রবিবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৪

আবু নাসিম বা লখিন্দর কোনোটিই তার নাম ছিল না... (পাঁচ)




পাঁচ.

ঘরে ফিরতে রাত হয় লখিন্দরের।

এ এমন নতুন কিছু তো নয়। কিন্তু তবু, গাড়ি থেকে নেমে, নিজের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে, সব কিছু যেন নতুনই লাগে লখিন্দরের। এই সোডিয়াম আলো, ঘোলাটে রাস্তা, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নৈশ-কুকুর সব কিছুই যেন নতুনভাবে নতুনসাজে দাঁড়িয়েছে লখিন্দরের সামনে।
গাড়ি তার ঢুকে যাচ্ছিল গ্যারেজে, ধীর আর শান্তভাবে। তা দেখে, লখিন্দরের মনে হলো, তার জীবনটাও কি এমনই কোনো গ্যারেজের সন্ধান করেছে এতকাল? আর এই এখন সে একটা গ্যারেজে, মোহনীয়ই বলতে হয় তাকে, ঢুকে যেতে পেরেছে? বা ঢুকে হয়তো যায় নি... কিন্তু জায়গাটার সন্ধান যেন পেয়েছে... সে জানে কোথায় এখন তাকে যেতে হবে... সে জেনেছে কি?

লখিন্দর তার প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকায়। আছে। একটা ফুলতোলা রুমাল সেখানে আছে। বেড়ালের পেটের মতো নরোম আর তুলতুলে রুমাল, অথচ কেমন যেন উষ্ণ-- এই উষ্ণতা কি রঞ্জনার নাকি লখিন্দরের হৃদয়ের? হাতের মুঠোর ভেতর রুমালটা নিয়ে লখিন্দর একটু চাপ দেয়, তারপরেই ছেড়ে দেয়। ছেড়ে দেয় কি আসলে? নাকি ছাড়ার ভান করতে থাকে? লখিন্দরকে আমরা যত চিনবো যত দেখবো ততই এই প্রশ্নটা আমাদের উদ্বেল করবে যে সে আসলে আজ পর্যন্ত যা-কিছু ছেড়ে দিয়েছে তার সবই সত্যি নাকি তার অধিকাংশই আসলে এক ধরনের ছেড়ে দেয়ার ভান? এই ভান তার নিজের সাথেই কি? আমরা কিছুই নিশ্চিত হতে পারি না। নিশ্চিত হতে পারে না লখিন্দরও। ড্রাইভার গাড়ি গ্যারেজ করে নেমে পড়ে। লখিন্দর গাড়ির জায়গায় যেন নিজেকেই দেখতে পায়। যেন হেডলাইটের মতো জেগে থাকা এক পলকে নিভিয়ে এই কোমলতার ভেতর-- এটা কি ভ্রুণ তবে-- লখিন্দর নিজেকে গ্যারেজ করে। যেন হাঁটুর কাছে নিজের মাথাটা নিয়ে কুণ্ডলি পাকিয়েছে সে, যেন পেয়ে গেছে যা পাওয়ার; নতুন আর কিছুই পাবার বা পেরিয়ে যাবার তার নেই। যেন এখানেই বন্দর, যেন এখানেই তার নোঙর পড়েছে, যেন এখানেই সে থেকে যেতে চেয়েছিল। যেন, জীবনের এই অংশটার জন্যই, সে বেঁচেছিল।

কিন্তু, পরক্ষণেই, লখিন্দর টলে ওঠে। তার একটা ঝড়ের কথা মনে আসে। যা তার অভিজ্ঞানে এসেছিল ডুবে যাওয়ার ভেতর। আর ডুবতে ডুবতেও তো সে ভেবেছিল এই বুঝি তার গন্তব্য। তাহলে মানুষের গন্তব্য ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হয়? বদলে যায়? মানুষ বদলে যায় না আসলে-- আসলে তার গন্তব্য বদলে যায়?

ড্রাইভার এগিয়ে আসে। লখিন্দরকে কী যেন বলে, লখিন্দর শুনতে পায় না, বা বুঝতে পারে না, বা শুনতে সে ঠিকই পায় বুঝতে সে ঠিকই পারে, কিন্তু শুনতে বা বুঝতে সে চায় না। ড্রাইভার চলে যায় কি? লখিন্দরের মনে হয় ড্রাইভার চলে যাক। তার চোখের সামনে থেকে চলে যাক, তার জীবন থেকে চলে যাক, তার হৃদয় থেকে চলে যাক-- সে তার জীবনে কোনো ড্রাইভার রাখতে চায় না। সে চায় না কেউ তার জীবন চালিয়ে নিয়ে যাক। লখিন্দর ঠিক করে আগামীকাল সকালেই সে ড্রাইভারটাকে বিদায় জানিয়ে দেবে এবং তারপরেই, বিদায় জানাবে রঞ্জনাকে।

আমাদের ভেতর প্রশ্ন জাগে ড্রাইভারের সাথে সাথে রঞ্জনার কথাও কেন মনে আসে লখিন্দরের? সাথে এও মনে হয় লখিন্দর কি আসলে ভয় পেয়েছে? ভয়টা কি বিলীন হবার? কিন্তু সে একটা জীবন পর্যন্ত অন্য একটা জীবনে বিলীনই হতে চেয়েছিল। নাকি লখিন্দর আসলে ভয় পেয়েছে সানগ্লাশের আড়ালে থাকা সাপের মতো সেই শান্ত দুটো চোখকে! আমান খানকে কি লখিন্দর ভয় পায়?

অথচ এই আমান খানের চোখেই লখিন্দর আজ দেখল ভয়। নগ্ন ভয়। আমান খানের চোখে? আমাদের অবিশ্বাসই হয়। অথচ লখিন্দরের সাথে আমরাও কি তা প্রত্যক্ষ করি নি? আমান খানের চোখে ভয়ই বটে। আজ, বাবুভাইয়ের পার্টিতে, রঞ্জনা আর লখিন্দরের ভেতর যখন বয়ে যাচ্ছে কথার স্রোত, লখিন্দরের যখন মনে হচ্ছে সে আসলে ভেসে যাচ্ছে কোথাও... আর তার বারবার মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের সেই গানটা যে আমি ডুবতে রাজি আছি অথচ তার মনে হচ্ছে সে আসলে ভাসতেই রাজি আছে... এরকম স্মৃতি, সঙ্গীত ও দ্বন্দের ভেতর যখন লখিন্দর আর তখনই একজন এগিয়ে আসে তাদের দিকে। মৃদু হাসতে হাসতে। লখিন্দরের চোখের কোণা সেই এগিয়ে আসা ব্যক্তিকে আর তারপরেই আমান খানকে দেখে। আর আমান খানকে দেখে বিস্মিত হতে হয় লখিন্দরকে। ওই মাঝারি আকৃতির মানুষটাকে এগিয়ে আসতে দেখে আমান খান যেন গলে যায়, যেন একখণ্ড মোম মাত্রই আগুনের আঁচ পেয়েছে... গলে যাচ্ছে আমান খান, গলে গলে যেন পায়ের কাছে জমে যাচ্ছে, আর এর বিগলনের উত্তাপ নিয়ে এগিয়ে আসছে সেই মাঝারি বা বেঁটে আকৃতির মানুষটি। মানুষটির পেছনে আরো দুটি মানুষ। তাদের চোখ হিসহিসে, তাকানোর মধ্যে কেমন সাবধানী ভাব... এগুলো কি তবে গানম্যান?

গানম্যান? এই শব্দটা মাথায় আসার সাথে সাথেই পুরো দৃশ্যটা যেন বুঝে ওঠে লখিন্দর। আরো একবার আড়চোখে তাকায় সে আমান খানের দিকে। দেখে আমান খান তার চশমাটা খুলে ফেলেছে-- তার মেকআপহীন চোখের নিচ দুটো মদে মদে ফুলে ঢোলের মতো হয়ে আছে। আর চোখে অদ্ভুত ধরনের এক বিনয়, গলে পড়ার জড়িয়ে থাকার এক আকুতি... তবে সবকিছু ছাপিয়ে ওই চোখ দুটো থেকে যা ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল তা হলো ভয়। লখিন্দর মানুষের চোখকে পড়াই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের মনে করেছিল, আর সেই মুহূর্তে আমান খানের চোখ পড়তে গিয়ে তার মনে হয়েছিল এই যে মাঝারি বা প্রায় বেঁটে আকৃতির লোকটি, যাকে সে একটু আগে চিনতে পেরেছে বলে ধারণা করছে, তার ক্ষমতা তার অর্জন এতটাই ব্যাপক যে আমান খানের মতো প্রতাপও গুঁড়িয়ে যায়; বর্ষায় ভেজা মুড়ির মতো বা অক্ষম পৌরুষের মতো নেতিয়ে পড়ে; লখিন্দর যার কথা এতদিন শুনেছিল, কিন্তু দেখে নি একবারও-- মানুষ এড়িয়ে চলতে চাইলেও যার পার্টির দাওয়াত একবারের জন্যও উপেক্ষা করার কথা ভাবে নি লখিন্দর... তাদের দিকে এগিয়ে আসা সেই মাঝারি আকৃতির মানুষটার আসলে রয়েছে সম্মোহনের শক্তি। ফলে লখিন্দর লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়। আর সেই সম্মোহনের ভেতরেই লখিন্দর দেখে ছুটে যাচ্ছে আমান খান... কুজো হয়ে। যেন চুম্বকের দিকে ছুটে যাচ্ছে প্রাণহীন লৌহখণ্ড... নাকি আসলে মোমখণ্ড ছুটে যাচ্ছে আগুনের দিকে? এইবার বোধহয় গলে একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাবে। হাতটা বাড়িয়ে দেয় আমান খান, কোনোমতে। লখিন্দর দেখে এমনকি রঞ্জনাও যেন কুকড়ে গেছে। লখিন্দরের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে রঞ্জনা, অথবা শ্বাস নেয়, অথবা খুব অস্পষ্ট একটা শব্দ করে। আর শব্দের মধ্যে একটা নাম খেলে যায়, ঘুরে ঘুরে যায় যেন।

--- বাবুভাই। বাবুভাই।

নামটা যেন একটা জলের ঘুর্ণির ভেতর ঘুরতেই থাকে, পাক খায় বারবার। লখিন্দর জেনেছে এই ব্যক্তিটি বাবুভাই না হয়ে অন্য কেউ হতেই পারেন না। তারপরও, রঞ্জনার বলার পর, তার মনে হয় নামটা যেন প্রথমবারের মতো শুনলো। লখিন্দর রঞ্জনার দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে যায়। রঞ্জনার রূপচর্চিত ওই মুখটা তার মুখের খুব কাছাকাছি, গালের রঙের আভাটুকু যেন লখিন্দেরর চোখের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে, সাথে অদ্ভুত এক সুঘ্রাণ-- লখিন্দরের মনে হলো এই ঘ্রাণ রঞ্জনার কোনো অতল থেকে আসছে-- নাভি থেকে কি? হরিণের যেমন কস্তুরি-- মৃগনাভি কি রয়েছে রঞ্জনারও? এই ঘ্রাণে লখিন্দরের আবিষ্ট হয়ে থাকার কথা ছিল অন্তত আধাবেলা, অথচ লখিন্দর দেখে সেই ঘ্রাণ ছাপিয়ে তার চোখ-নাক-কানসহ সমস্ত ইন্দ্রিয় ছুটে চলে যাচ্ছে বাবুভাইয়ের দিকে। যেন বাবুভাই জীবন্ত কোনো মাদক। ধেয়ে আসছে, আর বইয়ে নিয়ে যাচ্ছে মানুষের সমস্ত আবেগ আর অনুভূতি।

বাবুভাইয়ের উদ্দেশ্যে শূন্যে ছুঁড়ে দেয়া আমান খানের হাতটা অবশেষে বাবুভাই ধরেন। হাসেন। হেসেই আমান খানের দিক থেকে মাথা ফিরিয়ে তাকান লখিন্দরের দিকে। এই তাকানোটা যেন এক দিক নির্দেশনা আমাদের জন্য-- যেন আমরা বুঝতে পারি এভাবেই দৃশ্যের সাথে সাথে দৃষ্টি, আর দৃষ্টির সাথে সাথে দৃশ্য বদলে দিতে থাকে মানুষ। আমান খানকে ধরেই রাখেন বাবুভাই, আর তার চোখ পড়ে থাকে লখিন্দরের দিকে। লখিন্দর যেন একটু ঝুঁকে যায়। নিজের অজান্তেই। ঝুঁকে বিনয়ের হাসি হাসতে যায়। আর তখনই জলদকণ্ঠ শোনা যায়। বাবুভাই কথা বলতে শুরু করেন। বলেন, কেমন আছো...

লখিন্দর প্রায় জবাব দিয়েই ফেলছিল। আর তখন, কোনো এক কারণে, সে বুঝল এই প্রশ্ন তাকে করা হয় নি। আর তখনই, তার পেছন থেকে, রঞ্জনা জবাব দিয়ে উঠল, ভালো আছি বাবুভাই... ভালো আছি...
রঞ্জনা এগিয়ে বাবুভাইয়ের আরেকটা হাত ধরে ফেলল। লখিন্দর দেখল এক হাতে আমান খান আর আরেক হাতে রঞ্জনাকে নিয়ে বাবুভাই দাঁড়িয়ে আছেন তারই সামনে-- যেন পুরো ঢাকাই ফিল্ম তার করায়ত্ত্বে, এমনই মনে হয় লখিন্দরের; আর নিজেকে অনতিদূরের নিতান্ত দর্শক ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না সে। এরকম সময়গুলোতে লখিন্দর, এর আগেই তো আসলে এরকম অনেক সময়ই পেরিয়ে এসেছে সে, গুটিয়ে যায় সাধারণত। নিজের উপস্থিতি বোঝানোর জন্য বাড়তি কিছুই করে নি সে কখনো, সাধারণত চুপচাপ চলে গেছে, বা মুখটা হাসি হাসি করে দাঁড়িয়ে থেকেছে এতদিন। কিন্তু এখন সে কি লখিন্দর নয়? এখন সে রাস্তায় বেরোলে কি হুল্লোড় ওঠে না! সাধারণ মানুষ থেকে ঘরের মানুষ সবার কি আলাদা নজর সে আশা করে না? সে কি এখনো সেই স্ট্রাগল অ্যাকটর? এখনো নবাগত? তার পেছনে কি এখন সুপার হিট নেই? তার হাতে কি নেই হিট সুপার হিট হওয়ার মতো আরো ক'খানা ছবি?

লখিন্দরের অপমানবোধ হওয়ার কথা। অথচ তার বদলে, কী আশ্চর্যজনকভাবে, তার ভেতর তৈরি হচ্ছে শ্রদ্ধা। আর নিজের ভেতর এই অনুভূতি দেখে লখিন্দর বিস্মিত হয়। নিজের আরেকটি অংশ, যা এতকাল কোথায় ছিল জানে না লখিন্দর, আবিষ্কার করে। ক'রে, সে অভিনেতা বলেই বোধহয়, আনন্দিত হয়। তার মনেহয় অভিনয় তো অন্য কিছু না বরং নিজের ভেতর নিজেকেই আবিষ্কার করা। আর নিজের এই আরেকটি অংশ আবিষ্কার করার পর তার লোভ জাগে। লোভ জাগে এমন একটা চরিত্রে অভিনয় করতে যা আসলে এক ড্রাগ স্মাগলার, চোরাচালানকারী অথচ সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত একটা ব্যক্তিকে দেখার পর অপমানের বদলে শ্রদ্ধা জাগে। তাহলে সেই চরিত্রটি কেমন হবে? সামাজিকভাবে তার অবস্থান কী হবে? সে কি আর হিরো হয়ে থাকতে পারবে, নাকি ভিলেন হয়ে যাবে?

এখন কাল ভিলেনের, ভাবে লখিন্দর। তবে তা অবশ্যই সিনেমায় নয়, বাস্তবে। অথবা ভিলেনের কালই ছিল সর্বদা। আর ভিলেনের কাল ছিল বলেই রূপালি পর্দায় চোখেমুখেঠোঁটে রঙ এঁকে লখিন্দরদের নায়ক সাজতে হয়। রঙিন পর্দাজুড়ে ভিলেনকে শায়েস্তা করতে হয়। যে কাজ বাস্তবে সম্ভব হয় না মানুষ তাই দেখতে চায় সিনেমায়-- সিনেমা এমনই এক মহার্ঘ! লখিন্দেরর ভেতর এবার শ্লেষ তৈরি হয়। তবে তা ক্ষণকালমাত্র। সামনে বাবুভাইয়ের মতো ওজনদার একজনকে রেখে আর যায় হোক শ্লেষাত্মক থাকতে নেই, এটুকু বোঝে লখিন্দর। শ্লেষের আগে তৈরি হওয়া ওই যে শ্রদ্ধাবোধ সেটা কি উড়ে গেল তবে? না। লখিন্দর বুঝতে পারে শ্রদ্ধাটা তার বেশ শক্ত ইঁটের গাঁথুনিতে উঠেছে-- অত সহজে তা টলবার নয়।

বাবুভাই, দুইহাতে বাংলার দুই মহান হিরো হিরোইনকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যাকে চিনেও চেনে না লখিন্দর, বুঝেও সবটা বোঝে না সে। আর লখিন্দরের সাথে সাথে আমাদেরও উচিত তাকে একটু চিনে নেয়া। অবশ্য বাবুভাইকে না চেনাটা কম জানাটাই আমাদের জন্য কম ঝুঁকির। কিন্তু গল্প শোনা তো সব সময় ঝুঁকিহীন থাকে না, আর থাকে না বলেই লখিন্দর আর রঞ্জনা আর আমান খানের এই গল্পের ভেতর দুজন গানম্যান নিয়ে উপস্থিত হয় বাবুভাই। উচ্চতায় প্রায় নগন্য সাড়ে চার ফিটের এই ব্যক্তির দুই হাতে চার চারে আটটি আঙটি। দামী পাথর আর সোনারূপা মিলিয়ে হাতের আঙুলগুলো ঝিলিক দেয় সব সময়। পরনে শাদা লুঙ্গি, শাদা শার্ট। এতই শাদা যে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখ ধাঁধিয়ে যেতে পারে। ছোট ছোট চুল পাকা গোঁফ চুনে পোড়া ঠোঁট কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে শীতল দুটো চোখ। আর সেই শীতলতায় বাবুভাই তাকিয়ে আছেন লখিন্দরের দিকে। লখিন্দরের মনে হয় এই চোখ দিয়ে সমুদ্রের তলদেশ থেকে গভীর কোনো খাদের ভেতর থেকে ঝিনুকমুক্তো তুলে আনা যায়। লখিন্দরের মনে হয় তার প্রতিটি হৃদস্পন্দন যেন দেখতে পাচ্ছেন বাবুভাই।

এবার বাবুভাই তার ডান হাতটা ছাড়িয়ে নেন। এই শহরের সবচেয়ে অন্ধকারের মানুষ, যিনি কখনোই ক্যামেরার ফ্ল্যাশে ধরা পড়েন নি, আর পড়লেও তার ছবি কখনোই কোথাও ছাপা হয় না... তিনি তার হাত থেকে ছাড়িয়ে নেন আমান খানকে। ছাড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে আসেন আরেকটু। ফলে পিছিয়ে যায় আমান খান-- যেন সিনেমা থেকেই। আর সেই হাতে টেনে নেন লখিন্দরকে। টেনে নেন মানে বাড়িয়ে দেন লখিন্দরের দিকে। আর লখিন্দর নিজেই সেই নাগপাশে, নাগপাশ শব্দটা ভেবেই লখিন্দরের ভেতর শিহরণ তৈরি হয়, নিজেকে বন্দি হতে দেয়। জড়িয়ে যায় যেন। আর এক ফাঁকে তাকিয়ে নেয় আমান খানের দিকে। আমান খান একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেও মনে হয় বাবুভাই আর তার মধ্যে অন্তত তিনটা সমুদ্রের দূরত্ব তৈরি হয়ে যাচ্ছে। আর এই সমুদ্র দূরত্বের এই পাড়ে লখিন্দরকে যেন আঁকড়ে ধরেন বাবুভাই। আর তখনই লখিন্দর শোনে সেই কথাটা। সেই কথা, যা শোনার জন্য ব্যাকূল থাকে এই বাংলার হিরো হিরোইন। সেই শব্দ যা শোনার পর থেকেই লখিন্দরের মনে হচ্ছে তার জীবনের গাড়িটা এবার বোধহয় গ্যারেজ পেয়েছে... বন্দর পাচ্ছে তার জাহাজ... যেন সে জীবনানন্দ দাশ... হাঁটতে হাঁটতে এসেছে নাটোর...

বাবুভাই লখিন্দরের পিঠে আরেকটু চাপ দিয়ে রঞ্জনার দিকে তাকান। অল্প হাসেন। তারপর লখিন্দরের পিঠের ওপর চাপটা কমিয়ে দেন। বলেন, লখিন্দর, তুমাকে আমার ফিল্মে নিলাম...

লখিন্দর এখন তার গ্যারেজের দিকে তার গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবুভাইয়ের ওই কথাগুলো যেন ঘুরতেই থাকে বারবার... লখিন্দর, তুমাকে আমার ফিল্মে নিলাম... তুমাকে আমার ফিল্মে নিলাম... তুমাকে আমার ফিল্মে নিলাম...

বাবুভাই ছিলেন সেই সময়ের ঢাকাই ফিল্মের সবচেয়ে বড় প্রডিওসার। লখিন্দর তখনো জানে না এই বড় প্রডিওসারের বড় সিনেমা করতে গিয়েই বড় একটা ঘটনা ঘটবে তার জীবনে। আর আমরা এখন নিশ্চিত সেই বড় ঘটনার ভেতরে ছড়িয়ে থাকবে রঞ্জনা। তবে সে ঘটনা জানতে আমাদের আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে!

(চলবে...)

ছবি: আহমেদ খান হীরক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন