শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৪

পিঁপড়াবিদ্যা: ফিরে আসছেন কি ফারুকী?













এই কদিন আগেই সবাই মিলে গেলাম দেখতে... আর কি... পিঁপড়াবিদ্যা।
পিঁপড়াবিদ্যা হলো মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর প্রথম বাংলা শিরোনামের সিনেমা-- এরকম করে ভাবা যায়- যেহেতু তার আগের সিনেমাগুলোর নাম 'ব্যাচেলর', 'মেড ইন বাংলাদেশ', থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার', 'টেলিভিশন'। এইসব নাম ছেড়ে হঠাৎ ফারুকী নাম দিলেন এই সিনেমাটার--- 'পিঁপড়াবিদ্যা'। বাংলা নাম বটে... এবং নামের মধ্যে কী যেন একটা আলাদা আলাদা ব্যাপারও আছে, ওই ব্যাপারটা খুঁজতে আমরা টিকিটের কথা ভাবি।

সিনেমাটা রিলিজ হওয়ার আগে, যেমন সব সিনেমারই আসে, তেমনভাবেই সিনেমার ট্রেলার এসেছিল বাজারে। বাজার মানে ইউটিউবে। (ইউটিউব এখন বাজার বটে)। ট্রেলার দেখে কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছিল না সিনেমার। আর এই ট্রেলার দেখেই সবাইকে সিনেমার গল্প লেখার একটা প্রতিযোগীতাও আহ্বান করেছিলেন ফারুকী। অনেকে তাতে অংশগ্রহণও করেছিলো। কোনো এক টিভি চ্যানেলে ফারুকী বলছিলেন যে যারা গল্প পাঠিয়েছে তাদের কিছু গল্প খুবই সুন্দর... খুবই নতুনত্ব আছে গল্পে।

এসব দেখে-শুনে মনে হচ্ছিল, হুদাই এইসব। বিজ্ঞাপনের নতুন স্টাইল আরকি...! তো পরে আবার ভাবলাম বিজ্ঞাপনের নতুন স্টাইল তো খারাপ জিনিস না! নতুন নতুন স্টাইলের বিজ্ঞাপন তো ক্রিয়েটিভিটি।

বলাকা সিনেমা হলে আগে থেকে বলে, টিকিটের ব্যবস্থা করে, আমরা কজন গেলাম। হলের বাইরে বিরাট একটা ব্যানার। ব্যানারে নানা রকম চিত্র ও কথা লেখা থাকলেও মূলত ফারুকীকে হাইলাইট করা হয়েছে। এর পেছনে মূল কারণ 'পিঁপড়াবিদ্যা'য় কোনো স্টার সুপারস্টার তো নাই। না থাকায়, যেমনটা হওয়া সিনেমার জন্য জরুরি, ডিরেক্টরই হেড সব কিছুর, তেমনটাই হয়েছে। এই হওয়া খুব দরকার বলে মনে হয়। এই হওয়া ছড়িয়ে যাওয়া উচিত আরো বেশি। এই পিঁপড়াবিদ্যায় ফলে ডিরেক্টরই স্টার। এইটা ফারুকীর একটা ব্যাপার যে ফারুকী তার তৈরী নাটকেও এবং আগের সিনেমাগুলোতেও প্রধান স্টার। কখনো কখনো একলা স্টার। এটা একটা সিনেমার জন্য এবং সিনেমার সামগ্রিক প্রবাহের জন্য খুব ইতিবাচক মনে হয়।

হলের ভেতরে লোক ছিল বেশ। আর সিনেমা শুরু হতেই তালি আর চাপা হাসি ছিল। যেসব হিউমারে চাপা হাসি চলছিল সেসব শুধু তাৎক্ষণিক হাসি ছিলো না। কিছু হাসি ছিলো ফারুকীর কাজে পরিচিত মানুষের হাসি। তারা জানে ফারুকী এমনে এমনে দেখাবে... ফলে তাদের ভেতর প্রস্তুতি থাকে... আর সেই প্রস্তুতির পর তাদের আশাকে পর্দায় দেখতে পেয়ে হাসে... তারা মনে মনে বা কানে কানে বলে, কইছিলাম না... কইছিলাম না... দেখো... দোখো এখন কী করে...

তারা জানে ফারুকী এমন করে। তারা পূর্ব অভিজ্ঞতা ও বর্তমান হিউমারে হাসে। তারা হাসতে চাইছে বলেও অবশ্য হাসছে এবং তালি বাজাচ্ছে, এরকম মনে হয় আমাদের।

সিনেমায় মিঠু নামের যে ছেলেটা অভিনয় করছিল না তাকে বেশ লাগছিল। তার একটা ইন্টারভিউ পড়ছিলাম সিনেমার আগে... সে বলছিল সে নাকি অভিনয় টভিনয় করতে আসে নি... সে ডিরেক্টর হতে চায়... এরপরে সে ডিরেক্টরের কাজই করবে... তো মিঠুকে দেখে মনে হলো সে অভিনয় করছেও না আসলে... আসলে মিঠু যেমন তার জীবনে তেমনই যেন আছে পর্দায়। এটা ফারুকীর আরেকটা গুণ (কখনো দোষও)... তিনি তার ক্যারেক্টারদের দিয়ে অভিনয় করাযন না। বিশেষত অ্যামেচাররা তার হাতে ভালো খেলে।

এই মিঠু যার চাকরি নাই বাকরি নাই আয় নাই... তার একটা ছোট বোন আর অচল বাবা ও মুখরা মায়ের পরিবার... যে পরিবার অর্থকষ্টে আছে বলে বোনের প্রাইভেট কাল থেকে বন্ধ হয়ে যাবেই বলে মনে হচ্ছে এরকম এক মিঠু সিগারেটের সেলসম্যান থেকে এমএলএম ব্যবসায় ধাবিত হয়। এই মিঠু যখন তার স্বপ্নের কথা বলে যে কোনো বিদেশীনিকে বিয়ে করে বিদেশ চলে যাওয়া তখন হল ফাটিয়ে তালি পড়ে... বুঝতে পারি এসব তরুণের চোখেও তো বিদেশ ও বিদেশীনি লেগে আছে! ফারুকী দক্ষ ডাক্তারের মতো তাদের পালস ধরে থাকেন। মনে হয় বাংলাদেশের এই দরিদ্র কিন্তু স্বপ্নে বিভোর পালসটা ফারুকী খুব সিধেভাবে আছড়ালেন আমাদের সামনে। হল তালিতে ভরে থাকে, হাসিতেও। মিঠুর সংলাপ বলায় আরো হুল্লোড় ওঠে। এই মিঠু একটা চুরির সেকেন্ডহ্যান্ড ফোন কেনে। আর আমরা এখান থেকেই মূলত গল্পে প্রবেশ করি। এই ফোনটি শিনার। শিনা এই গল্পের নায়িকা বটে। এবং সে ওই সিনেমার চরিত্রেও নায়িকা। মডেল, অভিনয়শিল্পী। জনপ্রিয়। মিঠু শিনার চুরি যাওয়া ফোনটাই কেনে। আর শিনা তার ফোনটা খুঁজছে পাগলের মতো, কারণ ফোনে আছে একটা বিশেষ ভিডিও চিত্র। এই চিত্র শিনার বয়ফ্রেন্ড করেছিল। কোথাও না বললেও না দেখালেও বোঝা যায় ভিডিও চিত্রটিতে শিনা ও তার বয়ফ্রেন্ডের বিছানার দৃশ্য আছে। ফলে আমরা উৎকণ্ঠিত হই এবং একটু দমআটকা সচেতনতা নিয়ে অপেক্ষা করি কী ঘটতে যাচ্ছে।

শিনার অনুরোধে ফোনটা ফেরত দেয় মিঠু। শিনা বুঝতে পারে না মিঠু ভিডিওটা দেখেছে কিনা... শিনার ভেতর চাপ তৈরি হয়। আমাদের ভেতরেও। মিঠু অবশ্র নানাভাবে ফেভার চায় শিনার।শিনা তা করেও যায়। আর এক সময় শিনাকে মিঠু জানায় সেই ভিডিওটা সে অন্য কোথাও কপি করে রেখেছে। মিঠু সেই ভিডিওটা নষ্ট করে দেয়ার বদলে শিনার সাথে স্বামী-স্ত্রীর অভিনয় করতে চায়। একটা পর্যায়ে শিনা মিঠুকে ফ্ল্যাট থেকে বের করে দেয়।

আরো গল্প আছে কিছুটা। মানে গল্পের পরিণতি আছে। সেটুকু বলার দরকার দেখি না। পরিণতি দেখাতে গিয়ে ফারুকী বিভিন্ন সিম্বল ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তবু, বিরতির (বিরতিটা পরিকল্পিত নয় বলেই মনে হয়েছে) আগে পর্যন্ত গল্প যেমন সেলাইহীনভাবে যাচ্ছিল... তেমনটা আর পাই না পরে গিয়ে। পরের অংশে শিনার লম্বা অনুপস্থিতি আর বেশ কয়েকবার মিঠুর পয়েন্ট অব ভিউ থেকে বেরিয়ে মিঠুর পুরনো প্রেমিকার স্বামীর পয়েন্ট অব ভিউটা ব্যক্তিগতভাবে আমাকে পীড়া দিয়েছে। আর চূড়ান্ত পরিণতিটা কি খুব বেশি ক্লিশে?
জানি না। কিন্তু কেনে যেন মনে হলো আরো অন্য কিছু কি হতে পারতো? আরো অন্য কিছু কি হতো পারতো?

আবার ভাবলাম এই যে আরো অন্য কিছু কি হতে পারতো বলে দর্শককে এক ধরনের ভাবনার মধ্যে ফেলে দেওয়া এটাও কি ফারুকীর সাফল্য নয়? হয়তো।

১ ঘণ্টা ৩০ মিনিটের কি সিনেমাটা? কিন্তু ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিটের কি হতে পারতো? কিন্তু ফারুকী তা করেন নি কেন? 'টেলিফিল্ম হয়ে গেছে' এরকম শোনার ভয়ে?

ফারুকী কি এখন আর এসব ভয় পান? বিশ্বাস করি না।

পিঁপড়াবিদ্যায় ফারুকী আছেন, প্রবলভাবেই আছেন। যেমন তিনি তাঁর নাটকগুলোতে ছিলেন। সিনেমায় এসে তিনি মাঝেমাঝে আপোস করেছেন বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু পিঁপড়াবিদ্যাটা দেখে মনে হলো ফারুকী ফিরে এসেছেন।

গল্পের নায়িকা শিনা নায়িকা হওয়ায় ফারুকী ইচ্ছা করলেই আরো গ্ল্যামার-গান ইত্যাদি দেখাতে পারতেন, খুব সুযোগ ছিল সিনেমায়, ইচ্ছা করলেই ফর্মুলার মধ্যে থাকতে পারতেন, কিন্তু ফারুকী তা থাকেন নি। তিনি নিজের গল্পটা নিজের স্টাইলেই বলতে চেয়েছেন... তিনি নিজের একটা ভাষা দাঁড় করাতে চাচ্ছেন... এই জন্যই ফারুকীকে দশে দশ দেয়া যায়। তবু কঞ্জুশ শিক্ষকের মতো আরো তিনটা নাম্বার কেটে রাখতে চাই। কাটতে চাই শেষের ওই পনের মিনিটের জন্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন