বুধবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৬

সামাজিক (যোগাযোগের) বিয়ে


আঁকা: সাদমান মুনতাসির
বলা নেই কওয়া নেই দুম করে হিমেল চীনে চলে গেল।
আমরা যারা তার বন্ধু, তারা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। বন্ধু-বন্ধুতে গলায় গলায় ভাব থাকলেও ভেতরে ভেতরে আমাদের জোর প্রতিযোগিতা। চীন সফর করে হিমেল কি সেই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে গেল? কী কারণে গেল সে? ব্যবসা নাকি স্কলারশিপ? কিছুই জানার উপায় নেই, চীনে ফেসবুক চলে না। হিমেলের কোনো স্ট্যাটাস নেই, কোনো আপডেট নেই। না জানি কোন সোনার হরিণ পেয়ে গেল সে! ঈর্ষায় আমরা এমন জ্বলতে লাগলাম যে এমনকি ফেসবুকিংও অসহ্য মনে হতে লাগল।
হিমেল দেশে ফিরে এল পাক্কা ১০ দিন পর। এসেই ফোনে তার বাসায় দাওয়াত দিয়ে বসল। কী উপলক্ষ, কী বিষয়, কিছুই জানতে পারলাম না। হিমেলকে জিজ্ঞেস করলে বলল, ‘সারপ্রাইজ সারপ্রাইজ!’
কী আর সারপ্রাইজ হবে! দেশের বাইরে গিয়েছিল, আমাদের জন্য বড়জোর চকলেট নিয়ে ফিরেছে। গতবার বাপ্পি গেল নেপাল, আমাদের জন্য নিয়ে ফিরল চুইংগাম। সেই চুইংগাম ঢাকা শহরের মোড়ে মোড়ে পাওয়া যায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফ্রি চকলেটের লোভেই যথাসময়ে হিমেলের বাসায় হাজির হলাম। হয়েই হার্ট অ্যাটাকের জোগাড়! ড্রয়িংরুমে একটা চীনা পুতুল। পুতুলের চোখ পিটপিট করে, পুতুল ঘোরে, হাঁটে। হঠাৎ শুনি পুতুল কথাও বলে। ‘ইয়াংচু চিয়াংচু’ ধরনের ভাষা। হিমেল বলল, ‘বন্ধু, পরিচিত হ, তোদের ভাবি...চিয়ানা!’
আমরা ধাক্কা খেলাম। ভাবি? হিমেল শেষ পর্যন্ত কিনা একটা পুতুলকে বিয়ে করল? বাপ্পি মুখ ফসকে বলেই বসল, ‘চায়না থেইকা পুতুল বিয়া করলা, বন্ধু?’
হিমেল হেসে উঠল। চীনা পুতুলটা ঘাড় নাড়িয়ে বলল, ‘আপনেরা কিয়ামন আছেন সকলে?’
আমাদের হার্টের রিদম আরেকবার মিস করল। এ তো পুতুল নয়...জ্যান্ত মানুষ! মানে হিমেল চীনে গিয়ে চীনা বউ নিয়ে এসেছে? কী অদ্ভুত! কী সর্বনাশ! এখন আমাদের কী হবে? চীনের জিনিস বলতে আমরা এত দিন চীনাবাদাম আর চীনামাটির বাসন-কোসন দেখেছি। আরও দেখেছি মোবাইল ফোন আর রেডিও। কিন্তু এটা তো আস্ত পুতুলের মতো মেয়ে! যাকে হিমেল বিয়ে করে ফেলেছে। হিমেলের এত সৌভাগ্য! অসম্ভব! আমাদের মাথা ঝনঝনিয়ে উঠল। আমরা ফটাফট প্রশ্ন করে গেলাম আর হিমেল তার চেয়েও ফটাফট উত্তর দিয়ে চলল। মাঝখানে বসা চীনা কন্যা টেনিস খেলা দেখার মতো একবার আমাদের মুখের ওপর, একবার হিমেলের মুখের তার দৃষ্টি আছড়াতে লাগল।
আমরা বললাম, ‘শেষ পর্যন্ত চীনে বিয়ে?’
: প্রেম তো কোনো বর্ডার মানে না, বন্ধু!
: তাই বলে আমাদের জানাবি না?
: কিছু জানানোর আগেই বিয়েটা করতে হলো। চিয়ানার বাবা খুব হার্ড! ঢাকাই ফিল্মের নায়িকাদের বাবার মতোই!
: কী করে পরিচয়?
: সামাজিক পরিচয় বন্ধু...সামাজিক যোগাযোগের বিয়ে!
: সামাজিক যোগাযোগ মানে? চীনে তো ফেসবুক চালুই নেই!
: তোরা কি মনে করিস ভিপিএন শুধু আমরাই ব্যবহার করতে জানি? আর হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার কি সামাজিক যোগাযোগ না?
: এখন কী করবি?
: সংসার করব। প্রেম করেছি, বিয়ে করেছি, এবার তো সংসারের পালা!
: চায়না কিছুই টেকে না, না মোবাইল ফোন, না ইলেকট্রনিকস জিনিস! বিয়েটা টিকবে তো?
: টিকবে। চায়নার মানুষেরা তাদের মোবাইল ফোনের মতো না, তারা তাদের বিখ্যাত প্রাচীরটার মতো, না টিকে উপায় নেই!
আমরা অত্যন্ত আহত হলাম। বন্ধুর সব সহ্য করা যায়, শুধু সুন্দরী বউ সহ্য করা যায় না, সে বউ যদি বিদেশি হয়, তা হলে তো কোনো কথাই নেই। আমরা চি-চা-চি করে এক অদ্ভুত ভাষায় হিমেলের চায়না বউয়ের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। পুরো রাস্তায় আমরা নিজেদের মধ্যে কোনো কথা বললাম না। বন্ধুর বিদেশি ও সুন্দরী বউ দেখে আমরা বাক্হত। অনেকক্ষণ পর বাপ্পি আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘চীনা দূতাবাসটা কোথায়, তুই জানিস?’
: হুম, জানি।
: যাবি?
: তুইও যাবি?
: হুম।
পরদিনই চীনা দূতাবাসে ভিসার জন্য আবেদন করলাম আমরা। আর চোখ-কান খোলা রাখতে শুরু করলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে। বিয়ে যদি একটা করতেই হয়, তা হলে তা সামাজিক যোগাযোগেরই বিয়ে হোক!

রস+আলোয় প্রকাশিত-
http://m.prothom-alo.com/roshalo/article/743026/%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%AF%E0%A7%8B%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%AF%E0%A7%8B%E0%A6%97%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন