রবিবার, ১০ আগস্ট, ২০১৪

দাস

একটা অর্ধেক পাহাড়ের কাছে গিয়ে মন ঘুরে আসে।

মনের বড় দীনকাল চলছে। মন খুঁজেও আর পুরো পাহাড়, ওইসব হিমালয় টিমালয় পায় না। যখন পায় না তখন টিলাকে পাহাড়, ডোবাকে সমুদ্র মনে করে। একটা ঝোপের ভেতর ঢুকে মনে করে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করেছে। অথচ, এইদিন, এই মন, এক ডুবে সত্যিকারের সমুদ্র ডিঙাতে পারতো।

মানুষ একবার সাঁতার শিখলে নাকি তা আর কখনো ভোলে না। কিন্তু সক্ষমতা তো হারায়। হয়তো নিজের শরীরের ভার এতো বেশি হয়ে গেল যে আর তা বহন করা গেল না।

ভার খুব বেশি হয়ে গেছে বলেই মনে হচ্ছে। দুর্ভার। অথচ দুর্বার বলেও তো একটা শব্দ ছিল। দুর্বার আর হওয়া গেল না বলেই মনে হচ্ছে। হায় ভার।

আজ যেমন লেগুনা করে আসছিলাম অফিসে। হ্যাঁ প্রতিদিনের মতোই। প্রথম যখন লেগুনা দেখি শহরে, অথবা শহর যখন প্রথম আসে আমার কাছে, আমার চোখে, ওই লেগুনা দেখে আঁতকে উঠেছিলাম... আরে এ কী জীব? কী এই বাহন...? এরমধ্যে মানুষ কীভাবে ঢোকে!
ভেবেছিলাম, আমি কোনোদিনও ওই লেগুনা নামের বাহনটিতে আর উঠবো না।
ইঠিও নি অনেক দিন।
কিন্তু এখন আমি লেগুনার নিয়মিত যাত্রী। আসতে যেতে বারবার লেগুনার কবর আমাকে ধন্য করে।
আমি ভাবি এভাবেই মানুষ মানিয়ে নেয়। মানিয়ে নিতে শেখে। তবে মানতে মানতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কী হয়? বিদ্রোহ? হাস্যকর। যে মানতে শেখে, যে পোষ মানে তার আবার বিদ্রোহ কী?

দেখলাম লেগুনার দিকে ছুটে আসছে জীবনানন্দ দাশ। নাকি এই দাশ আসলে দাস হবে?
আমাদের এখানে সবাই তো দাস। ছোট দাস বড় দাস, সবচেয়ে বেশি মাঝারি দাস। তো জীবনানন্দ দাস ছুটতে ছুটতে আমাদের লেগুনাকে ধরার চেষ্টা করতে থাকলো। আর আমাদের লেগুনাটা একবার থামে আবার চলে আবার থামে আবার চলে...
জীবননান্দ দাস উঠতে চায় উঠতে পারে না। কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে এই দাস আমার কাছে সাহায্য চায়। মুখে না চোখে। চোখের ভেতর সাহায্যের জন্য আবেদন। আমি এই আবেদন উপেক্ষা করি। বনলতা সেন লেখার সময় তো এই লোক কোনো সাহায্য চায় নি। এমনকি ট্রামের তলায় পড়ার সময়ও না। তবে এখন কেন?

লেগুনাটা থামলো একটু। আর দেখলাম আমদের বোকাসোকা চেহারার জীবনানন্দ দাস লাফ দিয়ে, বলা যায় ম্যাট্রিক্স স্টাইলে, লেগুনার ভেতর ঢুকলো। আমি হুমায়ূন আহমেদ স্টাইলে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। হুমায়ূন আহমেদের স্টাইলটা হলো যেখানে তেমন কিছু বলার নেই চরিত্রের অথচ কিছু একটা না বলালে পরের অংশ যাওয়াটা অনিশ্চিত তখন চরিত্রটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবে... তখন মনে হতে পারে আহারে...

আমি আহারে ভাবলাম তবে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম একটা। ছোট্ট করে। ছোট্ট শ্বাসটা আমার বুকের মধ্যে তৈরি হয়ে ওখানেই মরে গেল। তখন আমার পাশে পাছা রাখতে রাখতে জীবনানন্দ দাস বলল, মাইরা দিলেন?

আমি একটু অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকাই। খেয়াল করেন তাকে তাঁর বলছি। মানে সম্মান দিতে চাচ্ছি। এই সম্মান কিন্তু সে আমার কাছে তেমনভাবে অর্জন করে নি। সে অর্জন করেছিল আমার পূর্বজদের কাছে। মানে সবাই বলছিল আহা জীবনানন্দ দাশ তো জবর ব্যাপার... কবিদের কবি... নির্জনের কবি... এসব বলে বলে আমারও মনে হয়েছিল যে তাকে তাঁর বলাই উচিত হবে। নাহলে কেমনে কী! এত বড় কবি। অবশ্য তাঁর সঙ্গী সাথিরা তাঁকে বড় কবি মানে নি। তাঁকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করেছিল। ওই হাসি ঠাট্টা টিকে নি কারণ আমাদের মনে জীবনানন্দ নিয়ে একটা রোমান্টিকতা আছে। আত্মহত্যার মতো রোমান্টিকতা আমাদের গলিয়ে রেখেছে। তাঁর আত্মহত্যার কথা ভেবেছি আর তাঁর উটের গ্রীবার কাছে মাথা নিচু করে ঘুমিয়ে গিয়েছি। তারপর ধরেন ওই যে অর্থ নয় কীর্তি নয়... তখন মনে হয় যাহশালা সে তো আমাদের ভেতরের কথাই বলছে যেন কীভাবে কীভাবে... আর আমাদের যে এমনই হয় সেটাও তো আমরা জানতাম না। আমাদের ওই অনির্বচনীয় আবেগকে প্রথম জীবনানন্দ দাশই যেন ভাষা দিলো... আমরা খুব আবেগাহত হলাম। ভাবলাম এই তো বিপন্ন বিস্ময়। আমরা খুবই বিস্মিত হলাম। হায় হায়, হালায় কয় কী...!

'আপনে তো আমাকে গালাগালি করতাছেন মনে লয়...!'

আমি জীবনানন্দ দাসের দিকে তাকালাম। আরে এর মুখে তো লোকালেরও লোকাল ভাষা। আমি কী বলবো না বুঝে একটা হাঁচি দিলাম। আসলে হাঁচি তখন দিই নি, এখন লেখায় দিলাম। মনে হলো হাঁচি দিলে এখানে একটা দৃশ্যের মতো কিছু তৈরি করা যায় কিনা। তো দিলাম একটা বড় হাঁচি। আর জীবনানন্দ প্রায় উড়ে যায় এমন দশা। তাড়াতাড়ি ডান হাত দিয়ে লেগুনার রড ধরে নিলো সে। তার চেক শার্ট কুচকে গেল। তবে চেক শার্টই কিনা এ নিয়ে আমার এখন সংশয় আছে। কারণ এখন আমার ঠিক মনে পড়ছে না তার পরনে কী ছিল। লুঙ্গিও থাকতে পারে।

না না, লুঙ্গি ছিল না। লুঙ্গি থাকলে এভাবে দৌড়ে দৌড়ে লেগুনায় উঠতে পারতো না। তো আমি জীবনানন্দ দাসকে বললাম, আপনি কবিদের কবি... আপনি এ ভাষায় কথা বলছেন কেন?

জীবনানন্দ দাস মুচকি মুচকি হাসে আর কিছু বলে না। আমার তখন রাগ হয় কিনা ভাবি। মানে জীবনানন্দ না হয়ে অন্য কেউ হলে তো খুবই রাগ হতো, কিন্তু যে লোক তাকে মাফ করে দেওয়াই উচিত হয়তো। মাফ করলাম না। আরেকটা হাঁচি দিলাম। তবে এ হাঁচিটা আগের হাঁচির মতো ফেক না। মানে সত্যি তখন হাঁচিটা দিয়েছি। জীবনানন্দ আবার হাসে। বলে, শোনেন ভাষা তো আপনেরা বদলায়া দিতেছেন... কবিরা তো আপডেট থাকবার চায়... তাই এখন এইসব ভাষা শিখতেছি... ভাবতেছি বনলতা সেন আবার লিখবো... আপনাদের ভাষায়...

আমি বললাম লেখাই উচিত। রবীন্দ্রনাথের ম্যালা সাহাবি আছে... তারা তো চায় রবীন্দ্রনাথ যেমন আছে তেমনই থাকুক। তাতে রবীন্দ্রনাথ মরে গেলেও কিছু যায় আসে না। আপনার কপাল আপনার তেমন সাহাবি টাহাবি নেই। কিন্তু তাও আপনি যদি নতুন করে বনলতা লেখেন এমন হইচই হবে... সবাই আপনাকে ফাঁসিও দিয়ে দিতে পারে...

আর দেখি কি যে জীবনানন্দ দাসের চোখে ভয়। আবার সেই চোখের খেলা। বড় বড় ডাগড় ডাগড় চোখে তাড়া খাওয়া ভয়। মানে কি, যে লোক ট্রামের সামনে দাঁড়াতে ভয় পায় না তার আবার ফাঁসিতে কি ভয়?

আমি বললাম, ভাই আপনার কি ফাঁসিতে ভয় লাগছে?

জীবনানন্দ দাস বলল, নাহ। ফাঁসিতে ভয় নাই খালি রবীন্দ্রনাথে ভয়...

আমি বললাম, এই জন্যই কি নজরুলকে ধরছিলেন?

জীবনানন্দ বলল, ছাইড়াও তো দিছি ভাই... এত কিছু মনে রাখেন ক্যান? এখন বনলতারে নিয়া ভাবতেছে... আপনাদের বাংলায় আবার তারে লিখতে হবে... এই একটা ঝামেলা! বড়ই চিন্তিত আছি...!

বললাম, আপনি তো দেখি হুমায়ূন আহমেদ স্টাইলে বাংলা বলছেন?

লেগুনাটা ঝাঁকি খেয়ে উঠল। আর জীবননান্দ দাস বলল, ভাষা যা খুশি বলেন... বক্তব্য কী সেইটাই আসল কথা... লাখ লাখ পুতুপুতু ভাষা দিয়া কোনো বক্তব্য না-কওয়ার মধ্যে কোনো গৌরব নাই...!

আমি বললাম, ভাইরে আপনি তো আমার মনের কথা বললেন...!

জীবননানন্দ দাস তখন ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকল। একটা হুমায়ূনি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আসলে ফেলল কিনা বলা মুস্কিল। মানে সন্দেহটা থেকেই গেল। তবে একটু ঝুঁকে এল আমার দিকে, তারপর বলল, শোনেন আমি কিছুই কই নাই। যা কওয়ার আমার মুখ ব্যবহার কইরা আপনে কওয়াইতেছেন...! আপনে একটা বানচোত টাইপের লেখক বইলাই এমন কাজটা করতেছেন... আপনে এত্তগুলা হারামি আছেন...!

আমার খুবই রাগ হলো। সে জীবনানন্দ দাশ হোক আর জীবনানন্দ দাস যে-ই হোক। রাগে আমার শরীর কাঁপতে শুরু করল। ফলে তাকে ধাক্কা দিলাম। খেয়াল করেন তাকে আর সম্মানসূচক চন্দ্রবিন্দু দিচ্ছি না। কারণ যাকে মেরে ফেলার জন্য ধাক্কা দিচ্ছি তাকে আর সম্মান দেখিয়ে কী হবে?

ধাক্কা দিলাম। জীবনানন্দ উল্টে গেল। পড়লো গিয়ে রোডে। লেগুনা থেকে নিচে পড়ে গেলে কারো মরার কথা না। এখন চলতি বাস-টাসই ভরসা।

জীবনানন্দ পার্ট শেষ হওয়ার পর দেখছি প্রথমে যা লিখেছি তার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ওইটুকু কেটেই আর কী করছি... আর এই লেখা কে পড়েই বা উদ্ধার করছে... ফলে যা লেখা আছে তাই থাক। এখন নতুন একটা লিখা লিখতে হবে। বনলতা সেন। জীবনানন্দ দাসের শেষ ইচ্ছা পূরণ করার প্রয়োজন আছে। জীবিত সে কিছু পায় নি, মরেই তার সব প্রাপ্তি...

মন আর টিলার খবর থাক...!

এবার মন যায় নাটোরের দিকে...!!


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন