ছয়.
রোল...
ক্যামেরা...
এ্যাকশন...
এই
এ্যাকশন শুনলেই লখিন্দরদের
রক্তে আগুন লাগে। শুধু রক্তে
না যেন শরীরের সব জায়গাতেই
লাগে। বিশেষত মাথায়। তবে এই
আগুন শীতল। জ্বলন্ত জাগতিক
আগুনের চেয়েও কি শীতল আগুন
ভয়ঙ্কর?
জাগতিক
আগুন একটা নির্দিষ্ট সময়
জ্বালাতে পারে,
তার
দহনের ক্ষমতা সসীম,
কিন্তু
এই যে শীতল আগুন যা বইতে থাকে
রক্তের ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে...
প্রবাহিত
হতে থাকে গলে যাওয়া উত্তপ্ত
সীসার মতো তা যেন অদ্ভুত তৎপরতায়
এক নিদারুণ ঘোরের ভেতর ধাক্কা
মারে। আর মেরেই গচ্ছিত রাখে
যাপনের সব কিছু। এটা তখনও শেষ
হয় না যখন ডিরেক্টর 'কাট'
বলে।
অন্তত লখিন্দরের শরীর থেকে
যায় না। মাথা থেকে যায় না,
হৃদয়
থেকেও যায় না। অনেকক্ষণ ধরে,
চরিত্র
থেকে বেরোয় না লখিন্দর। বা
বলা ভালো চরিত্র তাকে ছাড়ে
না। যেন লখিন্দর,
নতজানু
থাকে,
চরিত্রটির
নিকট।
আজ
একটা গানের দৃশ্য শ্যুট হবে।
সেট পড়েছে তিন নাম্বার ফ্লোরে।
সিনেমার নাম 'তোমার
বাড়ি আমার বাড়ি'।
সামাজিক সিনেমা। তবে এই সামাজিক
সিনেমাতেও একটা ক্যাবারে আছে
বটে। ক্যাবারে যুগ প্রায় শেষ
হতে চলেছে। তারপরেও শেষ হইয়াও
শেষ হইতেছে না যেন...
নাচবে
এক নতুন মেয়ে। নাম মাধবী। তবে
এই নাম তো ফিল্মে চলবে না। তাই
নাম বদলানো হবে। বদলে নাম কী
হবে সেটা এখনো ঠিক হয় না। তাকে
সবাই এক্সট্রা বলে ডাকছে।
যদিও এক্সট্রা বলতে যা বুঝায়
মাধবী তা না।
লখিন্দর
বসে আছে আয়না আর তীব্র লাইটের
সামনে। তার মেকআপ প্রায় শেষ।
মেকআপম্যান রঞ্জু শেষ তুলিটা
চালাচ্ছে তার চিবুক আর গাল
ধরে। যেহেতু ক্যাবারে গান,
লাল-নীল
আলোর ঝলকানি আছে--
রঞ্জুকে
তা মাথায় রাখতে হচ্ছে। লখিন্দরকে
যেন ফ্যাকাশে না দেখায়। রঞ্জুর
কাজ লখিন্দরের পছন্দ হয়েছে।
লখিন্দর ভাবছে রঞ্জুকে
পার্মানেন্ট করে নেয়া যায়
কিনা!
রঞ্জু
একটা সময় আমান খানের বাঁধা
মেকআপম্যান ছিল। তারপর আমান
খান বেছে নেয় আরেকজনকে। রঞ্জুর
কাজ প্রায় বন্ধ হওয়ার যোগাড়
হয়েছিল--
লখিন্দরের
সাথে রঞ্জুর কোনো পরিচয় ছিল
না--
কিন্তু
এই ফিল্মের ডিরেক্টর এসে তাকে
বলেছিল--
ফিনিশিং
খুবই ভালো ব্যাটার...
খালি
কপাল মন্দ...
বোম্বেতে
এই ব্যাটা থাকলে লাল হইয়া
যাইতো...
আপনে
খালি দেখেন ওর হাতের কাজ...
লখিন্দর
সিগারেট টানতে টানতে আয়নায়
কখনো নিজেকে কখনো রঞ্জুকে
দেখছে। ফিনিশিং সত্যি আছে!
দুয়েকদিন
দেখার পর কোনো একটা সিদ্ধান্ত
নেবে লখিন্দর। ঢাকাই ফিল্মে
ব্যক্তিগত মেকআপম্যান কারো
নেই,
কিন্তু
আমান খানের আছে। ফলে লখিন্দরেরও
থাকতে পারে। এক চিলতে হাসি
ফুটে ওঠে লখিন্দরের মুখে।
নকল গোঁফের নিচে সে হাসিটা
বারান্দায় মেলে দেয়া স্যান্ডোগেঞ্জির
মতো ঝুলে থাকে। নিজেকে লখিন্দর
বলে,
তাহলে
প্রতিযোগীতায় নেমে গেলে?
আমান
খানের সঙ্গে?
নাকি
প্রতিযোগীতাটা আগে থেকেই
তৈরি হয়েই ছিল?
সেদিন
শুধু বাবুভাই তাতে আগুনটা
জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন।
আগুন।
তা তো জ্বলছেই এক নীরব। নিরন্তর।
লখিন্দরের ভেতর। কতদিন থেকে?
সে
আগুন প্রথম শীতল হয়েছিল সেই
পারদরোদজ্বলা টিনের বাড়ির
সেই তরুণীর শ্রান্ত ঠোঁটে।
লখিন্দর যেন মনে করতে গিয়ে
গুলিয়ে ফেলে। সেই তরুণীর
স্থানে চলে আসে রঞ্জনার ঠোঁট।
ভরাট আর রঙচর্চিত ঠোঁট। কমলার
শিরাউপশিরার মতো সেই ঠোঁটে
ব্যাকুলতার চিহ্ন। যেন ঠোঁটটা
কিছু একটা বলতে চাচ্ছে। এমন
ঠোঁট কি ছিলো কুবেরের শ্যালিকার।
না,
তা
তো হতে পারে না। তবু,
এই
ঠোঁটটা মনে এলেই ওই সংলাপটা
মনে আসে লখিন্দরের।
-
আমারে
নিবা মাঝি?
আমারে
নিবা মাঝি অনেকক্ষণ ধরে গুঞ্জরিত
হতে থাকে লখিন্দরের ভেতরে।
সেই ঠোঁটজোড়া ফাঁক হয়ে যায়
অনেকটা। ভেতরের গোলাপি জিভটা
ইঁদুরের মাথার মতো নড়ে। তুমি
কি সাপ লখিন্দর?
তুমি
কি শিকারী?
লখিন্দরের
ভেতর একটা প্রবাহ উদ্দাম হয়ে
ওঠে। উত্তেজনা অনুভব করে
লখিন্দর। আর তা প্রতিহত সে
করতে চায় অন্য কিছু ভেবে। ফলে
লখিন্দর অযথায় রঞ্জুকে প্রশ্ন
করে,
বাড়িতে
কে আছে তোমার?
রঞ্জু
কী যেন উত্তর দেয় আগ্রহের
সাথে। লখিন্দর শোনে না। সে
তার শরীরের ভেতর যে কাঁপন
অনুভব করে তাতে নিজেকে ভাসিয়ে
দিতে চায় যেন। রঞ্জনা। তখন
হাসে নি। তখন যখন বাবুভাই
বলেছিল আমি তোমাকে নিয়ে ছবি
করতে চাই। তখন যখন লখিন্দরকে
এগিয়ে রেখেছিলেন বাবুভাই।
আমান খানকে ছেড়ে এক হাতে রঞ্জনা
আরেক হাতে লখিন্দরকে জড়িয়ে
যেন বোঝাচ্ছিলেন তার নতুন
ভাবনার কথা। তখন যখন পিছিয়ে
পড়ে যাচ্ছিল আমান খান। বাবুভাইয়ের
ছায়া থেকে,
লখিন্দরের
নতুন দৌড় থেকে...
কিন্তু
এগিয়ে ছিলো কি রঞ্জনার ভালোবাসায়?
বাবুভাইয়ের
কথা শুনে,
লখিন্দরকে
নিয়ে সিনেমা করার কথা শুনে,
রঞ্জনার
ওই সুন্দর ঠোঁটদুটো অল্প একটু
ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল--
তাতে
শঙ্কা ছিলো--
দেখেছিলো
লখিন্দর। দেখে,
তখন,
প্রথমবারের
মতো,
রঞ্জনাকে
পাবার বাসনা জেগে উঠেছিলো
লখিন্দরের।
কেন
এই পাবার ইচ্ছা লখিন্দরের?
ভালোবাসা
কি?
ভালোবাসা
কি তবে ধাবিত করছে লখিন্দরকে?
কিন্তু
আমরা তো বুঝেছি লখিন্দরের এক
অমোচনীয় বেদনার মতো প্রেম
আছে ,
বা
বলা ভালোবাসা আছে,
অথবা
নেই কিন্তু লখিন্দর ভাবে আছে--
এমন
একটা দ্বন্দ্ব আছে--
আছে
নদীরপাড় আর স্রোত,
আছে
শ্যামল বিকাল আর ক্ষুধাতৃষ্ণার
মধ্যে প্রবাহিত সরল সেবা।
তাহলে?
তাহলে
কি আবার একটা ভালোবাসা এখন
বাসনা হয়ে জেগে উঠছে লখিন্দরের
বুকের ভেতর?
লখিন্দরের
সন্দেহ হয়। সন্দেহ হয় আমাদেরও।
আমরা ভাবি এই বাসনা বোধহয়
ভালোবাসার থেকেও তীব্র কোনো
কিছুর। কিন্তু এমন ভেবেই আমরা
থমকে যাই--
ভালোবাসার
থেকে তীব্র আর কী হতে পারে?
কোথাও
তো আমরা এমন কথা শুনি নি। আমরা
জেনেছি ভালোবাসাই চূড়ান্ত--
ভালোবাসাই
তীব্রতম--
ভালোবাসাই
শ্রেষ্ঠ প্লাবন। আর কোনো
প্লাবন আর কোনো তীব্রতা আর
কোনো চূড়ান্ত কিছু নেই। যুগ
যুগ ধরে সভ্যতা এমনই বলে এসেছে।
কিন্তু লখিন্দরের ভেতরে প্রবাহ
তাতে কোনো ভালোবাসা কি আছে
এখন?
নেই।
নেই একেবারে। তাহলে?
এই
বাসনা কিসের?
আমাদের
সন্দেহ হয় এই বাসনা আসলে
অধিকারের। কে বলেছে ভালোবাসাই
চূড়ান্ত কথা?
যারা
বলেছে তারা তাহলে ভুল বলে
এসেছেন। মিথ্যা ধোকায় রেখেছেন
সভ্যতার পর সভ্যতা। কারণ
সভ্যতা গড়ে ওঠে নি কোনো
ভালোবাসায়--
সভ্যতা
গড়ে উঠেছে এবং ভেঙেছে কেবলই
অধিকার করবার বাসনায়। এই
অধিকারের ইচ্ছার পদতলে নতজানু
হয়ে থাকে ভালোবাসা। ফলে লখিন্দর
যখন রঞ্জনার ঠোঁটে শঙ্কা দেখতে
পায় তার ভেতরেও এক ক্রুর জেগে
ওঠে। রঞ্জনার ঠোঁট এবং পুরো
রঞ্জনার ওপর কেমন একটা অধিকার
চায় লখিন্দর।
আমরা
ধারণা করতে পারি রঞ্জনা যদি
সতন্ত্র কেউ হতো,
রঞ্জনা
যদি না হতো আমান খানের বাস্তবিক
নায়িকা,
লখিন্দরের
হয়তো রঞ্জনার প্রতি কোনো
বাসনায় অনুভূত হতো না। বাসনা,
অধিকারের
বাসনা এমন আশ্চর্য এক বোধ যে
তাতে প্রতিপক্ষ না থাকলে জমে
না। আর আমান খানের মতো প্রতিপক্ষ
কোথায় পাবে লখিন্দর?
রঞ্জনার
শঙ্কাভরা মুখ দেখে তাই একটা
নীরব প্লাবন ঘটছিলো লখিন্দরের
ভেতর। আগুন কি?
যে
আগুনটা তার লাগে লাইট-ক্যামেরা-এ্যাকশন
শুনলে?
তেমনই
কি?
মাথা
কি তার দুলে উঠেছিলো--
যেভাবে
প্রথম দুলেছিলো ডোম ময়নার
সাথে চুয়ানি খেয়ে...
আর
সেই দুলুনির পর তেমন দুলুনি
অভিজ্ঞাত হওয়ার জন্য পরের
জীবনে একের পর এক পাত্র খালি
করে চলেছিলো সে--
অথচ
প্রথম দুলুনির মতো কিছুই ছিলো
না আর--
আর
সেই সময় রঞ্জনাকে দেখে লখিন্দর
অনুভব করেছিলো সেই আশ্চর্য
দুলুনি...
একই
রকম...
আর
তখন রঞ্জনাকে সম্পূর্ণভাবে
দেখে নিয়েছিলো লখিন্দর।
বাবুভাইয়ের আরেক বাহুতেই তো
ছিলো সে। ঘামে চকচকে গলার কাছে
হীরামোড়া লকেটটা দুলছিলো আর
লখিন্দর,
আমাদের
সমস্ত পূর্বধারণাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি
দেখিয়ে,
দুলে
দুলে উঠছিলো। দুলে দুলে উঠছিলো
আর বিড়বিড় করে বলছিলো,
বাবুভাই,
আপনার
ছবিতে তো একা কাজ করতে পারবো
না আমি...
বাবুভাই
জীবনে কি কখনো না শুনেছেন?
শুনেছেন
নিশ্চয়,
কিন্তু
যারা তাকে না বলেছিলো তারা
কি আর কোনো কিছু বলার অবস্থায়
আছে?
তারা
কি হারিয়ে যায় নি?
চলে
যায় নি মাছের পেটে বা সমুদ্রের
গভীর তলদেশে...
অথবা
ডানা পায় নি কি তারা?
উড়ে
যায় নি একটা পাহাড় থেকে আরেকটা
পাহাড়...
একটা
মেঘ থেকে আরেকটা মেঘে?
লখিন্দরের
কথা শুনে এমনকি আমান খানও বিষম
খায়। হুইস্কি হড়কে চলে যায়
এক শিরা থেকে অচেনা অন্য শিরায়।
আমান খান কি ভেবেছিলো এবার
লখিন্দরের কি হবে?
কল্পনা
করেছিলো আমান খান?
কল্পনাশক্তিতে
আমান খান খুব একটা ঋদ্ধ তো
ছিলো না,
তবু
তার মনে হয়েছিলো লখিন্দরকে
হয়তো পাওয়া যাবে কোনো খাদের
কিনারে। মাতাল ও মৃত অবস্থায়।
এমন ভেবে আমান খান আবার বিষম
খায়। তার ভালো লাগে খুব। সুখ
সুখ লাগে। বিষমচলা অবস্থাতেও
আমান খান তাই হেসে ওঠে। নিজেকে
তার ডানাঅলা মনে হতে থাকে।
তবে
আশ্চর্য হয় রঞ্জনা। আশ্চর্য
হয় লখিন্দরের সাহস দেখে।
কিন্তু সহসাই রঞ্জনা ভাবে
লখিন্দর আসলে সাহসী তো নয়--
লখিন্দর
অপরিণামদর্শী। লখিন্দর আসলে
বোকা। লখিন্দর আসলে জানে না
বাবুভাই কে...
আর
হয়তো জানার সুযোগও পাবে না।
তখন রঞ্জনার একটু মায়া হয়।
এবং মায়া যে হচ্ছে তা ভেবে
আবার আশ্চর্য হয় রঞ্জনা। এই
প্রায় ভিলেনের মতো লোকটার
জন্য তার বা আমান খানের ভেতর
মায়া হওয়ার তো কোনো জায়গা নেই।
গত প্রায় এক দশক ধরে তৈরি করা
তাদের সাম্রাজ্যে প্রথম অনুচর
হয়ে ঢুকেছে লখিন্দর। তাদের
সংসারে যেমন ঢুকেছিল সৎবাবা...
চিন্তায়
ছেদ ঘটে রঞ্জনার। দেখে ধীরে
ধীরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিচ্ছেন
বাবুভাই। লখিন্দর থেকে এমনকি
রঞ্জনা থেকেও। দম আটকে আসে
রঞ্জনার। এবার এমন কিছু একটা
ঘটতে যাবে যা কখনো কারো কল্পনাতেই
আসতে পারে না। লখিন্দরের দিকে
তাকিয়ে আবারও করুণা তৈরি হয়
রঞ্জনার। হয়তো শেষবারের মতো
দেখছে তাকে। আর এই শেষবারের
কথা ভেবে একটু যেন সুখও হয়
রঞ্জনার। কিন্তু সেই সুখ
বেশিক্ষণ স্থায়ি হয় না।
আশ্চর্যজনকভাবে বাবুভাই
লখিন্দরের কাঁধে হাত রাখেন।
বলেন,
একা
কি ফিলিম হয় মিয়া?
তুমি
একা কাম করবা ক্যান?
কও
কারে লাগবো তোমার?
কী
লাগবো তোমার?
তোমার
লগে আমি পরপর পাঁচটা ফিলিম
নামামু...
কও
কোন হিরোইন তোমার লাগে?
আর
দেখো লখিন্দরের কী সাহস!
সে
বাবুভাইয়ের হাতটা ধরে নামিয়ে
নেয়। তারপর যেন বন্ধু হ্যান্ডশেক
করছে এমনভাবে ঝাঁকায় হাতটা
আর বলে,
আমার
ফিল্মে আপনি থাকবেন ব্যস...
আর
কাউকে লাগবে না বাবুভাই...
আপনি
থাকবেন ছায়া হয়ে...
খুব
যেন মজার কথা বলেছে এমনভাবে
খুশি হয়ে ওঠেন বাবুভাই। বলেন,
আরে
আমার ফিলিমে আমি থাকবো না...
এইটা
কী বললা...
লখিন্দর
বলে,
শুধু
ফিলমে না বাবুভাই...
আপনি
আমার জীবনেও বড়ভাই হয়ে থাকবেন...
বাবুভাইয়ের
হাসিমুখটা কি একটু থমকে যায়?
অনেক
আলোর ঝলকে আমরা ভালো দেখতে
পাই না। কিন্তু লখিন্দরকে
ছাড়িয়ে বাবুভাই তার প্যান্টের
পকেটে হাত ঢোকান। বের করে আনেন
সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার।
বাবুভাই প্যাকেটটা খোলেন,
নিজে
একটা সিগারেট বের করেন আর
প্যাকেটটা এগিয়ে দেন লখিন্দরের
দিকে। লখিন্দর প্যাকেট থেকে
সিগারেট বের করে। বাবুভাই
নিজের সিগারেটে আগুন জ্বালিয়ে
প্রথম ধোঁয়াটা ছাড়েন। লখিন্দর
অপেক্ষা করতে থাকে হয় আগুন
না হয় লাইটার এগিয়ে দেবেন
বাবুভাই--
কিন্তু
বাবুভাই তার কোনোটাই করেন
না। লখিন্দর একটু দ্বিধায়
পড়ে যায়। লখিন্দর কি লাইটার
চাইবে বাবুভাইয়ের কাছে?
কিন্তু
প্রথম ধোঁয়া ছাড়ার পরই বাবুভাই
কথা বলে ওঠেন। ধোঁয়া ও কথা
একসাথে বেরোতে থাকে বাইরে।
তাতে লখিন্দরের কোনো অসুবিধা
হয় না শুনতে বা বুঝতে--
শুধু
সিগারেট জ্বালানো এবং না-জ্বালানোর
অস্বস্তিটা চলতে থাকে--
বাবুভাই
বলেন,
তুমি
যা চাইলা...
সেই
চাওয়ার উত্তর এত জলদি দেওয়া
দুস্কর...!
তবে
যদি দিই তাহলে তুমি জানবা...
তারপর
বাবুভাই লখিন্দরের দিকে লাইটার
এগিয়ে দেন। 'খটাশ'
করে
জ্বালেন। লালচে আলোয় ভরে
ওঠে লখিন্দরের মুখ। আর লখিন্দরের
ওই মুখটা দেখে রঞ্জনা আর আমান
খান দুজনেরই বুকটা যেন পুড়তে
থাকে। এমন বাবুভাই কখনো দেখে
নি তারা...
কিন্তু
তাদের মনে হয় এমন লখিন্দরও
তো কখনো দেখে নি তারা...
সিনেমা
যেন তাদের কাছে নতুন নতুন
বিস্ময় নিয়ে হাজির হচ্ছে...
এবং
এই বিস্ময়গুলো তাদের একেবারেই
অসহ্য মনে হয়।
লখিন্দর
সিগারেটটা জ্বালিয়ে সাবধানে
ধোঁয়াটা ছাড়ে,
যেন
বাবুভাইয়ের মুখের ওপর সেগুলো
আছড়ে না পড়ে। বাবুভাই বলেন,
তোমার
আর কি লাগবো কও...?
লখিন্দর
বলে,
বাবুভাই,
একটা
ভালো স্ক্রিপ্ট রাইটার লাগবে...
আমি
আপনারে দিয়া ঢাকাই ফিল্ম
পাল্টায়ে দেবো...
বাবুভাই
বলেন,
ডান।
এইবার কও আর কী লাগবো...
লখিন্দর
বলে,
আর
একটা ভালো হিরোইন...
এই
কথা বলতে গিয়ে লখিন্দরের বুক
কাঁপছিলো,
বাসনা
কি জাগছিলো...
শুনলে
আশ্চর্য লাগে যে এই কথা বলার
সময় লখিন্দরের মাথায় রঞ্জনা
ছিলো না--
কিন্তু
ছিলো চোখে...
ফলে
লখিন্দর চোখের সামনের রঞ্জনাকে
দেখলো কেমন মলিন হয়ে যেতে...
আর
তখনই রঞ্জনাকে একটা টান মারেন
বাবুভাই। বলেন,
আমার
কাছে তো সেরা নাইকাই আছে...
কী
কও তুমি...?
লখিন্দর
রঞ্জনার কম্পমান চোখের ভেতরে
কিছু দেখতে চেয়েছিলো কি?
কিন্তু
বাবুভাইয়ের প্রশ্নে সে সুযোগটা
আর পায় না লখিন্দর। বলে,
হ্যাঁ
বাবুভাই...
উনি
সেরা নায়িকাই...
প্রশংসাটুকু
শুনতে রঞ্জনার ভালো লাগে না।
আর সেই ভালো না লাগাটা সে পরে
জাহির করে আমান খানের সাথে।
বিছানায়। যখন রাত ভোরের দিকে
যাচ্ছে। কিন্তু রঞ্জনার মনে
হচ্ছিলো আর কোনো ভোর তার দেখা
হবে না...
আমান
খান তখন কী বলেছিলো সেটা শুনতে
আমাদের একটু অপেক্ষা করতে
হয়। কারণ মেকআপরুমে বসে থেকে
নকল গোঁফ নিয়ে রক্তের ভেতর
উত্তেজনাকে প্রবাহিত হতে
দেয়া লখিন্দর শোনে অ্যাসিটেন্ট
ডিরেক্টরের হাঁক...
ওস্তাদ
শট রেডি...!
লখিন্দর
নড়ে ওঠে। তার ভেতরের উত্তেজনা
এক অন্যদিকে বাঁক নেয়। এবার
সে তৈরি হয় রোল...
ক্যামেরা...
এ্যাকশন...
শোনার
জন্য। আর তার সমস্ত ধমনীজুড়ে
খেলা করতে থাকে অপেক্ষা।
কিন্তু এই অপেক্ষার মধ্যে
লখিন্দর কি জানতে পারবে আমান
খান রঞ্জনাকে কী এমন বলেছিল
সেই না-ভোর
হওয়া রাতে...
যা
শুনে বাবুভাই আর লখিন্দরেরর
সব ক'টা
সিনেমার নায়িকা হতে রাজি হয়ে
গিয়েছিলো রঞ্জনা?
আমরা
জানি এসব চিন্তা লখিন্দর
কোনোদিনই তেমন একটা করে নি।
কিন্তু এখন আমাদের মনে হয়,
ইশ,
লখিন্দর
যদি এসব চিন্তাও একটু করতো...!
তাহলে
আজ তার ফ্ল্যাটের ওপরে পানির
ট্যাঙ্কের ভেতর বস্তাবন্দী
রঞ্জনাকে দেখতে হতো না...
নাকি
হতো?
যা
ঘটার তাই কি ঘটতো?
লখিন্দর-রঞ্জনা-আমান
খান আর বাবুভাই কি আসলে এক
চূড়ান্ত নিয়তিতে বাঁধা ছিলো?
যা
ঘটেছে তার অন্যথা হওয়ার উপায়
কি আসলে ছিলো?
আমরা
ভাবি,
কিন্তু
আমরা ঠিক ঠাওর করতে পারি না।
(চলবে...)
ছবি: আহমেদ খান হীরক
(চলবে...)
ছবি: আহমেদ খান হীরক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন