শুক্রবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৫

ফাহমিদের মোটা হওয়ার গোপন রহস্য (উইকি লিকস)


ফাহমিদ প্রথম প্রেমে পড়ে চার বছর বয়সে। পাঁচ ক্লাশ ওপরের টিনা আপার। টিনা আপার একটা গজাল দাঁত ছিল। ফাহমিদ ভেবেছিল কোনো এক রাতে, টিনা আপা ঘুমালে, চুপি চুপি টিনা আপার বিছানায় গিয়ে, ওই গজাল দাঁতটা চুরি করে নিয়ে আসবে। তারপর সেটা হরলিক্সের বয়ামে লুকিয়ে রেখে দেবে। সারাদিনে দুয়েকবার সে দাঁত চুপি চুপি দেখবে। কিন্তু ফাহমিদের ইচ্ছাপূরণ হয় নি-- তার আগেই একটা কালো ও মোটামতো লোক টিনা আপাকে বিয়ে করে ময়মনসিং থেকে বগুড়া নিয়ে চলে গেল। ফাহমিদ শূন্য বয়ামে কিছুদিন অশ্রু বিসর্জন করল। তারপর হরলিক্স খাওয়া একেবারের মতো ছেড়ে দিলো।

ক্লাশ নাইনে আবার প্রেমে পড়ল ফাহমিদ। এবারও এক বড় আপার। তবে তিন বছরের বড়। আপার নাম শাম্মী। অসাধারণ রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। বন্যাটন্যা নস্যি। টেনের ফেয়ারওয়েলের দিন কলেজ থেকে শাম্মী আপা যেদিন গান গাইতে এল ফাহমিদদের স্কুলে, ফাহমিদ সেদিন পুরো স্কুলমাঠ একা একা অযথা দৌড়ালো। দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপাতে হাঁপাতে যখন ফাহমিদের হৃদয় কিছুটা শান্ত হয়ে এল তখন স্কুলগেটে মুখোমুখি হয়ে গেল শাম্মী আপার। শাম্মী আপা ঘর্মাক্ত ফাহমিদকে দেখে খুবই আশ্চর্য হলো। বলল, আরে কী পাগল, তুমি একা একা দৌড়াচ্ছো কেন?

ফাহমিদ সাথে সাথে ফিট। কেউ ভাবলো মৃগী, কেউ ভাবলো রোদ, কেউ ভাবলো দৌড়-- শুধু শাম্মী আপা ফাহমিদের চোখে আলাদা কী জানি দেখল। পরের দিন নিজের গাছের দুটো বেল নিয়ে শাম্মী আপা ফাহমিদের বাসায় গেল। ফাহমিদকে দেখতে। ফাহমিদ তখন পেপের ছবি এঁকে দিচ্ছিলো ছোট ভাইকে। শাম্মী আপা যতক্ষণ থাকলো ফাহমিদ ততক্ষণ ছোট ভাইয়ের ড্রইং খাতায় পেনসিল ঘোরাতে থাকলো। একটা কথাও বলল না। শাম্মী আপা বলল, আচ্ছা পাগলা ছেলে তো! শাম্মী আপা চলে গেল। ছোট ভাই ফাহমিদের কাছ থেকে তার ড্রইং খাতাটা কেড়ে নিলো। কারণ ফাহমিদ পেপের বদলে এতক্ষণ দুইটা বেল এঁকেছে। ফাহমিদের ইচ্ছা ছিল এই বেল দুটো সে শাম্মী আপাকে দেখাবে। শাম্মী আপার একটা পোর্ট্রেট করবে। কিন্তু তার আগেই শাম্মী আপার বিয়ে হয়ে গেল টাক আর ফরসা আর মোটামতো এক লোকের সাথে। শাম্মী আপা নিজের ঘর-বাড়ি-ময়মনসিং আর ফাহমিদকে ছেড়ে ওই লোকটার সাথে বেহায়ার মতো নারায়ণগঞ্জ চলে গেল। ফাহমিদ ছোটভাইয়ের ড্রইং খাতাটা ছিঁড়ে ফেলল এবং বেল খাওয়া বন্ধ করে দিলো।

ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার পরার সময় ফাহমিদ তৃতীয়বারের মতো প্রেমে পড়ল। এবারের মেয়েটি তারচেয়ে বয়সে ছোট। ঠিক এক বছরের ছোট। একই কলেজে পড়ে। নাম তুলি। তুলতুলে চেহারা। চোখের মণি সব সময়ের জন্য ছলছল করে। মনে হয় একটু জোরে কথা বললেই কেঁদে ফেলবে। যেন কেউ আগলে আগলে রাখবে বলেই মেয়েটার জন্ম। ফাহমিদ ঠিক করল সে-ই হবে তুলির ইজেল। সব সময় তাকে অবারিত আকাশ দিয়ে যাবে। ফলে ফাহমিদ কবিতায় এল। জীবনানন্দ আর নির্মলেন্দু গুণের দুই রেল লাইনের মাঝে স্লিপার হয়ে পড়ে রইল চারটা মাস। পঞ্চম মাসের প্রথম সকালে ফাহমিদের ভেতর থেকে একটা কবিতা বেরিয়ে এল। তরতাজা প্রেমভাঁজা এই কবিতা বুকের বাঁ পাশে, তুলির পদতলে রেখে ছুটলো তুলিরই উদ্দেশ্যে।

সারা কলেজ হন্যে হয়ে খুঁজেও যখন তুলিকে পাচ্ছে না ফাহমিদ, বুকের তাজা কবিতাটা যখন বাসি হতে শুরু করেছে, তখন প্রশাসন ভবনের পেছনে--টগবগে পুকুরের পাশে--কলমিনলের আড়ালে তুলিকে খুঁজে পেল ফাহমিদ। আর তুলির বাহুবন্ধনে পেল মোটু শহিদুলকে। যে শহিদুল ক্রিকেট খেলতে গেলে ইনজামামের মত কথায় কথায় রান আউট হয় সে শহিদুলই ফাহমিদকে ক্লিন বোল্ড করে দিলো। ফাহমিদের ইচ্ছা ছিল তুলিকে নিয়ে কাব্যনদে নাও ভাসাবে। কিন্তু সে-ই তুলিকেই কিনা পাওয়া গেল প্রবন্ধের মতো খড়খড়ে এক পুকুরপাড়ে!

ফাহমিদ তার নির্মলেন্দু গুণকে কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলল আর জীবনানন্দকে আগুনে পোড়ালো। তবু তার বুকের আগুন নিভলো না। সে ছাইভস্মের ভেতরে হিসাব করতে বসলো- তার জীবনের তিনটা যে প্রেম সেই তিনটা প্রেমই ছিনিয়ে নিয়েছে মোটা মোটা তিনটা লোক। এ ধরণী তব মেদচর্বিগণের! ফাহমিদ রোগাপটকা একটা ছেলে। জোরে কথা না বললে তার দিকে কেউ নজর পর্যন্ত দেয় না। কিন্তু এমন চলতে থাকলে সকল উর্বশী চলে যাবে ইন্দ্রপুরীতেই। ফাহমিদ তাই আবার বেল খাওয়া শুরু করল, শুরু করল হরলিক্স খাওয়া। শুধু তাই নয়, সে তার সমস্ত খাওয়াই বাড়িয়ে চলল। তিনবেলা হলো চারবেলা... চারবেলা হলো পাঁচবেলা... পাঁচবেলা হলো ছয়বেলা...! ফাহমিদ তার খাওয়া বাড়িয়েই চলল বাড়িয়েই চলল বাড়িয়েই চলল!

গত পাঁচ বছরের সাধনায় উত্তীর্ণ ফাহমিদ। তার ওজন এখন একশ সাঁইত্রিশ কেজি। ওয়েট মেশিনে উঠলে মেশিনটা কুঁইইই করে আওয়াজ করে। জবান থাকলে হয়তো বলতো এক এক কইরা আসেন ভাই... নাইলে তো মারা পড়বো! তারপর হয়তো বিপ বিপ তুলে কিছু গালিগালাজ করতো। আফসোস মেশিনের জবান থাকে না।

ফাহমিদ এখন ধীরে নড়াচড়া করে, তারচেয়েও ধীরে কথা বলে, এবং তারওচেয়ে ধীরে হাসে। সে তার সমস্ত শক্তি আর উত্তেজনা জমিয়ে রাখছে। ফাহমিদ জানে এখন সে  প্রস্তুত। এখন তার জীবনে কেউ প্রেম নিয়ে এলেই আর ফিরে যেতে পারবে না। সে তাকে ফিরে যেতে দেবে না। আষ্টেপৃষ্টে তাকে জড়িয়ে আটকে রাখবে।
ফাহমিদের ইচ্ছা তার প্রেমিকাটার তুলতুলে একটা মুখ আর একটা গজাল দাঁত থাকবে। আর তাকে দেখে ফিক করে হেসে বলবে, আরে, তুমি আচ্ছা পাগলা তো!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন