই লোভনীয়। খেতে নিশ্চয়ই আরও ভালো হবে। শিয়ালের জিবে পানি চলে এল। কিন্তু এলে কী হবে, তার কাছে তো কোনো পয়সা নেই! শিয়াল ভাবল দোকানি যেহেতু আশপাশে নেই, তাহলে এই সুযোগ! এক থোকা আঙুর চুরি করে খেয়ে ফেললেই হয়। কিন্তু যেই চুরি করতে যাবে, অমনি তার মনে হলো সে তো মাশরাফির ভক্ত! মাশরাফির মতো একজনের ভক্ত হওয়ার পরও যদি সে চুরি করতে যায়, তাহলে সবচেয়ে বেশি অসম্মান হবে মাশরাফির! শিয়ালটা কিছুক্ষণ ভেবেটেবে বাসায় যাওয়ার পথ ধরল। যেতে যেতে বলল, ‘আঙুর ফল আসলে টক না, কিন্তু টক না হলেই সেগুলো চুরি করার কোনো কারণ নেই!’
আলাদিনের আশ্চর্য মাশরাফি
আলাদিন ছোটবেলাতেই রূপকথার বইয়ে পড়েছিল যে দুনিয়ায় এমন একটা আশ্চর্য প্রদীপ আছে, যার ভেতর থাকে এক দৈত্য। এই দৈত্য মহাশক্তিধর। তার কাছে যা চাওয়া যায় তা-ই পাওয়া যায়। সেই থেকে আলাদিন অন্য সব কাজ বাদ দিয়ে সেই আশ্চর্য প্রদীপের খোঁজে উঠেপড়ে লেগেছে। প্রদীপের সন্ধানে নাওয়া-খাওয়াও ছেড়েছে প্রায়। অন্য কিছু না করার কারণে পড়েছেও ভীষণ বিপদে। ঘরে চুলা জ্বলে না প্রায়ই। মা-বাবাকে নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটছে তার। তবু কোনো কাজের প্রতি তার খেয়াল নেই। তার একটাই কথা, আমার লাগবে আশ্চর্য প্রদীপ! এ রকম একটা সময়ে আলাদিনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল মাশরাফির। আলাদিনের সব কথা শুনে মাশরাফি বলল, ‘আসলে কি জানো আলাদিন, প্রত্যেক মানুষের ভেতরেই আছে একটা আশ্চর্য প্রদীপ! সেই প্রদীপের নাম স্বপ্ন! আর সেই প্রদীপ ঘষা দিলেই বের হবে ইচ্ছা নামের এক মহাশক্তিধর দৈত্য! তাই তুমি সেই ইচ্ছাশক্তি দিয়ে তোমার স্বপ্ন পূরণ করো। বাইরের কোনো আশ্চর্য প্রদীপের তোমার কোনো দরকারই হবে না!’ সেই থেকে আলাদিন মন দিয়ে নিজের কাজ করে। এখন সে অনেক ভালো আছে। বিয়ের এই মৌসুমে সে বিয়েও করতে যাচ্ছে। দু-এক দিনের মধ্যেই সে মাশরাফিকে দাওয়াত দিতে যাবে!