বৃহস্পতিবার, ৮ জানুয়ারী, ২০১৫

হে রাম! হে রাম!!




দেশ তখন স্বাধীন হয়েছে। দেশ মানে ভারতবর্ষ। ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়ে ভারত আর পাকিস্তানে ভাগ হয়েছে। একটা ভূখণ্ড নাকি হিন্দুর একটা নাকি মুসলমানের। এপাড়ের হিন্দু ওপাড়ে যায়, ওপাড়ের মুসলমান এপাড়ে আসে। এপাড় ওপাড় জুড়ে দাঙ্গা। মারামারি। লড়াই। খুনাখুনি। এই খুনাখুনি যে হবে তা জানতেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। তাই তিনি এই দ্বিজাতিতত্বের বিভক্তি চান নি। এমনকি তিনি সন্দিহান ছিলেন স্বাধীনতাতেও। তিনি ভয় পেয়েছিলেন এই ভারতবর্ষের অর্ধশিক্ষিত রাজনীতিবিদরা সত্যিকারের দেশ শাসন করতে পারবে কিনা! তিনি তাই প্রাথমিক অবস্থায় স্বরাজ চেয়েছিলেন। কিন্তু ভারতবর্ষ দু'ভূখণ্ডে বিভক্ত হয়ে স্বাধীন হয়। নেহরুর হিন্দুর হিন্দুস্থান আর জিন্নাহর মুসলমানের পাকিস্তান। দাঙ্গা চলতে থাকে। মানবতা রাম আর রহিমের মধ্যে এক সর্বভূক আগুন হয়ে জ্বলতে থাকে। ইংরেজরা ততক্ষণে রাণী এলিজাবেদের কোলে বসে লবেনচুষ চুষছে আর মজা দেখছে। কলকাতা যেন পুড়ে ছাই। গঙ্গা হিন্দু মুসলমান তথা মানুষের লাশে স্রোতহীন। যেন স্রোত তত দিনে রক্ত হয়ে গেছে। রক্ত গাঢ় হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। বন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে ফসলের খেত। পাখি যেন আকাশে ওড়ে না। বাতাস ধর্মান্ধ হৃদয়ের গন্ধে মৌ মৌ করছে। কলকাতা পাগল হয়ে গেছে। গান্ধী তখন তাঁর আশ্রম ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন। ওদিকে লাহোর তথা পাকিস্তানও জ্বলছে। গান্ধী কলকাতা ঘুরে এসেছেন, বলেছেন অহিংসার কথা, কলকাতা স্থিমিত; এবার গান্ধী লাহোর যাবেন। বেরিয়েছেন তিনি। আশ্রম পেরিয়ে মাঠ। নেতারা গাড়িতে গান্ধীর জন্য অপেক্ষা করছেন, তাদের শেষ ভরসা ইংরেজদের এই ন্যাকেড লিডার। একখণ্ড শাদা ধুতি আর একটা লাঠির ভরে ফটোগ্রাফারের সাথে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছেন। মাঠের প্রান্তে পূজার থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভক্তরা। গান্ধী তাদের দেখে দাঁড়ান। হাতজোর করে নমস্কার করেন। এক ভক্ত এগিয়ে যায় গান্ধীর দিকে। পা ছুঁয়ে আশির্বাদ নেয়। গান্ধী হাত উঁচু করে আশির্বাদ দেন। কিছু যেন বলতে যান। কিন্তু ততক্ষণে ভক্তটা পিছিয়ে আসে দু'কদম। নিজের কোমর থেকে বের করে পিস্তল। লহমায় তাক করে গান্ধীর দিকে। ঠাশ ঠাশ করে দুটো গুলি করে গান্ধীর বুক বরাবর। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ে সবাই। এমনকি গান্ধী নিজেও। গান্ধীর হাত থেকে তাঁর চিরসাথী লাঠিটা খসে যায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় ট্রেন থেকে ধাক্কা খাওয়ার অনুভূতি হয় যেন গান্ধীর। তাঁর চোখের সামনে তাঁরই ভক্ত। হাতে পিস্তল। গান্ধী বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করেন। যেন কেউ ছ্যাঁকা দিয়েছে উষ্ণ লৌহ খণ্ডের। ধাক্কা খেলেন গান্ধী। কিন্তু শুধুই কি তা বুলেটের বিপরীত গতির ধাক্কা? আর কিছু নয়? ধাক্কাটা কি অবিশ্বাস আর হতবিহ্বলতারও ছিল না? যে অহিংসায় কেটে গেছে তাঁর সারাটি যাপিত জীবন সে অহিংসার বদলে একি হিংসার চরম রূপ? পিস্তল? বুলেট? ঘৃণা? এত ঘৃণাও কেউ জমিয়ে রেখেছিল তবে কেউ! তার জন্যে এত রিরংসা?
লহমায় গান্ধীর মনে পড়ে যায় তাঁর সহধর্মিনী আর সন্তানের মুখ। আর তাঁর ছাগলগুলোর কথা আর সুতোর কাজ শেষ না হওয়া সেই শান্ত চক্রাগুলোকে। আর ভারতবর্ষের সেই দরিদ্র অসহায় নিপীড়িত মানুষের মুখগুলো, যেগুলো আজো চেয়ে আছে লাঠিতে ভর দেয়া এক পৌঢ়ের দিকে। ভালোবাসার শ্রদ্ধার বাপুজির দিকে। সব ছাপিয়ে গান্ধীর মুখ থেকে এক চরম আর্তি বেরিয়ে আসে-- হে রাম!
হে রাম!!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন