মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০১৭

বাবা হওয়া সহজ নয়

 পৃথিবীতে হাঁটাবাবা, ছালাবাবা, কানাবাবা, ছানাবাবা, পাগলাবাবার মতো হাজারো বাবা থাকার পরও আমি সেই ছেলেবেলা থেকে শুধু সাধারণ এক বাবা হতে চেয়েছিলাম। এর কারণও আছে। খুব অল্প বয়সেই নিজের বাবাকে দেখে বুঝেছিলাম, বাবা হওয়া মানেই বিরাট স্বাধীনতা। একে তো বাড়ির সবাইকে ধমকেধামকে দৌড়ের ওপর রাখা যায়, তার ওপর খেয়ালখুশিমতো বাড়ি থেকে বের হওয়া থেকে শুরু করে ইচ্ছামতো বাড়িও ফেরা যায়। কারও কিচ্ছু বলার নেই।

তাই ছেলেবেলায় কেউ যখন জানতে চাইত, ‘বলো তো হীরক, বড় হয়ে তুমি কী হবে?’ আমি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-বিজ্ঞানী প্রভৃতি ছকবাঁধা জবাবের ধার দিয়েও যেতাম না। সপাট বলতাম, ‘বড় হয়ে আমি বাবা হব।’

আমার উত্তরে কেউ হাসত, কেউ ধমক দিত। কিন্তু আমি লক্ষ্যচ্যুত হইনি। বাবা হওয়ার দুর্মর বাসনা নিয়েই আমি বেড়ে উঠেছি। তার পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ ছিল ক্লাস নাইনে। এইটের সোমাকে যেদিন প্রথম (এবং শেষ) এবং দীর্ঘ প্রেমপত্রটি লিখলাম সেদিনই, সেই চিঠির শেষ লাইনে লিখেছিলাম, ‘সত্যি বলছি সোমা, আমি আর অন্য কিছু নয়, শুধুই বাবা হতে চাই!’

সোমা আমার চিঠিটা পৌঁছে দিয়েছিল তার বড় বোনের হাতে। বড় বোন মারফত চিঠিটা যেই না সেজ ভাইয়ের হাতে পৌঁছাল, অমনি আমার পিঠে ফুটে উঠল লাল-নীল-বেগুনি দাগ। পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে কলেজজীবনে রুনাকে এই কথা জানালাম একটু অন্যভাবে। আশ্রয় নিলাম কবিতার। লিখলাম, ‘রুনাঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো না কো তুমি, ও তো বড় হাবা/ আমাকে সুযোগ দাও, আমি হবো ভালো এক বাবা!’

রুনার এক বড় ভাই আছে, সেই ভাই যে এসআই তা আমার জানা ছিল না। যখন জানলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। একটা পুরা রাত মা-মশাদের সঙ্গে কাটানোর পর সকালে যখন আমার বাবা আমাকে নিয়ে আসছেন, তখন ভেতরের বাবা হওয়ার আশাটা একেবারেই ম্রিয়মাণ।

কিন্তু বাবাই আবার আমার বাবা হওয়ার খেয়ালটা চাগিয়ে দিলেন। এক অবসরে তিনি আমার বিয়ে দিয়ে দিলেন। বললেন, ‘নে বাবা, এবার বাবা হবি না কাকা হবি তোর ব্যাপার!’

বাবা ছেড়ে দিলে কী হবে, আত্মীয়স্বজন তো ছাড়ে না। দেখা হলেই বলে, ‘কী, কদ্দুর? বাবা কবে হবি?’
আরে, কী মুশকিল! আমি তো ছারপোকা নই যে কিছুক্ষণের মধ্যেই বংশবিস্তার করে ফেলব! সবকিছুর একটা সময় আছে, একটা ক্ষণ আছে। আত্মীয়রা তাকিয়ে থাকে কৌতূহলে। আমি ইনিয়ে-বিনিয়ে বলি, ‘এই তো!’
ওরা বলে, ‘আরে না না, দেরি করিস না একদম। বাবা হওয়া তো সহজ কিছু না। অনেক ঝক্কি। সন্তানকে বড় করতে হবে, তার লালনপালনের দিকে লক্ষ রাখতে হবে, ভালো স্কুলে পড়াতে হবে, সব পরীক্ষায় যেন গোল্ডেন পায়, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে!’
: গোল্ডেন এ প্লাস?
: হ্যাঁ, গোল্ডেন এ প্লাস না পেলে সন্তানকে পড়িয়ে আর লাভ কী? এখন তো সবাই গোল্ডেন এ প্লাস পায়, আর তোর ছেলে পাবে না?
: ছেলে? মেয়েও তো হতে পারে।
: হতে পারে, অসুবিধা কী! ছেলে হোক মেয়ে হোক গোল্ডেন এ প্লাস কিন্তু লাগবেই লাগবে!
: আচ্ছা।
: শুধু আচ্ছা না, ভালোমতো রেডি হ। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতে হবে।
: ইংলিশ মিডিয়ামে?
: না তো কী, বাংলা মিডিয়ামে পড়াবি ছেলেকে?
: মেয়েও তো হতে পারে।
: হোক না, আপত্তি কিসের? কিন্তু ছেলে হোক মেয়ে হোক ইংলিশ মিডিয়াম কিন্তু লাগবেই লাগবে!
: আচ্ছা আচ্ছা।
: আচ্ছা আচ্ছা কী? তোর ইংরেজি খুবই পুওর। এখন থেকেই ইংরেজি পড়া শুরু কর, না হলে তোর বাচ্চার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলতে পারবি না। বাচ্চা তোকে মূর্খ বলবে। সন্তান তোকে মূর্খ বললে শুনতে ভালো লাগবে?
: না।
আমি পরের দিনই ২৭দিনেইংরেজিশিক্ষাবইটা কিনে নিয়ে এলাম। মনে মনে বললাম, ‘বাবা হওয়া দেখছি সহজ বিষয় না!’
আর ওদিকে ২৭ দিনে ইংরেজি শেখার আগেই সুখবরটা চলে এল। ডাক্তার আমার দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললেন, ‘আপনি তো বাবা হতে চলেছেন!’
ডাক্তারের ফিসফিসানি দেখে আমি ভড়কে গেলাম। আমি বাবা হতে চলেছি নাকি আমার ফাঁসি হতে চলেছে? আমি বললাম, ‘জি, এটা তো খুশির খবর।’
ডাক্তার ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘বাবা হতে যাচ্ছেন, এটার মানে জানেন তো? এখন থেকে অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করতে হবে আপনাকে। এটা ফাঁসির চেয়ে কম কী?’
: আচ্ছা।
: আর সব সময় স্ত্রীর টেক কেয়ার করবেন।
: জি, নিশ্চয়ই করব।
: তার খাওয়ার প্রতি নজর রাখবেন!
: জি জি, রাখব।
: আর তার সঙ্গে একদম ঝগড়া করবেন না, বুঝতে পেরেছেন?

সবই ঠিক ছিল, কিন্তু বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া না করে থাকাটা হয়ে পড়ল খুব মুশকিলের। সারা সপ্তাহ অফিস করে সপ্তাহান্তে বউয়ের সঙ্গে একটু ঝগড়াই তো ছিল আমার একমাত্র বিনোদন। এই বিনোদনে ব্যাপক টান পড়ল। বউ আর আমার কথোপকথন হতে থাকল এই রকম-
বউ: তুমি একটা দায়িত্ব–কর্তব্যহীন উজবুক!
আমি: ঠিকই তো। আমারও নিজেকে এমনই মনে হয়।
বউ: তোমার চেয়ে গাধারাও জ্ঞানী।
আমি: আলবত। আমার তুলনায় গাধা হলো জ্ঞানতাপস।
কিছুদিনের মধ্যে বউও প্রতিবাদহীন গোবেচারা আমাকে আর মেনে নিতে পারল না। কেমন ভেজিটেবল মার্কা হয়ে গেল আমাদের কথাবার্তা।
: খেয়েছ?
: হুম।
: ওষুধ খেয়েছ?
: হুম।
: আচ্ছা, ঘুমিয়ে পড়ো।
: আচ্ছা।
এই নিরুত্তেজনার জীবনে সাময়িক উত্তেজনা হিসেবে এল অনাগত সন্তানের নামকরণ।সোনামণিদের১০১টিসুন্দরনাম বইটা নিয়ে দেখা করতে এল কয়েকজন বন্ধুবান্ধব। বউকে দেখলাম সে অনলাইনে নাম খুঁজে চলেছে। আমি বললাম, ছেলে হলে তীব্র, মেয়ে হলে তুলতুল। বউ সপাটে ‘না’ করে দিল। এই নিয়ে অনেক দিন পর একটু ঝগড়াও হলো। মনে একটু প্রশান্তি নিয়ে সে রাতে ঘুমাতে গেলাম।
নির্দিষ্ট দিনে আমি বাবা হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকলাম ওটির সামনে। নাটক-সিনেমায় যেমন দেখেছি তেমন করে পায়চারি করতে লাগলাম। হাত কামড়ানো, পা কামড়ানো অবস্থা। তখন এক বন্ধু এসে বলল, ‘ভয় পাস না, নবজাতকদের স্মৃতি থাকে না। তোকে দেখে নিতান্তই যে উদ্বাস্তুর মতো লাগছে, তা তোর সন্তান কোনোভাবেই মনে রাখতে পারবে না!’
তারপরও হাত দিয়ে মাথার চুলটা যেই ঠিক করতে যাব অমনি দরজা খুলে গেল। নার্স আমার কোলে সদ্যোজাত মেয়েটিকে দিতেই আমি মনে মনে বলতে গেলাম, ‘আমি পাইলাম। আমি ইহাকে পাইলাম।’ কিন্তু তার অাগেই মেয়ে কাঁদতে শুরু করল। আত্মীয়স্বজন ছুটে এল। ‘সর সর, ছাড় ছাড়! কেমন বাবা হয়েছিস? মেয়েটাকে কোলেও নিতে পারছিস না?’
আমি দেখলাম আমার মেয়ে অন্যদের কোলে দিব্যি খুশ হালে আছে। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, বরং শুরু। এরপর যখনই মেয়েকে কোলে নিতে চাই, মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে চোখমুখ কুঁচকে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। আত্মীয়স্বজনের ধমকের মুখে পড়ি। তারা বলে, ‘কেমন বাবা তুই? মেয়েটাকে কাঁদাচ্ছিস কেন? তুই তো দেখছি এখনো বাবাই হতে পারলি না!’
সত্যি, মেয়ে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনো বোধ হয় বাবা হতে পারিনি। কিন্তু আমিও লেগে আছি, হাল ছাড়িনি। বাবার কসম, বাবা আমি হবই!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন