শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

আমরা 'ভাগ্যবান' দুর্ভাগা

গল্প ১
মাসুদ রানার হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম
গোপন এক মিশন নিয়ে সেই সকাল থেকে মাসুদ রানা বসে আছে কারওয়ান বাজারে। তার চওড়া কপালে তিন-চারটা ব্রণ, যার একটা এরই মধ্যে পেকেও গেছে। ব্যথা হচ্ছে অল্প অল্প। রানা বুঝতে পারছে না ব্রণটায় খোঁটাখুঁটি করা ঠিক হবে কি না। কারণ, সে এখন রয়েছে বিশেষ একটা অ্যাসাইনমেন্টে।
গত রাতেই জরুরি খবর দিয়ে মতিঝিল অফিসে ডাকা হয়েছিল তাকে। আর গিয়েই চক্ষু চড়কগাছ রানার। রাহাত খানের নাকের নিচে ঝুলছে এক অতিকায় গোঁফ। কাঁচা-পাকা ভ্রুজোড়াও আর নেই, তাতে কলপের কালি। গুনগুন করে গান গাইছেন রাহাত খান, ‘ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে…’।
নিজের চোখ আর কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না রানা। এ কী দেখছে, এ কী শুনছে সে! রাহাত খান একটা ফাইল এগিয়ে দিলেন রানার দিকে। ফাইলের রং লাল। ওপরে বড় বড় করে লেখা, ‘টপ সিক্রেট!’
ফাইলটা খুলতেই রানা দেখল, এক তরুণীর ছবি। অনিন্দ্যসুন্দরী। চোখে-মুখে জাদু। রানা দেখল, রাহাত খানের মুখে লজ্জা মেশানো হাসি! মানে কী এসবের?
রাহাত খান বললেন, ‘নিচে একটা চিঠি আছে। প্রতি সকালে ও কারওয়ান বাজারে সবজি কিনতে আসে। চিঠিটা তাকে পৌঁছে দিতে হবে, বুঝেছ?’
রানা চাকরি বাঁচানোর ভয়ে আর কিছু বলল না। ফাইলটা বন্ধ করে রেখে দিল নিজের কাছে। বেরিয়ে যাচ্ছিল রানা। ডাক দিলেন রাহাত খান, ‘রানা! সাবধান! এ আমার জীবন-মরণের প্রশ্ন!’
: জি, অবশ্যই!
: আর শোনো, কয়েকটা নীল পদ্মও নিয়ে যেয়ো। আজকালকার জেনারেশন তো, আমি এসব ঠিক বুঝেও উঠতে পারি না...বোঝোই তো! তোমরাই ভরসা!
: কোনো চিন্তা করবেন না, স্যার!
রানা এখন কারওয়ান বাজারে অপেক্ষা করছে কপালে ব্রণের ব্যথা আর গোপন মিশনের উৎকণ্ঠা নিয়ে। তার হাত পেছনে লুকানো। কারণ, সে হাতে দুলছে কয়েকটি নীল পদ্ম।
.গল্প ২
আজ মিসির আলীর বিয়ে
কাজী বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ! এবার বর বাবাজি, উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে সালাম দিন।’
মিসির আলী উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে সালাম দিতে গেলেন। কিন্তু দিতে গিয়ে হঠাৎই তীব্র টান অনুভব করলেন পায়ের রগে। হঠাৎই ব্যথা। ব্যথাটা চিড়িক করে একেবারে মাথায় গিয়ে ঠেকল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ধপাস করে পড়ে গেলেন।
মিসির আলী বুঝতে পারলেন, তিনি জ্ঞান হারাচ্ছেন। এ সময় তাঁর নিজের মানসিক অবস্থা নিয়েই ভাবনা আসার কথা, তিনি এখন এক্স ওয়াই জেড সংখ্যা ধরে অমীমাংসিত রহস্যের মীমাংসা করবেন। কিন্তু অত্যন্ত বিচলিতভাবে তিনি খেয়াল করলেন, তাঁর মাথার ভেতর এ সময় অন্য একটা মুখ ভেসে উঠছে। এই মুখ ফারিয়ার। ফারিয়াকে তিনি আজ এই কিছুক্ষণ আগে বিয়ে করেছেন! ফারিয়ার মুখের ওপর দিয়ে মিসির আলীর সব রহস্য, সব অমীমাংসা যেন নিমেষেই হারিয়ে যাচ্ছে। মিসির আলী মনে মনে বললেন, ‘হায় হায়, বউয়ের চেহারা এভাবে সামনে চলে এলে তো আমি কোনো কাজ করতে পারব না!’ তিনি মন ফেরানোর চেষ্টা করলেন। ১০০ থেকে উল্টো গণনা শুরু করলেন। ভালোই আসছিলেন। কিন্তু আটকা পড়লেন পঁচিশে। ফারিয়ার বয়স ২৫। ফারিয়া বলে ‘সুইট টোয়েন্টি ফাইভ’। ‘সুইট’ বলার সময় ফারিয়ার ঠোঁট অদ্ভুত রকমের গোল হয়। তা দেখতে কী যে ভালো লাগে! মিসির আলীর সব হিসাব তালগোল পাকিয়ে গেল। মিসির আলী বললেন, ‘হায় হায়! হায় হায়!’
জ্ঞান হারানো অবস্থাতেই মিসির আলী ফারিয়ার কণ্ঠ শুনতে পেলেন। ফারিয়া তাঁকে ডাকছে, ‘অ্যাই মিসির, মিসির! অ্যাই, ওঠো না...অ্যাই বাবুটা, ওঠো বলছি!’
মিসির আলী কী করবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি জানেন ফারিয়ার এই ডাকে সাড়া দিলে তাঁর জীবনের বাকি রহস্যগুলো চিরকাল অমীমাংসিতই থেকে যাবে। কিন্তু তারপরও এই ডাক উপেক্ষা করার শক্তি তিনি অনুভব করছেন না। ফারিয়া ডেকেই যাচ্ছে, ‘মিসির, অ্যাই মিসির, বাবু আমার, ওঠো...।’
গল্প ৩

বিদায় হিমু
খালু হুংকার দিয়ে বললেন, ‘বিদায় হিমু, বিদায়!’
খালুর হাতে চকচকে ল্যুগার। হিমু একটা ঢোক গিলল। বিপদের সময় বাদলই হোক আর রূপাই হোক, কারও কোনো খবর পাওয়া যায় না। যা করার এখন নিজেকেই করতে হবে। হিমুর পরনে পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির রং মেরুন। মেরুন রঙের পাঞ্জাবিটাতে পাঁচটা পকেট। দুইটা বাইরে আর তিনটা ভেতরে। ভেতরের একটা পকেটে তার প্রিয় ওয়ালথার পিপিকেটা নাক গুঁজে আছে। সেটা একবার বের করতে পারলেই...!
হিমু তার হাতটা পাঞ্জাবির পকেটের ভেতরে নিয়ে যেতেই খালু চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘উঁহু,  চুপ করে ডেরিয়ে থাকো! নড়েছ কি মরেছ!’
‘খাইছে!’ বলে উঠল হিমু। এবার তাহলে কী করা যায়? খালুর হাতটা তিরতির করে কাঁপছে। যেকোনো সময় ঠাস করে গুলি বেরিয়ে যাবে। তাহলে খালুর বাড়ি থেকে এত টাকাপয়সা চুরি করে আর লাভই–বা     কী হবে?
‘না হিমু, আরও কত কত দিন তোমাকে বাঁচতে হবে! কত রকমভাবে ভোগ করতে হবে জীবনটা।’ মনে মনে ভাবে সে। বাবা ডায়েরি ভর্তি যতই উপদেশবাণী লিখে যাক, যতই বলুক, ‘বাবা হিমালয়, পৃথিবীকে তুমি সমান দুই ভাগে বিভক্ত করিতে পারো। এক ভাগ ভোগ আর এক ভাগ যোগ। তুমি এই দুইটির কোনোটিতেই প্রবেশ করিবে না। তোমাকে চলিতে হবে তিন নম্বর পথে...।’
‘হুহ্! তিন নম্বর পথ! আমি ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা নাকি?’
খালু এগিয়ে আসছেন। না, আর অপেক্ষা করা যায় না। হিমু তীব্র বেগে লাফিয়ে পড়ল সামনে। এক লহমায় মেরুন পাঞ্জাবির ভেতর থেকে তার হাতে উঠে এল ওয়ালথার পিপিকে। এবার খালু আর হিমু মুখোমুখি। দুজনের হাতেই শোভা পাচ্ছে দুটি পিস্তল। গুলি ছুটবে যেকোনো সময়...!
পাদটীকা: আমরা সৌভাগ্যবান! আমরা জানি, ওপরের গল্পগুলো ভুল। কিন্তু আমাদের শিশুরা দুর্ভাগা! তারা জানেও না, তাদের পাঠ্যপুস্তকে কোনটা ভুল আর কোনটা ঠিক!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন