লখিন্দর আর আমান খানকে মুখোমুখি দেখে রঞ্জনা এগিয়ে আসছিল।
রঞ্জনা,
যাকে
আমরা সিনেমায় আর সিনেমার বাইরে
একই রকম দেখি। ঝকমকে,
দ্যুতিময়...
একক
হিরোইন। বাবুভাইয়ের এই মধ্যরাতের
পার্টিতে আরো অনেক হিরোইনই
তো ছিল...
চারদিকে
তারা আলো করেই আছে...
যেন
একেকটা রূপেজ্বলা মশাল। যেন
প্রত্যেকেই একেকটা সৌন্দর্যের
বাতিঘর। অথচ রঞ্জনার এমনই
জোরালো,
এমনকি
ঘাতকও বলা যায়--
উপস্থিতি
যে এইসব বাতিঘর কিংবা মশাল
এক ফুঁয়ে যেন নিভে যায়। চাঁদের
সামনে জোনাকিদের আর কতটা চলে?
কতটাই
বা জ্বলে?
রঞ্জনা,
সাক্ষাৎ
সুন্দর ছিল তখন,
এবং
এখনো। এখন,
এই
যে তাকে দেখি একটা চটের বস্তার
ভেতর আড়ষ্ট স্থির,
হাত
পেছনে বাঁধা,
একটা
আধাভরা পানির ট্যাঙ্কের ভেতর--
ওই
অন্ধকারের ভেতর আমাদের দেখার
চোখ থাকলে দেখি--
রঞ্জনা
এখনো সুন্দর। রঞ্জনা এখনো
সেই নায়িকা,
সেই
হিরোইন। যার কটাক্ষে লাখ লাখ
তরুণের বুকে হিন্দোল ওঠে।
যার ঠোঁট গোল করে ন্যাকামি
করে কথা বলায় শত শত তরুণ টগবগ
করে ফোটে। রঞ্জনা ভেবে তারা
তাদের পাশবালিশ কোলবালিশ
কাঁথা মাথার বালিশ জড়িয়ে
ধরে...
রাতে
রঞ্জনাকে ছোঁয়ার আশায় এবং
স্পর্ধায় তারা সাদা ঘোড়ার
স্রোতে ভেসে যায়।
লখিন্দর
আর আমান খানে মাঝে রঞ্জনা এসে
দাঁড়ায়। এই প্রথম আমরা এরকম
দৃশ্যে মুখোমুখি হয়। এবং
মুখোমুখি হয়ে বুঝতে পারি যেন
এটাই ছিল এই গল্পের শুরু--
শুরু
ভাবতে গিয়ে আমাদের শরীরটা
কেঁপে ওঠে। ভাবতে বাধ্য হই
এমন একটা শুরুই কি আসলে টেনে
নিয়ে এসেছিল অমোঘ শেষ?
শুরুতেই
শেষ?
একটা
বৃত্তের মতো?
লখিন্দর
তখন কি এমন ভেবেছিল?
বোধহয়
না। লখিন্দর তখন রঞ্জনাকে
দেখছিল। এর আগে চর্মচোখে সে
কখনো রঞ্জনাকে দেখে নি। এখন
দেখে তার মনে হয়েছিল সৌন্দর্য
একটা বিরাট রহস্য হয়ে তার
সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সৌন্দর্যের
কি কোনো ঘ্রাণ আছে?
বিজাতীয়?
লখিন্দরের
নাকে ঘ্রাণটা যেন ঘুরে ঘুরে
যায়। আর লখিন্দরের মনে হয় এমন
ঘ্রাণ সে পেয়েছিল অনেক অনেক
আগে...
একটা
নদীর পাশে...
পারদিয়া
বাড়ির উঠানে...
একটা
পাখি যখন তার মুখে এক গ্রাস
ভাত তুলে দিয়েছিল...
লখিন্দর
ভাবে ক্ষুধা আর প্রেম আর জীবন
একটা সমান্তরাল সাধের মতো,
একটা
স্মৃতি হয়ে যেন যাত্রার বিবেকের
মতো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
আর এখন ঘড়ির কাঁটার মতো তার
বেঁচে থাকার সূচকটা স্থির
হয়ে আছে অনন্য রঞ্জনার দিকে।
রঞ্জনা
বলে,
তার
আগে আপনি বলেন আপনি কেমন আছেন?
লখিন্দরের
বুঝতে দেরী হয় এই রকম একটা
প্রশ্ন করেছে রঞ্জনা। এবং
প্রশ্নটা তাকেই করেছে। লখিন্দর
তাকিয়ে থাকে রঞ্জনার দিকে।
আমান খান বলে,
দেখেছো
রঞ্জনা...
ফিল্মে
গড়গড় করে ডায়লগ বলা হিরোও
তোমার মুখ দেখে চুপ মেরে
গেছেগা...
রঞ্জনা
হাসে। বলে,
মুখ
না...
বলো
রূপ...
রঞ্জনা
হাসে। হাসিতে ছেনালি থাকে।
কিন্তু এই ছেনালিটা এতটুকু
অশ্লীল লাগে না লখিন্দরের।
ফলে সেও হাসে। আর মজার ব্যাপার
এখানে এভাবে রঞ্জনার সাথে
হাসতে পেরে তার ভালো লাগে।
তার ভালো লাগাটা একটা আভা হয়ে
মুখের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। সেই
আভা কি খেয়াল করতে পারে আমান
খান?
আমান
খানের চোখে এই রাত্রেও একটা
সানগ্লাশ বটে...
কিন্তু
আমাদের মনে হয় সানগ্লাশের
রঙিন কাচের ভেতর দিয়েও আমান
খানের ওই আভাটুকু দেখতে অসুবিধা
হয় না। আমরা দেখি আমান খানের
মুখের মাংসপেশী ধীরে ধীরে
শক্ত হয়ে আসে। সানগ্লাশের
ভেতরের চোখ দুটি কুচকে যাচ্ছে।
আর আমাদের যদি আমান খানের
মাথার ভেতরটা দেখার অধিকার
থাকতো তবে দেখতাম সেখানে
অদ্ভুত কিছু সূত্র বেরিয়ে
পড়েছে...
ছেঁড়া
কাপড়ের মতো সূত্রগুলো নানান
আবেগে দুলছে...
আর
একটার সাথে আরেকটা দারুণভাবে
লেপটে যাচ্ছে। আর লেপটে লেপটে
ক্রমান্বয়ে বড় হচ্ছে। আমরা
দেখতে পেলে বুঝতে পারতাম,
বলা
যায় নিশ্চিত হতাম,
আর
নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতাম,
ও
আচ্ছা,
ষড়যন্ত্র
তাহলে এরকমই দেখতে...!
তেমন
হিংস্র কিছু না বাহ্যিকে...
বরং
দলা পাকানো কাপড়ের মতো...
কিন্তু
আমাদের নজর বারবার চলে যায়
রঞ্জনার দিকে। যেহেতু আমরা
প্রত্যেকেই আসলে সৌন্দর্যের
দিকেই তাকাতে চাই। সৌন্দর্য
হচ্ছে সেই চৌম্বক যা এই পৃথিবী
সৃষ্টির আগেই সৃষ্টি হয়েছিল...
এরকম
ভাবে লখিন্দর। আর আমাদের মতো
সেও তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়
রঞ্জনার দিকে।
রঞ্জনা
একটা বেয়ারাকে ডাকে। একটা
পাত্র উঠিয়ে নেয়। এগিয়ে দেয়
লখিন্দরের দিকে। বলে,
নিন।
রূপ না...
হুইস্কি
খান...!
ইতস্তত
করে লখিন্দর তা হাতে নেয়। এবং
তার ইচ্ছা করে শুকরিয়া বলতে।
কিন্তু সে ধন্যবাদ বলে। কিন্তু
ধন্যবাদে যেন সে সবটা বলতে
পারে না। তখন বলে,
অনেক
অনেক ধন্যবাদ।
আমান
খান বলে,
রঞ্জু
আমাদের ড্যাশিং হিরো তো তোমাকে
ধন্যবাদ দিতে দিতে...
তারপর
আমান খান আর কথা শেষ করে না।
ভুররর ধরনের ঠোঁট দিয়ে শব্দ
করে। তাতে হুইস্কিসহ বেশ
কিছুটা থুতু বাতাসে ডানা মেলে।
এবং কোনো বাধা না পেয়ে সেগুলো
গিয়ে ঠাঁই পায় লখিন্দরের মুখে।
লখিন্দরের চোখমুখ কুচকে আসে।
আর খিলখিল করে হেসে ওঠে রঞ্জনাও।
থুতুতে
যতটা,
তারচেয়ে
বেশি রঞ্জনার হাসিতে,
অপদস্থবোধ
করে লখিন্দর। কী করবে বুঝতে
পারে না। সে সামলে নিতে পারে
না। অথচ লখিন্দরকে আমরা যেমন
চিনি তাতে তার সামলে নেয়ার
কথাই। সে প্রথমেই তার পকেট
হাতরায়। নেই। আরো দুটো পকেট
আছে,
সেগুলোও
আতিপাতি খোঁজে সে। নেই। একটা
রুমাল কোথাও নেই।
তার
হাতে একটা গ্লাশ আছে। তাতে
অর্ধেকমতো হইস্কি রয়েছে।
লখিন্দরের স্বতস্ফূর্ত সত্ত্বা
বলছে তা ছুঁড়ে মারতে আমান
খানের দিকে। তার ওই অংশটা
চাচ্ছে আমান খানের মুখ ভরে
উঠুক হুইস্কিতে,
এমনকি
কাচকাটা রক্তেও...
লখিন্দরের
ডান হাতের গ্লাশটা ধীরে ধীরে
উঠে যায়। খুব নিষ্ঠুর হয়ে
কুচকে যায় তার চোখ। একটু টলে
যায় শরীরটা। মাথার ভেতরে ধা
ধা করে জ্বলছে যেন আগুনটা।
কিন্তু কীসের আগুন ঠিক তা
পরিস্কার নয়। লখিন্দরের কাছেও
না...
আমাদের
কাছেও না...
এটা
কি পূর্ব কোনো প্রতিযোগীতা?
নাকি
এই মুহূর্তের গ্লানির?
নাকি
ঈর্ষার?
ঈর্ষা
শব্দটা একটা পিয়ানোর শব্দ
তোলে লখিন্দরের ভেতর। ঈর্ষা।
দারুণ একটা শব্দ। তবে এই ঈর্ষা
কি সাফল্যের?
নাকি
নারীর?
লখিন্দর
রঞ্জনার দিকে একবার তাকায়।
এই কি তবে সেই নারী?
অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত
ভেসে যায় এই কি তবে সেই নারী?
এই
কি তবে সেই ঈর্ষা?
এই
প্রথম লখিন্দরকে আমরা দ্বন্দ্বকাতর
দেখি। তার হাতটা উঠে যায় ঠিকই
কিন্তু তার চোখের তারায় কেমন
বিচলন দেখি...
আর
সেই বিচলন কি রঞ্জনা দেখতে
পায়?
রঞ্জনা
এগিয়ে আসে। তার হাতে একটা
ফুলতোলা রুমাল। সেটা এগিয়ে
দেয় লখিন্দরের দিকে। রঞ্জনা
বলে,
কিছু
মনে করবেন না হিরো...
বড়
বড় পার্টিতে এরকম ছোট ছোট ঘটনা
হয়েই থাকে...
নিন,
আমরা
রুমালটা নিন...
মুছে
নিন...
একটা
ঘ্রাণ যেন ধেয়ে আসে লখিন্দরের
দিকে। কেমন একটা শান্তির মতো
সেই ঘ্রাণ। লখিন্দরের গ্লাশতোলা
হাতটা ধীরে ধীরে নেমে আসে।
মনে হয় ঢিলছোঁড়া পুকুরের
শ্যাওলাগুলো আবার যথাস্থানে
জমে যেতে থাকে। লখিন্দর খুবই
মৃদু হাসে। রুমালটা নেয়। মুখটা
মুছতে থাকে ধীরে ধীরে। তবে
আমাদের মনে হয় সে যেন তার
হৃদয়টাই মুছে নিচ্ছে আবার।
আর হৃদয় মোছার জন্য রঞ্জনার
চেয়ে ভালো রুমাল সে কোথায়
পাবে?
রুমালটা
কিন্তু লখিন্দর নিজের পকেটেই
রেখে দিয়েছিল...।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন