বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

আমি স্বর্গে যেতে চেয়েছিলাম


পেইন্টিং: ম্যাক্সিম শিয়াশোঁ


যাবো উত্তরা।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। তবে এটাই একমাত্র ভয় নয়— ভয়টা আমার ব্যাগে। অফিস থেকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছে— জায়গামতো পৌঁছে দিতে হবে। প্রেসের ছোট চাকরি আমার, নিতান্তই ছাপোষা মানুষ। ফলে কাঁধে ঝোলানো কালো ব্যাগের ভেতর যখন দুই দুইটা মোটা বান্ডেল তখন তিরিশটা গ্রীষ্মদগ্ধ এই বুকে কাঁপন জাগে।

তার-ওপর দাঁড়িয়ে আছি কুখ্যাত ফার্মগেটে। কুখ্যাত, কারণ এখান থেকেই আমি আমার আড়াই হাজার টাকার মোবাইলটা হারিয়েছিলাম। বাসে উঠতে গিয়ে বুঝেছিলাম আমার পকেট থেকে কে যেন গর্ভমুক্ত করলো মোবাইলটা।
কিছুই করতে পারি নি। কিছুই করার ছিল না আসলে। তবে পুরো ঘটনাটা বিশ্বাস করে উঠতে এক সপ্তাহ সময় লেগেছিল। আর ধাক্কাটা কেটেছিল প্রায় একমাস পর।

দাঁড়িয়ে আছি ফুটপাতে। জুতা স্যান্ডেলের পসরা সাজানো আছে। মানুষজন আসছে, দেখছে সে-পসরা, কিন্তু কিনছে না। মাসের প্রথম দিক চলছে... এখনই তো কেনার কথা। একটু দূরে যৌন বটিকা বিক্রি হচ্ছে। তাদের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে এ দুনিয়ার সকলেই যৌনরোগে ভুগছে। সাথে এক ছাগলের পেটে মানুষের বাচ্চা হওয়ার রগরগে উপাখ্যান বর্ণনা চলছে। তবে তাদের ব্যবসাও মন্দা। মাছিও উড়ছে না বলে মনে হয়। আশপাশে দু’একজন ঘুরঘুর করছে— তবে খুব সম্ভবত লোকগুলো ওই ক্যানভাসারের দলেরই।

এরকম সময় ঘাড় ঘোরাতে গিয়ে দেখলাম মেয়েটাকে— কেমন যেন উসকোখুসকো। একটা মোটা বেণি চুলে। আর কোটরে ঢোকা চোখ। খসখসে চামড়া। আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিতে একধরনের ঘোর।
আমি আমার ব্যাগটা একটু চেপে ধরলাম। পিছিয়ে এলাম একধাপ। মেয়েটার হাতেও একটা ব্যাগ। আমার পিছিয়ে যাওয়া ধাপের সাথে সঙ্গতি রেখেই যেন সে এগিয়ে এলো একধাপ।

কী করবো? ফুটপাত থেকে নেমে যাবো নাকি? আরেকধাপ এগিয়ে এলো মেয়েটি। আমি পিছিয়ে গেলাম আরো একধাপ। পোশাক-আশাকেই বোঝা যাচ্ছে বস্তি-টস্তিতে থাকে। শুকনো ঠোঁট। মুখের চামড়ায় ভাঁজ। অথচ তরুণী। মনে মনে ভেবেই বসলাম— পতিতা নাকি?
হতেই পারে। এদের নানান রকম ধান্ধা থাকে। দিনে এক, রাতে আরেক। আমি ব্যাগটা চেপে ধরে কোনোমতে দাঁড়িয়ে থাকলাম। মেয়েটা এগিয়ে এসে খসখসে গলায় বললো, ভাইজান এয়ারপোর্টের গাড়ি কুনটা?

ব্যাস, বুঝে গেলাম। টার্গেটে পড়ে গেছি। কিন্তু আমার ব্যাগে যে পঁচিশ হাজার টাকার দু’দুটো বান্ডেল সে খবর ওরা কী করে জানলো? এই টাকা অফিসের জামিল স্যারকে পৌঁছে দিতে হবে। জামিল স্যারের স্ত্রীর ডেলিভারি হয়েছে— বাচ্চা ভালো আছে, কিন্তু স্ত্রী আশঙ্কামুক্ত নন। উত্তরা হাসপাতালে ভুগছেন। জামিল স্যারের নগদ ক্যাশ দরকার। এক্ষুণি টাকাটা নিয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু নিয়ে যেতে পারবো কি? এরা কি এখন আমায় ঘিরে ধরবে? মেয়েটার এই প্রশ্নে কি কোনো সিগনাল ছিল? এখনি কি বিভিন্ন দিক থেকে তার গ্রুপের লোকজন চলে আসবে? তারপর আমার সাথে ধাক্কাধাক্কি করে ছিনিয়ে নেবে ব্যাগটা?

মেয়েটা আরেকবার কী যেন জিজ্ঞেস করলো, এগিয়েও এলো আরেকটা ধাপ। আমি আর কোনোদিকে না তাকিয়ে একছুটে চলে গেলাম আনন্দ সিনেমা হলের বারান্দায়। এ জায়গায় ভিড়বাট্টা তুলনামূলক কম। প্রায় ফাঁকা বারান্দা... শুধু, শুধু একটা মেয়ে, একটা পিলারের সাথে হেলান দিয়ে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। হাসছে মেয়েটা। আহা কী সুন্দর হাসি। আর কী কোমল! মনে হচ্ছে একতাল মাখন। আর সেই মাখনের ভেতর একটা জ্বলজ্বলে প্রতিমা। দেখে মনে হলো কবি হয়ে যাবো। ফোনটা হাতবদল করলো মেয়েটা, রিনরিন শব্দ উঠলো। চুড়ি, কাঁচের চুড়ি। কতদিন পর ঢাকায় কাঁচের চুড়ি! যেন পাখির গান। কিন্তু মেয়েটির পায়ের কাছে একটা ট্রাভেল ব্যাগ। ট্রাভেল ব্যাগ কেন? কোথায় যাচ্ছে সে? পালিয়ে যাচ্ছে নাকি! আমি একটু এগিয়েই গেলাম। এ আকর্ষণ চুম্বকের দিকে লোহার আকর্ষণের মতোই পুরনো।

কাছে যেতেই মেয়েটি কথা বলে উঠলো। অবশ্য ফোনের অপরপ্রান্তের কাউকে লক্ষ্য করে। আমার মতো ম্যাদাকলার সাথে তার কথা বলতে বয়েই গেছে! সে বললো, বললো মানে যেন গান... ওই যে একটা গান ছিল না— মুখের কথায় হয় যে গান তুমিই যদিও গাও...
আহা মেয়েটা যদি বেদনা দিতো তাহলে তাও কিন্তু মধুর হয়ে যেতো!

মেয়েটা ঠোঁটটা কেমন একরকমের গোল করে বললো, তাহলে?
তারপর থামলো। তাকালো আমার দিকে এবং স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্ব না দিয়ে তাকালো অন্যদিকে। ফোনে একটু জোর দিয়ে বললো, একা চলে আসবো?
ওদিক থেকে কী যেন বললো, দেখলাম মেয়েটার মুখ থেকে রক্ত সরে গেল। সন্ধ্যার ওই আধোন্ধকারের ভেতরেই যেন তার ঘন চুলের মতোই কালো রাত নেমে এলো চেহারায়। হায়, এমন সুন্দরও বেদনাহত হয়?

আগের তাকানোয় গুরুত্ব পাইনি, এবার গুরুত্ব দাবি করে বসলাম— একটা কাশি দিলাম।

যেন একটা শিশু ডলফিন তাকালো, এত মায়া চোখে। কিন্তু কিছু বললো না। নীরবতা যে-ময়ই হোক না কেন আমি তা চাই না। বললাম, ব্যাগটা সাবধানে রাখুন। ধরে রাখুন। এদিকটায় ম্যালা ঝামেলা আছে।

কথা বলতে বলতে একটু আগে যেদিক থেকে এসেছি সেদিকে তাকালাম। উসকোখুসকো ওই মেয়েটাকে দেখতে পেলাম না। হয়তো কোথাও লুকিয়ে আমাকেই ফলো করছে। আর আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে এই সুন্দরও যেন খুঁজছে সেই অসুন্দর, এই মোহ যেন খুঁজছে সেই আশঙ্কা।

বললাম, ফার্মগেট গিজগিজ করছে ছিনতাইকারী আর চোরে... তাই...
কিন্তু মেয়েটার চোখ শীতল। শীতলই তো, নাকি?

একটু অভিমান হলো, বা হতে পারে এরকম একটা ভাব নিলাম। না, যথেষ্ট হলো, আর না! পা বাড়াতে যাবো, একটা সিএনজি দেখে উঠে যাবো, বাসের অপেক্ষা করা বৃথা...

তখন মেয়েটা বললো, খুব ধীরে ধীরেই বললো, টঙ্গী... এখান থেকে টঙ্গি যেতে কতক্ষণ লাগবে?

আমার মনে হলো, কেউ যেন কানের ভেতর দিয়ে আমার হৃদয় তার পাঁচটা কোমল তুলতুলে আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দিলো।

বললাম, কিভাবে যাবেন তার ওপর নির্ভর করছে... আর রাস্তার জ্যামের ওপর...

বললো, আপনি কোথায় যাবেন? আমাকে একটু বাসটাস দেখিয়ে দেবেন? এখানে... আমাকে নিতে... যে আসার কথা সে আসে নি! একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে...

মনে মনে ভাবি কার আসার কথা ছিল?
ভাই?
বন্ধু?
প্রেমিক?
স্বামী?

নাহ, স্বামি ভাবতে ইচ্ছা করলো না— প্রেমিক তবে? প্রেমিকের বদলে আমি এলাম, আমিও কি প্রেমিক নই?

ভেতরে লালসার জিভের লকলকে সাড়া পাই। সড়সড় আওয়াজ হয়। তাকে ভালোবাসার চোয়াল দিয়ে আটকে রাখি। কণ্ঠ যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলি, তাড়াতাড়ি যেতে চাইলে অবশ্য সিএনজিতে যাওয়াই ভালো!

একটা রাত। সিএনজি। যদি দুজনে পাশাপাশি বসি, টঙ্গী হবে স্বর্গযাত্রা। আমি শ্বাসরোধ করে অপেক্ষা করি। কে না চায় একটা স্বর্গের দিকে যাত্রা করতে?

মেয়েটা বললো, আপনি কোনদিকে যাবেন?
আমি বললাম, আমি...? আমি তো... মানে ওই যে... ওই দিকেই... টঙ্গীর কাছাকাছি...

মেয়েটা যেন একটু স্বস্তি পায়। বলে, কিছু মনে করবেন না... আপনি যদি ওইদিকেই যান... তাহলে কি আমার সাথে একটু যাবেন... মানে আপনি আপনার জায়গায় নেমে গেলেন...

একটা সিএনজি। রাত। ছুটে যাচ্ছি। খুচরো চুল। আমলার ঘ্রাণ।
আবার একটা দৃশ্য ভেসে উঠলো মনের ভেতর।

আমি সংক্ষিপ্তভাবে বললাম, হ্যাঁ নিশ্চয়।

তবু গলা কাঁপলো। আর তারপরেই সিএনজি এসে দাঁড়ালো যেন আমাদের সামনে। ভাড়া চাইলো, যেমন চায় সাধারণত— প্রায় ডাবল। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে উঠে পড়লাম। একটা সিএনজি। রাত। আহা...
ফার্মগেট পেরোনোর সময় দেখলাম সেই যে বস্তি-বস্তি মেয়েটা ভিড়ঠেলা একটা বাসে উঠবার চেষ্টা করছে। আসলে যে কারো পকেট মারতেই উঠছে না তাই বা কে জানে? এরা তো এমনই হয়!

২.
বনানী পেরিয়ে যাওয়াটা একসময় মনে হচ্ছিল অসম্ভব। এত জ্যাম।
আমার কিন্তু বসে থাকতে খারাপ লাগছিল না। আমলার গন্ধ না হলেও মেয়েটা একটা সুন্দর পারফিউম ব্যবহার করেছে। বাতাসের ধাক্কায় মাঝে সাঝে সেটা নাকের ভেতর দিয়ে মাথায় উঠে যাচ্ছে। বুক ভরিয়ে দিচ্ছে। এরমধ্যেই কয়েকবার ভেবেছি নামটা জেনে নেবো... কিন্তু কথায় কথায় তা হয়েই উঠছে না। তবে নামটা জানা খুব জরুরি... কারণ নামটা জানা হলেই ফোন নাম্বারে যেতে পারবো...

একটা সিএনজি। রাত। আর একটা রূপকথার রাজকন্যা। বনানী পেরিয়ে গেলাম। ছুটে চলেছি। মনে হচ্ছে আর থামবার কোনো প্রয়োজন নেই।
উত্তম-সুচিত্রা কি আর এমনি এমনি গেয়েছিল... এই পথ যদি শেষ না হয়...
আহারে, সত্যি সত্যি যদি এই পথ শেষ না হতো...! স্বর্গের দিকের যাত্রা কেন শেষ হবে?

৩.
মেয়েটি সম্পর্কে যতই জানতে চাচ্ছি, ততই যেন কিছু জানতে পারছি না। এয়ারপোর্ট রেলস্টেশনের খুব কাছাকাছি চলে আসছি। আমি শুধু মুগ্ধচোখে মেয়েটাকে দেখছি। একটু আগেই সে ব্যাগ থেকে লিপিস্টিক বের করে ঠোঁটে ঘঁষেছিল। লাল আগুন ঠোঁটে আগে থেকেই ছিল... তার গনগনে ভাব আরো বাড়লো।

এরপরেই আরেকটা কী এক কৌটা বের করলো মেয়েটি। এগিয়ে এলো আমার দিকে। আমার যে হাল সেই একই হাল মেয়েটারও নাকি? কখন থেকে আমার মেয়েটাকে একটা চুমু দিতে ইচ্ছা করছে... মেয়েটারও কি তাই? এগিয়ে এলো আরো।
বাইরে বাতাস। ছুটে চলার তীব্রতা। ভেতরে আমার সাথে মেয়ে। যেন নাকে নাক। কী যেন বললো মেয়েটা। আমাকে? নাকি ড্রাইভারকে?

আমার ঠোঁটটা একটু ফাঁক হয়ে গেল। একটু নতুন স্বাদের আশায় যেন বুকটাও অমন করেই ফাঁক হয়ে রইলো। মেয়েটার শ্বাস এসে পড়ছে আমার গালের ওপর। আর তখনই মেয়েটা সেই কৌটা থেকে কী নিয়ে আমার চোখে ঘঁষে দিলো।

হঠাৎ-ই, লহমায়, যেন অন্ধ হয়ে গেলাম আমি।

চিৎকার করে উঠলাম। তাতে তেমন লাভ হলো না। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক করলো সিএনজি। আর তারপর ঝটকায় ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো আমাকে রাস্তায়। তার আগে অবশ্য আমার কাঁধ থেকে ব্যাগটা টেনে নিয়েছে ওই সুন্দরী। আমাকে ধাক্কা দেয়ার আগে মেয়েটার ঠোঁটে কী অদ্ভুত হাসিই না লেগে ছিল!

বলতে বাধ্য হচ্ছি হাসিটা তখনও খুব সুন্দর ছিল।

রাস্তায় পড়েই অসহনীয় ধাক্কাটা লাগলো আমার কাঁধে। মনে হলো কেউ আগুন দিয়ে ঘঁষে দিলো কাঁধের জায়গাটা। তারপরেই অনেকখানি গড়িয়ে গেলাম। আর গিয়ে থামলাম আরেকটা ধাক্কায়। এবারের ধাক্কাটা লাগলো মাথায়। আইল্যান্ডের সাথে। দেখলাম বা শুনলাম সিএনজিটা ছুটে গেল... মেয়েটা কি ওই খাঁচার ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে দেখছিল তখন?

ধা করে একটা গাড়ি পাশ কাটিয়ে গেল আমাকে। আর তখন আমার খুব ঘুমাতে ইচ্ছা করলো।

৪.
নানা মানুষের গুঞ্জনে চোখ মেলে তাকালাম। এবং তাকাতে গিয়ে বুঝলাম আসলে তাকাতে পারছি না। একটা খসখসে হাত আমার চোখ থেকে মলমগুলো সরানোর চেষ্টা করছে। আমাকে নড়তে দেখে একটা রুক্ষ কণ্ঠস্বর বললো, আপনে এইহানে আইলেন ক্যামনে? কী হইছে আপনের?

কণ্ঠস্বরটা কেমন চেনা চেনা লাগলো যেন। চোখটা আবার মেলতে গেলাম, পারলাম না।

ওই খসখসে হাতদুটো ক্রমাগত আমার চোখ পরিস্কার করে চলেছে। আর উদগ্রীবতার সাথে বলছে, শোনেন, আপনে কই যাইবেন কন... আমারে কন... আমি নিয়া যাইতেছি...

আমার মনে পড়লো— আমি স্বর্গে যেতে চেয়েছিলাম।


...........................................................................

প্রকাশ: http://www.banglanews24.com/beta/fullnews/bn/322447.html

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন