শুক্রবার, ৫ জুন, ২০১৫

আমার আঙুলগুলোর মধ্যে একটি নষ্ট হয়ে গেছে




আমার হাত। হাতে ছড়ানো শাপলার মতো পাঁচটি আঙুল। সুষম বণ্টন তাদের। একটির চেয়ে আরেকটি সুন্দর। একটির চেয়ে আরেকটির দৈর্ঘ যতটুকু দীর্ঘ বা খর্ব হওয়া উচিত ঠিক ততটুকুই। আমি আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আমার আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রোমাঞ্চিত হই। আমার মনে হয় কবজির মতো জায়গাটা আসলে বৃন্ত আর আঙুলগুলো ফুলের পাঁপড়ি। আমি হাঁটতে হাঁটতে আমার ঝুলন্ত হাতের দিকে তাকিয়ে ফুলের ঘ্রাণ পাই।

ফুলের পাঁপড়িগুলো, আসলে আঙুলগুলো আমি চিনতে শিখেছিলাম শৈশবেই। প্রথমে যে নামটা শিখেছিলাম তা হলো বুড়ো আঙুল। আঙুলের সাথে বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকেই সখ্যতা থাকে। বুড়ো আঙুলের সাথে সে সখ্যতাটা একটু বেশি। এটা চুষে চুষে একটা লম্বা সময় বাচ্চাদের যায়। তো এই আঙুলের নাম যখন জানতে পারলাম বুড়া তখনই তাকে বেশ আপন মনে হতে লাগল। কারণ আমাকে মাঝে মধ্যে বুড়া বলে ডাকা হতো। আমি একটা আত্মীয়তা পেলাম আঙুলটার সাথে।

কনিষ্ঠাকে চিনলাম কিন্নি আঙুল বলে। তাও খুব অদ্ভুতভাবে। পাড়ায় খেলার সময়। আমরা লুকাচুন্নি খেলছিলাম। একটা গোল করে তার মধ্যে চোর বসিয়ে আমরা সবাই লুকিয়ে পড়ছিলাম। আর বারবার চোর হচ্ছিল প্রিমা। আমাদের বয়স তখন চার পাঁচ হয়তো। প্রিমা কোনোভাবেই আমাদের খুঁজে না পেয়ে হঠাৎ কেঁদে ফেলল। আমি বেরিয়ে এলাম আড়াল থেকে। গোলে গিয়ে দাঁড়ানোর বদলে প্রিমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। প্রিমা আমাকে দেখেই মাটি থেকে একমুঠ ধুলা উঠিয়ে ছুঁড়ে দিলো আমার মুখে। মেয়েদের নিষ্ঠুরতার সাথে সেই প্রথম আমার পরিচয়। আমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর প্রিমা দৌড়ে পালিয়ে গেল বাড়ির দিকে্ আমি কাঁদবো কিনা অনেকক্ষণ বুঝতে পারলাম না। রবি এসে বলল, তুই আর প্রিমার সাথে কথা বলিস না! আড়ি নিয়া নিস!
আমি তাকালাম রবির দিকে। আড়ি কীভাবে নিতে হয় আমি জানি না। রবি তার কিন্নি আঙুলটা বের করে দেখালো। কিন্নি আঙুলের সাথে কিন্নি আঙুলের ঠোকাঠুকি হলেই আড়ি হয়ে যায়। আমি রবির কিন্নি আঙুলের দিকে আমার কিন্নি আঙুলটা বাড়াতেই রবি আঁৎকে উঠল। সর্বনাশ! দুজনের কিন্নি আঙুল ছুঁয়ে গেলেই তো আড়ি। তখন আমরা অন্তত তিন দিন কথা বলতে পারবো না। রবির সাথে কথা না বলে থাকা মুস্কিল। প্রত্যেক দুপুরে ওকে নিয়েই তো আমি আম চুরি করতে যাই। অতএব, নো আড়ি।

কিন্তু পরদিন প্রিমা এলেই রবি আমার কিন্নি আঙুলটা ধরে বাড়িয়ে দিল প্রিমার দিকে। আমি আড়ি চাই। প্রিমাও চায় কিনা বোঝা গেল না। কিন্তু প্রিমার যে প্রিয় বন্ধু সে প্রিমার কিন্নি আঙুলটা বাড়িয়ে দিল। আমাদের দুজনের আঙুল স্পর্শ করল আড়ির উদ্দেশ্যে। আড়ি আড়ি আড়ি। কিন্তু মজা হলো আমার আর প্রিমার আড়িটা শুধু থাকল রবিদের সামনে। আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম। লুকিয়ে লুকিয়ে আমসত্ত বিনিময়ও করতে থাকলাম। আমাদের ঠিকঠাক বয়স হলে আমরা হয়তো ওই আড়ির জন্য প্রেমেই পড়ে যেতাম। তাই আড়ি কিন্তু ভালো। ভালো আমার প্রিয় কিন্নি আঙুল, মানে কনিষ্ঠাও।

আমাদের বাড়িতে মুজিবের একটা ছবি ছিল। তখন এরশাদের সময় বলে মুজিবের ছবিটা খুব একটা যত্নে ছিল না। ফ্রেমে বেশ ধুলোবালি জমেছিল আবার ছবিটাও কিছুটা বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। ছবিটায় মুজিব একটা আঙুল তুলে বুক চিতিয়ে কী যেন বলছিল। বোধহয় ইয়াহিয়াদের শাসাচ্ছিল। ছবির নিচে লেখা ছিল 'তোমার তর্জনীতে বাংলাদেশ'।
ততদিনে বাংলা বেশ পড়তে পারি। কিন্তু তর্জনীতে বাংলাদেশ ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না কিন্তু মুজিবের ওই তর্জনী দেখে, তর্জনীর মহিমা বুঝতে পারি। তর্জনী এক শক্তিশালী আঙুল। তর্জনী এক প্রত্যয় ও অবজ্ঞা। হ্যাঁ অবজ্ঞাও মনে হতো তখন। তখন কোনো বন্ধু আমার দিকে তর্জনী তুললে আমার খুব রাগ হতো। সেলু একবার আমার দিকে তর্জনী তুলেছিল দেখে আমি ওর তর্জনী ভেঙে দিতে চেয়েছিলাম। ওর ওই আঙুলটা ধরে ঘুরিয়ে দিয়েছিলাম। সেলু কঠিন চিৎকার না করলে ওইদিন সে তার তর্জনী হারিয়ে ফেলতো। আমার মনে হয় মানুষ তর্জনী হারিয়ে ফেললে মর্যাদা হারিয়ে ফেলে। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। শক্তি হারিয়ে ফেলে।
কিন্তু সব তর্জনীতে শক্তি থাকে না। একটু বড় হয়ে যখন নানা উপপাতি নেতাদের সমাবেশে গিয়েছি দেখেছি তারা কী নির্মমভাবে মুজিবের তর্জনী হেলনী নকল করার চেষ্টা করছে। চেষ্টা করছে এবং ব্যর্থ হচ্ছে। সব তর্জনী হয়ে ওঠে না। তবে তাতে তর্জনীর মহিমা বিন্দুমাত্র কমে না। ছড়িয়ে রাখা আঙুলগুলোর দিকে তাকালেই মনে হয় একটা অনড় প্রত্যয় তর্জনী হয়ে এক ঔদ্ধত্ব হয়ে ফুটে আছে।

আরেকটু বড় হলে, কৈশোরের শেষের দিকেই, হঠাৎ অনামিকা কাল তৈরি হয় যেন। অনামিকা নামটাই কী অদ্ভুত না? তর্জনীর পর, মধ্যমা, আর তারপরেই অনামিকা। আঙুলটির নাম নেই। আর এই নাম না থাকা প্রকাশ করে যে নামটি সে নামটি কী সুন্দর। অনামিকা। অনামিকা। আর এই আঙুলটি যেন তোমার হৃদয়ের কথা বলে। তোমার হৃদয়কে প্রকাশ করে। সবাইকে দেখায় দেখো এই ছেলেটির একটি হৃদয় আছে। আর সে হৃদয়ের মধ্যে কোনো এক নারী রয়েছে। আর রয়েছে বলেই সে এই আঙুলটিতে একটি বন্ধনের চিহ্ন দিয়ে রেখেছে।
আমার অনামিকা প্রথম বেঁধেছিল যে নারী তার স্পর্শ মনে পড়ে। একটা ঘাস ছিঁড়ে সে সেটি খুব অদ্ভুত উপায়ে আমার অনামিকায় পরিয়ে দিয়েছিল। তখন খটখটে দুপুর ছিল। কিন্তু আমার মনে পড়ে অনামিকায় ঘাসের বাঁধন পড়তেই দুপুরটা লহমায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। রোদজ্বলা আকাশটা হিম শীতল হয়ে গিয়েছিল। পরে জেনেছিলাম, হৃদয়ের উত্তাপ এমন বিভ্রম ঘটায়। আর অনামিকা হৃদয়ের কথা বলে। হৃদয়ের আয়না হয়ে দাঁড়ায়। অনামিকা হৃদয় আর জগতকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে মুচকি মুচকি হাসে। অনামিকাকে তাই ভালোবেসে ফেলি। অনামিকার দিকে তাই অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি। অনামিকা নাকের কাছে ধরলে হৃদয়ের ঘ্রাণ পাই। ঘ্রাণে যেন কাঁঠালিচাঁপার স্বাদ থাকে। আমি ঘুমিয়ে পড়ি, আমার অনামিকা জেগে থাকে।

বাকী থাকে মধ্যমা। মধ্যমাকে আমার মনে হয়েছিল একটা নৌকার মাস্তুল। মনে হয়েছিল মধ্যমা আমার এই সমস্ত অসমতাকে এক স্থির বিন্যাস দেয়। আমাকে দীপ্ত রাখে। আমার আঙুলকে সচল রাখে। কিন্তু এই দুর্দান্ত ধী একটি আঙুলের দিকে আমি আর তাকাতে পারি না। আমার মনে হয় আমার এ আঙুলটি নষ্ট হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আমার এই মধ্যমায় ধরেছে কোনো নীরব পচন। যা থেকে খুলে খুলে আসছে মাংস। যে আঙুল থেকে আমি ঘ্যাণ পেতাম এতকাল সেখানে এখন নর্দমার দুর্গন্ধ পাই। আঙুলটি আর ধীয়ের থাকে না। স্রেফ এক কুৎসিত চিহ্ন হয়ে থেকে যায়। অথচ আমার আঙুলটি পশ্চিম ঘুরতে যায় নি। অথচ আমার এই সুন্দর আঙুলটি উড়তে চায় নি। অথচ আমার এই সুন্দর মধ্যমা কোনোদিনই স্খলিত হতে চায় নি। আমি কখনই চাই নি আমার কোনো আঙুল fuck নির্দেশ করবে। আমি জানি আমার আঙুলগুলো এরচেয়ে অনেক সৌন্দর্যমন্ডিত। আমার আঙুলে দ্রোহ-প্রেম-বিশ্বাস-হৃদয়-ছোটবেলা সব আছে, কেবল fuck নেই। অথচ এরপরেও আমি আমার মধ্যমা কোথাও দেখাতে পারি না। আঙুলের বিন্যাসে যেন মধ্যমা ধীরে ধীরে গুটিয়ে যাচ্ছে। অথচ মধ্যমা আর তর্জনীর ফাঁকে সিগারেট না গুঁজলে আমার ধূমপান হয়ে ওঠে না। মধ্যমা চিবুকে না ছোঁয়ালে আমার চিন্তা গাঢ় হয় না। আমি মধ্যমার বিস্তার চাই। আমি চাই আমার এই ফুলের পাপড়ির মতো মধ্যমা কোনো দুঃস্থ চিহ্ন না হয়ে শিল্প হয়ে উঠুক। আমি আমার আঙুলকে নষ্ট করে ফেলতে চাই না।



ছবি: গুগল

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন