সোমবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৬

কাছে আসার সাহসী গল্প

..: মিস মালবিকা! মিস...
: শুনতে পাচ্ছি। বলেন, কী বলবেন!
: কেমন আছেন, মিস...?
: কেমন আছি মানে? আপনি হেলে আমার ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছেন, এখন আর কেমন থাকব?
: আপনিও কিন্তু হেলেছেন! ভূমিকম্পে আমরা দুজন দুজনের দিকে হেলে একেবারে কাছে চলে এসেছি! কী সৌভাগ্য আমাদের...!
: িকসের সৌভাগ্য? মানুষগুলো এমন খারাপ করে আমাদের বানিয়েছে...! যেনতেনভাবে লেক ভরাট করেছে, বাজে পাইলিংয়ের সঙ্গে আবার বাজে রড-সিমেন্টও ব্যবহার করেছে! আমার তো ভয় হচ্ছে, যেকোনো সময় একেবারে হুড়মুড়িয়ে না পড়ে যাই!
: ভয় পাবেন না...আমি তো আছিই!
: আপনি আছেন বলেই আরও বেশি ভয় পাচ্ছি! আপনার ওজনে না একেবারে চাপা পড়ে যাই!
: তবে যা-ই বলেন, আমার কিন্তু খারাপ লাগছে না!
: তা লাগবে কেন? যেদিন আপনাকে তৈরি করল, রং করে জেল্লা বাড়াল, বাইরে একটা ঝাড়বাতি লাগিয়ে দিল, সেদিন থেকেই তো আপনি কেমন-কেমন চোখে আমার দিকে তাকান! আসলে আমার বাইরের রংটা পিংক করাই ভুল হয়েছে!
: কী যে বলেন! পিংকে আপনাকে দারুণ দারুণ মানায়...কবি বলেছেন, ‘প্রহর শেষের আলোয় দেখা সেদিন চৈত্র মাস...তোমার পিংকে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ!’ আমার ঠিক ওই সর্বনাশা দশাই হয়েছিল! তিন দিন তিন রাত আপনার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারিনি।
: পরে চোখ তো ঠিকই ফেরালেন...ওই যে পাশের ফ্ল্যাটটা যখন অরেঞ্জ কালার করল! আসলে আপনারা সব পুরুষ বিল্ডিংই একই রকম! খালি ছোক ছোক করেন!
: না না, আমি কিন্তু সবার মতো নই! জানেন, আপনার পাশাপাশি থাকতে থাকতে কত দিন ভেবেছি, আপনাকে একটু ছুঁয়ে দেখি...
: ওই তো শুধু ছোঁয়াছুঁয়িরই ইচ্ছা!
: কিন্তু আমার তো হাত নাই। তাই...
: তাই গেটের বাগানবিলাসটাকে ঠেলে দিলেন আমার দিকে। একটু বাতাস হলেই ও কখনো আমার ঝাউগাছ ছুঁয়ে দিয়ে যায় আবার কখনো আমার কার্নিশটা ছোঁয়!
: কবি বলেছেন, ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে একটুকু কথা শুনি...তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ব্যালকনি!’
: রাখেন আপনার ব্যালকনি! দিনের বেলা যেমন তেমন রাতের বেলায় সব কটা লাইট জ্বালিয়ে আপনি আমার দিকে টুকটুক করে তাকিয়ে থাকেন! অসহ্য! আর সেবার! সেবার তো বিয়ের মরিচবাতি আমার ছাদেও উঠিয়ে নানা রকম রং-তামাশা করলেন! ছি ছি ছি! লোকে কী ভেবেছিল!
: লোকে ভেবেছিল এই দুই বিল্ডিংয়ের মধ্যে কত মধুর সম্পর্ক! একেবারে মেড ফর ইচ আদার!
: শোনেন, আমার সঙ্গে আপনি এ রকম সিনেমা মার্কা কথা বলবেন না দয়া করে!
: তাহলে কী বলব?
: ভালোমতো কথা বলবেন। আপনি জানেন, আমার আত্মীয়স্বজন সব গুলশান-বনানীতে থাকে? বনানীর সবচেয়ে সুন্দর যে বিল্ডিং, তিনি আমার খালু। ওই ফ্ল্যাটে পুলিশ সুপার থাকেন, আপনি জানেন? বেশি তেড়িবেড়ি করলে আপনার বাড়ির পানির লাইন, ডিশের লাইন, গ্যাসের লাইনসহ আরও যেসব লাইন-বেলাইন আছে, সব বন্ধ করে দিতে পারি আমি...কী হলো হাসছেন কেন?
: হাসছি, কারণ, দেখছি আপনি এখনো আমাদের পরিস্থিতি বুঝতে পারেননি। আমরা এখন হেলে পড়া বিল্ডিং। আমাদের ভেতর থেকে লোকজন সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই আমরা পরিত্যক্ত হয়ে যাব। তখন আমার কথা শোনার জন্য শুধু আপনিই থাকবেন, আর আপনার কথাও আমাকেই শুনতে হবে!
: এতে এত খুশি হওয়ার কিছু নাই। আমি কোনো দিনই আপনাকে পাত্তা দেব না!
: শোনেন, কবি বলেছেন, ‘বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু।’ তাই আমাকে আপনি বন্ধু ভাবতেই পারেন!
: এখন বন্ধু ভাবতে বলছেন, আরেকটু পরে বলবেন তুমি করে বলতে...
: কী করে বুঝলেন?
: বুঝব না? আপনাদের মতো বিল্ডিংদের সব সূত্র আমার মুখস্থ। ‘তুমি’ বলতে বলতে আপনারা ঝট করে বলে বসবেন আই লাভ ইউ!
: আই লাভ ইউ!
: কী?
: হ্যাঁ। আই লাভ ইউ! কবি বলেছেন, ‘ভালোবাসি ভালোবাসি...এই সুরে কাছে দূরে...’
: রাখেন আপনার কবি বলেছেন বলেছেন! সবই তো নিজের মতো বানিয়ে বলছেন!
: শুধু ভালোবাসাটা বানানো নয়! আমি তোমাকে...আরে আরে দুনিয়া তো দেখি আবার কেঁপে উঠছে!
: হায় হায়, আবার ভূমিকম্প!
: আর বোধ হয় বাঁচলাম না! মানুষেরা আমাদের বানানোর পর কত সুন্দর সুন্দর নাম দেয়, রংচং করে, সুন্দর সুন্দর লাইট দিয়ে সাজায়...কিন্তু বানানোর আগেই যদি আমাদের নিয়ে ভাবত! বানানোর সময় যদি একটু গুরুত্ব দিত...তাহলে আর এই দিন দেখতে হতো না!
: শোনেন, আমরা তো বোধ হয় ধসেই যাচ্ছি, তার আগে আপনাকেও আমার কিছু বলার আছে...
: কী?
: আমিও আপনাকে, মানে তোমাকে ভালোবাসি...
: কী! সত্যি বলছ?
: হ্যাঁ, কিন্তু এবার কিছু একটা করো! এত কাঁপন তো সহ্য করতে পারছি না! আরে আরে, আমরা কি আবার সোজা হয়ে যাচ্ছি?
: এক ভূমিকম্পে হেলে পড়েছিলাম, আরেক ভূমিকম্পে আবার দাঁড়িয়ে যাচ্ছি? মানে কী? তাহলে আমাদের প্রেম, আমাদের রিলেশনের কী হবে? আমি তো ভেবেছিলাম আমাদের বিয়ে হবে...আমাদের বাচ্চা হবে ছোট ছোট ডুপ্লেক্স! তারা আমাদের মা-বাবা বলবে! কত স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি! মানি না মানি না, এ ভূমিকম্প মানি না...মালবিকা!
: চুপ করো, গাধার মতো চেঁচিয়ো না। জানো না, কবি বলেছেন, ‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানিয়া লয় না, দূরেও ঠেলিয়া দেয়...!’
: হায়! কবিরা কেন যে এত কথা বলে! কেন! কেন!! কেন!!!


প্রকাশ- রস+আলো
লিংক: http://www.prothom-alo.com/roshalo/article/839674/%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%86%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%B8%E0%A7%80-%E0%A6%97%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন