আট.
রঞ্জনার উত্তরার ফ্ল্যাটে রঞ্জনা ছিল না। বসে ছিল আমান খান। কিছুটা মাতাল। ঘড়ির কাঁটা তিনটা পেরিয়ে গিয়েছিল, আমান খান অবশ্য সেদিকে খেয়াল রাখে নি। অথবা খেয়াল রাখার প্রয়োজন মনে করে নি।
তার লখিন্দরের কথা খেয়ালে এসেছিল, এসেছিল বাবুভাইও, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এসব ছাপিয়ে তার ভেতর জ্বালাময় হয়ে ছিল যার ছবি সে সেই উঠতি হিরোইন-- চুমকি। তার ঠোঁট আর শরীর, যেন ঠোঁটজোড়া শরীর থেকে আলাদা, আর শরীর বলতে আসলে সেই সব অংশ যেগুলো পুরুষকে আলাদাভাবে ভাবায় নাড়ায়, আমান খানের ভেতর সেগুলো আলোড়ন তোলে। আরো কিছুক্ষণ এমন কাটতে পারতো আমান খানের, কিন্তু তার শঙ্কাও হয়। শঙ্কাটা রঞ্জনাকে ঘিরে। রঞ্জনা,পার্টি থেকে বেরিয়ে গেছে তার আগে, অথচ সে ফ্ল্যাটে আসে নি। আমান খানের শঙ্কা ক্রোধের দিকে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে থাকে। যেন শঙ্কাটা কেরোসিন, ছড়ানো রয়েছে মেঝেতে, আর আমান খান ক্রোধের একটা ম্যাচ জ্বালিয়ে ছুঁড়ে দেয় শঙ্কার কেরোসিনে, আর তা দপ করেই জ্বলে মেঝেতে বা তার মনে ছড়িয়ে যেতে থাকে।
তার লখিন্দরের কথা খেয়ালে এসেছিল, এসেছিল বাবুভাইও, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এসব ছাপিয়ে তার ভেতর জ্বালাময় হয়ে ছিল যার ছবি সে সেই উঠতি হিরোইন-- চুমকি। তার ঠোঁট আর শরীর, যেন ঠোঁটজোড়া শরীর থেকে আলাদা, আর শরীর বলতে আসলে সেই সব অংশ যেগুলো পুরুষকে আলাদাভাবে ভাবায় নাড়ায়, আমান খানের ভেতর সেগুলো আলোড়ন তোলে। আরো কিছুক্ষণ এমন কাটতে পারতো আমান খানের, কিন্তু তার শঙ্কাও হয়। শঙ্কাটা রঞ্জনাকে ঘিরে। রঞ্জনা,পার্টি থেকে বেরিয়ে গেছে তার আগে, অথচ সে ফ্ল্যাটে আসে নি। আমান খানের শঙ্কা ক্রোধের দিকে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে থাকে। যেন শঙ্কাটা কেরোসিন, ছড়ানো রয়েছে মেঝেতে, আর আমান খান ক্রোধের একটা ম্যাচ জ্বালিয়ে ছুঁড়ে দেয় শঙ্কার কেরোসিনে, আর তা দপ করেই জ্বলে মেঝেতে বা তার মনে ছড়িয়ে যেতে থাকে।
বাইরে গাড়ির আওয়াজ হয়। আগুন হু হু করে জ্বলে ওঠে। দাঁড়িয়ে যায় আমান খান। আর তখন ঘরে ঢোকে রঞ্জনা। রঞ্জনা আমান খানকে দেখে যেন পাত্তাই দেয় না। বলে, কী ব্যাপার, তুমি এখানে?
আমান খানের ভেতর একটা সাপ ফোঁস করে ওঠে। রঞ্জনা কথা চালিয়ে যায়। বলে, বলতে পারো আর কোথায় যাবে? তাই না? তা যাওয়ার জায়গা তোমার তো কম নেই! ঘরে আছে সতীসাবিত্রী শাবানার মতো বউ! তার কাছে যেতে না চাইলে নতুন একজনের দিকেও তো নজর রাখতে দেখলাম! হুম! ওই যে ওই ডাইনিটা... কী যেন নাম?
কথা বলতে বলতে রঞ্জনা আয়নার সামনে গিয়ে কানের অলংকার খুলতে শুরু করে। ছুটে যায় আমান খান। পেছন থেকে রঞ্জনার ঘাড় চেপে ধরে। চিৎকার করে ওঠে রঞ্জনা। বলে, ছাড় কুত্তা ছাড়...
আমান খান বলে, লখিন্দরের সাথে ফিল্ম পাইয়া তোর রঙ ধরছে না? তোর রঙ আমি বাইর করছি...
আমান খান টান দেয় রঞ্জনাকে, দিয়েই ধাক্কা মারে। এমন অপ্রত্যাশিত আঘাতে রঞ্জনা কেঁপে ওঠে। অপ্রত্যাশিত? তাই কি? রঞ্জনার ভেতরে যেন প্রত্যাশা আর অপ্রত্যাশা দুটোই যেন একসাথে ডানা মেলে ওঠে। অনেক দিন পর। একটা পাখির বাচ্চার কথা মনে হয় তার। পাখিটার ডানা ভাঙা ছিল। উড়তে পারছিল না। আর রঞ্জনার সৎবাবা সেটাকে ধরে হাসতে হাসতে আগুনে ঝলসেছিল। লবন-মরিচ লাগিয়ে খেয়েছিল। এতটুকু পাখি, সৎবাবার মুখের ভেতর একবারেই ঢুকে গিয়েছিল পুরোটা, কুড়মুড় করে চিবিয়ে খেয়েছিল। সেই হাড় ভাঙার শব্দ রঞ্জনার কানে এখনো বাজে। বাজতে থাকে। এখনো। আমান খান রঞ্জনাকে আবার টানে। টেনে ছেঁচড়ে নিয়ে যেতে চায় বিছানায়। পা চালায় রঞ্জনা। এইটুকু শক্তি প্রয়োগ করতে তার ভালো লাগে। যেন সে তার সৎবাবার ওপরেই লাথিটা মারে। আর লাথটা মারার পর আমান খানকে রঞ্জনার সৎবাবা মনে হয়। কেমন অশরীরি একটা জোর পায় সে। দুহাত দিয়ে ধাক্কা মারে আমান খানকে। আমান খান পড়ে যায়। তার চোখ থেকে বাহারী সানগ্লাশ খুলে যায়। ছড়িয়ে যায় দূরে। আমান খান সানগ্লাশটার দিকে একবার তাকায়। তারপর রঞ্জনার দিকে তাকিয়ে যেন মনের ফনাটা বের করে। বলে, তোরে আমি বস্তি থেইকা উঠায়া আইনা হিরোইন বানাইছি! তোর কীসের এত দেমাগ, অ্যা? কীসের দেমাগ?
রঞ্জনা বলে, আমারে উঠাইয়া আইনা খুব পস্তানি লাগতেছে না? এখন তুই উঠাইতে চাস ওই চুমকিরে!
আমান খান উঠে দাঁড়ায়। বলে, আমি আমান খান! আমান খান! আমি যাবে ইচ্ছা তারে উঠাইতে পারি যারে ইচ্ছা তারে নামাইতি পারি... আমি সব পারি!
খিলখিল করে হেসে ওঠে রঞ্জনা। বলে, কী পারিস তা দেখায়ে দিছে বাবুভাই! সামনে আর তোর কোনো ছবি নাই! সবগুলা বানাইবো ওই লখিন্দররে দিয়া! সবগুলা! তুই হলে বইসা খালি তালি মারবি!
ঠাশ করে একটা চড় মারে আমান খান। রঞ্জনার মুখ ঘুরে যায়। ঠোঁট কেটে যায়। আর ঠোঁটের কোণায় ওই রক্ত দেখে ভেতরের সাপটা ছোবল মারতে চায় আমান খানের। হামলে পড়ে রঞ্জনার ওপর। ঠোঁট দুটোকে চুষে খেতে চায় আমান খান। আর খেতে গিয়ে তার চুমকির কথা মনে পড়ে, খুব করে পড়ে; আর তারপরেই মনে পড়ে লখিন্দরকে। ফলে আমান খান দাঁতের ব্যবহার করে। এবং ধাক্কা মারে রঞ্জনাকে। বিছানায়। আর এই ধাক্কা প্রত্যাশিত ছিল রঞ্জনার। ছিল, প্রত্যাশিত ছিল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমান খানের ফনা ঝাঁপির ভেতর ঢুকে যায়। আমান খানের ক্রোধ স্রোত হয়ে যায়। আর স্রোত হওয়ার আগে, আমান খান বলে, ততক্ষণে রক্ত কোমল হয়ে গেছে, ততক্ষণে রঞ্জনা রঞ্জু হয়ে গেছে, আমান খান বলে, রঞ্জু, তুই হবি ওই লখিন্দরের সর্বনাশের কারণ...তুই হবি সর্বনাশ!
সর্বনাশ শব্দটা রঞ্জনা আর আমান খান দুজনকেই পুলকিত করে। রঞ্জনা কেমন যেন হেসে ওঠে। এলিয়ে দেয় শরীরটা আরো। আরো বেশি গ্রহণ করতে চায় আমান খানকে। আমান খান যেন একটা তীর ছোঁড়ে, এভাবে শরীরটা বেঁকিয়ে, রঞ্জনার সাথে নিজেকে পেঁচিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, তুই খেলবি এমন এক খেলা যা যুগে যুগে খেলে আসছিস তোরা! লখিন্দরকে এবার খাঁচায় ঢুকাবি, তোর পায়ের তলায় রাখবি!যে মাথাটা উঠেছে ফনার মতোন সেইটা ধড় থেইকা আলাদা কইরা দিবি! সাথে থাকবি পাশে থাকবি ছায়ার মতোন আর তার সবকিছুই কাইটা ছাড়খার কইরা দিবি! পারবি না?
হিসহিস করে ওঠে আমান খান। তীরটা ছোঁড়ে। সাদা ঘোড়ার স্রোতে ভেসে যায় দুজনেই। একটা গভীর ষড়যন্ত্র কামজ ঘ্রাণের ভেতর শেষ হয়। শুধু শ্বাসের শব্দ থাকে। স্বেদ থাকে। অ্যালকোহলের মিষ্টি গন্ধ থাকে। এসির বিজবিজ আওয়াজ থাকে। আর রঞ্জনার প্রতীজ্ঞা থাকে।
রঞ্জনা বলে, আমি ওই লখিন্দরের সব শেষ করে দেবো! সব! ওর আমি সর্বনাশ ছাড়বো!
আমরা যারা পরের গল্পটা জানি এবং তারো পরের গল্পটা জানতে চাই তারা রঞ্জনার এই কথাটা মনে রাখতে পারি। রঞ্জনা বা আমান খান কেউই এই কথাটা জীবনে আর কখনো ভোলে নি, ভুলি নি আমরাও। অথচ যাকে নিয়ে এই কথা, যার সর্বনাশ নিয়ে আমাদের এই মাথাব্যথা,সেই লখিন্দরের দিকে তাকালে দেখি 'আমার বাড়ি তোমার বাড়ি' ছবির সেটে ক্যাবারে নাচের জন্য তৈরি। আমরা মাঝে মাঝে অবাক হই এই ভেবে যে ইঁদুর দৌড়ের এই সিনেমার হাইওয়েতে কী করে এত শান্ত থাকে লখিন্দর। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবি লখিন্দর বোধহয় সেই সবের একজন যারা জীবনটাকে কখনোই দৌড় হিশেবে নেয় নি, সব সময় সেটাকে উদযাপন করতে চেয়েছে। মিউজিক বেজে উঠতেই আমান খান ফ্রেমের ভেতর ঢুকে পড়ে। অপর দিক থেকে নাচের ভঙ্গিতে ছুটে আসে মাধবী। যার এখনো কোনো নাম দেয়া হয় নি। যাকে এখনো এক্সট্রা বলেই ডাকা হচ্ছে। আর তখন লখিন্দরের মনে হয় তারও একটা নাম ছিল, যে নামে তাকে এখন কেউ ডাকে না, যে নামে তাকে এখন কেউ চেনে না। আর যে নামে তাকে ডাকে, যে নামে তাকে চেনে সে নাম তার নয়।
মিউজিক বেজে ওঠে। পরিচালক বলে ওঠে, এ্যাকশন!
(ক্রমশ...)
ছবি: লেখক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন